পাট

পাট (Jute) Tiliaceae বর্গের Corchorus গণভুক্ত দ্বিবীজপত্রী অাঁশযুক্ত উদ্ভিদ। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাট অাঁশ প্রধানত দুটি প্রজাতি, সাদাপাট (Corchorus capsularis) ও তোষাপাট (Corchorus olitorius) থেকে উৎপন্ন হয়। সাদা ও তোষা পাটের উৎপত্তিস্থল যথাক্রমে দক্ষিণ চীনসহ ইন্দো-বার্মা এবং ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকা। সম্ভবত উড়িয়া শব্দ jhuta বা jota থেকে jute শব্দটির উদ্ভব। অবশ্য, ‘জুটা’ ও ‘পট্ট’ বস্ত্র ব্যবহারের কথা যথাক্রমে বাইবেল এবং মনুসংহিতা ও মহাভারতে উল্লেখ আছে যা এতদঞ্চলে পাটদ্রব্যের সুপ্রাচীন ব্যবহারের সাক্ষ্যবহ।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, ব্রাজিল এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশে পাটের আবাদ হয়। বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ এক সময়ে একচেটিয়া সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে এদেশ থেকে প্রায় ৮০% পাট রপ্তানি হতো। কিন্তু ১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং বর্তমানে বিশ্ব চাহিদার শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ পাট বাংলাদেশ থেকে বাইরে যায়। এ অবনতির বড় কারণ পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সেসঙ্গে বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব।

পাট গাছ

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে পাটের চাষ হয়ে আসছে। এক সময়ে এটি বাগানের উদ্ভিদ হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন এর ব্যবহার ছিল সীমিত; কেবল পাতা সবজি ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহূত হতো। উষ্ণমন্ডল ও উপ-উষ্ণমন্ডলীয় বিভিন্ন জলবায়ুর পরিবেশে পাট জন্মে। মার্চ, এপ্রিল ও মে পর্যন্ত প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ২৫০ মিমি বৃষ্টিপাতসহ যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০০ মিমি বা ততোধিক সেখানে পাট ভাল ফলন দেয়। প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার সীমারেখা ১৮°-৩৩° সে। পাট বর্ষাকালীন ফসল। বাংলাদেশে সাধারণত বীজবপন শুরু হয় ফেব্রুয়ারির শেষে এবং প্রজাতিভেদে মে মাসের শেষ পর্যন্ত চলে। পাটচাষ প্রাক-বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সাদাপাট অধিকতর পানিসহিষ্ণু বিধায় সাধারণত নিচুজমি, এমনকি জলাবদ্ধ জমিতেও চাষ করা যায়। অন্যদিকে জলবদ্ধতা তোষাপাটের জন্য ক্ষতিকর, তাই মাঝারি থেকে নিম্ন-মাঝারি জমিতে চাষ করা হয়।কয়েক ধরনের জমিতে, কর্দম থেকে বেলে-দোঅাঁশ পর্যন্ত ভাল উর্বরতাসহ ৫.০-৮.৬ পর্যন্ত অম্লমানের (pH) মাটিতে পাট ফলানো যায়।

পাট চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু বাংলাদেশের গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যমান থাকায় উক্ত সময়েই এর আবাদ হয়। উচ্চ তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, পরিচ্ছন্ন আকাশ পাটের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক। দেশি পাটের চেয়ে তোষাপাট কিছুটা পরে বুনতে হয়। তবে জমিতে জুন-জুলাই মাসে পানি জমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে জমিতে পাট কিছুটা আগাম বপন করা উচিত। স্বপরাগায়িত এবং ১৪ জোড়া ক্রোমোজোমবহ এই ফসলের বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘ আলোক-দিবসের প্রয়োজন। বীজবপনের পর অাঁশের জন্য ফসল তুলতে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। ফুল আসার সময়ই পাট কাটতে হয়। অাঁশ পাওয়া যায় কান্ডের বাস্ট বা ফ্লোয়েম স্তর থেকে। পাটচাষ শ্রমঘন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষীরা প্রান্তিক, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র খামারি। সফল চাষাবাদের জন্য জমিপ্রস্ত্তত খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ৩-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি মসৃণ করা এবং জমিতে ২০ শতাংশের বেশি জীববস্ত্ত থাকা আবশ্যক। মাটির ধরন অনুযায়ী সাধারণত NPK অর্থাৎ নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাশিয়ামের যথানুপাতে গোবরও ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে কৃষকরা পাটচাষে সচরাচর কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করে না।

