ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড় (Cyclone) ঘূর্ণিঝড় হলো গ্রীষ্মমন্ডলী ঝড় বা বায়ুমন্ডলীয় একটি উত্তাল অবস্থা যা বাতাসের প্রচন্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত হয়। এটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের একটি। ঘূর্ণিঝড় হলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় (Tropical cyclone) বা বায়ুমন্ডলীয় একটি উত্তাল অবস্থা যা বাতাসের প্রচন্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত হয়। পৃথিবীর ৩০º উত্তর এবং ৩০º দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ব্যতীত পৃথিবীর বাদবাকি গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাগরাঞ্চল যে মারাত্মক বায়ুমন্ডলীয় দুর্যোগসমূহ জন্ম দিচ্ছে তা সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে গড়ে ৮০টি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সাইক্লোন’ গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ (Kyklos) থেকে এসেছে। কাইক্লোস শব্দের অর্থ কুন্ডলী পাকানো সাপ। ঘূর্ণিঝড়ের উপগ্রহ চিত্র থেকে এমনতর নামকরণের যথার্থতা বোঝা যায়। ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিদ হেনরী পিডিংটন ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত সামুদ্রিক দুর্যোগ বিষয়ক পুস্তক The Sailor’s Horn-book for the Law of Storms -এ প্রথমবারের মতো সাইক্লোন শব্দটি ব্যবহার করেন। একটি অঞ্চলে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে একটি কেন্দ্রাভিমুখী ঘূর্ণায়মান প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ থেকেই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। উত্তর গোলার্ধে এ বায়ু ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী অর্থাৎ উত্তরাভিমুখী এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণাভিমুখী প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং এ অঞ্চলের বাইরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডল বহির্ভূত ঘূর্ণিঝড়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সাধারণভাবে ধ্বংসাত্মক এবং বাংলাদেশে তা প্রভূত ক্ষতিসাধন করে থাকে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়কে আমেরিকা মহাদেশে ‘হারিকেন’, দূরপ্রাচ্যে ‘টাইফুন’, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বলা হয় সাইক্লোন এবং বাংলায় ঘূর্ণিঝড়। পাশ্চাত্যে হারিকেনকে মানুষের নামেও চিহ্নিত করা হয়, যেমন: মিচেল, এনড্রু, ক্যারল, ডরোথি এবং ইভ। তবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে এ ধরনের নামকরণ প্রবণতা নেই। কখনও কখনও মধ্য অক্ষাংশ অঞ্চলে এটিকে নিম্নচাপ (Depression) বলা হলেও বর্তমানে সাইক্লোন শব্দটি হারিকেনধর্মী গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপকে প্রকাশের জন্যই ব্যবহূত হচ্ছে, বিশেষত যখন তা ভারত মহাসাগর থেকে উদ্ভূত হয়। বাংলায় এর আরেকটি প্রচলিত নাম ‘তুফান’ যা চীনা শব্দ ‘টাইফুন’ থেকে এসেছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলের অংশ, যার উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের প্রান্তে রয়েছে অনেকটা চোঙ আকৃতির উপকূলভাগ। বাংলাদেশের এ স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান মৌসুমীবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো এবং বন্যাও বয়ে আনে। বঙ্গোপসাগর গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির একটি আদর্শ ক্ষেত্র। ঘূর্ণিঝড় সাধারণত গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হয় বিধায় এ সম্পর্কে যথাযথ অনুসন্ধানের কাজটি খুব সহজ নয়। মহাশূন্য গবেষণার অগ্রগতির ফলে আবহাওয়া উপগ্রহগুলি এ সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য দিতে পারায় অনুসন্ধানের কাজে কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছে। উন্নত দেশসমূহ বিমান থেকে নিরীক্ষণ এবং ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সরাসরি অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় নিরীক্ষণ এবং অনুসন্ধানকর্মের সূত্রপাত ঘটেছে।
শ্রেণীবিভাগ বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা অনুসারে এর শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যভিত্তিক নামকরণ ব্যবহূত হচ্ছে: নিম্নচাপ (বাতাসের গতিবেগ ৬২ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত), ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ৬৩-৮৭ কিমি/ঘণ্টা), তীব্র ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ৮৮-১১৮ কিমি/ঘণ্টা) এবং হারিকেনের তীব্রতাসহ ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ১১৮ কিমি/ঘণ্টার উপরে)।
