ফসল

ফসল (Crop)  মানুষের ব্যবহার্য যেকোন উদ্ভিজ্জ যা ফলানো বা সংগৃহীত হয়। গোটা পৃথিবীতে চাষকৃত ৮০টির বেশি ফসল মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, ঔষধ, পানীয়, রাবার, রঞ্জক ও অন্যান্য সামগ্রী যোগায়। রপ্তানির জন্য উৎপন্ন ফসলকে সাধারণত অর্থকরী ফসল বলা হয়। সামগ্রিকভাবে ফসল চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত: খাদ্যফসল, পশুখাদ্য, অাঁশ ফসল ও বিবিধ।

খাদ্যফসল পৃথিবীর মানুষের খাদ্যের প্রধান যোগানদার। এগুলির মধ্যে আছে দানাশস্য, কচু, আলু, ডাল, শাকসবজি, তৈলবীজ, ফল, চীনাবাদাম, আখ ও মসলা। দানাশস্যই পুষ্টির চাহিদার সিংহভাগ মেটায়। বাংলাদেশের প্রধান দানাশস্য হলো ধান ও গম এবং অপ্রধান শস্যের মধ্যে আছে যব, জোয়ার, ভুট্টা, বজরা, চীনা ও কাউন। তৈলবীজের মধ্যে তিল এবং সরিষাই প্রধান।

গবাদি পশুর জন্য উৎপন্ন পশুখাদ্যের প্রধান অংশভাগ ঘাসের, যদিও বাংলাদেশে ঘাস চাষ ততটা ব্যাপক নয়। অনেক জেলায় ভাদই ও রবি ফসল হিসেবে ঘাসের চাষ হয়ে থাকে। তুঁতগাছের চাষ মূলত রাজশাহী ও নবাবগঞ্জ জেলাতেই সীমিত।

অাঁশ ফসলে আছে পাট, তুলা, শণ ও কেনাফ। এর মধ্যে পাটই প্রধান, বাংলাদেশে এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৪০,৩৪,৫৮৯ বেল।

অন্যান্য ফসলের মধ্যে রয়েছে চা, তামাক, রাবার, ফুল এবং ভেষজ ও রঞ্জক উৎপাদক গাছগাছড়া। দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল চায়ের উৎপাদন সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলেই সীমিত।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

আরও দেখুন [[[আখ|আখ]]; আলু; গম; চা; ডাল; তুলা; ধান; পাট; ভুট্টা; মরিচ

প্রধান ফসলসমূহ (major crops)  একটি দেশের মোট শস্যচাষ এলাকার শতকরা এক ভাগ বা ততোধিক এলাকায় জন্মানো ফসল। বাংলাদেশে কেবল নয়টি শস্য ধান (৭৩.৯৪%), গম (৪.৪৫%), পাট (৩.৯১%), সরিষা (৩.০৮%), মসুরি (১.৫৪%), খেসারি (১.২৫%), আলু (১.১৩%), আখ (১.১২%) ও মরিচ (১.০৫%) শস্যচাষ এলাকার ১% (১৪৬.১ লক্ষ হেক্টর) বা ততোধিক এলাকায় জন্মায় বিধায় এগুলি প্রধান ফসল হিসেবে বিবেচ্য।

বাংলাদেশে ধান চাষেরই প্রাধান্য। ফসল তোলার মরসুম অনুযায়ী ধানকে প্রধান তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন আমন (বোনা ও রোপা জাতগুলি), বোরো, ও আউশ যথাক্রমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি, মার্চ-মে ও জুলাই-আগস্ট মৌসুমে ফলে। আবার, এসব জাতের মধ্যে রোপা আমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মোট জমির ৪৬.৩০% জুড়ে চাষ হয়। অবশিষ্ট ২৬.৮৫%, ১৭.৫৯% ও ৯.২৬% জমিতে যথাক্রমে বোরো, আউশ ও বোনা আমনের চাষ হয়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র রোপা আমনের চাষ হয়। বোনা আমনের সিংহভাগ ফলে দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিচু জমিতে। প্রতি জেলায়, বিশেষত সেচাঞ্চলে কিছু পরিমাণ বোরো চাষ হয়, অন্যদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে আউশ চাষ।

বাংলাদেশের ধানের পর অতি গুরুত্বপূর্ণ শস্য গম প্রধানত উত্তরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শুষ্ক এলাকায় কেবল রবি ফসল হিসেবেই ফলে। রপ্তানিকৃত ফসলের মধ্যে পাট শীর্ষে এবং চাষকৃত জমির পরিমাণের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মার প্লাবনভূমিতেই পাট চাষ সীমিত। চতুর্থ স্থানের অধিকারী সরিষা ফলে প্রধানত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনার প্লাবনভূমির নিচু এলাকায়।

মসুরি ও খেসারি এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ডাল বাংলাদেশে ফলে। মসুরি প্রধানত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে এবং খেসারি দ্বীপ ও চরাঞ্চলে (যে কোন জেগে ওঠা নদীতল, বিশেষত বালিময় চর) যত্রতত্র জন্মায়।

রবি সবজির মধ্যে আলু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চাষও অত্যন্ত ব্যাপক। বর্তমানে আলু মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট ও নিলফামারী জেলাসমূহের প্রধান ফসল। দেশের অষ্টম গুরুত্বপূর্ণ ফসল আখ ফলে প্রধানত রাজশাহী, নাটোর ও চুয়াডাঙ্গায়। বাংলাদেশের প্রতি জেলায় অল্পবিস্তর মরিচ ফললেও উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ এবং বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় মরিচ ফলে বেশি।

অপ্রধান ফসল (Minor crop)  দেশের গড় শস্য উৎপাদন এলাকার এক শতাংশের কম জমিতে উৎপন্ন শস্যাদি। বাংলাদেশে ছোলা (০.৭৮%), বজরা ও ভুট্টা (০.৬০%), পিঁয়াজ (০.৫৮%), মাষকলাই (০.৫১%), মিষ্টিআলু (০.৪৫%), চীনাবাদাম (০.৪০%), সবুজ মটর (০.৩৬%), তিল (০.৩৩%), তিসি (০.৩০%), রসুন (০.২০%), মটর (০.১২%), বার্লি (০.১০%) ইত্যাদি সচরাচর গৌণ শস্যরূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। এছাড়া সবজি ও মসলা উৎপাদক উদ্ভিদসহ কিছু শস্য গড় শস্যোৎপাদন এলাকার অতি সামান্য পরিমাণ জমিতে (যেমন, প্রতিটি ০.১০% শতাংশেরও কম) চাষ হয় এবং একত্রে চাষের পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৫৭ শতাংশ।

জমির পরিমাণের হিসাবে, কতকগুলি গৌণ অর্থকরী ফসল, যেমন চা রপ্তানিযোগ্য ফসলরূপে দ্বিতীয় স্থানে আছে। প্রধানত মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকায় এবং হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার স্বল্প এলাকায় চায়ের চাষ হয়। তামাক, সুপারি ও পান অন্য তিনটি অর্থকরী গৌণ ফসল। তামাক চাষে এগিয়ে রয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুষ্টিয়া। সমুদ্রকূলবর্তী জেলাসমূহে সাধারণত সুপারি চাষ বেশি। অন্যদিকে পান বরিশাল, কক্সবাজার, রাজশাহী, মৌলভীবাজার ও সাতক্ষীরার কতিপয় এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ফসল।

গৌণ দানাশস্যের মধ্যে ভুট্টা, বার্লি ও বিভিন্ন জাতের বজরা কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় জন্মে। অধিকাংশ জেলায় কিছু পরিমাণ চীনাবাদাম, তিল ও তিসি জন্মায়। ছোলা, মাষকলাই, সবুজ মটর ও মটর প্রতি জেলায় কিছু পরিমাণে জন্মে। মাষকলাই সবচেয়ে বেশি জন্মে নবাবগঞ্জে। সবজি ও মসলার মধ্যে যথাক্রমে বেগুন এবং পিঁয়াজ ও রসুন প্রতিটি জেলার বসতবাড়ির বাগানে এবং জমিতে ফলে, অন্যদিকে পটুয়াখালী ও ভোলায় সাধারণত মিষ্টিআলুর চাষ ভাল হয়।

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বসতবাড়িতে কলা, আম, নারিকেল ও কাঁঠাল ফলে। আনারসের ফলন প্রধানত মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন জেলায় হয়। [এম জাহিদুল হাসান]

খরিফ ফসল (Kharif crop)  এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত উৎপন্ন ফসল, যাদের মাটিতে সঞ্চিত আর্দ্রতা ফসলের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটায়। মূলত খরিফ ফসল বসন্ত বা গ্রীষ্মে বুনে গ্রীষ্মের শেষ বা শীতের শুরুতে তোলা হয়। মৌসুমটি বর্ণনার সুবিধার্থে খরিফ-১ ও খরিফ-২ এভাবে বিভক্ত। প্রায়শই প্রাক-খরিফ হিসেবে শনাক্ত খরিফ-১ অনতিদীর্ঘ এবং প্রকৃতপক্ষে মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু ও মে মাসে শেষ হয়। উচ্চ তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতাই খরিফ মৌসুমের বৈশিষ্ট্য।

খরিফ ফসল, রোপা আমন

এই মৌসুমে উৎপন্ন দেশের প্রধান প্রধান ফসল ১. দানাশস্য বোনা ও রোপা আউশ, রোপা আমন, চীনা, কাউন ও জোয়ার; ২. কন্দ ও মূলজাতীয় ফসল পানিকচু, মুখীকচু, ওলকচু, মানকচু ও পঞ্চমুখী কচু; ৩. তৈলবীজ তিল, চীনাবাদাম ও সয়াবিন; ৪. ডাল জাতীয় ফসল মাষকলাই, মুগ ও অড়হর; ৫. গ্রীষ্মকালীন সবজি ঢেঁড়স, লালশাক, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, করলা, চিচিঙ্গা, বরবটি, বেগুন ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো; ৬. মসলাজাতীয় ফসল কাঁচামরিচ, আদা ও হলুদ; ৭. অাঁশজাতীয় ফসল পাট, কেনাফ (Kenaf), মেস্তা ও তুলা; ৮. চিনিজাতীয় ফসল আখ; ৯. পানীয় ফসল চা; এবং ১০. ফল কলা, আনারস, পেঁপে ও ফুটি।

যেসব অঞ্চলে সেচ সুবিধা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই সেখানে অধিকাংশ খরিফ ফসল খরা ও বন্যা পরিস্থিতির অধীন।

রবি শস্য (Rabi crop)  দুটি কৃষি মৌসুমের মধ্যে রবি মৌসুমে উৎপন্ন ফসল। এ মৌসুমের শুরু আর্দ্র জলবায়ু মৌসুমের শেষে অর্থাৎ নভেম্বর মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের বিরতি শুরু হলে এবং অব্যাহত থাকে মার্চ মাসের শেষাবধি। শুষ্ক ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া এই মৌসুমের বৈশিষ্ট্য, কিন্তু শুরু ও শেষে উষ্ণতা থাকলেও মধ্যবর্তী ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই সময়কাল যথেষ্ট ঠান্ডা। রবি শস্য চাষের গড়পড়তা ব্যাপ্তিকাল বাংলাদেশের পশ্চিম এলাকায় ১০০-১২০ দিন এবং উত্তর-পূর্ব অংশে ১৪০-১৫০ দিন।

রবি শস্য,সরিষা

দেশে উৎপন্ন প্রধান রবি শস্য: ১. দানাশস্য গম, ভুট্টা, যব ও বোরো ধান; ২. কন্দ ও মূলজাতীয় ফসল আলু, মিষ্টিআলু; ৩. তৈলবীজ সরিষা, তিল, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী, তিসি, কুসুম; ৪. ডালজাতীয় ফসল মটর, মসুরি, খেসারি, মুগ ও বরবটি; ৫. শীতকালীন শাকসবজি বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন, টমেটো, গাজর, শালগম, ওলকপি, মূলা, পালংশাক, লেটুস, লাউ, দেশী শিম; ৬. মসলাসমূহ মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, জিরা, কালোজিরা, মেথি; ৭. অাঁশজাতীয় ফসল শনপাট; ৮. চিনিজাতীয় ফসল আখ; ৯. উত্তেজক ফসল তামাক; এবং ১০. ফল তরমুজ। রবি শস্য ১২৫ সেমি পর্যন্ত মাটির নিচে সঞ্চিত আদ্রর্তা ব্যবহার করতে পারে।

উচ্চফলনশীল ফসল (high yielding crop)  বিপুলসংখ্যক ফসল আবাদের অনুকূল জলবায়ু বাংলাদেশে রয়েছে। দেশে উৎপন্ন প্রধান প্রধান ফসলগুলি হচ্ছে ধান, গম, পাট, ইক্ষু, তৈলবীজ, ডাল, আলু, মিষ্টিআলু, তামাক, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফল। অধিকাংশ ফসলের স্থানীয় বা দেশী জাতসমূহ নিম্ন-ফলনশীল। ফসলের উচ্চফলনশীল জাতসমূহের উদ্ভাবনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফসল গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত উন্নত জাতসমূহের প্রবর্তনে বিগত কয়েক দশকে উন্নত ফসল চাষের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। [মোঃ শহীদুল ইসলাম]

বৃষ্টিনির্ভর খাদ্যশস্য (Rain-fed food crop)  প্রাকৃতিক বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে খাদ্যশস্য চাষ, অর্থাৎ কোন প্রকার সেচ ব্যতীত সম্পূর্ণ বৃষ্টিনির্ভর ফসল আবাদ। বাংলাদেশের কৃষি-বাস্ত্তসংস্থানিক অঞ্চল ও আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দরুন এদেশের কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাদের শস্যের নিরাপত্তা বিধানে অসমর্থ বিধায় তারা পরিপোষক, স্বল্প-পরিমাণ উপকরণভিত্তিক ও ঝুঁকি এড়ানোর উপযোগী এক ধরনের মিশ্র চাষাবাদের আশ্রয় নেয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে একঘেয়ে বর্ষার আগে ও পরে যথাক্রমে উষ্ণ-আর্দ্র গ্রীষ্মকাল ও শুষ্ক হালকা শীত মৌসুম থাকে। ১৯৯৪-৯৫ সালে বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের মোট বৃষ্টিনির্ভর জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০৬ লক্ষ হেক্টর, যা মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৬%।

বৃষ্টিনির্ভর জাতের ধানগুলির মধ্যে আছে আউশ ও আমন, উচ্চফলনশীল জাতগুলি, পাইজাম, স্থানীয় আউশ, ছিটা-আমন ও স্থানীয় রোপা আমন। মোট জমি ও অসেচকৃত জমির পরিমাণ সারণিতে দেখানো হয়েছে। আউশ ও আমন চাষাধীন জমির ৯৩-৯৪ শতাংশই বৃষ্টিনির্ভর।

খরিফ মৌসুমে ধান ছাড়াও তিল, বরবটি, জোয়ার এবং কিছু চীনা, কাওন, বজরা ইত্যাদিও জন্মে। কিন্তু রবি মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, চীনা, কাওন, তৈল ফসল ও ডালের ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। গমের মোট জমির ৫৬% বৃষ্টিনির্ভর। বোরো ধানের মাত্র ১০% বৃষ্টিনির্ভর, তাও স্থানীয় জাতের। তৈল ও ডাল ফসলের জমির ৯৫ শতাংশের বেশি বৃষ্টিনির্ভর।

ডাল প্রোটিনের অন্যতম উৎস এবং ডালের শিকড়লগ্ন মিথোজীবী Rhizobium ব্যাকটেরিয়া মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ করে বলে এই ফসল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চাষকৃত জমির পরিমাণ অনুযায়ী ডালের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে খেসারি (২,৪৮,৩৬৫ হে), মসুরি, (২,০৯,০৪৯ হে), ছোলা (৮৫,৬৪১ হে), মাষকলাই, (৬৮,৪৯২ হে) ও মুগ (৮৫,৬৪১ হে)। এগুলির দখলে আছে ডাল চাষাধীন জমির শতকরা ৯৩ ভাগ। ডাল মাটির বাড়তি আর্দ্রতা এবং শীতকালের সামান্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করেই ফলানো হয়। ১৯৯৪-৯৫ সালে বাংলাদেশে উৎপন্ন ডালের পরিমাণ ছিল ৫৩,৩৫,৯৯০ মে টন, মাথাপিছু অনুমোদিত দৈনিক ৫৮ গ্রাম চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনের মাত্র ১৮%। এই চাহিদার কিছুটা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ভোজ্য তেল শস্যের প্রায় ৯৫% মাটির বাড়তি আর্দ্রতার ভিত্তিতে ফলানো হয়। তৈলবীজ চাষাধীন জমির ৭৩ শতাংশে সরিষা ও ১৯ শতাংশে তিল ফলে। ১৯৯৪-৯৫ সালে উৎপন্ন ৩,০৭,৬০২ মে টন তৈলবীজ থেকে ১৭,৯,৫২৪ মে টন তৈল পাওয়া যায় যা ছিল চাহিদার মাত্র ২৭%।

বাংলাদেশে ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদনে যথাসম্ভব স্বল্প উপকরণাদি যোগানো হয়, ফলে উৎপাদনও কম, এতে দেখা দেয় প্রোটিন ও চর্বির প্রকট ঘাটতি। অত্যাবশ্যকীয় প্রোটিন ও চর্বির অভাব হলে কোন জাতি দৈহিক ও মানসিকভাবে দক্ষ হতে পারে না। ডাল ও তৈলবীজের সঙ্গে যব, ভুট্টা ও জোয়ারজাতীয় দানাশস্যের উৎপাদন কমপক্ষে ৫০% বাড়িয়ে সুষম খাদ্যের চাহিদাপুরণ করা যেতে পারে। [এস.এম হাসানুজ্জামান]

শস্য সমাহার (Crop combination) এক ফসল মৌসুমে একই ক্ষেতে দুই বা ততোধিক শস্যচাষ। এতে কৃষকদের জন্য একই জমিতে নানান ফসল ফলিয়ে জমির মোট উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শিমজাতীয় ফসলের চাষের সাহায্যে মাটির উর্বরতা অটুট রাখার সুবিধা হয়।

ফসলের একত্র চাষের ধরন (ফসল সমাবন্ধ) মিশ্রচাষ কৌশলের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে একটি গণনীয় এককে তত্ত্বীয় বণ্টনের সঙ্গে বিভিন্ন ফসলের চাষকৃত এলাকার যথার্থ শতকরা হিসাবের তুলনা। উদাহরণস্বরূপ, যে কোন এককে একটি শস্যের জন্য জমির তাত্ত্বিক বণ্টন হবে ১০০, ০, ০... শতাংশ। একইভাবে ২-শস্যের সমন্বয়ে তা হবে ৫০, ৫০, ০, ০... শতাংশ এবং এর ততোধিক সমন্বয়ে এভাবেই জমি বণ্টিত হতে থাকবে।

সমাবন্ধ কৌশল অনুসারে, বাংলাদেশে ১৯৯৪-৯৫ সালে ফসলের গোটা সামষ্টিক প্যাটার্নের দৃষ্টান্ত হলো ৩-ফসলের (৩ জাতের ধান) সমন্বয়, অর্থাৎ আমন-বোরো-আউশ। বিশদ বিশ্লেষণে ১ থেকে ৯-ফসলের সমন্বয় শনাক্ত করা হয়েছে। খুলনা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালী জেলাগুলিতে আমনের একক চাষ হয়। তেরোটি জেলায় ২-ফসল সমন্বয়ের ৩টি ধরন শনাক্ত করা হয়েছে। আমন-বোরো সমন্বয় দেখা যায় গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। আমন-আউশ মিশ্রণ আছে পঞ্চগড়, ঝালকাঠি ও ভোলায় এবং সুনামগঞ্জে বোরো-আমন সমন্বয়।

একুশটি জেলায় চার ধরনের ৩-শস্যের সমাবন্ধ হয়। রংপুর, নড়াইল, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে আছে আমন-বোরো মিশ্রচাষ। আমন-আউশ-বোরো মিশ্রচাষ চলে নিলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পিরোজপুর, বরিশাল ও নোয়াখালীতে। আমন-বোরো-পাট মিশ্রচাষ নরসিংদীতে এবং আমন-আউশ-খেসারি সমন্বয় বরগুনায়।

বোরো-আমন-পাট-সরিষা, বোরো-আমন-সরিষা-আউশ, আমন-আউশ-বোরো, আমন-বোরো-পাট-গম, আমন-গম-বোরো-আউশ, আমন-বোরো-গম-আউশ, আমন-আউশ-মাষকলাই-বোরো এই সাত ধরনের ৪-শস্য সমাবন্ধ যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নবাবগঞ্জে প্রচলিত।

দশ ধরনের ৫-শস্য সমাবন্ধ, যেমন: আমন-আউশ-বোরো-কলা-সরিষা, আমন-আউশ-কলা-বোরো-সরিষা, বোরো-আমন-সরিষা-আউশ-পাট, আমন-বোরো-আলু-পাট-আউশ, আমন-আউশ-বোরো-পাট-সরিষা, আমন-আউশ-গম-মসুরি-পাট, আমন-বোরো-আউশ-পাট-মসুরি, আমন-গম-আউশ-বোরো-আখ, আমন-বোরো-আউশ-গম-আখ, আমন-বোরো-গম-পাট-সরিষা ইত্যাদির সংযুক্তি চাষ যথাক্রমে খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় দেখা যায়।

মেহেরপুর, মাগুরা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও রাঙ্গামাটিতে যথাক্রমে আমন-আউশ-গম-পাট-মসুরি-বোরো, আমন-আউশ-পাট-বোরো-মসুরি-ছোলা, আমন-বোরো-আউশ-সরিষা-গম-পাট, আমন-আউশ-বোরো-সরিষা-গম-পাট, আমন-কলা-বোরো-আউশ-সরিষা-আনারস এই ৬-শস্যের সমাবন্ধ দেখা যায়।

তিন ধরনের ৭-শস্যের সংযুক্ত চাষ যেমন: আমন-আউশ-গম-মসুরি-বোরো-ছোলা-পাট, আমন-আউশ-বোরো-গম-পাট-মসুরি-ছোলা, আমন-আউশ-বোরো-গম-পাট-মসুরি-ছোলার চাষ হয় যথাক্রমে চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায়।

পাবনায় ৮-শস্যের (আমন-আউশ-গম-পাট-খেসারি-সরিষা-পিঁয়াজ-মসুরি) মিশ্রচাষ ও শরীয়তপুরে ৯-শস্যের (আমন-আউশ-বোরো-মসুরি-মরিচ-সরিষা-পাট-খেসারি-গম) সমাবন্ধ চাষ দেখা যায়।  [এম জাহিদুল হাসান]

শস্য বৈচিত্র্য (Crop diversification)  একটি কৃষি বাস্ত্তসংস্থানিক অঞ্চলে কৃষক ও সামাজিক গোষ্ঠী কর্তৃক সাধারণত আরোপিত ও লালিত জীবন পদ্ধতি বস্ত্তত নানা ধরনের শস্যচাষের ভিত্তি যোগায়। বাংলাদেশের চাষযোগ্য জমির প্রায় ৫০% মধ্য-জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্লাবিত থাকে, যেখানে জলবদ্ধতা সহিষ্ণু শস্যই কেবল চাষ করা যায়। বন্যামুক্ত অঞ্চলে বৃষ্টিসিক্ত ও সেচকৃত উভয় অবস্থাতেই বিভিন্ন প্রকার শস্যের চাষ হয়। শুষ্ক শীতের সময় ধান ব্যতীত অন্য ফসল মাটিতে থেকে যাওয়া (residual) আর্দ্রতায় ফলানো যায়। সেচের মাধ্যমে অন্যান্য শস্য ও বোরো ধানের ব্যাপক চাষ চলে এবং তাতে বহুবিধ শস্যচাষ বাড়ে। অন্যদিকে, ৮,৩৩,০০০ হেক্টরের উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে শস্যচাষের ঘনত্ব (Crop Intensity) ৬২-১৫৯%। আর্থ-সামাজিক ও কৃষি বাস্ত্তসংস্থানিক চাপের জন্য চাষীরা মোট চাষ জমির প্রায় ৭৪ শতাংশে ধান চাষে বাধ্য হয়। অবশিষ্ট ২৬% জমিতে ডাল, তৈলবীজ, আখ, মসলা, পাট, তুলা ইত্যাদির মতো প্রধান ফসল ফলায়। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রায় ৮০ প্রজাতি ও শতাধিক জাতের ফসল চাষের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মোট চাষজমি ও একক শস্যচাষ জমির অনুপাত বহুবিধ শস্যচাষের সূচক (Index) যোগায়। ফসল চাষের অপেক্ষাকৃত উচ্চমুখী ঘনত্ব বহুবিধ শস্যচাষের সূচকের সঙ্গেও সম্পর্কিত। রংপুর, বগুড়া, জামালপুর ও ময়মনসিংহে (এগুলি অনুকূল কৃষি প্রতিবেশ এলাকার অন্তর্গত) বহুবিধ শস্যচাষ সূচক (CDI) ১০.৪ থেকে ১২.০ ও শস্যচাষের ঘনত্ব (CI) ১৯৬ থেকে ২০২। CDI-র মান ৪ থেকে কম হলে তা নিম্নমানের CD হিসেবে বিবেচ্য।

বিশ্ব ব্যাংক CD পরিমাপে নিচের সূত্র অনুসরণ করে

S = 1-  (Ai / A)2,

যেখানে A = মোট বাৎসরিক শস্যচাষ এলাকা, Ai নির্দিষ্ট মৌসুমে একটি শস্য চাষাধীন এলাকা ও S হলো CD পরিমাপ, যাকে  সিম্পসন্স সূচক (Simpson’s Index) বলা হয় এবং যা ০ থেকে ১ এর মধ্যে ওঠানামা করে। যখন S = ০.৫ তখন এটা বোঝায় যে পর পর দুই বছরে একই মাঠে দুটি শস্যচাষ হয়েছে। S সাধারণত শস্যবৈচিত্র্যের উত্তম পরিমাপ যোগায়। বিশ্ব ব্যাংক CD পরিমাপের জন্য আরেকটি সূত্র দিয়েছে

R =  (ar) / (A),

এখানে প্রতিটি ধান শস্যের এলাকা হলো ar। ০ এবং ১-এর মধ্যে R ওঠা নামা করে। অবশ্য এক্ষেত্রে R-এর উচ্চমান CD-র নিম্নমান নির্দেশ করে।

বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম CDI হলো শস্য উৎপাদনে বর্তমান স্থবিরতা, অসম ও কম পুষ্টিযুক্ত খাদ্য ফসল এবং মাটির পুষ্টি ঘাটতির পুঞ্জীভূত ফল। তবে অপেক্ষাকৃত উচ্চতর CD-র সুফল: খাদ্যে নিরাপত্তা; ভৌত, জৈবিক, বাস্ত্তসংস্থানিক ও অর্থনৈতিক চাপগুলি দূর করে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বাড়তি মুনাফা; বাণিজ্যিক কৃষিচাষ প্রবর্তনের অনুপ্রেরণা; স্থানীয় ও বৈদেশিক বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে গম, ভুট্টা, তুলা, পাট, আখ, সবজি ও বাৎসরিক উৎপন্ন ফলের অনুকূল বাজারদর; লাভজনক একক, মিশ্র ও বহু ফসলি চাষকৌশলের জন্য স্থানীয় স্তরে বিশেষীকরণসহ অবকাঠামোতে অনুকূল বিনিয়োগ, সহায়ক সার্ভিস ‘উন্নত’ প্রসেসিংয়ের সুযোগ-সুবিধা এবং মাটির সুস্থতা ও পরিবেশের উন্নতির জন্য সবুজ সার ব্যবহারসহ মাটিতে জৈববস্ত্ত যোগানো।  [এস.এম হাসানুজ্জামান]

শস্যমান (Crop modelling)  সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে লব্ধ কৃষিজ জ্ঞান একটি মাত্রাগত প্রণালীর ভেতর সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার এবং এগুলিকে সমন্বিত করার এবং সমগ্র ফসল ব্যবস্থা অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি। একটি ফসল মডেল হচ্ছে ফসলের সাদাসিধা বিবরণ যা ফসলের বর্ধন গবেষণা এবং পরিবেশের প্রতি ফসল বর্ধনের প্রতিক্রিয়াগুলি নিরূপণ করার কাজে ব্যবহূত হয়ে থাকে। সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফসল মডেলসমূহ বর্ণনামূলক এবং ব্যাখ্যামূলক মডেল হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একটি বর্ণনামূলক মডেল একটি ব্যবস্থার কার্যকর সরল রীতিকে সঠিকভাবে বর্ণনা করে।

একটি ব্যাখ্যামূলক মডেলে নিহিত থাকে বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়াসমূহের মাত্রিক বর্ণনা যা একটি ব্যবস্থার আচরণের কারণ। অনুকরণ মডেলসমূহ হচ্ছে আমাদের চারপাশে বিরাজমান ব্যবস্থাগুলির মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি সাধাসিধা একটি বর্ণনা। অন্য কথায় বলা যায় অনুকরণ মডেল হচ্ছে এমন একটি মডিউল যা একটি ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলি চিহ্নিত বা বর্ণনা করে, সাধারণত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতো। ব্যাপক ভিত্তিক মডেলসমূহ এমন ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে যার ভিতর অত্যাবশ্যকীয় উপাদানসমূহ সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করা এবং বহুল পরিমাণে এই জ্ঞান সম্মিলিত করা হয়ে থাকে। সংক্ষিপ্ত মডেলসমূহ হচ্ছে ব্যাপক ভিত্তিক মডেলগুলির সারাংশ। বর্তমানকালে সংক্ষিপ্ত এবং ব্যাপক ভিত্তিক মডেলসমূহ ব্যবহূত হচ্ছে। এগুলি গতিশীলতা সম্পন্ন ও কুশলী এবং এগুলিকে ফসল অনুকরণ মডেলও বলা হয়ে থাকে। ফসল মডেলিং প্রক্রিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করা জ্ঞান একত্রিত করে; যেমন, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, ফসলের শারীরবিজ্ঞান, কৃষি জলবায়ু বিজ্ঞান, উদ্ভিদ রোগবিদ্যা, কৃষি র্অথনীতি এবং এরূপ আরও অনেক ক্ষেত্র থেকে আহরিত জ্ঞান। বিগত ৩০-৪০ বছর সময়কালে ফসল বর্ধন অনুকরণ মডেলসমূহের উন্নয়ন করা হয়েছে। একটি মডেলের উৎপত্তি কতকগুলি ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়: উৎপত্তিক্ষেত্র বা পরিধি নির্ধারণ করা (Calibration)মূল্যায়ন (অভীক্ষণ এবং যথার্থতা নিশ্চিতকরণ) এবং আরও অনেকগুলি আন্তঃক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করে। ফসল মডেলসমূহ হচ্ছে উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের নিয়মিত গবেষণার প্রক্রিয়ার কেবলমাত্র একটি সম্প্রসারিত অংশ। উপাত্ত বিশ্লেষণ অপরিহার্যভাবে মানসিক কাঠামোর মধ্যে কিছু বিশ্লেষণ (ধারণামূলক মডেল) অন্তর্ভুক্ত করে যেটি সচরাচর একটি গাণিতিক মডেল (এক বা একাধিক নির্ধারিত সমীকরণ) হিসেবে ব্যক্ত করা হয়ে থাকে।

ফসল মডেলিং-এর উপর বাংলাদেশে অতি সীমিত গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। ধান উৎপাদনের জন্য অনুকরণ (simulation) এবং প্রণালীসমূহ বিশ্লেষণ (SARP) শিরোনামে ফিলিপাইনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই প্রকল্পটি ছিল আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং নেদারল্যান্ডের ওয়েগেনিনজেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা বিভাগের কৃষি জৈবিক গবেষণা কেন্দ্র এবং তত্ত্বীয় উৎপাদন প্রতিবেশ (TPE-WAU) বিভাগের একটি সহযোগিতামূলক উদ্যোগ। প্রকল্পটির সামগ্রিক লক্ষ্য ছিল ফসল অনুকরণ এবং প্রণালীসমূহ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এশীয় ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষণার সামর্থ্য তৈরি করা। কর্মকান্ডসমূহকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য চারটি প্রধান বিষয়কে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এগুলি হচ্ছে কৃষি প্রতিবেশ ব্যবস্থা, সম্ভাবনা সূচক উৎপাদন, ফসল এবং মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, এবং ফসল রক্ষণাবেক্ষণ। এই প্রকল্পের আওতায় এমএসিআরওএস (MACROS) এবং ওআরওয়াইজেডএ (ORYZA) এর শ্রেণিভুক্ত ফসল মডেলসমূহ বিকশিত, বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ, যথার্থতা নিশ্চিতকরণ এবং পরীক্ষণের কাজ ফিলিপাইনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সম্পন্ন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মীদল এই মডেলসমূহের মধ্য থেকে কিছু মডেল পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে নিজেদের উপযোগী করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ধান ফসলের কিছু মডেলও উদ্ভব করা হয়েছিল এবং এই প্রকল্পের আওতাধীনে কিছু কিছু মডেলে পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে উপযোগী করা হয়েছিল।

কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য সহায়তা ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত ডিএসএসএটি (Decision Support System for Agrotechnology Transfer/DSSAT) এর সুবিধার আওতায় কৃষি প্রযুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক প্রমিত মাপক এর নির্ধারিত কিছু কিছু কার্যক্রমের প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চালু রয়েছে।

পরীক্ষণসমূহের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা চিহ্নিত করার কাজে ফসল মডেলসমূহ ব্যবহার করা যেতে পারে। জলবায়ুগত অবস্থা এবং এক বছর থেকে অন্য বছরে আবহাওয়ার তারতম্যের ভিত্তিতে ফসলের চারা লাগানো, বীজ বপন, প্রকার নির্ধারণ ইত্যাদি; সেচ প্রয়োগের অনুসূচি প্রণয়ন, ফসল চাষপদ্ধতির পরিকল্পনা, অভীক্ষা এবং মূল্যায়ন করা এবং এরূপ আরও অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাকে সহায়তা প্রদানে ফসল মডেলসমূহ ও ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ফসল অনুকরণ (simulation) মডেলসমূহ বর্তমানে খুবই উপকারী বলে প্রমাণিত এবং গবেষণা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াসমূহের ক্ষেত্রে বাস্তব অবদান রাখতে পারে। ফসল মডেলসমূহ ব্যবহার করার মাধ্যমে বহুসংখ্যক সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তির সম্ভারের প্রাক-বাছাইয়ের কাজ করা যেতে পারে। মডেলসমূহ এবং মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ একটি অপরটির পরিপূরক হতে পারে এবং কেবলমাত্র মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত ঐতিহ্যগত পরীক্ষণের উপর এককভাবে সবসময় নির্ভর করা যায় না, বিশেষ করে যখন সমস্যাগুলির সমাধান করা তাৎক্ষণিকভাবে অতি জরুরি হয়ে পড়ে।  [মোঃ সিরাজুল ইসলাম]

শস্যচক্র (Crop rotation)  বছরের বিভিন্ন সময়ে একই জমিতে ফসল ফলানোর ক্রমপর্যায়। ফসল একটি নির্দিষ্ট ক্রমপর্যায়ে ফলানো হয় যাতে মাটির সার ব্যবহার ও মাটিতে সার যোগ করা যায় এবং কীটপতঙ্গ ও ছত্রাকের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হয়। শিমজাতীয় ফসলের শিকড়ে নাইট্রোজেনগ্রাহী ব্যাকটেরিয়া থাকায় শস্যপর্যায়ে এই জাতীয় ফসল অন্তর্ভুক্ত হলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে।

অনেক দেশেই ৩-৪ বছরের শস্যপর্যায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত, যেমন হেমন্তের দানাশস্যের পর একটি মূলজ ফসল, তারপর বাসন্তী দানাশস্য ও সবশেষে শিমজাতীয় ফসল, মটরশুঁটি বা শিম।

বাংলাদেশে খুব পরিকল্পিতভাবে না হলেও কৃষকরা অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য শস্যপর্যায় অনুসরণ করে। তারা সাধারণত অগভীর শিকড়ের ফসল (ধান) চাষের পর গভীর শিকড়যুক্ত ফসল (পাট) লাগায় এবং শেষে চাষ করে বরিশস্য (সরিষা, ডাল, ইত্যাদি)।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

কৃষি মৌসুম (Cropping season)  উপ-উষ্ণমন্ডলের ভৌগোলিক অবস্থানে থাকায় ফসল চাষের উপযোগী তাপমাত্রা বাংলাদেশে সারা বছরই থাকে। চাষাবাদ পদ্ধতির ভিত্তিতে ফসল উৎপাদনের গোটা সময়কাল খরিফ ও রবি এই দুটি প্রধান মৌসুমে বিভক্ত। খরিফ মৌসুমে উৎপন্ন ফসলকে (ধান, পাট, ভুট্টা, জোয়ার ইত্যাদি) খরিফ ফসল এবং রবি মৌসুমে উৎপন্ন ফসলকে (গম, সরিষা, মটর কলাই, মসুরি ইত্যাদি) রবি ফসল বলা হয়। মে মাস থেকে শুরু হয়ে পুরো অক্টোবর পর্যন্ত খরিফ মৌসুম চলে, আর রবি মৌসুমের শুরু নভেম্বরে ও শেষ এপ্রিলে। এই দুটি প্রধান মৌসুম ছাড়াও প্রাক-খরিফ নামে আরেকটি অন্তর্বর্তী মৌসুমও আছে। এটি মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে মে-জুন মাসে শেষ হয়। বাংলাদেশের ফসল চাষের মৌসুমগুলির প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে বর্ণিত হলো:

প্রাক-খরিফ মৌসুম  বছরের পর বছর বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাত্রায় ও পৌনঃপুন্যে অনির্ভরযোগ্য বৃষ্টিপাত এবং কিছু ফসলের জন্য (পাট, বোনা-আমন, আউশ, চীনাবাদাম, ডাঁটা, কাকরোল ইত্যাদি) মাঝে মাঝে আর্দ্রতার যোগানই এই মৌসুমের বৈশিষ্ট্য। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মাটি কখনও আর্দ্র, কখনও শুষ্ক হয়ে ওঠে। এই মৌসুমে এই ধরনের শুষ্কতা ও আর্দ্রতার আপেক্ষিক দৈর্ঘ্য ও পৌনঃপুন্য প্রত্যেক বছর প্রাক-বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের সময়কাল ও পরিমাণের উপর নির্ভরশীল।

বৃষ্টিপাতের অবস্থার ভিত্তিতে গোটা বাংলাদেশ ছয়টি বিশেষ অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলির পরিসর সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পূর্ব অংশের ১০-২০ দিনের গড় দৈর্ঘ্যসহ পি-১ অঞ্চল থেকে যশোর ও সাতক্ষীরা জেলাগুলির পশ্চিমের ৬০ দিনের অধিক গড় দৈর্ঘ্যসহ পি-৬ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত।

সেচ সুবিধাদি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সেচের আওতায় উৎপন্ন প্রাক-খরিফ ফসলের মধ্যে রয়েছে আখ, ভুট্টা, পাট, ডাঁটা, চীনাবাদাম, কলা, তিল, ঢেঁড়স, কাকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, উচ্ছে, করলা, পুঁইশাক, আদা, হলুদ ইত্যাদি।

খরিফ মৌসুম  শুরু মে মাস থেকে যখন বৃষ্টির পানি ও মাটিতে সঞ্চিত আর্দ্রতা একত্রে বৃষ্টিনির্ভর বা সেচ সুবিধাহীন খরিফ ফসলগুলিকে পর্যাপ্ত পানি যোগায়। প্রকৃতপক্ষে এই মৌসুমের শুরু সেই তারিখ থেকে যখন বর্ষণ ক্রমাগত ০.৫ উবন-প্রস্বেদন বিভব (potential evapotranspiration/PET) অতিক্রম করতে শুরু করে এবং শেষ হয় যখন বর্ষাঋতুর শেষে বৃষ্টির পানি ও মাটিতে সঞ্চিত অনুমিত ১০০ মিমি আর্দ্রতার সঙ্গে একত্রে ০.৫ PET–এর নিচে নেমে আসে। এই মৌসুমের বেশির ভাগ সময়ই বৃষ্টিপাত PET-এর পূর্ণমাত্রা অতিক্রম করে এবং অভেদ্য মাটির উপর বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখা যায়। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের সময়কালকে আর্দ্রকাল (humid period) বলা হয়।

কোন কোন জমির মাটির আর্দ্রতার অবস্থান বস্ত্তত বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকেই বিবেচ্য। উদাহরণস্বরূপ, বৃষ্টিপাত PET-এর পূর্ণমাত্রার নিচে এলে উঁচু জমিতে ডোবায় পানি ধরে রাখা যায়। খরিফ মৌসুমে সর্বাধিক উৎপন্ন ফসলগুলির মধ্যে উল্লেখ্য পাট, আউশ ধান, বোনা-আমন, রোপা-আমন, তিল, গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন সবজি, আদা, হলুদ, গোলমরিচ, কাঁচামরিচ, কচু, তুলা, মুগ, মাষকলাই ইত্যাদি। যেসব অঞ্চলে পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই সেখানে অধিকাংশ খরিফ ফসলই অনাবৃষ্টি ও বন্যার কবলে পড়ে।

রবি মৌসুম  আর্দ্র সময়কালের শেষে শুরু এবং প্রাক-খরিফ মৌসুম পর্যন্ত বিস্তৃত। রবি ফসল উৎপাদনের গড় স্থায়িত্বকাল দেশের সর্বপশ্চিমে ১০০-১২০ দিন থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১৪০-১৫০ দিন। রবি ফসল বা শীতের ফসল মাটির ১.২৫ মিটার নিচের আর্দ্রতাও ব্যবহার করতে পারে (শক্ত মাটির স্তর না থাকলে)। রবি মৌসুম শুরুর গড় তারিখ হলো দেশের সর্ব পশ্চিমে ১-১০ অক্টোবর থেকে দেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যভাগ ও পূর্বভাগে ১-১০ নভেম্বর পর্যন্ত। এই মৌসুম শেষ হওয়ার গড় সময়কাল হলো দেশের পশ্চিমাঞ্চলে পরবর্তী বছরের ১-১০ ফেব্রুয়ারি আর উত্তর-পূর্বাংশে ২০-৩১ মার্চ। নভেম্বরের পর বোনা/লাগানো হলে গম, ভুট্টা, সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তামাক, আলু, মিষ্টিআলু, আখ, মসুরি, মটরকলাই ও খেসারির মতো বেশির ভাগ রবি ফসলই ভাল ফলন দেয়। এসব ফসল মাটির অবশিষ্ট আর্দ্রতা সদ্ব্যবহার তথা শীতকালীন সময়ে ঠান্ডায় বেড়ে ওঠার সুবিধাও লাভ করতে পারে।

বর্ষা মৌসুম শেষ হবার পরও যেসব নিচু জমি এবং অতি নিচু জমিতে বন্যা অব্যাহত থাকে সেগুলি থেকে বন্যার পানি নেমে যাবার পরই সেখানে রবি মৌসুম শুরু হয়।

পর্যায়ক্রমিক চাষ (Relay cropping)  কোন ফসল ক্ষেতে জন্মানো ফসল পরিণত অবস্থায় পৌঁছলে অথবা পরিপক্কতা লাভ করার সময়ে ঐ একই ক্ষেতে অন্য আরেক ফসল জন্মাবার পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ, রোপা আমন ক্ষেতে মটরশুঁটির আবাদ এবং আখের মতো বর্ষজীবী ফসলের সঙ্গে সরিষা চাষ উল্লেখ করা যায়। পর্যায়ক্রমিক চাষের মূল উদ্দেশ্য ফসল মৌসুমে সঠিক ফসল চাষে বিলম্ব হবার সুযোগ না দেওয়া এবং সেসঙ্গে শস্য চাষের ঘনত্ব বৃদ্ধি। পর্যায়ক্রমিক চাষে ব্যবহূত শস্যাদি মাটিতে থেকে যাওয়া আর্দ্রতা ব্যবহার করে এবং পূর্ববর্তী ফসল চাষে প্রয়োগকৃত পুষ্টির অবশিষ্টাংশ কাজে লাগাবার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমিক চাষে সচরাচর ব্যবহূত উল্লেখযোগ্য ফসল-যুগল রোপা আমন-মাষকলাই, রোপা আমন-মটর, আউশ-আমন, রোপা ধান-ধইনচা, পাট-লতা শাক, আখ-মটরশুঁটি, আখ-তিসি, আখ-পিঁয়াজ, আখ-রসুন, আখ-আলু, আলু-রসুন, আলু-পটল, সরিষা-তিসি, ভুট্টা-বাদাম, ভুট্টা-মিষ্টি কুমড়া, পিঁয়াজ-তরমুজ, তিল-ছিটানো আউশ, এবং মরিচ-মূলা।  [মোঃ শহীদুল ইসলাম]

ফসলের পানি চাহিদা (Crop water requirement)  শস্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ। এটি মাটি, ফসল, জলবায়ুজনিত কারণ, স্থানীয় অবস্থা ও খামারের চাষ পদ্ধতির প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বীজের অঙ্কুরোদ্গম, চারার বৃদ্ধি ও অন্যান্য বৃদ্ধিবিষয়ক কর্মকান্ডের জন্য পানি অপরিহার্য। পানি উদ্ভিদের জলশূন্যতা রোধ করে এবং এর পুষ্টিবস্ত্ত ও সালোক-সংশ্লেষণ সৃষ্ট উপাদান পরিবহণ করে। উদ্ভিদের সক্রিয় বিপাকে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ কলা ও কোষের ৮০-৯০% পানি প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদে প্রবিষ্ট পানির সিংহভাগই বাষ্পাকারে নির্গত হয়ে যায়। নির্গত পানি প্রতিস্থাপনে ব্যর্থ হলে কোষের স্ফীতিহানি ঘটে, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং অবশেষে পানিশূন্যতার কারণে উদ্ভিদ মারা যায়। শস্যের ফলন (দানা বা শুষ্ক পদার্থ) শস্যের বাষ্পীভবন প্রস্বেদন (evapotranspiration/ET) চাহিদার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। মাটি ও উদ্ভিদপৃষ্ঠ থেকে পানির বাস্পীভবন এবং সেসঙ্গে উদ্ভিদ কলার মাধ্যমে পানির প্রস্বেদন ET-র অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে ET সরাসরি মাঠপর্যায়ে পরিমাপের মাধ্যমে (যেমন, লাইসিমিটার ট্যাঙ্ক, বাষ্পীভবন কড়াই ইত্যাদি) অথবা জলবায়ুগত ও শস্যে উপাত্তভিত্তিক হিসাব থেকে নির্ধারিত হয়। ক্ষেতে পানিসেচের উদ্দেশ্যে মোট পানির চাহিদা হলো ক্ষেত তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পানি, ফসলের ET চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় পানি ও অনুস্রাবণে (percolation) বিনষ্ট পানির পরিমাণের মোট যোগফল। পানির এই মোট পরিমাণকে ক্ষেতের পানির চাহিদা (FWR) হিসেবে গণ্য করা হয়। FWR এবং মোট ফলপ্রদ বৃষ্টিপাত ও মাটির আর্দ্রতা থেকে প্রাপ্ত পানির যোগফলের পার্থক্য হলো ক্ষেতের পানি সেচের চাহিদা (FIR) যা সেচ দ্বারা সরবরাহ করতে হয়। বাংলাদেশে পানিসেচের পরিকল্পনাসমূহ কখনও ১০০% কার্যকর নয়। ফলত পদ্ধতিগতভাবে বিনষ্ট ক্ষতিপূরণের জন্য পাম্প করে অতিরিক্ত পানির সংস্থান করতে হয়। এজন্য মোট পানিসেচ চাহিদা ক্ষেতের পানিসেচের চাহিদার চেয়ে বেশি হয়। অবশ্য, পানি-ঘাটতি ও অত্যধিক পানি উভয়ই শস্যের জন্য ক্ষতিকর।  [মোঃ হারুন-অর-রশিদ]

আরও দেখুন সেচ' সেচের আওতাধীন জমি

ফসলের বালাই দমন (Crop pest control)  অর্থনৈতিক, প্রতিবেশগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অনুকূল প্রভাব নিশ্চিত করে এমন বালাই দমন কার্যধারা নির্বাচন এবং তার ব্যবহার। এর মধ্যে রয়েছে বালাই বৃদ্ধির ব্যাপকতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা, বালাই দমন পদ্ধতি বাছাই করা, কীটপতঙ্গ বিনাশকারী দ্রব্যের সঠিক ব্যবহার অথবা কোন দমন কার্যের অনাবশ্যকতা কার্যকরভাবে জ্ঞাত করানো। কীটপতঙ্গ সৃষ্ট ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লভ্য কলাকৌশল প্রায় অশেষ এবং এর ভেতর রয়েছে ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তীর্ণ পরিসর। জটিলতার ক্রমবর্ধমান বিন্যাস অনুযায়ী সেগুলিকে সুবিধাজনকভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে যেমন উন্নততর চাষাবাদ, যান্ত্রিক, প্রাকৃতিক, জীবজ, রাসায়নিক, জীনতাত্ত্বিক এবং নিয়ন্ত্রণকারী পদ্ধতিসমূহ। বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং মোট জমির প্রায় ৬৪ শতাংশ ফসল উৎপাদনের আওতায় রয়েছে। দেখা গিয়েছে যে প্রায় ৭০০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ কৃষিজাত ফসলের ক্ষতিসাধন করছে, হয় সরাসরি ফসল খেয়ে, নতুবা ফসলের বিবিধ রোগ বিস্তারের মাধ্যমে।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, প্রতি বছর প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ফসল মাঠেই বিনষ্ট হয়ে যায় কীটপতঙ্গ সৃষ্ট উপদ্রবের কারণে। হিসাব করা হয়েছে যে, প্রতি বছর যে পরিমাণ ফসল নষ্ট হয় তা দেশে প্রতি বছর আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের দ্বিগুণের কাছাকাছি। অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র ও নিরক্ষর বিধায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং ফসল সংরক্ষণ প্রক্রিয়া তাদের জানা নেই। সার ও যথার্থ কীটনাশক লভ্য হলেও তা ক্রয়ের জন্য অর্থের সংস্থান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এছাড়াও প্রদর্শনী খামার অথবা প্রদর্শনী জমির অভাবের কারণে অধিকাংশ কৃষককেই আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় নি এবং তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মানো সম্ভব হয় নি যে পুরনো পদ্ধতির চেয়ে নতুন কলাকৌশল শ্রেয়। কৃষিকাজ সম্বন্ধে পরামর্শ দানের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের অভাব। যেহেতু ফসলের বালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে এখনও কীটনাশকের ব্যবহার সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রয়োগ কৌশল, তাই প্রায় প্রতি বছর ১৪,৩৪০ মে টন কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (Food and Agricultural Organisation-FAO) এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (Department of Agricultural Extension-DAE) যৌথভাবে বাংলাদেশে ৬৩টি জেলার ৭২টি থানায় সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শুরু করেছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিপুলসংখ্যক কৃষক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হচ্ছে এবং ফসলে বালাই নিয়ন্ত্রণের আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করছে। এর ফলে কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিতভাবেই সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে এবং তার পরিবর্তে প্রাকৃতিক বালাই দমনকার্য বৃদ্ধি পাবে।  [মোনাওয়ার আহমাদ এবং মাসুম আহমাদ]

আরও দেখুন কীটনাশক; কীটপতঙ্গ