নিচুজমিতে পাট কাটা

অবশ্য, ব্যবহূত হলে তিন পর্যায়ে করা হয়: জমি প্রস্ত্ততের সময় একবার এবং যথাসময়ে টপড্রেসিং হিসেবে দু’বার। পরিচর্যার সময় অতিরিক্ত পাটগাছ তুলে ফেলা ছাড়াও আগাছা পরিষ্কার আবশ্যক। ছিটিয়ে বপনে সাধারণত প্রতি হেক্টরে লাগে ১০-১২ কেজি বীজ। সারিতে বপনে বীজ লাগে কিছুটা কম। কৃষকেরা বীজের জন্য বীজ পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত (অক্টোবর-নভেম্বর) ফসলের কিছুটা রেখে দেয়। পাট কাটার পর নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ দিয়ে অাঁটি বেঁধে পাতা ঝরানোর জন্য তারা সেগুলিকে ৫-৭ দিন জমিতে দাঁড় করিয়ে রাখে। তারপর অাঁটিগুলি পানিতে ডুবানো হয়। স্বচ্ছ ও মন্দবহ পানি পাট জাগ দেওয়ার জন্য সর্বোত্তম। বারো থেকে ১৫ দিন পর জাগ সম্পন্ন হলে হাত দিয়ে কাঠি থেকে অাঁশ পৃথক করে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর কৃষকরা স্থানীয় বাজারে পাট বিক্রি করে।

বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতে পাট উৎপন্ন হলেও ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরই প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। পাটচাষাধীন মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২,২৬,৬৫৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৪০,৩৪,৫৮৯ বেল। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২৭টি উচ্চফলনশীল ও উন্নত মানের পাটের জাত (cultivar) উদ্ভাবন করেছে।

পাটের তৈরি সামগ্রী

পাটজাত সামগ্রী  পাট ও পাটজাত সামগ্রী বহুল ব্যবহূত। প্রাচীনকাল থেকে প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহূত হয়ে আসছে। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার আগে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রশি, হাতে তৈরি কাপড়, শিকা ও গৃহসজ্জার সামগ্রীসহ গৃহস্থালি ও খামারে উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হতো। মধ্যযুগে বাংলায় পাটজাত দ্রব্যের মধ্যে গানিবস্তা ও পাটশাড়ির বহুল ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। আঠারো শতক থেকে বিদেশে গানিব্যাগ রপ্তানি হয়েছে। পাটের পাতা ও মূল স্থানীয় লোকেরা ভেষজ ও সবজি হিসেবে ব্যবহার করে। শণের বিকল্প হিসেবে পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার আরম্ভ হয় পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত ডান্ডিতে। পাটজাত দ্রব্যের প্রথাগত ব্যবহার প্রধানত পাকানো সুতা, শক্ত কাপড়, চটের ব্যাগ, টুইল কাপড়, কার্পেট ব্যাকিং, উল-প্যাক, মাদুর, মোটা কাপড়, দেয়াল-আচ্ছাদন, গালিচা ও বিভিন্ন ধরনের গৃহসজ্জার বস্ত্র প্রভৃতিতে সীমাবদ্ধ।

পাট গবেষণা  পাটের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯০০ সালে ভারত সরকার তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার জন্য একজন পাট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন। এ গবেষক এবং তাঁর সহকর্মীরা পরবর্তীতে কয়েকটি উন্নতজাতের পাট উদ্ভাবন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাকিয়া বোম্বাই (Kakya Bombai), ডি১৫৪ এবং Chinsurah Green। ১৯৩৮ সালে ঢাকায় সর্বপ্রথম একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ পাট গবেষণাগার (Indian Jute Research Institute) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রায় একই সময়ে কলকাতার টালিগঞ্জে একটি প্রযুক্তি গবেষণাগারও স্থাপিত হয়। ১৯৫১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি (Central Jute Committee) গঠিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে তেজগাঁও-এ একটি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকার শেরে-বাংলা নগরে মানিক মিঞা এভিনিউ-এ অবস্থিত এই গবেষণাগার বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