উৎপত্তি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭°সে এর উপরে থাকা প্রয়োজন। অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি ঘটে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে। সাধারণত ৫° উত্তর থেকে ৩০° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির উৎপত্তি ঘটে। ধারণা করা হয় যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ক্ষেত্রে আন্তঃক্রান্তীয় মিলন বলয় (Inter-tropical Convergence zone) - এর কিছু ভূমিকা রয়েছে। আন্তঃক্রান্তীয় মিলন বলয়ের অবস্থান হলো বিষুবরেখার কাছাকাছি, যেখানে দুই গোলার্ধের বায়ুপ্রবাহ এসে মিলিত হয়, তবে এর অবস্থান ঋতুভেদের ওপর নির্ভর করে। একটি ঘূর্ণিঝড় পৃথিবীর আবর্তন থেকে সৃষ্ট ‘কোরিওলিস ফোর্স’ থেকে তার ঘূর্ণায়মান গতি প্রাপ্ত হয়। কার্যত বিষুবরেখায় এ শক্তি শূন্যের (০) পর্যায়ে থাকে। সুতরাং ঘূর্ণিঝড়গুলি ঠিক বিষুবরেখা থেকে সৃষ্টি হয় না। প্রয়োজনীয় ঘূর্ণিগতির জন্য ঝড়গুলির উৎপত্তি ঘটে বিষুবরেখা থেকে কিছুটা উত্তর দিকে। সম্ভবত পূর্বদিক থেকে আসা ঢেউরাজিও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় কিছু ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন ধরনের বায়ুমন্ডলীয় বিপর্যয়ের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় হলো সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। একটি ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাস ৩০০ থেকে ৬০০ কিমি পর্যন্ত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ে সবসময়ই বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ১১৮ কিমি এর বেশি এবং তা শক্তিশালী নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। নিম্নচাপ কেন্দ্রে বায়ুর চাপ থাকে ৫০ থেকে ৬০ হেক্সা প্যাসকেল এবং প্রান্তদেশে এর পরিমাণ আরও বেশি হয়। প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা এবং সুপ্ত তাপ নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে বয়ে নিয়ে আসে যা ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। সাপের মতো কুন্ডলী পাকানো ঘূর্ণায়মান বাতাস নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হলে সেখানে প্রচন্ড গতিবেগ সৃষ্টি করে।
ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর গাঠনিক চিত্র হলো এর ‘চোখ’। উপগ্রহ চিত্রগুলিতে এ চোখের গঠন বা আকৃতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের চোখের মতো অংশটি ক্ষুদ্র এবং প্রায় বৃত্তাকার বা কখনও এটি চ্যাপ্টা হয়। এ অঞ্চলের ব্যাস থাকে ৮-৫০ কিমি। চোখে বায়ুচাপ থাকে সর্বনিম্ন এবং তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ। ঘূর্ণিঝড়ের চোখ যত উষ্ণ থাকে ঝড় ততো বেশি শক্তিশালী হয়। চোখে বায়ুপ্রবাহ থাকে খুবই হালকা (সাধারণত ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ কিমি-এর বেশি নয়) এবং মেঘ থাকে না বললেই চলে। এর বিপরীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যায় চোখটির পরিসীমার বাইরে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় যাকে চোখ-দেয়াল বলা হয়। এখানে বাতাসের বেগ এবং বৃষ্টিপাত সবচেয়ে বেশি।
চোখ-দেয়ালের বাইরের সীমানা থেকে বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের মূল কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি সাধারণত বৃত্তাকার অথবা প্রায় বৃত্তাকার এবং এর ব্যাস ১০০ থেকে ৮০০ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঘূর্ণিঝড়গুলি প্রায়শই কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে একটি লম্বা লেজের মতো অঞ্চল নিয়ে আবর্তিত হয় এবং এ প্রলম্বিত অংশে একাধিক বলয় থাকে। সমগ্র বিষয়টি একটি সর্পিলাকার কাঠামো তৈরি করে যা অনেকটা ‘উল্টানো কমা’ বা ‘উদ্ধার চিহ্নের’ মত। ঘূর্ণিঝড়ের লেজটি কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের লেজের মতো অংশটি সাধারণত প্রাণকেন্দ্র বা মুল অংশটির পূর্বেই ভূমিকে অতিক্রম করে যার ফলে ঝড়ের পূর্বে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় এবং ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার শুরুতে প্রায়শই বৃষ্টিপাত ঘটে। এ ধরনের লক্ষণ সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত হতে পারে।
পরিক্রমণশীল একটি ঘূর্ণিঝড়ের ডান প্রান্তে বাম প্রান্তটির তুলনায় অধিক ধ্বংসাত্মক শক্তি বিদ্যমান থাকে। কাজেই সমুদ্রের দক্ষিণ দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় যখন উত্তরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আঘাত হানে, তখন ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ডান অংশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। একটি ঘূর্ণিঝড়ের শুরু থেকে সমাপ্তির সময়সীমা ৭-১০ দিন পর্যন্ত ব্যাপ্ত এবং এসময় জুড়ে ২৫০-৫০০ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে পারে। ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানার পর জলীয়বাষ্প সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ দুর্বল হয়ে এর জীবনচক্রের সমাপ্তি ঘটে।
ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ প্রাথমিক পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় ঘণ্টায় ৫-১০ কিমি হারে উৎপত্তি স্থল থেকে অগ্রসর হতে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এ গতি ঘণ্টায় ২০-৩০ কিমি, এমনকি ঘণ্টায় ৪০ কিমি পর্যন্ত হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণত প্রারম্ভে উত্তর-পশ্চিমমুখী এবং পরবর্তী পর্যায়ে পূর্বদিকে বেঁকে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তবে সংঘটিত বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ বিচারে উল্লিখিত প্রবণতা সবসময় প্রকাশ করে না। ঘূর্ণিঝড়ের অনুষঙ্গ হলো ভারি বর্ষণ এবং সমুদ্রের জলরাশির স্ফীতি, যাকে বলা হয় জলোচ্ছ্বাস। যদি সমুদ্রে জোয়ারকালীন এমন ঘটে তবে তুলনামূলকভাবে জলোচ্ছ্বাস আরও জোরদার হয় এবং তা ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসের মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাচীরাকৃতি পানির প্রবাহ জীবন ও সম্পদের সমূহ ক্ষতি সাধন করে।