কৃষি

কৃষি (Agriculture)  ফসল ও অন্যান্য কৃষিজ সম্পদ উৎপাদনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। কৃষিক্ষেত্রে অন্য উপশাখাগুলি হচ্ছে গবাদি পশু, মৎস্য, ও বন। বাংলাদেশের কৃষি কার্যক্রম মূলত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষিই বাংলাদেশের জনজীবনের প্রধান অবলম্বন সে কারণে কৃষি সম্পর্কিত অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় নিম্নে উপস্থাপিত হলো।

ইতিহাস কৃষিভূমি কৃষি জীববৈচিত্র্য প্রধান ফসল উৎপাদন চাষপদ্ধতির ধরন কৃষিশ্রমিক কৃষিঋণ কৃষিসামগ্রী বিপণন কৃষিনীতি কৃষিশিা ও গবেষণা ফসলের জাত উদ্ভাবন ফসলের তিকর প্রাণী ও রোগবালাই কৃষিসম্পদ কৃষি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়াদি কৃষি যন্ত্রপাতি খামার উপকরণ ও সরঞ্জাম কৃষিতে ব্যবহƒত প্রযুক্তি কৃষিসংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ ও প্রশিণ

ইতিহাস  প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি বাঙালির জীবিকার উৎস। উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। কিন্তু প্রায় গোটা বাংলা পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা প্রসারিত পলিগঠিত সমভূমি হওয়ার দরুন প্রাচীনকাল থেকেই এখানে কৃষিকাজ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল এবং এখানে কৃষির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল অত্যধিক। ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে শিল্পকর্ম, বিশেষত সুতিবস্ত্র উৎপাদন  হ্রাসের ফলে এ চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। বস্ত্তত ১৯২১ সালের মধ্যে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় চার-পঞ্চমাংশ (৭৭.৩%) কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে, যা সমগ্র ভারতে ছিল ৬৯.৮%। ব্রিটিশ আমলে জনসাধারণ বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণিভুক্ত ছিল একদিকে বিভিন্ন পর্যায়ের খাজনা আদায়কারী ভূমিমালিক (জমিদার) ও নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী, অন্যদিকে রায়ত, বর্গাদার ও ক্ষেতমজুর। তবে রায়তরাই চাষাবাদে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। বাংলার দু অংশের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত ভূখন্ডেই কৃষির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল প্রকট।

প্রাচীন, মধ্যযুগ ও ব্রিটিশ আমলে কৃষি অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল উপখাত হিসেবে শস্য-উৎপাদনের অত্যধিক প্রাধান্য। কৃষির অন্য তিনটি উপখাত পশুসম্পদ, মৎস্য ও বন ছিল অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন। বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করা হতো এবং সরকারি প্রকাশনায় সংগ্রহের সময় অনুযায়ী এগুলি তিন শিরোনামে উল্লেখ করা হতো ভাদই (শারদ), খারিফ (হৈমন্তী) ও রবি (বাসন্তী)। এসব ফসলের মধ্যে ছিল ধান, পাট, গম, জোয়ার, যব, আখ, তামাক, তৈলবীজ, আলু, পিঁয়াজ, রসুন, আফিম, নীল, চা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ডাল, সুগন্ধি ও মসলা। ধান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনতম শস্যগুলির একটি। মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপিতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে ধানের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য কয়েকটি লেখায়ও এ শস্যের উল্লেখ রয়েছে কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ ও ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এবং ‘কাসাপালা’ ও ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ প্রভৃতি রচনায়।

সেন রাজত্বে বিশেষভাবে বিভিন্ন লিপিতে ধানক্ষেতের বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেনের অনুলিয়া তাম্রশাসনে হেমন্তে শালিধান কাটার উল্লেখ রয়েছে। একই লিপিতে আরও আছে যে, রাজা ব্রাহ্মণদের ধানীজমিসহ কয়েকটি গ্রাম দান করেন। ইদিলপুর তাম্রশাসনে ধানের আরেকটি উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে ধানকে সাধারণ অর্থে শালি বলা হয়েছে। আসলে, বাংলার বিভিন্ন সুপ্রাচীন জনপদ বঙ্গ, বরেন্দ্র, গৌড়, পুন্ড্রবধর্ন, রাঢ় ও সমতটে উৎপন্ন অনেকগুলি জাতের মধ্যে এটি সর্বোত্তম। প্রাচীন বাংলায় অন্যান্য বহু ফসল জন্মানোর উল্লেখও পাওয়া যায় যেমন তুলা, যব, সরিষা, আখ এবং কলাই ও মুগের মতো ডাল। তুলা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন বাংলায় তুলার চাষাবাদের কথা জানা যায়। এসব শস্য ছাড়াও বহু শাকসবজি ও ফলমূল উৎপন্ন হতো। খনার বচনে নিম্নোক্ত শাকসবজির উল্লেখ রয়েছে বেগুন, লাউ, মূলা, কচু, মরিচ, হলুদ, পটল। বিভিন্ন ধরনের ফলগাছ যেমন আম, কাঁঠাল, ডালিম, কলা, মহুয়া, খেজুর, লেবু, ডুমুর, তেঁতুল, নারিকেল প্রভৃতি প্রচুর জন্মাতো। পাল ও সেন রাজত্বকালের বহু লিপিতে আম ও কাঁঠালের উল্লেখ পাওয়া যায়।

খ্রিস্টীয় সাত শতকে বাংলা সফরকারী চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং পুন্ড্রবর্ধনে পর্যাপ্ত কাঁঠালের কথা লিখেছেন। লক্ষ্মণ সেনের গোবিন্দপুর তাম্রশাসনে ও কলকাতা সাহিত্য পরিষদের বিশ্বরূপ সেনের তাম্রলিপিতে এ ফলের উল্লেখ রয়েছে। পাহাড়পুরে পোড়ামাটির ফলকে প্রায়ই কলাগাছের ছবি দেখা যায়। চন্দ্র, বর্মণ ও সেন শাসনামলের শিলালিপি থেকে এটা স্পষ্ট যে, আট শতকের পর থেকে বাংলায় নারিকেলের ব্যাপক চাষ চলছিল। পান, সুপারি চাষও হতো। বারুই বা বারুজীবী নামে পরিচিত এক শ্রেণির লোকেরা পান চাষ করত। এসব ফসল ভারতের অন্যান্য অংশে রপ্তানি হতো। আরেকটি উপকরণ ছিল বাঁশ ঘরবাড়ি, ঝুড়ি ও রৌদ্রাবরক ছাদ তৈরীতে ব্যবহূত হতো। ‘রামচরিত’ গ্রন্থে বরেন্দ্রকে অশোক, কেশর, মহুয়া, কনক, কেতকী, মালতী, নাগকেশর ও পদ্মসহ অসংখ্য জাতের আকর্ষণীয় ফুলের স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভেষজ ফলবৃক্ষ, যেমন আমলকি, বহেড়া,  হরীতকী এ ত্রিফলা প্রাচীন বাংলায় রোপণ করা হতো।

চাষাবাদ, পরিবহণ ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত সামগ্রীর জন্য ব্যবহূত কৃষকদের মূল পশুসম্পদ ছিল গরু। গরুর সংখ্যা দিয়ে কখনও কখনও লোকের ধনদৌলতের পরিমাপ করা হতো। পাল ও সেন রাজাদের ভূদানের কতিপয় উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, চারণভূমিতে গবাদি পশুর জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘাস জন্মাতো এবং এগুলি সাধারণত গ্রামের কাছাকাছি অবস্থিত থাকত। গ্রামবাসীরা কখনও কখনও যৌথভাবে রাখাল নিয়োগ করত, যে প্রতিদিন ভোরে মালিকের গরুর পাল বাথানে বা চাষজমির বাইরে পতিত জমিতে নিয়ে যেত এবং গোধূলিতে ফিরিয়ে আনত। খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল  দুধ, দই, মাখন ও ঘি। গরুর হাড়  সার তৈরিতে আর গোবর সার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহূত হতো। ভাস্কর্য, শিলালিপি ও সাহিত্যে উল্লিখিত অন্যান্য পশুর মধ্যে রয়েছে মহিষ, ঘোড়া, ছাগল, মেষ, হরিণ, বানর, শূকর, শিয়াল, সিংহ, বাঘ ইত্যাদি। সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির বিভিন্ন ধরনের মাছ মিলত প্রচুর এবং সেটা ছিল খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বিভিন্ন ছাপচিত্র ও লেখা থেকে প্রাচীন বাংলার ভূমির উর্বরতার প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। হিউয়েন-সাঙ জমিতে নিবিড় ও নিয়মিত চাষাবাদ লক্ষ্য করেন। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থের কিছু কবিতায় এ বর্ণনার সমর্থন মেলে। অবশ্য, সকল জমি উর্বর ছিল না এবং সেগুলি পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানিও পেত না, তাই সেসব জমিতে কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন হতো। বিভিন্ন শাসক মহিপাল, রামসাগর, প্রাণসাগরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য জলাশয় সম্ভবত এজন্যই খনন করেছিলেন। ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের নাগাল পাওয়ার জন্য কূপখনন কৌশলও লোকে জানত এবং নালায় বা খালে পানি সরবরাহের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করত। খালগুলি পানিতে উপচে ধানক্ষেত ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য পানি নিয়ন্ত্রণের কৌশলটিও তারা ভালই আয়ত্ত করেছিল। উইলিয়ম উইলকক্স (William Wilcox) এ প্রাচীন পদ্ধতিকে বলেছেন ‘উপচে-পড়া সেচ’ (overflow irrigation)। এসময় ব্যবহূত নানা ধরনের কৃষি হাতিয়ারের নাম বিভিন্ন লিখিত উৎস থেকে জানা যায়। এগুলি হচ্ছে লাঙলের ফাল, দা, কাস্তে, পাশি, পাচনবাড়ি ও ঢেঁকি। গ্রাম্য কামার ও কাঠমিস্ত্রিরাই এসব হাতিয়ারের অধিকাংশ তৈরি করত। রামেশ্বর লিখিত ‘কাসাপালা’ গ্রন্থে এসব হাতিয়ার তৈরির বিভিন্ন প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। বাংলায় প্রাপ্ত গুপ্তযুগের অধিকাংশ তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে যে, রাষ্ট্র বা রাজা নিজেই ভূমি বিক্রয় করত আর এটা ধর্মীয় কাজে দান করা হলে ভূমি মঞ্জুরি থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় আয়ের এক-ষষ্ঠমাংশ রাজাকে দিতে হতো। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভূমিক্রয়ের আবেদন স্থানীয় কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজার নিকট পেশ করতে হতো এবং ধর্মীয় মঞ্জুরির ক্ষেত্রে রাজার অনুমতি বিশেষভাবে প্রয়োজন হতো, কারণ ভূমির সকল রাজকীয় পাওনা পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র রাজারই ছিল।

এভাবে প্রাচীনকালের যথাসম্ভব লব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় যে রাজা বা রাষ্ট্রই ছিল জমির মালিক। তৎকালীন ভূমির ব্যক্তি মালিকানার অস্তিত্বের কোনো কোনো প্রবক্তা এ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, অধিকাংশ শিলালিপিতেই উল্লিখিত জমি ছিল পতিত বা খিলা। কিন্তু ফরিদপুরে প্রাপ্ত তিনটি তাম্রশাসনে এবং অধিকাংশ পাল ও সেন শিলালিপিতে শুধু পতিত নয়, গোটা গ্রাম অনুদানেরও উল্লেখ রয়েছে। এসব গ্রামে নিশ্চিতই বসতবাড়ি এবং চাষাধীন জমিও থাকত। আবার লোকনাথের ত্রিপুরা অনুদানপত্রে বনভূমিতেও রাজার মালিকানার প্রমাণ রয়েছে। ভূমির রাজকীয় মালিকানার পক্ষে আরেকটি প্রমাণ হলো রাজা একটি মঞ্জুরি বাজেয়াপ্ত বা বাতিল করে অন্য কোনো ব্যক্তিকে সেটির মঞ্জুরি প্রদান করতে পারতেন। অবশ্য, রাষ্ট্র ভূমির মালিক হলেও গ্রামে বসবাসরত কৃষকদের দ্বারাই কৃষিব্যবস্থা পরিচালিত হতো এবং চাষাবাদ ছিল ব্যক্তিগত খামারভিত্তিক। কৃষিদ্রব্যে রাজার অংশভাগ ছিল রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু প্রাপ্ত উৎসগুলিতে বিভিন্ন নামের কর উল্লিখিত হলেও রাজস্ব ও অন্যান্য কর হিসেবে উৎপন্ন দ্রব্যের কতটা রাষ্ট্র আদায় করত তা জানা যায় না। ভূমি রাজস্বের অধিকাংশই দ্রব্যের হিসাবে নির্ধারিত হলেও কোনো কোনো ফসলের ক্ষেত্রে ভাগবাটোয়ারা কঠিন বিধায় সেটা নগদ অর্থে নির্ধারিত হতো। সম্ভবত হিরণ্য ছিল এ ধরনের একটি কর। কোনো কোনো স্থানে চাষে ব্যবহূত লাঙলের সংখ্যার হিসাবে কৃষকরা রাজকীয় পাওনা পরিশোধ করত।

বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা ও স্থানীয় লেখালেখি থেকে মধ্যযুগের কৃষির অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গতর তথ্যাদি পাওয়া যায়। বিদেশি পর্যটকগণ অবশ্য বাংলার মাটির উর্বরতা ও কৃষির অগ্রগতির উচ্চপ্রশংসা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে, ১৩৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দের এক চীনা পর্যটকের বর্ণনায় এ তথ্য পাওয়া যায় ‘স্বর্গের ঋতুগুলি পৃথিবীর ধনদৌলত সারা রাজ্যে ছড়িয়ে রেখেছে।’ প্রায় একই সময়ে  ইবনে বতুতা পূর্ব বাংলা সফর করেন। তাঁর বর্ণনায় তিনি নদীপথে ১৫ দিন ধরে সিলেট থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণকালে ডানে ও বামে ফলবাগান, উন্নত পানিসেচ ব্যবস্থা, সমৃদ্ধ গ্রাম ও বাগবাগিচা দেখতে পান, ‘যেন আমরা একটি বাজারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি।’ শায়েস্তা খাঁর সময়ে বার্নিয়ার (Bernier) বাংলায় এসেছিলেন। তিনি পদ্মার উভয় তীরে বিভিন্ন যান্ত্রিক পানিসেচসহ ফসলের অত্যন্ত উর্বর মাঠ লক্ষ্য করেন। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ‘ফসলের সামান্য ক্ষতি ছাড়াই একটি বিশেষ জাতের ধান একই বছরে তিনবার রোপণ ও কাটা হতো’। কিন্তু এটাকে ভূমির সাধারণ উর্বরতার একটি সূচক হিসেবে ধরা যায় না। এমনকি বিশ শতকের মাঝামাঝিও খুব কম জমিতেই বছরে তিনটি ফসল আবাদ করা গেছে।

কৃষির সমৃদ্ধি সম্পর্কিত সমসাময়িক তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুলতানি ও মুগল আমলে বাংলার কৃষির যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। অনেক স্থানের নামের সঙ্গে ‘আবাদ’ সংযুক্তি (যেমন, ফতেহাবাদ ও খালিফাবাদ) সেসব জায়গা চাষাধীনে আসার সাক্ষ্যবহ হতে পারে। তৎকালীন সরকার ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, বীজ ও বলদ বা কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ক্রয়ে সহায়তার জন্য সরকার কৃষকদের  তাকাবি ঋণ দিত। পতিত জমি আবাদে উৎসাহ দানের জন্য কৃষকদের কম খাজনায় জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি করে শেষ পর্যন্ত পুরো খাজনা আদায় করা হতো। সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপের পিছনে মূল কারণ ছিল চাষাবাদের সম্প্রসারণ অর্থাৎ সরকারি আয়ের মূল উৎস ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি। অবশ্য, কৃষি সম্প্রসারণে মূল ভূমিকা পালন করেছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে মধ্যযুগে ফসলি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির হিসাব জানা যায় নি। কিন্তু মুগল আমলে (১৫২৬-১৭০৭ খ্রি) বাংলার কতিপয় অংশে (মুগল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও) ফসলি জমির পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার ধারণাটি ইরফান হাবিব প্রশ্নসাপেক্ষ মনে করেন।

প্রাচীনকালের মতো মধ্যযুগের প্রধান কৃষিপণ্য ছিল ধান। এটি এত উৎপন্ন হতো যে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানির জন্যও যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকত। মোটামুটি তিন ধরনের ধান চাষ হতো। এগুলি আউশ (হেমন্ত), আমন (শীত) ও বোরো (গ্রীষ্ম)। এ তিন ধরনের প্রত্যেকটির মধ্যে বহু প্রকারভেদ ছিল এবং এগুলির অনেক নাম ‘শূন্যপূরাণ’ ও ‘শিবায়ন’ সহ সমসাময়িক উৎসসমূহে উল্লিখিত আছে। অবশ্য, শূন্যপূরাণ অনুসারে ধানের সহস্রাধিক প্রকারভেদ ছিল। প্রত্যেক জাতের ধানের একটি করে দানা সংগ্রহ করা হলেও একটি বড় পাত্র ভরে যাবে বলে মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল যে মন্তব্য করেছিলেন উপরিউক্ত তথ্যে তার দৃঢ় সমর্থন মেলে। এ বর্ণনা অতিরঞ্জিত নয়। বিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে প্রকৃতপক্ষে ধানের সহস্রাধিক প্রকারভেদ প্রদর্শিত হয়। আবুল ফজল একটি বিশেষ জাতের ধানের বর্ণনা দিয়েছেন যা পানির গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায়, ফলে পানি ফসলের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এখানে তিনি সম্ভবত বন্যাপ্রবণ নিচু এলাকার বোনা আমন ধানের অর্থাৎ জলিধানের কথা উল্লেখ করে থাকবেন। আমনের একটি শীতকালীন প্রকারভেদও আছে আর এটি হল রোপা আমন।

তুলা ও  তুঁত ছিল প্রদেশের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমুখী ফসল। প্রসঙ্গত, সুতা ও রেশম ছিল বাংলার প্রধান শিল্প। পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তুলা উৎপন্ন হতো। পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত তুলা জন্মাত বীরভূম, বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় আর উত্তরবঙ্গে প্রধানত রংপুর, মালদহ ও দিনাজপুর জেলায়। অবশ্য, বিখ্যাত  মসলিন শিল্পের উপযোগী অতি উন্নতমানের তুলা ফলত ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায়। জন টেলর নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক এজেন্ট ১৮০০ সালের দিকে উল্লেখ করেন যে, ঢাকা শহরের চারপাশে ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী স্থানে ‘পৃথিবীর যে কোনো অংশের তুলনায় সর্বোত্তম মানের’ তুলা (কার্পাস) উৎপন্ন হয়। টেলর আরও লিখেছেন যে, তুলার বীজ বোনা হতো অক্টোবর-নভেম্বরে এবং ফসল তোলা হতো এপ্রিল-মে মাসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সুতি বস্ত্রশিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তুলার চাষও প্রকৃতপক্ষে বন্ধ হয়ে যায়। রেশমপোকার জন্য তুঁতগাছ জন্মাত মধ্য ও উত্তরবঙ্গে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী জেলায়। খুব সম্ভব ফসলটি চীন থেকে প্রবর্তিত হয় এবং পনেরো শতকে বাংলায় একজন চীনা পর্যটকের বর্ণনায় প্রথমবারের মতো রেশমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবুল ফজল, টেভার্নিয়ার ও বার্নিয়ার-এর লেখা এবং ইংরেজ কারখানার নথিপত্রেও প্রদেশে তুঁতচাষের উল্লেখ দেখা যায়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে  কাসিমবাজার সফরকারী টেভার্নিয়ার উল্লেখ করেন যে, কাশিমবাজারে রেশমের বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায় ২৫ লক্ষ পাউন্ডের সমপরিমাণ যার একাংশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হতো।

আরেকটি বাণিজ্যিক ফসল ছিল ইক্ষু। ১৭৫৬ সাল পর্যন্তও বাংলার চিনির একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য চালু ছিল মাদ্রাজ, বোম্বে, মালাবার উপকূল, সুরাট, সিন্ধু, মাসকাট, মক্কা ও জেদ্দার সঙ্গে। এমনকি সতেরো শতকের মাঝামাঝিও বিপুল পরিমাণ চিনির রপ্তানি বাণিজ্যসহ বাংলা ছিল এ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। বারবোসা, বারথেমা ও বার্নিয়ার বিবরণী এবং ইংরেজ ও ওলন্দাজ নথিপত্রে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। এতে বোঝা যায় যে, ইক্ষু মধ্যযুগের বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ছিল। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পায় এবং উৎপন্ন চিনি তখন কেবল প্রদেশের নিজস্ব চাহিদা মেটাতে পারত। জমির একটি নির্দিষ্ট অংশে একাধিক জাতের সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজের মতো বাণিজ্যিক ফসল ফলানো হতো। এ সময় প্রদেশে কিছু নতুন শস্য প্রবর্তিত হয় তামাক, ভুট্টা ও সম্ভবত নীল। একইভাবে, তিনটি নতুন ফল- কাজুবাদাম, আনারস ও পেঁপে পাশ্চাত্য থেকে এসে পৌঁছায়। মিষ্টিআলু ও সাধারণ আলু এ সময়ই প্রবতির্ত হয়। এভাবে, বাঙালি কৃষকরা শুধু বহুবিধ শস্য চাষই নয়, নতুন শস্য গ্রহণেও উৎসাহী হয়। এ ছাড়া, সমসাময়িক বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, নদ-নদী, শাখানদী,  হাওর, বিল, পুকুর ও সমুদ্রে ছিল বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মাছ।

মধ্যযুগে ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর হিসেবে সরকার কৃষিদ্রব্যের কতটা আদায় করত সে সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। চতুর্দশ শতকে এ প্রদেশ সফরকারী ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন যে, ‘নীল নদীর’ তীরের গ্রামবাসীরা অন্যান্য উপকরণসহ ভূমিকর হিসেবে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেক প্রদান করত। ওয়াং-তে-উয়ান (Wang-ta-Yuan) ওই সময়ের এক লেখায় বলেছেন যে, মধ্যযুগে রাষ্ট্র মোট উৎপন্ন দ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ কর হিসেবে আদায় করত। জমির উৎপাদিকা শক্তি ও ফসলের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্বের হারে পার্থক্য হয়ে থাকে এটা মনে রাখলেই এ আপাত অসামঞ্জস্য সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। এভাবে সুলতানি আমলে কৃষিদ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত রাজস্বের ভিন্ন ভিন্ন হার চালু ছিল। আকবরের সময় নির্দিষ্ট হার ছিল উৎপন্ন দ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ। মুর্শিদকুলী খাঁর আমলেও এ হার অব্যাহত থাকে। অবশ্য, ভূমি রাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য পল্লীকরও ছিল এবং উল্লেখ করা হয় যে, ভারতবর্ষে এসব অতিরিক্ত করের পরিমাণ ছিল মোট ভূমি রাজস্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তাই বলা যায়, মধ্যযুগের বাংলায় যে কোনো নির্দিষ্ট মান বিবেচনায় রাজস্ব হার ছিল অত্যধিক।

নির্ধারিত হারে প্রতি একক পরিমাণ ভূমির জন্য অথবা গোটা গ্রামের জন্য এককালীন হিসেবে রাজস্ব ধার্য করা হতো। কোনো কোনো স্থানে লাঙলের সংখ্যার ভিত্তিতে ভূমি রাজস্ব ধার্যের প্রথা চালু ছিল। ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর নগদ অর্থে পরিশোধ করা হতো। অর্থাৎ কৃষকদের উৎপন্ন কৃষিদ্রব্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিক্রয় করতে হতো। অন্যদিকে পণ্যোৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামবাসীরা অর্থকরী ও খাদ্যশস্য শহরের বাজারে বিক্রয় করত, কিন্তু বিনিময়ে তেমন কিছুই কিনত না। কেননা গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় সকল অ-কৃষিদ্রব্য গ্রামেই উৎপন্ন হতো। এটা বলা যায়, মধ্যযুগে প্রত্যেকটি গ্রামই স্বনির্ভর ছিল। জমিদার বলে অভিহিত বিভিন্ন সংখ্যা ও মর্যাদার সচরাচর বংশানুক্রমিক মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণি ও ‘আমিল’ হিসেবে পরিচিত কর্মচারীদের সহযোগিতায় ভূমি রাজস্ব আদায় করা হতো। সুলতানি ও মুগল আমলে সাধারণভাবে কৃষকদের পাট্টা দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। কবিকঙ্কনের ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ গ্রন্থে উপকথাখ্যাত প্রজাবর্গের যথাক্রমে ইন্দ্র ও কালকেতুর কাছ থেকে বন্দোবস্ত পাট্টা গ্রহণের ঘটনা বর্ণিত আছে। প্রজা ছিল দু’ধরনের খুদকাস্ত ও পয়কাস্ত। গোড়ার দিকের ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা প্রথম বর্গের প্রজাদের বলত স্থায়ী চাষি। দ্বিতীয় বর্গের চাষিরা অস্থায়ী ভিত্তিতে জমিচাষের জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে আসত এবং তারা খুদকাস্ত চাষীদের চেয়ে সাধারণত কম খাজনা দিত।

চাষাবাদ পদ্ধতি এবং কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ছিল প্রাচীন যুগের মতোই। এ সময় বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল চাষাবাদ পদ্ধতির দিক থেকে একমাত্র ব্যতিক্রম। সেখানে প্রচলিত  জুমচাষ আজও চালু রয়েছে। কুয়া থেকে পানি তোলার পদ্ধতি তখনও উন্নত হয় নি। তৎকালীন উত্তর-ভারতে প্রবর্তিত ‘পারস্য হুইল’ বাংলায় পরিচিত ছিল না। জমিতে সার প্রয়োগ পদ্ধতিও সম্ভবত অনুরূপ ছিল। ফলে, মুগল আমলে গুরুত্বপূর্ণ শস্যের ফলন উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতক বা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। ওই সময় অধিক উর্বর জমি চাষাধীনে আনার জন্য শস্যের ফলন হার অধিক হতে পারে এ যুক্তি দেখানো চলে। কিন্তু একথাও বলা যায় যে, জমি-মানুষ অনুপাত অধিকতর অনুকূল থাকায় স্বল্পনিবিড় চাষাবাদ অনুসরণ করা হতো। অনুকূল জমি-মানুষ অনুপাত থেকে বোঝা যায় যে, মধ্যযুগের বাংলায় মাথাপিছু উৎপাদন অপেক্ষাকৃত অধিক ছিল। মধ্যযুগে কৃষিদ্রব্যের নিম্নমূল্য যা বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা কৃষিদ্রব্যের প্রাচুর্যের সূচক হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে।

ফসল উৎপাদন কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও বা অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। প্রদেশের কোনো কোনো স্থানে মাঝে মাঝে সম্ভবত দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বিরাজ করত। দ্বিতীয়ত, কৃষকশ্রেণীর মধ্যে নির্দিষ্টমাত্রার অসাম্য বিদ্যমান ছিল। একদিকে একশ্রেণীর গ্রামীণ পরিবারের এত বেশি জমি ছিল যে কেবল পারিবারিক শ্রমে সেগুলি চাষাবাদ সম্ভব হতো না, অন্যদিকে আরেক শ্রেণির কোনো জমিই ছিল না বা থাকলেও খুবই সামান্য। এ থেকে বোঝা যায় যে, গ্রামীণ পরিবারগুলির একাংশ কৃষিশ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত। তাই মাথাপিছু গড় উৎপাদন অধিক থাকলেও বণ্টন ছিল অসমান। তৃতীয়ত, কৃষকদের ওপর রাষ্ট্রের দাবি ছিল অত্যধিক, মোট উৎপন্নের প্রায় ৪০%। পরিশেষে, কৃষিসংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কৃষিদ্রব্যের যোগান পর্যাপ্ত থাকলেও জীবনযাত্রার সার্বিক মান সন্তোষজনক ছিল না। বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা ও স্থানীয় সূত্রের প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবুল ফজল জানান যে, বাংলার সাধারণ মানুষ শুধু কোমরে লুঙ্গি গুঁজে গোটা শরীর প্রায় উদোম রাখত। জলবায়ুগত বা সামাজিক প্রথার জন্য এমনটি ঘটত তা স্বীকার্য নয়। পরিধেয় বস্ত্রের ধরন ও মান থেকেই উচ্চশ্রেণীকে পৃথক করা যেত। সেসময়ে বাংলায় তুলা উৎপাদন ও তাঁতের প্রচলন অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। ধান-চালের তুলনায় কাপড় ছিল মহার্ঘ। জুতার ব্যবহার ব্যাপক ছিল না এবং মোরল্যান্ডের মতে, চামড়ার উচ্চমূল্যের জন্যই এটি ঘটত। অধিকাংশ কৃষক খড়ে ছাওয়া মাটির এক কামরার ঘরে থাকত। চৌকি ও বাঁশের চাটাই ছাড়া কৃষকদের ঘরে অন্য কোনো আসবাবপত্র তেমন মিলত না। কাঁসা বা তামার তৈজসপত্র যথেষ্ট দামী হওয়ায় জনসাধারণ সাধারণত সেগুলি ব্যবহার করত না। তাই কৃষি উৎপাদনের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বাংলার কৃষকরা উচ্চমানের জীবনযাপন করত তেমন নিদর্শন পাওয়া সত্যিই কঠিন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষিখাতের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। প্রধানত আবাদি এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের মোট পরিমাণ ও মূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু, ভারত শিল্পপণ্য থেকে কৃষিপণ্য সরবরাহকারী হিসেবে নিজ ভূমিকা পরিবর্তন করায় এবং নির্দিষ্ট কিছু শিল্প ও নগর কেন্দ্র উন্নয়নের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায়, অতীতের চেয়ে বাজারের জন্য উৎপাদন আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অবনতি ও জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে এসময় কৃষিখাতের ওপর বর্ধিত (জনসংখ্যার) চাপ সত্ত্বেও এমনটি ঘটেছিল। বাংলাতেই বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভূত হয়, কারণ এটিই প্রথম ব্রিটিশের শাসনাধীন হয়েছিল।

আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আবাদযোগ্য পতিত জমি ছিল। এটি থাকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ প্রদেশের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক জনহানি ঘটায়। কিন্তু পরবর্তী শতকে ফসলি এলাকা দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে এটি বস্ত্তত শেষসীমায় পৌঁছায় (চাষাবাদ সম্প্রসারণের আর তেমন সুযোগ ছিল না)। অবশ্য, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডেই মূলত তৎকালীন চাষাবাদ সম্প্রসারণ কেন্দ্রীভূত ছিল। এভাবে, উনিশ শতকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বৃহত্তর অংশ, ত্রিপুরাসহ (বর্তমান কুমিল্লা জেলা) মেঘনা মোহনার অধিকাংশ, বরেন্দ্র অঞ্চল, সুন্দরবন ও উত্তর-পূর্ব বাংলার হাওর এলাকা পুরোপুরি চাষাবাদের আওতায় আসে। ২৪ পরগনা, খুলনা ও বাকেরগঞ্জে তিন জেলার কৃষক সুন্দরবন অঞ্চল পুনরুদ্ধারে অংশ নেয়। চাষাবাদের নতুন নতুন এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার আদমশুমারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়। অবশ্য, সুন্দরবন আবাদ করে এসব জেলায় চাষাবাদ সম্প্রসারণ প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অধিক মাত্রায় হচ্ছিল। মাটির অধিক উর্বরতার ফলে সেখানে একজন প্রজার পক্ষে অন্য যে কোনো স্থানের চেয়ে বৃহত্তর এলাকা চাষাবাদ সম্ভব হতো। অধিকন্তু, চাষাবাদের একটি বড় অংশ করত অনাবাসিক প্রজারা যারা সেখানে মৌসুমের জমিচাষের পর নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করত। পুনরুদ্ধারের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল এসব জেলায় নদীগুলিতে অনবরত জেগে ওঠা উর্বর পলিময় জমি। বাকেরগঞ্জ জেলায় এ সুযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল। ত্রিপুরা জেলার বিশাল চরাঞ্চল এসময় চাষাধীনে আনা হয়। সমগ্র পূর্ববঙ্গে নতুনভাবে গড়ে ওঠা এসব কৃষিবসতি ছাড়াও সেখানে কয়েকটি জেলার নিজস্ব বিশেষ আবাদযোগ্য অঞ্চল ছিল। ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায় এ ধরনের অঞ্চল ছিল প্রায় জনশূন্য মধুপুর জঙ্গল। দিনাজপুরের দক্ষিণের এক-তৃতীয়াংশ, পূর্ব-মালদহের অর্ধাংশ, পশ্চিম-বগুড়ার অর্ধাংশ ও রাজশাহীর উত্তরের এক-চতুর্থাংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি অভিবাসী  সাঁওতাল শ্রমিকদের দ্বারাই আবাদ সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য, পশ্চিম ও মধ্য বাংলার কিছু অংশে অবস্থা ছিল ভিন্নতর। এখানে বহুকাল থেকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নদীব্যবস্থার একটি অবক্ষয় চলছিল। দূরবর্তী গ্রামসমূহকে রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য রেলপথ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে এ অবক্ষয় তৎকালে ত্বরান্বিত হয়। ফলে দুটি প্রতিকূল প্রভাব দেখা দেয় ভূমির উৎপাদশীলতা হ্রাস এবং ম্যালেরিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। শেষোক্ত কারণে লোকবৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নদীয়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, হুগলি, যশোরের মতো জেলাগুলিতে আবাদি এলাকা কমে যায় বা অপরিবর্তিত থাকে। প্রদেশের দুটি অংশ ক্ষয়িত ও সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে উৎপাদন ক্ষমতার পার্থক্য থাকলেও বাংলায় সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল পরিমাণগতভাবে এবং মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থমূল্যেও। উনিশ শতকে পূর্ব বাংলার জেলাসমূহে বিভিন্ন ফসলের ফলনের হারে কোনো উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল না।

উনিশ শতকে শস্য উৎপাদনের উল্লিখিত বর্ণনার ভিত্তি হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিক মূল্যায়ন এবং প্রতি দশ বছরে আদমশুমারি জনসংখ্যার পরিসংখ্যান, কিন্তু ফসলি জমি ও একর প্রতি ফলনের কোনো কালানুক্রমিক তথ্য নয়। সরকার এধরনের তথ্য সরবরাহ শুরু করে কেবল ১৮৯১/৯২ সালের পর থেকে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রকাশনা হলো Estimates of Area and Yields of Principal Crops in India, Agricultural Statistics of India, Agricultural Statistics of Bengal, Season and Crop Report। এসব পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সরকারিভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গের কোনো কোনো জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল বা হ্রাস পাওয়া অব্যাহত ছিল। পক্ষান্তরে, পূর্ববঙ্গের জেলাসমূহে আবাদি জমির পরিমাণ প্রান্তিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (বিশেষত দুফসলি চাষ বিস্তারের ফলে)। কিন্তু বৃদ্ধিহার এসময় এতই প্রান্তিক ছিল যে সার্বিক বিন্যাসে বদ্ধাবস্থা ধরা পড়ে। একক ফসলগুলির মধ্যে পাটের জমি কিছুটা বাড়লেও ধানের (মোট ফসলি জমির ৮০%) ক্ষেত্রে বদ্ধাবস্থা সার্বিক প্রবণতার নির্ধারক ছিল। সরকারিভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪১ সালের পর খাদ্যশস্যের চাষাধীন জমির পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এটা ছিল তখন কয়েক বছর ধরে সরকার পরিচালিত ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ প্রচারাভিযানের অবদান। অবশ্য, এ অভিযানের যতটা সাফল্য দাবি করা হয়েছিল আসলে তা হয়ত ততটা ছিল না। শস্যের ফলন হারে কী কী প্রবণতা লক্ষনীয় ছিল? প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যাবে যে, পাট ও ইক্ষুর ফলন বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু আমন ধানের ফলন হার বৃদ্ধি পায় নি। অর্থাৎ সামগ্রিক ফলন হারে স্থবিরতা বিরাজমান ছিল। যাবতীয় ফসলের ফলন হার ও আওতাধীন জমির পরিমাণের স্থবিরাবস্থা থেকে বোঝা যায় যে, সামগ্রিক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায় নি। এটি এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছিল যখন বার্ষিক ১% হারে বাড়ছিল জনসংখ্যা। বিশ শতকের শুরুতে অত্যধিক জন ঘনত্বের দরুন মাথাপিছু ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল, অর্থাৎ গড়পড়তা জোতজমি ছোট হয়ে (প্রায় ৪ একর) পড়েছিল। এসময় শস্য উৎপাদনের স্থবিরতার ফলে মাথাপিছু উৎপাদন আরও হ্রাস পেয়েছিল।

ইতোমধ্যে ১৮৮৫ সালে একটি প্রাদেশিক কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কৃষি উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাতে ছিল ১. বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী, শিবপুর ও রংপুরে পরীক্ষামূলক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা; ২. প্রদর্শক (ডেমোনেস্ট্রেটর) নিয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের উন্নত চাষপদ্ধতি প্রদর্শন; ৩. কৃষিবিষয়ক লেখা প্রকাশের মাধ্যমে কৃষকদের বিভিন্ন পরীক্ষণের ফলাফল জানানো; ৪. কৃষকদের উন্নততর বীজ সরবরাহ; ৫. কৃষক সন্তানদের উন্নত চাষপদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ৬. উন্নত কৃষি হাতিয়ার প্রবর্তন। কিন্তু খামার পর্যায়ে এসব উদ্যোগের প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। ফলে চাষাবাদ পদ্ধতি এবং কৃষির যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার প্রায় মধ্য ও প্রাচীন যুগের মতোই সেকেলে থেকে যায়। বাণিজ্যিক সার অজ্ঞাত ছিল। উন্নত জাতের বীজ ব্যবহারে সামান্য অগ্রগতি ঘটে। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের শেষের দিকে মাত্র ৬% ধানী জমিতে উন্নত বীজ বপন করা হতো। মোট ফসলি জমির একটি ক্ষুদ্রাংশে সেচব্যবস্থা চালু ছিল এবং শুধু পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় জেলায় তা সীমিত ছিল। এদিকে পূর্ববঙ্গের জেলাসমূহে দুফসলি জমি বৃদ্ধির ফলে পতিত জমি হ্রাস পায়। অতঃপর প্রধান প্রধান শস্যের একর প্রতি ফলনের স্থবিরতার কারণগুলি আর প্রচ্ছন্ন থাকে না।

ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে কৃষি উৎপাদন শুধু পরিমাণ ও মূল্যের দিক থেকেই বৃদ্ধি পায় নি, অধিকতর বাণিজ্যিক বা বাজারমুখীও হয়েছিল। নতুন না হলেও বাণিজ্যিকীকরণ এসময় কৃষি-অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন শুধু অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রেই সীমিত থাকে নি, এক পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী (Report on the Marketing of Rice in India) উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের শেষের দিকে বাংলায় উৎপাদিত মোট ধানের শতকরা ৪৪ ভাগ বাজারজাত হতো। অবশ্য, অর্থকরী ফসলের আবাদও বৃদ্ধি পায় এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, বিশেষত পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের কতিপয় জেলায় (ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রংপুর)। পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ বৃদ্ধির সময় এতে মোট কৃষিশ্রমের ১০ শতাংশের কর্মসংস্থান জোটে, পাট ব্যবসায় বিভিন্ন মধ্যগ শ্রেণি সম্পৃক্ত হয়, কলকাতায় মিলমালিক ও রপ্তানিকারক মুনাফা অর্জন করতে থাকে, যথেষ্ট সংখ্যক শিল্পশ্রমিক গড়ে ওঠে এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৃষিখাতে বিপুল পরিমাণ বাজারজাত উদ্বৃত্ত দেখা দেয়। এক হিসাব অনুযায়ী, বাজারজাত উদ্বৃত্তে পাটের অংশভাগ ছিল ১৯২০/২১ সালে ২০% থেকে ১৯২৫/২৬ সালে ৬৪%, ১৯২০/২১-১৯৩২/৩৩ সালে গড় উদ্বৃত্ত ছিল ৪০%, যেখানে ধানের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৪%।

পাট ছিল একটি রপ্তানি ফসল কাঁচা ও শিল্পপণ্য। পাটজাত পণ্যের মধ্যে ছিল চটের ব্যাগ ও প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার্য চটের কাপড়। এভাবে বৈদেশিক চাহিদাই পাট উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৮৫৫ সালে এবং পরবর্তী ৫০ বছরে আরও ৩৪টি পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০০/০১ সালে এসব কলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার ছিল ৩,১৫,০০০ টাকু ও ১৫,৩৪০ তাঁত এবং এগুলিতে নিয়োজিত ১ লক্ষ ১০ হাজার শ্রমিক, ব্যবহূত হতো মোট উৎপন্ন ফসলের প্রায় ৪০%। ইতোমধ্যে ডান্ডি মিলগুলিতে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং ১৮৯৬/৯৭ সালের দিকে পাট চাষাধীন জমি ১৮৭৬/৭৭ সালের মাত্র ৫ লক্ষ ৫৩ হাজার একর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ লক্ষ একরে দাঁড়ায়। ১৯২০-৪৭ সময়কালে পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ ছিল মোট ফসলি জমির ১০% এবং তা শীর্ষে পৌঁছে ১৯০৪/০৫-১৯০৭/০৮ সালে, যখন ৩০ লক্ষাধিক একর জমিতে পাট ফলত। পাট চাষাধীন জমি অতঃপর তেমন হ্রাস পায় নি, এমনকি মন্দার বছরগুলিতেও, যখন দাম খুব কমে গিয়েছিল। দুটি পাট অনুসন্ধান কমিটি (Finlow committee and Fawcus Committee) যথার্থই চিহ্নিত করেছিল যে, এটি ঘটেছিল একটি লাভজনক বিকল্প ফসলের অনুপস্থিতির জন্যই।

উনিশ ও বিশ শতকে বাংলায় উৎপন্ন অন্যান্য অর্থকরী শস্য ছিল চা, আফিম, নীল, আখ, তামাক ও বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ। রোপা ফসল হিসেবে চা ছিল অন্যান্য অর্থকরী ফসল থেকে এ বিবেচনায় পৃথক যে, এটি ছিল সম্পূর্ণ মজুরি-শ্রম (অধিকাংশ উপজাতীয়) ভিত্তিক। চা বাগান ছিল মাত্র তিনটি জেলায় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও চট্টগ্রামে। আফিমের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল উৎপাদন ও বিক্রয়ের ওপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু আফিম উৎপাদন প্রধানত পাটনা ও আশেপাশে সীমাবদ্ধ ছিল। নীলচাষের বৃদ্ধিহার ছিল উল্লেখযোগ্য এবং পশ্চিম ভারত, উত্তর আমেরিকার একাংশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো সাবেক উৎস থেকে নীল সরবরাহ ঘাটতির ফলে বর্ধমান বিদেশি চাহিদা এক্ষেত্রেও প্রধান প্রণোদনা যুগিয়েছিল। নীলচাষ সম্প্রসারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। বাংলা থেকে সুতিবস্ত্র রপ্তানি হ্রাস পাওয়ায় প্রধানত প্রেরণযোগ্য মুদ্রার্জনের জন্য সরকারের একটি লাভজনক বৈদেশিক বাণিজ্যের অত্যধিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল এবং সরকার নীলকে একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে দেখেছিল। অবশ্য নীলচাষ বৃদ্ধির জন্য নীলকরদের অর্থনীতি বহির্ভূত একটি দমন কৌশল ছিল। কেননা নীলচাষ চাষিদের জন্য লাভজনক ছিল না এবং স্বেচ্ছায় তারা এ ফসল চাষ করত না। ফলে নীলচাষ নির্যাতনমূলক হয়ে পড়ে এবং ১৮৫৯-৬০ সালে প্রজারা নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আগেকার নীলবিরোধী ছোটখাটো প্রতিরোধ থেকে পৃথক এ নীলবিদ্রোহ নীল চাষের গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিণামে বাংলায় নীলচাষ দ্রুত হ্রাস পায়। ইক্ষু তখনও আরেকটি অর্থকরী ফসল এবং এটি ছিল কয়েকটি ফসলের (অন্যগুলি চা, তিসি) একটি, যেগুলির একর প্রতি ফলনে কিছুটা উন্নতি দেখা দিচ্ছিল। দুটি কারণে এমনটি ঘটেছিল। প্রথমত, বিশ শতকের ত্রিশের দশকে অর্ধেকের বেশি ইক্ষুর জমিতে উন্নত জাতের চারা রোপণ করা হতো এবং দ্বিতীয়ত, ইক্ষু মাড়াইয়ের জন্য লোহার তৈরি কলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু পাট ব্যতীত অন্য সব অর্থকরী ফসলের একত্র দখলে প্রদেশের মোট ফসলি জমির ৫ শতাংশও ছিল না।

১৭৯৩ সালে লর্ড  কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার কৃষিকে আভিজাত্যিক কাঠামো দিয়েছিল। এ ব্যবস্থায় জমিদারদের জমির স্বত্বাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সরকার তাদের ওপর ধার্যকৃত খাজনা চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। এতে আরও শর্ত থাকে যে, অতঃপর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাতে খাজনা মওকুফ বা স্থগিত দাবি করার কোনো অধিকার স্বত্বাধিকারীদের থাকবে না এবং কোনো স্বত্বাধিকারী নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যথারীতি খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার জমিদারির সম্পূর্ণ বা অংশত বিশেষ নিলামে বিক্রি হবে। খাজনা বিক্রয় আইনের (সূর্যাস্ত আইন বলে পরিচিত) কঠোর প্রয়োগের ফলে অনেক জমিদারি নিলামে বিক্রি হয়ে যায় এবং পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং সরকারি ও জমিদারি কাজে নিয়োজিত এক শ্রেণির লোক নতুন জমিদার হয়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের একটি উদ্দেশ্য ছিল এ যে, জমিদারদের ওপর সরকারের দাবি অপরিবর্তিত থাকায় তারা কৃষি উন্নয়নে মূলধন নিয়োগ করবে। লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তিগত সম্পদের জাদুস্পর্শ এদেশের জমিদারদেরও ব্রিটিশ সহযাত্রীদের অনুসরণে প্রেরণা যোগাবে। কিন্তু এ প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। পুরানো বা নতুন জমিদার কেউই কৃষিতে মূলধন বিনিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেয় নি।