পাট চাষ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাদেশিক সরকার ১৯৪০ সালে Jute Regulation Directorate স্থাপন করে। এ অধিদপ্তর পাটচাষ, উৎপাদন এবং চাষ এলাকা নির্ধারণসহ পাটচাষের জন্য চাষী নির্দিষ্ট করার দায়িত্বও পালন করত। ১৯৪৯ সালে পাট ব্যবসায় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকির জন্য পাকিস্তান সরকার জুট বোর্ড গঠন করে।

এ ব্যাপারে Jute Trading Corporation, Jute Price Stabilization Corporation এবং Jute Marketing Corporation প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র পাট বিভাগ (Jute Division) গঠিত হয়; পরে ১৯৭৬ সালে এ বিভাগ পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের রূপ নেয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পাট সংস্থার (International Jute Organization) প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। সংস্থাটির বর্তমান নাম (International Jute Study Group)।  [এ.বি.এম আব্দুলাহ এবং মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]

পাটের রোগ  পাট গাছের দুটি প্রজাতিই বেশ কিছু রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এসব রোগের মধ্যে Macrophomina phasiolina ছত্রাক সৃষ্ট কান্ডপচা রোগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্কুরোদ্গম পর্যায় থেকে শুরু করে বৃদ্ধির শেষ পর্যায় পর্যন্ত পাট গাছের সকল পর্যায়েই এই রোগ উৎপাদক সংক্রমণ এবং প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পারে। অঙ্কুরোদ্গমের পরপরই বীজপত্র সংক্রমণের কালচে রঙের দাগ দেখা যেতে পারে। ভেজা মাটিতে পাট চারা হেলে পড়া বা ড্যাম্পিং অফ ও চারা ধ্বসা রোগ দেখা দেয়। চারার পরবর্তী বৃদ্ধি পর্যায়ে পাতাও আক্রান্ত হতে পারে এবং পাট গাছের পত্রফলক বা মধ্যশিরায় বাদামি থেকে কালো ক্ষত সৃষ্টি করে, যা পাতার বোটা এমনকি কান্ডের পর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এই ক্ষত কান্ডের এক বা একাধিক পর্বে গাঢ় বাদামি থেকে কালো পচন সৃষ্টি করে। এই ক্ষত কখনও কখনও কান্ডকে প্রায় বেষ্টন করে ফেলে এবং অনুভূমিকভাবে ও নিচের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগ আরও বৃদ্ধি পেলে গাছের পাতা ঝরে পড়তে পারে। মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে এই রোগজীবাণু গাছের ক্যাপস্যুল ও বীজের ভিতরেও প্রবেশ করতে পারে।

এই ছত্রাক প্রাথমিকভাবে বীজবাহিত এবং ফসলের অবশিষ্টাংশে ও মাটিতে স্কেলরোসিয়াম গঠন করে শীতকালীন সময় অতিবাহিত করে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই ছত্রাকের বিভিন্ন উপজাত দেখা গিয়েছে। তুলা, তিল, শিম ও বেগুন এই রোগজীবাণুর বিকল্প পোষক হিসেবে পরিচিত।

ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস ও জমি জীবাণুমুক্তকরণের মাধ্যমে পরবর্তী বছরগুলিতে এর সংক্রমণ কমানো যায়। বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স, হোমাই, কিউপ্রাভিট নামক ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজশোধন অনেক ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়।

Botryodiplodia theobromae  নামক ছত্রাকের সংক্রমণে পাটের কালো পট্ট রোগ হয়। বয়স্ক পাট গাছে এ রোগ ক্ষত সৃষ্টি করে, যা গোড়া থেকে প্রায় ০.৫-০.৮ মি উঁচু অংশের কান্ড বেষ্টন করে রাখে। রোগাক্রান্ত গাছের পাতা সাধারণত অসময়েই ঝরে পড়ে। আক্রান্ত প্রধান কান্ডের বাকল থেকে লম্বালম্বিভাবে বাদামি অাঁশগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছোবড়ার আকারে বের হতে দেখা যায়। আক্রান্ত পাট গাছ শুকনো কাঠির মতো দেখায়। মৃত কান্ডের উপরিভাগে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পিকনিডিয়া লক্ষ্য করা যায়। অতিমাত্রার আর্দ্রতা ও অধিক তাপমাত্রায় এই রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে।