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে প্রায়শই ধারণা করা হয় যে, ঘূর্ণিঝড়টি উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় প্রবাহের দিককে অনুসরণ করে থাকে। স্পারসো (স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েরই নির্দিষ্ট পরিচালনাকারী বায়ুপ্রবাহ থাকে; তবে বিভিন্ন ঝড়ের ক্ষেত্রে এ বায়ুপ্রবাহের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। অধিকন্তু উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় প্রবাহ ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথের মতোই নিয়ত পরিবর্তনশীল হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় পরিচালনাকারী বায়ুপ্রবাহের ভূমিকা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সহজসাধ্য নয়। স্পারসো গত একশ বছরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়সমূহের জলবায়ুগত দিক পর্যালোচনা করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ সম্পর্কে পূর্বাভাসের জন্য টাইয়ান (TYAN) নামে একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করেছে। এ মডেল ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানার ২৪ ঘণ্টা আগে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া গিয়েছে।
জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল ঝড়ো বাতাস সমুদ্রপৃষ্ঠে আকস্মিক উন্মাতাল তরঙ্গ এবং জলস্ফীতির সৃষ্টি করে যা জলোচ্ছ্বাস হিসেবে পরিচিত। জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড়ের একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র যখন সমুদ্রতীর অতিক্রম করে, প্রায় কাছাকাছি সময়েই জলোচ্ছ্বাস তীরবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে এ যাবৎ সংঘটিত জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৩ মিটার। ঘূর্ণিঝড়কালীন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন ঘটে এ জলোচ্ছ্বাসের দ্বারা, যা অনেক সময় উপকূলীয় দ্বীপ এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাসমূহকে বিরানভূমিতে পরিণত করে। বাংলা ভাষায় জলোচ্ছ্বাস, বান, জোয়ারঘটিত জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ঘটিত জলোচ্ছ্বাস, ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস প্রায় সমার্থক হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে।
একটি ঘূর্ণিঝড়ের সর্বাপেক্ষা ধ্বংসাত্মক উপাদান হলো এর সঙ্গে সংঘটিত জলোচ্ছ্বাস। পাঁচ/ছয় মিটার উচ্চতার সবেগে ধেয়ে আসা প্রাচীরাকৃতির জলরাশি দ্বারা সৃষ্ট বিরাট বিপর্যয় প্রতিরোধে কার্যকরী কিছু করার থাকে না। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় সংঘটনের সময়কাল হলো এপ্রিল থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস। প্রতি বৎসর গড়ে পাঁচটি পর্যন্ত মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে এবং এর সঙ্গে সংঘটিত জলোচ্ছ্বাস কখনও কখনও দেশের ২০০ কিমি অভ্যন্তর পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড়জনিত জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে চন্দ্র সূর্যের একত্রিত আকর্ষণ যোগ হলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা আরও বেড়ে যায় এবং মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সৃষ্ট ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতার বিস্তার সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ের (১২-১৩ নভেম্বর) সঙ্গে ৬-১০ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ছিল; বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিমি। সমুদ্রে জোয়ারকালীন সময়ের এ ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে এ পযন্ত সংঘটিত সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাঁচ লক্ষ মানুষের জীবনাবসান ঘটে এ ঘূর্ণিঝড়ে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিমি। এ ঝড় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং খুলনা এলাকায় আঘাত হানে; ঝড়ের সঙ্গে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬.১-৭.৬ মিটার এবং এতে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়।
বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের সমুদ্রতীরের আকৃতি ফানেল বা চোঙ-এর মতো হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বারবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের শিকারে পরিণত হয় এ ভূখন্ড। উপসাগরীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির গতিপথের আওতায় আরও রয়েছে ভারতের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল, মায়ানমার এবং কখনও কখনও শ্রীলংকা। কিন্তু যখন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় আঘাত হানে তখন ঘূর্ণিঝড়গুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করে। এ অঞ্চলের নিচু সমতল ভূমি, ঘন জনবসতি এবং নিম্নমানের উপকরণে নির্মিত বাড়িঘরের জন্যই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ এবং উপকূলবর্তী দ্বীপ ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, মনপুরা, কুতুবদিয়া, মহেশখালি, নিঝুম দ্বীপ, উড়ির চর ও নতুন জেগে ওঠা অন্যান্য দ্বীপগুলি।
ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ঘণ্টায় ৫৪ কিমি-এর বেশি গতিবেগসম্পন্ন ১৭৪টি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে জানুয়ারিতে ১টি, ফেব্রুয়ারিতে ১টি, মার্চে ১টি, এপ্রিলে ৯টি, মে মাসে ৩২টি, জুনে ৬টি, জুলাই মাসে ৮টি, আগস্টে ৪টি, সেপ্টেম্বরে ১৪টি, অক্টোবরে ৩১টি, নভেম্বরে ৪৭টি এবং ডিসেম্বর মাসে ২০টি ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা ঘটে। এ তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলি প্রধানত প্রাক-বর্ষা মৌসুম (এপ্রিল-মে) এবং বর্ষা-উত্তর সময়ে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) বেশি ঘটেছে এবং এগুলিই ছিল সর্বাপেক্ষা ধ্বংসাত্মক। তবে ঘূর্ণিঝড়গুলির সবকটিই বাংলাদেশে আঘাত হানে নি।
প্রধান ঘূর্ণিঝড়, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কালপঞ্জি
১৫৮৪ বাকেরগঞ্জ এবং পটুয়াখালী জেলায় আঘাত হানে। বজ্রবিদ্যুৎসহ হারিকেনের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এ ঝড় পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী ছিল; কেবল উঁচু স্থানে স্থাপিত মন্দিরগুলি ছাড়া সমস্ত ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয় এবং বহু নৌযান ডুবে যায়। মানুষ ও গৃহপালিত জীব মিলিয়ে প্রায় ২০,০০,০০০ প্রাণহানি ঘটে।
১৫৮৫ মেঘনা মোহনায় আঘাত হানে। প্রচন্ড ঝড়ো প্লাবনের ফলে বাকেরগঞ্জের পূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়। প্রাণহানি এবং ফসলের ক্ষতি ছিল সামান্য।
১৭৯৭ (নভেম্বর) তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায়। সাধারণ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি জাহাজ নিমজ্জিত হয়।
১৮২২ (মে) বরিশাল, হাতিয়া দ্বীপ এবং নোয়াখালী জেলায় তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। সরকারি নথিপত্রাদি পানিতে ভেসে যায়, ৪০,০০০ মানুষের মৃত্যু এবং ১,০০,০০০ গবাদিপশুর জীবনহানি ঘটে।
১৮৩১ (অক্টোবর) জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনে বরিশাল অঞ্চল আক্রান্ত হয়। মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে (ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না)।
১৮৭২ (অক্টোবর) কক্সবাজারের উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও বহু মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৮৭৬ (৩১ অক্টোবর) মেঘনা মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী উপকুলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন সংঘটিত হয়। এ ঝড়ের সঙ্গে সংঘটিত ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২.২ মিটার (৪০ ফুট)। এ সময় বিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের জলস্রোত মেঘনার মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ মারা যায়। আরও অধিক মানুষ মারা যায় দুর্যোগ পরবর্তী মহামারী এবং দুর্ভিক্ষে।
১৮৯৭ (২৪ অক্টোবর) হারিকেনের তীব্রতাসহ প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস চট্টগ্রাম ও কুতুবদিয়া দ্বীপে আঘাত হানে। সমুদ্র তীরবর্তী মূলভূমির গ্রামসমূহ ভেসে যায়। দুর্যোগে প্রাথমিকভাবে মৃত্যু হয় ১৪,০০০ মানুষের এবং পরবর্তী সময়ে মহামারীর ( কলেরা) কারণে আরও ১৮,০০০ জনের মৃত্যু হয়।
১৮৯৮ (মে) ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন টেকনাফে আঘাত হানে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
১৯০৪ (নভেম্বর) সোনাদিয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু এবং বহু মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়।
১৯০৯ (১৬ অক্টোবর) খুলনা অঞ্চলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনে ৬৯৮ জন মানুষ ও ৭০,৬৫৪টি গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯১৩ (অক্টোবর) ঘূর্ণিঝড়ে মুক্তাগাছা উপজেলার (ময়মনসিংহ) ৫০০ মানুষের মৃত্যুসহ বহু গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়।
১৯১৭ (২৪ সেপ্টেম্বর) হারিকেনের তীব্রতাসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়ে খুলনায় ৪৩২ ব্যক্তি নিহত এবং ২৮,০২৯ গবাদিপশু মারা যায়।
১৯৪১ (মে) মেঘনা মোহনার পূর্ব অংশে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বহু মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৪২ (অক্টোবর) তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রচুর বন্যপ্রাণী মারা যায় এবং নৌযানের ক্ষয়ক্ষতি হয় (সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না)।
১৯৪৮ (১৭-১৯ মে) চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর মধ্যবর্তী এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১,২০০ মানুষ ও ২০,০০০ গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৫৮ (১৬-১৯) মেঘনা মোহনার পূর্ব ও পশ্চিমাংশ এবং বরিশালের পূর্বাঞ্চল ও নোয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৮৭০ জন মানুষ ও ১৪,৫০০ গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে এবং ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৫৮ (২১-২৪ অক্টোবর) চট্টগ্রামের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়, প্রায় এক লক্ষ পরিবার গৃহহীন হয় এবং সরকার গৃহনির্মাণ ঋণ বিতরণ করে।
১৯৬০ (৯-১০ অক্টোবর) মেঘনার মোহনার পূর্বাঞ্চলে (নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর এবং পটুয়াখালী) ঘণ্টায় ২০১ কিমি বেগে বায়ু প্রবাহিত হয় এবং সর্বোচ্চ ৩.০৫ মিটার জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয় চর জববার, চর আমিনা, চর ভাটা, রামগতি, হাতিয়া এবং নোয়াখালীতে। প্রায় ৩,০০০ মানুষের মৃত্যু, ৬২,৭২৫টি বাড়িঘর ধ্বংস এবং প্রায় ৯৪,০০০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ বিনষ্ট ও হাজার হাজার গবাদিপশু মারা যায়।