জমিদারদের অনেকে রায়তের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের কাজ চালাতেও প্রস্ত্তত ছিল না। তাই তারা স্থায়ী খাজনা প্রদানকারী একটি শ্রেণির কাছে জমিজমার দায়িত্ব হস্তান্তর করতে শুরু করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে তারা যেসব শর্তপূরণে সম্মত হয়েছিল, তাদের ওপরও সে শর্তাদিই আরোপিত হয়েছিল। ভোগদখলের দিক থেকে এসব স্বত্ব ছিল জমিদার ও রায়তের মধ্যবর্তী এবং এজন্যই এগুলি হলো মধ্যস্বত্ব বা মধ্যবর্তী সম্পত্তি। জমিদারি স্বত্বের মতো মধ্যস্বত্বও ছিল হস্তান্তরযোগ্য ও বংশানুক্রমিক। মধ্যস্বত্ব ছিল প্রধানত দু’ধরনের পত্তনি স্বত্ব ও পতিত জমি আবাদ স্বত্ব। পত্তনি স্বত্ব প্রথম উদ্ভাবন করেন বর্ধমানের মহারাজা। তিনি তাঁর বিশাল সম্পত্তিকে হাজার হাজার ব্লকে বিভক্ত করেন যার প্রত্যেকটির দায়িত্বে ছিল একজন মধ্যগ পত্তনিদার। পত্তনিদার অতঃপর সৃষ্টি করে দরপত্তনি (দ্বিতীয় শ্রেণি) এবং দরপত্তনিদাররা একইভাবে সৃষ্টি করে ছেপত্তনি (তৃতীয় শ্রেণি), ইত্যাদি। অন্যান্য জমিদারও ব্যবস্থাটি অনুসরণ করে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলার প্রধানত পতিত জমি পুনরুদ্ধারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাই ছিল পতিত জমি আবাদ মধ্যস্বত্বভোগী। জমিদারগণ বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করে এবং আবাদকৃত ভূমির ওপর স্থায়ী অধিকারের বিনিময়ে তাদের পতিত (চাষযোগ্য পতিত) জমি পুনরুদ্ধারে মূলধন বিনিয়োগের অনুমতি দেয়। পত্তনি স্বত্বের মতো পতিত জমি আবাদ স্বত্বেও বহু স্তর কাঠামোর উদ্ভব ঘটে যাদের স্থানীয় নাম ছিল তালুকদার, হাওলাদার, নিম-হাওলাদার, গাঁতিদার প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে, মধ্যস্বত্বভোগীদের উদ্ভবে জমিদারির একটি নির্দিষ্ট অংশই শুধু প্রভাবিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, মধ্যস্বত্বভোগীদের স্তরসংখ্যা কখনই অর্ধশতাধিক ছিল না, যা ভারতীয় সংবিধিবদ্ধ কমিশনে উল্লিখিত হয়েছে। সংখ্যাটি বাকেরগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১২টি ছিল। অন্য যেসব জেলার তথ্য পাওয়া গেছে তদনুযায়ী ঢাকায় ৪, যশোহরে ৬ বা ৭, খুলনায় ৮, বগুড়ায় ১০ ও ময়মনসিংহে ৩।

জমিদার বা মূল স্বত্বাধিকারী ও বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও গোটা একপ্রস্থ আবওয়াবের (অবৈধ উপকর) আকারে কৃষি উদ্বৃত্তের একটি বিরাট অংশ আত্মসাৎ করত। ১৭৯৩ সাল থেকে দুভাবে এ উদ্বৃত্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে- খাজনার বর্ধমান হার এবং অতিরিক্ত ভূমি চাষাধীনে আনা। কিন্তু রাষ্ট্রের চাহিদা ছিল বাঁধা। একটি তথ্য থেকে এ বৃদ্ধির মাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এক হিসাব অনুযায়ী ১৯১৮/১৯ সালে এসব স্বত্বাধিকারী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মোট খাজনা ১২.৮৫ কোটি টাকার ৭৬.৭% আত্মসাৎ করেছিল, আর ভূমিরাজস্ব হিসেবে রাষ্ট্রকে দিয়েছিল মাত্র ২.৯৯ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উল্লেখ ছিল যে আদায়কৃত মোট খাজনার ৯০% কোষাগারে যাবে এবং জমিদাররা পাবে মাত্র ১০%। খাজনা ও রাজস্বের এ ফাঁকের সুবাদে স্বত্বাধিকারী ও মধস্বত্বভোগীরা একটি বর্ধিষ্ণু মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণির (ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত) ভিত্তি স্থাপন করে যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল আইন, সাংবাদিকতা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সিভিল সার্ভিস ও বিচার কাজে নিয়োজিতদের প্রথম সফল প্রজন্ম। কিন্তু জমিদাররা এ উদ্বৃত্তের একাংশ কৃষি উন্নয়নে বিনিয়োগ করে নি। এখানেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা নিহিত। এতে কৃষিউদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা পালন না করেই জমিদাররা এ উদ্বৃত্ত ভোগ করার সুযোগ পায়। ভূমি পুনরুদ্ধারে সহায়তা যুগিয়ে পতিত জমি আবাদ ভূমিস্বত্ব কিছুটা উৎপাদনশীল ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্ত, বিশ শতকের প্রথম দিকে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বস্ত্তত থেমে গেলে মূল মালিকসহ অন্যান্য সমগোত্রীয়দের মতো এ মধ্যস্বত্বভোগীরাও পরজীবীতে পরিণত হয়। প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ১৯৩৮ সালে নিযুক্ত ‘বেঙ্গল ভূমি-রাজস্ব কমিশন’ (ফ্লাউড কমিশন হিসেবে পরিচিত) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের সুপারিশ করে। অবশ্য, ব্রিটিশ শাসনের অবশিষ্ট বছরগুলিতে আর সুপারিশটি বাস্তবায়িত হয় নি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনে রায়তের অধিকার কখনও সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত হয় নি। অন্যদিকে, ১৭৯৯, ১৮১২, ১৮২২ ও ১৮৪৪ সালের বিধিবিধানের মাধ্যমে তাদের অবস্থান দুর্বলতর করা হয়েছিল। এসব বিধিবিধানের সুবাদেই জমিদারদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, কৃষকদের ওপর বর্ধিত হারে খাজনা চাপানো হয় এবং ভূমিস্বত্বে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। অতঃপর ১৮৫৯ সালের শুরু থেকে প্রজাদের অবস্থা উন্নয়নে বেশ কিছু আইনগত পদক্ষেপ গৃহীত হলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ রায়তরা প্রকৃতপক্ষে মালিকানার সকল অধিকার- উত্তরাধিকার, ভূমির অবাধ হস্তান্তর, উচ্ছেদ ও খাজনাবৃদ্ধির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা লাভ করে। এমনকি রায়তদের অধীনস্থ তস্য-রায়তরাও কতিপয় আইনগত অধিকার পায়। বর্গাদার বা ভাগচাষিদেরও কতিপয় অধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় (উৎপন্ন ফসলে সাধারণত তাদের অংশভাগ ছিল ৫০%), কিন্তু সম্ভবত প্রাদেশিক আইন পরিষদে ধনী কৃষক ও জমিদারদের প্রতিনিধিদের বিরোধিতার কারণে উদ্যোগটি সফল হয় নি। এভাবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিকে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে। একদিকে ছিল খাজনা আদায়কারী একশ্রেণীর জমিদার ও বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং অন্যদিকে জমির ‘মালিক’ চাষিগণ। একটি নির্দিষ্ট স্তরের যে মধ্যস্বত্বভোগী ছিল তার অধস্তন মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে একজন জমিদার, সে আবার জমিদারের বা তার ঊর্ধ্বতন মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে ছিল, একজন প্রজা। নিয়মানুযায়ী, খাজনা আদায়কারী মাত্রেই ভূমিমালিক আর খাজনা প্রদানকারী মাত্রেই প্রজা। একইভাবে, অধীনস্থ রায়তদের কাছ থেকে খাজনা আদায়কারী রায়তও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একজন জমিদার। আবার, ভূস্বামী (অর্থাৎ মূল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী) প্রধানত খাজনার আয়ে জীবনযাপন করলেও তাদের নির্দিষ্ট খাসজমিও থাকত এবং তারা সেগুলি বর্গাচাষি ও ক্ষেতমজুরের সাহায্যে চাষ করত। চাষাবাদের ধরন উল্লেখ না করে বিভিন্ন শ্রেণির দখলে ভূমির অনুপাত ছিল এরূপ জমিদারের খাসজমি ২০%, রায়তদের ৭২% ও তস্য-প্রজার ৮%।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের মতো চাষাবাদে চাষিদেরই প্রাধান্য ছিল। বেঙ্গল ভূমি রাজস্ব কমিশনের এক হিসাব অনুযায়ী কৃষক পরিবারের সদস্যদের চাষকৃত ভূমির পরিমাণ ছিল মোট ভূমির ৬৬%। অবশ্য, এ ভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ চাষ করত বর্গাদার ও ক্ষেতমজুররা। আবার, ভূমি রাজস্ব কমিশনের তথ্যানুযায়ী এ দুটি শ্রেণি যথাক্রমে ২১% ও ১৩% জমি চাষ করত। এভাবে, বিভিন্ন শ্রেণির গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে কৃষিজমি বণ্টনে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য ছিল। একদিকে, এক শ্রেণির ধনী কৃষকের অধিক জমি ছিল যা পারিবারিক ‘শ্রমে চাষাবাদ সম্ভব হতো না’। তাই তারা বর্গাদার অথবা ভাড়া মজুর নিয়োগ করত। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকের জমির পরিমাণ এত অল্প ছিল যে তাতে তাদের সকলের কর্মসংস্থান হতো না। ভূমি রাজস্ব কমিশনের অন্য একটি তথ্যে একই বিষয় সত্যায়িত হয়েছে। এভাবে, যেখানে ৫ একরের অধিক জমির মালিকদের দখলে ছিল প্রদেশের মোট জমির ২৫%, সেখানে ২ একরের কম জমির মালিকদের দখলে ছিল মোট জমির প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ (৪৬%)। উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেকের পরিবর্তে বর্গাদারদের দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া উচিত এটি ছিল ফ্লাউড কমিশনের পরামর্শ। এ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ব্রিটিশ শাসনের শেষ বছরগুলিতে একটি সশস্ত্র আন্দোলন (তেভাগা হিসেবে পরিচিত) সংঘটিত হয়। কিন্তু আন্দোলন সফল হয় নি।

ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্রিটিশ শাসনামলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যাপকতর বাণিজ্যিক যোগাযোগের ফলে গ্রামাঞ্চলে অতীতের তুলনায় অধিক হারে নগদ লেনদেনের সূচনা ঘটে। বাণিজ্যিকীকরণ প্রসারে অপেক্ষাকৃত অপ্রভাবিত অঞ্চলের বা জনগোষ্ঠীর ওপরও অর্থের ব্যবহার যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অবশ্য, পরিবর্তিত পরিবেশে গড়ে ওঠা ঋণদান সংস্থাসমূহ প্রায় একচেটিয়াভাবে রপ্তানি বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ শিল্পের প্রয়োজন মিটাতে থাকায় গ্রামাঞ্চল কার্যত সংগঠিত অর্থসংস্থানের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে পড়েছিল। এভাবে, একটি অর্থনৈতিক কাঠামোর কার্যগত পদ্ধতিতে সৃষ্ট ব্যাপক শূন্যতা পূরণ করেছিল মহাজন, পাঠান, কাবুলী, ব্যবসায়ী, জমিদার ও ধনী কৃষকের মতো উত্তমর্ণরা। ১৯০৪ সালে সরকার কর্তৃক সূচিত সমবায় ঋণদান আন্দোলন খুব সীমিত সাফল্য অর্জন করে, কৃষিঋণ পায় মোট গ্রহণেচ্ছুদের এক ক্ষুদ্রাংশ (১৯৪৩ সালে ১০%)। এভাবে মহাজনরাই প্রকৃতপক্ষে ঋণের একমাত্র উৎস থাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে গৃহীত অধিকাংশ ঋণই সরাসরি উৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয় নি। দ্বিতীয়ত, এমনকি এসব ঋণ উৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হলেও ব্যয়িত হয়েছে গতানুগতিক যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার ও বীজ ক্রয়ে, একর প্রতি ফলন বাড়াতে পারে তেমন কোনো উপকরণের জন্য নয়। তৃতীয়ত, উত্তমর্ণদের ধার্য সুদের হার ছিল অত্যধিক; ঝুঁকিমুক্ত ঋণের ওপর বছরে ১৮%-৩৮%, আর ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে আরও বেশি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সম্ভবত সুদের টাকার পরিমাণ জমিদারের খাজনার চেয়ে বেশি হতে শুরু করেছিল। যেভাবেই হোক, এ তিনটি বৈরী উপাদানের প্রভাবে ঋণের অর্থের একাংশ অপরিশোধিত থেকে যায় এবং পুঞ্জিত ঋণসমস্যা দেখা দেয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাংকিং তদন্ত কমিটির হিসাব অনুযায়ী ১৯২৯/৩০ সালে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকা। অন্য একটি হিসাব মোতাবেক ১৯৩৪ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল (পুঞ্জিত সুদ ব্যতীত) ৯৬ কোটি টাকা। ১৯২৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে ঋণ সমস্যা অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় কৃষি পণ্যের দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে যায় অথচ ঋণের পরিমাণ একই পর্যায়ে থাকে। এমতাবস্থায় ঋণগ্রস্ত কৃষকদের সাহায্য দানের জরুরি প্রয়োজন অনুভূত হয়। (প্রসঙ্গত, ভারত সরকারের ১৯৩৫ সালের অ্যাক্টের অধীনে কৃষকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।) তদনুযায়ী ১৯৩৬ সালে কৃষি ঋণগ্রহীতা আইন পাস হয় এবং এ আইনের অধীনে ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলির ঋণের পরিমাণ পরিশোধ ক্ষমতার আওতায় কমিয়ে আনতে প্রদেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত পূর্ব বাংলার কিছু জেলায় ঋণসালিশী বোর্ড গঠিত হয়। ১৯৪৪ সালের মধ্যে ঋণসালিশী বোর্ড ৫০ কোটি টাকার গ্রামীণ ঋণ ১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনে। এদিকে, মহাজনদের ধার্য সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অপকর্ম রোধে ১৯৪০ সালে একটি ঋণদাতা আইন (Moneylenders Act) পাস করা হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ১৯৪৫ সালে প্রদেশে কৃষি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

ব্রিটিশ আমলের শেষ পর্যায়ে প্রায় দু দশক ধরে সব ধরনের ফসল উৎপাদনে বদ্ধাবস্থা থাকাকালে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটে এবং বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে বঙ্গীয় ভূমি রাজস্ব কমিশনের (১৯৩৮) ভাষায় ‘সকল শ্রেণির মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগের শ্বাসরুদ্ধকর’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ এবং কৃষকদের চাষাধীন জমিতে তাদের মালিকানার অধিকার দেওয়া হলেও এ বদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকে। অতঃপর বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার বীজ-পানি-সার প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষির, বিশেষত খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলে কর্মসূচিটি আরও গতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে সেচপাম্প, সার ও উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, সেচকৃত জমি ও উন্নত জাতের ধানের বপণকৃত ক্ষেতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। একই সময়, বিশেষত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের উত্তরসূরি) কর্তৃক প্রদত্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৬৭/৭০-১৯৮৫/৮৮ সালে জনসংখ্যার বৃদ্ধিহার ২.৪৮ শতাংশের পাশাপাশি সামগ্রিক শস্যের উৎপাদন মাত্র ১.৫৩% ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১.৮৯% বৃদ্ধি পেয়েছিল। গমের উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল ১৫.১% হারে। কিন্তু ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির অত্যধিক নিম্নহার (১.৯৬%) সামগ্রিক খাদ্যশস্যের বৃদ্ধিহার হ্রাস করেছে। ফলে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য পূর্ণ হয় নি। একই সময়ে (১৯৬৭-৮৮ সালে) ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন যথাক্রমে ১.৭২% ও ০.৭২% হ্রাস পায়। অন্যদিকে, পাট উৎপাদন প্রান্তিকভাবে বৃদ্ধি পায় (০.১৫%)। গত এক দশকে বাণিজ্যিক সার ও উন্নত জাতের বীজের ব্যবহার এবং সেচ এলাকার আনুপাতিক হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে নি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, ১৯৯০/৯১-১৯৯৩/৯৪ ও ১৯৯৪/৯৫-১৯৯৭/৯৮ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় একই পর্যায়ে (১ কোটি ৮০ লক্ষ টন) রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীন ও মধ্য যুগে এবং ব্রিটিশ আমলে শস্য উৎপাদন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপখাত ছিল এবং ১৯৯৭/৯৮ সালেও তাই থেকেছে সামগ্রিক কৃষির ৭২%। অন্যান্য উপখাতের অংশগুলি হচ্ছে বন (৭%), পশুসম্পদ (১০%) ও মৎস্য (১১%)। শস্য উৎপাদন উপখাতের মধ্যে ধান এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল (মোট ফসলি জমির তিন-চতুর্থাংশ)। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কৃষি আরও নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পাটচাষ সম্প্রতি হ্রাস পেয়েছে, নীট ফসলি জমি ১৯৭৩/৭৪ সালের ২ কোটি ৯ লক্ষ ৭৭ হাজার একর থেকে ১৯৯৬/৯৭ সালে ১ কোটি ৯৪ লক্ষ ১ হাজার একরে হ্রাস পেয়েছে; একাধিক ফসলি জমির পরিমাণ ১৯৭৩/৭৪ সালের ৮৪ লক্ষ ৪৭ হাজার একর থেকে ১৯৯৬/৯৭ সালে ১ কোটি ৪৬ লক্ষ ৮৮ হাজার একরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জিডিপি (GDP) বা মোট দেশীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ৬০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৭/৯৮ সালে প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।

ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষিতে লক্ষণীয় যে, উল্লেখযোগ্য পরিসরে পর্যাপ্ত শিল্পায়ন প্রয়াসের অনুপস্থিতি হলো গোটা অর্থনীতি, বিশেষত কৃষিখাতের দুর্বলতার একটি প্রধান উৎস। বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত এ ভূখন্ডে ব্রিটিশ আমলে প্রকৃতপক্ষে শিল্পায়ন প্রচেষ্টা অনুপস্থিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও এ দুর্বলতা ঘোচেনি। ১৯৭১ সালের পরবর্তীকালে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নি। নীট ফসলি জমির ক্রমাগত হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প উন্নয়নের অনুপস্থিতির অর্থ (কৃষি ও পশুসম্পদ শুমারির তথ্যানুযায়ী) ভূমিহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি যা ১৯৫১ সালের ১৭ শতাংশ থেকে ১৯৮৩/৮৪ সালে ৫৬.৫ শতাংশে দাঁড়ায়। জোতজমার আয়তন বিভাজনের পরিবর্তনশীল বিন্যাসও বাংলাদেশে কৃষক পরিবারগুলির নিঃস্বতার হার বৃদ্ধির একটি সূচক। ক্ষুদ্র খামারের শতকরা হার ১৯৬০ সালের ৫১.৬% থেকে ১৯৯৬ সালে ৭৯.৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র আকারের খামারের গড় আয়তন একই সময়ে ১.১১ একর থেকে হ্রাস পেয়ে ০.৯ একরে পৌঁছয়। ক্ষুদ্র খামারের বেশির ভাগই টেকসই নয়। অন্যদিকে, মাঝারি ও বড় জোতজমার অনুপাত তথা এসব জোতজমার গড় আয়তন গত ৩৬ বছরে ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮৪ সালের ভূমিসংস্কার অধ্যাদেশ কৃষিজমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা প্রতি পরিবারের জন্য ১৯৭২ সালের ১০০ বিঘা থেকে ৬০ বিঘায় হ্রাস করেছে। ১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী ১৫ একর বা ততোধিক পরিমাণ জমির খামারের আয়তন দেশের মোট ভূমির মাত্র ০.৪%, অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার অধিক সকল জমি অধিগ্রহণ (যা হবে অত্যন্ত কঠিন কাজ) করলেও এভাবে প্রাপ্ত ভূমি নড়বড়ে খামারগুলিতে পুনর্বণ্টনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এখানেই সমস্যার মূল জটিলতা নিহিত যার মুখোমুখি বাংলাদেশের কৃষি এবং গোটা অর্থনীতি।  [এম মোফাখ্খারুল ইসলাম]

কৃষিভূমি (Agricultural land)  ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমিই প্রধান উপাদান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এটি একটি অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশে আরও অধিক জমি কৃষিকাজের আওতায় আনার সুযোগ অতি অল্প বা একেবারে নেই বললেই চলে; তাই বর্তমানে জমি ও মানুষের অসন্তোষজনক অনুপাত (০.০৬) বিদ্যমান।

বাংলাদেশের মোট আয়তন প্রায় ১৪.৩ মিলিয়ন হেক্টর যার প্রায় ১৭.৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি, ২২.৭ শতাংশে রয়েছে স্থায়ী জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি এবং অবশিষ্ট ৫৯.৮ শতাংশ জমি কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা যায়। অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভূমির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ মিটার হতে ৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ভূ-প্রাকৃতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভূমিতে রয়েছে পাহাড় (১২%), উচ্চ সমতলভূমি (৮%) এবং বন্যাপ্লাবিত সমতলভূমি (৮০%)। বর্ষা মৌসুমে সমতলভূমির বিশাল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। বন্যার গভীরতার উপর ভিত্তি করে ভূমিকে উচ্চ ভূমি (৩৬%), মধ্যম উচ্চ ভূমি (৩৯%), মধ্যম নিচু ভূমি (১৫%), নিচু ভূমি (৮%) এবং অতি নিচু ভূমিতে (২%) শ্রেণিভুক্ত করা হয়ে থাকে। ভূমি ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলির ভিত্তিতে ভূমিকে ত্রিশটি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে এবং ৮৮টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে।

সকল জমি সব ধরনের ফসলের জন্য উপযুক্ত নয়। মাটির বুনট অতিহালকা না হলে ধান সব ধরনের জমিতেই চাষ করা যায়। তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদ খরিফ মৌসুমে অল্প গভীর বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে সীমিত। যেসব এলাকায় বন্যার পানি দীর্ঘ স্থায়ী হয় এবং পানির গভীরতা বেশী সেসব এলাকায় একটি স্থানীয় জাতের ধান (জলি আমন) চাষ করা যায়। রবি মৌসুমে উত্তম নিষ্কাশনযুক্ত উচুঁ ও মাঝারী উচু জমিতে অনেক ধরনের ফসলের চাষ করা হয়। তবে যেসব জমির অভ্যন্তরিন নিষ্কাশন অতি মন্থর এবং যেখানে সেচ সুবিধা প্রদান করা যায় এবং ফসল তোলার আগে যেখানে বন্যার কোনো প্রকোপ দেখা দেয় না সেসব জমি রবি মৌসুমে উফসী জাতের ধান চাষের জন্য উপযুক্ত। শুষ্ক মৌসুমে মৃত্তিকার লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এবং যথোপযুক্ত মানসম্পন্ন সেচের পানি না পাওয়ার কারণে উপকুলীয় অঞ্চলসমূহের কৃষি জমির ব্যবহার বর্ষা মৌসুমের ফসল চাষের মধ্যে সীমিত থাকে। এ কারণে উপকুলীয় অঞ্চলসমূহে ফসল উৎপাদনের ব্যাপকতা নিম্ন মাত্রার। মানসম্পন্ন সেচের পানির নিশ্চতার সঙ্গে সাধারণত উচুঁ থেকে মধ্যম উঁচু জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল নিবিড়ভাবে চাষের অনুশীলন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে গড়ে ১৭৬ শতাংশ হারে ফসল আবাদের ব্যাপকতা সম্বলিত মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর। এক ফসলি, দুই এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ হলো যথাক্রমে ২.৮৪, ৩.৯৮ এবং ০.৯৮ মিলিয়ন হেক্টর। মোট ফসলি জমির ৭৭ শতাংশ জমিতেই ধানের চাষ করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ করা হয় প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতে।

এক বিরাট সংখ্যক খামার মালিকানা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কৃষি জমি খন্ড খন্ড হয়ে ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়েছে। গড়ে প্রায় ০.৫ হেক্টর আয়তনের জমির খামার মালিকের সংখ্যা হলো প্রায় ১৯ মিলিয়ন। প্রতিটি জোতজমায় আবার রয়েছে কয়েক টুকরা জমির খন্ড, সাধারণত যার আয়তন ০.১ থেকে শুরু করে ০.২ হেক্টর।  [নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া]

কৃষি জমি হ্রাস (Decline of agricultural land)  আমাদের দেশে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ফলে আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ। বিগত আশির দশকে পল্লী এলাকায় গ্রামবাসীদের বসতবাটি ও কৃষি বহির্ভূত কাজে ব্যবহূত হতো শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ জমি, এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগে। ১৯৮৩-৮৪ সালে দেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একর। ১৯৯৬ সালে তা হ্রাস পায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে। এই ১২ বছরে আবাদি জমি হ্রাস পেয়েছে গড়ে প্রায় ১ শতাংশ হারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগরায়ন ও শিল্পায়ন। তদুপরি রাস্তাঘাট, ইটের ভাটা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের তাগিদ বাড়ছে। তাতেও কৃষি কাজের বাইরে চলে যাচ্ছে অনেক আবাদি জমি। নদী ভাঙনের ফলেও হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জমি। বর্তমানে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতক। একজন মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য এর প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ জমির প্রাপ্যতা একান্ত আবশ্যক।

কৃষি জমির প্রাপ্যতা হ্রাস তথা এর অপ্রতুলতার পরিণতি হলো খাদ্যাভাব, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য। নতুন প্রযুক্তি ধারণের ফলে বিগত ৩ দশকে আমাদের কৃষির উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র্য অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগতভাবে কৃষি জমি হ্রাসের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পরও এদেশে খাদ্য ঘাটতি রয়েই গেছে। প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ লাখ টন খাদ্য শস্যের আমদানি করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। আমাদের এই পরনির্ভরতা কাটানোর জন্য ক্রমাগতভাবে কৃষি জমি হ্রাসের বর্তমান প্রবণতাকে অবশ্যই ঠেকাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

কৃষি জমি হ্রাসের বিষয়টি নিয়ে গত এক যুগ ধরে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু তেমন কার্যকর কোন পদক্ষেপ এ নাগাদ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার এ সমস্যাটিকে বেশ আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয়। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং কৃষি জমির অকৃষি কাজে ব্যবহার বন্ধের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অত:পর এ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একনেকের এক সভায় তিনি রাস্তা-ঘাট কিংবা সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে কৃষি জমির মাটি না কাটা এবং ইট তৈরিতে কৃষি জমির মাটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সব ক্ষেত্রে তিনি নদী ও খালের মাটি ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর ফলে একদিকে যেমন কৃষি জমির অকৃষি কাজে ব্যবহার হ্রাস পাবে, তেমনি পুনঃ খননের কারণে নাব্যতা ফিরে পাবে স্থানীয় খাল ও নদীগুলো। তাতে সেচ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও হবে ত্বরান্বিত। এদিক থেকে বর্তমান সরকারের কৃষি জমির ক্রমাগত সংকোচন রোধ ও তা সংরক্ষণের অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়।

কৃষি জমি হ্রাসের পেছনে কারণগুলো বহুমাত্রিক। এর প্রতিকারের জন্যেও চাই বহুমুখী পদক্ষেপ। পরিবার প্রতি তথা মাথাপিছু কৃষি জমি কমে আসার মূল কারণ হলো জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি। তাতে চিরায়ত যৌথ পরিবারগুলো ভাংছে, খামারের সংখ্যা বাড়ছে। হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জোতের পরিমাণ। ১৯৬০ সালে মোট খামারের সংখ্যা ছিল ৬১ লাখ ৩৯ হাজার। ১৯৯৬ সালে তা ভেঙ্গে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯৭ হাজারে উপনীত হয়। এ সময়ের ব্যবধানে প্রতিটি কৃষি জোতের গড় আকার ৩.৫৪ একর থেকে হ্রাস পায় ১.৭১ একরে। কৃষি জোতের বর্তমান ক্ষুদ্র আকৃতিকে কোন ক্রমেই আধুনিক চাষাবাদের জন্য সহায়ক বলা চলে না। এভাবে কৃষি জোতের গড় আকৃতি হ্রাস ও মাথাপিছু কৃষি জমি কমে আসাকে ঠেকাতে হলে সবার আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আমাদের জনসংখ্যা। বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১.৫ শতাংশ। এটাকে নিয়ে আসতে হবে শূন্যের কোঠায়। তজ্জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশের জনগণকে। এর জন্যে চাই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। সরকারের একজন মাঠ কর্মী যখন সম্প্রসারণ বার্তা নিয়ে মানুযষের কাছে যায়, তখন দশ, বিশ কিংবা ত্রিশজন মানুষ তাতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতা যখন একই বিষয়ে কথা বলেন, তখন উদ্বুদ্ধ হয় হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ মানুষ। এ বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে।

এক হিসেব থেকে দেখা যায়, আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ জমি শস্য চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ৪০ ভাগ জমি মধ্যম মাত্রার উপযোগী আর বাকি ২৫ ভাগ জমি শস্য উৎপাদনের জন্য কম উপযোগী। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য খাবার যোগাতে হলে ফসল চাষের জন্য ভালো উপযোগী জমি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। অকৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ছাড় দিতে হবে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের জমি। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে চাষযোগ্য জমি অকারণে গ্রাম সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহূত না হয়। ছোটখাটো শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে গ্রামীণ গ্রোঁথ সেন্টারগুলোকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে বাড়িঘর তৈরি না করে সুপরিকল্পিতভাবে তা স্থাপন করতে হবে রাস্তার দু’পাশে, নির্ধারিত এলাকায়। গ্রামীণ আবাসনের জন্য যেখানে সম্ভব, সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বহুতল দালান। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে সহজ কিস্তির ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এই উদ্দেশ্যে গ্রামীণ এলাকাকে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক এবং কৃষি জোনে চিহ্নিত করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ। তেমনিভাবে শহর এলাকাগুলোকেও আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা হিসেবে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ এবং খেলাধুলার স্থানগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে আলাদাভাবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই কেউ ল্যান্ড জোনিংকে অমান্য করে নতুন স্থাপনা গড়তে না পারে।

কৃষি জমির অকৃষি কাজে ব্যবহার ছাড়াও জমির উর্বরতা হ্রাস এখন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির বড় অন্তরায়। জমিতে অসম পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার, বারংবার একই ফসলের চাষ, উচ্চ নিবিড়তায় অবিরাম চাষাবাদ ইত্যাদি কারণে জমি ক্রমেই উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে পলিমাটি ও জৈবসার ব্যবহার এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় মাটির উৎপাদনশীলতা পুনরুদ্ধার করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। যেখানে সেচ ও পানি নিষ্কাশন দরকার সেখানে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া কৃষি কাজের আওতাভুক্ত করতে হবে পরিত্যক্ত গ্রামীণ জমিগুলো। সেই সঙ্গে বনভূমি, টিলা ও জলাভূমিকে পুরোপুরি সংরক্ষণ করতে হবে যাতে পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়।

আমাদের দেশের বনাঞ্চলগুলো ক্রমেই উজাড় হচ্ছে। গাছ কেটে মানুষ বিরাণভূমিতে পরিণত করছে সংরক্ষিত বনভূমি। সেদিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। বনায়নের উপযোগী ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়নের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ প্রক্রিয়াকে ঠেকানো যেতে পারে। তাছাড়া জুম চাষ ও স্থানান্তরিত চাষাবাদের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমির যে ক্ষতিসাধন হচ্ছে, জুমিয়াদের পরিকল্পিত স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার প্রতিকার করা যেতে পারে। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক নতুন চর জেগে উঠছে। ভূমি উদ্ধার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন জেগে উঠা চরে উপযুক্ত চাষাবাদের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতার অভাবহেতু প্রয়োজনের তুরনায় অনেক বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তাতে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি চাষের আওতাবহির্ভূত হয়ে যায়। কিন্তু সেই অধিগৃহীত জমি সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা হয় না। আমাদের দেশে অনেক শিল্প নগরী আছে যেখানে অধিগৃহীত জমির ব্যবহার অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন কাজে আমাদের অধিকৃত কৃষি জমির শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে। এটা নিতান্তই অপচয়। এই অপচয় রোধ করতে হবে। বিশেষ করে সেচ সুবিধাযুক্ত জমির অধিগ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। যে জমিতে দুই বা ততোধিক ফসল ফলে, এমন জমি ইটের ভাটা স্থাপন ও ব্যক্তিগত নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে হলে তা ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। যেখানে সম্ভব, সরকারি খাস জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অপরদিকে অধিগ্রহণকৃত অব্যবহূত জমি কৃষি কাজে ফিরিয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশে এমন অনেক রাস্তা-ঘাট আছে যেগুলোর একান্তই প্রয়োজন ছিল না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তার নিজের সুবিধার জন্য বাড়ির আঙ্গিনা দিয়ে সরকারি অর্থে রাস্তা নির্মাণ করেছেন, এমন উদাহরণও একেবারে কম নেই। এগুলো নিরোৎসাহিত করতে হবে। তাছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, মহাসড়কের দুই ধার, স্কুল-কলেজের আঙ্গিনা, স্থানীয় জলাভূমি ইত্যাদির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোতে বিভিন্ন শস্যের চাষ, ফল বৃক্ষ রোপণ, পশু-পাখি পালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদি উৎপাদনমূলক কর্মকান্ডের প্রসার ঘটিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম করতে হবে।

ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক আইন প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশে। এর কোনটা এখনো প্রয়োজনীয়, কোনটা একেবারেই সেকেলে। এগুলো বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পর্যালোচনা করিয়ে নিতে হবে। তার উপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হবে একটি নতুন ভূমি ব্যবহার নীতিমালা। যার মাধ্যমে কৃষি জমির অকৃষি কাজে ব্যবহার রোধ করা যাবে। নিশ্চিত করা যাবে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার।  [জাহাঙ্গীর আলম]

কৃষি জীববৈচিত্র্য (Agricultural biodiversity)  অঞ্চল বিশেষে কৃষি কার্যক্রমে ব্যবহূত বিভিন্ন জীবসম্পদ। এদেশের গোটা ভূভাগ প্রধানত বদ্বীপ দ্বারা গঠিত। উপমহাদেশের নানা সামাজিক-বাস্ত্তসংস্থানিক অবস্থান থেকে, এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশ থেকেও এদেশে মানুষের আগমন ঘটেছে। শত শত বছর যাবৎ এখানকার মানুষ প্রায় ৮৫ ধরনের কাজে ১৩৬৪ প্রজাতির দেশী-বিদেশি উদ্ভিদ চাষ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে আসছে। এদেশে প্রায় ১৭৫ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ জন্মে। শতকের পর শতক বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবহার সাপেক্ষে তাদের চাহিদা অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে আসছে। প্রায় ৮-১০ হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান, পাট, আখ, তুলা, তিসি, সরিষা, শসা, শিম, লাউ, কলা, আম, বেল, বেগুন, শাকসবজি, জাম, হরীতকী, আমলকি, বহেড়া, আদা, হলুদ ইত্যাদি নিজেদের পছন্দ মতো উৎপাদন করছে। পরিবারের মহিলারাও নিজেদের প্রয়োজনে বসতবাড়িতে এবং ক্ষেতজমিতে যথেষ্ট পরিমাণে সময়োপযোগী উদ্ভিদের চাষ ও সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পেশাজীবী পরিবারে তৎকালীন অর্জিত ভেষজবিদ্যার চর্চা আজও টিকে আছে। ধানের জীববৈচিত্র্য অত্যধিক। এদেশে ধানের প্রায় ১০,০০০ প্রকারভেদ/স্থলজ জাত ছিল। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ধানের শনাক্তকৃত প্রায় ৭৪৩৯টি জেনেটিক সম্ভারের মধ্যে রয়েছে ৬৩টি ভ্যারাইটি, ১৮টি সংকরীকৃত এবং অবশিষ্ট সবগুলি অবিমিশ্র ধারার নির্বাচন। কৃষকরা বর্তমানে শেষোক্তদের মধ্যে মাত্র ২২টি এবং আধুনিক ভ্যারাইটির ৩৭টি ধানের চাষ করে। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ধানের তিনটি বনজ প্রজাতি শনাক্ত করা গেছে। গোপালগঞ্জ ও সিলেটের নিম্নভূমি এলাকা গভীর পানির ধানের জাতগুলির আদি উৎস বলে ধরা হয়। ধানের অন্যান্য অনেক জাতও দেশের নানা অঞ্চলের স্থলজ ভ্যারাইটি থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভূত। আর্থিক বিবেচনায় উচ্চফলনশীল (HYV) জাত প্রবর্তনের ফলে ধানের অনেক আদি জাত ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গম (Triticum aestivum) এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য। একটি দেশীয় বাদে গমের আর সবগুলি জিনগত উৎপাদন সংযোজিত এবং সংকরীকরণের ধারায় স্থানীয়ভাবে সমৃদ্ধ। অপ্রধান ফসলের অধিকাংশই দেশীয় জাতের। অবশ্য কাউন, চীনা ও অল্প কয়েকটি জাতের ধান এগুলির অন্তর্ভুক্ত। দেশী পাটের (Corchorus capsularis) ক্ষেত্রে ৯৫৮টি ধরন (accessions) আছে। তোষাপাট (Corchorus olitorius) বাংলাদেশে একটি নতুন সংযোজন। পাট প্রজাতিগুলির জেনিটিক সম্ভার বাংলাদেশে তুলার ওপর চাপ সৃষ্টি করায় শেষোক্তটি এখন বিলুপ্তপ্রায়।

অধিকাংশ তৈল ফসল বিশ্বের এ অঞ্চলের স্থলজ প্রজাতি থেকে নির্বাচিত ও বিকশিত। বারোশ’র বেশি উদ্ভিদ জেনিটিক সম্ভার (PGR) সমৃদ্ধ ১০টি বর্ষজীবী প্রজাতি আছে যাদের অধিকাংশ থেকেই নানা ধরনের তৈল ও চর্বি উৎপন্ন হয়। সরিষা ও রেপসিড দুটি গুরুত্বপূর্ণ তৈল বীজ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য Brassica campestris এবং B. juncea। এগুলিতে বিদ্যমান প্রায় ৫০০ PGR নতুন নতুন প্রকারভেদ সৃষ্টির জন্য ব্যবহূত হচ্ছে। তদুপরি ৭০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে B. napus, B. carinataB. nigra প্রজাতিগুলির চাষ প্রবর্তিত হয়েছে। চীনাবাদাম (৪২০), সয়াবিন (১৪৫) ও তিল (১৩২) হচ্ছে অত্যধিক PGR সমৃদ্ধ তিনটি প্রজাতি যেগুলি এদেশে চাষ ও ব্যবহূত হচ্ছে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকান প্রজাতির সয়াবিন বাংলাদেশে প্রথম প্রবর্তিত হয়। আমেরিকান প্রজাতির সয়াবিন, এর আদিরূপ চীনের সয়াবিনের PGR থেকে যথেষ্ট ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বনজ দেশী সয়াবিন PGR দেখা যায়। ইদানিং প্রবর্তিত তেলপাম ছাড়া চর্বি ও তেলপ্রদায়ী আরও কিছু বৃক্ষ আছে।

ডালসহ শিমজাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফসল এ অঞ্চলে লভ্য অনেকগুলি প্রাকৃতিক জাত থেকে নির্বাচিত হয়েছে। সংগ্রহের হিসাব থেকে দেখা যায় যে, ৭০৯৯ PGR-র মধ্যে ৩৪৬৩টি মাত্র ৮টি প্রজাতি থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন। অবশিষ্টগুলি প্রবর্তিত এবং এদের অনেকগুলি কৃষিক্ষেত্রে সুফলদায়ক এবং চলিত উৎপাদন প্রণালীতে সুঅভ্যস্ত। প্রবর্তিত বিদেশি প্রজাতিগুলির মধ্যে মসুর, খেসারি ও মুগ প্রধান।

বাংলাদেশ ইক্ষুর উৎস কেন্দ্রের নিকটেই অবস্থিত, আর এটি ভারত ও পাকিস্তানে পৌঁছতে অনেকগুলি জেনিটিক সম্ভার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটই যথাক্রমে Saccharum officinarumS. spontaneum দুই প্রজাতির যথাক্রমে ৪৫৯টি ও ২৬টি PGR সংরক্ষণ করছে। চিনি বিটের কিছু PGR ছাড়া অন্যতর কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিনি ফসল নেই। প্রতি বছর খেজুরের রস থেকে যথেষ্ট পরিমাণ পাটালি গুড় উৎপন্ন হয়। প্রায় ২৪ প্রজাতির PGR আছে, যেগুলির নির্যাস থেকে মৌমাছিরা মধু তৈরি করে। বার্ষিক উৎপন্ন মধুর পরিমাণ যথেষ্ট এবং তা চিনির অন্যতম বিকল্প।

পর্যাপ্ত সংখ্যক PGR-সহ ৩৩ প্রজাতির সাধারণ ফল রয়েছে। বৈচিত্র্যময় এসব ফলের মধ্যে আছে আম, বাতাবিলেবু, পেয়ারা ও কাঁঠাল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাগানে এগুলির ৪৬৩টি প্রকারভেদ শনাক্ত করা গেছে। গৌণ ফলসমূহের মধ্যে আছে ৫৪টি প্রজাতি ও ২৯৮টি জাত, আর শেষোক্তদের ২০৭টি স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত। বাংলাদেশে বনজ ফলের ৫২ প্রজাতি রয়েছে। তিন ধরনের PGR আছে যেগুলির মূল ও কন্দ থেকে সবজি (১১ প্রজাতি), পাতা (৮ প্রজাতি) ও ফল (২০ প্রজাতি) পাওয়া যায়। এ ৩৯ প্রজাতির ১৮৮৮টির অধিক PGR রয়েছে আর নির্বাচক ও ভোক্তাদের পছন্দ সাপেক্ষে কৃষি-বাস্ত্তসংস্থানিক এলাকার বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী উপাদান নির্বাচনের ফলেই এত অধিক সংখ্যক প্রকারভেদের উদ্ভব ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ প্রতিটি বেগুন, টমেটো, মূলা, কুমড়া, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, দেশী শিম, ডাঁটাশাক এবং আরও অনেকগুলির অন্যূন ৫/৬ রকমের বাণিজ্যিক প্রকারভেদ দেখা যায়।

কমপক্ষে ১৭টি প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের মসলা উৎপাদন করে এবং ২১টি প্রজাতি থেকে খাদ্যের নানা রকমের রং উৎপন্ন হয়। মসলা ও খাদ্য-রং উৎপাদক মাত্র ৯ প্রজাতির ৩০৩টি PGR আছে, যাদের অনেকগুলিই ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণযোগ্য। এদেশে রয়েছে বিচিত্র ধরনের ফুল ও লতাপাতাপূর্ণ উদ্ভিদ প্রজাতির বিপুল সমাহার। বাহারি গাছপালা, অর্কিড, কাচঘরের গাছ, জলজ উদ্ভিদ, গোলাপ, সংরক্ষিত উদ্ভিদ, বিশেষ পরিবেশের গাছপালা (৭৭ গোত্র ও ২৫৩ গণ) এবং ক্যাকটাস, পাথুরে পরিবেশের ঔষধি ও দেয়াল লতার অসংখ্য প্রজাতি আছে। বস্ত্তত বহু বিচিত্র PGR-সহ এ দলে আছে ৭৮১ প্রজাতি ও প্রকারভেদ। এসব প্রজাতির অনেকগুলিই দেশী। কিছুসংখ্যক গোলাপ ও ক্যাকটাসের অধিকাংশ এবং বিভিন্ন ধরনের বহু অর্কিড, বাহারি উদ্ভিদ ও কাচঘরের গাছপালার বহু প্রজাতিই বিদেশী।

চা এদেশের একটি বিশিষ্ট অর্থকরী ফসল এবং চায়ের জ্ঞাত PGR থেকে দেখা যায় যে, ক্লোনের স্থানীয় সংগ্রহ ২৪৬ আর বহিরাগত উপাদান মাত্র ২৮। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট মাত্র ২৮টি স্থানীয় এবং ১৭টি বহিরাগত ক্লোন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে রক্ষণাবেক্ষণ করছে। কফির প্রজাতি মাত্র ৩টি আর কফি এদেশের বাণিজ্যিক ফসল নয়।

অত্যন্ত সীমিত বনাঞ্চল এবং মানুষ ও জমির অনুপাত অতি অল্প বিধায় বনবৃক্ষের প্রজাতিগুলির PGR সামাজিক ও কৃষি-বনায়ন প্রক্রিয়ায় বিস্তার লাভ করেছে। এজন্য বনজ বৃক্ষের প্রজাতি বৈচিত্র্য এখন সারা দেশে দেখা যায়। ইদানিং বাড়ির আশেপাশে, খাসজমিতে ও শস্যক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উদ্ভিদ প্রজাতি সম্পর্কে নানা লিখিত তথ্যাদিও এখন সহজলভ্য।

প্রায় ২৪ প্রজাতির দারুবৃক্ষের অধিকাংশ কাঠ আসবাব তৈরীতে ব্যবহূত হয়। কৃষি যন্ত্রপাতি, নৌকা, ট্রলার ও জাহাজ, কাগজের মন্ড ও কাগজ ইত্যাদি প্রস্ত্ততে ব্যবহূত বৃক্ষ প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ২৪, ৫২, ৩০। সেতু, রেলের স্লিপার, গরুর গাড়ি ও অন্যান্য গাড়ি, পরিবহণ শিল্প, বিদ্যুতের খুঁটি, পাইলিং ও জেটি নির্মাণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ব্যবহূত হয়। এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ অঞ্চলের মানুষ নানা ধরনের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বৃক্ষের চাষ ও পরিচর্যা করে এসেছে। কোনো কোনো বৃক্ষ একাধিক কাজেও ব্যবহূত হয়।  [লুৎফুর রহমান]