Colletotrichum corchorum নামক ছত্রাকের সংক্রমণে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ হয় এবং এই রোগ কেবল সাটা পাটের ভ্যারাইটিসমূহে হয়ে থাকে। কান্ডে হলুদাভ-বাদামি, পানিভেজা অবনমিত দাগ সৃষ্টির মাধ্যমে এই রোগের প্রকাশ ঘটে। এসব দাগ দৈর্ঘ্যে প্রায় এক সেন্টিমিটার ও প্রস্থে কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। এই দাগগুলির রঙ গাঢ় বাদামি এবং শেষ পর্যন্ত কালো রঙ ধারণ করে। কিছু দাগ একীভূত হয়ে কান্ড বেষ্টন করে বড় আকারের আস্তর বা তালি দেওয়ার মতো গঠন সৃষ্টি করে। সংক্রমণের ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে গাছ নেতিয়ে পড়তে পারে বা খুব দুর্বলভাবে বেঁচে থাকতে পারে। এই জীবাণু পডও সংক্রমণ করতে পারে।

তোষা পাটের বিভিন্ন ভ্যারাইটিতে অ্যানথ্রাকনোজ রোগের অনাক্রম্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এজন্য olitorius জাতের সঙ্গে ফসল আবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়। অন্যান্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পাট গাছের কান্ড পচা রোগ দমনের সুপারিশকৃত পদ্ধতির অনুরূপ।

বাংলাদেশে সাধারণত পাট উৎপাদী এলাকায় Sclerotium rolfsii নামক ছত্রাক সৃষ্ট নরম পচা রোগ হতে দেখা যায়। এদেশে চাষকৃত সবগুলি জাতের পাটফসল এই রোগের প্রতি সংবেদনশীল। এ রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাট গাছের গোড়ায় পচন লক্ষ্য করা যায়। রোগের লক্ষণ হিসেবে মৃত্তিকার আর্দ্র অবস্থায় এই ছত্রাকের মাইসেলিয়ামগুলি তুলার মতো গঠনে দৃষ্টিগোচর হয় এবং একই সঙ্গে গাছের গোড়া অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহুসংখ্যক বাদামি রঙের স্কেলরোসিয়াম দেখা যায়। পাতা সাধারণত নুয়ে পড়ে। আক্রান্ত গাছগুলি ক্ষতস্থানে ভেঙে যেতে পারে। পাট গাছের গোড়ায় কিউপ্রাভিট অথবা ভিটাভেক নামক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে এ রোগের প্রকোপ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়। Oidium প্রজাতির ছত্রাকসৃষ্ট পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হলে পাট গাছের পত্রফলকের উপরে সাদাটে থেকে ছাই রঙের পাউডারি লক্ষণ দেখা দেয়। আক্রান্ত পাতাগুলি শীঘ্রই বাদামি রঙে রূপান্তরিত হয় ও বিবর্ণ হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অাঁশগুলি নিম্নমানের হয়।

পাটগাছে Meloidogyne incognitaM. javanica প্রজাতির নিমাটোড শিকড়ে গিঁট রোগ সৃষ্টি করে। দুই প্রজাতির পাট গাছই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত C. capsularis প্রজাতির পাট গাছে ভাইরাস কর্তৃক মোজাইক রোগ হয়। এ রোগ হলে পাটপাতায় ছড়ানো ছিটানোভাবে হলদেটে ও সবুজাভ আস্তরের মতো গঠন দেখা যায়। এছাড়া এতে আক্রান্ত পাতাগুলি কুঁকড়ে যায়। Phyllosticta প্রজাতির ছত্রাকের সাহায্যে পাট পাতায় দাগ রোগ হয়ে থাকে। এটি পাট ফসলের একটি অপ্রধান রোগ।  [আবুল খায়ের]