১৯৬০ (৩০-৩১ অক্টোবর) চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী এবং মেঘনা মোহনার পূর্বাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ৪.৬ মিটার থেকে ৬.১ মিটার জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে ৫,৬৮,১৬১টি বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, বিশেষত হাতিয়া দ্বীপের ৭০% ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। দুটি বৃহৎ সমুদ্রগামী জাহাজ তীরে আছড়ে পড়ে, কর্ণফুলি নদীতে ৫-৭টি জাহাজ নিমজ্জিত হয় এবং মোট প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
১৯৬১ (৯ মে) ঘণ্টায় ১৬১ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ২.৪৪-৩.০৫ মিটার জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বাগেরহাট ও খুলনা সদরের উপর দিয়ে বয়ে যায়। নোয়াখালী-হরিনারায়নপুরের রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং চর আলেকজান্ডারে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মোট ১১,৪৬৮ জনের মৃত্যু এবং প্রায় ২৫,০০০ গবাদিপশু ধ্বংস হয়।
১৯৬২ (২৬-৩০ অক্টোবর) ঘণ্টায় ১৬১ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ২.৫-৩.০ মিটার জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় ফেনীতে আঘাত হানে। প্রায় ১,০০০ জনের মৃত্যু এবং বহু গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৬৩ (২৮-২৯ মে) তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজারসহ উপকুলবর্তী দ্বীপ কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রামে ৪.৩-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। সর্বোচ্চ বায়ুপ্রবাহ ছিল ঘণ্টায় ২০৩ কিমি এবং কক্সবাজারে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬৪ কিমি। এ দুর্যোগে বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয়; কমপক্ষে ১১,৫২০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, ৩২,৬১৭ গবাদিপশু মারা যায়, বাড়িঘর ধ্বংস হয় ৩,৭৬,৩৩২টি, ৪,৭৮৭টি নৌযান নিমজ্জিত হয় এবং বহু ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৬৫ (১১-১২ মে) ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬২ কিমি বেগে ৩.৭ মিটার উঁচু ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে আঘাত হানে। জীবনহানি ছিল প্রায় ১৯,২৭৯, বরিশালেই মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬,৪৫৬।
১৯৬৫ (১৪-১৫ ডিসেম্বর) কক্সবাজার ও সংলগ্ন সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা, পটুয়াখালী ৪.৭-৬ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়। কক্সবাজারে সর্বোচ্চ বায়ুপ্রবাহ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিমি; কক্সবাজার, পটুয়াখালী এবং সোনাদিয়া, রাঙ্গাদিয়া ও হামিদিয়া দ্বীপের উপকূল এলাকায় ১০ নম্বর বিপদ সংকেত প্রদর্শন করা হয়। কক্সবাজারের ৪০,০০০ লবণ ক্ষেত্র প্লাবিত এবং মোট ৮৭৩ জন মানুষ নিহত হয়।
১৯৬৬ (১ অক্টোবর) সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় ঘণ্টায় ১৪৬ কিমি বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে এবং ৪.৭-৯.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এ দুর্যোগে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১৫,০০,০০০; নোয়াখালী ও বাকেরগঞ্জ এলাকায় মানুষ ও গবাদিপশুর মৃত্যু যথাক্রমে ৮৫০ এবং ৬৫,০০০।
১৯৬৯ (১৪ এপ্রিল) ঢাকা জেলার ডেমরায় টর্নেডো আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৪৩ কিমি; মৃতের সংখ্যা ৯২২ এবং ১৬,৫১১ জন আহত; উপদ্রুত অঞ্চলে আর্থিক ক্ষতি হয় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা।
১৯৭০ (১২-১৩ নভেম্বর) বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণ ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচন্ড বাতাস দু’দিন ধরে বারবার আঘাত হানে চট্টগ্রামে এবং সে সঙ্গে বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিন-এর উত্তরাঞ্চল, চর তজিমুদ্দিন, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণঘাটায়। স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা বেশি জীবন, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয় এ দুর্যোগে। সরকারি হিসাব মোতাবেক ৫,০০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এবং ৩৮,০০০ সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭৭,০০০ অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হিসাবে দেখা যায় যে ৪৬,০০০ জন অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করে। মোট ২০,০০০ এর অধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বিশাল; দশ লক্ষেরও অধিক গবাদিপশুর মৃত্যু হয়; ৪,০০,০০০ ঘরবাড়ি এবং ৩,৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭০ সালের এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২২ কিমি এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মিটার। সমুদ্রে ভরাজোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংঘটিত হওয়ায় এমন প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৭১ (৫-৬ নভেম্বর) চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে (ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায় নি)।