আরও দেখুন তুলা; ফল; পাট; ধান; চা; গম

প্রধান ফসল উৎপাদন (Production of major crops)  উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয় নানা ধরনের ফসল চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া যথেষ্ট অনুকূল। বর্তমানে এদেশে প্রায় ১০০ জাতের ফসল উৎপন্ন হলেও ধানই প্রধান শস্য, ফলে বছরের তিনটি ফসল মৌসুমেই মোট ফসলি জমির (১৩ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর) প্রায় ৭৭% জুড়ে ধানের চাষ হয়। মোট ধানক্ষেতের ৭৫ শতাংশ জমিতে ফলে উচ্চফলনশীল জাত। অন্যান্য ফসলের মধ্যে আছে গম, পাট, তৈলবীজ, ডাল, তামাক, তুলা, ইক্ষু, ফল ও শাকসবজি।

সারণি ১ বাংলাদেশের প্রধান ফসল উৎপাদনের জমির আয়তন ও উৎপাদনের পরিমাণ (২০০৪-২০০৭)।

ফসল জমির আয়তন (০০০ হেক্টর) উৎপাদন (০০০ মে টন)
ধান (মোট) ১০,৪৯৬ ২৬,৩৩৫
গম ৪৭৯ ৮১৬
ভুট্টা ১০৫ ৫৯৩
আলু ৩২৪ ৪,৭২৮
পাট ৪০৪ ৮১৯
আখ ১৫৩ ৫,৯০১
ডাল (একত্রে) ৩৫০ ২৮৯
তেল (একত্রে) ৩৪৪ ৬৪৩
মসলা ৩২৪ ১,১৯৬
তামাক ৩১ ৪১

বাংলাদেশে বৃষ্টিনির্ভর ও সেচনির্ভর উভয় ধরনের জমিতেই ফসল ফলানো হয়। অবশ্য এখনো প্রথমোক্ত চাষেরই প্রাধান্য, প্রায় ৬০% জমিই বৃষ্টিনির্ভর। এই ধরনের চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিরাচরিত চাষপদ্ধতি, স্থানীয় জাতের ফসল, অল্প সার প্রয়োগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব। উৎপাদনশীলতা সাধারণত কম এবং বছর বছর উৎপাদনের ওঠা-নামা অত্যধিক। খরা ও অতিবৃষ্টি দুটির জন্যই কৃষি উৎপাদনে অস্থিরতা বিরাজ করে। সেচনির্ভর কৃষি সচরাচর HYV-র মতো উচ্চতর প্রযুক্তি, অধিকমাত্রায় সার প্রয়োগ ও উন্নতর ব্যবস্থাপনা এর সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে এই ধরনের চাষের উৎপাদনশীলতাও অধিক এবং স্থিতিশীল।

আরও দেখুন ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পাট, আখ, ডাল, মসলা, তামাক

ফসল বিন্যাস (Cropping pattern)  বছরের বিভিন্ন চাষ মৌসুমে ফসলের স্থানগত ও কালগত ব্যবস্থাপনা প্রধানত ভৌত, জৈবিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বছরে রবি, খরিফ-১ বা প্রাক-খরিফ ও খরিফ-২ এই তিনটি ফসল মৌসুম চালু আছে। ধান প্রধান ফসল বিধায় ফসল বিন্যাসে ধানেরই প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। ভূমির ধরণ, মাটির বৈশিষ্ট্য ও পানির প্রাপ্যতার নিরিখে বছরে এক, দুই বা তিন বার ধানচাষ হতে পারে। সেচ সুবিধা আছে এমন উঁচু জমিতে দুই বা তিন বার ধানচাষ হয়ে থাকে। মাঝারি নিচু জমিতে আউশ ও বোনা আমনের মিশ্রচাষ আর অন্যদিকে খরিফ মৌসুমে গভীর বন্যাপ্লাবিত জমিতে একবার বোনা আমন (জলি আমন ধান) বা রবি মৌসুমে বোরো চাষ হয়ে থাকে। ধান ছাড়া অন্যান্য ফসল সচরাচর রবি এবং খরিফ-১ মৌসুমে ফলানো হয়। এই জাতীয় অধিকাংশ ফসলই জমির শুকনো অবস্থায় চাষ শুরু হয়, যদিও পাট (দেশী জাতের), কাউন ও আখ পরিপক্ক হলে কিছুটা পানি সহ্য করতে পারে। খরিফ-১ মৌসুমে পাট চাষ হয় এবং তা জমির জন্য বোনা আউশের বিকল্প ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়। জমির ধরণ, বন্যার পানি নামা ও পরবর্তী শস্য তোলার সময়ের ভিত্তিতে রবি মৌসুমের ফসল বিন্যাস হতে পারে আগাম, মধ্য ও নাবি।

বৃষ্টিনির্ভর শুষ্ক এলাকায় খরাসহিষ্ণু স্বল্পকালীন শস্য প্রজাতিগুলির চাষ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সনাতন চাষপদ্ধতিতে অধিক ফসল উৎপাদন কঠিন হলেও তা সাধারণত অধিকতর স্থিতিশীল। মৌসুমি ফসলে মিশ্রচাষ ও মধ্যবর্তী ফসল চাষের ব্যাপক প্রয়োগও আরেকটি বিবেচ্য বিষয়। এই পদ্ধতি কৃষককে একই জমি থেকে বিভিন্ন জাতের ফসল তোলা, মোট উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শিমজাতীয় ফসল চাষের মাধ্যমে জমির উর্বরতা অটুট রাখা ও বৃদ্ধির সুযোগ যোগায়। বোনা আউশ, পাট, ভুট্টা, যব ও ছোলা বৃষ্টিনির্ভর শুষ্ক জমির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসল। দুইয়ের অধিক ফসল চাষপদ্ধতির অর্ন্তভূক্ত হলে মিশ্রচাষ,আন্তঃচাষ বা পর্যায়িক চাষ অনুসৃত হয়।

বন্যামুক্ত এলাকায় সেচ সুবিধা রয়েছে এমন জমিতে ধানের পরে ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল বিন্যাস। কোনো কোনো বন্যামুক্ত এলাকায় তিনবার ধানচাষ চালু থাকলেও জমির উর্বরতা শক্তি বজায় রাখার বিবেচনায় তা বাঞ্জনীয় নয়। ফসল বিন্যাসে রবি মৌসুমের প্রথম শস্য হিসেবে শীতকালে গম, ডাল, বা তৈলবীজের মতো একটি ফসল ফলানো উত্তম নির্বাচন।

জমির ধরণ, মাটির বুনট, প্লাবনকাল, বৃষ্টিপাত (পরিমাণ ও বণ্টন) ও কৃষকের সহায়-সম্পদ দ্বারা প্রভাবিত শস্যের উৎপাদন পরিবেশের নিরিখেই সাধারণত বাংলাদেশে অনেকগুলি ফসল বিন্যাস চালু আছে। বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদন পরিবেশে প্রধান প্রধান ফসল বিন্যাসের কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:

পানির প্রাপ্যতা জমির ধরণ রবি খরিফ-১ খরিফ-২
বৃষ্টিনির্ভর অবস্থায় উঁচু-মাঝারি উঁচু গম/আলু/ডাল/ তৈলবীজ/আখ বোনা আউশ/পাট/বোনা আমন রোপা আমন/পতিত
সেচনির্ভর অবস্থায় উঁচু-মাঝারি উঁচু গম/বোরো/আলূ/তামাক/সবজি রোপা আউশ/পতিত পতিত/রোপা আমন

[নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া]

কৃষিশ্রমিক (Agricultural labour)  শস্য উৎপাদন, পশুপালন, মৎস্যচাষ বা বনায়নের মতো বিভিন্ন কৃষিকাজ পরিচালনায় কায়িক শ্রমদাতা গ্রামীণ শ্রমিকশ্রেণীর মূলধারা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে কৃষিক্ষেত্রে সংগঠিত কোনো কৃষিশ্রমের বাজার এবং মজুরি শ্রমের কোনো বিধানও ছিল না। জোতদাররা তাদের জমি সাধারণত বর্গাদারদের মধ্যে বণ্টন করত, কখনও ক্রীতদাস, স্থায়ী মজুর, (বছরচুক্তিতে), ফসলে প্রদত্ত মজুরিতে ভাড়াটে শ্রমিক এবং এমনকি আহার-বাসস্থানের বিনিময়ে মজুর খাটিয়ে জমিজমার একাংশ নিজেরা চাষ করত। বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্রচাষিরা নিজ পরিবারের সদস্যদের কাজে লাগাত, অধিকন্তু কঠোরভাবে অনুসৃত পারস্পরিক বিনিময় প্রথায় শ্রমবিনিময় (স্থানীয় নাম বদলা, গাঁতি ইত্যাদি) অনুসরণ করত। ১৮৪৩ সালে আইনের মাধ্যমে ক্রীতদাস প্রথা রহিত হয়। বদলা প্রথা ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে অধিক প্রচলিত ছিল, কিন্তু ভূমিহীনতা বৃদ্ধি ও মুদ্রা অর্থনীতি প্রবর্তনের ফলে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া খাটা কার্যত বদলা প্রথার স্থান দখল করে নেয়। মজুরের পাওনা তখনও আংশিক হলেও ফসলের মাধ্যমে পরিশোধ করা হতো যা আজও গ্রামাঞ্চলে চালু আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে ১৯৯৫-৯৬ সালে বাংলাদেশের ৫ কোটি ৬০ লক্ষ সাধারণ শ্রমিকের মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লক্ষ (৬৩.২%) কৃষিতে নিয়োজিত ছিল। মোট কৃষি শ্রমিকের ১৮% ছিল বেতনভুক দিনমজুর এবং অবশিষ্টাংশে ছিল খোদ কৃষক ও তাদের পরিবারের বেতনহীন লোকজন। দেশে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ১৯৮৫-৮৬ সালের (১ কোটি ৭৫ লক্ষ) তুলনায় ১৯৯০-৯১ (৩ কোটি ৩৩ লক্ষ) ও ১৯৯৫-৯৬ সালে (৩ কোটি ৪৫ লক্ষ) যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধির মূলে রয়েছে কৃষি কার্যক্রমের আওতায় এখন পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন এবং ফসল মাড়াই, সিদ্ধকরণ, শুকানো ও খোসা ছাড়ানো, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের মতো কর্মকান্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাধারণত গ্রামীণ মহিলারা এ ধরনের কৃষিকাজ করে থাকে। কৃষি শ্রমিকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু। ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৬ লক্ষ শ্রমজীবী শিশুশ্রমিক (কর্মরত শিশুশ্রমিকের ৬৩%) বাংলাদেশের কৃষিতে নিযুক্ত ছিল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মোট কৃষি শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে, কিন্তু অ-কৃষিখাতের তুলনায় কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের হার কমছে। ১৯৮৯ সালে কৃষিতে মোট জনশক্তির ৭৩.৮% নিয়োজিত ছিল যা ১৯৯৫-৯৬ সালে ৬৩.২ শতাংশে নেমে আসে, অন্যদিকে অ-কৃষিখাতে তা ২৬.২% থেকে ৩৬.৮% বৃদ্ধি পায়। আগে অ-কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও দেশে স্বাক্ষরতার হার কম থাকায় কৃষিখাত বিপুল সংখ্যক নিরক্ষর ও অদক্ষ জনশক্তিতে ভারাক্রান্ত ছিল। শিক্ষার বিস্তার ও নগরায়ণের ফলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।

ব্রিটিশ শাসনে প্রবর্তিত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা ভূমিহীন লোকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করে এবং শেষপর্যন্ত এদের অধিকাংশই ক্ষেতখামারের দিনমজুরে পরিণত হয়। ব্রিটিশ শাসকগণ ঘন ঘন দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে কৃষি উন্নয়নে কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে, কিন্তু সকল প্রচেষ্টারই লক্ষ্য ছিল ভূমি মালিক কৃষক, ভূমিহীন দিনমজুর নয়। প্রায় ২৬% গ্রামীণ পরিবারের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র বা প্রধান পেশা ছিল কায়িক শ্রম, আরও ১৩% এটিকে আয়ের সহায়ক উৎস হিসেবে গ্রহণ করত। এভাবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ গ্রামবাসী সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মজুরি শ্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৯০০ সালে বাংলার প্রায় ৬ লক্ষ গ্রামীণ লোকের (মোট গ্রামবাসীর ৭%) প্রধান পেশা ছিল কায়িক শ্রম। বিশ শতকের সত্তরের দশকের প্রথম দিকে মজুরি শ্রমিকের এ সংখ্যা ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ লক্ষে দাঁড়ায় (২৭%)। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পরিচালিত কৃষি জরিপে (১৯৬৫-৬৬) দেখা যায় যে, ইতোমধ্যে ২৫% কৃষকই ক্ষেতমজুরে পরিণত এবং তাদের তিন-পঞ্চমাংশই ভূমিহীন। এতে ক্ষেতমজুরের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়। শ্রমিকের মজুরি ও যাতায়াতের একটি আঞ্চলিক পার্থক্যও ছিল।

গ্রামবাংলায় তিন ধরনের শ্রমিক-এর সহাবস্থান দেখা যায় সাময়িক দিনমজুর, বছরচুক্তি শ্রমিক ও মৌসুমি শ্রমিক। সাময়িক দিনমজুর হচ্ছে সংক্ষিপ্ততম এক চুক্তি যা অর্ধদিবস (বা এক বেলা) থেকে কয়েক দিনের (সাধারণত এক ‘হাট’ সময়, অর্থাৎ দু হাটের মধ্যবর্তী সময়কাল) জন্য হতে পারে। এ নিয়োগে শ্রমিকরা সর্বাধিক স্বাধীনতা পেয়ে থাকে, আবার সর্বাধিক নিরাপত্তাহীনতায়ও ভোগে। দিনমজুররা ব্যস্ত মৌসুমে মজুরি বৃদ্ধির সুবিধা পেলেও একইভাবে মন্দার সময় আবার অনাহারের শিকারও হয়। বছরচুক্তির শ্রমিকরা নিয়োগকারীর বাড়িতে থাকে এবং নগদ অর্থের সঙ্গে খাদ্য-বস্ত্রও পায়। কিশোররা খাদ্য ও বস্ত্রের বিনিময়েই কাজ শুরু করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরচুক্তির শ্রমিকরা এক ধরনের ‘ঋণ-দাসত্বে’ বাঁধা থাকে এবং তারা ঋণশোধের জন্যই নিয়োগকারীর কাজ করে। শীতকালে সাধারণত ফসল তোলার জন্য মৌসুমি শ্রমিকদের ২ থেকে ৪ মাসের জন্য নিয়োগ করা হয়। তারা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত করে এবং মজুরি হিসেবে খাবার ও ধান বা নগদ অর্থ গ্রহণ করে থাকে। মজুরির ধান সাধারণত তোলা ফসলের অংশ (১/১২ থেকে ১/৫)। মজুরির পরিমাণ ও মজুরি পরিশোধের ধরনের মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য থাকলেও আগে সারা বাংলায় মজুরি শ্রমিকদের নিয়োগের শর্ত ছিল প্রায় অভিন্ন। অধিকাংশ স্থানে নিয়োগকারী শ্রমিকের দুপুরের আহার (ভাত ও আনুষঙ্গিক) ও মজুরির বৃহত্তর অংশ নগদ অর্থে প্রদান করত। সকালের হালকা খাবার হিসেবে খই-মুড়ি বা পান্তা, পান-সুপারি ও ডাব দেওয়া হতো। মহিলাদের মজুরি ছিল অপেক্ষাকৃত কম, সাধারণত দ্রব্যের আকারে, পরিমাণ ছিল মাড়াইকৃত বা ভানা শস্যের এক দশমাংশ। সাঁওতাল, বাউরি ও অন্যান্য আদিবাসী মহিলারা অত্যন্ত পরিশ্রমী শ্রমিক।

১৮৮০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে সারা বাংলায় কৃষিশ্রমিকের মজুরি হ্রাস পায়। চালের পরিমাণের সঙ্গে প্রমিতকৃত মজুরি পশ্চিম বাংলায় ২ সের (১ সের=০.৯ কেজি) থেকে পূর্ববাংলায় ৯ সেরের মধ্যে ওঠা-নামা করত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মজুরির পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা প্রধানত উন্নত শ্রমনিবিড় কৃষিপ্রযুক্তি প্রবর্তনের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অধিকতর আয়ের সন্ধানে কৃষিশ্রমিকদের ব্যাপক হারে শহরাঞ্চলে আসার জন্যই ঘটেছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (Vulnerable Group Development/VGD) কর্মসূচি, ভূমি সংস্কার, খাস জমিতে গুচ্ছগ্রাম গঠন, সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ ও উপার্জনমুখী কার্যক্রম বিস্তার ইত্যাদি বর্তমানে কৃষিশ্রমিকদের অবস্থা উন্নয়নে সহায়তা করছে।  [এম সাইফুল্লাহ]

কৃষিঋণ (Agricultural credit)  কৃষিকাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে কৃষক কর্তৃক ঋণ হিসেবে গৃহীত আর্থিক সহায়তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরাঘূর্ণিঝড়জলোচ্ছ্বাস বা  নদীভাঙন) এবং রোগবালাই ও ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণে ফসলহানির ক্ষতি সামলাতে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হয়। ব্যাংক, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সনাতন ঋণদাতা (মহাজন, বেপারি, ধনী কৃষক) বা বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজন এ সহায়তা দিয়ে থাকে। জমির খাজনা বা অতিরিক্ত কর পরিশোধে নগদ অর্থের অভাবে বাংলার কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা আবহমান কালের একটি সমস্যা। বিবাহ ও মরণোত্তর অনুষ্ঠানাদি পালন বা বিবাদ মীমাংসার অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ থেকেও কৃষকগণ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত।

বৈদিক ভারতে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ) মহাজনদের নিকট থেকে কৃষকদের ঋণ গ্রহণের প্রচলন ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রাচীন যুগের মহাজনি ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। মণুর লেখাতেও মহাজনি ব্যবসার উল্লেখ আছে। আববাসীয় যুগে বাগদাদ থেকে আগত মুসলিম ব্যবসায়ীরা উপমহাদেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ধারণার প্রসার ঘটায়। মুগল আমলে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং অর্থের ব্যাপক লেনদেন ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। মুগলরা মহাজনদের সহযোগিতায় ১৭০০ সালে উপমহাদেশের প্রথম ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘হিন্দুস্থান ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করে। ব্যবসা-বাণিজ্যমুখী এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কৃষকসমাজ পেশাদার ঋণদাতা, গ্রামীণ ব্যবসায়ী (মহাজন) ও দোকানদারদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসের ওপর নির্ভর করত, যারা চড়া হারে সুদ আদায় করে সমাজের একটি সম্পদশালী শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

সুলতানি ও মুগল আমলে শাসকরা নিম্নহারে খাজনা মঞ্জুরির সময় কৃষকদের কৃষিঋণ সুবিধাও দিতেন। ‘তাকাবি’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত এ ঋণের মাধ্যমে কৃষকরা বীজ, বলদ, কৃষিযন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ক্রয় করত এবং অনাবাদি জমি আবাদের মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকা চাষাধীন এনে উৎপাদন বাড়াত। ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্যও ছিল কৃষিতে ঋণ সমস্যার সমাধান। প্রত্যাশা ছিল যে, প্রথমবারের মতো জমিদারির স্বত্বাধিকারপ্রাপ্ত জমিদাররা কৃষি উন্নয়নে মূলধন বিনিয়োগ করবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করতে ব্রিটিশ শাসকগণ উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

নবজাত ঋণদান সংস্থাগুলি শহর এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় একচেটিয়াভাবে কাজ করত এবং অর্থায়নের সংগঠিত উৎসসমূহ গ্রামাঞ্চলে পৌঁছত না, যদিও গ্রামগুলিতে সেসময় মুদ্রা-অর্থনীতির ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক ১৯০৪ সালে চালু সমবায় ঋণ আন্দোলন কৃষিঋণ গ্রাহকদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল। ব্যবসায়ী-মহাজনরা অধমর্ণ কৃষকদের নিকট থেকে নিয়মিত সুদ আদায়ের পাশাপাশি তাদের উৎপন্ন পণ্যও একচেটিয়া ক্রয় করে দ্বিগুণ মুনাফা আদায় করত। এ ধরনের বাধ্যবাধকতা উৎপাদকদের প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে সরিয়ে সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি থেকে তাদের বঞ্চিত করত। বাংলার কোনো কোনো স্থানে, বিশেষত ঢাকায় জমিদাররাও লগ্নিব্যবসায় জড়িত ছিল যা কৃষিব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছিল। জমিদার তথা ঋণদাতারা ঋণের বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে এবং একই সঙ্গে খাজনা ও ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করে ঋণগ্রহীতা কৃষকদের ওপর দ্বিগুণ চাপ প্রয়োগ করতে পারত। ধনী কৃষকরা সাধারণত খাবার ও বীজ উভয় প্রয়োজনে ধান ধার দিত যা ফসল তোলার পর পরিশোধ করতে হতো। পণ্য আকারের এ ঋণ ধারকৃত শস্যের প্রকৃত দামের ভিত্তিতে নগদ অর্থেও শোধ করা চলত। কাবুলি ও মাড়োয়াড়ির মতো বেশ কিছু ভিনদেশী মহাজন ছিল যারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এ পেশা গ্রহণ করেছিল। নতুন নতুন ঋণদান সংস্থার উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ঋণদানের এসব বহিরাগত উৎস ধীরে ধীরে লোপ পায়। বাংলার অনেক স্থানে বেনিয়ার মতো সংঘবদ্ধ ঋণদাতারা বর্ণভিত্তিক একটি সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল। বেনিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সাহা ও সুবর্ণ বণিকরা ছিল সর্বাধিক ক্ষমতাশালী শ্রেণি যারা ঋণদানের সুযোগে এমনকি প্রজাদের জমিজমাও দখল করে নিত। ১৯২৮ সালের গোড়ার দিকের ‘মহামন্দা’র সময় অর্থলগ্নিদারদের নিপীড়ন চরমে পৌঁছায়। এ সময় ধান ও পাটের মতো কৃষিদ্রব্যের মূল্য দ্রুত হ্রাসের ফলে কৃষকদের আয় ও ঋণের প্রাপ্যতা হ্রাস পায়। ধনী লগ্নিদাররা সুযোগটি গ্রহণ করে এবং ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমিজমা ছিনিয়ে নেয়। এভাবে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি কৃষকদের কাছ থেকে অ-কৃষক শ্রেণির হাতে চলে যায়, যা পরিণামে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনে বড় রকমের আঘাত হানে। বেঙ্গল প্রাদেশিক ব্যাংকিং অনুসন্ধান কমিটির (The Bengal Provincial Banking Enquiry Committee) প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৯২৯-৩০ সালে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের কাছে অনাদায়ী মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক অনুসন্ধানী বেঙ্গল বোর্ড (The Bengal Board of Economic Enquiry) জানায় যে, ১৯৩৪ সালে বাংলার প্রায় ৭৭% পরিবারই ঋণগ্রস্ত ছিল। অনেক স্থানে ঋণগ্রস্ত কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে। কমিউনিস্ট নেতারা এসব আন্দোলনে প্রায়শই নেতৃত্ব দিতেন। সুদ ও সুদের কারবার ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকায় এসব আন্দোলন কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও রূপ নিত। অনেক স্থানে মুসলমানদের সঙ্গে মহাজনদের (যারা ছিল প্রধানত হিন্দু) সংঘর্ষ বাধে, যদিও কিছু মুসলমান ‘দাদনি’ ব্যবস্থায় অর্থলগ্নি ব্যবসা করত।

‘মহামন্দা’র পর পরিচালিত বিভিন্ন জরিপ কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য কিছু পদক্ষেপ সুপারিশ করে। এদিকে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে কৃষকরা ভোটাধিকার পায় আর তা বাংলায় বিরাজমান রাজনৈতিক পরিবেশে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য তাদের প্রচারে কৃষকদের বর্ধমান ঋণগ্রস্ততার ওপর গুরুত্ব দিতে থাকে। রাজনৈতিক চাপের মুখে আইন পরিষদ কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রণীত বেঙ্গল কৃষি ঋণগ্রহীতা আইন (The Bengal Agricultural Debtors Act) প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ‘ঋণসালিশী বোর্ড’ গঠন সুপারিশ করে। কিন্তু অধিকাংশ ঋণ খাইখালাসী বন্ধকীকৃত থাকায় এসব বোর্ড সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে নি। ‘ঋণসালিশী বোর্ডে’র কার্যকরতার জন্য সরকার ১৯৩৮ সালে বেঙ্গল প্রজাস্বত্ব আইন (The Bengal Tenancy Act) সংশোধন করে এবং সকল বন্ধকী চুক্তি অবৈধ ঘোষিত হয়। সংশোধিত আইন অনুযায়ী মূল ঋণের বেশির ভাগ অর্থ ও সুদ পরিশোধ করা হলে মালিক ১৫ বছর পর জমি ফেরত পেত। লগ্নিকারীর ধার্যকৃত সুদের হার নিয়ন্ত্রণে ১৯৪০ সালে ১৯৩৩ সালের বেঙ্গল অর্থঋণ আইন (The Bengal Moneylending Act) সংশোধন করা হয়। ‘ঋণসালিশী বোর্ডে’র কার্যক্রম সাময়িকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন ঘটালেও ঋণদাতারা উসুল নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে এবং ঋণদান ব্যবসা চালাতে অসম্মত হয়, ফলে ঋণের অভাবে শেষ পর্যন্ত কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। কৃষকদের ঋণ সংস্থানের কোনো বিকল্প না করেই আইনগত বিধান আরোপ করা হয়েছিল। ঋণদাতারা বন্ধক গ্রহণে আগ্রহী না থাকায় কৃষকরা নগদ অর্থ জোগাড় করতে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হতো। বারবার জমি হস্তান্তরের ফলে জমির অত্যধিক খন্ডায়ন এমনকি শেষ পর্যন্ত ভূমিহীনতার সমস্যাও দেখা দেয়। পরিশেষে ১৯৪৫ সালে ‘ঋণসালিশী বোর্ডে’র কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলা হয়।

১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে ৩৬টি তফসিলী ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং-এর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে আর এসব ব্যাংক অনেকগুলি কৃষিঋণ সুবিধা দিত। ১৯৬১ সালে কৃষিঋণ সংশ্লিষ্ট বিশেষ ব্যাংক ‘পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় কুমিল্লা সমবায় মডেলসহ (১৯৫৯) কয়েকটি স্থানীয় শরিকানামূলক গ্রামীণ ঋণদান কৌশলের উদ্ভব ঘটে এবং এগুলি সহজ শর্তে কৃষিঋণ বিতরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

স্বাধীনতার পর সরকার জাতীয় অর্থনীতি জোরদারের উদ্যোগ নেয় এবং কৃষকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে কৃষিঋণ হিসেবে অধিকতর পরিমাণ সম্পদের যোগান দিতে শুরু করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও সংস্থাসমূহের অধিক সংখ্যক শাখা গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে  বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকরাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংকগুলি, চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংক লিমিটেডজনতা ব্যাংক লিমিটেডঅগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডরূপালী ব্যাংক লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী। এসব ব্যাংক ও পল্লী উন্নয়ন বোর্ড সারা দেশে ১৯৯৮-৯৯ ও ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে যথাক্রমে ৩০০৬ কোটি টাকা ও ২৮৫১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে।

সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত কৃষিঋণের ৬০ শতাংশের বেশি বিতরণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে শাখা প্রতিষ্ঠা করছে। মৌসুমি শস্য উৎপাদন, হালের বলদ বা কৃষিযন্ত্রপাতি ক্রয়, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধখামার প্রতিষ্ঠার মতো বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে কৃষকদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ভূমিহীন ও প্রান্তিকচাষি এবং গ্রামীণ মহিলাদের জন্য কয়েকটি বিশেষ কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের ১৭টি বিশেষ কর্মসূচির অর্থায়নে ১৯৯৯-২০০০ সালে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে ১২৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত সকল কর্মসূচিতে সরকারের মোট কৃষিঋণের ২৫% আর শস্য উৎপাদনে ৬০% বিতরণ করা হয়। এসব কর্মসূচির অধীনে ঋণের সুদের হার ১০% থেকে ১৫% হয়ে থাকে।

সরকার নির্ধারিত কৃষিঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতি বছরই অবণ্টিত থেকে গেলেও (১৯৯৮-৯৯ ও ১৯৯৯-২০০০ সালে যথাক্রমে ২৬৪ কোটি টাকা ও ৪৯৭ কোটি টাকা) অনেক দরিদ্র কৃষক জটিল নিয়ম-কানুন ও জামানত সমস্যার জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না। অধিকন্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানি এবং ঋণের দায়িত্বহীন ব্যবহার অনেকক্ষেত্রে ঋণগ্রস্ত কৃষককে ঋণখেলাপিতে পরিণত করেছে। অনাদায়ী কৃষিঋণ (২০০০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৬৫২৫ কোটি টাকা) একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত  গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্রদের মধ্যে জামানতহীন ঋণের যোগান দিতে একটি অপ্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুরু করে। ঋণগ্রহীতাকে নিজেদের উদ্যোগে গঠিত ৫ জনের একটি দল হিসেবে ব্যাংকে উপস্থিত হতে হয়। একজন সদস্য ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, সকল সদস্যের ঋণপ্রাপ্তি বাতিল বা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দলের সদস্যগণ নিজ নিজ ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে পরস্পরকে সহযোগিতা ও উপদেশ দিয়ে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অধিক হারে সুদ আদায় করলেও প্রচলিত ঋণখেলাপি সমস্যাকে অতিক্রম করে কৃষি ও অন্যান্য উপার্জনমুখী কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়নের একটি সফল মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির অধীনে গ্রাহকরা (অধিকাংশই মহিলা) হাঁস-মুরগি বা গাভী পালন, মৎসচাষ, শাকসবজি ও ফলের বাগান বা কুটির শিল্পের মতো ছোটখাটো কাজের মাধ্যমে স্বনির্ভর হচ্ছে। অন্যান্য অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একই ধরনের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং আরও তিনটি প্রধান এনজিও ব্র্যাকআশা ও  প্রশিকা ১৯৯৯-২০০০ সালে ৩৯১৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছ এবং একই বছর ৩৯৪৩ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ আদায় করেছে। ২০০০ সালের জুন মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।

স্থানীয় ও বিদেশি বেসরকারি ব্যাংকসমূহও বর্তমানে কৃষিঋণ অনুমোদন করছে। স্থানীয় বেসকারি ব্যাংকসমূহ ১৯৯৪-৯৫ সালে বিতরণ করে ৫১.৮৭ কোটি টাকা যা ১৯৯৯-২০০০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৫০ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলির বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ১৯৯৮-৯৯ সালে ৪৪.১২ কোটি টাকা এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে ৩৭১ কোটি টাকা। অধিকন্তু, পেশাগত সমবায় সমিতিগুলি নিজেদের সঞ্চয় থেকে সদস্যদের ঋণ মঞ্জুর করে থাকে। এসব সমবায় হচ্ছে সমবায় ভূমিবন্ধকী ব্যাংক, ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি, জেলে সমবায় সমিতি, আখ উৎপাদক সমবায় সমিতি, কৃষি সমবায় সমিতি (ডিপার্টমেন্ট), কৃষি সমবায় সমিতি (বিআরডিবি), দুগ্ধ সমবায় সমিতি, ভূমিহীন কৃষক সমবায় সমিতি, খামার সমবায় সমিতি, তৈল উৎপাদক সমবায় সমিতি, পানচাষি সমবায় সমিতি ও চীনাবাদাম সমবায় সমিতি। এসব সমিতি ১৯৯৬-৯৭ সালে ৫২.২ লক্ষ সদস্যের মধ্যে ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে।

১৯৯৯ সালে প্রণীত কৃষিনীতি জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিসমূহকে সক্রিয় করেছে এবং ঋণবিতরণ ব্যবস্থা সহজীকরণের মাধ্যমে যথাসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণ প্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সহজীকরণ কৌশল ও ঋণ আদায়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় এবং বিতরণকৃত ঋণের আদায় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।  [এম সাইফুল্লাহ]

কৃষিসামগ্রী বিপণন (Agricultural marketing)  কৃষিদ্রব্য, উপকরণ ও কৃষি-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামগ্রী উৎপাদক, ভোক্তা ও মধ্যগসহ অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর নিকট পৌঁছানোর পদ্ধতি। বিপুল সংখ্যক লোক ধান, পাট, শাকসবজি, ফল, গবাদি পশু, দুধ, হাঁস-মুরগি, ডিম ও মাছ ইত্যাদি বাজারজাতকরণে নিয়োজিত রয়েছে। কৃষিদ্রব্য বিপণনের ইতিহাস কৃষির ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। কৃষিভিত্তিক সমাজে পণ্য বিনিময় প্রথার প্রাধান্য ছিল এবং ব্রিটিশ শাসনামলে মুদ্রা অর্থনীতির অনুপ্রবেশ কৃষিদ্রব্য বিপণন সহজতর এবং বিনিময় সমস্যা বহুলাংশে দূর করে। বিভিন্ন শস্যের বাজারমূল্যের হ্রাসবৃদ্ধিতে কৃষকরা অত্যন্ত সংবেদী বিধায় কোনো এলাকার শস্যচাষের ধরন শস্যগুলির ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক ফসল চাষে কৃষকের আগ্রহও কম থাকে। তুলনামূলক লাভক্ষতির বিবেচনা সাপেক্ষে স্মরণাতীতকাল থেকে কৃষকেরা শস্য নির্বাচনে অগ্রাধিকার পরিবর্তন করে আসছে। বিগত সতেরো ও আঠারো শতকে তুলা ছিল বাংলার অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফসল, কেননা তৎকালীন বাংলা ছিল বিশ্বের একটি বৃহৎ বস্ত্র রপ্তানিকারী দেশ। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বস্ত্র রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলাও বাজার হারাতে থাকে এবং ওই শতকের মাঝামাঝি তুলা উৎপাদন অত্যধিক হ্রাস পায়। নীল ছিল আরেকটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পণ্য, কিন্তু সেটিও দীর্ঘদিন বাজার ধরে রাখতে পারে নি। আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে নীলচাষ হ্রাস পেতে থাকে এবং একই সময় একটি স্থানীয় ফসল পাট বাজার দখল করতে শুরু করে যা উনিশ শতকের শেষের দিকে একটি প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠে। পাট বাজারজাতকরণ ও সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে বিপুল কর্মশক্তি নিয়োজিত থাকায় এটি এখনও বাংলাদেশের একটি প্রধান ফসল, যদিও আগের মতো এখন আর ততটা লাভজনক নয়। ব্রিটিশ শাসকগণ চীনের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দুটি আমদানি নির্ভর ফসল চা ও আফিম চাষে প্রণোদনা যোগায় এবং তার ফলে দুটি সম্ভাবনাময় নতুন ফসল চাষ শুরু হয়। চা চাষ আজও অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭ সাল) পরপর তৈলবীজ, খাদ্যশস্য ও আলুর মতো লাভজনক অন্যান্য ফসল আফিমের স্থান দখল করে নেয়। ইক্ষুও দীর্ঘদিন একটি সম্ভাবনাময় ফসল ছিল, কিন্তু উনিশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে বীটজাত চিনিশিল্পের দ্রুত বিকাশের ফলে আখ চাষ হ্রাস পায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক পরিবারের জমির পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত থাকায় তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ফসল উৎপাদন করে। দেশের প্রায় ৫৩% পরিবারেরই জমির পরিমাণ ০.০৫-২.৪৯ একর এবং তারা শুধু আপন অন্নসংস্থানের জন্যই চাষাবাদ করে। বাজারে কৃষিদ্রব্যের সরবরাহে বৃহত্তর অংশীদার মাঝারি (২.৫-৭.৪৯ একর) ও বড় (৭.৫০ একর ও তদূর্ধ্ব) কৃষক, যাদের সংখ্যা যথাক্রমে ১১.৭% ও ১.৭%। দেশে ধান, পাট, তুলা, ইক্ষু ও চায়ের মতো প্রধান পণ্য বিপণন পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও পর্যাপ্ত নয়। খাদ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন, চিনিকল ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড নিজ নিজ ক্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করে। কিন্তু অধিকাংশ কৃষিদ্রব্য বিভিন্ন ধরনের মধ্যগদের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে। সরকারি সংস্থা হিসেবে কৃষি বাজারজাতকরণ অধিদপ্তর বস্ত্তত উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দায়িত্বে রয়েছে। মোট ৩৭৫ জনবল নিয়ে গঠিত অধিদপ্তরটি এ ব্যাপারে সরকারকেও পরামর্শ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত কৃষিদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে চা, কাঁচাপাট, গলদা ও বাগদা চিংড়ি, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও মসলা। এসব পণ্যের রপ্তানি থেকে দেশ ১৯৯৮-৯৯ সালে ১৩.৩ কোটি ডলার আয় করেছে। কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্য, যেমন পাটজাত সামগ্রী, কাঁচা চামড়া, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যও দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ দখল করে আছে।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে ঘোষিত কৃষিনীতিতে কৃষিদ্রব্য বাজারজাতকরণ উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। খামারজাত দ্রব্যাদি যথাসময়ে বিক্রির জন্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষিপণ্যের ওপর দালাল-ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণেও এ নীতিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ রয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো প্রণীত এ কৃষিনীতিতে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে উপেক্ষিত ছিল। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে বাংলা ছিল কাঁচামালের যোগানদার এবং একইসঙ্গে তাদের শিল্পপণ্যের একটি বাজার। তাই ব্রিটিশ শিল্পমালিকদের কাছে কৃষিদ্রব্যের উপযোগিতার নিরিখেই এগুলির বাণিজ্যিক মূল্য উঠা-নামা করত। পাকিস্তানি শাসকরা কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে উদ্যোগী হলেও সেসব শিল্প ছিল আমদানি প্রতিস্থাপক, তাতে কৃষকের বদলে লাভবান হতো শহুরে শ্রেণি। সেসময়ে বাজারমূল্যের চেয়ে কমদামে বাধ্যতামূলকভাবে ধান/চাল সংগ্রহ চলত এবং পাট রপ্তানির ওপর অত্যধিক কর আরোপ করা হয়েছিল। উনিশ শতকের ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত তদনীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বর্তমানে বিএডিসি) বিভিন্ন কৃষি উপকরণ বিতরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে সংগৃহীত বীজ, সার, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি জেলা ও থানা পর্যায়ের লাইসেন্সধারী ডিলারদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। সেগুলি ডিলাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের সরবরাহ করত। এক্ষেত্রে তাদের আয় ছিল কেবল পূর্ব নির্ধারিত কমিশন। স্বাধীনতার পর কৃষিদ্রব্য ও কৃষি উপকরণ বিপণনে এসব নীতি বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়। সরকার বিগত তিন দশকে নিয়ন্ত্রণ গুটিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে এবং কৃষি উপকরণ ও খাদ্যশস্যের সংগ্রহ ও বিতরণে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে বর্তমানে রপ্তানিমুখী শিল্প সহায়তা পাচ্ছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী আমদানির পরিবর্তে হাঁস-মুরগি খামার ও দুগ্ধশিল্প সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানিকে উৎসাহ দিচ্ছে।  [এম সাইফুল্লাহ্]

কৃষিনীতি (Agricultural policy)  ভূমি ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষির টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুসরণীয় নির্ধারিত নীতি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও পরিবেশ সম্পর্কে উদ্বেগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি যৌক্তিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় কৃষি ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু প্রাচীন, মধ্য ও ব্রিটিশ যুগের শাসকগণ কৃষির উন্নয়নে খুব সীমিত মনযোগ দিয়েছিলেন। অত্যন্ত উর্বর মৃত্তিকা ও উপযোগী জলবায়ু সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত স্থবিরতা, সেকেলে উপকরণ ব্যবহার এবং ভূমি মালিকানা ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা কৃষকদের জন্য উৎসাহব্যাঞ্জক না হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি ছিল সামান্যই। কৃষি ছিল চাষিদের পেশা, খাজনা প্রদান ছাড়া যাদের সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ খাজনার পরিমাণ আবার মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা ও শস্যের প্রকৃতি অনুযায়ী অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ছিল। খাজনা আদায়ের নামে কৃষকদের শোষণ ও নিপীড়ন করা হতো। কৃষি কাজ বাংলায় কদাচিৎ বাণিজ্যিক ভিত্তি পেয়েছিল এবং কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্যের অর্ধেকের বেশি তার উৎপাদনে ব্যয় হতো। কর আরোপের ফলে উদ্বৃত্ত প্রায় শূন্যে নেমে আসত বিশেষ করে যেখানে কৃষকদের উৎপাদনশীলতা কম ছিল। মধ্য যুগে কৃষির ওপর রাষ্ট্রীয় করের দাবি ছিল মোট উৎপন্ন পণ্যের এক-পঞ্চমাংশ। আকবরের শাসনামলে এ হারের নির্দিষ্ট মান ছিল উৎপন্ন কৃষিপণ্যের এক-তৃতীয়াংশ যা মুর্শিদকুলী খানের শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শাসকগণ অবশ্য কৃষির উন্নয়নে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে কৃষি কাজে পানি সেচের লক্ষ্যে মহিপাল, রামসাগর ও প্রাণসাগর-এর মতো বৃহৎ জলাশয়সমূহ খনন তারই উদাহরণ। পাল ও সেন রাজত্বকালে পশুসম্পদ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছিল। সুলতানি ও মুগল শাসকগণও ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে চাষাবাদের সম্প্রসারণে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কৃষি উপকরণ ক্রয় করার জন্য কৃষকদের ঋণ দেওয়া হতো। নিম্নহারে ভূমি কর মঞ্জুর অনাবাদি জমির আবাদে উৎসাহিত করে।

ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে বাংলায় কৃষি একটি প্রাতিষ্ঠানিকরূপ লাভ করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় নিয়মিতভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমি কর পরিশোধের শর্তে জমিদারগণ ভূমির মালিকে পরিণত হয়। এ আইনে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভিত্তি করে কর মওকুফ বা বাতিলের আবেদন থেকে জমিদারদের বিরত রাখা হয় এবং এতে বলা হয়, যথাসময়ে জমিদারের কর পরিশোধের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তার জমিদারি নিলামে বিক্রয় হবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের সহায়তা ও তত্ত্বাবধানের ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এ উদ্দেশ্য অবশ্য কদাচিৎ অর্জিত হয়েছে।

ইংল্যান্ডের শিল্প-কারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহের একটি উৎস হিসেবে বাংলাকে বিবেচনা করা হতো এবং ব্রিটিশ আমলে বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। ঔপনিবেশিক ক্ষমতার পুরোপুরি সুযোগ নিয়ে তারা ইংল্যান্ডে তৈরি শিল্পজাতপণ্য বাংলা ও ভারতে বিপণনের জন্য নিয়ে আসত। এ চক্র অব্যাহত রাখার জন্য তারা পাট ও চায়ের মতো অর্থকরী ফসলের আবাদের সম্প্রসারণে উৎসাহ প্রদান করে এবং এমনকি নীল চাষ করতে কৃষকদের ওপর বল প্রয়োগ করে যা বাধার সম্মুখীন হয় এবং পরিশেষে একটি বিপ্লবে রূপ নেয়। ব্রিটিশ শাসকগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনামলে ভারতের শিল্পায়নের জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি যা স্থানীয় কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারত। বরং, তাদের কর্মকান্ড ও কৌশলের ফলে চিনি বা মসলিনের মতো শিল্পের অবনতি, এমনকি একেবারে বিলুপ্তি ঘটে।

বারবার দুর্ভিক্ষ ও ভূমি রাজস্ব আয়ের তীব্র ঘাটতি পরিশেষে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করে বেশ কয়েকটি কমিশন ও কমিটি গঠন করতে, যারা বাংলার কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ প্রণয়ন করে। এদের মধ্যে রয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলুপ্তি, ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলির ঋণের পরিমাণ হ্রাস করে তাদের পরিশোধ করার সামর্থে নামিয়ে আনা, বর্গাচাষিদের উৎপন্ন কৃষিপণ্যের দুই-তৃতীয়াংশের ভোগ করতে দেওয়া, কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা, সমবায় আন্দোলন গড়ে তোলা প্রভৃতি। এসব পরামর্শের কয়েকটির বাস্তবায়নের ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলি হচ্ছে সমবায় ঋণ আন্দোলন (১৯০৪), কৃষি বিভাগ (১৯০৬), কৃষি গবেষণাগার (১৯০৮), ঋণ সালিশী বোর্ড (১৯৩৬) ও বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট (১৯৩৮)।

পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ আইন দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ করা হয় এবং কৃষকদের তাদের চাষকৃত জমির ওপর মালিকানা অধিকার দেওয়া হয়। ভর্তুকিকৃত মূল্যে কৃষি উপকরণের (বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রভৃতি) বণ্টন ও সহজ সুদের হারে কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব নিয়ে বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন/বিএডিসি) ও পূর্ব পাকিস্তান কৃষি ব্যাংক (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক/বিকেবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সমন্বিত পল্লী উন্নয়নে সুনাম অর্জনকারী মডেল হিসেবে ‘কুমিল্লা এপ্রোচ’ কার্যক্রম শুরু করে। বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সরকার সূচিত বীজ-সেচ-সার প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নব-প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। কিন্তু বাজারমূল্যের চেয়ে নিম্নহারে ধান-চালের বাধ্যতামূলক সংগ্রহ এবং পাট রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ কৃষকদের দারূনভাবে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে।