ক্ষতিকর পোকামাকড়  ফসল বৃদ্ধির প্রায় সব পর্যায়েই পাট গাছ এক ডজনের বেশি কীটপতঙ্গ ও ক্ষুদ্র মাইট (mite) দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের আক্রমণে ফসলের উৎপাদন এবং গুণগত মান উভয়ই হ্রাস পায়। এক হিসাবে দেখা গেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল কীটপতঙ্গের আক্রমণেই ফসলের শতকরা ১২ ভাগ অথবা তার বেশি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। তবে এদের ক্ষতির মাত্রা এলাকাভেদে কম-বেশি হয় এবং বিভিন্ন বছরেও এদের ক্ষতির পরিমাণে পার্থক্য হয়। অনিষ্টকারী পোকা-পাকড়ের আক্রমণ বহুলাংশে নির্ভর করে বিদ্যমান আবহাওয়া, পাটের জাত, চাষ পদ্ধতি এবং পরজীবী ও পরভুক প্রাণীর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ওপর। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাট গাছের যেসব ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ শনাক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি মুখ্য (major) এবং অন্যগুলি গৌণ (minor) আপদ হিসেবে চিহ্নিত। তবে আবহাওয়া ও অন্যান্য পরিবেশগত কারণ অনুকূল হলে একটি গৌণ ক্ষতিকর প্রাণী মুখ্য পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। নিম্নের সারণিতে এ দেশের পাট গাছের অনিষ্টকারী যেসব কীটপতঙ্গ ও পোকা-মাকড় সচরাচর দেখা যায় তার একটি তালিকা, ক্ষতির ধরন ও আনুষঙ্গিক তথ্য উল্লেখ করা হলো।

নাম ইংরেজি নাম বৈজ্ঞানিক নাম বর্গ অবস্থান ক্ষতির ধরন
পাটের বিছা পোকা Jute hairy caterpillar Spilosoma obliqua Lepidoptera মুখ্য পাতা খায়
পাটের ঘোড়া পোকা Jute semilooper Anomis sabulifera Lepidoptera মুখ্য পাতা খায়
পাটের এপিওন/কান্ডের উইভিল Jute stem weevil Apion corchori Coleoptera মুখ্য কান্ড ছিদ্র করে গিঁট সৃষ্টি করে
উড়চুঙ্গা/ঘুগড়া পোকা Field cricket Brachytrypes portentosus Orthoptera মুখ্য গাছের গোড়া কেটে দেয়
হলুদ মাইট Yellow mite Polyphagotarsonemus latus Acarina মুখ্য পাতার রস চুষে খায়
কাতরী পোকা Indigo caterpillar Spodoptera exigua Lepidoptera গৌণ  পাতা খায়
কালো বিছা পোকা Black hairy caterpillar Pericallia ricini Lepidoptera গৌণ পাতা খায়
কাটুই পোকা Jute cut worm Spodoptera litura Lepidoptera গৌণ  পাতা খায়
শুঁটির মাজরা পোকা Pod borer Earias cuprioviridis Lepidoptera গৌণ  পাতা খায়
ছরি পোকা Stick insect Scopula emmisaria Lepidoptera গৌণ  পাতা খায়
লাল মাইট Red mite Tetranychus bioculatus Acarina গৌণ পাতার রস চুষে খায়
পাটের ছাতরা পোকা Mealy bug Ferisia pseudococcus Homoptera গৌণ  পাতার রস চুষে খায়
পাটের জাবপোকা Jute aphid Apis gossypii Homoptera গৌণ  পাতার রস চুষে খায়
পাট পাতার মাইনার Leaf miner Trachys pacifica Coleoptera গৌণ  পাতার উপর গর্ত করে
উইপোকা Termite Microtermes obesi, Odontotermes obesus Isoptera গৌণ    গুদামে অাঁশের ক্ষতি করে
--- Stem girdler Nupsera bicolor Coleoptera গৌণ  কান্ড ক্ষতি করে
পাতার পোকা Leaf beetle Luperomorpha vittata Coleoptera গৌণ          কচি পাতা খায়
শোষক পোকা Hooded hopper Otinotus elongatus Homoptera গৌণ  কান্ডের রস চুষে খায়