১৯৭১ (২৮-৩০ নভেম্বর) সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৭-১১৩ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও এক মিটারের কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। সমগ্র খুলনা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করে এবং খুলনা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
১৯৭৩ (৬-৯ ডিসেম্বর) সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। পটুয়াখালীর উপকুলবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়।
১৯৭৪ (১৩-১৫ আগস্ট) ঘণ্টায় ৮০.৫ কিমি বায়ুপ্রবাহসহ ঘূর্ণিঝড় খুলনার উপর দিয়ে বয়ে যায়। প্রায় ৬০০ মানুষের মৃত্যু ও প্রচুর গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৭৪ (২৪-২৮ নভেম্বর) কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কিমি বেগে বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও ২.৮-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। প্রায় ২০০ মানুষ ও ১,০০০ গবাদিপশু নিহত হয় এবং ২,৩০০ ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।
১৯৭৫ (৯-১২ মে) ভোলা, কক্সবাজার এবং খুলনায় ঘণ্টায় ৯৬.৫ থেকে ১১২.৬ কিমি বায়ুপ্রবাহসহ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। ৫ ব্যক্তির মৃত্যু এবং কিছুসংখ্যক মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয়।
১৯৭৭ (৯-১২ মে) খুলনা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে ঘণ্টায় ১১২.৬৩ কিমি বেগে ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়। মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি এবং বেশ কিছু নৌযান নিখোঁজ (ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় নি) হয়।
১৯৮৩ (১৪-১৫ অক্টোবর) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ১২২ কিমি বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ৪৩ ব্যক্তি নিহত, ৬টি মাছধরার ট্রলার ও ১টি যন্ত্রচালিত নৌকা নিমজ্জিত হয়। ১৫০ জন মৎস্যজীবী ও ১০০ মাছধরার নৌকা নিখোজ হয় এবং ২০% আমন ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৮৩ (৫-৯ নভেম্বর) ঘণ্টায় ১৩৬ কিমি বেগে বায়ুপ্রবাহ ও ১.৫২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়ার সন্নিকটস্থ কক্সবাজার উপকূল ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নিম্নাঞ্চল, টেকনাফ, উখিয়া, ময়িপং, সোনাদিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং নোয়াখালীর উপর দিয়ে বয়ে যায়। ৫০টি নৌকা সহ ৩০০ মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয় এবং ২,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
১৯৮৫ (২৪-২৫ মে) তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে (সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং উড়িরচর) আঘাত হানে। বাতাসের গতিবেগ ছিল চট্টগ্রামে ১৫৪ কিমি/ঘণ্টা, সন্দ্বীপে ১৪০ কিমি/ঘণ্টা, কক্সবাজারে ১০০ কিমি/ঘণ্টা এবং সেইসঙ্গে ৩.০-৪.৬ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এতে ১১,০৬৯ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৪,৩৭৯টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও মোট ১,৩৫,০৩৩ পশুসম্পদ বিনষ্ট হয়। মোট ৭৪ কিমি সড়ক ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৮৬ (৮-৯ নভেম্বর) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়। বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিমি এবং খুলনায় ৯০ কিমি। এতে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৭,২০০ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৮৮ (২৪-৩০ নভেম্বর) যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনা-বরিশালের চরাঞ্চলের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিমি বেগে বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় ৪.৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। এতে ৫,৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫,০০০ গবাদিপশু মারা যায়। বহুসংখ্যক বন্য পশু মারা যায় - তার মধ্যে হরিণ ১৫,০০০ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯; এবং ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় ৯৪১ কোটি টাকার।
১৯৯১ (২৯ এপ্রিল) এ ঝড়টিকে ‘১৯৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়’ নামে চিহ্নিত করা হয়। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাত্রে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়টির উৎপত্তি হয় প্রশান্ত মহাসাগরে, বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে ৬,০০০ কিমি দূরে। বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছাতে ঝড়টির সময় লেগেছিল ২০ দিন। আকারের দিক থেকে ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তার ছিল বাংলাদেশের আকৃতির চেয়েও বড়। কেন্দ্রীভূত মেঘপুঞ্জের ব্যাস ছিল ৬০০ কিমি। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল সন্দ্বীপে ঘণ্টায় ২২৫ কিমি। এ ছাড়া অন্যান্য ঝড় কবলিত অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ছিল নিম্নরূপ: চট্টগ্রামে ঘণ্টায় ১৬০ কিমি, খেপুপাড়া (কলাপাড়া) ১৮০ কিমি, কুতুবদিয়া ১৮০ কিমি, কক্সবাজার ১৮৫ কিমি এবং ভোলা ১৭৮ কিমি। নোয়া-১১ (NOAA-11) উপগ্রহের ২৯ এপ্রিল ১৩ঃ ৩৮ ঘণ্টায় তোলা দূর অনুধাবন চিত্র অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের প্রাক্কলিত সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ কিমি। স্পারসো (SPARRSO) সর্বপ্রথম ২৩ এপ্রিল তারিখে নোয়া-১১ এবং জিএমএস-৪ (GMS-4) উপগ্রহগুলি থেকে গৃহীত চিত্র বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়টিকে একটি নিম্নচাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিমি এর নিচে)। নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় ২৫ এপ্রিল। প্রাথমিক অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়টি কিছুটা উত্তরপশ্চিম দিকে পরে উত্তর দিকে সরে যায়। ২৮ এপ্রিল থেকে এটি উত্তরপূর্ব দিকে সরে আসা শুরু করে এবং ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের উত্তর দিয়ে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড়টি ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই উপকূলীয় দ্বীপ সমূহে (যেমন নিঝুম দ্বীপ, মনপুরা, ভোলা, সন্দ্বীপ) আঘাত হানতে শুরু করেছিল। ঘূর্ণিঝড়কালীন ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের প্রাক্কলিত উচ্চতা ছিল ৫ থেকে ৮ মিটার। এ দুর্যোগে জীবন ও সম্পদ ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। সম্পদের প্রাক্কলিত আর্থিক ক্ষতি ৬,০০০ কোটি টাকা। মোট ১,৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, গবাদিপশু মারা যায় ৭০,০০০।
১৯৯১ (৩১ মে থেকে ২ জুন) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং পটুয়াখালী, বরিশাল; নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ১১০ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ১.৯ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানিসহ বেশ কিছু নৌযান নিখোঁজ হয় এবং ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৯৪ (২৯ এপ্রিল ৩মে) উপকূলবর্তী দ্বীপ এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চল ঘণ্টায় ২১০ কিমি বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়। প্রায় ৪০০ মানুষের মৃত্যু এবং ৮,০০০ গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৯৫ (২১-২৫ নভেম্বর) উপকূলবর্তী দ্বীপ এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিমি বেগে বায়ুপ্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭,০০০ গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।
১৯৯৭ (১৬-১৯ মে) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ঘণ্টায় ২২৫ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ৩.০৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের (হারিকেন) শিকার হয়। সরকার ও জনসাধারণের যথাযথ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ মহাদুর্যোগে মাত্র ১২৬ জন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।
১৯৯৭ (২৫-২৭ সেপ্টেম্বর) হারিকেনের তীব্রতাসম্পন্ন প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও ১.৮৩ থেকে ৩.০৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং ভোলার চরাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায়।
১৯৯৮ (১৬-২০ মে) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘণ্টায় ১৫০ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ১.৮৩ থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়।
১৯৯৮ (১৯-২২ নভেম্বর) উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনা বরিশাল ও পটুয়াখালীর চরাঞ্চল ঘণ্টায় ৯০ কিমি বায়ুপ্রবাহ ও ১.২২ থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়।
২০০৭ (১৫-১৭ নভেম্বর) ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে যাতে প্রায় তিন সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটে।
২০০৮ (৩ মে) ঘুর্ণিঝড় ‘নার্গিস’ উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয়। যা মায়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে। এতে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
২০০৮ (২৭ অক্টোবর) ঘুর্ণিঝড় ‘রেশমী’ বাংলাদেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানে। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ৮০ কিমি এবং প্রচুর ঝড়বৃষ্টিতে জাহাজ ও মৎস্যশিল্পের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়।
২০০৯ (১৯-২১ এপ্রিল) ঘূর্ণিঝড় ‘বিজলি’ বাংলাদেশে মৃদুভাবে আঘাত হানে এবং এই ঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলে কিছু কাঁচা ঘরবাড়ি ও ফসলী জমি ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তেমন বৃহত্তর কোন ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
২০০৯ (২৭-২৯ মে) ঘুর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলে ১৫টি উপকূলীয় জেলায় আঘাত হানে যাতে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রানহানি ঘটে, দুই লক্ষাধিক ঘরবাড়ি এবং তিন লক্ষাধিক একর আবাদি জমি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণে আবহাওয়া উপগ্রহ বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো রকেট অথবা উপগ্রহ সুবিধা নেই, তবে উন্নত দেশের উৎক্ষিপ্ত উপগ্রহ থেকে আবহাওয়ার চিত্র গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আবহাওয়া উপগ্রহসমূহ থেকে চিত্র গ্রহণের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় চিত্র প্রেরণ ভূকেন্দ্র (ATP or Automatic Picture Transmission Ground Station) প্রতিষ্ঠিত হয়। নাসা (NASA)-র তত্ত্বাবধানে ইউএসএইডের (USAID) আর্থিক সহযোগিতায় সম্প্রতি এ কেন্দ্রে উপগ্রহ থেকে চিত্র গ্রহণ ও বিশ্লেষণে উন্নত প্রযুক্তির সাজসরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল উন্নত সরঞ্জামের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া-১৪, নোয়া-১৫ এবং জাপানি জিএমএস-৫ উপগ্রহসমূহ থেকে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে। জিএমএস উপগ্রহগুলি প্রতি ঘণ্টায় তথ্য প্রেরণ করে। নোয়া উপগ্রহগুলির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে প্রতি ছয় ঘণ্টা পর পর। বর্তমান আধুনিক সরঞ্জামের সাহায্যে আবহাওয়া চিত্রে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ ও বাংলাদেশের সীমারেখা চিহ্নিত করা যায়। চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। এ উন্নত ব্যবস্থার কারণে বঙ্গোপসাগারের কোনো ঘূর্ণিঝড়ই এখন আর দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা একটি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসাত্মক শক্তি হাজার হাজার মেগাটন আনবিক বোমার শক্তির সঙ্গে তুলনীয়। স্বভাবতই এ প্রচন্ড শক্তিকে হ্রাস বা পরিমিতকরণ বর্তমান প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার যুগেও অনেকাংশেই দুঃসাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক মহাসাগরে সিলভার আয়োডাইড ছড়িয়ে বাতাসের উচ্চ মাত্রার গতিকে প্রশমিত করার পরীক্ষা চালিয়েছে। যদিও এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা খুবই আশাব্যঞ্জক কিন্তু এখনও তা নিষ্পত্তিহীন একটি পর্যায়ে রয়েছে। অধিকন্তু এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের দিক পরিবর্তন এবং অন্য দেশের দিকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির সৃষ্টি প্রতিহত করা বা তীব্রতাকে হ্রাস করার ক্ষেত্রে অন্যান্য যে পদ্ধতিগুলির কথা বলা হচ্ছে তা হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের সম্ভাব্য এলাকায় তেল ছড়িয়ে দিয়ে পানির উপর বিস্তৃত একটি পাতলা স্তর সৃষ্টি করা অথবা রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে বাষ্পীভবনের হার কমিয়ে ফেলা। তবে এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা পরিচালনা বা বাস্তবায়নের পূর্বে ভয়াবহ সমুদ্র দূষণের বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করা প্রয়োজন।
নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঘূর্ণিঝড়ও একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। বাংলাদেশকে এ দুর্যোগের পুনঃপুন সংঘটনের জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হবে। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা এবং কার্যকর নিরাপত্তা ও ত্রাণ কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞকে অনেকাংশেই প্রতিহত করা সম্ভব। ঘূর্ণিঝড়ের প্রচন্ডতাকে আংশিক প্রশমণের এটাই একমাত্র পথ।
বর্তমানে বাংলাদেশের রয়েছে একটি ব্যাপক ঘূর্ণিঝড় প্রস্ত্ততিমূলক কর্মসূচি (সিপিপি)। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে কর্মসূচিটি পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের ১৯৫টি ইউনিয়নের ২,০৪৩টি ওয়ার্ডে নিয়োজিত ৩২,০০০ স্বেচ্ছাসেবী সদস্য এ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় তার করণীয় সম্পর্কে সজাগ এবং প্রস্ত্তত। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি বেতারযন্ত্র, একটি মেগাফোনসহ সাইরেন, একটি সংকেত টর্চলাইট এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি উপজেলায় ওয়ারলেস সেট দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখা হয়।
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানসহ সমগ্র সরকারি প্রশাসন যৌথভাবে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কার্যকর করে। ঘূর্ণিঝড় বা এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন ও অংশগ্রহণের জন্য সরকারের স্থায়ী আদেশ রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ এবং প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে লক্ষণীয় উন্নতি করেছে। ১৯৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময় গৃহীত সতর্কীকরণ এবং প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থার বিস্তৃত কার্যক্রম বর্তমানের এ উন্নতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় এ পর্যন্ত ২,৫০০ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ণের জন্য উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। উন্নত ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা এবং আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বে জনগণকে এর মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্ত্ততি দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। [মাসুদ হাসান চৌধুরী]
আরও দেখুন জলোচ্ছ্বাস; প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
গ্রন্থপঞ্জি AM Chowdhury, ‘Rose Petals for Tropical Cyclones’, Nuclear Science and Applications (118), 1978; AM Chowdhury et al, ‘Sterering Wind Effects on Cyclone Tracks in the Bay of Bengal’, The Dhaka University Journal of Science 43 (1), January 1995; BBS, 1998 Statistical Yearbook of Bangladesh (19th edition), Bangladesh Bureau of Statistics, Government of the People’s Republic of Bangladesh, 1999; K Nizamuddin (ed), Disaster in Bangladesh: Selected Readings, Disaster Research Training and Management Centre, University of Dhaka, 2001.