কৃষি উপকরণ নীতি  স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রথম কয়েক বছর বাংলাদেশে কৃষকদের মধ্যে উচ্চ ভর্তুকিতে কৃষি উপকরণ সরবরাহের নীতি অব্যাহত থাকে। সরকার ক্রমান্বয়ে laissez faire অর্থনীতি অনুসরণের নীতি গ্রহণ করে এবং বিএডিসি’র একচেটিয়া বাজারকে খর্ব করে। ১৯৭১ ও ১৯৮১ সালের মধ্যের দশ বছরে দেশে সারের ব্যবহার (কেজি/হে) ১১.০ থেকে ৩০.৯, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচের অধীন জমির পরিমাণ ৩.৮% থেকে ১১%, ধান ও গমের উচ্চফলনশীল জাতসমূহের চাষের অধীন জমির পরিমাণ ২.৫% থেকে ২২.৭% এ বৃদ্ধি পেয়েছে। সকল প্রকার সারের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মূল্য ভর্তুকি ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল ৬৮% এবং তা ১৯৭৯-৮০ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৪৭% এবং ১৯৮০ সালের পর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ১৯৯৪-৯৫ সালের তীব্র ইউরিয়া সঙ্কটের পর সরকার খোলা বাজার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচিত ডিলারের মাধ্যমে সার বিতরণের জন্য বিএডিসিকে অনুমতি প্রদান করে। সরকার বিভিন্ন প্রকার সারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য সহায়তাও প্রদান করে। একই সময়ে সেচ-যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর থেকে বাধা ও করসমূহ (সম্পূর্ণ ও আংশিক রূপে) প্রত্যাহারের সরকারি নীতি সেচের সম্প্রসারণে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। নীতি পরিবর্তনসমূহের মধ্যে আরও রয়েছে ক্ষুদ্রসেচ কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অনুমোদন, বেসরকারি ব্যবসায়ীদের ধান, চাল ও গম আমদানির ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং সরকারিভাবে ধান চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে উম্মুক্ত দরপত্র আহবান ব্যবস্থা প্রচলন। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি ঋণ পুনঃতালিকাভুক্তকরণ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমির মালিকানার জন্য খাজনা মওকুফ, শস্য বহুমুখীকরণ কর্মসূচি এবং দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পদক্ষেপ। বাংলাদেশের খাদ্যাবস্থার উন্নয়নে নীতিগত পদক্ষেপগুলির অবদান রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল প্রায় ২ কোটি ৪৩ লক্ষ মেট্রিক টন যা দেশের ১৩ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় কৃষিনীতি ঘোষণা করে। এ নীতির সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে শস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা। দেশের জিডিপি-তে কৃষির অবদানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এবং মোট জিডিপি-র প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রদানকারী কৃষির প্রধান উপখাত ফসল উন্নয়নে জাতীয় কৃষিনীতিতে বিভিন্ন কৌশল তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আবাদকৃত জমির প্রায় ৭৫% ধানের অধীনে রয়েছে। এধরনের একক ফসল নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক, পরিবেশ বা পুষ্টিগত দিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। কৃষিনীতিতে তাই দেশের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নে শস্য বহুমুখীকরণ কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় কৃষিনীতির লক্ষ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে বিএডিসি’র বীজ বিতরণ কর্মসূচির উন্নয়ন এবং মোট বীজের চাহিদার কমপক্ষে ১০% বিএডিসি’র সরবরাহ থেকে পূরণ নিশ্চিত করা। বর্তমানে চালু বীজ সংক্রান্ত বিধি-বিধানের আলোকে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বীজের উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রধান শস্যগুলির বীজের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রবর্তিত বীজের আপদকালিন মওজুদ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।

কৃষি উপকরণ নীতি অনুযায়ী বেসরকারি খাতে সারের বণ্টন অব্যাহত থাকবে, কিন্তু যথাসময়ে সারের সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি খাত প্রয়োজনে সার আমদানি করবে। এ নীতিতে মৃত্তিকার সুষ্ঠু গুণাগুণ বজায় রাখতে সুষম সার প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হচ্ছে যথাযথ প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে সেচ এলাকা বৃদ্ধি ও সেচের ব্যয় হ্রাস করা; পরিবেশ উপযোগী ও টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা; পোকামাকড়, রোগবালাই দমনে যান্ত্রিক, পরিচর্যাগত ও জীবজ পদ্ধতিসমূহ ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা; পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যে কোনো বালাইনাশক (pesticide) ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা এবং পর্যায়ক্রমে এসব আপদনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। এ ছাড়া উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করা; কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পকে উৎসাহ প্রদান করা এবং কৃষি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রচেষ্টা চালানো উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কৃষিনীতি দ্বিমাত্রিক কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত কৃষক-কৃষাণীদের শনাক্তকৃত সমস্যার সমাধানে কম খরচে যুৎসই প্রযুক্তিগুলিকে নিয়ে একটি এবং উচ্চতর গবেষণা পদ্ধতিগত জ্ঞানের মাধ্যমে প্রায়োগিক গবেষণা অনুসরণ করে অপরটি। জাতীয় কৃষিনীতি অনুযায়ী সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা (SAFTA) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে কৃষি বিষয়ক চুক্তির আলোকে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে, একই সাথে, জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতি  ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো প্রণীত পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতি জিডিপি-র ৬.৫% অবদানকারী পশুসম্পদ উপখাতের উন্নয়নে সরকার অনুসরণ করছে। পল্লী অঞ্চলে আত্ম-কর্মসংস্থান ও উপার্জন বৃদ্ধির উপায় হিসেবে হাঁস-মুরগি ও পশু পালনের সম্প্রসারণে এতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমিষজাতীয় খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পশুসম্পদ-নীতি সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দুধ, মাংস, ডিম উৎপাদনে স্বয়ম্বরতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এসব লক্ষ্য অর্জনে পশুসম্পদ-নীতিতে যে সব কৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পশুর জাত আমদানি, সংকরায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জাতসমূহের উন্নয়ন, ক্ষুদ্র আকারের দুগ্ধ ও হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদান, প্রশিক্ষণ এবং ঋণসহ প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ সরবরাহ করা। নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে দুধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত সামগ্রীর আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, একই সঙ্গে হাঁস-মুরগি ও ডেইরি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ ও যন্ত্রপাতির আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে। নীতির নির্দেশনা অনুযায়ী, পশুসম্পদ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সমূহের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন, টিকাদান, চিকিৎসা, পশুখাদ্য উৎপাদন ও প্রশিক্ষণের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। অন্যান্য সরকারি সংস্থা, এনজিওসমূহ, জনপ্রতিনিধি এবং ধর্মীয় নেতাদেরকেও এসব কর্মসূচিতে নিয়োজিত করা হয়েছে। পশুসম্পদ-নীতি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহের ওপর শিক্ষা ও গবেষণার সম্প্রসারণেও গুরুত্ব আরোপ করেছে। পরবর্তীকালে পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতি ১৯৯২ পরিবর্তন করা হয় এবং ‘জাতীয় পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতি-২০০৭’ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

জাতীয় মৎস্যনীতি  ১৯৯৮ সালে ঘোষিত জাতীয় মৎস্যনীতিতে ৪৮.৬ লক্ষ হেক্টর জুড়ে ১৪ লক্ষ পুকুর ও বিপুল সংখ্যক অন্যান্য মৌসুমি প্লাবন ভূমি এবং বঙ্গোপসাগরের ২২৫ কিমি দীর্ঘ উপকূল অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মৎস্য খাতকে প্রাণিজ আমিষের একটি উৎস হিসেবে এবং পল্লী কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে সম্ভবনাময় বলে উল্লেখ করে মৎস্যনীতিতে এর উন্নয়নে মাছের পোনা, খাদ্য ও ঋণের মতো বিভিন্ন উপকরণের প্রাপ্যতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি যেকোন বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগকে মৎস্যনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘কারেন্টজাল’ দিয়ে মাছ ধরা এবং পোনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ ধরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, পতিত পুকুরসমূহের অধিগ্রহণসহ মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে বিভিন্ন আইন বলবৎ করা হয়েছে। রপ্তানিমুখী চিংড়ি শিল্পের উন্নয়নে এবং ম্যানগ্রোভ পরিবেশের ক্ষতি না করে আধা-নিবিড় চিংড়ি চাষে জাতীয় মৎস্যনীতিতে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় বননীতি  বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৯ সালে প্রণীত বননীতি পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য ১৯৯৪ সালে সংশোধন করা হয়। জাতীয় বননীতি ১৯৯৪-এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুত বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত অবক্ষয় রোধ করা। অবক্ষয়কৃত ও অনাচ্ছাদিত বনভূমিসহ সরকারি পরিসংখ্যানে বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূমির ১২-১৪% বলে দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা মাত্র ৫-৬%। সংশোধিত বননীতি ২০১৫ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ ২০% এ বৃদ্ধি করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। যেহেতু অবক্ষয়কৃত ও অনাচ্ছাদিত বনভূমির পুনর্বাসনের মাধ্যমে দেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বনিম্ন বনাঞ্চল পূরণ করা যাচ্ছে না, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে তাই একটি সর্বাত্মক আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে বননীতিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত বনায়ন কর্মসূচির পাশাপাশি সামাজিক বনায়ন ও কৃষি বনায়নের মতো আরও কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশি প্রজাতির বৃক্ষরোপণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু, মানুষকে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে দেশের উপকূল অঞ্চলে একটি সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের পতিত জমি, রাস্তা, রেললাইন ও বাঁধের পার্শ্বেও বৃক্ষরোপণ চলছে। বননীতি অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এসব কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত বনাঞ্চল গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  [আবু আবদুল্লাহ এবং এম সাইফুল্লাহ্]

কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা (Agricultuaral Education and Research)

কৃষিশিক্ষা  কৃষি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেশে কৃষিশিক্ষার প্রথম ও মজবুত বুনিয়াদ গড়ে ওঠে ১৯৩৮ সালে তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী  .কে ফজলুল হক কর্তৃক ঢাকার মণিপুর ফার্মে (বর্তমানে শেরে-বাংলা নগর) বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট (Bengal Agricultural Institute) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। Royal Agriculture Commission-এর পরামর্শক্রমে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট ছিল তৎকালে প্রদেশে উচ্চতর কৃষিশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদেরও মর্যাদা পেয়েছিল।পরবর্তী সময়ে এটি বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট (Bangladesh Agricultural Institute/BAI), নামে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের অধিভুক্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।

কৃষিশিক্ষা, বিশেষত উচ্চতর কৃষিশিক্ষা বিভিন্ন সময়ে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে দু’পর্যায়ে ডিগ্রি দেওয়া হতো, মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে দু’বছরের বি.এসসি (কৃষি) এবং ফলিত কৃষি বিজ্ঞান বিষয়ে আরও দু’বছরের বি.এজি ডিগ্রি। পরবর্তীকালে ১৯৪৫ সালে ৩ বছরের বি.এজি ডিগ্রি চালু করা হয় এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট চার বছরের বি.এসসি এজি কোর্স চালু করে। নতুন পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধারা বহাল রয়েছে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে ১৯৫৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ কমিশনই সর্বপ্রথম জরুরি ভিত্তিতে পাকিস্তানের দুই অংশে দুটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। কমিশন কৃষি কলেজে তৎকালীন প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে অভিমত রাখে যে, সরকারি বিভাগের বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে কৃষিশিক্ষার পূর্ণ বিকাশ কখনই সম্ভব নয়, কেননা সকল উচ্চশিক্ষার জন্য অপরিহার্য যে গবেষণার পরিবেশ তা কলেজে বিদ্যমান নেই। বিভিন্ন বিষয় যথাযথ বিবেচনার পর কমিশন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই কৃষি বিষয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণা কার্যক্রমের সর্বোচ্চ বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। সম্প্রসারণ কার্যক্রমের কথা উল্লেখ না করলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কৃষিশিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণা, শিক্ষা ও সম্প্রসারণ একীকরণের বিষয়টি পর্যালোচনাকালে কমিশন মন্তব্য করে যে, ‘কৃষকদের কাছে ব্যবহার্য ও গ্রহণযোগ্যরূপে পৌঁছাতে না পারলে গবেষণার ফলাফলের মূল্য সামান্যই, আর তাই নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সবগুলি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষামূলক সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এভাবে কমিশন প্রথমবারের মতো কৃষিক্ষেত্রে গবেষণা, শিক্ষাদান ও সম্প্রসারণ একীভূত করার মতো তাৎপর্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।

পরিশেষে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে উচ্চতর কৃষিশিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটে। এটির অধ্যাদেশ (১৯৬১) অনুযায়ী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল ‘কৃষি ও কৃষির সকল শাখায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা।’ এ অধ্যাদেশের ২ পৃষ্ঠায় ৫ক অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের যে কোনো শাখায় বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও জ্ঞানবিস্তারের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।

তৎকালীন পাকিস্তান খাদ্য ও কৃষি কমিশন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশকৃত গবেষণা, শিক্ষা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম একীকরণ সমর্থন করে নি। তারা মতপ্রকাশ করে যে, সম্প্রসারণের সকল কার্যক্রম সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্বারাই পরিচালিত হওয়া উচিত। ফলে বাস্তবে কোনো সম্প্রসারণ কার্যক্রম ছাড়াই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পথ অনুসরণ করে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে গৃহীত হয়েছিল। অন্যদিকে ভারত বেশ কয়েক বছরের চিন্তাভাবনার পর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয় স্থির করে এবং বিখ্যাত ল্যান্ড গ্রান্ট কলেজের মডেল অনুসরণে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমের সকল পর্যায়ে শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণকে সমন্বিত করে। অন্যদিকে ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৬৪) সে দেশে প্রতি রাজ্যে অন্ততপক্ষে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অবস্থাগত পার্থক্যের কারণেই ভারতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং শুধু জ্ঞানচর্চা ও পান্ডিত্যের ক্ষেত্রে সীমিত না থেকে ক্ষেতখামারের সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। সম্প্রসারণ কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কৃষক ও অন্যান্য প্রান্তিকফলভোগীদের কাছে হস্তান্তরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুরনো প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী গত ২০ বছরে আরও কয়েকটি নতুন ইনস্টিটিউট/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৮০ সালে বি.এসসি, এজি ডিগ্রি দানের লক্ষ্যে গাজীপুরের সালনায় বাংলাদেশ কৃষিবিজ্ঞান কলেজ (Bangladesh College of Agricultural Sciences/BCAS) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কয়েকবার পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কৃষির বিভিন্ন শাখায় এম.এসসি, এজি এবং পিএইচ.ডি ডিগ্রি দেওয়ার জন্য এটির নতুন নামকরণ হয় স্নাতকোত্তর কৃষি শিক্ষা ইনস্টিটিউট (Institute of Post Graduate Studies in Agriculture/IPSA)। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে একে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত করে কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে বি.এসসি (কৃষি), এম.এসসি (কৃষি) ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এটি এখন কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে পটুয়াখালীর দুমকীতে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ এবং ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন এ দুটি কৃষি কলেজ শুধু ফসলবিদ্যায় বি.এসসি, এজি ডিগ্রি দিয়ে থাকে। বর্তমানে পটুয়াখালী ও দিনাজপুরের কলেজ দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পুনর্গঠিত হয়েছে এবং কৃষি একটি অনুষদ হিসেবে থাকছে, আর এইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলি কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়েছে।

রাজশাহী ও বগুড়ায় দুটি বেসরকারি কৃষি কলেজ আছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি College of Forestry বনবিদ্যায় বি.এসসি ডিগ্রি দিয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Forestry and Environment স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়। এ ছাড়া পশুচিকিৎসায় ডিগ্রি দানের জন্য দুটি পশুচিকিৎসা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়; একটি সিলেটে, অন্যটি চট্টগ্রামে। ব্যবস্থাপনা কাঠামো, পেশাগত সুযোগ-সুবিধা, স্বায়ত্তশাসন এবং তহবিল যোগানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, কলেজগুলি তা পায় না। শিক্ষাগত বিষয়ে কলেজগুলি অধিভুক্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সরকারি বিভাগ বা ব্যবস্থাপনা বোর্ডের (বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে) নিয়ন্ত্রণে। এ ধরনের দ্বৈত-নিয়ন্ত্রণ কলেজগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ভোগকৃত পেশাগত সুযোগ, শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান এবং তহবিল যোগানোর সুবিধা থেকে দূরে রেখেছে। বর্তমানে এর দুটো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (Agricultural Extension Training Institute/AETI) এবং বন ও পশুপালনের মতো কৃষির অন্যান্য উপখাতের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলিও ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষা দিয়ে থাকে।

ছাত্রভর্তি  কৃষির সবগুলি উপখাত মিলিয়ে প্রতি বছর স্নাতক পর্যায়ে প্রায় ১২০০ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২০০-২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ইনস্টিটিউট পিএইচ.ডি পর্যায়ে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ডিপ্লোমা কোর্সে প্রতি বছর কয়েকশ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে থাকে।

পরীক্ষা-পদ্ধতি বিশ্বের অধিকাংশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি এবং কঠোর অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন চালু হলেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলি দীর্ঘদিন বার্ষিক পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ অব্যাহত রেখেছে। বিগত কয়েক বছরে এটি স্বীকৃত হয়েছে যে, সেমিস্টার পদ্ধতি ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের জন্যই ফলপ্রসূ। এ পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক যেমন পাঠ্যসূচি বা পাঠ্যপুস্তক তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, তেমনি ছাত্রছাত্রীদেরও সর্বক্ষণ প্রস্ত্তত থাকার জন্য সারাবছর লেখাপড়া করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সেমিস্টার পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য কাজ করছে। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সঙ্গে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয়েছে।

অনুষদসমূহ ছয়টি অনুষদ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র বহু-অনুষদীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলি হচ্ছে কৃষিতত্ত্ব, পশুচিকিৎসা, মাৎস্যবিজ্ঞান, পশুপালন, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিদ্যা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শুধু কৃষি অনুষদ থাকলেও অদূরভবিষ্যতে আরও নতুন অনুষদ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। কৃষি/বনবিদ্যা/পশুপালন কলেজগুলিতে কয়েকটি বিভাগ নিয়ে শুধু একটি অনুষদ রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদ ছাড়াও আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সিস্টেম নামে একটি গবেষণা ইউনিট এবং Graduate Training Institute (GTI)। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সিস্টেম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম/প্রকল্পে অর্থায়ন, সমন্বয় ও তদারকি করে থাকে আর GTI স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং কৃষি উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয়।

ব্যবস্থাপনা কাঠামো এতে রয়েছে সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, বোর্ড অব স্টাডিজ, উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক কমিটি এবং অন্যান্য বিশেষ কমিটি আর তা মোটামুটি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অনুরূপ। কলেজ/প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অর্থবরাদ্দ দেয় ও তাদের কার্যক্রম তদারক করে। সীমিত শাসনক্ষমতা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই পরামর্শ দেয়।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ না থাকা বা সুযোগের অপ্রতুলতা থেকে যে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে তা অনুমানক্রমে তৎকালীন পাকিস্তান খাদ্য ও কৃষি কমিশনের পরামর্শ ছিল- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের জন্য যাতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির পরীক্ষাগার ও খামারে কাজ করতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকরভাবে এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছেন।

বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা শক্তিশালী করার জন্য গঠিত যৌথ পর্যালোচনা দল (১৯৭৮) নিম্নোক্ত মতামত প্রকাশ করে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ল্যান্ড গ্রান্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এ তুলনা সঠিক নয়, কারণ ভারতে ১৯৫৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গড়ে তোলা হয়েছিল কৃষি কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণকে গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে আলাদা করার জন্য। ভারতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কৃষি বিভাগের (মন্ত্রণালয়) অধীন। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেসময় পশ্চিম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ধাঁচে গড়া তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিকাশমান কৃষির চাহিদা পূরণের উপযুক্ত বিবেচিত না হওয়ায় ল্যান্ড গ্র্যান্ট কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব কলেজ (পরবর্তীকালে ১৮৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়) বোর্ড অব রিজেন্টস (Board of Regents)-এর অধীনে ছিল যা নিয়ন্ত্রণ করত বোর্ড অব গভর্নরস, আর সেটা ছিল রাষ্ট্রীয় আইন প্রণেতাদের নিকট দায়বদ্ধ। ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা মার্কিন ল্যান্ড গ্রান্ট কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়- কোনোটিই শিক্ষা বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নয়।

কৃষি গবেষণা  বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ব্যবস্থার উদ্ভব ও মূল্যায়নের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ১৮৮০ সালের দুর্ভিক্ষ কমিশনের পরামর্শক্রমে ভারতবর্ষের তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ১৯০৬ সালে কৃষি বিভাগ গঠন করে। পরবর্তী সময়ে ১৯০৮ সালে ঢাকা শহরের কয়েক মাইল উত্তরে তেজগাঁয় কৃষি গবেষণাগার গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পার্শ্ববর্তী ৪০৩ একর জমির উপর একটি পরীক্ষণ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। এ গবেষণা কেন্দ্র ঢাকা-মণিপুর ফার্ম (বর্তমানে শেরে-বাংলা নগর) হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে স্থানীয় পর্যায়ে গবেষণা ও প্রদর্শনী কার্যক্রম চালানোর জন্য বাংলার তৎকালীন প্রত্যেকটি জেলায় জেলা কৃষিখামার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৬২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ফসল, মৃত্তিকা, সার ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের ওপর পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রম পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ছিল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-৬৫) গ্রহণের মাধ্যমে একক প্রতিষ্ঠানে, পূর্ব পাকিস্তান কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (East Pakistan Agricultural Research Institute/EPARI) বিচ্ছিন্ন গবেষণা কার্যক্রমকে প্রথমবারের মতো সমন্বিত করা হয়।

পাকিস্তানের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ষাটের দশকের প্রথম দিকে ঢাকা-ফার্ম অধিগ্রহণ করে। কিন্তু গবেষণা অবকাঠামো স্থানান্তরের জন্য কোনো বিকল্প স্থান বরাদ্ধ না দেওয়ায় ১৯৬০ সালের দিকে এ অঞ্চলে কৃষি গবেষণা এক বাধার সম্মুখীন হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকার ৩২ কিলোমিটার উত্তরে জয়দেবপুরে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে  বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৩ সালে এ নবপ্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট কার্যক্রম শুরু করে। দেশে ইতোমধ্যেই ধান, পাট, ইক্ষু, চা, বন, মৃত্তিকা, মৎস্য ও পশুসম্পদের ওপর পৃথক পৃথক ইনস্টিটিউট/গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর (১৯৭৩) এসব ইনস্টিটিউট/কেন্দ্রের অধিকাংশই পুনর্গঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে ১০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের ফসল, পশুসম্পদ, মৎস্য ও বনবিদ্যার ওপর কাজ করছে। অধিকন্তু বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কয়েকটি কৃষি কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সবগুলি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটই স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছিল এবং পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছিল। প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও তাঁর জ্যেষ্ঠ সহকর্মীগণ প্রধানত ওই ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম তৈরি করতেন। সাধারণত আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সংযোগের অভাব ছিল এবং সেজন্য ইনস্টিটিউটগুলির গবেষণা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ে সামগ্রিক কার্যক্রম গ্রহণ অপিরহার্য হয়ে ওঠে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব অনুধাবন করেই ১৯৭৩ সালে  বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সারা দেশে কৃষি গবেষণার সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সহজতর করার জন্য কৃষি গবেষণা পদ্ধতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করার জন্যই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের সৃষ্টি। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ফসল, পশুসম্পদ, মৎস্য ও বনবিদ্যার ওপর গবেষণারত ১০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সবগুলিতেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের ভূমিকা সম্প্রসারিত রয়েছে এবং এগুলির সমন্বয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কৃষি গবেষণা ব্যবস্থা (National Agricultural Research System/NARS) গঠিত হয়েছে। NARS-এ দেড় হাজারের মতো বিজ্ঞানী কর্মরত আছেন।

NARS–এ কৃষি গবেষণার পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন  পরস্পর-বিচ্ছিন্ন প্রায় ডজন খানেক প্রতিষ্ঠানে দেশের কৃষি গবেষণা ছড়ানো ছিটানো থাকার দুর্বল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ গড়ে তোলা হয়। উপখাতগুলির (বিভিন্ন ফসল, পশুসম্পদ, মৎস্য ও বনবিদ্যা) সমস্যার অগ্রাধিকার নিরূপণ এবং পুরো গবেষণা ব্যবস্থার জনবল, ভৌত ও আর্থিক সম্পদ বরাদ্দের সমন্বয় বিধানে সমর্থ, কৃষি গবেষণার এমন কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা না থাকায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে ছিল জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিকল্পনা (National Agricultural Research Plan/NARP) প্রণয়ন, চাষাবাদে জরুরি সমস্যাসমূহের ওপর চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রকল্প প্রস্ত্তত, গবেষণা ব্যবস্থার মানবসম্পদ জরিপ, জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও দলিল প্রস্ত্তত কেন্দ্র (Documentation Centre) প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠির সাহায্যপুষ্ট গবেষণা কার্যক্রমের পরিকল্পনা পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের মধ্যে ১৯৮১-৮২ সালে কারিগরি সহায়তা সেবা বিভাগ (Technical Support Services Division) নামে একটি বিভাগ গড়ে তোলা হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে চুক্তিভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শুরু হয়। এ মূল্যায়নলব্ধ ফলাফল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাম বৃদ্ধি করে। বস্ত্ততপক্ষে এটিই ছিল বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৮৩-৮৪ সালে কারিগরি সহায়তা সেবাপ্রদান বিভাগ ‘পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন বিভাগ’ হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। এ বিভাগের কার্যক্রম বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সেগুলির শিক্ষাদানমূলক বিভাগ/অনুষদসমূহের সাফল্য মূল্যায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ প্রথম জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিকল্পনা (১৯৭৯-৮৩) প্রণয়ন করে। ১৯৮৩-৮৪ সালে দ্বিতীয় NARP (১৯৮৪-৮৮) প্রণয়নের জন্য আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। এ ছাড়া ১৯৮৩-৮৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ‘চুক্তিভিত্তিক গবেষণার জন্য ম্যানুয়াল’ প্রকাশ করে যাতে ছিল প্রকল্প নির্বাচনের রীতি, প্রকল্প পরিকল্পনার ধাপসমূহ, প্রকল্পের গুরুত্ব নির্ধারণ, প্রকল্প পরিবীক্ষণ, প্রতিবেদন তৈরি ও গবেষণালব্ধ ফলাফল মূল্যায়ন ও সদ্ব্যবহার। ১৯৮৪-৮৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ম্যানুয়ালে বর্ণিত নীতিমালার ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নকৃত চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রকল্পসমূহের জন্য অর্ধবার্ষিক পরিবীক্ষণ পদ্ধতি প্রচলন করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের একদল বিজ্ঞানী কর্তৃক অতঃপর মাঠপর্যায়ে পরিবীক্ষণের সূচনা ঘটে।

গবেষণা পরিকল্পনা  জাতীয় পর্যায়ে কৃষি গবেষণার পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ পালন করে থাকে। জাতীয় প্রয়োজন ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি গবেষণার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষি গবেষণা ব্যবস্থার গবেষণা সামর্থ্য উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা এবং যথাযথ গবেষণা অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর কৌশল পরিকল্পনা প্রণয়ন সবকিছুই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ ধরনের পরিকল্পনায় সাধারণত অগ্রাধিকারের পর্যায়িক হালনাগাদের অবকাশসহ পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারিত হয়ে থাকে। জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিকল্পনা কৃষি গবেষণার দিকনির্দেশনা দেয় এবং জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় সহায়তা যোগানোর ভিত্তিতে গবেষণার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, অগ্রাধিকার ও সুযোগ বর্ণনা করে।

কৃষি গবেষণার কৌশলগত পরিকল্পনা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ২০১০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়ে জাতীয় কৃষি গবেষণার জন্য ৬টি ব্যাপক কার্যক্ষেত্রভিত্তিক যে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, তাতে আছে ১. উদ্ভিদ উৎপাদন প্রণালী; ২. পশুপালন প্রণালী; ৩. প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রণালী; ৪. কৃষি উৎপাদন সহায়তা প্রণালী; ৫. কৃষিনীতি সহায়তা প্রণালী; এবং ৬. কৃষিতথ্য সহায়তা প্রণালী। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ পর্যায়িকভাবে কৃষি গবেষণারত জনবলের অবস্থান সম্পর্কে সমীক্ষা চালায় এবং সে ভিত্তিতে কৃষি গবেষণা কর্মীদের জন্য যথাযথ জনবল উন্নয়ন পরিকল্পনা (দীর্ঘ ও স্বল্প উভয় মেয়াদি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম) গ্রহণ করে যাতে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকে।

গবেষণার জন্য যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলার চাহিদার বিষয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক পরীক্ষিত হয় এবং চালু গবেষণা প্রতিষ্ঠান/কেন্দ্রগুলিকে শক্তিশালী করার এবং চাহিদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা দক্ষতা ও অর্থযোগানের ভিত্তিতে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পদক্ষেপ গৃহীত হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউট পর্যায়ে গবেষণা প্রকল্প তৈরি হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের অর্থায়ন প্রত্যাশী কৃষি গবেষণা প্রকল্পসমূহের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি মাপকাঠি বিবেচনাধীন থাকে।

গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ৯টি অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছে। এগুলি ১. রংপুর ও দিনাজপুর; ২. বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা; ৩. কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা; ৪. বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুর; ৫. জামালপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ; ৬. কুমিল্লা ও সিলেট; ৭. নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম; ৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ৯. ঢাকা ও টাঙ্গাইল।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কোনো অঞ্চলের কৃষি সম্পর্কিত সমস্যার নিরূপণের জন্য NARS ইনস্টিটিউটগুলির সঙ্গে যৌথভাবে আঞ্চলিক কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসব কর্মশালায় কৃষির ৪টি উপখাতের সবগুলি শস্য, মৎস্য, বন ও পশুসম্পদ নিয়ে আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের NARS বিজ্ঞানীগণ, কৃষি কারিগরি কমিটির (Agricultural Technical Committee/ATC) সদস্যবর্গ, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং নেতৃস্থানীয় কৃষকগণ কর্মশালায় যোগ দেন। কর্মশালায় প্রদর্শনী প্লটসমূহের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং শস্য, মৎস্য, বন ও পশুসম্পদ ক্ষেত্রে বিরাজমান স্থানীয় সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা চলে। এভাবে মাঠপর্যায় থেকে গবেষণাযোগ্য বিষয়গুলি শনাক্ত করা হয়।

চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রকল্প  চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত গবেষণার বিষয় একটি অঞ্চলের জন্য হলে ATC তা পরীক্ষা করবে এবং প্রকল্পটি একাধিক অঞ্চলের জন্য হলে এটি National Agriculutural Techinical Coordination Committee/NATCC কর্তৃক পরীক্ষিত হবে। ATC/NATCC-তে পরীক্ষার পর প্রকল্পটি অর্থসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদে পেশ করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ বিভাগীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি পর্যালোচনার পর স্ব স্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে পর্যালোচনার জন্য পাঠায়। পরে প্রকল্পটি পর্যালোচকের মন্তব্যসহ কারিগরি পরামর্শ কমিটিতে (Technical Advisory Committee/TAC) উপস্থাপন করা হয়। TAC-এ রয়েছেন ১. স্ব স্ব বিষয়ের সদস্য পরিচালক; ২. সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ২-৩ জন বিশেষজ্ঞ সদস্য; ৩. সদস্য-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) এবং ৪. সদস্য পরিচালক (কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজতত্ত্ব)। TAC-এর সকল সদস্য কোনো সংশোধন ছাড়া বা সংশোধিত আকারে প্রকল্পটি অনুমোদন করলে এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কার্যনির্বাহি পরিষদে পেশ করা হয়। কার্যনির্বাহি পরিষদের মন্তব্য/পরামর্শের ভিত্তিতে প্রকল্পগুলি সংশোধন করতে হয় এবং চেয়ারম্যান অর্থসংস্থানের জন্য সেটা পেশ করেন।

মূল্যায়ন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ বিভিন্ন পর্যায়ে ইনস্টিটিউটগুলির গবেষণা কার্যক্রমের মূল্যায়ন করে থাকে। ১৯৮৬ সালে পরিকল্পনা কমিশনের অনুরোধে ইক্ষু গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (Sugarcane Research and Training Institute/SRTI) কার্যক্রমের ফলাফল (performance) মূল্যায়ন করা হয়েছিল এবং ওই একই বছরে বিশেষ মুল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে USAID/ Winrock International এবং ARP-III (বিশ্ব ব্যাংক) প্রকল্পসমূহের কর্মকান্ডও মূল্যায়ন করা হয়েছিল। এ ছাড়া আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রকল্পসমূহের বার্ষিক পর্যালোচনা করে থাকে।

জাতীয় কৃষি গবেষণা ব্যবস্থার আওতাভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণভাবে এখনও সম্পূর্ণ দলিলকৃত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পারে নি। উদাহরণস্বরূপ NARS-এর সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বছরে একবার বার্ষিক কার্যক্রম পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে সভায় পরবর্তী বছরের গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা চলে। অন্যসব NARS ইনস্টিটিউটে একই অবস্থা বিরাজমান, ব্যতিক্রম শুধু BRRI যেখানে বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় কার্যক্রম ও প্রকল্পসমূহের অপেক্ষাকৃত বিশদ আলোচনা চলে এবং বিজ্ঞানীদের জবাবদিহিতা তুলে ধরা হয় এবং প্রতি তৃতীয় বছরে একবার বহিঃপর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকে। বহিরাগত পর্যালোচকদল BRRI-র গবেষণা কার্যক্রম ও ফলাফল মূল্যায়ন করে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ প্রণীত পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা অনুসরণে ইনস্টিটিউটগুলি যথাসময়ে যাতে গবেষণা পরিকল্পনা প্রস্ত্তত করে বর্তমানে তেমন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। ইনস্টিটিউটগুলি কর্তৃক গৃহীত গবেষণা কার্যক্রম এখন অনেক সুশৃঙ্খল ও প্রয়োগধর্মী।  [কাজী এম বদরুদ্দোজা]

আরও দেখুন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিশদ; বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

ফসলের জাত উদ্ভাবন (Development of crop varieties) বাংলাদেশে বিদ্যমান বিপুল সংখ্যক উদ্ভিদের মধ্যে আছে প্রায় ৫,০০০ গুপ্তবীজী প্রজাতি (angiosperm)। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকে জীবনযাপনের ধারায় বিভিন্ন প্রজাতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উদ্ভিদ চাষাবাদের আওতাধীন করেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি বাস্ত্তসংস্থানিক অবস্থা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমি নানা অঞ্চলে তাদের নানা ধরনের উদ্ভিদ বংশাণুসম্পদ নির্বাচনে অনুপ্রাণিত করেছে। এগুলির মধ্যে প্রায় ১৬০ প্রজাতি বিবিধ পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশে সরকারের জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন জাতের ফসলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার আইনত নিবন্ধন ও অবমুক্তির জন্য ইতিপূর্বে নির্বাচিত উদ্ভিদের নমুনা ব্যবহূত হয়ে থাকে। এদেশে স্থানীয় বন্য উদ্ভিদসম্পদ থেকে উদ্ভূত স্থলজ জাতসমূহের সংগ্রহ ও চাষ থেকে প্রাথমিকভাবে ফসলের প্রকারভেদ নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। উদাহরণ হিসেবে, এ অঞ্চলেই আজকের ধান Oryza sativa প্রজাতির উৎপত্তি যার অজস্র জাত ও প্রকারভেদ বিদ্যমান। উনিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকের ‘বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ কমিশন’ প্রদত্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯০৫ সাল নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশের এতদঞ্চলে বঙ্গীয় কৃষিখামার ও গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় ধান, পাট ও চাষাধীন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জাতসমূহের নির্বাচন ও নিবন্ধীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিভিন্ন ফসলের জাতগুলির উৎপত্তির প্রক্রিয়া ও সময়কাল নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো।

সারণি ২ দীর্ঘকাল যাবৎ বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য নিবন্ধিত ও অবমুক্ত বিভিন্ন ফসল প্রজাতির জাত/প্রকারভেদ।

ফসল-প্রজাতি জাতের সংখ্যা ফসলের জাতগুলি উৎপাদনের প্রক্রিয়া
ধান (Oryza sativa): আধুনিক জাত (৩৭), BINA (৬), ইঅট (২)৭টি। ৪৫ ৪৫টির মধ্যে BRRI কর্তৃক সংকরণের মাধ্যমে ৩০টি এবং প্রবর্তন ও নির্বাচনের মাধ্যমে BRRI BINA কর্তৃক মিউটেশন-উত্তর নির্বাচনের মাধ্যমে ৬টি। BAU কর্তৃক প্রবর্তন ও সংকরণের মাধ্যমে ২টি। সবগুলিই ১৯৬৮ সালের পরবর্তী।
ধান (Oryza sativa): পুরানো জাতভেদ ২৪ সবগুলি ভ্যারাইটি স্থলজ জাত থেকে নির্বাচিত। প্রবর্তিত হয়েছে নাইজেরিয়া (নাজিরশাইল) থেকে, গভীর পানির ধানের বংশাণুসম্পদ ও স্থানীয় বোরো ধানের স্থলজ জাতগুলি থেকে। প্রায় সবগুলিই ১৯৬৮ সালের পূর্ববর্তী।
গম (Triticum aestivum) ২৬ ২৬ CIMMYT প্রবর্তিত বংশাণুসম্পদ থেকে এই জাতগুলি নির্বাচিত। অন্যান্য উৎসের মধ্যে বিশ শতকের সত্তরের দশকের পর সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সংকরায়ণ থেকে কিছু নির্বাচন।
বার্লি  (Hordeam vulgare) ২ পুরানো জাতের বংশাণুসম্পদ থেকে বাছাইকৃত, ১৯৮০ সালের পর নিবন্ধিত।
ভুট্টা (Zea mays) এগুলি সাদা-দানা জাতের একটির এবং স্বাভাবিক ভুট্টা-দানার রঙের অন্যগুলির বিমিশ্র নমুনা। শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝির পর শস্যের জাত হিসেবে নির্বাচিত। ওই শতকের বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ভুট্টার নির্বাচিত সংকর-জাত আমদানি করা হয়েছিল।
চীনা (Panicum miliarium) সম্ভবত বহুকাল আগে প্রবর্তিত স্থানীয় উদ্ভিদ-বংশাণুসম্পদ থেকে নির্বাচিত এবং ১৯৮০ সালের নিবন্ধিত।
কাউন (Setaria italica স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত উদ্ভিদ-বংশাণুসম্পদ থেকে সংগৃহীত ও পরবর্তীকালে নির্বাচিত।
পাট (Corchorus capsularis এটমপাট BINA কর্তৃক পুরানো জাত ডি-১৫৪ থেকে নির্বাচিত মিউট্যান্ট। অতিসম্প্রতি অবমুক্ত  বিশ শতকের নববইর দশকের গোড়ার দিকে) জাতগুলির ২টি (BJRI-৫, BJRI-৬) সংকর থকে উৎপন্ন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ভূমিজ জাত (land race) থেকে হয় ডি-১৫৪।
পাট (Corchorus olitorius)  ১টি এ অঞ্চলের পুরানো জাত, মূল উৎস থেকে প্রবর্তিত (বিশ শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি) ভূমিজ জাত থেকে নির্বাচিত। অন্য দুটি ব্রাজিল ও উগান্ডা থেকে প্রবর্তিত জাত থেকে নির্বাচিত।
মেস্তা (Hibiscus sabdariffa)  ১ স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত উদ্ভিদ-বংশাণুম্পদ থেকে নির্বাচিত। কেনাফ (Hibiscus canabinus) ২  একটি যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরটি ইরান থেকে প্রবর্তিত। উভয়ই BJRI মাধ্যমে চাষাধীন।
তুলা (Gossypium spp.) ভারত (২), পাকিস্তান (১) ও যুক্তরাষ্ট্র (৩) থেকে বাংলাদেশে প্রবর্তনের পর নির্বাচিত। চট্টগ্রাম তুলার জাতগুলি বহুবর্ষজীবী ও জাত হিসেবে নিবন্ধিত নয়। বর্তমানে এগুলি কেবল বসতবাড়িতেই লভ্য।
আলু (Solanum tuberosum) :   আধুনিক জাতসমূহ ১৫ বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে হল্যান্ড (১১), যুক্তরাজ্য (১), ভারত (১) এবং CIP, পেরু (২) থেকে প্রবর্তিত। সম্প্রতি TPS (True Potato Seeds/আসল আলুবীজ) হিসেবে সংকরজাতগুলির প্রবর্তন ও পরীক্ষা চলছে।
আলু: দেশী জাতসমূহ (Solanum tuberosum) বহুকাল আগে ভারত থেকে প্রবর্তিত। এগুলির পরিবর্তে এখন অনেক এলাকায়ই উচ্চ-ফলনশীল জাতের চাষ চলছে।
মিষ্টিআলু (Ipomea batatas  ৩টি বাংলাদেশের এবং ১টি করে ফিলিপাইন ও তাইওয়ান থেকে প্রবর্তিত।
আখ (Saccharum officinarum) ১২ চিনি উৎপাদনের জন্য ১১টি জাত চিনিকলে ব্যবহূত। একটি জাত চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী।বাংলাদেশী উদ্ভিদ-বংশাণুসম্পদ থেকে এগুলি বাছাইকৃত যা বহুকাল আগে উষ্ণ-মন্ডলীয় এশিয়া থেকে প্রবর্তিত হয়েছিল ।
ছোলা (Cicer arietinum)  ৫ প্রবর্তনের পর নির্বাচন মাধ্যমে ৪টি জাত উদ্ভাবিত। ১টি মিউটেন্ট থেকে বাছাইকৃত। এগুলির বংশাণুবৈচিত্র্য স্বল্প।
মসুর (Lens culinaris) বিশ শতকের ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে ১টি বাংলাদেশের উদ্ভিদসম্পদ থেকে নির্বাচিত। আরেকটি সত্তরের দশকের শেষের দিকে সিরিয়া থেকে প্রবর্তিত এবং তা থেকে বাছাইকৃত।
মুগ (Vigna mungo) প্রবর্তিত ভারতীয় উৎস থেকে ২টি নির্বাচিত। অন্য ২টি BINA কর্তৃক বিকিরণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত।
মাষকলাই (Vigna radiata প্রজাতিটি এ অঞ্চলের না হওয়ায় এর চাষযোগ্য জাতগুলি প্রবর্তিত উৎস থেকে বাছাইকৃত। পশুখাদ্যশস্য হিসেবে এটি বিশ শতকের চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে নির্বাচিত হয়েছিল।
খেসারি (Lathyrus sativus) কৃষিজ জাতসমূহ থেকে বাছাইকৃত। এতে বিদ্যমান এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকায় অধিক পরিমাণ আহারে ল্যাথারিজম রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গোমটর (Vigna unguiculata) দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বহু বছর থেকে চাষকৃত স্থানীয় শস্যের জাতসমূহ থেকে নির্বাচিত। সম্ভবত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পর্তুগিজদের দ্বারা প্রবর্তিত। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমেও এসেছে  বলে ধারণা করা হয়।
ভারতীয় সরিষা (Brassica juncea) ২টি স্থানীয় উৎস থেকে এবং ১টি ভারতীয় উৎস থেকে উৎপন্ন। আরেকটি ইঅট কর্তৃক মিউটাজেন   প্রয়োগে উদ্ভূত মিউট্যান্ট থেকে নির্বাচিত।
বাদামী সরিষা (Brassica campestris) টরি-৭ হিসেবে নিবন্ধিত অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী সরিষার জাতটি এই এলাকার অন্যতম আদি নির্বাচন। এখনও ব্যাপকভাবে চাষ চলে। অন্য জাতটি টিএস-৭২, ১৯৭২ সালে টরি-উৎস থেকে বাছাইকৃত।
হলুদ সরিষা (Brassica campestris) ৪টি জাতের ১টি ১৯৭২ সালে চেকস্লোভাকিয়া থেকে প্রবর্তিত এবং ১৯৮২ সালে ‘সম্পদ’ নামে নিবন্ধিত। এসএস-৭৫ মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান থেকে প্রবর্তিত ও ১৯৮১ সালে নিবন্ধিত। অন্য ২টি মিউটেশন ঘটিয়ে উৎপন্ন।
রাই-সরিষা (Brassica napus) বিশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি প্রবর্তিত। B. campestrisB. napus এই দুই প্রজাতির অনুপ্রবিষ্ট (introgressive) সংকর থেকে বাংলাদেশে আগাম পরিপক্কতার জন্য নির্বাচিত।
সূর্যমুখী (Helianthus annuus মুক্ত-পরাগায়িত বিমিশ্র জাত। সুঅভিযোজিত সংকর জাতের বীজ প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। চাষাধীন জমির পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত।
তিল (Sesamum indicum) বাংলাদেশে প্রকৃতিজাত উৎস থেকে ১টি নির্বাচিত। অন্যটি সিরিয়া থেকে প্রবর্তনের পর বাছাইকৃত।
সয়াবিন (Glycine max) ২টি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১টি শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত হয়ে আগত।
চীনাবাদাম (Arachis hypogea) অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও ভারত থেকে ১টি করে প্রবর্তিত। অন্য ২টিও বিদেশী, তবে বিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশে চাষাধীন।
হলুদ (Curcuma domestica) বহু বছর ধরে চাষকৃত স্থানীয় জাত থেকে নির্বাচিত।
গোলমরিচ (Piper nigrum) মূলত মালয়েশিয়া থেকে প্রবর্তিত এবং জাত হিসেবে অবমুক্তির জন্য ক্লোন থেকে নির্বাচিত।
পেয়ারা (Psidium guajava) ২টি জাতের ১টি থাইল্যান্ড থেকে প্রবর্তিত এবং অন্যটি স্থানীয় জাত থেকে নির্বাচিত।
পেঁপে (Carica papaya)  স্থানীয় উৎস থেকে বাছাইকৃত জাতটি অবমুক্ত করা হয়েছে। কয়েকটি সংকরজাতও পাওয়া যায়।
কলা (Musa spp.) : স্থানীয় ও বিদেশী বসরাই নামে প্রবর্তিত একটি কলার জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে দেশের ২টি গুরুত্বপূর্ণ জাত - অমৃতসাগর ও সবরি। বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা কাঁচকলা, চাঁপা, গণসুন্দরি, বিচিকলার (ডিপ্লয়েড) জাতগুলি চাষ করে।
বাঁধাকপি (Brassica oleracea var. capitata) ১৬ এগুলির বীজ আমদানিকৃত এবং চাষের জন্য আমদানিকারকদের মাধ্যমে প্রতি বছর আমদানির জন্য জাতসমূহ জাতীয় বীজ-ব্যাঙ্কে নিবন্ধিত হয়। এগুলির অভিযোজিত জাতগুলির দেশের অঞ্চলভেদে ফলনে পার্থক্য ঘটে।
ফুলকপি (Brassica oleracea var. botrytis) ১১ ১১টি জাতের মধ্যে কৃষকদের বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাত্র ১টি বাংলাদেশে উৎপন্ন যা টাঙ্গাইলে চাষ হচ্ছে। অন্য সবগুলি অন্যান্য দেশ থেকে বীজ হিসেবে আমদানিকৃত এবং অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের সংকর।
মূলা (Raphanus sativus) সবগুলিই আমদানিকৃত। অধিকন্তু আছে জাপান থেকে প্রবর্তিত ‘তাসাকিসান’ জাত। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাত লাল-বোম্বাই (Red Bombay)।
পিঁয়াজ (Allium cepa)  তাহেরপুরী ও ফরিদপুর ভাটি বাংলাদেশের ২টি বাছাইকৃত জাত। অন্যগুলি ভারতীয় এবং আমদানিকৃত বীজে চাষ।
টমেটো (Lycopersicon lycopersicum) ১০  ১০টি জাতের সবগুলি আমদানিকৃত। এসব জাতের অধিকাংশই দীর্ঘদিন থেকে চাষাধীন।
মটর (Pisum sativum)   সবগুলিই আমদানিকৃত। মটরকলাই নামে একটি বাংলাদেশে উৎপন্ন এবং কৃষকদের দ্বারা নির্বাচিত; সরিষা বা খেসারির সঙ্গে অধিকাংশ নিচু জমিতে চাষ হয়।
মিষ্টিভুট্টা (Zea mays উভয়ই আমদানিকৃত, সংকর জাত।
শশা (Cucumis sativus) ২টিই বিদেশ থেকে প্রবর্তিত।
বেগুন (Solanum melongena) প্রজনন প্রক্রিয়ায় BARI কর্তৃক ৩টি জাত উদ্ভাবিত। অন্য ৬টি অতীতে স্থানীয় লোকদের দ্বারা ভূমিজ জাত থেকে নির্বাচিত।
লাউ (Lagenaria vulgaris)  ২টিই আমদানিকৃত ও প্রবর্তিত। ৩টি স্থানীয় জাতও রয়েছে।