অনিষ্টকারী পোকা-মাকড়ের মধ্যে পাটের বিছা পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এ পোকা দেশের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং দেশি ও তোষা উভয় ধরনের পাটকেই আক্রমণ করে। এর লার্ভা দশা, বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের লার্ভা অত্যধিক পরিমাণে পাট পাতা খেয়ে গাছকে প্রায় পাতাহীন অবস্থায় পরিণত করে। সাদা বা দেশি পাট এদের আক্রমণের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। পাটের ঘোড়া পোকা আরেকটি মারাত্মক ক্ষতিকর পতঙ্গ। এ পোকা বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে, বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া এবং রাজশাহী জেলায় পাটের ব্যাপক ক্ষতি করে। এর ক্ষতির ধরন পাটের বিছা পোকার অনুরূপ। উভয় জাতের পাট গাছকে আক্রমণ করলেও আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, তোষাপাট এ পোকার আক্রমণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘোড়া পোকার লার্ভা সাধারণত গাছের ডগা এবং উপর দিকের কচি পাতা খেয়ে নষ্ট করে। ফলে আক্রান্ত গাছে শাখা বের হয় এবং বৃদ্ধিও যথেষ্ট কমে যায়। পাটের অন্য আরেকটি ক্ষতিকর পোকা পাটের এপিওন (jute apion)। এটি কান্ডের উইভিল (stem weevil) নামে পরিচিত। ক্ষুদ্র এ উইভিল দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩ মিমি, তাই অনেক সময়ে এদের চোখে পড়ে না। এ পোকার প্রাদুর্ভাব মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা এবং টাঙ্গাইল এলাকায় বেশি। ক্ষেতে পাট গাছ যখন মাত্র ১৫-২০ সেমি লম্বা হয়, সাধারণত তখনই এদের আক্রমণ শুরু হয়। পরিণত পোকা কচি পাতায় সূক্ষ্ম ছিদ্র তৈরি করে। স্ত্রী পোকা সাধারণত ডগায় এবং কচি কান্ডের ভিতর ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বেরিয়ে লার্ভা কান্ডের উপরের অংশ খেয়ে নষ্ট করে। এতে কান্ডে এবং শেষ পর্যায়ে পাটের অাঁশে গিঁট সৃষ্টি হয়।

দেশের যেসব এলাকায় পাটের আবাদ হয় তার প্রায় সর্বত্রই হলুদ ও লাল উভয় ধরনের মাইটের উপস্থিতি সর্বজনীন। এদের ক্ষতির লক্ষণও বেশ বৈশিষ্ট্যময়। এ পোকা পাতার অঙ্কীয়ভাগ থেকে রস চুষে খায়। ফলে পাতা ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যায়। অতিমাত্রায় আক্রান্ত হলে পাতা শুকিয়ে যায় এবং পাট গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পাটের ঘুগড়া পোকা সাধারণত পাট গাছের নিচের অংশ আক্রমণ করে বাড়ন্ত চারার গোড়া কেটে দেয়। পাটের কাতরী পোকা বস্ত্তত কচি পাট গাছের এক বড় শত্রু। খরা অবস্থায় অনেক সময়ে এদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। কালো বিছা পোকা সাধারণ বিছা পোকার মতো পাতা খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। উভয় প্রজাতির স্বভাব এবং ক্ষতির ধরন প্রায় একই রকম হলেও উভয়কে একত্রে একই পাট ক্ষেতে সাধারণত দেখা যায় না।

পাটের বিছা পোকা এবং ঘোড়া পোকার ক্ষয়ক্ষতি থেকে ফসল রক্ষার সহজতম উপায় ক্ষেত থেকে এদের ডিমের গুচ্ছ এবং লার্ভা সংগ্রহ করে তা ধ্বংস করে দেওয়া। অনেক কৃষক অবশ্য পাটের অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুপারিশকৃত সহজলভ্য কীটনাশক প্রয়োগ করা উত্তম বলে মনে করেন।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

আরও দেখুন তন্তু-ফসল; পাট কার্পেট; পাট প্রতিবেদন, ১৮৭৭; পাট শিল্প; বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট