ফারসি
ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে ইরানে। বর্তমান ইরান যে সভ্যতা ও কৃষ্টির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা প্রধানত ইলামি (Elamite) সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের প্রথমভাগে দক্ষিণ ইরানে এই সভ্যতার পত্তন হয় বলে মনে করা হয়। ইরানের বর্তমান অধিবাসীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আর্য বংশোদ্ভূত। আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মধ্য এশিয়ার সমভূমি থেকে ইরানে অভিবাসন শুরু করে বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। ওই এলাকার আদিবাসী এবং অভিবাসিত আর্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও মেলামেশার ফলে একটি নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। এই নতুন ভাষাটিই ফারসি ভাষা। এ ভাষা চারটি পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে: আবেস্তা, প্রাচীন ফারসি, পাহলভি ও আধুনিক ফারসি।
আবেস্তা Zoroasterian ধর্মমতের প্রবক্তা ইরানের আদি ধর্মগুরু Zoroaster (খ্রি.পূ ১১০০) কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মগ্রন্থ কিতাবে আবেস্তার ভাষা। উত্তর ইরানের মিডিয়া এলাকায় এ ভাষার উৎপত্তি। কিতাবে আবেস্তার পাঁচটি অংশ। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন অংশ ‘গাথা’ নামে পরিচিত এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে এটি মোটামুটিভাবে ঋগ্বেদের সম পর্যায়ের। আবেস্তার অবশিষ্ট অংশগুলি পরবর্তী সময়ের এবং সেগুলির বিষয়বস্ত্ত বিভিন্ন সময়ে লিখিত হয়েছে। প্রথমদিকে আবেস্তা ছিল মৌখিক ভাষা; পরে লিখিত আকারে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় এবং তখন এটি একটি মৃত ভাষায় পরিণত হয়।
প্রাচীন ফারসি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালের দিকে হাখামানশিদের যুগে ইরানে এ ভাষার প্রচলন ছিল। এ ভাষা সাংকেতিক মিখ বা পেরেক আকৃতির চিহ্ন বিশেষের মাধ্যমে লেখা হতো। ভাষাটি কেবল রাজকীয় নির্দেশাবলি প্রচারের কাজেই ব্যবহূত হতো, কারণ স্বল্পসংখ্যক লোক এর পাঠ জানত। বিসতুন পর্বত ও নাকশে রোস্তমের পাথরে এবং পারসিপোলিস প্রাসাদের দেয়াল ও স্তম্ভে খোদাই করা শিলালিপিতে এ ভাষার কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ ভাষা আবেস্তার কাছাকাছি এবং এতে রয়েছে উচ্চ পর্যায়ের শব্দরূপ ও স্বরবিভেদ; তাছাড়া ব্যাকরণগত দিক থেকে সংস্কৃত ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য প্রাচীন ভাষাসমূহের সঙ্গে এর অনেকাংশে সাদৃশ্য রয়েছে।
পাহলভি আশকানিযুগে (খ্রি.পূ ২৪৯-২২৬) পাহলভি বা মধ্য ফারসি নামে ইরানে আর একটি ভাষার উদ্ভব ঘটে। এটি মূলত আবেস্তা ও প্রাচীন ফারসির বিবর্তিত রূপ। পরবর্তীতে সাসানিদের রাজত্বকালে (খ্রি.পূ ২২৬-৬৫২) এ ভাষার উচ্চারণ ও আঙ্গিকগত উৎকর্ষ সাধিত হয়। এভাবে আশকানি ও সাসানিদের রাজত্বকাল মিলে প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী এ ভাষা ইরানে প্রচলিত ছিল। আশকানি যুগে পাহলভি ভাষায় কিছু গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু দুচারটি ছাড়া সেগুলির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রাচীন ইরানের ইতিহাসে সাসানিদের রাজত্বকালকেই স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। এ যুগে ইরানের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভূত উন্নতি লাভ করে। এরাই প্রথমে গ্রিক ও ভারতীয় মূল্যবান বইপত্র পাহলভি ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করে। স্মরণীয় যে, বিখ্যাত সাসানি সম্রাট নওশেরওয়ান ভারতের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ পঞ্চতন্ত্র পাহলভি ভাষায় অনুবাদ করান। পরবর্তীকালে সামানিযুগের (৮৭৪-৯৯৮ খ্রি) প্রসিদ্ধ অন্ধ কবি রুদাকি এর কাব্যানুবাদ করেন।
পাহলভি ভাষায় বেশকিছু রম্যরচনা, ঘটনাপঞ্জি, ছোটগল্প, কবিতা, গান ইত্যাদি রচিত হয় এবং পরবর্তীতে ফারসি কবিরা সেগুলির কিছু কিছু আধুনিক ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ খসরু ও শিরীন, রোস্তমনামা, বাহরামনামা, ইস্কান্দারনামা ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও সাসানিযুগের পাহলভি ভাষায় রচিত হেজার দাস্তান (হাজার কাহিনী) কাব্যটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং পরে আলফা-লাইলা ওয়া লাইলা (এক হাজার এক রজনী) নামে সেটি আরবি ভাষায় অনূদিত হয়।
আধুনিক ফারসি শেষ সাসানি সম্রাট ইয়াযদগারদ ৩য় (৬৬৪-৬৫২ খ্রি)-এর রাজত্বকালে মুসলমানগণ কর্তৃক ইরান দখলের পর ইরানের জনগণ বিপুলভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ফলে আরবি ভাষার প্রভাবে পাহলভি ভাষা ক্রমান্বয়ে ফারসিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। এভাবেই পাহলভি ভাষার ন্যায় পাহলভি সাহিত্যের অনেক গ্রন্থও বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এক সময় আরব ভাষাবিদগণ পাহলভি বর্ণমালাকে আরবি বর্ণমালার ধাঁচে পরিবর্তন করেন। কয়েকটি বর্ণের আরবি প্রতিবর্ণ না থাকায় অতিরিক্ত বিন্দু/চিহ্ন প্রয়োগে উক্ত বর্ণগুলি তৈরি করা হয়। যেমন আরবি ‘বে’ হরফের নিচে দুটি বিন্দু দিয়ে ‘পে’, ‘জিম’-এর পেটে দুটি বিন্দু দিয়ে ‘চে’, ‘যে’ হরফের উপরে দুটি বিন্দু দিয়ে ‘ঝে’ এবং ‘কাফ’ হরফের উপরে একটি সোজা রেখাচিহ্ন বসিয়ে ‘গাফ’ বর্ণ তৈরি করা হয়। এভাবেই পাহলভি বর্ণমালা ও ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ফারসি বর্ণমালা ও আধুনিক ফারসি ভাষার উদ্ভব ঘটে।
বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই ইরান ও বাংলা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। ভারতের নৌবন্দরসমূহ, যেমন: দেবল, নিরুন, সুপারাকা, বাড়িগাজা, টাগারা, মুজিরিস, নেলকিনডা, আরিয়েক, তাম্রলিপ্তি, গাঙ্গে, সাপ্তগ্রামা (সাতগাঁও/সপ্তগ্রাম), সরন্দিপ ইত্যাদি থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরণের নৌযান পারস্য উপসাগরের উবুলা, ওমানা, ইউডেইমন, সিরফ, কাইস, হরমুজ, সকোট্রা এবং গেড্রসিয়া উপকূল অতিক্রম করত। বাংলার প্রাচীন নৌবন্দরসমূহ, যেমন: তাম্রলিপ্তি, গাঙ্গে এবং সাপ্তগ্রামা তৎকালীন বাংলার নৌব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এসব বন্দর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দেশসমূহের ব্যবসায়ী ও নাবিকদের আকৃষ্ট করত। বাংলার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও গ্রেকো-রোমান বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে খ্রিস্টীয় অব্দের শুরু থেকেই তাম্রলিপ্তির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ফলে বাংলার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও ইরানের কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্কই নয়, সাংস্কৃতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। ইরানি বণিক ও বাণিজ্যপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যবাহিনী, প্রকৌশলী, কারিগর, সুফি, দরবেশ এবং শিল্পীদেরও আগমন ঘটে বাংলায়। এ ধরনের সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে রাজদরবার, সমাজ ও শিল্পসাহিত্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই ফারসি ভাষার চর্চা ও ইসলাম প্রচার শুরু হয়। ইরান থেকে আগত সুফি-দরবেশগণ সৈনিক, ব্যবসায়ী ও রাজপুত্রদের কাফেলার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়ে জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে এবং কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে জানতে গিয়ে আরবি ও ফারসি ভাষার চর্চা করে। সুফিরা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি সম্পর্কে অসংখ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যা এতদঞ্চলে ফারসি ভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
মুসলিম শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সুলতানি যুগ (১২০৩-১৫৭৬) যদিও বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ফারসি ভাষার বিস্তার ও উন্নয়নে ইরানি বণিক ও সুফিদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল, কিন্তু উপমহাদেশব্যাপী ফারসির দ্রুত বিস্তার লাভ ঘটে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফারসি স্বীকৃত হওয়ার পরই। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট কুতুবউদ্দীন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া ও গৌড় জয় করেন। পরবর্তীতে তিনি সমগ্র উত্তর বাংলা অধিকার করেন। বাংলায় এই মুসলিম শাসন সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহকে পাল্টে দেয়। বাংলার অধিকাংশ জনগণ, বিশেষত পূর্ব বাংলার জনগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব কমতে থাকে এবং ফারসি মুসলিম রাজদরবারের ভাষা হওয়ায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বাংলার যেসব জায়গায় ইসলামের অনুসারীরা বসতি স্থাপন করে, সেসব জায়গায় ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং এ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক মসজিদ, মকতব ও মাদ্রাসা। ফলে আরবি ও ফারসি সাহিত্যের উন্নয়নের একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ধর্মীয় ও লোকায়ত উভয় ধরনের ফারসি গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন শাসকগণও লেখক ও কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। তৎকালীন বিখ্যাত শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের মধ্যে গৌড়, পান্ডুয়া, দারাসবাড়ি, রংপুর, সোনারগাঁও, ঢাকা, সিলেট, বগুড়া এবং চট্টগ্রামের কেন্দ্রসমূহ ছিল উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্নে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০,০০০।
ছয়শত বছরেরও অধিককালব্যাপী (১২০৩-১৮৩৭) ফারসি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। এই দীর্ঘ সময়ে হাজার হাজার ফারসি গ্রন্থ রচিত হয়েছে; অসংখ্য কবি ফারসি ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। সেসব সাহিত্যকর্ম পান্ডুলিপি অথবা গ্রন্থের আকারে বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে উনিশ শতকের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত সুলতানুল আখবার ও দুরবীন-সহ পাঁচ-ছয়টি ফারসি দৈনিক কলকাতা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো, যা এতদঞ্চলে ফারসি ভাষার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।
সমরকান্দের বিখ্যাত হানাফি ফিক্হ (ইসলামি আইন) শাস্ত্রবিদ ও সুফি কাজী রুকনউদ্দীন আবু হামিদ মোহাম্মাদ বিন মোহাম্মাদ আল-অমিদী সংস্কৃত ভাষায় লিখিত অমৃতকুন্ড গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এটিই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষায় অনূদিত প্রথম সাহিত্যকর্ম। অমৃতকুন্ড একটি যোগশাস্ত্র। এতে ১০টি অধ্যায় ও ৫০টি শ্লোক আছে।
গৌড়ের গভর্নর নাসিরউদ্দীন মাহমুদ বগরা খান (১২৮৩-১২৯১) ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের একজন উদার পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সভাকক্ষ ছিল প্রসিদ্ধ কবিদের মিলনস্থল। তাঁর শাসনামলে অনেক কবি-সাহিত্যিক, যেমন শামসুদ্দীন দবীর ও কাজী আছীর দিল্লি থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা ফারসি ভাষার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
বিহারের প্রসিদ্ধ সুফি শেখ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মুনইয়ারীর শ্বশুর এবং শিক্ষক বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা ১২৮২-৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে আগমন করেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের জন্য একটি মাদ্রাসা এবং শিষ্যদের জন্য একটি খানকাহ্ স্থাপন করেন, যা ছিল তৎকালীন সময়ে জ্ঞানার্জনের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। আধ্যাত্মিক বিষয়াবলি নিয়ে রচিত তাঁর মাকামাত গ্রন্থটি তাঁর জীবদ্দশাতেই অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করে।
নাসিরউদ্দীন বগরা খানের পুত্র রুকনুদ্দীন কায়কাউসের রাজত্বকালে (১২৯১-১৩০১) তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে ফিক্হ বিষয়ে নামে-এ-হক নামে ফারসি ভাষায় একটি গ্রন্থ রচিত হয়। গ্রন্থটি দশ খন্ডে বিভক্ত এবং এতে ১৮০টি কবিতা স্থান পায়। এটি শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার রচনা বলে কথিত হলেও লেখকের ভূমিকা থেকে জানা যায় যে, মূলত এটি তাঁর একজন শিষ্য তাঁর শিক্ষামূলক বক্তব্যের আলোকে সম্পাদনা করেন।
সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের শাসনামলে (১৩৯০-১৪০৯) সোনারগাঁও লেখক ও ফিক্হ শাস্ত্রবিদদের প্রসিদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তখন এত অধিক পরিমাণে ফারসি গদ্য ও কাব্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটে যে, সম্ভবত এটাই ছিল বাংলায় ফারসি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ।
সুফি কবি হাফিজ শিরাজী রচিত একটি গজল থেকে তৎকালীন বাংলায় ফারসি সাহিত্যের উৎকর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়। সুলতান গিয়াসুদ্দীন একটি গজল রচনা করতে গিয়ে প্রথম শ্লোকের অর্ধেক রচনার পর অবশিষ্ট অংশ লিখতে অসমর্থ হওয়ায় এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য হাফিজের নিকট প্রেরণ করেন এবং তাঁকে বাংলাদেশ সফরেরও আমন্ত্রণ জানান। উত্তরে কবি এরূপ জবাব দেন: ‘সাগ্বি হাদিছে সার্ভ ও গুল ও লালেহ্ মি রাভাদ/ ভীন বাহাছ বা সালাসা গ্বাচছালা মি রাভাদ/ শেকার শেকান শাভান্দ হামে তোতিয়ানে হিন্দ/ যীন কন্দে পারেছি বেহ্ বাংগালেহ্ মি রাভাদ\’ [সাকি! সার্ভ, গুল ও লালার আলোচনা চলছে/ তিন ধৌতকারী (পান পেয়ালা)সহ এ আলোচনা চলছে/ হিন্দুস্থানের সকল তোতা পাখি (কবিগণ) ঠোঁট দিয়ে মিছরিদানা ভাঙছে/ (হাফিজের পঙ্ক্তিমালার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠছে)/ যে, ফারসির এই মিছরিখন্ড (ফারসি গজল), বাংলায় যাচ্ছে\]
সুলতান জালালউদ্দীন মোহাম্মাদ শাহ (১৪১৫-১৪৩২) ছিলেন ইসলামি জ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি মক্কায় প্রতিষ্ঠিত একটি মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করতেন, যা তখন অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হতো। সুলতান রুকনুদ্দীন বরবক শাহের দরবার (১৪৫৯-১৪৭৪) অসংখ্য বিদ্যানুরাগীর উপস্থিতি দ্বারা মহিমান্বিত ছিল। তাঁদের মধ্যে রাজসভার কবি আমির জয়নুদ্দীন হারাবী, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও ফারহাঙ্গে আমির শিহাবুদ্দীন কিরমানী শীর্ষক ফারসি অভিধানের সম্পাদক আমির শিহাবুদ্দীন হাকিম কিরমানী এবং কবি মনসুর শিরাজী, মালিক ইউসুফ বিন হামিদ, সাইয়্যেদ জালাল, সাইয়্যেদ মোহম্মাদ রুকন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এ যুগেই মাওলানা ইব্রাহীম কাওয়াম ফারুকী উপমহাদেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীনতম ফারসি অভিধান ফারহাঙ্গে ইব্রাহিমী সম্পাদনা করেন। অভিধানটি বিহারের প্রখ্যাত সুফি মখদুম শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মুনইয়ারীর স্মরণে উৎসর্গ করা হয়; তাই এটি ‘শরফনামা’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। এটি এঅঞ্চলে ফারসি চর্চার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
হুসেন শাহী রাজত্বকালে, বিশেষত আলাউদ্দীন হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) সময়ে ফারসি ও আরবির ব্যবহার এঅঞ্চলে ব্যাপক বিস্তারলাভ করে। মোহাম্মাদ বুদাই, যিনি সাইয়্যেদ মীর আলাভী নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন, এ যুগেই সাহিত্যসাধনা করেন। তিনি হিদায়াত-উর-রুমী নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলার সুলতানি যুগে (১২০৩-১৫৭৬) অত্র এলাকার জনহিতৈষী ও সংস্কৃতিমনা সুলতানগণ এভাবেই পরবর্তীকালে এঅঞ্চলে ফারসি চর্চার ব্যাপক ভিত্তিভূমি রচনা করেন।
মুগল আমল এ আমলে বাংলায় ফারসি সাহিত্য অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি লাভ করে এবং স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় যেসব মুগল গভর্নরের দরবারে জ্ঞানী, পন্ডিত ও সম্মানিত ব্যক্তিবগের্র নিয়মিত উপস্থিতি ছিল, সমকালীন ও পরবর্তীকালের ঘটনাপঞ্জি এবং জীবনী-রচয়িতৃগণ তাঁদের উল্লেখ করেছেন। তাঁরা হলেন মুনিম খান, ইসলাম খান, কাসিম খান, শাহ শুজা, শায়েস্তা খান এবং মীর জুমলা। এই শাসকগণ ফারসি কবিতার উন্নয়নে উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা পালন এবং অনেক কবিকে আশ্রয় প্রদান করেন।
মীর্জা জাফর বেগ কাজভীনি অপর একজন কবি যিনি বাদশাহ আকবরের যুগে বাংলায় অভিবাসিত হন। তিনি ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামী গান্জাভীর কাব্যরীতির অনুকরণে শিরিন ও খসরু নামে একটি মসনভি রচনা করেন। একজন সাধারণ সামরিক কর্মকর্তা মীর্জা নাথান বাহরিস্তানে গাইবী শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি এমন অনেক সৈনিক-কবির উল্লেখ করেন যাঁরা যুদ্ধে বিজয় ও সৈনিকদের কৃতিত্বকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কবিতা রচনা করতেন। তাঁদের মধ্যে লোকমান, মীর কাসিম এবং মোবারক উল্লেখযোগ্য।
মীর্জা নাথান প্রায় বিশ বছর বাংলায় চাকরি করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাংলা ও আসামে সংঘটিত ঘটনাসমূহের পরিপূর্ণ বর্ণনা উপস্থাপন করেন। ইরানের ইসফাহান থেকে আগত মীর জুমলা ছিলেন একজন পন্ডিত ও কবি। তাঁর কুল্লিয়াত-এ (কবিতা সংগ্রহ) ২০,০০০ পঙ্ক্তি স্থান পেয়েছে। মীর জুমলার ঘটনাপঞ্জির লেখক ছিলেন শাহাবুদ্দীন তালিশ। তিনি মীর জুমলার কুচবিহার ও আসাম অভিযানে সহযাত্রী ছিলেন এবং ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে ফাত্হে ইব্রিয়া নামে আসামে সংঘটিত ঘটনাবলির প্রকৃত বিবরণ-সম্বলিত একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান কাসিম খানকে বাংলার গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন। ঐতিহাসিক এবং জীবনচরিত-বিষয়ক গ্রন্থ সুব্হে সাদিক-এর লেখক মুহাম্মাদ সাদিকও কাসিম খানের সঙ্গে বাংলায় আগমন করেন। সুব্হে সাদিক-এ জাহাঙ্গীরনগরে বসবাসকারী অনেক ফারসি লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তাঁদের কাব্যকর্মের উদ্ধৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব লেখক ও কবির অধিকাংশই ছিলেন পেশাগতভাবে সৈনিক। পাদশাহনামা গ্রন্থের লেখক আব্দুল হামিদ লাহোরী তাঁকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতিমূর্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়াও তাঁর মতে তিনি ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা ও অঙ্কশাস্ত্রে সমকালীন পন্ডিতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতার অধিকারী ছিলেন। মীর মুহাম্মাদ মাসুম ছিলেন মুগল যুগের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক। তিনি শাহ শুজার পৃষ্ঠপোষকতায় তারিখে শাহ শুজায়ী শীর্ষক একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে মুর্শিদকুলি খান বাংলায় স্বাধীন সুবেদারি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে অসংখ্য কবি ও লেখক বিবাদ-বিসম্বাদপূর্ণ ইরান ও উত্তর ভারত থেকে বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদে আগমন করেন। অধিকন্তু মুর্শিদাবাদ পূর্ববাংলা, বিশেষত ঢাকা থেকেও বেশকিছু সংখ্যক কবি ও বুদ্ধিজীবীকে আকৃষ্ট করেছিল। ১৭৯৬ থেকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নুসরাত জঙ্গ ঢাকার নওয়াব নাজীম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ফারসি ভাষায় তারিখে নুসরাতজঙ্গী গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশযুগে ফারসিচর্চা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম শতকব্যাপী প্রভাবশালী ভাষা হিসেবে ফারসির ব্যবহার অব্যাহত থাকে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইহতেসামুদ্দীন ক্যাপ্টেন আরকিবাল্ড সুইনের সঙ্গে ভ্রমণ করেন এবং তাঁর সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি শিগুরফনামায়ে বেলায়েত গ্রন্থে ফারসি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। এ যুগের অপরাপর ফারসি গ্রন্থের মধ্যে গোলাম হুসাইন তাবাতাবাঈ রচিত সয়ারুল মোতাআখ্খেরিন (১৭৮৩), গোলাম হুসাইন সেলিম রচিত সেরাজ-উস্সালাতীন (১৭৮৭) এবং মুনশি সলিমুল্লাহর তারিখে বাংগালা (১৭৬৩) উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সমাজে ফারসির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইংরেজ সরকার এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পরও সুদীর্ঘ ৮০ বছর (১৭৫৭-১৮৩৭) ফারসিকেই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়।
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘হান্টার-শিক্ষা-কমিশন’-এ সাক্ষ্যদানকালে আরবি-ফারসির তৎকালীন সামাজিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩) বলেন যে, আরবি-ফারসিতে পন্ডিত না হলে কোন মুসলিম পন্ডিতকে প্রকৃত পন্ডিত বলে মনে করা হয় না এবং মুসলিম সমাজে তাঁর মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয় না। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ঢাকায় ফারসিচর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আগা আহমদ আলীর নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মুয়াইয়্যাদে বোরহান ও শামশীরে তীযতার শীর্ষক ফারসি অভিধান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এ দুটি অভিধান অদ্যাবধি উপমহাদেশে ব্যবহূত হয়ে আসছে। তাঁর অপরাপর রচনার মধ্যে রিসালায়ে তারানা এবং হাফ্ত আসমান উল্লেখযোগ্য। খাজা হায়দার জান শায়েককে মীর্জা গালিব ‘বুলবুলে বাংলাদেশ‘ (বাংলাদেশের বুলবুলি) বলে অভিহিত করতেন। ফারসি ভাষায় তাঁর একটি দীভান (কবিতা সংকলন) ও একটি পত্রসংকলন পাওয়া যায়।
ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত ফারসি লেখক হলেন তারিখে কাশমিরিয়ানে ঢাকা-র লেখক খাজা আবদুর রহীম সাব, খাজা আহসানুল্লাহ শাহীন, মীর্জা মাহমুদ শীরাজী মাখমুর যিনি আকর্ষণীয় ফারসি ভাষায় ঢাকার ঐতিহাসিক ইমামবাড়ার ইতিহাস রচনা করেন, পদ্য ও গদ্য রচনায় দক্ষ মৌলবি আবু মুহম্মদ আবদুল গফুর নাস্সাখ, যাঁর প্রধান কর্ম ফারসিতে লিখিত ফারসি কবি-সাহিত্যিকদের জীবনীগ্রন্থ তাযকেরাতুল মোআছেরীন এবং সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ বাকের তাবাতাবাঈ যিনি ইরান থেকে বাংলায় অভিবাসিত হয়ে ঢাকায় বসবাস করেন এবং এখানেই ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে হোসেইনি দালানে সমাহিত হন। তাবাতাবাঈর দীভান ও প্রশস্তিগাথাসমূহের প্রতি সাহিত্য-সমালোচকগণ অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন। ঢাকার অপরাপর ফারসি কবিদের মধ্যে আবদুল মামুন জওকী, মুনশি ওয়ারিস আলী জিয়া, আগা মাহমুদ আলী, মসিহুদ্দীন শোরিশ, কাজীমুদ্দীন সিদ্দিকী, মাওলানা ফজলুল করিম, শাহ বোরহানুল্লাহ, মুনশি জালালুদ্দীন এবং মোয়াজজামুদ্দীন সাঈদ উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহ্রাওয়ার্দী (১৮৩৪-১৮৮৫) ফারসি ভাষায় কাব্যচর্চা করতেন। ফারসি ভাষায় রচিত তাঁর কাব্যসংকলন দীভানে উবায়দী নামে খ্যাত। ভাব, বিষয়বস্ত্ত ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে তাঁর কবিতায় সাদী, হাফিজ, জামী, সায়েব, নাজিরি ও গালিবের প্রভাব রয়েছে। তাঁর দাস্তানে ফার্সি অমুয শীর্ষক পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত গ্রন্থটি একটি আদর্শ ফারসি ব্যাকরণ। ঢাকার অপর একজন সম্ভ্রান্ত গবেষক হাকিম হাবিবুর রহমান ফারসি শিক্ষার বিস্তার ও প্রসারের সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সালাসায়ে গাস্সালা শীর্ষক ফারসি কবি-সাহিত্যিকদের জীবনীগ্রন্থে তৎকালীন বাংলায় রচিত ১৭৩টি সাহিত্যকর্মের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামও ছিল ফারসি সাহিত্যচর্চার একটি কেন্দ্র। চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ফারসি লেখকদের মধ্যে মাখ্যানুল আদভিয়ার লেখক হাকিম মুহাম্মাদ হুসাইন আলাভী এবং খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ প্রসিদ্ধ ছিলেন। হামিদুল্লাহর অহাদিসুল খাওয়ানীন ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের অন্যান্য ফারসি কবিদের মধ্যে সন্দ্বীপের মাওলানা আবদুল আউয়াল, মুহাম্মাদ আবদুল আলী, মৌলবি ফায়জুল কবির শাওক, মৌলবি ফায়জুল্লাহ ইসলামাবাদী, মুহাম্মাদ সোলায়মান আরমান এবং আবদুল আলী দুররী উল্লেখযোগ্য।
মধ্যযুগে ফারসি ভাষাভাষী মুসলিম মিশনারিদের প্রধান কেন্দ্ররূপে সিলেট সমৃদ্ধি লাভ করে এবং ফারসি চর্চার প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সেখানকার লেখকদের মধ্যে মা‘দানূল ফাওয়ায়েদ গ্রন্থের লেখক সাইয়্যেদ শাহ ইসরাইল, জারাউল মুসান্নিফ গ্রন্থের লেখক বানিয়াচঙ্গের মুহাম্মাদ আরশাদ এবং গুলে বকাওলী মসনাভী ও খোয়াবনামা গ্রন্থদ্বয়ের লেখক পেইলের প্রসিদ্ধ ফারসি কবি সাইয়্যেদ রায়হানউদ্দীন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফারসি ভাষার উন্নয়নে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অবদানও উল্লেখযোগ্য। রাজাপুরের কাজী পরিবার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। খানবাহাদুর আবদুল গফুর নাস্সাখ ছিলেন এ পরিবারের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর ফারসি সাহিত্যে অবদান সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর পিতা কাজী ফকির মোহাম্মাদ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক বিষয়ে লিখিত জামিয়ুত্তাওয়ারিখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ফকির মুহাম্মাদের অপর দুই পুত্র আবদুল হামিদ এবং আবদুল বারিও কবি ছিলেন।
আবু মুঈন আযদুদ্দিন আযুদ, শাহ সাইয়্যেদ রিয়াজাতুল্লাহ, নাসিরউদ্দিন আহমাদ, শামসুদ্দিন শামসাম এবং আশরাফুদ্দিন শার্ফ ছিলেন কুমিল্লার প্রথম সারির ফারসি কবিদের অন্তর্ভুক্ত। বরিশালে মুহাম্মাদ ফাজিল, এলাচিরাম ও তালেব এবং ময়মনসিংহে সাইয়্যেদ নাজমুদ্দিন আহমাদ নাদির ও মুহাম্মাদ আবদুল হাই আখতারের ন্যায় কবিদের আবির্ভাব ঘটে। সাইয়্যেদ আবদুর রশিদ শাহজাদপুরী পাবনার একজন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী এবং সুফি মানসের অধিকারী ছিলেন। তিনি খাকানি ও উরফির ন্যায় ইরানি কবিদের অনুকরণে আকর্ষণীয় ফারসি কাসিদা রচনায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন ও আধুনিক গ্রন্থাগার স্থাপিত হওয়ায় ফারসি চর্চা প্রসার লাভ করে। পূর্বের ন্যায় এ শতকেও মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু রাজা-মহারাজারা ফারসি সাহিত্য চর্চায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও হিন্দুধর্মের সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ফারসি ভাষায় তাওহীদ বিষয়ে তোহফাতুল মুওয়াহিদীন নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এতদঞ্চলে ফারসির গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট একটি অধ্যাদেশ (No. XXIX, 1837 AD) জারির মাধ্যমে অফিস-আদালত তথা রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে ফারসির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। উক্ত অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে তখন কলকতার মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে প্রায় আট হাজার স্বাক্ষরসম্বলিত একটি স্মারকলিপি ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করা হয়। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকেও ৪৮১জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরসম্বলিত অনুরূপ আর একটি স্মারকলিপি ঢাকার বিচারপতি জে.এফ.জি কুকের মাধ্যমে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের নিকট পেশ করা হয়। লক্ষণীয় যে, স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ১৯৯ জন ছিলেন হিন্দু। কিন্তু এসব স্মারকলিপি ইংরেজ সরকারের গৃহীত নীতিতে কোনোরূপ পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। কলকাতা ও ঢাকার বহু সংখ্যক পদস্থ ও সম্মানিত ব্যক্তির দাবি উপেক্ষা করে সরকারের ঘোষণা কার্যকর করা হয়। এসব সত্ত্বেও এ এলাকায় ফারসিচর্চা অব্যাহত ছিল। শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান জনগণ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিষয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালু থাকে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ও উর্দু বিভাগ চালু হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ফারসি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ্য ছিল। বর্তমানে সাধারণ স্কুল পর্যায়ে ফারসি পড়ানো না হলেও ঐতিহ্যগত ভাষা ও সাহিত্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমকালীন ভাষা হিসেবে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পাঠ্যসূচিতে ফারসি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশ এমনকি ভারতের প্রায় সকল সাধারণ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গ্রন্থাগারসমূহে ফারসি পান্ডুলিপি রয়েছে। প্রতিবছর এসব পান্ডুলিপির কিছু কিছু গবেষকগণ প্রকাশ করে থাকেন।
বাংলা সাহিত্যে ফারসির প্রভাব ফারসি ভাষাভাষী তুর্কি আফগান বিজয়িগণ বাংলাকে তাঁদের নতুন আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে একটি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কাল সূচিত হয়। এ বিবর্তনকাল পরবর্তী সাতশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরিণতিতে বাংলা ভাষা শাসকদের শক্তিশালী ভাষার প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মুসলিম কবি ও লেখকগণ মৌলিক বাংলা সাহিত্য রচনা বা ইসলামি বিষয়াবলি বাংলা ভাষায় অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন। এ কারণেই বাংলা ভাষায় অসংখ্য ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলমান লেখকগণ প্রচলিত ধারাকেই আত্তীকরণ করেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষে অনৈসলামিক প্রভাব দূর করার জন্য কিছু কিছু সংযোজন ও পরিবর্তনও করেন। উদাহরণস্বরূপ মুসলমান কবিরা মঙ্গলকাব্যে প্রচলিত হিন্দু দেবদেবীর বন্দনা ও গুণকীর্তন রীতির পরিবর্তে মুসলিম রীতি, বিশেষত ইরানের ঐতিহ্য অনুযায়ী হামদ্ ও নাত্-এর প্রচলন করেন। একইভাবে দৌলত কাজী (১৬০০-১৬৩৮) বা আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) যখন হিন্দু রাজপুত্রের কাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করেন, তখনও তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রশস্তিমূলক কবিতার মাধ্যমে শুরু করেন।
ফারসি ভাষাদ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত মুসলমান লেখকদের সাহিত্য ‘দোভাষী সাহিত্য’ নামে পরিচিত। এগুলি মূলত বাংলা ও ফারসির সমন্বয়ে এক প্রকার মিশ্র সাহিত্য। মুসলমানদের ধর্ম, সমাজ বা দর্শন বিষয়ে কোনো কিছু লেখার ক্ষেত্রে আজও এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। একারণে দোভাষী সাহিত্যে যখনই মুসলিম রাজসভার বর্ণনা এসেছে বা মুসলিম রাজাকে সম্বোধন করা হয়েছে অথবা ইসলামি চিন্তা, আদর্শ এবং কুরআন ও অন্যান্য পবিত্র গ্রন্থ কিংবা মুসলিম সুফি-দরবেশ ও বিদ্বান ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তখনই আরবি ও ফারসি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের কবিরাই এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪১০) দরবারের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর ধর্মীয় গ্রন্থাবলিকে ‘কিতাব’ এবং বিদ্বান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের ‘আলিমান’ বলে সম্বোধন করেছেন। সরদার জয়েনউদ্দীন তাঁর রসুলবিজয় কাব্যেও এ ধরনের শব্দ ও বাগ্বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ করেছেন। তিনি মুকুটের স্থলে ‘তাজ’, আরোহীর স্থলে ‘সোয়ার’ এবং পিতামহের স্থলে ‘দাদা’ ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে এ পদ্ধতি আরও ব্যপকতা লাভ করে যেমন, সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) তাঁর শবে মেরাজ কাব্যগ্রন্থে কিতাব, আলিমান ও আলিম ছাড়াও আল্লাহ, রাসুলে খোদা, নূরে মোহাম্মাদী, পীর পয়গমতর ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এছাড়া ক্রিয়াপদ হিসেবেও তিনি এসব শব্দ প্রয়োগ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ তাঁর নবীবংশ ও ওফাতে রাসূল গ্রন্থদ্বয়ে ‘নিকালিয়া’ শব্দের উল্লেখ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিকালিয়া শব্দটি বাইরে যাওয়া অর্থে ব্যবহূত হয়েছে।
দোভাষী সাহিত্যের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর কাহিনী গভীর ভালবাসা, অদম্য সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ। শাহ্ গরীবুল্লাহর ইউসুফ-জুলেখা ও আমীর হামজা (১ম খন্ড) এই শ্রেণির প্রথম সার্থক কাব্য। এই ধারার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেন সৈয়দ হামজা। হামজা তাঁর মধুমালতী কাব্য প্রথাগত ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতেই রচনা করেন; কিন্তু তাঁর জৈগুনের পুথি ও হাতেম তাই রচনায় ফারসি ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। দোভাষী পুথিসাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে শাহ্ গরীবুল্লাহ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
রোম্যান্টিক রচনাবলি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফারসি প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে লৌকিক প্রেমকাহিনীমূলক রোম্যান্টিক ক্ষেত্রটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারার উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যে ফেরদৌসী/জামীর কাব্য অবলম্বনে রচিত ইউসুফ-জুলেখার লেখক শাহ মুহাম্মদ সগীর, লাইলী-মজনুর লেখক দৌলত উজির বাহরাম খান, সতীময়না-লোরচন্দ্রানীর লেখক আরাকানের দৌলত কাজী, পদ্মাবতী, সয়ফুলমূলূক-বদিয়ুজ্জমালের লেখক আলাওল, ইউসুফ-জুলেখার লেখক আবদুল হাকিম, মৃগাবতীর লেখক কোরেশী মাগন ঠাকুর, আমীর হামজার লেখক আবদুন নবী, জঙ্গনামার লেখক হেয়াত মামুদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
বীরত্ব গাথা এ ধরনের কাব্যে মহানবী (স.), তাঁর সাহাবিগণ এবং মুসলিম বীরদের রোম্যান্টিক, কাল্পনিক ও অলৌকিক ঘটনা অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। এসব কাব্য ইসলামি অনুশাসন ও বিধিবিধানকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার ও মুসলিম বীরদের মহিমান্বিত করার উদ্দেশ্যে রচিত। এ কারণে এগুলিকে অবিশ্বাসী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মহানবী (স.)-র বিজয়ের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। জয়েনউদ্দীনের রসুলবিজয় এ কাব্য ধারার প্রচীনতম সৃষ্টি। জয়েনউদ্দীন প্রবর্তিত রীতির অনুসরণেই শাহ বিরিদ খান রসুলবিজয় এবং হানিফার দিগ্বিজয় রচনা করেন। এছাড়াও সৈয়দ হামজার আমীর হামজা, হেয়াত মাহমুদ ও গরীবুল্লাহ্র জঙ্গনামা, মোহাম্মদ খানের হানিফার লড়াই এবং সৈয়দ সুলতানের রসুলবিজয় এই একই রীতিতে রচিত।
ঐতিহাসিক কাব্য এ ধারার প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি হলেন চট্টগামের সৈয়দ সুলতান। নবীবংশ কাব্যে তিনি রসুলের জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে তাঁর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের কারবালায় শাহাদত বরণ করা পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বর্ণনা দিয়েছেন। পূর্বে মুহম্মদ খানও মাকতুলে হোসেন শিরোনামে একটি কাব্য রচনা করেন। ইমাম হোসেনের শাহাদতের ঘটনা এ গ্রন্থের মূল বিষয়। সমগ্র কাহিনীই কারবালার হূদয়বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়েছে। কায়কোবাদের মোহাররম শরীফ এ ধারার প্রাচীনতম গ্রন্থ। ইমাম হোসেনের শাহাদতকে অনুসরণ করে এতে একটি মর্সিয়া (শোকসঙ্গীত) স্থান পেয়েছে। স্বর্গ ও মর্তব্যাপী কল্পনার স্বাধীনতাই এ শোকগাথার মূল বৈশিষ্ট্য। এতে তিনি কেবল গাছপালা, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের নয়, বরং ফিরিশতা ও পরলোকগত আত্মাদেরও বিলাপের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন।
ধর্মীয় কাব্য খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক ছিল মুসলিম সংস্কৃতির সম্প্রসারণের যুগ। এ সময়ের অনেক কবিই বিশ্বসৃষ্টি, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর জীবনী ও ইসলামের বিধি-বিধানের বর্ণনা দিয়েছেন। মোজাম্মেল এ ধারার প্রাচীনতম লেখক। তাঁর কাব্য নীতিশাস্ত্রের বিভিন্ন বিধি-বিধানের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। আফজাল আলী মঙ্গলকাব্যের অনুসরণে ইসলামি বিধি-বিধানের বিশদ বিবরণ-সম্বলিত নসিহৎনামা রচনা করেন। এতে তিনি স্বপ্নে তাঁর পীর শাহ রোস্তম কীভাবে তাঁর নিকট আবির্ভূত হতেন এবং নির্দেশাবলি প্রদান করতেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, শাবে মিরাজ, ওফাতে রাসুল ও মোহাম্মদ খানের মাকতুলে হোসেন এবং কিয়ামতনামায় বিশ্বের সৃষ্টি, বিবর্তন ও কিয়ামত বা ধ্বংস এবং পুনরুত্থান দিবসে সৎ ও অসৎ আত্মার চূড়ান্ত বিচারের বিষয়সমূহ উপস্থাপন করেছেন।
নসরুল্লাহ খান (আনু. ১৫৬০-১৬২৫) তাঁর শরীয়তনামায় আল্লাহর নির্দেশাবলির কথা বলেছেন এবং আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনকারীদের সর্তক করেছেন। এটা স্পষ্ট যে, নসরুল্লাহ খান এ গ্রন্থটি মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় বিধানাবলি সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যেই রচনা করেছিলেন। অনুরূপভাবে শেখ মোত্তালিব তাঁর কিফায়াতুল মোসলেমিন গ্রন্থে নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত ও ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। নসরুল্লাহর শরীয়তনামা এবং শেখ মোত্তালিবের কিফায়াতুল মোসলেমিন গ্রন্থদ্বয়ের বহু সংখ্যক পান্ডুলিপি থেকেই বোঝা যায় যে, গ্রন্থদুটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
সুফিসাহিত্য এ দেশে ইসলাম প্রচারে সুফি দরবেশগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ সুফি মতবাদের প্রভাবে গড়ে উঠেছে। সাহিত্যের এ ধারাটিকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: আধ্যাত্মিকতাবাদের তত্ত্ব ও তার অনুশীলনের দার্শনিক ব্যাখ্যা এবং ঐতিহ্যগত সঙ্গীতাবলি। সঙ্গীতগুলি মূলত পদাবলি হিসেবে পরিচিত এবং এ ধারা প্রধানত বাউল ও মুর্শিদি গানের সমন্বয়ে গঠিত। এতে একজন শিষ্যের আত্মবিনাশ ও দিব্যজ্যোতি লাভের জন্য অতিক্রমণীয় পর্যায়সমূহের বিস্তারিত বিবরণ আছে। হাজী মোহাম্মাদ এবং সৈয়দ সুলতান এ ধারার লেখকদের মধ্যে প্রধান।
হাজী মোহাম্মাদের নূর জামাল কাব্য সৈয়দ সুলতানের জনন প্রদীপের চেয়ে অধিকতর দার্শনিক তত্ত্বসমৃদ্ধ। তিনি পাঠকদের প্রথমে শরীয়তের কথা বলেন, পরে ওহাদাতুল ওজুদ ও সর্বেশ্বরবাদ সম্পর্কে বহুমুখী দার্শনিক তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করান। এছাড়াও তিনি ইবনুল আরাবী এবং মোজাদ্দেদে আলফে ছানি (রা.)-র বিভিন্ন মতবাদও বর্ণনা করেন। জনপ্রিয় মুর্শিদি ও বাউল গানগুলি গভীর দার্শনিক তত্ত্বে ভরপুর। বাংলায় প্রাপ্ত অধিকাংশ মুর্শিদি গান ইরানি কবি মাওলানা জালালউদ্দীন রুমীর মাসনাভী এবং শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তারের মানতিক উত্তায়ের-এর প্রভাবে প্রভাবিত।
বাংলা ভাষায় ফারসির প্রভাব তুর্কি-আফগানদের শাসনাধীনে বাংলার প্রশাসন হিন্দু জমিদারদের হাতে ন্যস্ত হয় এবং তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কায়স্থ। স্বভাবতই এঅঞ্চলের জনগণের জীবন ও ভাষার ওপর সোনারগাঁও ও গৌড়ের মুসলিম দরবারের প্রভাব ছিল অতি সামান্য। বাংলায় যেসব মুসলমান স্থায়িভাবে বসতি স্থাপন করেছিল তারা স্থানীয় জনসাধারণ কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষ এবং ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে বাংলার মুসলিম বাদশাহরা বাংলা সাহিত্যের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। উপরন্তু মুসলিম শাসনের সূচনাকালে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের যোগাযোগের ফলে প্রচুর ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে।
সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুগল শাসনের সূত্রপাত ঘটে। মুগল আমলে ফারসির প্রভাব পূর্বের তুলনায় আরও ব্যাপক হয়। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর পর এক সাংস্কৃতিক বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার পরিণতিতে ইন্দো-মুসলিম সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে এবং হিন্দুস্থানি/উর্দু ভাষা এর বাহন হয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে হিন্দুস্থানি ভাষা ভারতে ফারসি ভাষা ও ইসলামি চেতনা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে উচ্চ শ্রেণির লোকজন, এমনকি হিন্দুরাও কথ্য বাংলায় ব্যাপকভাবে ফারসি শব্দ ব্যবহার করতে থাকে। উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং বাংলার মুনশিরা ধনিক শ্রেণির ছেলেমেয়েদের ফারসি পড়াতেন। সেকালে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই মাদ্রাসা ও মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত কৃষ্ণরাম দাসের রাইমঙ্গলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়: ‘অবিলম্বে উত্তরিল রাজার নগরে। বালকে পারসী পড়ে আখন হুজুরে\ কানেতে সোনার কলম দোয়াত সম্মুখে। কিতাবত সুনিপুণ কায়স্থগণ লেখে\’
বাংলা ভাষায় শব্দ, লিঙ্গ ও বাক্য এই তিন ক্ষেত্রেই ফারসির প্রভাব লক্ষ করা যায়; তবে শব্দের ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ব্যাপকতর। বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি ও তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের প্রভাবে মূল বাংলা শব্দেরই বিলুপ্তি ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি বাংলা শব্দ বন্ধনীতে উল্লেখ করা হলো: খরগোশ (শশারু), বাজ (সাঁচান/সয়চান), শিকার (আখেট), নালিশ (গোহারি), বিদায় (মেলানি), জাহাজ (বুহিত), হাজার (দশ শ) ইত্যাদি।
দীর্ঘকাল মুসলমান শাসনের কারণে রাজস্ব, প্রশাসন, রাজকীয় সম্ভাষণ, যুদ্ধ, ব্যবসা প্রভৃতিবিষয়ক বহু ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। সেগুলির একটি তালিকা উপস্থাপিত হলো:
রাজস্ব, প্রশাসন ও আইনসংক্রান্ত: জরিমানা, জেরা, অছিয়তনামা, তামাদি, দারোগা, নালিশ, ফয়সালা, ফরিয়াদ, রায়, সালিশ, পারওয়ানে, ফরমান, মুনশি, ওকালতনামা, পেশকার ইত্যাদি।
রাজকীয় উচ্চপদ, যুদ্ধবিগ্রহ ও শিকারসংক্রান্ত: জমিদার, তখত, তহশিলদার, তালুক, তালুকদার, নবাব, বাদশা, বেগম, বাহাদুর, কামান, তীর, তোপ, ফৌজ ইত্যাদি।
ধর্মসংক্রান্ত: খোদা, পয়গম্বর, ফিরিশতা, বেহেশত, দোজখ, মসজিদ, ঈদগাহ, খানকাহ্, দরগাহ, নামায, রোজা, মরছিয়া, মাতম, জায়নামায, উযু, গুনাহ, নেক্কার, বদকার, পরহেজকার ইত্যাদি।
শিক্ষাসংক্রান্ত: কাগজ, কেচ্ছা, পীর, বুজুর্গ ইত্যাদি।
বিলাসদ্রব্য, ব্যবসা ও সভ্যতার উপকরণবিষয়ক: আতর, আয়না, গোলাপ, গুলদানি, চশমা, দালান, মখমল, ফারাশ ইত্যাদি।
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিষয়ক: পা, সিনা, গরদান, পাঞ্জা, দেল ইত্যাদি।
পোষাক-পরিচ্ছদসংক্রান্ত: আচকান, জোববা, চাদর, পর্দা, শালওয়ার, পিরাহান, কামারবান্দ ইত্যাদি।
খাদ্যবিষয়ক: বিরিয়ানি, গোশত, হালুয়া, কাবাব, কিমা, মোরববা, সব্জি, আনার, কিশমিশ, পেস্তা, বাদাম ইত্যাদি।
জাতিসংক্রান্ত: হিন্দু, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি।
পেশাসংক্রান্ত: কারিগর, খানসামা, খিদমাতগার, চাকর, দোকানদার, বাজিকর, জাদুকর ইত্যাদি।
পরিবার ও আত্মীয়সংক্রান্ত: বাবা, মা, দাদা, খালা, দামাদ, কানীজ, দোস্ত, ইয়ার ইত্যাদি।
নামসংক্রান্ত: দিল-আফরুয, দিলরুবা, নুরজাহান, জামশীদ, রোস্তম, সোহরাব ইত্যাদি।
স্থানবিষয়ক: হাম্মামখানা, গোসলখানা, সরাইখানা, মোসাফেরখানা, ইয়াতীমখানা, কারখানা, বালাখানা, আসমান, যমীন, বাজার ইত্যাদি।
পশুপাখির নামসংক্রান্ত: খরগোশ, বুলবুল, কবুতর, বাজ, তোতা, হাইওয়ান, জানোয়ার ইত্যাদি।
সাধারণ দ্রব্যাদি, কল্পনা ও ভাবসংক্রান্ত: আওয়াজ, আবহাওয়া, আতশ, আফসোস, কম, কোমর, গরম, নরম, পেশা, সফেদ, হুশিয়ার, হরদম, সেতার ইত্যাদি।
ভৌগোলিক স্থানসংক্রান্ত: নওয়াবপুর, গুলিস্তান, রাজশাহী, রংপুর ইত্যাদি। এ ধরনের প্রায় দুই হাজারেরও অধিক শব্দ বাংলা ভাষায় স্থায়িভাবে স্থান করে নিয়েছে।
ফারসি ভাষা বাংলা ব্যাকরণকেও প্রভাবিত করেছে। যেমন ফারসি ‘মাদী’ ও ‘মর্দা’ (মার্দ) শব্দের প্রয়োগে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়: মর্দা-কবুতর, মাদী-কবুতর; মর্দা-কুকুর, মাদী-কুকুর ইত্যাদি। ফারসিতে অবশ্য এই লিঙ্গনির্দেশক শব্দ বিশেষ্যের পরে বসে, যেমন: আহুয়ে নার (পুরুষ জাতীয় হরিণ), আহুয়ে মাদী (স্ত্রী জাতীয় হরিণ) ইত্যাদি। অপরদিকে ফারসি ‘মোর্গ’ শব্দটি মোরগ ও মুরগি উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহূত হয়, কিন্তু বাংলায় মোর্গ বলতে কেবল পুরুষ জাতীয় মোরগ এবং মুরগি বলতে স্ত্রী জাতীয় মোরগ বোঝায়।
ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের মাধ্যমে অনেক বাংলা শব্দ গঠিত হয়েছে; আবার অনেক ফারসি শব্দ মূল অর্থসহ বাংলায় ব্যবহূত হচ্ছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফারসি আ বা া-চিহ্ন বাংলায় লোপ পেয়েছে; যেমন: কামারকমর; গারমগরম; নারমনরম ইত্যাদি। আবার অনেক বাংলা শব্দ ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটি স্বতন্ত্র অর্থ ও ভাববিশিষ্টি শব্দ তৈরি করেছে, যেমন: কেরানিগিরি, বাবুগিরি, দর-পত্তর, বে-গতিক ইত্যাদি।
বাংলা বাক্য গঠনেও ফারসির প্রভাব লক্ষণীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ: মান ইন কার কারদেবুদাম = আমি একাজ করেছিলাম; মান ইয়েক্তা নান খোর্দাম = আমি একটা নান খেলাম; তু কুজা রাফ্তী = তুই কোথায় গেলি? ইত্যাদি।
ফারসির ন্যায় বাংলাতেও লিঙ্গের তারতম্যের কারণে ক্রিয়াপদ প্রভাবিত হয় না, যেমন: বাবা রাফ্ত = বাবা গেলেন; মামা রাফ্ত = মা গেলেন; বেরাদর অমাদ = ভাই এলেন; খাহার অমাদ = বোন এলেন ইত্যাদি।
বাংলা ও ফারসি উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যা ও লিঙ্গভেদের কারণে বিশেষণ প্রভাবিত হয় না, যেমন: গুলে সাফীদ = সাদা ফুল; গুলহায়ে সাফীদ = সাদা ফুলগুলি; পেছারে খোব = ভাল ছেলে, দোখ্তারে খোব = ভাল মেয়ে ইত্যাদি।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফারসির চর্চা অত্যন্ত সীমিত হলেও বিগত সাতশ বছরে তা বাংলা ভাষায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছে এবং বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। দশ সহস্রাধিক ফারসি শব্দ কেবল সাহিত্যে বা আদর্শ বাংলায়ই নয়, বরং এ এলাকার আঞ্চলিক ভাষারও অংশে পরিণত হয়েছে। অতি পরিচিত কিছু কিছু শব্দ ও বাক্য আছে যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে ফারসি থেকে উদ্ভূত নয় বলে মনে হয়, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এসব শব্দ ও বাক্য আসলে ফারসিজাত। যেমন, ‘আবহাওয়া এখন বেশি গরম আছে’ এ বাংলা বাক্যটি শব্দ ও গঠন উভয় দিক থেকেই ‘আবহাওয়া আকনুন বিশ গার্ম আছত্’ এই ফারসি বাক্যটির অনুরূপ। [আবু মূসা মোঃ আরিফ বিল্লাহ]
গ্রন্থপঞ্জি মুহাম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৫; আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস: সুলতানী আমল, ঢাকা, ১৯৬৭; আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সম্পা:, শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী (৩য় খন্ড), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫; Suniti Kumar Chatterji, The Origin and Development of the Bengali Language, Calcutta, 1993; Sirajul Islam ed., History of Bangladesh, Vol. III, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka, 1997.