ফসলের ক্ষতিকর প্রাণী ও রোগবালাই

ক্ষতিকর প্রাণী (Pest)  শস্য আক্রমণকারী ও অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধক কীটপতঙ্গ, মাইট, নিমাটোড, ইঁদুর অথবা পাখিসহ যে কোনো জীব। বর্তমান হিসাব মতো বাংলাদেশে শুধু কীটপতঙ্গঘটিত বাৎসরিক ফসলহানির পরিমাণ ধান ১৬%, পাট ১৫%, গম ১১%, আখ ২০%, শাকসবজি ২৫% এবং ডাল শস্য ২৫%। শস্যভুক বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর ইঁদুর ছাড়াও গুদামজাত শস্য ও সামগ্রীর অনিষ্টকারী মোট ৭০০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ ও মাইট এ পর্যন্ত দেশে তালিকাভুক্ত হয়েছে, এর মধ্যে দুই শতাধিক প্রজাতি ‘মুখ্য’ অনিষ্টকারী হিসেবে গণ্য। ‘মুখ্য’ বা ‘গৌণ’ হিসেবে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের অবস্থান সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট বাস্ত্ততন্ত্রের বিদ্যমান পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।

সারণি ৩  মাঠের বিভিন্ন শস্যের প্রধান ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও মাইটের প্রজাতি সংখ্যা।

শস্য #প্রধান কীটপতঙ্গের বর্গ/গোত্র #প্রজাতি সংখ্যা

দানাশস্য (ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি) #Lepidoptera: Pyralidae, Noctuidae Coleoptera: Chrysomelidae Homoptera: Cicadellidae#৩৪

ডালশস্য (মটরকলাই, ছোলা, মুগ ইত্যাদি) #Lepidoptera: Noctuidae, Pyralidae, Pterophoridae, Arctiidae, Lycaenidae Diptera: Agromyzidae Homoptera: Aphididae #১৩

তৈলবীজ (সরিষা, তিল, সয়াবিন, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ইত্যাদি)#Homoptera: Aphididae, Cicadellidae Lepidoptera: Sphingidae, Arctiidae, Gelechiidae, Noctuidae, Lymantridae Hymenoptera: Tenthredinidae Diptera: Agromyzidae #১৯

আখ #Lepidoptera: Pyralidae, Noctuidae Isoptera: Termitidae Coleoptera: Scarabaeidae Homoptera: Lophopidae, Aleyrodidae, Aphididae#১৬

পাট   #Lepidoptera: Arctiidae, Noctuidae Coleoptera: Apionidae Orthoptera: Gryllidae Acarina (mite): Tetranichidae,Tarsonemidae #৬

তুলা  #Homoptera: Cicadellidae, aphididae, Aleyrodidae Hemiptera: Pyrrhocoridae Lepidoptera: Noctuidae, Pyralidae#৮

কন্দজাতীয় ফসল (আলু, মিষ্টিআলু, কচু) #Lepidoptera: Noctuidae, Pyralidae, Arctiidae Sphingidae Coleoptera: Coccinellidae, Curculionidae, Chrysomelidae Homoptera: Cicadellidae, Aphididae#১৭

শাকসবজি (লাউ-কুমড়া, শিম, ঢেঁড়স বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি) #Coleoptera: Chrysomelidae, Coccinellidae Diptera: Tephritidae Lepidoptera: Noctuidae, Pyralidae, Yponomeutidae, Lycaenidae, Pieridae Homoptera: Aphididae, Cicadellidae Hemiptera: Pyrrhocoridae#৩৭

কিছু কিছু ফসল প্রায় সর্বত্র সারা বছরই ফলে, আবার অন্যান্য কিছু দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভাল ফলন দেয়। চাষ পদ্ধতিভিত্তিক কোনো কোনো কৃষি-বাস্ত্তসংস্থানিক অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণের ঘটনা বেশি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ধানের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দেশের সর্বত্র থাকলেও ধানের পামরি পোকার (Dicladispa armigera) প্রকোপ পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায়ই অত্যধিক। ধানের মাজরা পোকার (Scirpophaga incertulas) আক্রমণ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বোরো ধানেই বেশি দেখা যায়। উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধানের উপর সবুজ শোষকপোকার (Nephotettix spp.) আক্রমণ অধিক। সেচব্যবস্থাধীন নিচু ধানী জমিতে সাদাপিঠ শোষকপোকা এবং বাদামি শোষকপোকার (Nilaparvata lugens) উৎপাত বেশি। পাটের বিছা পোকা (Spilosoma obliqua) বাংলাদেশের পাট উৎপাদক জেলাগুলির সর্বত্র দেখা গেলেও পাটের ঘোড়াপোকা (Anomis sabulifera) দেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনায় মারাত্মক ক্ষতিকর।

উল্লিখিত তালিকাটিতে ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়ে আক্রান্ত প্রধান ফসলগুলির নাম, কীটপতঙ্গের বর্গ/গোত্র এবং প্রজাতির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ফলবৃক্ষ ও রোপিত ফসলের কীটপতঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হয় নি।

নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা  ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বাংলাদেশে কার্যত অনুপস্থিত ছিল। ধান ও পাট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসল হবার কারণে এ জাতীয় ফসলের পোকা দমন কিছু সনাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন, শস্যাবর্তন, হাত দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কীটসংগ্রহ, উদ্ভিদের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ধ্বংস এবং উন্নত চাষগত ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে অজৈব কীটনাশক (লেড আরসেনেট/lead arsenate এবং নিকোটিন সালফেট/nicotine sulphate) এবং স্থূল উপকরণ (ছাই, অশোধিত চুন এবং অশোধিত তেল) ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ সর্বপ্রথম কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যবহার চালু করে এবং কৃষকদের মধ্যে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। ধান ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের মধ্যে অল্প সময়েই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সাল থেকে সরকার হ্রাসকৃত মূল্যে কীটনাশক বিক্রয় শুরু করে এবং ১৯৭৯ সাল থেকে এ ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে কৃষকরা এ রাসায়নিক ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে ২৯৯টি ট্রেডমার্ক নামের বিভিন্ন শ্রেণি ও ধরনের (formulation) সর্বমোট ৯৪টি কীটনাশক (একটি উদ্ভিদজাত) কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধীকৃত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে কৃত্রিম বালাইনাশকের (pesticides) মোট ব্যবহার ছিল প্রায় ১৪,৩৪০ মে টন তন্মধ্যে সক্রিয় বা কার্যকর উপাদান ছিল ২৪৬২ মে টন। গোটা দেশে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ কীটনাশকই ধানের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহূত হয়। ২০০৫ সালে মোট ২৫,৪৬৬ মে টন বালাইনাশক ব্যবহূত হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে ১৪,০৬১ মে টন দানাদার, ২,৫১১ মে টন তরল এবং ৩২৩ মে টন গুঁড়া কীটনাশক। এ সময়ে ছত্রাকনাশক (fungicides), আগাছানাশক (weedicides) এবং ইঁদুরনাশক (rodenticides) ব্যবহূত হয়েছে যথাক্রমে ৫,৭১১, ২,৭৭৪ এবং ২৩ মে টন  (উৎস Bangladesh Pesticide Association)।

শুধু রাসায়নিক কীটনাশক সব সময় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সুফল এনে দেয় না। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (DAE) সম্প্রতি ৬৩ জেলার ৭২ উপজেলায় FAO-এর সঙ্গে যৌথভাবে সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management/IPM) কার্যক্রম শুরু করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ শাকসবজি ও ধানের সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থপনা সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ৮৩৬ জন সম্প্রসারণ কর্মীকে প্রশিক্ষণদানের জন্য ডানিডা (DANIDA)-এর সহযোগিতায় ১৩৭ উপজেলায় পাঁচ বছর মেয়াদি অপর একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। প্রায় ২৫,০০০ সবজি চাষি ও ৮০,০০০ ধান চাষি এ সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম থেকে উপকৃত হবে। সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ছাড়াও পরিকল্পনাটির আরও ৩টি কার্যক্রম রয়েছে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের নজরদারি ও পূর্বাভাস, কীটনাশক প্রয়োগ ও মাননিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ উন্নয়ন।

রোগবালাই (Disease)  সব ধরনের ফসলই নানা প্রকার রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। আজ পর্যন্ত ৪৩টি ফসলি উদ্ভিদের ৫৩৬টি রোগ চিহ্নিত হয়েছে। কেবল রোগের কারণে কি পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও বিশেষজ্ঞদের এক হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির মাত্রা বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা। শুধুমাত্র উৎপাদন নয়, রোগের কারণে সব ফসলেই গুণগত মান বহুলাংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশে ধান ও অন্যান্য দানাশস্য, ডাল তৈলবীজ, শাকসবজি, ফল, তন্তু ফসল, আখ এবং মসলাদির যথাক্রমে ১১০, ১০৯, ৮০, ৯৪, ৫৫, ৩৩, ২৪ এবং ৩১টি রোগ স্পষ্টত শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে যথাক্রমে ৩৭, ২৬, ২৪, ৩২, ২৮, ১৮, ৯ এবং ৮টি রোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের রোগ সাধারণত রোগজীবাণুর ধরনের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা এবং উদ্ভিদের পরজীবী নিমাটোড। মাটি অথবা বীজের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগ যথাক্রমে মাটিবাহিত ও বীজবাহিত রোগ নামে পরিচিত। কতক রোগ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, আবার কতক, বিশেষ করে ভাইরাস রোগ সংক্রামিত হয় সাধারণত কীটপতঙ্গের মাধ্যমে।

সারণি ৪  বাংলাদেশের বিভিন্ন ফসলের রোগ (সংখ্যা)

ফসল.শস্য#মোট রোগ#প্রধান রোগ#অপ্রধান রোগ

দানাশস্য#১১০#৩৭#৭৩

ডাল#১০৯#২৬#৮৩

তৈলবীজ#৮০#২৪#৫৬

শাকসবজি #৯৪#৩২#৬২

ফল/ফলগাছ #৫৫#২৮#২৭

তন্তু ফসল  #৩৩#১৮#১৫

আখ#২৪#৯#১৫

মসলা #৩১#৮#১৫

মোট #৫৩৬#১৮২#৩৫৬

উৎস  HU Ahmed 1994, PAB-GIFAP Asia Working Group Meeting Proceedings.

বাংলাদেশ থেকে আজ পর্যন্ত চিহ্নিত দানাশস্যের মোট ১১০টি রোগের মধ্যে প্রায় ৭৫টি ছত্রাকঘটিত। ধান ও অন্যান্য দানাশস্যের গুরুত্বপূর্ণ রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে ধানের পাতা ঝলসানো রোগ, খোলপোড়া রোগ, টুংরো, উফ্রা, কান্ডপচা রোগ, খোলপচারোগ, বাদামি দাগ, লালরেখা রোগ, এবং শিকড়গিট (root knot) রোগ; গমের কান্ডপচা, লালচে রেখা রোগ, চারাপোড়া রোগ, ও পাতা ঝলসানো রোগ; ভূট্টার পাতাপোড়া রোগ; বার্লির লালচে রেখা ও গোড়াপচা রোগ; কাউনের গোড়াপচা, পাতা ঝলসানো ও ডাউনি মাইল্ডডিউ রোগ; বাজরার পাতার দাগ, অ্যানথ্রাকনোজ, পাতার মরিচা রোগ ও ডাউনি মাইল্ডডিউ এবং যবের লুজ স্মাট ও লিফ ব্লচ।

প্রায় ১০৯টি বিভিন্ন ধরনের রোগ দ্বারা ডালজাতীয় ফসল আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ২৬টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। মাঠ পর্যায়ে এসব রোগ শনাক্ত করা হয়েছে ছোলা (১১), মসুর (১৬), খেসারি (১৪), মুগ (১৬), মাষকলাই (২১), মটর (১১), শিমমটর (১১), এবং গোমটর (৯) থেকে। এসব ফসলের উল্লেখযোগ্য রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে মূলপচা রোগ (root rot), পাতা ঝলসানো রোগ, ইয়োলো মোজাইক (yellow mosaic), উইল্ট (wilt), রাস্ট (rust) এবং ডাউনি মাইল্ডডিউ। বাংলাদেশ থেকে ২৪টি প্রধান রোগসহ প্রায় ৮০টি রোগ সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, সয়াবিন, সূর্যমুখী এবং তিসিসহ নয়টি তৈলবীজ শস্য থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসব ফসলের সবচেয়ে ক্ষতিকর ও উল্লেখযোগ্য রোগগুলি হচ্ছে সরিষার অলটারনেরিয়া ব্লাইট; চীনাবাদামের টিক্কা ও রাস্ট; তিসি, চীনাবাদাম ও তিলের কান্ডপচা রোগ, এবং সয়াবিনের অ্যানথ্রাকনোজ ও ইয়োলো মোজাইক রোগ।

mviwY 5  †ivMRxevYyNwUZ `vbvk‡m¨i †ivM (msL¨v)

ফসল #রোগজীবাণু  #মোট

  1.  ছত্রাক  #ব্যাকটেরিয়া #ভাইরাস ও মাইকোপ্লাজমা#নিমাটোড   #

ধান #২০#৩#২#৬#৩১

গম#১২#০#২#৬#২০

ভূট্টা  #১৯#১#৩#৫#২৮

কাউন#৭#০#০#৩#১০

বার্লি #১১#০#২#০#১৩

বাজরা (সরগাম)#৪#০#১#০#৫

যব#২#০#১#০#৩

মোট#৭৫##১১#২০#১১০

উৎস HU Ahmed 1994, PAB-GIFAP Asia Working Group Meeting Proceedings.

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয় এমন নয়টি সবজি ফসলের প্রায় ৯৪টি রোগ আজ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি মুখ্য রোগ হিসেবে বিবেচিত। উল্লেখযোগ্য রোগগুলি হলো আলুর ব্লাইট, কান্ডপচা, ব্লাক স্ক্র্যাফ, ড্রাই রট, উইল্ট, ব্লাক লেগ, রিং রট, নাবি ধ্বসা, বাদামী পচা এবং পাতামোড়া; টমেটোর লেট ব্লাইট, আর্লি ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট এবং মোজাইক; বেগুনের ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, ফ্রুট রট এবং লিটল লিফ; বাধাকপি, ফুলকপি ও মুলার লিফ স্পট; শিমের অ্যানথ্রাকনোজ; ঢেঁড়সের ইয়োলো মোজাইক এবং লাউয়ের পাউডারি মাইল্ডডিউ।

বিভিন্ন ফলের প্রায় ৫৫টি চিহ্নিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কলার ফিউসারিয়াম উইল্ট, ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট এবং সিগাটোকা (sigatoka); পেপের মোজাইক (ভাইরাস) এবং স্টেম রট; আমের অ্যানথ্রাকনোজ; লেবুজাতীয় ফলগাছের ডাইব্যাক (dieback) এবং পেয়ারার উইল্ট রোগ। ফলের অনেক রোগই বীজবাহিত। আক্রান্ত বীজ থেকে উৎপন্ন চারা বেঁচে থাকলে পরবর্তী মৌসুমেই রোগ প্রকাশ প্রায়।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

আরও দেখুন কীটনাশক; সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা; ক্ষতিকর প্রাণী

কৃষিসম্পদ (Agricultural resources)  কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান কৃষিসম্পদ হচ্ছে জমি, পানি, কৃষি জলবায়ু, ফসলের বিভিন্ন জাত ও উপজাত, পশুসম্পদ ও মৎস্য এবং বনাঞ্চল। এদেশের ভূমিসম্পদ তিনটি প্রধান ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত; প্লাবনভূমি, সোপান (terrace) ও পার্বত্য। বাংলাদেশের প্রায় ৮০% প্লাবনভূমির অন্তর্গত। সাধারণত পলিগঠিত এ সমভূমিতে মেঘনা, যমুনা, পদ্মা ও সেগুলির অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে। এসব নদনদী দ্বারা বাংলাদেশের ভৌত পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠিত। এগুলি সুলভ পরিবহণ যোগায়, নিষ্কাশন নালা হিসেবে কাজ করে এবং মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করে। অধিকন্তু, নদীসমূহ প্রচুর পরিমাণে কাদা, পলি ও বালি বহন করে কৃষিজমিতে জমা করে। এভাবে সঞ্চিত কাদা ও পলিতে পটাশযুক্ত খনিজ থাকে এবং তা মাটিকে পটাশিয়ামঘটিত পুষ্টিদ্রব্যে সমৃদ্ধ রাখে। চার ধরনের প্রধান প্লাবনভূমি শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলি (ক) পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলীর পবর্তসানু (piedmont); (খ) পদ্মার জোয়ারধৌত প্লাবনভূমি; (গ) পদ্মা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারার বিসর্প প্লাবনভূমিসমূহ; এবং (ঘ) পুরাতন ও নতুন মেঘনার মোহনাগুলি। মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত সোপান অঞ্চলগুলি কিছুটা উঁচু এবং বাংলাদেশের প্রায় ৮% জুড়ে বিস্তৃত। গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার অংশ নিয়ে মধুপুর অঞ্চল এবং রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলার অংশ নিয়ে বরেন্দ্রভূমি গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহ এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, সিলেট জেলার অংশ এবং ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলগুলি গঠিত যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২%। এ অঞ্চলগুলি উঁচু-নিচু পাহাড় অধ্যুষিত।

মোট প্রায় ১৩৫ লক্ষ হেক্টর ভূমির মধ্যে কৃষিতে ব্যবহূত হচ্ছে প্রায় ৯১ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর, আর বনাঞ্চল বা সম্ভাব্য বনাঞ্চলে রয়েছে ২৪ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর। গত তিন দশকে কৃষিজমির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ফসলি জমি (নিট ফসলি জমির ৩০%) অনবরত দুই ফসলি (৫৫%) ও তিন ফসলি (১৫%) জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ফসল চাষের নিবিড়তা (crop intensity) প্রায় ১৮২%।

ভৌত রাসায়নিক ধর্ম, বর্ণ, পুরুত্ব ও চুনের উপস্থিতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাটি মোটামুটি ২০টি সাধারণ শ্রেণিতে বিভক্ত। দেশের অধিকাংশ মাটিই ফসলের পুষ্টি যোগাতে কম সমর্থ। বিভিন্ন মাটিতে ব্যাপকভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত পুষ্টিবস্ত্ত হলো নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও গন্ধক। যেসব চুনসমৃদ্ধ ও হালকা বুনটের মাটিতে ফসল চাষের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে জিঙ্ক ঘাটতি প্রকট। বোরন ঘাটতিও অনেক এলাকায় দেখা যায় যা গম, সূর্যমুখী ও সরিষার বন্ধ্যাত্ব এবং পেঁপের ফলবিকৃতির অন্যতম কারণ। হিমালয়ের পাদদেশের সমতলের মাটিতে এবং অম্লীয় বাদামী পাহাড়ি মাটিতে ম্যাগনেসিয়াম ঘাটতি দেখা যায়। বিগত পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে এদেশে মাটির উর্বরতা মৃত্তিকাবিজ্ঞানী এবং কৃষিবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ষাটের দশকে রাসায়নিক সারনির্ভর উচ্চফলনশীল জাতসমূহ প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত প্রধানত সনাতন চাষাবাদ চলছিল যখন ফলন খুব কম ছিল এবং মাটির উর্বরতার ওপর চাপও পড়ত না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শস্য উৎপাদন সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল জাত ও নিবিড় চাষাবাদ প্রবর্তনের পর থেকে সারাদেশে মাটির উর্বরতার দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে। বর্তমানে কৃষকেরা হেক্টর প্রতি বছরে মাত্র ১৩২ কেজি হারে (নাইট্রোজেন ১০৪, ফসফেট ৫.৫, পটাশ ১১.৮ ও গন্ধক+দস্তা+অন্যান্য ১০.৭) প্রায় ৩০ লক্ষ মে টন সার ব্যবহার করছে, যেখানে সম্ভাব্য ক্ষয় হচ্ছে বছরে প্রায় ২০০ কেজি। এভাবে মাটির উপর অবিরাম চাপ অব্যাহত রয়েছে।

পানিসম্পদ  বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদগুলির একটি পানি। বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) ভারী বৃষ্টিপাত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১২৫০ মিমি ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৪০০০ মিলিমিটারের মতো। এ প্রচুর পরিমাণ ভূপৃষ্ঠস্থ পানি প্রধান নদীগুলি দিয়ে প্রবাহিত হয় ও সেগুলিকে প্লাবিত করে। অধিকন্তু, একই সময়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা প্রচুর পরিমাণ পানিতে প্রায়শই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং দেশে বন্যা দেখা দেয়। এসব বন্যা ক্ষেতের ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসহ অনেক সময় মানুষের প্রাণহাণিও ঘটায়। ভূপৃষ্ঠের উচ্চতার পার্থক্যের জন্য প্লাবনের গভীরতা ও স্থিতিকাল ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত প্লাবনের গভীরতা দেশের উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বে অগভীর, কিন্তু মধ্যাঞ্চলে গভীর থেকে খুব গভীর হয়ে থাকে।

সেচ এলাকা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯০-৯১ সালে প্রায় ২৬ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর থেকে ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রায় ৪০ লক্ষ হেক্টরে দাঁড়ায়। ১৯৯৬-৯৭ সালে যেখানে মোট সেচ এলাকার ৬৪.৫% ছিল ভূনিম্নস্থ সেচ সেখানে ভূপৃষ্ঠস্থ সেচ ছিল মাত্র প্রায় ৩১.৫%। ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত সেচ এলাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪ লক্ষ ১০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়, যা মোট সেচযোগ্য এলাকা ৭৫ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টরের প্রায় ৭২%। দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর ভূপৃষ্ঠস্থ পানি রয়েছে, কিন্তু পানির গুণাগুণ একটি বাস্তব সমস্যা। সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি ভূনিম্নস্থ অগভীর পানিস্তরে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে ভূমিতে লবণাক্ততা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে শস্য বহুমুখীকরণ কর্মসূচির সার্বিক সাফল্যের সঙ্গে পানির অবস্থা ও সেচ এলাকার একটা কার্যকর সম্পর্ক রয়েছে।

কৃষি জলবায়ু  বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে সারা দেশে চারটি কৃষি জলবায়ু অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্লেষিত তথ্যের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩০টি প্রধান কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫০টি কেন্দ্রের প্রাত্যহিক বৃষ্টিপাত, প্রায় ১৮০টি কেন্দ্রের দীর্ঘদিনের বৃষ্টিপাতের পরিমাপ, ৩০টি প্রধান কেন্দ্রের প্রাত্যহিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এবং অন্যান্য জলবায়ুগত পরিমাপ যেমন, ৩০টি প্রধান কেন্দ্রের কার্যকর উবনপ্রস্বেদন (evapotranspiration), বায়ুর গতি, সূর্যালোক ইত্যাদি। চারটি কৃষি জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ১. প্রাক-খরিফ সময়সীমার গড় দৈর্ঘ্য, যখন বৃষ্টিনির্ভর আর্দ্রতার যোগান অনিশ্চিত; ২. বৃষ্টিনির্ভর খরিফ ও রবিশস্য উৎপাদন মৌসুমের গড় দৈর্ঘ্য; ৩. সর্বনিম্ন তাপমাত্রাসহ (১৫° সে তাপমাত্রার নিচে) এক বছরের দিনের গড় সংখ্যা; ৪. গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রাসহ (৪০° সে তাপমাত্রার ঊর্ধ্বে) বছরে দিনের গড় সংখ্যা।

কৃষিজ সম্পদের ব্যবস্থাপনা  বর্তমান বাজারমূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি-তে) কৃষির অবদান ১৯৮৪-৮৫ সালে প্রায় ৫০.৪% থেকে ২০০৬-০৭ সালে প্রায় ২১% নেমে এলেও এ খাত এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। শস্য উপখাত একাই কৃষিসম্পদের মূল্য সংযোজনের প্রায় ৫৬% যোগান দেয় আর অতিরিক্ত ১৪% পশুসম্পদ, ২২% মৎস্য ও ৮% বন থেকে আসে। সাধারণ শ্রমশক্তির ৫২% কৃষিখাতে নিযুক্ত।

শস্য উপখাত  দানাজাতীয় শস্যের উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালে ১ কোটি ২ লক্ষ ৬০ হাজার টন থেকে গত দু’দশকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৬-০৭ সালে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ ৮৭ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। বোরো ও আমন ধান আর গম থেকেই প্রধানত এ বৃদ্ধি ঘটে। অ-দানাদার শস্যের মধ্যে আলুর উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮১-৮২ সালে ১০ লক্ষ ৯০ হাজার টন থেকে ২০০৭-০৮ সালে প্রায় ৮২ লক্ষ টনে পৌঁছেছে। সেচের মাধ্যমে বোরো চাষের জন্য জমি পুনর্বণ্টনের ফলে মোট উৎপাদন কমলেও ডাল আর তৈলবীজের মতো অন্যান্য শস্যের ফলন বেড়েছে। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য যৌগ চাষাবাদের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, বর্ধিত ফসল চাষের নিবিড়তা ও উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার আবশ্যক। এজন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের নিবিড় ব্যবহারের মাধ্যমে বীজ-সার-সেচ প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ।

প্রাণি সম্পদ উপখাত  বাংলাদেশের চিরায়ত চাষাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রাণি সম্পদ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশজ উৎপাদনে পশুসম্পদ উপখাতের অবদান ছিল স্থির মূল্যে ২.৯২ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৬.১৫ ভাগ। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, চাষাবাদ এবং চামড়াজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন ও রপ্তানিতে এ উপখাতের ভূমিকা অপরিসীম। মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০০৫-০৬ অর্থবছরে গরুর সংখ্যা ছিল ২২.৮ মিলিয়ন, মহিষের সংখ্যা ছিল ১.১৬ মিলিয়ন, ছাগলের সংখ্যা ১৯.৯৪ মিলিয়ন, ভেড়ার সংখ্যা ২.৫৭ মিলিয়ন, মোগর-মুরগির সংখ্যা ১৯৪.৮২ মিলিয়ন এবং হাঁসের সংখ্যা ছিল ৩৮.১৭ মিলিয়ন। মোট সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশে পশু-পাখির ঘনত্ব বেশি। তবে এদের উৎপাদনশীলতা কম। ফলে প্রাণিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে। অধিকাংশ পশুর জাত বংশগতভাবে নিম্নমানের এবং তাই নিম্ন উৎপাদনক্ষম। অবশ্য নিবিড় ও আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে বর্তমানে অধিক উৎপাদনশীল জাতগুলির পালন সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলছে। এ বিষয়ে আরো গবেষণা হচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্য, রোগ ও ব্যবস্থাপনা সমস্যার সমাধানকল্পে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পশু-পাখি সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এ পর্যন্ত ৫৯টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং তা সাধারণ কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগুলির মধ্যে রয়েছে গরু মোটাতাজাকরণ, সবুজ ঘাস সংরক্ষণ, ছাগলের পিপিআর ভ্যাকসিন ও বসন্ত রোগের টিকা উদ্ভাবন, ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য ব্রয়লার ও লেয়ার পালন, কোয়েল ও কবুতর পালন ইত্যাদি।

মৎস্য উপখাত  এ উপখাত খাবারযোগ্য মোট আমিষের প্রায় ৫৮% যোগান দিয়ে থাকে। দেশজ উৎপাদনে এ উপখাতের শরিকানা ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ৪.৭৩ শতাংশ। দেশের প্রায় ১.২৫ কোটি লোক তাদের জীবন জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের উপর নির্ভরশীল। আমাদের পানি সম্পদের বিস্তৃতি প্রায় ৪.৯ মিলিয়ন হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৩৪ শতাংশ। এদেশে রয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ্য পুকুর-দিঘি, যার আয়তন ৩.০৫ লক্ষ হেক্টর এবং ২৪,০০০ কি.মি. দীর্ঘ নদী-নদী যার আয়তন ১০.৩২ লক্ষ হেক্টর। এ ছাড়া রয়েছে ১.১৪ লক্ষ হেক্টর আয়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫,৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮,৮০০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট কাপ্তাই হ্রদ, প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর সুন্দরবন খড়ি অঞ্চল এবং ২৮.৩০ লক্ষ হেক্টর আয়তনের বিশাল প্লাবনভূমি। বিগত ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদন ছিল ২৪.৪০ লক্ষ মে টন। এর মধ্যে আভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের উৎপাদন ছিল ১০.০৭ লক্ষ মে টন। পুকুর-দিঘি ও বাঁওড়ের উৎপাদন ছিল ৮.১৬ লক্ষ মে টন এবং সামুদ্রিক উৎস থেকে আহরিত হয়েছে ৪.৮৭ লক্ষ মে টন। আমাদের আভ্যন্তরীণ মিঠা পানিতে আছে ২৬০ প্রজাতির মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি; মোহনা ও সমুদ্রে আছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। সম্প্রতি দেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের জাতীয় চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন যথেষ্ট নয়। ইতিমধ্যে  বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) উদ্ভাবিত কিছু প্রযুক্তি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে ব্যাপক প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও মৎস্যচাষ বিষয়ক পুস্তিকা/সারগ্রন্থ বিতরণের মাধ্যমে সারাদেশে গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে এসব প্রযুক্তি সাফল্যের সঙ্গে হস্তান্তর করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে কার্প মাছের বিভিন্ন আকারের পোনা উৎপাদন, কার্পের যৌথচাষ, নাইলোটিকার চাষ, সমন্বিত ধান-মাছচাষ এবং সমন্বিত হাঁস-মুরগি-মাছ চাষ।

বন উপখাত  দেশের শতকরা ৮৯ ভাগ বন এলাকা সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত। বাকি শতকরা ১১ ভাগ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন গ্রামীণ বনভূমি। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দেশের বনাঞ্চল ক্রমেই উজাড় হচ্ছে। বর্তমানে দেশের শতকরা মাত্র ৭.৭ ভাগ এলাকায় বৃক্ষরাজির আচ্ছাদন রয়েছে। এটি পরিবেশের ভারসাম্য ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত অপ্রতুল। বন হতে কাঠ, লাকড়ি, বাঁশ, গোলপাতা, মধু এবং মাছসহ শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ হয়ে থাকে। গত ৩ দশক ধরে এসবের মোট উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। তবে দেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে বনভূমি গড়ে তোলা এবং অপেক্ষাকৃত হালকা বনাঞ্চলে গাছের ভারি আচ্ছাদন সৃষ্টির প্রক্রিয়া লক্ষ্যণীয়। এ ছাড়া বনজ সম্পদের সার্বিক উন্নয়নের নিমিত্তে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানটিও বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা দেশের বন সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ খাদ্যঘাটতির দেশ। খাদ্য ও অন্যান্য প্রধান কৃষি উপখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে দুষ্প্রাপ্য কৃষিসম্পদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার জন্য সম্পদের গতিশীল প্রকৃতি ও অনন্যতা অনুধাবন আবশ্যক। নিবিড় চাষাবাদযোগ্য এলাকা এবং স্বল্প সম্ভাবনাশীল এলাকা উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ফলন লাভের জন্য কৃষিসম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা দরকার। এসবের অপব্যবহার কৃষির উৎপাদনশীলতার ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।  [মোঃ শহীদুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম]

আরও দেখুন কৃষি আবহাওয়া; ফসল; বন ও বনবিজ্ঞান; প্রাণিসম্পদ; সেচ

কৃষি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়াদি (Environmental issues related to agriculture)  পরিবেশগতভাবে বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপ্রবন দেশ। দেশের কোনো না কোনো স্থানে কম অথবা বেশি কিছু পরিবেশগত ঘটনা প্রতি বছরই সংঘটিত হয় এবং মাঝে মাঝে এগুলি হয়ে উঠে ধ্বংসাত্মক। এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিলাবৃষ্টি, প্রচন্ড ঘূর্ণিবাত্যা, অতিবৃষ্টিপাত, অথবা গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের মতো যে কোনো একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় সারা বছরের শ্রমকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। এ ছাড়াও আশংকা করা হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিশাল এলাকা সাগরের লবণাক্ত পানি দ্বারা নিমজ্জিত হতে পারে। অধিকন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রাকৃতিক কারণে দেশের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায় অব্যাহতভাবে অনুমোদন যোগ্য কৃষি উৎপাদনের ব্যাপারে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যেসব প্রধান পরিবেশগত সমস্যাবলীর সুরাহা করা আবশ্যক সেগুলি হচ্ছে বন্যা, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় (এবং আকস্মিক জোয়ারজনিত জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, মৃত্তিকার ক্ষয়, জমির মানের অবনতি, মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস, জৈব উপাদানের ক্ষয়প্রাপ্তি, প্রচন্ড ঘূর্ণিবাত্যা, ভূমিকম্প, কালবৈশাখী এবং শিলাবৃষ্টির সঙ্গে ঝড়, লবণাক্ততা, পলি জমা, হাঁস-মুরগি এবং গবাদি পশুর রোগ বালাই এবং ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্তরায় অতি উচ্চ তাপমাত্রা। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট প্রধান পরিবেশগত সমস্যাগুলি হলো পরিবেশের মানের অবনতি, ভূমিধ্বস, ভূগর্ভের পানি স্তর হ্রাস, বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়া, মৎস্য এবং গবাদি পশু সম্পদ হ্রাস পাওয়া এবং বায়ু ও পানি দূষিত হয়ে যাওয়া বা ভূমধ্যস্থ পানি আর্সেনিক দ্বারা দূষিত হওয়া। এসব সমস্যাবলীর মধ্যে বন্যা, অনাবৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো কিছু কিছু সমস্যা পুনরাবর্তক, অপরদিকে নির্বনায়ন, পানির প্রাপ্যতা হ্রাস এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো সমস্যাবলী পুঞ্জিভবনশীল।

মৌসুমি বায়ু বা জুন এবং অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ের বর্ষা ঋতু সাধারণত প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমির উপরিভাগ প্লাবিত করার মতো বন্যার সৃষ্টি করে থাকে। বিগত ৪৫ বছরের উপর সম্পাদনকৃত পরিসংখ্যান এবং মোটামুটি হিসাবসমূহে দেখানো হয়েছে যে, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালে ধ্বংস সাধনকারী বন্যা সংঘটিত হয়েছিল যেগুলি ৩.৫ থেকে ১২.২ মিলিয়ন হেক্টর পরিমাণ ভূমি প্লাবিত করেছিল। সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা যায় যে বাংলাদেশের মোট জমির ৫০ শতাংশ (প্রায় ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টর) কোনো না কোনো ধরনের বন্যায় প্লাবিত হওয়ার মতো অরক্ষিত অবস্থায় বিদ্যমান। বাংলাদেশে মাঝারি পর্যায়ের বন্যাপ্রবণ ভূমির পরিমাণ প্রায় ৫.০৫ মিলিয়ন হেক্টর। ১৯৮৮ সালে নজিরবিহীন বন্যা দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকার ক্ষতি করেছিল। সচরাচর যে পরিমাণ গভীরতা সম্পন্ন বন্যায় ভূমি প্লাবিত হয়ে থাকে তা হলো ৩০ থেকে ২৫০ সেমি এর পরিসর ভূক্ত কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চল এবং হাওর এলাকাগুলিতে এর গভীরতা ৫০০ সেন্টিমিটারে পৌছতে পারে। নদীর ব্যাপক প্লাবন অবকাঠামোকে অতি বেশি বিপর্যস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং মাঠের ফসলসমূহের অত্যধিক অনিষ্টসাধন করতে পারে এবং এসবের ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে অতি মন্দাভাব দেখা দিতে পারে। আকস্মিক বন্যাও প্রায়শই কোনো কোনো বিশেষ স্থানে বিশেষ করে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পূর্ব অংশে ফসল, মাছের পুকুর, সম্পত্তি এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর খুব বেশি ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে বন্যার বিস্তৃতি, গভীরতা এবং স্থায়িত্বকালের ক্ষেত্রে এক বছর থেকে অন্য বছরে তারতম্য ঘটে থাকে। যেসব কারণে বন্যার সৃষ্টি হয় সেগুলির পুনরাবৃত্তি প্রতি বছরই একই সময়ে একই রকমে ঘটে না এবং সেসবের থাকে না সমান বিনাশসাধনকারী ক্ষমতা। বাংলাদেশে বন্যা হবার মতো অনেকগুলি বড় কারণ রয়েছে যথা, ভারী মৌসুমি বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়জনিত প্রচন্ড জলোচ্ছ্বাস, নদীরকূল অতিক্রম করে প্রবাহিত স্রোত, সমতল উপরিভাগ সম্পন্ন ভূমি, স্থলভাগের উপর সঞ্চিত পানি, মৌসুমি বায়ু প্রবাহমান থাকাকালে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রচন্ড গতি সম্পন্ন তরঙ্গাকারে সৃষ্ট জোয়ার, পলি জমে থাকা, নির্বনীকরণ এবং দেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের উজানে বাঁধ নিমার্ণ।

ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে অনাবৃষ্টির কারণে সংঘটিত দুর্ভিক্ষগুলির এক একটি ছিল মহাঘাতক কিন্তু বর্ধিত হারে সেচ সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে এবং খাদ্য সাহায্যের বন্দোবস্ত করার মাধ্যমে অনাবৃষ্টির ক্ষতিকর প্রভাবগুলির অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে। তথাপি অনাবৃষ্টি ক্ষুদ্র কৃষিজীবি এবং কৃষি শ্রমিকদের কাছে বিশেষ করে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশের মানুষের জীবিকানির্বাহের উপায়ের ক্ষেত্রে একটি হুমকি হয়ে রয়ে গেছে। বাংলাদেশে যেসব স্থানে প্রধানত বৃষ্টিপাত থেকে পাওয়া পানির সাহায্যে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে সেসব অঞ্চলে ফসল উৎপাদন সীমাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনাবৃষ্টি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রায় প্রতি বছরই খারিফ মৌসুমে ২.৩২ মিলিয়ন হেক্টর জমি এবং রবি মৌসুমে ১.২ মিলিয়ন হেক্টর এর কাছাকাছি জমি অনাবৃষ্টি বা খরা কবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খারিফ মৌসুমের খরা রোপা আমনের উৎপাদন বার্ষিক প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মে টন কমিয়ে দিয়ে এর মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। রবি মৌসুমের খরা প্রধানত গম, আলু, সরিষা এবং আউশ ধানের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমষ্টিক জলবায়ুর বিচারে খরার মতো ঘটনাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত হচ্ছে সুস্পষ্টভাবেই একক মুখ্য কারণ। দীর্ঘকালের বৃষ্টিপাতের উপাত্ত দৃষ্টে এটি প্রতীয়মান হয় যে প্রতি পাঁচ বছরে গড়ে প্রায় একবার খরা দেশটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। খরার স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে আউশ ধান, গভীর পানিতে উৎপন্ন করা হয় এমন ধান (মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত) এবং রোপা আমন (অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) ফসলসমূহের ক্ষতির পরিমাণ। আবাদিত ধান শস্যের ধরন অনুযায়ী প্রচন্ডতা, ব্যাপকতা, উৎপাদন হ্রাসের মাত্রা এবং সম্পূরক সেচের আবশ্যকতার ক্ষেত্রে তারতম্য হয়ে থাকে। অতি খরাপীড়িত অঞ্চলসমূহে উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস প্রায়শই ৪৫% ছাড়িয়ে যায়। মৃত্তিকার ধরন এবং বীজ বোনা বা চারা লাগানোর সময়ের উপর নির্ভর করে প্রচন্ড খরাপীড়িত অঞ্চলসমূহে ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে ২০ থেকে ৩৫% এবং এমনকি ঈষৎ খরা প্রবন এলাকাগুলিতে উৎপাদনের ক্ষতিসমূহ ২০% ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশের নাজুক এলাকা, যেগুলিকে সবচেয়ে বেশি খরাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, সেসব অঞ্চলে উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণ পরিলক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশি। রবি মৌসুম চলাকালীন সময়ে কৃষিকাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত আবহাওয়া যেহেতু সচরাচর প্রতিকূল হয়ে থাকে সে অবস্থায় ফসলের ধরন, চারা লাগানোর সময়কাল এবং খরার প্রচন্ডতার উপর নির্ভর করে ফসল উৎপাদন হ্রাসের তারতম্য ঘটে ১০ শতাংশের কম থেকে শুরু করে ৭০ শতাংশের অধিক পরিমাণ পর্যন্ত।

বিগত পঞ্চাশ বছরে সংঘটিত প্রধান প্রধান প্রবল ঘূর্ণিবাত্যার ঘটনা সাক্ষ্যবহন করে যে, উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে দুর্যোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত মৃত্যু এবং সেসঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে সংঘটিত অসামান্য ক্ষতি এবং অবকাঠামোর ধ্বংসের জন্য এগুলিই দায়ী ছিল। প্রবল ঘূর্ণিবাত্যা এবং জোয়ারজনিত জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা বাংলাদেশে নিয়মিত দৃশ্যমান একটি বিষয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত এযাবতকালের সবচাইতে ভয়াবহ বলে চিহ্নিত প্রবল ঘূর্ণিবাত্যা এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রায় ১.৮ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল ধ্বংস, বহু মানুষের প্রাণহানি এবং গবাদি পশু ও জলজ সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে। একইভাবে প্রতি বছরই প্রাক-মৌসুমি শিলাঝড় এবং অতিবৃষ্টির কারণে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। ১৭৯৫-১৯০০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রতি দশ বছরে প্রায় একবার বড় ধরনের প্রবল ঘূর্ণিবাত্যা, ঝড় এবং জোয়ারজনিত প্লাবন আঘাত হানে। কিন্তু এ সময়ের পরে ১৯০১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি দু বছরে প্রায় একবার সংঘটিত হয়েছিল। অন্যান্য দশকগুলির তুলনায় ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে অধিক সংখ্যায় এ ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ দ্বারা দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সংঘটিত বড় ধরনের প্রবল ঘুর্ণিবাত্যাজনিত ঝড় এবং জোয়ারজনিত জলোচ্ছ্বাসের উপর গত ৮৫ বছরের সঞ্চিত উপাত্তসমূহে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা মে মাসে ঘটেছে প্রায় ৩৩%, অক্টোবরে ৩১%, নভেম্বরে ১৪% এবং ডিসেম্বর মাসে ঘটেছে ৮%। এ পরিসংখ্যানে যেটি নির্দেশ করে তা হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিবাত্যার মতো ঘটনাসমূহের প্রায় ৮৭% বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যায় মে, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে। উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং দূরবর্তী দ্বীপসমূহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। প্রবল ঘূর্ণিবাত্যাগুলির ঘটন সংখ্যা বিন্যাস চিত্রে (frequency distribution) দেখানো হয়েছে যে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ১৯টি প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে মে মাসে সংঘটিত হয়েছে সর্বোচ্চ ৬টি এবং এর পরেই রয়েছে অক্টোবরে ৫টি, ডিসেম্বরে ৪টি এবং নভেম্বরে ৩টি।

ছোট বড় উভয় ধরনের অনেক নদীভাঙ্গনের ফলে কৃষি জমি বিলীন হয়ে যায় এবং ধ্বংস হয় ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য নির্মাণ কাঠামো। মোটামুটিভাবে হিসাব করা হয়েছে যে, ভাঙনের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়ে যায়।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এবং দূরবর্তী চরাঞ্চলের ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার মৃত্তিকার লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব অঞ্চলে কৃষি জমির ব্যবহার খুবই অপ্রতুল, যা কিনা দেশের গড় ফসল ব্যাপকতার (১৭০%) চেয়ে অনেক নিচে এবং এগুলি চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলের ৬২% থেকে শুরু করে পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের ১১৪% এর পরিসর ভূক্ত। ভূমিক্ষয় এবং ভূমির উর্বরতা হ্রাস সমস্যা বাংলাদেশে নিম্ন উৎপাদন শীলতার প্রধান দুটি কারণ। অধিকাংশ মৃত্তিকায় জৈব উপাদানের পরিমাণ সংকটাপন্ন পর্যায়ের নিচে বিদ্যমান। অধিকন্তু ৪০ লক্ষ হেক্টরের অধিক পরিমাণ ফসলি জমিতে রয়েছে গন্ধক-এর ঘাটতি এবং আরও ২০ লক্ষ হেক্টর জমিতে দস্তার ঘাটতি। বিভিন্ন ধরনের বালাই এবং নানা রকমের রোগের কারণে ফসলের ক্ষতিও উচ্চমাত্রার; ১০-১৫% উৎপাদন ক্ষতির জন্য এককভাবে বালাইজনিত ক্ষতিই দায়ী। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, প্রায় এক শত ধরনের কীটনাশক নির্বিচারে দেশব্যাপী ব্যবহার করা হচ্ছে যা কিনা পানি এবং মৃত্তিকা দূষণের বড় কারণ।

প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় (tornadoes) ব্যাপকভাবে ছড়ানো অঞ্চলসমূহে ফসলি জমির বিশেষ কোনো অংশের ধ্বংস সাধন করতে পারে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে ভূমিকম্প প্রবন একটি অঞ্চল এবং যেকোনো সময়েই একাধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি বিদ্যমান রয়েছে যেগুলি বাঁধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের অপরাপর ব্যবস্থাদিসহ অবকাঠামোর গুরুতর ক্ষতিসাধন করতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায়শই ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটে এবং সেগুলি কৃষিসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি করে।

জনসংখ্যার অতি বেশি ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং মানুষের অন্যান্য কর্মকান্ড পরিবেশগত মান অবনতির জন্য বহুলাংশে দায়ী। মানুষের এসব কার্যকলাপের ফলে অপরিকল্পিতভাবে জমি জবর দখল হয়ে যাচ্ছে আবাসনের জন্য এবং হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমি এবং সেসঙ্গে বৃদ্ধি করছে ভূমিহীনের সংখ্যা, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য।

দেশের জলবায়ুর ঐতিহাসিক উপাত্তের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৭০ সাল থেকে বাৎসরিক অথবা মৌসুমগতভাবে সূর্যালোক প্রাপ্তির ঘণ্টা হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু সামান্য উঠা-নামা ব্যতিরেকে বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার ক্ষেত্রে তেমন লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে নি। হ্রাসমান উজ্জ্বল আবহাওয়ার সময়কাল হয়তোবা বিগত দশকগুলিতে নিম্ন উৎপাদনশীলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতার জন্য দায়ী দুটো প্রধান কারণ হলো পরিবেশগত নাজুক অবস্থার ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার। এসব কারণ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে বাংলাদেশে কৃষিসম্পদ ইতোমধ্যেই গুরুতর পরিবেশগত চাপের মধ্যে রয়েছে এবং যেখানে যতটা সম্ভব এ অপ্রতুল এবং অত্যাবশ্যকীয় কৃষি সম্পদের ভিত্তির উৎপাদন ক্ষমতা জরুরিভিত্তিতে বাড়াতে হবে।  [মো. সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন খরা; বন্যা; জলোচ্ছ্বাস; কালবৈশাখী; ঘূর্ণিঝড়

ফসলের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Crop hazard management) বিভিন্ন কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর দুর্যোগের প্রভাব এড়ানো বা সর্বনিম্নমাত্রায় রাখার জন্য গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা। মূলত এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে শস্য, পশুসম্পদ, মৎস্য, বন, ও অন্যান্য সম্পদের ওপর দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করে শস্য উৎপাদনসহ ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। কৃষিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার শস্য উৎপাদন কৌশলের অংশ হিসেবে কাঠামোগত বা কাঠামোবিহীন পদক্ষেপ বা প্রয়োগ যোগ্যতা অনুযায়ী উভয়ের সমন্বয়, বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিস্তার, উদ্বুদ্ধকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে। মৌসুমের প্রথমদিকে প্রায়শই কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাবৃষ্টি স্থানীয়ভাবে ফসল ও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে থাকে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নদীভাঙন এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা কৃষি নিবিড়করণে আঘাত হানছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন উচ্চতাপমাত্রা (প্রায় ৪০° সে) ও শীতকালে নিম্নতাপমাত্রা (৬-১০° সে) বিরাজ করে এবং এসব এলাকা সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত অঞ্চলের (১২০০-১৪০০ মিমি) অন্তর্গত। এসব কারণে ওই এলাকার গাছপালা ও অন্যান্য কৃষি কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ ক্রমে হ্রাস পাওয়া অবস্থাকে আরও জটিল করছে।

এসব প্রাকৃতিক ঘটনা কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭৪% কার্যকর ভূমি কৃষি কার্যক্রমের অধীন, ফলে তা সম্প্রসারণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতি ঝুঁকিপ্রবণ। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে সাধারণ এবং সংখ্যা ও তীব্রতার দিক থেকে প্রায়ই ভয়াবহরূপ ধারণ করে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বভাবতই কৃষির উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ কৃষক সম্প্রদায় এতে অভ্যস্ত এবং তারা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পুর্বপুরুষদের কাছ থেকে শেখা কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। উন্নত কারিগরি তথ্য পাওয়া যায় না বলে অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কৃষিতে অবশ্য বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। অধিকন্তু, দুর্যোগের ব্যাপকতা ও সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পৃথিবীর পূর্বাভাসকৃত তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। আগামী বছরগুলিতে লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও এর অধিকতর প্রয়োগ অত্যাবশ্যক হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলায় বিস্তারিত নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে। আধুনিক গবেষণা তথ্য উদ্ভাবন এবং তা কৃষকদের অধিতর গ্রহণের মাধ্যমে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকভাবে হ্রাস করা যায়। যদিও কাঠামোগত (বাঁধ, বেড়িবাঁধ, প্রভৃতি) পদক্ষেপ দ্বারা বন্যা হ্রাসে সহায়তা ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদাহরণ বিরল, তথাপি বন্যা, লবণাক্ততা ও খরা পরিস্থিতির সমাধানে কাঠামোগত ও কাঠামোবিহীন পদক্ষেপের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন।  [এম আনোয়ার ইকবাল]

কৃষি যন্ত্রপাতি (Agricultural machinery)  জমি তৈরির যন্ত্রপাতি-  খামারে শস্য উৎপাদনের প্রাথমিক স্তরে জমি তৈরীতে ব্যবহূত সব ধরনের হস্তচালিত যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী। মাটির ধরন ও অবস্থা, শক্তির উৎস, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর যন্ত্রপাতির ব্যবহার নির্ভরশীল। কোনো একটি ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন ঘটে। শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জমি তৈরী প্রথম ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সাবেকি, উন্নত ও আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি এ কাজে ব্যবহূত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কৃষকদের প্রধান প্রধান ফসল চাষাবাদে জমি তৈরির জন্য ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি নিম্নরূপ:

কোদাল  চাষাবাদের অন্যতম প্রাচীন হাতিয়ার, বাংলাদেশে সর্বত্রই দেখা যায়। কোদাল বা কোদালি গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে। কোদালের দুটি অংশ মাটি কাটার জন্য ইস্পাতের একটি ফলা এবং ধরার জন্য একটি কাঠের বা বাঁশের হাতল। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কোদাল দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে কামার ও শহরাঞ্চলে ছোট কারখানাগুলি কোদাল তৈরি করে। কৃষকরা বীজতলা তৈরি, আগাছা দমন, মাটি কাটা ও সরানো, বাঁধনির্মাণ বা খালখনন ও অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে কোদাল ব্যবহার করে। ফলার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও পুরুত্ব যথাক্রমে ২৫-৩০, ২০-২৫ ও ১-৩ সেমি এবং ওজন হয় ২-৩.২৫ কেজি। দেশী লাঙলে চাষ অসাধ্য খন্ডজমিতে কোদাল ব্যবহূত হয়।

লাঙল  এটি বাংলাদেশে চাষকার্যে সর্বাধিক ব্যবহূত হাতিয়ার। শতাধিক ধরনের দেশী লাঙল রয়েছে। লাঙলের ৩টি অংশ; নিচের অংশ ও হাতল, প্রধান দন্ড ও ফাল। লাঙলের নিচের অংশ ও হাতল একখন্ড কাঠে তৈরি। অবশ্য, কোনো কোনো অঞ্চলে এগুলি আলাদাভাবে তৈরি করে একত্রে জোড়া দেওয়া হয়। মাটির অবস্থা ও বলদের আকারের ভিত্তিতে লাঙলের নিচের অংশ চওড়া বা সরু হতে পারে। লাঙল সাধারণত ১.৯-২.০ মিটার লম্বা, ৫.০-৭.৫ সেমি চওড়া এবং ৩.৭৫-৫.০ সেমি পুরু হয়ে থাকে। দেশী লাঙল মাটি কাটতে পারে, কিন্তু উলটাতে পারে না। একটি দেশী লাঙলে দৈনিক প্রায় ০.১৬-০.২ হেক্টর জমি চাষ করা যায়। দেশের অনেক অঞ্চলে উন্নত ধরনের দেশী লাঙল ব্যবহূত হচ্ছে।

কৃষি


একক পশু-টানা লাঙল  (মহিষের লাঙল)  কাঠামোর দিক থেকে দেশী লাঙলের মতোই, কিন্তু টানে একটি বলদ বা মহিষ। লাঙলকে জোয়ালের সঙ্গে বাঁধার কৌশলও ভিন্ন। প্রধানত সিলেট অঞ্চলে ব্যবহূত হয়। জোয়াল হলো ১.২-১.৬ মিটার লম্বা বাঁশ বা কাঠের একটি দন্ড যা উভয় ধরনের লাঙলেই ব্যবহূত হয়। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির জোয়াল রয়েছে।

মই  চষাজমি সমান এবং চাষের পর মাটির ডেলা ভাঙতে ব্যবহূত হয়। মইয়ের স্থানীয় নাম চংগা, চংহাম, হ্যাপ্টা, সেপ্টা, দোলন, দোলনা, হাট্টা, কেয়াই, বাঁশই ইত্যাদি। ছিটানোর পর শস্যবীজ ঢেকে দিতে প্রায়ই মই ব্যবহূত হয়। গ্রাম্য কাঠমিস্ত্রিরা বাঁশ দিয়ে সহজেই মই তৈরি করে। কিন্তু শক্ত কাঠ দিয়েও মই তৈরি হয়। একজোড়া বলদ বা মহিষ এটি টানে এবং রশি দিয়ে মই জোয়ালের সঙ্গে বাঁধা থাকে।

কৃষি

মুগুর  মই দিয়ে মাটির ডেলা ভালভাবে ভাঙা না গেলে সেগুলি মুগুর দিয়ে ভাঙা হয়। এটি উজা, কুরিশ, সান্নায়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত। সাধারণত বাঁশ বা কাঠের তৈরী।

পাওয়ার টিলার  ইঞ্জিনচালিত চাষযন্ত্র। বিশ শতকের ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো সীমিতসংখ্যক কলের লাঙল জাপান থেকে আমদানি করা হয়। অবশ্য বলদের তীব্র অভাবের দরুনই বাংলাদেশে আশির দশকের শেষদিকে কলের লাঙলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। দেশে বর্তমানে এ লাঙলের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। একক অক্ষদন্ড, দুটি চাকাসহ ৭-১২ অশ্বশক্তির একটি কলের লাঙল একদিনে প্রায় ১ হেক্টর জমি চাষ করতে পারে। বর্তমানে পাওয়ার টিলার প্রধানত চীন থেকে আমদানি করা হয়।

কৃষি

হাইড্রোটিলার  একটি ঘূর্ণায়মান কর্ষণ ইউনিট, একটি চওড়া ধাতুকাঠামো ও একটি ইঞ্জিনে তৈরি যন্ত্র। কলের লাঙল অচল এমন জলাভূমি চাষের উপযোগী। দৈনিক প্রায় ১ হেক্টর জমি চাষ করতে পারে।

ট্রাক্টর  চাষাবাদ, ভারবহন, ধানভানা প্রভৃতি কাজে ব্যবহূত একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। চলে ৪০-৬০ অশ্বশক্তির একটি ডিজেল ইঞ্জিনে, চলন্ত ও স্থির উভয় অবস্থায়ই কাজ করে। স্থির অবস্থায় এটি পাওয়ার টেক অব শ্যাফট (PTO) নামের একটি শ্যাফটের সাহায্যে মেশিনে শক্তি যোগায়। PTO-র মাধ্যমে কপিকল, হাইড্রোলিক সিস্টেম ও ড্রবার (drawbar) শক্তির সরবরাহ পায়। ট্রাক্টরগুলিকে গঠন ও এর দ্বারা সম্পাদিত কাজের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিকরণ করা হয় ২ চাকাওয়ালা, ৩ চাকাওয়ালা, ৪ চাকাওয়ালা ইত্যাদি।

বীজবপন, চারারোপণ ও আন্তঃচাষকার্যে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি বীজবপন, চারারোপণ ও আন্তঃচাষকার্য প্রধানত বাংলাদেশী কৃষকদের কায়িক শ্রমনির্ভর হলেও উৎপাদন ব্যয় হ্রাস ও উন্নত চাষাবাদের জন্য কতিপয় যন্ত্রও ইদানিং ব্যবহূত হচ্ছে।

সাবেকি বীজবপন ও চারারোপণ  প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে বীজবপন ও চারারোপণের কাজ প্রধানত চিরাচরিত কায়িক শ্রমনির্ভর পদ্ধতিতেই সম্পন্ন হয়ে আসছে। শুষ্ক জমিতে ধানবীজ বিক্ষিপ্তভাবে হাতে ছিটানো হয়। সিক্ত জমির পরিস্থিতিতে কাদাভরা ক্ষেতে চাষিরা ইচ্ছামতো ধানের চারারোপণ করে। অবশ্য সারিবদ্ধ রোপণে ক্ষেতমজুররা দূরত্ব মাপার কাইম (kyme) নামের দাগকাটা কাঠের লাঠি ব্যবহার করে। রোপা ধানচাষে কৃষকরা প্রথমে একটি ছোট ক্ষেতে বা বীজতলায় ধানের বীজ বোনে এবং ৩-৪ সপ্তাহ বয়সী চারা তৈরি করে। যথাসময় চারা তুলে কাদাভরা জমিতে লাগানো হয়। গম, ভুট্টা, ডাল ইত্যাদি অন্যান্য দানাশস্য শুষ্ক জমিতে আবাদ করা হয়। অবশ্য লোকেরা লতা-গুল্ম, ঝোপ ও বৃক্ষ সর্বদাই হাতে লাগায়।

কৃষি

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে জুমচাষ প্রচলিত। পাহাড়ি ঢালে হাতিয়ার দিয়ে জমি প্রস্ত্তত দুষ্কর, এমনকি কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাহাড়িরা পুরো এলাকা চাষের পরিবর্তে ছুরি, দা, ছোট কোদাল, কুড়াল, খন্তা, ইত্যাদি বিশেষ ধরনের হাতিয়ারের সাহায্যে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেসব গর্তে বিভিন্ন শস্যের বীজ বা চারা রোপণ করে গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে।

আধুনিক বীজবপন ও চারারোপণ যন্ত্রপাতি  ১. সিডড্রিল (seed drill)- একটি চাকা, একটি বীজপাত্র, দুটি টানা গর্ত খনক, একটি প্রেস হুইল ও একটি হাতল নিয়ে এ যন্ত্র গঠিত। গর্ত খনক হলরেখা খোঁড়ে এবং বীজপাত্র থেকে তাতে বীজ পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে গর্ত খনকের পিছনের প্রেস হুইল সেগুলি মাটি চাপা দেয়। এ সিডড্রিল হ্যান্ড হো বা রোটারি উইডারের সাহায্যে সমান দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে বীজবপন করে। এতে শ্রম এবং একই সঙ্গে বীজও বাঁচানো যায়। এ যন্ত্রের ক্ষমতা প্রায় ০.৪ হেক্টর/ব্যক্তি-দিন। ২. বিরি ড্রাম সিডার (BRRI drum seeder)- এ যন্ত্র ধাতুপাত ও হালকা ওজনের নলে তৈরি। এতে ১৮-২৫ সেমি দূরে দূরে ৮টি সারি রয়েছে। যন্ত্রটি কাদাভরা জমিতে ভালভাবেই অঙ্কুরিত ধানবীজ সারিতে বুনতে পারে। প্রচলিত রোপণ পদ্ধতি থেকে এটি একটি নতুন ধারণা। এ যন্ত্র দিয়ে পরিচ্ছন্ন সারিতে বীজবপন করা এবং পুশ-টাইপ যান্ত্রিক নিড়ানিযন্ত্রে সুবিধামতো আগাছা পরিষ্কার করা যায়। এটি সমান দূরত্বে বীজ ফেলে এবং তাতে বীজের পরিমাণও যথেষ্ট কমে: ৫০-১০০ কেজি/হে আর ক্ষমতা প্রায় ০.১ হেক্টর/ব্যক্তি-দিন। ৩. বিরি হস্তচালিত ধানের চারারোপণ যন্ত্র (BRRI manual rice transplanter)- চারা রাখার ট্রে, হাতলসহ চারা উত্তোলক ও চারাবাহক কাঠের স্কিড বা গতি নিয়ন্ত্রক অংশগুলি নিয়ে গঠিত। ট্রে বা পলিথিন আসনের উপর বিশেষ (দাপগ) পদ্ধতিতে জন্মানো ধানের চারাও এটি রোপণ করতে পারে। এ যন্ত্রে হাতে লাগানোর তুলনায় ৫-৬ গুণ অধিক দ্রুতগতিতে কাজ করা যায়। যন্ত্রটি আগাছা নিড়ানোর কাজেও ব্যবহার্য। এতে ২০ সেমি দূরে দূরে ৬টি সারি রয়েছে। ক্ষমতা প্রায় ০.১৪ হে/ব্যক্তি-দিন।

নিড়ানি  বাংলাদেশে সাধারণত ৪ ধরনের নিড়ানি ব্যবহূত হয় সনাতন নিড়ানি, আচড়া, হ্যান্ড হো ও রোটারি উইডার। প্রাচীনকাল থেকে আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিড়ানি ব্যবহূত হয়ে আসছে। এর স্থানীয় নাম একাধিক ছেনিকাঁচি, নিড়িকাঁচি, ছেনিপাচন, পাশরি, কুরমি, খুরপি, পাচন, ডাহুকি, পুশরি, পাঞ্জা, টেংগি, টেংগারি, দৌতি, টানাকোদাল ইত্যাদি। শুষ্ক জমিতে হাত দিয়ে নিড়ানি চালানো হয়। এতে আছে ইস্পাতের একটি ফলা ও একটি কাঠের হাতল। নিড়ানির আকার ও নকশা মাটির অবস্থা ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয় কামারদের কলাকৌশলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। অাঁচড়া আগাছা দমনে, চারা পাতলা করতে এবং ১-২ সপ্তাহ বয়সী চারার জন্য জমিতে মাটির স্তর ভাঙা বা আলগা করতে ব্যবহূত হয়। এটি বিধা, বিন্ধা, নাঙ্গলা, নাঙ্গুলা, হাটনাঙ্গল ইত্যাদি নামে পরিচিত। অাঁচড়ার মূল অংশ কাঠ বা বাঁশের তৈরি। কাঠের অংশের সঙ্গে লোহা বা বাঁশের গজালিগুলি সেঁধানো থাকে। দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.৫-২.০ মিটার। হস্তচালিত নিড়ানি বা হ্যান্ড হো সামনে প্রায় ২৫ সেমি চওড়া একটি চাকা, ২-৩টি নিড়ানি (হো) ও একটি কাঠের হাতলে গঠিত। চাকা ও নিড়ানিগুলি ইস্পাতের তৈরি। শুকনো জমির আগাছা নিড়ানোর উপযোগী। রোটারি উইডার জাপানি রাইস উইডার নামেও পরিচিত। এতে একটি ট্রে, কাঠের বা লোহার রোটরের সঙ্গে যুক্ত ১ বা ২ সারি স্পাইক (দাঁত) রয়েছে। একটি জাপানি উইডারের ওজন ৩-৫ কেজি। এধরনের নিড়ানি জলা পরিবেশে ব্যবহূত হয়। এটি সারিবদ্ধভাবে লাগানো ফসলের জমির উপযোগী।

ক্ষতিকর প্রাণী নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি  ১. পিচকারি সাধারণত হাতে ব্যবহূত বাঁশের তৈরী কীটনাশক ছিটানোর পুরানো হাতিয়ার। এটির পিস্টন হচ্ছে একটি বাঁশের কাঠি এবং কাঠির মাথায় পুরানো কাপড়ের পুটলি পিস্টনহেডের কাজ করে। এটি কৃষকদের সহজে ব্যবহার্য হাতিয়ার। ২. স্প্রেয়ার বাংলাদেশে ব্যবহূত কয়েক ধরনের স্প্রেয়ারের মধ্যে ন্যাপস্যাক সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটি একটি লিকুইড ট্যাঙ্ক, প্রেসার চেম্বার ও নজল দিয়ে গঠিত। ট্যাঙ্কের ধারণক্ষমতা ১০ লিটার। ৩. ইঁদুরের ফাঁদ বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে তৈরী কয়েক ধরনের ইঁদুরের ফাঁদ পাওয়া যায়। অঞ্চলভেদে এটি তৈরীর কলাকৌশল ভিন্ন।

সেচযন্ত্র  বাংলাদেশে সেকেলে ও আধুনিক উভয় ধরনের সেচযন্ত্র ব্যবহূত হয়। এগুলির সাহায্যে খোঁড়া গর্ত, কুয়ো, নদী, বিল, হাওর, খাল, পুকুর, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপ ইত্যাদি উৎস থেকে সেচের পানি সরবরাহ করা যায়। সেচযন্ত্র/পাম্প নিম্নোক্ত শ্রেণিতে বিভক্ত:

সাবেকি পানি উত্তোলন যন্ত্র  দুফ লিফট এতে রয়েছে দুটি খুঁটির ওপর লিভার হিসেবে স্থাপিত একটি লম্বা বাঁশের খুঁটি। এটি স্থানীয়ভাবে তারা, কের্কা ইত্যাদি নামে পরিচিত। একটি ভারী জিনিস, সাধারণত একটি বড় পাথর খুঁটির খাটো বাহুর প্রান্তে বাঁধা থাকে। লিভারের লম্বা বাহুর সঙ্গে রশি বা দন্ডের সাহায্যে ঝুলানো সেঁউতির বিপরীতে এ ওজন ভারসাম্য রক্ষার কাজ করে। কুয়োর পানিতে বাকেটটি ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত একজন লোক রশি বা দন্ডটিকে ছেড়ে দিয়ে রাখে। অতঃপর বিপরীত ওজন দিয়ে সেঁউতিটি টেনে তোলা হয়। দেশীয় পদ্ধতিতে কায়িক শ্রমে কোদাল, বেলচা ইত্যাদি হস্তচালিত যন্ত্রের সাহায্যে পানির কুয়ো খুঁড়ে এসব কুয়ো থেকে পানি তোলার জন্য কেন্দ্রাতিগ পাম্পও ব্যবহূত হয়।

কৃষি

সেঁউতি প্রাচীনতম পানি তোলার যন্ত্রগুলির একটি। এর কয়েকটি স্থানীয় নামও আছে হিওট, সেচনি, উঁচা, হোচো, উঁচি, সেঁওত, উরি, ডবকি, হিথ, হিচুঁনি, ইচুঁনি, লুই, ডুরি, ঝাঝরা, ডোবকা ইত্যাদি। একটি ঝুড়ি বা বোলচার গড়নের সেচনি, তাতে রশি বাঁধা। দুজন লোক একে অপরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় এবং সেচনি দুলিয়ে পানি ভর্তি করে ঝুড়িটি তোলে এবং এভাবে তোলা পানি জমিতে গিয়ে পড়ে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠের পানি অর্থাৎ ডোবা, খাল ইত্যাদি থেকে পানিসেচের জন্য ব্যবহূত হয়।

দোন হস্তচালিত নৌকাকৃতি খাদালো কাঠামো যার একপ্রান্ত বন্ধ এবং অন্য প্রান্ত খোলা। এর অন্যান্য স্থানীয় নাম দোঙ্গা, কুন্দা, কোন, জান্ট ইত্যাদি। যন্ত্রকৌশল ও ব্যবহার পদ্ধতি দুফের মতো। নালা, পুকুর, বিল ইত্যাদি জলাশয় থেকে দোন-এর সাহায্যে ক্ষেতে পানি সেচ করা হয়।

উন্নত সেচপাম্প ডায়াফ্রাম পাম্প- ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি প্রকৌশল বিভাগে উদ্ভাবিত। স্থানীয়ভাবে বাকি পাম্প নামে পরিচিত। এ পাম্পে প্রধানত ইস্পাতের তৈরী ৩৫ সেমি আকারের দুটি চোষণকক্ষ আছে। পাশগুলি ঝালাইবদ্ধ করে দুটি বাক্স তৈরি হয় এবং ভেতরে পানি চলাচলের জন্য এগুলি Y আকৃতির একাধিক মুখের নলা দ্বারা যুক্ত থাকে। ডায়াফ্রাম তৈরি হয় ট্রাক বা ট্রাক্টরের পরিত্যক্ত অভ্যন্তরীণ নল দিয়ে। রাবার শিট দিয়ে বানানো হয় পাম্পের ফ্ল্যাপ বাল্ব। লিভার উপরের দিকে ওঠার সময় ডায়াফ্রামকে টেনে প্রসারিত করে এবং এভাবে জলাশয় বা নদীনালা থেকে পানি তুলে আনে। হাতল নামানো হলে ডায়াফ্রাম চেম্বারের আয়তন কমায় এবং চেম্বার থেকে পানি বের করে দেয়। এটি ৩ মিটার গভীরতা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩-৪ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে।

ব্যতিহারী (reciprocating) পাম্প ও তারা পাম্প অনেক বছর আগের প্রাথমিক নকশার এ পাম্প পরবর্তী সময়ে উন্নততর হয়েছে এবং ইউনিসেফ (UNICEF) এর আরও উন্নতি ঘটিয়েছে। এটি সরাসরি ৩.৮ সেমি চওড়া নলকূপে স্থাপন করা হয়। প্লানজার ছাঁচে ঢালাই PVC কাপ ওয়াশার ব্যবহার করে। চেক-বাল্ব সাধারণত চামড়ার একটি ফ্ল্যাপ। গোড়ায় ভূগর্ভ থেকে পানীয় জল উত্তোলনের জন্য পরিকল্পিত হলেও এখন সেচকার্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। এ পাম্প ৬-৭ মিটার গভীরতা থেকে প্রতি সেকেন্ডে এক লিটার পানি তুলতে পারে। ব্যতিহারী পাম্পের উন্নত মডেল ‘তারা’ পাম্প নামে পরিচিত।

ট্রেডল পাম্প/ঢেঁকিপাম্প স্থানীয় নাম ঢেঁকিপাম্প। এটি অগভীর নলকূপ চোষণ পাম্প। ‘পাম্প হেড’ হচেছ ইস্পাতের পাতের তৈরী একটি যুগল সিলিন্ডার, প্লানজারগুলি হলো ছাঁচে ঢালা PVC কাপ সিল আর চেক-বাল্ব রাবারের তৈরী সাধারণ ফ্ল্যাপ বাল্ব। পাম্পের উপরিকাঠামো বাঁশের তৈরী এবং সাধারণত বাঁশ, GI বা PVC নলকূপের সঙ্গে স্থাপিত। পানি তুলতে ১-২ জন লোকের প্রয়োজন। পানি তোলা যায় ৭-৮ মিটার গভীরতা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১-১.৫ লিটার। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য সাধারণত ব্যবহূত।

রোয়ার পাম্প (Rower pump) মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (Mennonite Central Committee/MCC) এবং মিরপুর কৃষি কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় (Mirpur Agricultural Workshop and Training School/MAWTS) ১৯৭৯ সালে পাম্পটি প্রবর্তন করে। রোয়ার পাম্প প্রধানত একটি  হস্তচালিত ব্যতিহারী (reciprocating) পাম্প। এটি ৬.৫-৭.০ মিটার গভীরতা থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। সাধারণত ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠ উভয় উৎস থেকে পানি উত্তোলনে ব্যবহূত।

পাওয়ার পাম্প শক্তিচালিত অধিকাংশ পাম্পই কেন্দ্রাতিগ ধরনের এবং তাতে প্রধানত দুটি অংশ: কাস্টিং নামের স্থির অংশ এবং ঘূর্ণায়মান অংশ বা ইমপেলার। চালু অবস্থায় ঘূর্ণায়মান ইমপেলার তার কেন্দ্র দিয়ে কাস্টিংয়ে পানি চোষে এবং ঘূর্ণনের কেন্দ্রাতিগ বলের দরুন ঘূর্ণায়মান ইমপেলারের কিনার দিয়ে পানির যোগান দেয়। চালানোর আগে পাম্পের কাস্টিং পানি দিয়ে ভর্তি করা হয়। প্রক্রিয়াটিকে প্রাইমিং বলে। কেন্দ্রাতিগ পাম্প অধিকাংশ ক্ষেত্রে লো-লিফট পাম্পে ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের শক্তিচালিত পাম্পের মধ্যে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির উৎস (পুকুর, নদী, বিল প্রভৃতি) থেকে পানি তোলার জন্য ব্যবহূত পাম্পকে লো-লিফট পাম্প বলে। শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রায় ৫০,০০০ লো-লিফট পাম্প ব্যবহূত হয়।

কৃষি

অন্য ধরনের শক্তিচালিত পাম্প হলো অগভীর নলকূপ। এটি ইস্পাত বা PVC-র তৈরি পাইপ যা উপযুক্ত পদ্ধতিতে পানির উৎসমুখে (Well point) মাটির ভেতরে ঢুকানো হয়। পানির স্তর ৭ মিটার বা ততোধিক নিচে থাকলে নির্দিষ্ট মানের খনকযন্ত্র ব্যবহূত হয়। পাইপের ব্যাস ৪-১০ সেমি হতে পারে। এসব কূপ থেকে পানি তোলার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেন্দ্রাতিগ পিস্টন ও প্রপেলার পাম্প লাগানো হয়।

অগভীর নলকূপের মতো একইভাবে গভীর নলকূপ স্থাপিত হলেও অনেক গভীর থেকে এ দিয়ে পানি তোলা যায়। নির্দিষ্ট স্থানের জলভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ওপর গভীর নলকূপের গভীরতা নির্ভরশীল। এগুলির গভীরতা হয় সাধারণত ৪৫-১০০ মিটার।

ফসলকাটা, মাড়াই, শুকানো ও পরিষ্করণ যন্ত্রপাতি  বাংলাদেশে ফসলকাটা, মাড়াই, শুকানো ও ঝাড়ার কৌশল এখনও সনাতন ধরনের। অবশ্য আধুনিক ফসল মাড়াইযন্ত্র কতিপয় শস্যের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের আবাদি ৮০ শতাংশের বেশি জমিতে ধানচাষ হওয়ায় ধান-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিই অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।

প্রচলিত পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহ কাস্তে ধান ও গম কাটার একমাত্র হাতিয়ার; এটি বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে ব্যবহূত হচ্ছে। স্থানীয় নাম কাচি, কাঞ্চি, ছড়ি, ছকড়ি, কেইচা ইত্যাদি। এর দুটি অংশ; নমনীয় ইস্পাতের দাঁতকাটা ফলা এবং কাঠের হাতল। কাস্তের দাঁতকাটা অংশ দিয়ে কাটার কাজ সম্পন্ন হয়। স্থানীয় কামাররা কাস্তে তৈরি করে এবং একটি কাস্তে দিয়ে ২-৩ বছর কাজ চালানো যায়। দাও ইস্পাতের তৈরী আরেকটি হাতিয়ার এবং পাট, বাঁশ, ইক্ষু ইত্যাদি ফসল কাটা এবং ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কারের কাজে ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রতি ঘরেই সাধারণত একটা দাও থাকে। স্থানীয় অন্যান্য নাম হাসুয়া, দা, শোলে, বেগি, ছেনি-দাও, জ্যাট ইত্যাদি।

কৃষি

আধুনিক পদ্ধতিতে ফসল কাটা  শস্যকাটা (reaper) বা ঘাসকাটা (mower) কল একটি শক্তিচালিত যন্ত্র। সাধারণত বাংলাদেশের বড় বড় সরকারি খামার ঘাস কাটতে ঘাসকাটা যন্ত্র ব্যবহার করে। অবশ্য, মাঠে কেবল সারিবদ্ধ ফসল কাটতে ও শুইয়ে রাখতে ঘাসকাটা যন্ত্র ব্যবহূত হয়। কাটা শস্য পরে লোকেরা মাড়াই চত্বরে বয়ে নিয়ে যায়। শস্যকাটা যন্ত্রে থাকে একটি ইঞ্জিন, একটি কাঠামো, একটি কাটার-বার অ্যাসেম্বলি ও একটি উইনড্রোয়ার অ্যাসেম্বলি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি ধান ও গম কাটার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে এবং সেটি জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। শস্যকাটা যন্ত্রটি পাওয়ার টিলারের সামনে জুড়ে দেওয়া হয়। পাওয়ার টিলার সামনে চলার সময় কাটার-বার অ্যাসেম্বলিতে শক্তি সঞ্চালিত হয় এবং তা ফসল কাটে। উইনড্রোয়ার অ্যাসেম্বলি শক্তভাবে ফসল ধরে রাখে এবং একটি ফ্লাট বেল্টের সাহায্যে কাটা ফসলকে কাটার যন্ত্রের পাশে নিয়ে যায়। একজন লোক যন্ত্রটি চালায় এবং দৈনিক ১ হেক্টর জমির ধান কাটতে পারে।

প্রচলিত মাড়াই  মোলন এটি কোনো যন্ত্র নয়, এমন একটি পদ্ধতি যা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ছড়া থেকে শস্যদানা পৃথক করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। এক্ষেত্রে, ২-৪টি গরু/বলদ একত্রে বেঁধে কাটা ফসলের উপর চক্রাকারে ঘোরানো হয়।

বাংলাদেশে প্রথাগত মাড়াইয়ের আরেকটি পদ্ধতি হাতে পিটানো। কৃষকরা ধাতুর তৈরী ড্রাম, কাঠের তক্তা বা বাঁশের মাচার উপর ফসলের গোছা পিটিয়ে থাকে। পিটানোর ফলে শস্যদানা আলাদা হয়ে যায়। সাধারণত শ্রমিকরা দল বেঁধে ড্রামের উপর পিটিয়ে ফসল মাড়াই করে।

কৃষি
কৃষি

বিভিন্ন পদ্ধতিতে ধান মাড়াই:গবাদি পশুর সাহায্যে#বাঁশের নির্মিত খোলা গরুর গাড়ির উপর

আধুনিক ফসল মাড়াই  পেডল থ্রেশার/পা-চালিত মাড়াইযন্ত্র প্রযুক্তিটি জাপানে উদ্ভাবিত হলেও বর্তমানে অনেক ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। পেডল থ্রেশারের একটি ত্রিকোণ ধাতুকাঠামোর মধ্যে থাকে ১টি থ্রেশিং ড্রাম, ১টি ক্র্যাঙ্ক ও ২টি গিয়ার। থ্রেশিং ড্রাম প্রধানত কাঠের তৈরী, তাতে নমনীয় ইস্পাতের সারিবদ্ধ তারের কাঁটা বসানো। এসব কাঁটা বা দাঁতের সাহায্যেই মাড়াইয়ের কাজটি চলে। বুশ ও বিয়ারিংয়ের সাহায্যে একটি শ্যাফটের সঙ্গে থ্রেসিং ড্রামটি যুক্ত। চালক থ্রেশারের পেছনে দাঁড়ায় এবং থ্রেশিং ড্রামের উপর ধানের গোছা এমনভাবে ধরে যেন ছড়াগুলি থ্রেশিং ড্রামের উপর থাকে। চালক পেডেলের সাহায্যে দক্ষিণাবর্তে থ্রেশিং ড্রামটিকে ঘুরায় এবং ঘোরার সময় দাঁতগুলি ছড়া থেকে ধান আলাদা করে।

পেডেল থ্রেশারের সাহায্যে
শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে

বিরি খোলা ড্রাম শক্তিচালিত মাড়াইযন্ত্র (BRRI open drum power thresher) ছোট ডিজেল ইঞ্জিনচালিত পেডেল থ্রেশারের একটি উন্নত রূপ। নারী কর্মীদের জন্য বিশেষ উপযোগী। ড্রামটি প্রায় ১.৫ মিটার লম্বা। তিন-চার জন লোক একত্রে কাজ করতে পারে এবং ঘণ্টায় ধানমাড়াই করা যায় প্রায় ৪০০-৫০০ কেজি।

শক্তিচালিত মাড়াইযন্ত্র এটি ফসল মাড়াই ও ঝাড়া বা চালা উভয় কাজই সম্পন্ন করে। এতে রয়েছে একটি ধাতুকাঠামো, একটি থ্রেশিং ড্রাম, একটি ব্লোয়ার অ্যাসেম্বলি ও একটি   ক্লিনিং অ্যাসেম্বলি।

প্রচলিত শুষ্ককরণ  বাংলাদেশে সাধারণত বাড়ির উঠোন, খোলামাঠ বা কখনও রাস্তার উপর রোদে শস্য ছড়িয়ে শুকানো হয়। এ পদ্ধতিতে কৃষকেরা শানবাঁধানো বা মাটির মেঝের উপর পাতলা স্তরে শস্যদানা ছড়িয়ে রাখে। শস্য ছড়ানো ও স্তূপ তৈরিতে প্রচলিত কিছু হস্তচালিত হাতিয়ার ব্যবহূত হয়। কখনও কখনও কৃষকেরা মাটির উপর চট বা চাটাই বিছিয়ে তাতে শস্যদানা ছড়িয়ে রাখে।

কৃষি


যান্ত্রিক শুষ্ককরণ  BRRI ব্যাচ ড্রাইয়ার- ইটের সঙ্গে চট ও বাঁশ দিয়ে বৈদ্যুতিক গিয়ার লাগিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরী ও সংযোজিত। তাপনের জন্য ধানের তুষ পোড়ানোর ঘট-চুল্লি (pot furnace) ব্যবহূত হয়। এ যন্ত্রের ক্ষমতা ৮ ঘণ্টায় প্রায় ১০০০ কেজি। চুল্লির উপরে টাইল সমন্বিত করে বায়ুপ্রবাহ ও তাপমাত্রা (প্রায় ৪৫° সে) নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহূত হয়। অপেক্ষাকৃত নিম্ন আর্দ্রতার গরম বাতাস ছড়ানো শস্যদানার মধ্যে চলার ফলে আর্দ্রতা উবে যায়। বীজ শুকানোর জন্য পদ্ধতিটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট SRR-১ ড্রাইয়ার বাঁশের তৈরী দুটি ফাঁপা সিলিন্ডার, একটি ১০০০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক হিটার, একটি ব্লোয়ার ও ০.৫ অশ্বশক্তির মোটর নিয়ে তৈরি। এটি নির্মাণ, সংস্থাপন ও পরিবহণ অত্যন্ত সহজ। ভেতরের সিলিন্ডারটি প্রায় ০.৪ মি চওড়া ও ১.৫ উঁচু। বাইরের সিলিন্ডারে থাকে ভেজা ধান। এটি ৬০ ঘণ্টায় ১০০০ কেজি ভেজা ধান শুকায়।

বাণিজ্যিক ড্রাইয়ার হলো একটি পূর্ণাঙ্গ যান্ত্রিক শুষ্ককরণ ব্যবস্থা। এতে চাটাই বা পাত্রে রাখা ভেজা শস্যের মধ্য দিয়ে গরম বাতাস ছাড়া হয়। ভেজা শস্যস্তরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় বাতাস দানা থেকে আর্দ্রতা শুষে নেয় এবং তা বায়ুমন্ডলে ছাড়ে। খামারবাড়িতে শস্য শুকাতে যান্ত্রিক ড্রাইয়ায়ের ব্যবহার নাই বললেই চলে। অবশ্য, কিছু আধুনিক বাণিজ্যিক ধানকল এ ধরনের ড্রাইয়ার ব্যবহার করছে যা আমদানিকৃত আধুনিক মিলের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি।

প্রচলিত ঝাড়া বা চালা  বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে সর্বাধিক ব্যবহূত ঝাড়ার সাধারণ হাতিয়ার হলো কুলা। এটি বাঁশের পাতলা চটা দিয়ে তৈরি। কুলার সাহায্যে শস্য ঝাড়ার কয়েকটি কৌশল রয়েছে। চালুনি হলো কুলার মতোই বাঁশের পাতলা চটা বুনে তৈরি, কিন্তু আকৃতি গোল, প্রায় ৬০ সেমি চওড়া ও সচ্ছিদ্র। গ্রামীণ কারিগররাই চালুনি বানায় এবং গোটা বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। হস্তচালিত ঝাড়াইযন্ত্র (winnower) কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়। এ যন্ত্র দিয়ে একজন কৃষক ঘণ্টায় ৩০০-৪০০ কেজি ধান পরিষ্কার করতে পারে। খারাপ আবহাওয়াতেও এটি ব্যবহার্য। এ ঝাড়াইযন্ত্রে আছে একটি চোঙ, একটি ব্লোয়ার, একটি ফ্রেম ও একটি নির্গমপথ। কাঠের তৈরী ফ্রেমের উপর চোঙ বসানো থাকে।

কৃষি

ইস্পাতের পাতের তৈরী ব্লোয়ার একটি শ্যাফটের সাহায্যে ফ্রেমের সঙ্গে এবং শ্যাফট ক্রাঙ্কের সাহায্যে অপারেটিং হ্যান্ডেলের (হাতল) সঙ্গে যুক্ত থাকে। হপারে ধান থাকে। হাতলের সাহায্যে ব্লোয়ার চালিয়ে বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি করে তা দিয়ে বিভিন্ন অবাঞ্ছিত পদার্থ, ধূলিবালি, অপুষ্ট দানা, তুষ, আগাছা, আগাছার বীজ ইত্যাদি দূর করা হয় এবং পরিষ্কার দানা হপারের নিচে পড়ে একটা পাত্রে জমা হয়। শক্তিচালিত ঝাড়াইযন্ত্রে রয়েছে শক্তি উৎস, দোলায়মান পর্দা ও ব্লোয়ার। শক্তির উৎস হতে পারে ইঞ্জিন বা মোটর। এটি প্রধানত খামারে, কলকারখানায় বা বীজশিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহূত হয়।

সংগৃহীত ফসল প্রসেসিং যন্ত্র ও গুদাম সংস্থান  সংগৃহীত ফসল প্রসেসিংয়ে ব্যবহূত হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি যা কৃষিদ্রব্যকে ভোগ্যপণ্যের রূপ দেয়। বাংলাদেশের কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদন করে এবং সেগুলির প্রসেসিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন এলাকায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।

অর্ধসিদ্ধকরণ  ধানের অর্ধসিদ্ধকরণের দুটি পর্যায় রয়েছে পানিতে ভিজানো ও বাষ্পগাহ। গ্রামাঞ্চলে মহিলারাই এ কাজটি করে। মাটি বা অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল বা ড্রামে ধান ভিজানোর পর ভেজা ধান মাটির পাতিল বা ড্রামে আংশিক পানিভর্তি করে চুলায় বসিয়ে জ্বাল দিয়ে ফুটন্ত পানিতে ৩০-৪৫ মিনিট রেখে ধান অর্ধসিদ্ধ করা হয়।

বাণিজ্যিক ধানকলের ক্ষেত্রে অর্ধসিদ্ধকরণে পানিতে ভিজানো ও বাষ্পগাহ দুটিই থাকে। নিম্নোক্ত কাঠামো/যন্ত্রপাতি ব্যবহূত হয় পানিতে ভিজানোর ট্যাঙ্ক হলো ইটের তৈরি ও ৫-১০ টন ধারণ ক্ষমতার। ভিজানো প্রক্রিয়ায় ট্যাঙ্কে ধান প্রায় ২৪-৪৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। বাষ্পগাহে ভেজা ধানকে বাষ্পকক্ষে ১৫-২০ মিনিট সিদ্ধ করা হয়।

ধানভানা  ধানের তুষ ছাড়ানো এবং চাল পরিষ্করণ ও স্বচ্ছকরণ পদ্ধতি। তুষ ছাড়ানো হচ্ছে শস্যের ত্বক অটুট রেখে তুষ খালাস করা। পরিষ্করণ ও স্বচ্ছকরণ অবশ্য ধানের শস্যের খোসা তুলে চালের উজ্জ্বলতা বাড়ানো। ধানভানার পর প্রায় ৬৭% চাল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সাবেকি ও আধুনিক ধানছাঁটাই যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।

সাবেকি ধানভানা ধান কাঁড়ার যন্ত্রগুলির মধ্যে বাংলাদেশে কাঠের তৈরি ঢেঁকি সর্বাধিক প্রচলিত এবং সাধারণত মহিলাদের দ্বারাই ব্যবহূত হয়। ঢেঁকি দিয়ে ধান কেঁড়ে প্রতিদিন মাত্র ৩০-৪০ কেজি চাল পাওয়া যায়। কাজটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ ও কম উৎপাদনক্ষম, কিন্তু ঢেঁকিছাঁটা চাল অতি উত্তম ও পুষ্টিকর। আরেকটি যন্ত্র উদূখল বা হামানদিস্তা স্থানীয়নাম উখল গেইল, সিয়া-গাইল, চুং, উড়ুনগাইন, সুম-গাইন, ইত্যাদি। এটির দুটি অংশ প্রায় ১.৫ মিটার লম্বা ও ৫ সেমি চওড়া একটি নিরেট বেলনাকার কাঠের দন্ড, একপ্রান্তে সেঁধানো লোহার একটি বেড় এবং একটি কাঠের হামানদিস্তা (উদূখল)। এটি চিড়া ও চালের গুঁড়ি তৈরীর জন্যও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক ব্যবহূত হয়।

দোলইন হলো আরেকটি হস্তচালিত কেন্দ্রাতিগ ধানভানা যন্ত্র, দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। বাঁশ দিয়ে বোনা উপরের অংশ একটি চোঙ যা গোড়ায় কোণিক আকৃতির এক চাকতির সঙ্গে যুক্ত। নিচের অংশের গড়ন অনেকটা একই ধরনের এবং উপরের অংশের মতোই মাথা চাকতির সঙ্গে যুক্ত। এসব চাকতিতে ছোট ছোট কাঠের দন্ড কেন্দ্র থেকে বিকীর্ণ হয়ে এমনভাবে সাজানো থাকে যেন ঘর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। শস্য চোঙে রাখা হয় এবং চাকতির ঘর্ষণের ফলে ছাঁটার কাজ সম্পন্ন হয়। দোলইন সাধারণত চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ব্যবহূত।

ধানভানা আধুনিক পদ্ধতি ছোট এঙ্গেলবার্গ ধানকল (Small Engleberg huller) প্রায় ৮৫% ধানভানা যন্ত্রই এ ধরনের এবং বাংলাদেশের মোট ধানের ৭০-৭৫% এখন এ যন্ত্রে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এঙ্গেলবার্গ ধানকলে রয়েছে কক্ষে বসানো একটি বেলনাকার রোটর। কক্ষের নিচের অংশ একটি সচ্ছিদ্র পাতের উপর বসানো, যাকে বলে চালুনি। রোটর চলে মোটর বা উপযুক্ত সরঞ্জামসহ ইঞ্জিনে। প্রবেশমুখ দিয়ে ধান ঢালা হয় এবং ধানগুলি রোটরের গায়ে কাটা খাঁজে লেগে এর শিরাল অংশের দিকে এগোয়। ধান কাঁড়া নিষ্পন্ন হয় নিচের দিকে, ঘর্ষক রোটা ও ধানের ঘর্ষণের ফলে। এঙ্গেলবার্গ ধানকল তুষ ছাড়ানো ও চাল পরিষ্করণ একই ধাপে সম্পন্ন করে এবং তাতে কুড়া ও তুষ মিশে থাকে, তাই এভাবে পাওয়া কুড়া থেকে তৈল নিষ্কাশন করা যায় না। এ ধরনের কাঁড়াপদ্ধতি অর্ধসিদ্ধ ধানের জন্য ভাল। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ এঙ্গেলবার্গ ধানকল আছে। বড় এঙ্গেলবার্গ ধানকল ধান প্রক্রিয়াকরণে উন্নততর পদ্ধতি ব্যবহার করে। এসব ধানকলে প্যাডি ক্লিনার বা রাইস গ্রেডার কোনোটিই নেই।

ক্ষুদে স্বয়ংক্রিয় ধানকল এতে আধুনিক ধানকলের সবগুলি প্রধান বৈশিষ্ট্যই আছে। এটি তুষ ছাড়ানোর জন্য একজোড়া রাবার রোলার, তুষ পৃথক করার একটি হাস্ক এসপাইরেটর, তুষ ছাড়ানোর সময় ধান পৃথক করার একটি প্যাডি-সেপারেটর এবং বাদামি চালকে সাদা করার একটি পলিশার নিয়ে গঠিত। এ ধরনের ধানকল সম্প্রতি চীন থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ জাতীয় প্রায় ৫০০ ধানকল চলছে।

বৃহৎ স্বয়ংক্রিয় ধানকল এতে ধান প্রসেসিংয়ের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহূত হয়। ধান পরিষ্কার করে উচ্চতাপে পানিতে ভিজিয়ে পরে চাপ দিয়ে বাষ্পের সাহায্যে ধান অর্ধসিদ্ধ করা হয়। ড্রাইয়ার ধান শুকায় এবং রাবার রোল শেলার বা ডিস্ক হুলার তুষ ছাড়ায়। প্যাডি-সেপারেটরে আকাঁড়া ধান বাদামী চাল থেকে পৃথক করে আবার কলে পাঠানো হয়। বাদামি চাল সাদা করে শঙ্কু-ধরনের পলিশার কিংবা এঙ্গেলবার্গ বা অ্যারেটেড রোলার পলিশার। ছাঁটা চাল তিন ধরনের হয় আস্ত চাল, ভাঙা চাল ও খুদ।

তৈলবীজ প্রসেসিং  বাংলাদেশে উৎপন্ন মোট ৪ লক্ষ ৭০ হাজার টন তৈলবীজ বিচ্ছিন্নভাবে বলদটানা ঘানি ও যান্ত্রিক ঘানিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ হয়। বলদটানা ঘানি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। এটি কাঠের তৈরী এবং চক্রাকার পথে ঘোরা বলদ বা গরু দিয়ে চালানো হয়। এর স্থানীয় নাম কলুর ঘানি, তেলের গাছ ইত্যাদি। একটি বলদ-টানা ঘানি ৪-৫ ঘণ্টায় প্রায় ৫ কেজি সরিষা ভাঙতে পারে। শক্তিচালিত ঘানি দেখতে বলদ-টানা ঘানির মতোই, কিন্তু যন্ত্রাংশ ইস্পাতের তৈরী এবং চলে ইঞ্জিন বা মোটরে। যান্ত্রিক ঘানি সাধারণত শহর, বাজার ও নগরাঞ্চলে চালু রয়েছে। এটি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বলদ-টানা ঘানি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। এ ঘানি লোহার স্ক্রু-প্রেস দিয়ে তৈরী, চলে বেল্টের দ্বারা যুক্ত মোটর বা ইঞ্জিনের শক্তিতে।

সনাতন পদ্ধতিতে তৈলবীজ প্রসেসিং

ডালশস্য প্রসেসিং  স্থানীয় নাম জাঁতা, পাথরের দুটি চাকতি দিয়ে গঠিত। নিচের চাকতি স্থির এবং উপরের চাকতিটি কাঠের হাতলের সাহায্যে হাত দিয়ে নিচের চাকতির উপর ঘুরানো হয়। উপরের চাকতিতে একটি ছিদ্র থাকে এবং তাতে গোটা ডাল ঢালা হয়। খোসা ছাড়ানো ডাল চাকতির পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে।

আখমাড়াই যন্ত্র  চিনিকল নেই বাংলাদেশের এমন প্রত্যন্ত গ্রামে কৃষকরা আখের রস নিষ্কাশনের জন্য আখমাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করে। এতে একটি কাঠের ফ্রেম এবং লোহার তৈরী বেলনাকার নিরেট তিনটি রোলার থাকে। রোলারগুলির একটি চালক এবং অন্য দুটি চালিত। একজোড়া মহিষ বা দুইজোড়া বলদ কিংবা উপযুক্ত শক্তিচালিত ডিজেল ইঞ্জিন দ্বারা চালক রোলারটি চালিত হয়।

গুদাম সংস্থান  ভবিষ্যত ব্যবহারের জন্যই শস্য গুদামজাত করা হয়। গ্রামের বসতবাড়িতে শস্য প্রধানত ডোল, মটকা, বেড়, কুঠি, গোলা, চটের থলে ইত্যাদি প্রচলিত পাত্র বা আধারের মধ্যে রাখা হয়। অবশ্য, সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি মজুতের জন্য গুদাম ও সাইলো ব্যবহার করে। প্রচলিত ধরনে গুদামজাতের জন্য বসতবাড়িতে বাঁশের তৈরী পাত্র বা ডোল ব্যবহূত হয়। এটি বাঁশের পাতলা চটি দিয়ে তৈরী, পিপাকৃতি, প্রায় ০.৫-১.০ মিটার চওড়া। একটি ডোলে ২৪০-২৫০ কেজি পর্যন্ত ধান রাখা যায়। ডোল সচরাচর বাঁশের মাচার উপর থাকে। ডোলের অনেক আঞ্চলিক নাম আছে ডুলি, লাই, কাল্লোম, বেরাং, বের, আন্তরি, উগার ইত্যাদি।

গোলা হলো বড় আকারের পাত্র যা বাঁশের মাচার উপর বানানো হয়। সাধারণত ধনী কৃষকরা ধান রাখার জন্য গোলা বানায়। স্থানীয় নাম ভাঁড়ার, জাবর মোরা, মটকা, আউরি ইত্যাদি।

বড় মৃৎপাত্র বা মটকা দেখতে মাটির বড় কলসির মতো। এ ধরনের পাত্রে ৪০-৫০ কেজি ধান বা চাউল রাখা যায়। দামে সস্তা ও গ্রামাঞ্চলে সহজপ্রাপ্য বলে অধিকাংশ কৃষক মটকা ব্যবহার করে। স্থানীয় নাম মইট, জাভা, জালা, কোলা, জোয়ার, হাড়ি, চাড়ি, মইটা ইত্যাদি। চটের ব্যাগ বা ছালা বাংলাদেশের সর্বত্র শস্য পরিবহণ, বিপণন ও গুদামজাতকরণে ব্যাপক ব্যবহূত। এমনকি সরকারি গুদামেও চটের ছালাভর্তি শস্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য জমা রাখা হয়। চটের ব্যাগের স্থানীয় নাম বস্তা। জ্বালানি বা তেলের খালি পাত্র বা ড্রামে গ্রামাঞ্চলের লোকে শস্যবীজ রাখে। মৃৎপাত্র বা কুঠি সাধারণত মটকার চেয়ে বড়, আয়তাকার বা বেলনাকৃতি, প্রায় ১০০-৫০০ কেজি ধান ধরে।

কৃষি

গুদাম  পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও আর্দ্রতা-দূরীকরণের ব্যবস্থাসহ ইটের তৈরী ঘর। শস্য ধারণক্ষমতা ৫০০-১০০০ মে টন। বাংলাদেশে ৬ লক্ষ মে টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের প্রায় ৭৫০টি গুদাম রয়েছে।

সাইলো  আধুনিক সংরক্ষণ সংস্থান এবং সাধারণত সরকারি ফসল সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানে ব্যবহূত। বিপুল পরিমাণ আমদানিকৃত শস্য সংরক্ষণে সাইলো অপরিহার্য। এগুলি শস্য ভর্তি ও খালাসের অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত।

চালের উপজাত প্রসেসিং যন্ত্রপাতি/প্রযুক্তি  এতে রয়েছে শস্য থেকে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যবস্ত্ত তৈরীতে ব্যবহার্য সব ধরনের হস্তচালিত যন্ত্র, হাতিয়ার, পাত্র ও দেশজ পদ্ধতি।

চিড়া তৈরীর প্রযুক্তি/যন্ত্রপাতি  চিড়া তৈরী বাংলাদেশের এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। ফসল তোলার পর নতুন ধান (আকাঁড়া) একটি তাওয়ায় ৫-১০ মিনিট গরম করে গরম ধানের উপর উচ্চচাপ প্রয়োগ করা হয়। পিটানো বা আঘাতের সাহায্যে এ ধরনের উচ্চচাপ প্রয়োগে সাধারণত দেশজ ঢেঁকি ও গাইল-ছিয়া (উদূখল-মুষল) ব্যবহূত হয়ে থাকে। এতে গরম ধানের দানা শেষ পর্যন্ত পাতলা চ্যাপ্টা টুকরায় পরিণত হয়।

আধুনিক চিড়াকলে আছে দুটি ঘূর্ণায়মান অংশ একটি পাত্র ও একটি রোলার। উভয়ই ঢালাই লোহার তৈরী এবং পাত্রটি প্রায় এক মিটার চওড়া। রোলারটি (ব্যাস ১৫ সেমি) এমনভাবে পাত্রে যুক্ত থাকে যাতে পাত্রটি ঘুরলে রোলারটিও পাত্রের সঙ্গে একই দিকে ঘোরে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনাসহ পাত্রটিতে ১-অশ্বশক্তি মোটরের সাহায্যে শক্তি যোগানো হয়। লোহার তাওয়ায় গরম ধান পাত্রে ঢাললে পাত্রের সঙ্গে ধানও ঘুরতে থাকে এবং পাত্রের দেয়ালে রোলারের দেওয়া চাপের ফলে শেষ পর্যন্ত ধান চ্যাপ্টা হয়ে যায়। পাত্রে একসঙ্গে ৩ কেজি পর্যন্ত গরম ধান রাখা যায়।

মুড়ি  খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত ধানের আরেকটি মূল্যবান উপজাত। ধানকে ১৫-২০ মিনিট গরম করার পর ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। অতঃপর ভেজা ধান অর্ধসিদ্ধ করে শুকিয়ে প্রচলিত ধানকলে ভানা হয়। মুড়ি প্রস্ত্ততকারীরা প্রতি ১০০ কেজি চালে প্রায় আধা কেজি সাধারণ লবণ মিশিয়ে থাকে। এভাবে তৈরী চাল লোহার তাওয়ায় পুনরায় ১০-১৫ মিনিট গরম করতে হয়। এসময় এক গোছা বাঁশের শলা দিয়ে অনবরত চাল নাড়া প্রয়োজন। একটি পৃথক মাটির পাত্রে বালিও তাতানো হয় এবং বালি ও চাল প্রত্যাশিত তাপমাত্রায় পৌঁছামাত্র গরম চাল দ্রুত পাত্রের গরম বালিতে রাখা হয়। মহিলারা উত্তপ্ত বালির পাত্রটি চুলা থেকে তুলে নিয়ে হাত দিয়ে ধরে ঘুরাতে শুরু করে। ঘুরানোর ফলে গরম চাল ফুটে ফেঁপে ওঠে। এটিই মুড়ি।

পিঠা তৈরীর জন্য চালের গুঁড়ি  চালকে ২-৩ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ভিজা চাল একটি সচ্ছিদ্র পাত্রে রাখা হয় যাতে চাল থেকে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়। এ চাল তারপর ঢেঁকি বা গাইল-ছিয়া দিয়ে গুঁড়া করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরীর জন্য এ গুঁড়ির সঙ্গে বিভিন্ন অনুপাতে পানি মিশানো হয়। চালের গুঁড়ি থেকে তৈরী বাংলাদেশে পিঠার ধরন প্রায় শতাধিক।

গ্রামীণ পরিবহণ যন্ত্রপাতি  গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পণ্য বা জিনিসপত্র বহন বা পরিবহণে ব্যবহূত পদ্ধতি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সেভাবে আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি বলে গ্রামীণ জনগণ এখনও পুরনো পদ্ধতি ও কলকব্জাই ব্যবহার করে থাকে। ক্ষেতমজুরেরা কাটা ফসল মাথায় করে মাড়াই উঠানে আনে। অদূরে ফসল বহনের এটিই সাধারণ পদ্ধতি। একজন লোক শরীর খাটিয়ে প্রায় ৫০-৬০ কেজি ওজন বহন করতে পারে। ফসল পরিবহণে ব্যবহূত অন্যান্য কল বা বাহনগুলি নিম্নরূপ:

ভার বা বাঁক  উন্নত যোগাযোগ নেই এমন গ্রামাঞ্চলে কাঁধে পণ্য বহনের জন্য তৈরী ১.৫-২.০ মিটার লম্বা ও ৩-৬ সেমি চওড়া একটি বাঁশের ফালি। এটির সাহায্যে একজন লোক ৫০-৭০ কেজি বোঝা ৩-৫ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত বহন করতে পারে।

গরুর গাড়ি  মাঠ থেকে শস্য আনা, সার ও বীজ বহন এবং বাজারে কৃষিদ্রব্য পরিবহণে ব্যবহূত। এতে রয়েছে ২টি কাঠের চাকা, ১টি বাঁশের মাচা ও ১টি জোয়াল। ব্যবহূত ভারবাহী পশুর জন্য এটি গরুর গাড়ি বা মহিষের গাড়ি হিসেবে পরিচিত। মাচাটি ৫-৬ মিটার লম্বা ও ১০০-১৩০ সেমি চওড়া। এ গাড়ি ৫০০-১৫০০ কেজি পণ্য ১৫-২০ কিমি দূরত্বে বহন করতে পারে।

খাদ্যশস্য পরিবহণের ব্যবহার্য গরু/মহিষের বাহন

ঠেলাগাড়ি  দেখতে গরুর গাড়ির মতো, কিন্তু চালায় মজুররা ঠেলে ও টেনে। এতে ৩-৪ জন লোক লাগে এবং ৫-১০ কিমি দূরত্বে ৫০০-১৫০০ কেজি মাল নিতে পারে।

ঘোড়ার গাড়ি  কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে এখনও ঘোড়ার গাড়ির চল আছে। এটি কাঠের ১টি মাচা এবং ১টি অক্ষদন্ডে সংযুক্ত ২টি কাঠের চাকায় গঠিত। ঘোড়ার গাড়ি প্রায় ৪.৫ মিটার লম্বা। এ গাড়িটি চালাতে একটি ঘোড়া লাগে এবং প্রায় ৫-৬ কিমি দূরত্বে ৪০০-৫০০ কেজি বোঝা বহন করতে পারে।

ভ্যানগাড়ি বা রিক্সাভ্যান  সড়ক যোগাযোগের উন্নতির ফলে পশুটানা গাড়ি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে এবং স্থানীয়ভাবে ভ্যানগাড়ি নামে পরিচিত বাহন সে স্থান দখল করছে। অনেক গ্রামাঞ্চলে ভ্যানগাড়ি বর্তমানে পরিবহণের প্রধান মাধ্যম, কেননা এটির গতিবেগ অধিক এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ। একজন লোক ভ্যানগাড়িতে এক দিনে ৩০ কিমি দূরত্বে ৫০০-১৫০০ কেজি মাল টানতে পারে।  [মোহাম্মদ আবদুল বাকী]

খামার উপকরণ ও সরঞ্জাম (Farm inputs and implements)  সেচের পানি এবং বীজ, সার, শ্রম ও কীটনাশকের মতো উপকরণসমূহ হলো ফসল উৎপাদনের প্রাকৃতিক নির্ধারক। এসব উপকরণের সুষম প্রয়োগই কেবল খামার পর্যায়ে একটি ফসলের অধিক ফলন নিশ্চিত করতে পারে। বীজ একটি মৌলিক উপকরণ বিধায় উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের শস্যের উন্নত মানের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যাদি পরিচালিত হয়। আজ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চফলনশীল জাতের ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আখ, নানা ধরনের ডাল ও তৈলবীজ, কন্দ ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন এবং খামার পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে। কৃষকরা সাধারণত তাদের নিজেদের উৎপাদিত বীজই সংরক্ষণ করে। ইতঃপূর্বে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনই কেবল যাচাইকৃত বীজ সরবরাহ করত, কিন্তু প্রায় কখনই মোট চাহিদার পাঁচ শতাংশের বেশি সরবরাহ করতে পারত না। বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানার অনেক প্রতিষ্ঠান বীজ ব্যবসায়ে নিয়োজিত।

বর্তমানে বিভিন্ন কাজে সর্বাধিক ব্যবহূত খামার সরঞ্জামগুলির বিবরণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

খামার কর্মকান্ড  #খামার সরঞ্জাম

জমি প্রস্ত্ততকরণ    #কাঠের লাঙল, ছাঁচে ঢালা লাঙল, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর।

exRecb   # হাতে ছড়ানো এবং শক্তিচালিত বীজবপন যন্ত্র।

আগাছা পরিষ্কার    #ভেজা জমির নিড়ানি, শুষ্ক জমির নিড়ানি, হস্তচালিত লম্বা বাটযুক্ত কোদাল। সেচ    দোন, হাত-পাম্প, পায়ে চাপা পাম্প ও শক্তিচালিত পাম্প, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপ।

কীটনাশক ছিটানো #পিঠে বহনযোগ্য স্প্রেয়ার, শক্তিচালিত স্প্রেয়ার, ফলবাগানের জন্য পদচালিত পাম্প।

dmj KvUv    #প্রচলিত হাতের কাস্তে, শক্তিচালিত ফসল কাটার যন্ত্র।

মাড়াই ও নিঙড়ানো    #ধান ও গমের জন্য পায়ে চাপা মাড়াইকল, ধান ও গমের জন্য শক্তিচালিত মাড়াইকল, হস্তচালিত ও শক্তিচালিত ভূট্টার খোসা ছাড়ানোর যন্ত্র; পশু-টানা ও শক্তিচালিত আখমাড়াই কল।

÷KvGbv     #রোদে শুকানোর ব্যবস্থা, ব্যাচ ড্রাইয়ার, ধানকলের জন্য স্বয়ংক্রিয় ড্রাইয়ার।

fvbv     #হিডেলবার্গ স্টেলহলার মিলস, বৃহদাকার স্বয়ংক্রিয় ধানকল, সাবেকি ঢেঁকি।

নানা জাতের উচ্চফলনশীল শস্যের পাশাপাশি উপকরণ হিসেবে সেচের পানির ব্যবহার ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সেচের আওতাধীন এলাকার পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মোট আবাদি জমির ৩০ শতাংশেরও বেশি এ পর্যন্ত সেচের আওতায় আনা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও মাটির আর্দ্রতা প্রাপ্তির নিরিখে সম্পূর্ণ ও সম্পূরক এ উভয় ধরনের সেচব্যবস্থাই প্রয়োগ করা হচ্ছে। ভূপৃষ্ঠস্থহ ও ভূগর্ভস্থ পানি উভয়ই সেচের পানির উৎস। সেচ পদ্ধতিগুলির মধ্যে আছে সাবেকি পদ্ধতি, শক্তিচালিত পাম্প, গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, হাতে চাপা নলকূপ ইত্যাদি।

ফসল উৎপাদনের জন্য সার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এবং সেচ সম্প্রসারণ ও নানা জাতের উচ্চফলনশীল শস্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ষাটের দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে সারের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬২-৬৩ সালে ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট, টিএসপি ও এমপি থেকে ব্যবহূত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম প্রভৃতি পুষ্টিদ্রব্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ২০,০০০ মে টন। ১৯৮০ সাল থেকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, গন্ধক ও দস্তার মতো পুষ্টিদ্রব্যগুলিরও ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে এসব পুষ্টিদ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ লক্ষ মে টন এবং সার হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট, টিএসপি, এসএসপি, এমপি, জিপসাম ও জিঙ্ক-সালফেট। বর্তমানে ফসলি জমিতে হেক্টর প্রতি বার্ষিক সারজাতীয় পুষ্টিদ্রব্যের ব্যবহার প্রায় ১০০ কেজি। এ ছাড়া প্রতি বছরই কিছু পরিমাণ জৈব এবং জীবজ সারও ব্যবহূত হচ্ছে।

কখনও কখনও কীটপতঙ্গ ও ইঁদুর ফসলের যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতি করে। এগুলির উপদ্রব এবং আর্থিক ক্ষতি থেকে ফসল রক্ষার জন্য বাংলাদেশে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রায়শই কীটনাশক ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে বছরে গড়পড়তা ব্যবহূত কীটনাশকের পরিমাণ প্রায় ৩৫ লক্ষ কেজি এবং গত দুই দশক ধরে এ পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।

কৃষির আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের খামার সরঞ্জাম নানা কাজে লাগানো শুরু হয়েছে। সাবেকি ও উন্নত মানসম্পন্ন উভয় ধরনের খামার সরঞ্জামেরই ব্যবহার চলছে। [নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া]

কৃষিতে ব্যবহূত প্রযুক্তি (Technology used in agriculture)  কৃষিকাজে বিভিন্ন কৌশল, হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি প্রয়োগ চিরাচরিত ব্যাপার। কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রযুক্তিগুলিরও পরিবর্তন ঘটে এবং বিবিধ সামাজিক ও যন্ত্রকৌশলগত উপাদানের বিবেচনার মাধ্যমেই কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গুরুত্ব মূল্যায়ন করা যায়। বাংলাদেশের কৃষি উন্নত দেশের কৃষি থেকে একেবারেই ভিন্ন। কৃষিকাজ এখানে অনেকটা সাবেকি গ্রামীণ ধরনের এবং জলবায়ু, মাটি, পানি, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ইত্যাদি স্থানীয় অবস্থা এবং একই সঙ্গে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। অধিকাংশ কৃষিজমিই খন্ডবিখন্ড এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী। এ উপমহাদেশের কৃষকদের দ্বারা শতকের পর শতক ধরে প্রচলিত প্রযুক্তি কোনো না কোনো ভাবে এখনও গ্রামীণ কৃষিতে ব্যবহূত হচ্ছে।

পশুশক্তি ও যন্ত্রশক্তি  জমিচাষ, বীজবপন, সেচ, ফসল তোলা, মাড়াই, পরিষ্করণ, বিভিন্ন আবাদ-সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য কৃষিতে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় মানুষ, পশু ও যন্ত্রপাতি।

পশুশক্তি  আদিকালে মানবশক্তি দ্বারাই কৃষিকাজ সম্পন্ন হতো। পরবর্তীকালে মানবশক্তির সহায়ক হিসেবে গরু, মহিষ, ঘোড়া, উট, গাধা ও হাতির মতো জন্তুদের পোষ মানানোর অথবা গৃহপালিত করার প্রথা চালু হয়। বাংলাদেশে কৃষিকাজে প্রধানত গরু ও মহিষ ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশের গরু অন্যান্য দেশের গরুর তুলনায় আকারে ছোট এবং গড়ে নিজ শরীরের ওজনের এক-দশমাংশের সমপরিমাণ বলপ্রয়োগ করে যদিও এরা স্বল্পসময়ের জন্য গড় বলের কয়েকগুণ বেশি বলপ্রয়োগও করতে পারে।

ফসল উৎপাদনের জন্য প্রাপ্ত শক্তির পরিমাপের নিরিখে প্রতিটি ষাঁড় ও পুরুষ মহিষ ০.৩৭৩ কিলোওয়াট (kW) এবং প্রতিটি গাভী ও স্ত্রী মহিষ ০.২৫ কিলোওয়াট শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজে ব্যবহূত গরু ও মহিষের সংখ্যা মোটামুটি ষাঁড় ৫৩,৭২,০০০, গাভী ১৬,৭৮,০০০, পুরুষ মহিষ ৪,৩০,৮৫৪, এবং স্ত্রী মহিষ ৭৬,৪৮৩। সবগুলি পশু থেকে প্রাপ্ত শক্তির মোট পরিমাণ ২৬০৩ মেগাওয়াট (mW)। কৃষি উৎপাদনে ব্যবহূত সর্বমোট প্রত্যক্ষ শক্তির মধ্যে পশুশক্তির পরিমাণ প্রায় ২৪%। ভারবাহী শক্তির উৎস হিসেবে পশুর ব্যবহার প্রধানত এদের নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণ ও পোষ মানানোর ওপর নির্ভরশীল।

যন্ত্রশক্তি  কৃষিকাজে পশুর ব্যবহারের প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বোঝা ও খাটুনি যথেষ্ট কমে যায়। তা সত্ত্বেও পশুদের দিয়ে কাজ করাতে এবং অনেক কৃষিকাজে খোদ মানুষকেও নিজ শক্তি ব্যয় করতে হয়। কৃষিতে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার মানুষের খাটুনি কমায় এবং এর ফলে অনেক কৃষিশ্রমিক কম পেশীশক্তিনির্ভর অন্যান্য আকর্ষণীয় কাজে যোগদানের সুযোগ পায়। বস্ত্ততপক্ষে, যন্ত্রশক্তির ব্যবহার কৃষিকাজে বিপ্লব ঘটায় এবং শ্রমিক পিছু উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কৃষিতে যন্ত্রশক্তির প্রয়োগ ছাড়া বর্তমান বিশ্বের বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের যোগান সম্ভব নয়। বিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সাধারণত ৮ kW ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার টিলারের (দুচাকা ট্রাক্টর) ব্যবহার বাংলাদেশে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বহুফসলি চাষ পদ্ধতির জন্য সময়মতো জমি তৈরী এখন সম্ভব হয়েছে।

জমি তৈরী সর্বাধিক শ্রমঘন কাজগুলির একটি এবং এতে গড়ে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্ত মোট শক্তির প্রায় ৪০% ব্যবহূত হয়। বর্তমানে জমি তৈরীর জন্য পশু থেকে পাওয়া প্রায় ২৬০৩ mW শক্তি ছাড়াও আনুমানিক ১,৫০,০০০ পাওয়ার টিলার ও ৫২০০ ট্রাক্টর ১৩৬৫ mW শক্তি সরবরাহ করছে। পরবর্তী শক্তিঘন কাজ হচ্ছে পানিসেচ। প্রায় ৫৪,০০০ লো-লিফট পাম্প, ২৪,০০০ গভীর নলকূপ ও ৪,৮৩,০০০ অগভীর নলকূপ প্রায় ৪২৯৩ mW শক্তি উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশে বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য ও যন্ত্রের জন্য বর্ধিত কৃষি উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে বা বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে শিল্পখাত ভবিষ্যতে আরও অধিক হারে কৃষিশ্রমিক আকৃষ্ট করবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সত্ত্বেও বর্তমানে ফসল রোপণ, উত্তোলন ও মাড়াইয়ের কাজে কৃষিশ্রমিকের অভাব রয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো যন্ত্রশক্তির তুলনায় মানবশক্তি ও পশুশক্তি অধিক ব্যয়বহুল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশী লাঙল, পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর দিয়ে জমি তৈরীতে হেক্টর প্রতি খরচ যথাক্রমে ১৩০০ টাকা, ১০৮০ টাকা ও ৮১০ টাকা। মানুষ, পা-চালিত মাড়াই যন্ত্র ও শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্রে ধান মাড়াইয়ের খরচ যথাক্রমে ০.২৫ টাকা/কেজি, ০.১৮ টাকা/কেজি ও ০.১৮ টাকা/কেজি। পা-চালিত ও শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্রের খরচ এক হলেও শক্তিচালিত মাড়াইযন্ত্র যথাসময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। অধিক ফসল মাড়াইয়ে শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্র অপরিহার্য। যন্ত্রশক্তির সাহায্য ছাড়া ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়, কেননা অন্যভাবে সীমিত পরিমাণ জমি থেকে অধিক পরিমাণ ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজনীয় সময়ানুবর্তিতা রক্ষা করা যায় না। অধিকন্তু, উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য যন্ত্রশক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক। যন্ত্রশক্তি ব্যতীত গভীর ভূমিকর্ষণ ও জমি প্রস্ত্তত, স্বল্প সময়ে ফসল তোলা ও মাড়াইয়ের মতো কাজগুলিও সম্পন্ন করা যায় না। তাই বর্তমানে মানবশক্তি ও পশুশক্তি দ্বারা নিষ্পন্ন এ ধরনের কিছু কাজ ভবিষ্যতে যন্ত্রশক্তির দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে।

প্রধানত পাওয়ার টিলার ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে কৃষিকাজে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেলেও এবং প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ পাওয়ার টিলার চাষাবাদে যুক্ত হলেও পশুশক্তিই এখন পর্যন্ত ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যক্ষ শক্তির ২৪% যোগান দিচ্ছে। সার ও কীটনাশক প্রয়োগ এবং খামার যন্ত্রপাতি ও সেচ যন্ত্রপাতি তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিকে পরোক্ষ শক্তি বিবেচনা করা যায়, যা পর্যাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও শক্তির পরিমাণ নির্ণয়ের হিসাবভুক্ত হয় নি।

বাংলাদেশে যন্ত্রশক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, সেচপাম্প এবং শস্য উৎপাদনে ব্যবহূত অন্যান্য তেলচালিত ইঞ্জিন। ফসল মাড়াই, খোসা-ভাঙা, ধান ও গম ভানা, তৈল নিষ্কাশন, আখ মাড়াই, চিনি উৎপাদন প্রভৃতি ফসল প্রক্রিয়াজাত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণও অত্যধিক। উদাহরণস্বরূপ, সারা বাংলাদেশে ধান ভানার জন্য প্রায় ১২০০ mW শক্তি ব্যবহূত হয়। সাধারণ নিয়মে শস্য উৎপাদনে এ শক্তি বিবেচনা করা হয় না বলে তা যন্ত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় নি। শস্য উৎপাদনের জন্য অধিকাংশ যন্ত্রশক্তি জমি তৈরি ও পানি তোলার কাজেই ব্যবহূত হয়।

সেচকাজে যন্ত্রশক্তি ব্যবহারকারী আধুনিক সেচপদ্ধতির অবদান ১৯৭১-৭২ সালের মোট ৪৪% থেকে ১৯৯৭-৯৮ সালে ৮৯%-এ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে সকল কৃষিকাজে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিও প্রয়োজন। বিভিন্ন কৃষিকাজে যন্ত্রশক্তি ব্যবহূত না হলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য ভবিষ্যতে খাদ্যচাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। লাগসই খামার যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে গবেষণা কাজ এগিয়ে চলেছে এবং আশা করা যায়, কৃষকদের জন্য উপযোগী খামার যন্ত্রপাতি অচিরেই উদ্ভাবিত হবে।

কৃষিতে শক্তি ব্যবহারের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে প্রত্যক্ষ শক্তির ব্যবহার মাত্র ০.৭৪ কিলোওয়াট/হেক্টর যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি না পেলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করা যাবে না আর এজন্য অপরিহার্য বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজে অধিক পরিমাণ যন্ত্রপাতির প্রবর্তন এবং যন্ত্রশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।

সেচ সনাতন ও আধুনিক (Irrigation: traditional and modern) উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা যোগানোর লক্ষ্যে মাটিতে কৃত্রিমভাবে পানি প্রদান। এটি উদ্ভিদ পরিবেশকে শীতলও রাখে। ভূপৃষ্ঠ, ভূতলের স্বল্প ও গভীর উৎসগুলি থেকে পানি সরবরাহ করা যায়। বংশপরম্পরায় সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠস্থ জলাধার থেকে পানি উত্তোলনের ব্যবহূত পদ্ধতিকে সনাতন সেচপদ্ধতি বলা হয়। দোন ও সেঁউতি হচ্ছে বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহূত সনাতন সেচকৌশল। সাম্প্রতিক প্রযুক্তির সেচ হলো আধুনিক সেচপদ্ধতি। শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত ধান উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বিশ শতকের ষাটের দশকে পদ্ধতিটি বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়। লো-লিফট পাম্প, গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও নালা হলো আধুনিক সেচপদ্ধতির উদাহরণ। নালার সেচপদ্ধতি ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশে এটি অপেক্ষাকৃত নতুন পদ্ধতি এবং এতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহূত বিধায় এটিও এখন সেচের আধুনিক পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।

সারণি ৬  সনাতন ও আধুনিক পদ্ধতিতে সেচকৃত এলাকা পরিবর্তনের ধারা।

বছর ##সেচ এলাকা##

# সনাতন (হাজার একর)  #  (%) # আধুনিক  (হাজার একর)#(%)

১৯৭১-৭২#৫৮৯.৬২#৫৬.৩১#৪৫৭.৪৫#৪৩.৬৯

১৯৭৬-৭৭#৫১৪.৬৭#৪২.৩৫#৭০০.৫৯#৫৭.৬৫

১৯৮১-৮২#৫৮৭.২৮#৩০.৪৫#১১৩৮.৪৮#৬৯.৫৪

১৬৮৬-৮৭#৪০২.২২#১৮.২৯#১৭৯৬.৭৭#৮১.৭১

১৯৯১-৯২#৩৯২.১০#১২.১৪#২৮৩৭.২০#৮৭.৮৬

১৯৯৬-৬৭#৩৬২.৯৫#৯.৮৩#৩৩২৯.৬১#৯০.১৭

সেচ বস্ত্তত ফসল উৎপাদনের একটি প্রাচীন পদ্ধতি। অনাদিকাল থেকেই নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুর সেচের জন্য ব্যবহূত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে অনেক নদ-নদী ও খাল থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ফসলের আধুনিক জাতগুলি চাষের জন্য সেচ অত্যাবশ্যক হয়ে উঠলে পানির স্তর সাধারণত তখন অপেক্ষাকৃত নিচে থাকে। সনাতন পদ্ধতির মাধ্যমে সেখান থেকে পানি এতটা উঁচুতে তোলা সম্ভব হতো না, তাই আধুনিক সেচপদ্ধতি প্রবর্তনের আগে সেচনির্ভর জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হতো না।

সনাতন সেচপদ্ধতিতে দুটি দেশীয় সেচকৌশল দোন ও সেঁউতি ব্যবহূত হয়। দোন হলো একটি ছোট নৌকাকৃতি যন্ত্র, সাধারণত ৩ থেকে ৪.৫ মিটার লম্বা যা একটি আলম্বের উপর কাজ করে। এটি একটি সমতল টিনের পাত বা কাঠে তৈরী। একজন লোক এটি দিয়ে সেচ দিতে পারে। দোনের পানি উত্তোলন ক্ষমতা প্রতি মিনিটে ১১৭ থেকে ৩৭৮ লিটার। পানিস্তর ২.২৫ মিটারের মধ্যে থাকলে এটি কায়িক শ্রমনির্ভর সর্বোত্তম সেচপদ্ধতি। সেঁউতি সমতল টিনের পাত বা ফালি-করা বাঁশ ও কাঠের তৈরী একটি ত্রিকোণ ঝুড়ি। ঝুড়ির সঙ্গে বাঁধা দুটি রশির দুপাশে দাঁড়িয়ে দু’জন লোক ঝুড়িটি দোলাতে থাকে। উৎস ৯০ সেমি নিচে থাকলে পানির পরিমাণ মিনিটে ২২৭ লিটার পর্যন্ত হতে পারে। দোনের মতো এটিও সর্বাধিক ২.২৫ মিটার নিচের উৎস থেকে পানি তুলতে পারে। সেঁউতিও ব্যাপক ব্যবহূত একটি সনাতন পানি উত্তোলনযন্ত্র।

বাংলাদেশে বিভিন্ন আধুনিক সেচপদ্ধতিতে লো-লিফট পাম্প, গভীর নলকূপ ও অগভীর নলকূপ বহুল ব্যবহূত কৃষি উপকরণ। ভূপৃষ্ঠের অপেক্ষাকৃত কম গভীরতা থেকে পানি তুলতে লো-লিফট পাম্প ব্যবহূত হয়। এটি একটি ওয়েল-ইঞ্জিন বা বৈদ্যুতিক মটরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং প্রতি সেকেন্ডে ২৮ থেকে ১১২ লিটার (১-৪ কিউসেক) পানি উত্তোলনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কেন্দ্রাতিগ পাম্প। পানি উত্তোলনে ব্যবহূত এ কেন্দ্রাতিগ পাম্প উৎস থেকে সর্বাধিক ৭ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে পানি তুলতে পারে। লো-লিফট পাম্প সেচের পানির উৎসের কাছে শক্ত মাটিতে বসানো হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভূপৃষ্ঠস্থ পানি রয়েছে এমন এলাকাসমূহে এ পাম্পের ব্যবহার সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫৪০০০ লো-লিফট পাম্প রয়েছে।

গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে একটি টারবাইন পানির নিচে স্থাপন করা হয়। মাটির উপর পাম্পের শ্যাফ্টের সঙ্গে যুক্ত ওয়েল-ইঞ্জিন বা বৈদ্যুতিক মটর টারবাইন-পাম্পটি চালায়। বাংলাদেশে সেচের জন্য ব্যবহূত অধিকাংশ গভীর নলকূপ প্রতি সেকেন্ডে ৫৬ লিটার ক্ষমতার এবং এগুলির অধিকাংশই উল্লম্ব টারবাইন ধরনের। ভূনিম্নস্থ পানিস্তরের নিরিখে গভীর নলকূপের গভীরতা ৩০ মিটার থেকে ১০০ মিটারেরও বেশি হতে পারে।

অগভীর নলকূপ ওয়েল-ইঞ্জিন বা বৈদ্যুতিক মটরের সাথে যুক্ত থাকে এবং নলকূপ থেকে পানি তোলার জন্য ভূপৃষ্ঠের উপর স্থাপিত হয়। অগভীর নলকূপ বিশ শতকের সত্তরের দশকে চালু হয় এবং প্রাথমিক খরচা কম এবং স্থাপন ও পরিচালনা সহজ বিধায় অচিরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

গত তিন দশকে হস্তচালিত পাম্প, রোয়ার পাম্প, ট্রিডল পাম্প, BARI পাম্প প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কায়িক শ্রমচালিত পাম্প সেচকাজে ব্যবহূত হয়েছে। কিন্তু লো-লিফট পাম্প, গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং সনাতন পদ্ধতির তুলনায় এগুলির সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

নালা-সেচ সমতল ভূমির কারণে বাংলাদেশ নালা-সেচের জন্য ততটা উপযোগী নয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (Bangladesh Water Development Board/BWDB) ৩৭৬টি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ আয়তনের ভূপৃষ্ঠস্থ পানি প্রকল্প রয়েছে যেগুলির মধ্যে পদ্মা-কপোতাক্ষ সেচপ্রকল্প, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচপ্রকল্প, বরিশাল সেচপ্রকল্প, ভোলা সেচপ্রকল্প, চাঁদপুর সেচপ্রকল্প, পাবনা সেচপ্রকল্প, মেঘনা-ধনাপগোদা সেচপ্রকল্প, কর্ণফুলী সেচপ্রকল্প, তিস্তা সেচপ্রকল্প ও মহুরি সেচপ্রকল্প হলো প্রধান নালা-সেচপ্রকল্প।

বাংলাদেশে অন্তর্ভূপৃষ্ঠ (subsurface) সেচ ও কণা-সেচ (drip irrigation) চালু নেই এবং মাত্র কয়েকটি চা বাগান ছিটানো (sprinkler) সেচপদ্ধতি ব্যবহার করে।

সনাতন ও আধুনিক উভয় সেচপদ্ধতিই কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আধুনিক পদ্ধতিগুলি প্রবর্তনের পর থেকেই অবশ্য এগুলির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দু’দশকে ভূনিম্নস্থ পানিসেচের উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে। আধুনিক সেচপদ্ধতি ব্যতীত বাংলাদেশে শস্যের ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধি বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছত না। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গৃহীত হলে মোট চাষযোগ্য জমির ৫০% পর্যন্ত সেচের আওতায় আনা সম্ভব।

সেচ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এবং ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা এ প্রযুক্তির সুফল লাভ করায় এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি সরাসরি কৃষকের আয় বৃদ্ধি করে। সেচকার্যক্রমে অতিরিক্ত শ্রমের প্রয়োজন বিধায় সেচের প্রবর্তন গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারে। অধিকন্তু, শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের ফলে অতিরিক্ত শ্রম নিয়োগ করা যায়, কারণ অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে বিপণন ও প্রক্রিয়াকরণে অতিরিক্ত শ্রমের প্রয়োজন হয়। সেচব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ইঞ্জিন, মোটর, পাম্প, পাইপ, ফিটিং প্রভৃতি উৎপাদন অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিল্পখাতে আয় বৃদ্ধি করে। তাই বলা যায়, আধুনিক সেচ দেশের জন্য বহুবিধ সুবিধা নিয়ে এসেছে।

অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো আধুনিক সেচব্যবস্থাও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। অগভীর নলকূপের যথেচ্ছা স্থাপন এবং এভাবে বিপুল পরিমাণ ভূনিম্নস্থ পানি তোলার ফলে আর্সেনিক দূষণ দেখা দিয়েছে এবং উত্তরাঞ্চলের বহু লোক আর্সেনিক দূষণ রোগে ভুগছে।  [ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়]

আরও দেখুন আর্সেনিকোসিস; সেচ

সার (Fertilizers and manures)  বিভিন্ন ধরনের অজৈব সার ও জৈবসার উদ্ভিদের মৌলিক পুষ্টি উপাদানের উৎস। ফসল উৎপাদনের সহায়ক উপকরণগুলির মধ্যে সার হলো একক সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ যা ফলন বৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচ্য। অবশ্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপকরণগুলিও পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে। অজৈব সার বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে শস্য উৎপাদনে সাফল্যের চাবিকাঠি এবং মোট উৎপাদনের প্রায় ৫০-৬০% সাফল্যের দাবিদার। ১৯৫১ সালে ২৬৯৮ মে টন অ্যমোনিয়াম সালফেট দিয়েই আমাদের কৃষিতে এই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের ব্যবহার শুরু। কিন্তু ওই শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সেচ সুবিধা উন্নয়নের সঙ্গে ফসলের আধুনিক জাতসমূহের প্রবর্তন ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি এই সারের ব্যবহারও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সার ব্যবহারের বৃদ্ধির ধারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমে এসে একটা স্থিতি অবস্থায় চলে আসছে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি’র মতো সার থেকে উদ্ভিদপুষ্টির ৩টি প্রধান উপাদান (N, P, K) মাটিতে সরবরাহ করা হতো। অ্যামোনিয়াম সালফেটের ব্যবহার চা চাষে সীমাবদ্ধ। আশির দশকের মাঝের দিকে ধানচাষে S ও Zn গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ফসলের প্রয়োজনীয় এসব খাদ্য উপাদান  সরবরাহের জন্য তখন জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট ও জিঙ্ক অক্সি-সালফেট প্রবর্তন করা হয়। নববই দশকের প্রথম দিকে কিছু এলাকায় কিছু ফসলের জন্য Mg, B ও Mo মৌলধারক বিভিন্ন সার নিয়ে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করা হয়। বিগত ৩ বছরের (২০০৫-২০০৮) গড়ে আমাদের দেশে ব্যবহূত অজৈব সারের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৬ লক্ষ মে টনের মতো। আর তাতে শুধু ইউরিয়া নাইট্রোজেনের পরিমাণ হলো প্রায় ৭০%। ১৯৯০ সালের আগে ফসফরাসের জন্য আমাদের কৃষকরা শুধু টিএসপি ব্যবহার করত, কারণ তখন P-বাহক সার হিসেবে বাজারে একমাত্র এটিই সহজলভ্য ছিল। ১৯৯০ সালের পর ফসফরাসের বিকল্প উৎস হিসেবে বাজারে SSP আসতে শুরু হয় এবং ক্রমেই সহজলভ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য ২০০০ সাল হতে এই সারের ব্যবহার কিছু কমে বর্তমানে স্থিতি অবস্থায় রয়েছে। ফসফরাসের আরেকটি উৎস DAP সার। নববই দশকের শেষ দিকে DAP সারের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের সারের মধ্যে ইউরিয়া ৬৩%, ফসফেট ২০% এবং কিছু জিঙ্ক সার স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয়। গন্ধকের উৎস হিসেবে জিপসাম TSP কারখানার উপজাত হিসেবে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। প্রায় ৮০% ফসফেট এবং MP পুরোটাই আমদানি করা হয়। বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের ফসল ও ফসল বিন্যাসে সুষম সার ব্যবহারের উপর অবিরাম গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষকদের সুষম সারের ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত করতে BARC ২০০৫ সালে ‘সার ব্যবহার সুপারিশ নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে।

অতীতে সরকারি খাত সার ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করত এবং তাতে, বিশেষত TSP ও MP সারের ক্ষেত্রে, অত্যধিক ভর্তুকি দেওয়া হতো। ১৯৯২-৯৩ সালে এক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ শুরু হওযার পর বর্তমানে বিভিন্ন সারের উপর ভর্তুকিও যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য, এতে নিম্নমানের ও পুরানো সার বিপণনের আশংকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সার ব্যবসায়ী ও কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকার ‘সার নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৯৫’ জারি করে।

জৈবসার হলো ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য জমিতে ব্যবহার্য উদ্ভিদ ও প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া বিভিন্ন পদার্থ। সাধারণত বিপুলায়তন এই বস্ত্ত স্বাভাবিক বা রূপান্তরিত অবস্থার ব্যবহূত হয়। কৃষিতে জৈব পদার্থের ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন ও একটি চিরাচরিত কৌশল। জমিতে এখন পর্যন্ত ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের জৈবপদার্থের মধ্যে গবাদিপশুর গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, খামারজাত সার ও সবুজসার উল্লেখযোগ্য। জৈবসারের মধ্যে গোবর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বস্ত্তর অনেকাংশ বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। টেকসই ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে গবেষক ও সম্প্রসারণ কর্মীরা এখন অজৈব ও জৈব সারের সমন্বিত ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫ মে টন জৈবসার প্রয়োগ প্রায় ৩৩% রাসায়নিক সারের চাহিদা কমাতে পারে।  [নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া]

আরও দেখুন জীবজসার

বালাইনাশক (Pesticide)  ফসলের ক্ষতিকর উদ্ভিদ বা প্রাণী নিয়ন্ত্রণের কাজে খামার, বাগান ও গৃহে ব্যবহূত রাসায়নিক। বালাইনাশক বিভিন্ন প্রকার: কীটনাশক (insecticides, পোকামাকড় মারার জন্য), কৃমিনাশক (nematocides, নিমাটোড মারার জন্য), টিক ও মাইটনাশক (acaricides, মাইটনাশের জন্য), ইঁদুরনাশক (rodenticides, ইঁদুর মারার জন্য), ছত্রাকনাশক (fungicides, ছত্রাক নিয়ন্ত্রণের জন্য) ও আগাছানাশক (herbicides, প্রধানত আগাছা ধ্বংসের জন্য)। রাসায়নিক বালাইনাশক সাধারণত স্পর্শ, সেবন বা ধুঁয়ার মাধ্যমে বিষ হিসেবে কাজ করে। স্পর্শবিষ অত্যন্ত দ্রুত বা বিলম্বে কার্যকর হতে পারে। সেবনবিষ খাদ্যের সঙ্গে প্রাণঘাতী মাত্রায় উদরস্থ হলে কার্যকর হয়। নিয়মানুসারে স্পর্শবিষ উত্তম সেবন বিষও। ধূপনবিষ (fumigants) প্রাথমিকভাবে কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবস্থায় থাকতে পারে, কিন্তু শুধু বায়বীয় অবস্থায়ই শ্বসন অঙ্গে ঢুকে কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে। কিছু কিছু কীটনাশক সিস্টেমিক (systemic) ধরনের অর্থাৎ প্রয়োগ স্থান থেকে উদ্ভিদের অন্যান্য অংশে পৌঁছায় যেখানে এগুলি ফসলভুক কীটপতঙ্গের উপরই কার্যকর হয়। উদ্ভিদজাত কীটনাশক (পাইরিথ্রাম, রোটিনোন ইত্যাদি) উষ্ণরক্তের প্রাণীর ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।

mviwY 7  2002 †_‡K 2005 mvj ch©š— e¨enƒZ wewfbœ evjvBbvkK (†g Ub)|

সাল#কীটনাশক#ছত্রাকনাশক#আগাছানাশক#ইঁদুরনাশক#মোট(মে টন)

<nowiki>#দানাদার#তরল#গুঁড়া##

২০০২#১২৩৩৫#১৪৯৭#১৪২#২৪১৯#৯৬৪#৩৯#১৭৩৯৩

২০০৩#১১৭৮১#১৮৩০#১৫৫#২৯৪১#১৩৫৪#১৯#১৮০৮০

২০০৪#১২১১৩#২০০৮#২২৯#৪২৭৯#৩৪৬৩#২৩#২২১১৫

২০০৫#১৪০৬১#২৫১১#৩২৩#৫৭৭২#২৭৭৫#২৪#২৫৪৬৬

Drm  Bangladesh Pesiticide Association|

সর্বাধিক কার্যকর বালাইনাশক কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত পদার্থ এবং আজ পর্যন্ত এরূপ হাজার হাজার রাসায়নিক আবিষ্কৃত হয়েছে। বালাইনাশকের সবচেয়ে বড় শ্রেণি হলো কীটনাশক, যেগুলি তাদের রাসায়নিক গুণাগুনের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভক্ত যেমন ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন (DDT ও সমগোত্রীয়), সাইক্লোডাইন যৌগ (ডাইএলড্রিন, অলড্রিন, হেপ্টাক্লোর), কার্বামেট যৌগ (সেভিন, সেভিডল) এবং অরগানোফসফেট যৌগ (ম্যালাথিওন, ডায়াজিনন, কার্বিক্রন ইত্যাদি)। ব্যবহার্য বালাইনাশকগুলি বিভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায় দানাদার, তরল বা অবদ্রবী কনসেনট্রেট, গুঁড়া অ্যারোসল ইত্যাদি।

১৯৫৬ সাল থেকে বাংলাদেশে বালাইনাশক ব্যবহূত হয়ে আসছে। অতীতে সরকারের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ বালাইনাশক আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করত। ১৯৭৪ সাল থেকে সরকার হ্রাসকৃত মূল্যে এগুলি বিক্রয় শুরু করে এবং ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা চালু রাখে। এ সরকারি ভর্তুকি ১৯৭৯ সালে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নিয়ে ব্যবসাটি পেসটিসাইড এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (PAB) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। অবশ্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি আমদানিযোগ্য ও ব্যবহার্য বালাইনাশকগুলি শনাক্ত ও অনুমোদন করে থাকে। প্রায় ২৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিনিধি মারফত এগুলি বিক্রয় করে। দ্রুত ও সহজদৃষ্ট কার্যকারিতা এবং স্বল্পমূল্যের কারণে বালাইনাশকের ব্যবহার কৃষকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে দেশে বালাইনাশকের মোট ব্যবহার ১৯৫৬ সালের সামান্য কয়েক মে টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৩ সালে ৫৫৬০ মে টনে পৌঁছায়। ১৯৭৯ সালে সরকারি ভর্তুকি সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের পর বালাইনাশকের ব্যবহার বিশ শতকের আশির দশকে কিছুটা কমার পরই আবারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিম্নের সারণিতে ২০০২-২০০৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন বালাইনাশক বণ্টনের ধরন উপস্থাপিত হয়েছে।

মানব কল্যাণে বালাইনাশকের অবদান অপরিমেয়। এসব রাসায়নিক দ্রব্য শুধু শস্য উৎপাদান বাড়িয়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি খাদ্যচাহিদাই পূরণ করছে না, বিশ্বব্যাপী কীটপতঙ্গবাহিত বিভিন্ন রোগ দমনেও সহায়তা করছে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলের কাজে DDT সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মানবকল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে কীটনাশকের আবিষ্কার একটি উল্লখযোগ্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য। কিন্তু কীটনাশকের উপর জনসাধারণের অত্যধিক নির্ভরতা এবং পরিবেশগত বিভিন্ন দিক পুরোপুরি বিবেচনা ছাড়াই এর যত্রতত্র প্রয়োগ ও বিরামহীন ব্যবহারের ফলে বর্তমানে এটি কতকগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। প্রশ্নগুলি হলো মানুষের স্বাস্থ্য, বন্যজীব ও পরিবেশের উপর এগুলির প্রভাব, কীটপতঙ্গের মধ্যে এগুলির বিরুদ্ধে বংশানুসৃত প্রতিরোধ গড়ে ওঠা এবং স্বাভাবিক জীবজ দমনের এজেন্টগুলির ধ্বংস। অল্প কয়েক বছর আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপের ফলে দেখা গেছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বছরে কীটনাশকে আক্রান্ত প্রায় ৫ লক্ষ লোকের মধ্যে ১০,০০০ জন মারা যায়। সন্দেহ নেই, এ পরিসংখ্যানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের ওপর বর্তায়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার কমানোর জন্য সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা, জীবজ দমন এবং পোকামাকড় প্রতিরোধক্ষম ফসল উদ্ভাবনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে।

বালাইনাশক নিয়ন্ত্রণ বিধি বালাইনাশক আইন বলতে মানব কল্যাণ ও ফসল সংরক্ষণের কাজে ব্যবহূত কীটনাশকের ব্যবহার সম্পর্কিত বিধি, অধ্যাদেশ ও আইন ইত্যাদি বোঝায়। উৎপাদনকারী, ব্যবহারকারী ও আইনপ্রণেতা সকলকেই এসব আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। বর্তমানে এ নিয়ম চালু হয়েছে যে, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য সকল প্রকার বালাইনাশকের প্রত্যেকটি বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিবন্ধি হওয়া বাধ্যতামূলক। বালাইনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১ এবং কীটনাশক বিধি ১৯৮৫ প্রয়োগে বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কীটনাশক আমদানি, উৎপাদন, সংশ্লেষণ, বিক্রয়, সরবরাহ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭১ সালে কৃষির বালাইনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১, ঘোষণা করা হয়েছিল। বালাইনাশক আমদানির লাইসেন্স প্রচলন এবং পুনঃমোড়ককরণ ব্যবস্থা সম্বলিত বিধিবিধান সংযোজনের মাধ্যমে ১৯৮০ সালে এ অধ্যাদেশ সংশোধনের পর এটিকে পুনরায় ১৯৮৩ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে ৯৪টি বালাইনাশক ২৯৯টি ট্রেডমার্ক সম্বলিত নামে কৃষিকাজে এবং ৭৫টি জনস্বাস্থ্য কাজে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিকৃত হয়েছে।

বালাইনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১ এ অধ্যাদেশের অধীনে একটি বালাইনাশক টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও একটি বালাইনাশক টেকনিক্যাল উপদেষ্টা সাব-কমিটিও গঠিত হয়েছে। অধ্যাদেশে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বালাইনাশক আমদানি, সংশ্লেষণ, বিক্রয়, সরবরাহ ও ব্যবহার নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদান; কীটনাশক টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি প্রতিষ্ঠা; বালাইনাশক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি বিশ্লেষক ও পরিদর্শক নিয়োগ; নিবন্ধন নবায়ন ও বাতিলকরণ; বালাইনাশকের নমুনা প্রাপ্তির ও বিশ্লেষণের ফলাফল বর্ণনার প্রক্রিয়া; পরিদর্শকের ক্ষমতা, অপরাধ ও শাস্তি; এবং আইন প্রণয়নের ক্ষমতা।

বালাইনাশক বিধি ১৯৮৫  এ বিধিতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে: বালাইনাশক নিবন্ধন নবায়ন, মাসুল, নিবন্ধন বাতিল ও নিবন্ধনের পর পূরণযোগ্য শর্তাবলী; কীটনাশক আমদানি; আমদানির জন্য অনুমতিপত্র ও আনুষঙ্গিক ফি, সংশ্লেষণ, পাইকারি মজুদ, খুচরা বিক্রয়, পুনঃমোড়ককরণ, ব্যবসায়িকভাবে বালাইনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও প্রচারকার্য; উপদেষ্টা কমিটি, গবেষণাগার ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি কার্যক্রম; মোড়ককরণ ও সামগ্রীর গায়ে লেবেল লাগানোর ধরন; বালাইনাশকের বিষাক্ততার শ্রেণিবিভাগ; বালাইনাশক উৎপাদন, সংশ্লেষণ, পুনঃমোড়ককরণ ও ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি; নিরাপত্তামূলক সতর্কতা; বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য প্রাসঙ্গিক তপসিল ও ফরম।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার পরিচালক হলেন নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানের অধিকারী। তিনি বালাইনাশক গবেষণাগারের পরিচালকও। নিবন্ধন অনুমোদনের পর বাজারজাত করার আগে উৎপাদিত সামগ্রীর গায়ে লাগানোর লেবেলের খসড়া অনুমোদনের জন্য জমা দিতে হয়।

বালাইনাশক আমদানির পদ্ধতি  বালাইনাশক আমদানি শুল্ক বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার পরিচালকের সুপারিশক্রমে এ আমদানির অনুমতিদাতা। আমদানিকারককে একটি মুচলেকা প্রদান করতে হয় যে, এ সামগ্রী শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহূত হবে। কৃত্রিম বালাইনাশকের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুমতিপত্র প্রয়োজন হয় না। কিন্তু শুল্ক বিভাগ সামগ্রীটির নিবন্ধন সনদপত্র পরীক্ষা করে সেটি নিবন্ধিত কিনা তাতে নিশ্চিত হবে।

কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ  কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার কর্মচারীদের টেকনিক্যাল যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা যাতে কর্মচারীরা বালাইনাশক অধ্যাদেশ ও আইনের শর্তগুলি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশের বালাইনাশক সমিতি (Bangladesh Pesiticide Association) কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার সঙ্গে একযোগে সম্প্রতি কীটনাশক ব্যবসায়ী ও কৃষকদের নিরাপদ ও বিধিবদ্ধভাবে বালাইনাশক ব্যবহারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দান শুরু করেছে।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

লাগসই প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর (Appropriate technology and technology transfer) প্রত্যাশিত ফল লাভের জন্য উৎপাদনশীল সম্পদাদিসহ জ্ঞান, উপকরণ ও ব্যবস্থাপনা বিধানের সমন্বয়কে প্রযুক্তি বলা যেতে পারে। একে জ্ঞান, উপকরণ, সেবা গঠন ও সমন্বয়ের ধরন এবং ঐভাবে কোনো প্রণালীকে কার্যকর ও টিকিয়ে রাখতে সহায়তা যোগানোও ভাবা যায়। অবশ্য, লাগসই প্রযুক্তি একটি কারিগরিগত পরিবর্তন বা প্রযুক্তি যা একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটায়। প্রযুক্তিসমূহের প্রধান বৈশিষ্ট্য নতুনত্ব, প্রায়োগিক উপযুক্ততা, পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত, অভিযোজ্যতা, অর্থনৈতিক লাভজনকতা, পরিবেশবশ্যতা, স্থায়িত্ব, আপেক্ষিক সুবিধা, সুসমতা, প্রবেশ্যতা ও প্রাপ্যতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা।

সারা বিশ্বে, এমনকি একই দেশে জলবায়ু, মাটি ও পানির প্রাপ্যতা এবং ভূসংস্থানের ব্যাপক ভিন্নতার কারণে একটি স্থানে লাগসই বা উপযুক্ত বিবেচিত একটি প্রযুক্তি অন্যত্র লাগসই নাও হতে পারে। আবার কিছু প্রযুক্তি একাধিক কৃষি বাস্ত্তসংস্থানিক অঞ্চলে লাগসই হতে পারে। এ ধরনের প্রযুক্তিগুলি হতে পারে ফসলের বিভিন্ন জাত, খামার মেশিনারি, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ইত্যাদি। বিভিন্ন কৃষি বাস্ত্তসংস্থানিক অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মাটি ও জলবায়ু থাকায় নির্দিষ্ট ফসল, সারের মাত্রা, পানির চাহিদা প্রভৃতি অঞ্চল নির্দিষ্ট হতে পারে। কিছু অঞ্চলে একটি বিশেষ ধরনের কৃষি এবং অন্যান্য অঞ্চলে অধিকতর বহুমুখী কৃষি থাকতে পারে।

বিশ শতকের সত্তরের দশকে সরকার লাগসই কৃষি প্রযুক্তির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদে লাগসই কৃষি প্রযুক্তিকোষ গঠন করা হয়। প্রযুক্তিকে তখন প্রকৌশল প্রযুক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতরভাবা হতো। পরবর্তীকালে ধারণাটি পশুসম্পদ ও মৎস্যসহ কৃষির সকল শাখায় বিস্তার লাভ করে।

একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সময় স্মরণ রাখতে হবে যেন তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তারা সেটির বিকাশ ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা কিছুটা দূর করা যায়। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে একটি প্রযুক্তি কারিগরিগতভাবে কার্যকর, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেই কেবল লাগসই বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা কৃষি, বন, মৎস্য ও পশুসম্পদের ক্ষেত্রে বহু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তির অনেকগুলি গৃহীত হয়েছে, কিছু ব্যবহারকারীর কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। শস্যখাতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তুলা ও ইক্ষুর অনেকগুলি উচ্চফলনশীল জাতের প্রযুক্তি প্যাকেজ অবমুক্ত করেছে। এসব প্যাকেজের সঙ্গে প্রযুক্তিগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য, চাষাবাদের প্রাসঙ্গিক নির্দেশ, উপকরণাদি প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা প্রণালী বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।

পশুসম্পদ খাতে উদ্ভাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলির মধ্যে রয়েছে গরুর মোটাতাজাকরণের জন্য খাদ্য হিসেবে ইউরিয়া-চিটাগুড়-খড়, সমন্বিত মুরগি-মাছ চাষ, ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ছাগল পালন মডেল এবং ডিমপাড়া মুরগির খাবারে পাতার প্রোটিন-কন্সেন্ট্রেট মিশ্রণ প্রদান।

মাছ চাষিদের মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে হস্তান্তরকৃত প্রযুক্তিগুলির কয়েকটি সিমেন্টের তৈরী ক্ষুদ্র জলাধারে বংশগতভাবে উন্নত শিং-মাগুরজাতীয় (সংকর) মাছের চাষ, ধানক্ষেতে মাছের সমন্বিত চাষ, ঘেরে মাছের চাষ ও পুকুরে পাঙ্গাসের চাষ। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের কাঠামোর মাধ্যমে কৃষিপ্রযুক্তিগুলি কৃষকদের কাছে হস্তান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও তাদের নিজস্ব কার্যক্রম ও কলাকৌশলের মাধ্যমে কৃষিপ্রযুক্তি বিস্তারে সম্পৃক্ত রয়েছে। পশুসম্পদ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর যথাক্রমে পশুসম্পদ ও মৎস্যখাতে প্রযুক্তি হস্তান্তরের দায়িত্বে রয়েছে। ফলাফল প্রদর্শন, দলীয় আলোচনা সভা, ফলাফল প্রদর্শনকালীন সভা, পদ্ধতি প্রদর্শন, প্রচারপত্র, পুস্তিকা, পোস্টার, বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মতো বিভিন্ন শিক্ষাদান মাধ্যম আগ্রহীদের কাছে লাগসই প্রযুক্তি পৌঁছতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

প্রযুক্তি গ্রহণের হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত নতুন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মনীতির মাধ্যমে খামার, কৃষক ও খামারের পরিবেশকে পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কর্মনীতিতে কিষাণীদের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা রয়েছে। নতুন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মনীতিতে প্রযুক্তি হস্তান্তর তরান্বিত করার লক্ষ্যে সম্প্রসারণ গবেষণা সংযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষির লাগসই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত করার লক্ষ্যে প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন উপজেলা ও জেলাসদরে কৃষি মেলার আয়োজন করে থাকে।  [এম আবুল কাশেম এবং ক্ষীরোদ চন্দ রায়]

কৃষি গবেষণায় নিউক্লিয়ার কলাকৌশল (Nuclear techniques in agricultural research) ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি গবেষণায় তেজষ্ক্রিয় আইসোটপ ও আণবিক শক্তির ব্যবহার। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণার যেসব প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে আণবিক পদ্ধতি সফল প্রমাণিত হয়েছে সেগুলি হলো মিউটেশন ব্রিডিং, মাটি-উদ্ভিদ সমীক্ষা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা ও ছত্রাকনাশক গবেষণা এবং খাদ্য সংরক্ষণ। খাদ্য ও বিকিরণ জীববিদ্যা ইনস্টিটিউট (IFRB) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA) দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও সেগুলি সংরক্ষণে বিকিরণ ও আইসোটপ ব্যবহার করছে। BINA ৬ জাতের উচ্চফলনশীল ধান (ইরাটম ২৪, ইরাটম ৩৮, বিনাসাইল, বিনাধান ৪,৫,৬), ২ জাতের পাট (এটমপাট ৩৮, বিনাদেশীপাট ২), ৪ জাতের সরিষা (অগ্রণী, সফল, বিনাসরিষা ৩, ৪), ২ জাতের ছোলা (হাইপ্রছোলা ও বিনাছোলা), ৫ জাতের মুগ (বিনামুগ ১,২,৩,৪,৫), ১ জাতের মাষকলাই (বিনামাষ ১) এবং ৩ জাতের টমেটো (বাহার, বিনাটমেটো ২, ৩) উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত এসব জাত শুধু উচ্চফলনশীলই নয়, এতে অন্যান্য গুণও রয়েছে। এগুলি আগে পাকে, বেশি প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং কীটপতঙ্গরোধী। মসুর, ছোলা, চীনাবাদাম, মুগ, বরবটি ও সয়াবিন G ৬টি শুঁটিজাতীয় শস্যের জন্য ইনস্টিটিউট সস্তা ও পরিবেশের অনুকূল জীবজসার উদ্ভাবন করেছে। কৃষকরা ইউরিয়ার বদলে এ সার ব্যবহার করে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে BINA অন্যান্যা যেসব ক্ষেত্রে অবদানও রেখেছে তার মধ্যে মাটির পুষ্টিদায়ক অবস্থান ও পুষ্টিগত অভাব নির্ধারণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও জিঙ্ক সারগুলির প্যাকেজ ব্যবস্থাপনা, পুষ্টিবস্ত্তর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং পরিপোষক উন্নয়নমুখী কৃষিকর্ম উল্লেখযোগ্য। বিবিধ শস্যের প্রজননবস্ত্তকে রোগজীবাণু ও ক্ষতিকর কীটপতঙ্গমুক্ত করার জন্য BINA স্ক্রিনিং কার্যক্রমও চালাচ্ছে। IFBR ফসল তোলার পর সেগুলি সংরক্ষণে এবং দানাশস্য, ডাল, ময়দা, মসলা, শুঁটকি ইত্যাদি গুদামজাত খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন নির্বীজনের প্রক্রিয়ায় আণবিক পদ্ধতি প্রয়োগ করছে।  [এম ইদ্রিস আলী]

কৃষিসংস্থা(Agricultural agency) দেশজ উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এবং দেশের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানে যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১২% আসে কৃষিদ্রব্য রপ্তানি থেকে। আবাদি জমির পরিমাণ ও উৎপাদন উভয় দিক থেকেই কৃষিতে ধানের প্রাধান্য রয়েছে, যা যথাক্রমে মোট পরিমাণের ৭৫% ও ৫৫%। নিম্নলিখিত সংস্থাগুলি দেশের কৃষিখাতে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে।

কৃষি মন্ত্রণালয়  এ মন্ত্রণালয় সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্য ও সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মুখ্য দায়িত্ব পালন করছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এ মন্ত্রণালয়-এর আওতাভুক্ত বিভিন্ন সংস্থাকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও বিদেশি মুদ্রা বিনিময় বাজেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থসহায়তা যুগিয়ে প্রকল্প ও কার্যক্রমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। সরকারের গৃহীত অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য মন্ত্রণালয়টি পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সংস্থাগুলিকে সহযোগিতা দেয় এবং তাদের গৃহীত উদ্যোগগুলির সমন্বয় সাধন করে। এটি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নাধীন ভৌত কার্যক্রম ও ব্যয় পরিবীক্ষণ করে। মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করে এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কৃষির অন্যান্য উপখাতে কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এ বিভাগ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের উন্নত পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে, মাঠপর্যায়ে আধুনিক চাষাবাদের কৌশল প্রয়োগের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেয়, বিভিন্ন জাতের শস্য উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং ইউনিয়ন/ব্লক পর্যায়ে অবস্থিত কর্মিবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তা বাস্তবায়ন করে। এ বিভাগ নিম্নলিখিত অধিদপ্তরসমূহের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে। কৃষি সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কৃষিতে উদ্বুদ্ধকরণের সকল উদ্যোগ সম্প্রসারণ এবং সারা দেশে সেগুলির ব্যবস্থাপনা; কৃষি অধিদপ্তর (পাট উৎপাদন) পাটচাষের এলাকায় সম্প্রসারণ ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম; কৃষি অধিদপ্তর (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) সমন্বিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনাসহ উদ্ভিদ সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য নির্বাচন এবং সেগুলির যথাযথ ব্যবহার কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান; এবং কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কৃষকদের সম্প্রসারণ বার্তা প্রস্ত্ততে ব্যবহার্য সম্পদ যোগানো এবং গবেষক/প্রজননকর্মীদের প্রদত্ত পরামর্শ ও সুপারিশের ভিত্তিতে এবং সাধারণ কৃষকদের মান অনুযায়ী বার্তা প্রস্ত্তত সম্পাদন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রধান কাজ উন্নত জাতের বীজ, সেচের পানি এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার পদ্ধতি ও প্রয়োগের মাত্রা কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলা এবং তা ব্যবহারে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। বিভাগটি কৃষকদের জন্য প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে ও কৃষক সমাবেশের আয়োজন করে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এ বিভাগ জনগণের খাদ্যে পুষ্টি সুষমতা উন্নয়নের জন্য শস্যের বৈচিত্র্যসাধন এবং ফল ও সবজি ইত্যাদি উৎপাদনে উৎসাহ যোগানোর জন্য উদ্যান উন্নয়ন কার্যক্রমের মতো কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস  সাধারণ কৃষকদের মধ্যে তথ্য প্রচারের জন্য উদ্বুদ্ধ একটি তথ্যসমৃদ্ধ ও শিক্ষামূলক সংস্থা। এটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে তৈরী উপকরণ ব্যবহার করে। কৃষি তথ্য সার্ভিস সচিত্র সাময়িকী, সংবাদ বুলেটিন, বই ও প্রচারপত্র ইত্যাদি প্রকাশ করে এবং শিক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ও উপকরণ বিতরণ করে। বিভাগটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে এবং সেগুলি গ্রামাঞ্চলে প্রদর্শন করে। এ ছাড়া রেডিও/টেলিভিশনে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে।

কৃষি বিপণন বিভাগ  এবিভাগ মূল্যতালিকা প্রচার, গুরুত্বপূর্ণ বাজার কেন্দ্রে নানা কৃষিদ্রব্যের পরিমাণের তথ্য সরবরাহ, বাজার-ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদকদের কৃষিদ্রব্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা যোগায়। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকার খামারবাড়িতে (ফার্মগেট) অবস্থিত। বিভাগটি নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্র থেকে বাজার দর সম্পর্কে নিয়মিত সাপ্তাহিক সংবাদ বুলেটিন প্রকাশ ও বেতারে প্রচার করে।

তুলা উন্নয়ন বোর্ড  কাঁচাতুলা আমদানির ওপর স্থানীয় সুতাকলগুলির নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত। বোর্ড ইতোমধ্যেই তুলাচাষের উপযোগী এলাকাগুলি শনাক্ত করেছে। এসব এলাকার তুলা চাষিদের কাছে বিভাগটি বীজ উৎপাদক তুলা ও অন্যান্য প্রসম্ভার (input) যোগায় এবং পূর্বঘোষিত দামে পুনরায় কৃষকদের কাছ থেকে বীজ-তুলা ক্রয় করে। প্রধান কার্যালয় ঢাকায় এবং আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহ দেশের তুলা উৎপাদক এলাকাগুলিতে অবস্থিত।

বীজ যাচাই সংস্থা  এটি কৃষি খাতে উৎপন্ন বিভিন্ন বীজ, যেমন ধান, গম, পাট, বীজ-আলু ও ইক্ষুর মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাইয়ের দায়িত্ব পালন করে। এ উদ্দেশ্যে সংস্থাটি বংশধারার বিশুদ্ধতা, মজুদ বীজের অঙ্কুরোদগম এবং সেগুলির আর্দ্রতার পরিমাণ পরীক্ষা করে থাকে। একই উদ্দেশ্যে এটি চুক্তিবদ্ধ বীজ উৎপাদকসহ প্রজনক ও বীজবর্ধক সংস্থাগুলির  বীজতলাগুলি মাঠপর্যায়ে নিয়মিত পরিদর্শন করে। এটি স্বাভাবিক বীজ বোর্ড (Natural Seed Board) সংস্থার সচিবালয়ের মতো কাজ করে। গাজীপুরের জয়দেবপুরে অবস্থিত এ এজেন্সি সেখানে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার ছাড়াও দূরের সকল ফিল্ড স্টেশনে ছোট ছোট পরীক্ষাগার স্থাপন করেছে।

কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট  গাজীপুরের জয়দেবপুরে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রশিক্ষণ ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকান্ড সমন্বয়ের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ বার্তাগুলি উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন  সার, বীজ, সেচের পানি ইত্যাদি কৃষি-প্রসম্ভার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষকদের দোরগোড়ায় সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দায়িত্ব পালনের জন্য কর্পোরেশন রাসায়নিক সার, সেচ সরঞ্জাম, উদ্ভিদ সংরক্ষক রাসায়নিক ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং বণ্টনসহ বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করে। রাসায়নিক সার ও সেচ সরঞ্জাম সরবরাহ ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ার পর বর্তমানে এ কর্পোরেশন বীজবর্ধন খামার চালায়, চুক্তিবদ্ধ উৎপাদকদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন সংগঠিত করে, ফল ও সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করে এবং সেচভিত্তিক এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প চালায়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কৃষি পরিকল্পনায় মাঠপর্যায়ের অগ্রাধিকার, কৃষি গবেষণা কর্মসূচি অনুমোদন ও তহবিল বরাদ্দের সমন্বয় সাধনকারী সংস্থা। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। এটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের ইনস্টিটিউটগুলি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষকদের কার্যক্রম সমন্বয়ে সহায়তা যোগায়। কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং নিজস্ব বেতনভুক বিজ্ঞানী বা চুক্তিবদ্ধ গবেষণায় কর্মরত বিজ্ঞানীদের দ্বারা সেগুলির বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করে। কৃষি স্নাতকদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাউন্সিল মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা দেয়। এটি একটি কম্পিউটার কেন্দ্র, জাতীয় কৃষি গ্রন্থাগার ও দলিল প্রস্ত্তত কেন্দ্র (documentation centre) পরিচালনা করে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট অবিভক্ত ভারত আমলের অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় এটি প্রতিষ্ঠিত ও গাজীপুরের জয়দেবপুরে অবস্থিত। একজন মহাপরিচালকের অধীনে এ প্রতিষ্ঠানটি ধান ব্যতীত অন্য সব ধরনের খাদ্যশস্যের ওপর গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইনস্টিটিউটের অন্যান্য কেন্দ্রগুলি দেশের বিভিন্ন কৃষি বাস্তব্য অঞ্চলে অবস্থিত। এটি গম, আলু, ডাল, তৈলবীজ, ভুট্টা, তুলা, ফল, কন্দ ও সবজির ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কৃষিসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জামকে মাঠে ব্যবহার্য করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোও ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট  ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট নতুন নতুন জাত প্রজনন, উদ্ভাবন, বৃদ্ধি, উদ্ভিদ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সার প্রয়োগের মাত্রা, চাষাবাদসহ ধানের সবগুলি দিক নিয়েই গবেষণা চালায়। জয়দেবপুরে প্রধান কার্যালয়সহ ইনস্টিটিউট দেশের দূরবর্তী কৃষি-বাস্তব্য অঞ্চলগুলিতে কয়েকটি স্টেশনও প্রতিষ্ঠা করেছে। ইনস্টিটিউট দেশে নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাতগুলির অভিযোজন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। সংস্থাটি ফিলিপাইনের লস বানোস-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে নিজেদের প্রচেষ্টাগুলি সমন্বিত করে থাকে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট  ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন জাতের পাটের উন্নয়ন ও চাষাবাদ সম্পর্কে গবেষণা চালায়। নতুন জাতের পাট উৎপাদন এবং প্রকৃত ফলন বৃদ্ধি এ সংস্থার দায়িত্ব। প্রতিষ্ঠানটি চাষাবাদ ও সার প্রয়োগের ওপর পরীক্ষা পরিচালনা করে। ইনস্টিটিউট পাটবীজ কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করে। এটি নিজস্ব কারিগরি বিভাগের মাধ্যমে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ওপরও গবেষণা চালায়।

ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট  পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং উৎপাদকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আখের বিভিন্ন জাতের উন্নয়ন, চাষাবাদ এবং প্রসম্ভার ও সম্প্রসারণ প্রণালী প্রয়োগের ওপর গবেষণা পরিচালনায় নিয়োজিত।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি ইনস্টিটিউট এটি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আণবিক বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন শস্যের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করে। এটি ধান, পাট, সরিষা, চীনাবাদাম, ডাল, টমেটো ইত্যাদি ফসল নিয়ে গবেষণা চালায়। বিভিন্ন ধরনের ফসলের ওপর সারের বিভিন্ন প্রয়োগমাত্রা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা ও সে ফলাফল মূল্যায়ন করে। ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনে ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এ ইনস্টিটিউট মাটির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ এবং ফসল উৎপাদনের নিরিখে মাটির শ্রেণিবিন্যাস ও গুণাগুণ নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে। এটি গোটা দেশে মাটি পরীক্ষা ও জরিপ চালায় এবং কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষকদের ব্যবহারের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ পোস্টার প্রকাশ করে। এ সংস্থা কৃষক ও কৃষি উন্নয়নে নিয়োজিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিভিন্ন স্থানে মাটি পরীক্ষার ল্যাবরেটরি ছাড়াও ইনস্টিটিউটের ভ্রাম্যমাণ ইউনিটগুলি কৃষকদের এলাকায় গিয়ে একই কাজ সম্পন্ন করে।

কৃষি অর্থনীতি গবেষণা ইউনিট এটি ১৯৭২ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত এবং জাতীয় কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মনীতির ওপর সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক (macro/micro) অর্থনৈতিক গবেষণা পরিচালনায় দায়বদ্ধ। নির্দেশিত নিয়মিত দায়িত্ব পালন ছাড়াও এটি সরকারের বিশেষ কৃষিকর্ম নীতির ফলাফল দ্রুত জরিপ/পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ ইউনিটটি বর্তমানে অকার্যকর অবস্থায় আছে। এটি পুরোদমে চালু করা দরকার।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়  এটি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পশুপালন, কৃষি, পশু চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, মাৎস্যবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদান করে। মৌলিক ও উন্নয়নমূলক গবেষণা ছাড়াও কৃষিবিজ্ঞানীদের জন্য রিফ্রেসার্স কোর্স ও স্বল্পমেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রমও চালু আছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বেটেরিনারী এন্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি নব প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু আছে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক  পূর্বতন কৃষি ব্যাংক ও কৃষি উন্নয়ন ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যাংক কৃষি ও তদ্রূপ কাজের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে। এটি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবেও কাজ করছে। এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকও একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে কৃষি বিষয়ে ঋণ বিতরণ করছে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন  ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের মৎস্যশিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে (স্বাদুপানির ও সামুদ্রিক মৎস্যাদি আহরণ, প্রসেসিং ও বিপণন) সহায়তা প্রদান করে। এর প্রধান কার্যালয় ঢাকায়।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন  এটি ১৯৭৬ সালে  প্রতিষ্ঠিত এবং চিনিকলগুলির নিয়ন্ত্রণসহ বেসরকারি খাতে পরিচালিত চিনি ও খাদ্য-প্রসেসিং শিল্পগুলির উন্নতি বিধানে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন  বাংলাদেশের বনভূমি থেকে বনজসম্পদ আহরণ, কাঠভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, রাবার বাগান সৃষ্টি, কাঁচা রাবার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণসহ বনজসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং প্রক্রিয়াজাত করার কাজে নিয়োজিত। এই কর্পোরেশনের কাজ দুটো সেক্টরে বিভক্ত, শিল্প সেক্টর ও কৃষি সেক্টর। দেশের মোট ৩টি রাবার অঞ্চলে ১৬টি বাগান রয়েছে, যার আয়তন ৩২৬৩৫ একর। এগুলো থেকে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচা রাবারের চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে।

মৎস্য অধিদপ্তর  মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত। দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এ অধিদপ্তরের মূল দায়িত্ব। এর প্রধান কার্যালয় কাকরাইল, ঢাকায় অবস্থিত। এ অধিদপ্তরের কর্মকান্ড জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিস্তৃত।

মাৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট  রাষ্ট্রপতি প্রণীত অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর প্রধান কার্যালয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহে অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইনস্টিটিউটের ৫টি গবেষণা কেন্দ্র ও ৫টি উপকেন্দ্র রয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নকল্পে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও পরীক্ষণ এ ইনস্টিটিউটের প্রধান উদ্দেশ্য। এ নাগাদ ইনস্টিটিউট কর্তৃক ৪৭টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭টি প্রযুক্তি দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্মের মধ্যে রয়েছে দেশের বিপন্ন প্রজাতির মৎস্য প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থার সাফল্য, পাংগাস ও চিংড়ি চাষ এবং ইলিশ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা।

প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর  সম্প্রসারণ কার্যক্রমসহ প্রজনন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতি বিধানের মাধ্যমে দেশের গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য ১৯৪৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত। এর প্রধান কার্যালয় খামারবাড়ী, ঢাকায় অবস্থিত। এর স্থানীয় কার্যালয়সমূহ উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। সাভারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গোপ্রজনন ও দুগ্ধ খামার, ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে প্রাণি সম্পদ ওষুধাগার, মহাখালীস্থ প্রাণি সম্পদ গবেষণাগার এবং মিরপুরস্থ ঢাকা চিড়িয়াখানা এ অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত।

বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট   প্রাণি সম্পদ বিষয়ে গবেষণার জন্য একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান, যা ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশবলে সাভারে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ প্রাণি সম্পদ ও হাঁস-মুরগির উপর মাঠপর্যায়ের সমস্যাভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই প্রাণি সম্পদ ও পোল্ট্রি উৎপাদন বিষয়ে ৪০টি উন্নত প্রযুক্তি এবং ১৯টি প্রযুক্তি প্যাকেজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত এসব প্রযুক্তি ও প্যাকেজ বিএলআরআই এর বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক অনুমোধিত হয়েছে এবং তা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক ব্যাপকভাবে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। ইনস্টিটিউটে ৭টি গবেষণা বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি বিভাগ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে, একটি বিভাগ মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তির পরীক্ষণ করছে এবং একটি বিভাগ পশু-পাখি উৎপাদনের আর্থ-সামাজিক ও বিপনণ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। এ ইনস্টিটিউটের দুটো আঞ্চলিক কার্যালয় যথাক্রমে নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবনে এবং বাঘাবাড়ী, সিরাজগঞ্জে অবস্থিত।

বন অধিদপ্তর  দেশের বন সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত। এর প্রধান কার্যালয় আগারগাঁও, ঢাকায় অবস্থিত। প্রধান বন সংরক্ষকের অধীনে দেশের সমগ্র বনাঞ্চল কয়েকটি অঞ্চলে (circle) বিভক্ত। অঞ্চল প্রধান বন বিভাগগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি বিভাগ কয়েকটি রেঞ্জ (range) এবং রেঞ্জগুলি কয়েকটি বিটে (beat) বিভক্ত। দেশের প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং ভূমিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষায় বন অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের বনজ সম্পদের ঘাটতি পূরণ, কাঠভিত্তিক শিল্প কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং জনগণের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা তথা সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বন অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া বন বিদ্যার প্রযুক্তিগত দিকের উন্নয়ন সাধনের জন্য সকল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তদুপরি, বন বিভাগের মাধ্যমে বন ব্যবস্থাপনা, বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ইকোপার্ক উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম সরাসরি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে অবদান রাখছে। দেশের বন সম্পদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০ বছর মেয়াদি (১৯৯৫-২০১৫) বন মহাপরিকল্পনা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউট  ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামের ষোলশহরে প্রতিষ্ঠিত এবং দেশের বন ও বনসম্পদ উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। দেশের বনজ সম্পদ বৃদ্ধি ও বিজ্ঞানসম্মত সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে বনজ সম্পদের সার্বিক উন্নয়ন, সংরক্ষণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা ইনস্টিটিউটের প্রধান লক্ষ্য। ইতোমধ্যেই এ ইনস্টিটিউট উপকূলীয় উল্লেখযোগ্য বৃক্ষ প্রজাতিসমূহের নার্সারি ও বাগান উত্তোলন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যা উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম  উদ্ভিদ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি একটি জাতীয় উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণশালা। দেশের ঐতিহ্যবাহী গাছপালাসহ যাবতীয় বৃক্ষলতা প্রজাতির শনাক্তকরণ ও এদের নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের মূল উদ্দেশ্য। দেশের ভেষজ সম্পদ, উদ্ভিদ বিদ্যার চর্চা এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য বৃক্ষসম্পদের গবেষণা ও উন্নয়ন, পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে হারবেরিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর প্রধান কার্যালয় মীরপুর, ঢাকায় অবস্থিত। [এম আবুল হাশেম ও জাহাঙ্গীর আলম]

কৃষি সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণ (Agricultural extension and training)  কৃষি সম্প্রসারণ  গবেষণালব্ধ বিষয়বস্ত্ত, মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা এবং উপযোগী প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে গঠিত এক ফলিত বিজ্ঞান। কৃষি সম্প্রসারণ তথ্য যোগাযোগের ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণকে কৃষিসংক্রান্ত কাজে যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে শস্য, কৃষি সম্প্রসারণ, পশুসম্পদ ও মৎস্যবিষয়ক কর্মকান্ড সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করে যথাক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (Department of Agricultural Extension/DAE), পশুসম্পদ অধিদপ্তর (Department of Livestock Services/DLS) এবং মৎস্য অধিদপ্তর (Department of Fisheries/DOF)। এদের মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান যার সাংগঠনিক কাঠামো ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত।

সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রগুলি হচ্ছে সদর দপ্তর (জাতীয় পর্যায়), অঞ্চল (জেলা পর্যায়), ইউনিট (থানা পর্যায়) এবং ব্লক (ইউনিয়ন পর্যায়)। জাতীয় পর্যায়ে প্রধান হিসেবে রয়েছেন মহাপরিচালক যাকে সহায়তা দেন ৭ জন পরিচালক। শাখাগুলি হচ্ছে খাদ্যশস্য শাখা, অর্থকরী ফসল শাখা, উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা, প্রশিক্ষণ শাখা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন শাখা, প্রশাসন শাখা এবং মাঠপর্যায়ে সেবা শাখা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের সকল নিয়মিত কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে সেবা শাখার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। খাদ্যশস্য শাখা, অর্থকরী ফসল শাখা, প্রশিক্ষণ শাখা ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা প্রধানত বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যক্রমের জন্য সারা দেশকে ৯টি অঞ্চলে ভাগ করেছে এবং প্রত্যেক অঞ্চলের প্রধান হিসেবে একজন করে অতিরিক্ত পরিচালক নিয়োজিত আছেন যিনি সম্প্রসারণের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণার সমন্বয় সাধন করেন এবং মাঠপর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং জাতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হচ্ছে অঞ্চল (জেলা)। একটি অঞ্চলের প্রধান হচ্ছেন একজন কৃষি সম্প্রসারণ উপ-পরিচালক, আর তাকে সহযোগিতা করেন একজন করে শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ, উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ, একজন উদ্যানবিদ্যা বিশেষজ্ঞ এবং একজন জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা। অধিকন্তু, বড় জেলাগুলিতে একজন ঊর্ধ্বতন সেচ ইঞ্জিনিয়ারও থাকেন। ইউনিটের দায়িত্বে রয়েছেন কৃষি কর্মকর্তা, যাকে সহায়তা করেন একজন করে অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং অধস্তন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা। ব্লক (ইউনিয়ন) পর্যায়ে কাজ করেন একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (ব্লক সুপারভাইজার)। তিনি কৃষক বা কৃষকদলকে সম্প্রসারণ সেবা দিয়ে থাকেন যেখানে থাকে ৬০০ থেকে ১২০০ কৃষক পরিবার (গড়ে প্রায় ৯০০)।

প্রশিক্ষণ  কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মী (সাধারণত ব্লক সুপারভাইজার নামে পরিচিত) গড়ে তোলার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের DAE-র অধীনে ১২টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। চাকরিকালীন প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর; স্নাতক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, কোটবাড়ী, কুমিল্লা; এবং পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, বগুড়া।

বাংলাদেশে কর্মরত কিছু এনজিও-র নিজস্ব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে এবং সেগুলি তাদের কর্মীদের কৃষি, গ্রামীণ সমাজবিদ্যা, মৎস্যচাষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।  [এম আবুল কাশেম]