মাদ্রাসা
মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষার বিশেষ প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয় হযরত মুহাম্মদ (স.) এর যুগে। তিনি ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কার সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দারুল আরকাম, হিজরতের পর মসজিদে নববীর উত্তর-পূর্ব দিকে সুফফা আবাসিক মাদ্রাসা এবং দারুল কুররাহ মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এ ছাড়া মসজিদে নববী (৬২২ খ্রি.) এবং মদীনার আরও ৯টি মসজিদ শিক্ষায়তন হিসেবে ব্যবহূত হয়। খলিফাদের মধ্যে হযরত ওমর (রা.) সিরিয়ায় ও হযরত আলী (রা.) বসরা ও কুফায় বৃহৎ দুটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। উমাইয়া যুগে দেশের বৃহদায়তন মসজিদগুলি মাদ্রাসারূপে ব্যবহূত হতো। আববাসীয় বংশের শাসকগণ মাদ্রাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের অনেকেই মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসা নির্মাণ করা ছাড়াও আলাদা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় মসজিদে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক ছিল।
বঙ্গদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয় সুলতানি আমলে (১২১০-১৫৭৬)। এ সময়ে বঙ্গদেশে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে মহিসন্তোষে মওলানা তকীউদীন আরাবীর মাদ্রাসা প্রাচীনতম। ১২৪৮ সালে সুলতান নাসিরউদ্দীন, বদরউদ্দীন ইসহাক, মিনহাজউদ্দীন, নিজামউদ্দীন দামিস্কি ও শামসউদ্দীন খাওয়ারিজমী একটি মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করেন যা এক শতাব্দীকাল কার্যকর ছিল।
মওলানা আবু তাওয়ামা ১২৭৮ সালে সোনারগাঁয়ে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং এটি ছিল তৎকালীন বাংলায় সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) গৌড় ও মালদহে বহু মাদ্রাসা স্থাপন করেন। সুলতানি আমলে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে ছিল আরবি, নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতিক, কালাম, তাসাউফ, সাহিত্য, ফিকাহ ও দর্শন।
মুগল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম বর্ধিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা চালু করা হয়। সে আমলে পর্যায়ক্রমে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভূগোল, হিসাববিজ্ঞান, কৃষি, লোকপ্রশাসন, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও চারুকলা প্রভৃতি বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে আলিয়া মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা এবং স্বতন্ত্র মাদ্রাসা এ তিন ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা থেকে এ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ধারা ছিল না। ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষায় আলিয়া মাদ্রাসা ধারা এবং ১৮৯৯ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর কওমী মাদ্রাসা ধারার প্রচলন হয়।
আলিয়া মাদ্রাসা উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকার গঠিত শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী আলিয়া মাদ্রাসায় ৫টি স্তর ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) দুই বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) দুই বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) দুই বছর মোট ১৬ বছরের কোর্স পরিচালিত হয়। কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যায়ে তাফসীর, হাদিস, ফিকাহ, আরবি সাহিত্য এবং মুজাবিবদ শাখায় দুই বছর মেয়াদি কোর্সের শেষে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে দু’ধরনের আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে: সরকার কর্তৃক পরিচালিত মাদ্রাসাগুলি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা এবং সরকার অনুমোদিত ও অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলি বেসরকারি আলিয়া মাদ্রাসা।
বাংলাদেশে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে প্রতিষ্ঠিত। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর হতে আলিয়া মাদ্রাসা সংস্কারের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন করে। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর পর ১৭৯১ সালে মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রবর্তন করে। এ সিলেবাস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধিভুক্ত বাংলা (আসামসহ), বিহার ও উড়িষ্যার সকল মাদ্রাসায় বাস্তবায়ন করা হয়। ১৮৬৯ সালের কমিটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছু সংশোধনী আনে। ১৮৭১ সালে বিচারপতি নরম্যান কমিটি বেঙ্গল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে। ১৮৭৩ সালে মোহসীন ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমান সরকারি কবি নজরুল কলেজ), চট্টগ্রাম দারুল উলুম মোহসিনীয়া মাদ্রাসা (বর্তমানে সরকারি মোহসীন কলেজ) ও রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৮২ সালের হান্টার কমিটির রিপোর্ট ১৮৮৪ সালে বাস্তবায়িত হয়। ১৯০৭ সালের কলকাতা কনফারেন্সে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাকে সমমানের তিন বছরের টাইটেল ক্লাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯১০ সালে এ.এইচ হার্লের নেতৃত্বে গঠিত মোহমেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় কতিপয় সংস্কারের প্রস্তাব করে।
১৯১৪ সালে অধ্যক্ষ শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদের নেতৃত্বে গঠিত মোহমেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি কর্তৃক প্রণীত কারিকুলামে ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয় এবং ১৯১৫ সালে তা বাস্তবায়িত হয়। মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে জুনিয়র ও সিনিয়র নামে দু’ধরনের নিউ স্কিম মাদ্রাসা চালু হয়। জুনিয়র মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আর সিনিয়র মাদ্রাসায় মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। এসব সিনিয়র মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সাহায্যভুক্ত করা হয়। সরকারি চাকুরি পেতে মুসলিম শিক্ষার্থীরা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়তে বিশেষ আগ্রহী ছিল।
শামসুল হুদা কমিটি ১৯২৭ সালে বাংলা ও আসামের ওল্ড স্কিম সিনিয়র মাদ্রাসাগুলির আলিম, ফাযিল ও ফখরুল মুহাদ্দিসীন শ্রেণির কেন্দ্রীয় পরীক্ষা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক গ্রহণ করার প্রস্তাব করে। এ কমিটি প্রণীত কামিলের সিলেবাসে সিয়াহ্ সিত্তা (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাযা, আবু দাউদ), অসূলুল হাদিস, তাফসীরুল বায়যাবী, তাফসীরুল কাশশাফ, তাফসীরুল কবীর, তাফসীরুল মাজমুউল বয়ান, ফিকাহ, অসূলুল ফিকাহ, মানতিক, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়।
১৯২৭ সালে Muhamadan Education-এর Assistant Director of Public Instruction কে চেয়ারম্যান এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে রেজিস্ট্রার করে Board of Central Madrasah Examinations, Bengal নামে সর্বপ্রথম একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয়। ১৯২৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড একটি সরকারি সংস্থা হিসেবে মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার সাথে যুক্ত ছিল।
১৯৩১ সালের Muslim Education Advisory Committee বা মোমেন কমিটি, ১৯৩৮-৪০ সালের মাওলা বখশ কমিটি আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের সুপারিশ করে। ১৯৪৬ সালের সৈয়দ মোয়াজ্জমউদ্দিন হোসাইন কমিটি আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়নে যে সুপারিশ করে তা ১৯৪৭ সালের ১ জুলাই হতে কার্যকর হয়। এ সুপারিশে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি কামিল শ্রেণির হাদিস বিভাগে অন্তর্ভুক্ত ছিল: সিয়াহ সিত্তা, নুখবাতুল ফিকর, তাফসীরুল বায়যাবী, তাফসীরুল কাশশাফ, আল-ইতকান, ইসলামের ইতিহাস, হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাস। কামিল শ্রেণির ফিকাহ্ বিভাগে ফিকাহ, অসূলে ফিকাহ, হাদিস, কালাম, ইসলামের ইতিহাস ও ফিকাহ শাস্ত্রের ইতিহাস, ইফতা এবং কামিল শ্রেণীর আদল বিভাগে প্রাচীন ও আধুনিক গদ্য, পদ্য, ইসলামের ইতিহাস এবং আরবি সাহিত্যের ইতিহাস ও সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদি পাঠ্যভুক্ত ছিল।
১৯৪৭ সালের পূর্ব বাংলায় আলিয়া মাদ্রাসা পাঠ্যসূচি অনুসারে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও বগুড়া সরকারি আলিয়া মাদ্রাসাসহ সরকার অনুমোদিত ও বোর্ড কর্তৃক মঞ্জুরিপ্রাপ্ত অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে ১৯৪৮ সালে মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষাসমূহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৪৯-৫১ সালের আকরম খাঁর East Bengal Education System Reconstruction Committee, ১৯৫৬ সালের আশরাফউদ্দীন চৌধুরী কমিটি, ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান শিক্ষা সংস্কার কমিশন, ১৯৫৮ সালের এম.এম শরীফ জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৩ সালের ড. এস.এম হোসাইনের Islamic Arabic University Committee, ১৯৬৯ সালের ইমামুদ্দীন চৌধুরীর Madrasa Review Committee, ১৯৭২-৭৩ সালের বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৭৩ সালের মাদ্রাসার শিক্ষা সংস্কার সংস্থা মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ করে।
১৯৭৫ সালের কুদরত-ই-খুদা কমিটির সুপারিশের আলোকে মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসাসমূহে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও বহুমুখী পাঠ্যসূচি প্রবর্তিত হয়। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত আলিম ও ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত ফাযিল পরীক্ষায় এ সিলেবাস কার্যকর হয়। উক্ত দু’শ্রেণিতে মাদ্রাসার নির্ধারিত সকল পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার এইচ.এস.সি এবং এস.এস.সি-এর সম্পূর্ণ কোর্স অর্ন্তভুক্ত করে ফাযিল শ্রেণিকে সাধারণ শিক্ষার এইচ.এস.সি এবং আলিমকে এস.এস.সি-এর মান দেওয়া হয়। এ কমিটি মাদ্রাসায় বিজ্ঞান শাখা চালু করে।
১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে Senior Madrasah Education System Committee গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ জুন হতে বোর্ডটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জনশিক্ষা পরিচালক প্রফেসর বাকী বিল্লাহ খান এর প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
১৯৮৪ সালে মুস্তফা বিন কাসিমের কমিটির সুপারিশের আলোকে সাধারণ শিক্ষার স্তরের সঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা স্তরের নিম্নরূপ সামঞ্জস্য করা হয়: ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর মোট ১৬ বছর। এ কমিটি কর্তৃক প্রণীত সিলেবাস ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত দাখিল ও ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত আলিম পরীক্ষায় কার্যকর হয়। উক্ত দু’শ্রেণিতে মাদ্রাসার নির্ধারিত সকল পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার যথাক্রমে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি-এর সম্পূর্ণ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করে দাখিলকে এস.এস.সি এবং আলিমকে এইচ.এস.সি-এর সমমান দেওয়া হয়। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অনুমোদিত যে কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু ফাযিল (ডিগ্রি) এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু মাদ্রাসা বা স্কুলে চাকুরির ক্ষেত্রে সমমান পায়, অন্য ক্ষেত্রে নয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের ফলে আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯০৭-০৮ সালে এদেশে ইবতেদায়ী হতে কামিল পর্যন্ত মাদ্রাসা ছিল ২,৪৪৪টি। ১৯৪৭ সালে ৩টি সরকারি মাদ্রাসাসহ (দাখিল হতে কামিল পর্যন্ত) আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ৩৭৮টি। ১৯৭১ সালে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদ্রাসার সর্বমোট সংখ্যা ছিল ৫০৭৫টি। ২০০৭ সালে মাদ্রাসার সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৯,৪৯৩টিতে। তন্মধ্যে দাখিল ৬,৭০০টি, আলিম ১,৪০০টি, ফাযিল ১,০৮৬টি এবং কামিল ১৯৮টি।
২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত মাদ্রাসা বোর্ড আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) হতে কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যন্ত সকল স্তরের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে Islamic University (Amendment) Act, 2006 মোতাবেক সাধারণ শিক্ষার সাথে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সমন্বিত করার কারণে ফাযিল (ডিগ্রি) ৩ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর মোট ৫ বছরের কোর্স চালু হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে, ২০০৬ সালের পর থেকে মাদ্রাসা বোর্ড শুধু দাখিল ও আলিম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। উক্ত আইন অনুসারে ১,০৮৬টি ফাযিল (স্নাতক) ও ১৯৮টি কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদ্রাসা অর্থাৎ ১,২৮৪টি মাদ্রাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার দীর্ঘ দিনের বিরাজমান পার্থক্য দূরীভূত হয়।
কওমী মাদ্রাসা আরবি ‘কওমুন’ শব্দ থেকে ‘কওমী’ শব্দের উৎপত্তি। কওমী শব্দের অর্থ হলো জাতীয়। তাই কওমী মাদ্রাসার যথার্থ অর্থ হলো জাতীয় মাদ্রাসা বা জাতীয় শিক্ষায়তন। কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে কেন্দ্র করে চারটি ধারা প্রচলিত রয়েছে: (ক) কিতাব বিভাগ বা দরসিয়াত বিভাগ, (খ) মক্তব বিভাগ, (গ) সহীহ কুরআন শিক্ষা ও কিরাত বিভাগ, এবং (ঘ) হিফ্জুল কুরআন বিভাগ। সরকারি সাহায্য ও প্রভাবমুক্ত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মাদ্রাসাই কওমী মাদ্রাসা। দরসে নিযামি শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষাদান করা হয় বলে এগুলিকে দরসে নিযামি মাদ্রাসা নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.), মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.), মওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) প্রমুখ আলেম জনগণের সহযোগিতায় ১৮৬৬ সালে প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং ১৮৬৭ সালে সাহারানপুরে মাজাহিরে উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এ দেওবন্দ মাদ্রাসাই বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার উৎস। ১৮৯৯ সালে এ মাদ্রাসার আদলে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে কওমী মাদ্রাসার সূচনা ও বিকাশ ঘটে। এজন্য এ মাদ্রাসাকে উম্মুল মাদারিস বা মাদ্রাসা সমূহের জননী বলা হয়। মোল্লা কুতুবউদ্দীন শহীদ (মৃ. ১৭১১ খ্রি.) উপমহাদেশে প্রচলিত দরসে নিযামিয়ার উদ্ভাবক হলেও তাঁর পুত্র মোল্লা নিযামুদ্দীনের (মৃ. ১৭৪৮ খ্রি.) সময় এ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার লাভ করে এবং তা দরসে নিযামিয়া নামে অভিহিত হয়।
বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা দুটি পর্যায়ে বিভক্ত: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা। দুটি পর্যায়ে ৬টি স্তর এবং এ ৬টি স্তরে ১৬টি শ্রেণি রয়েছে। আল্ মারহালাতুল ইবতিদায়িয়্যা বা প্রথম স্তরে আওয়াল, ছানী, ছালেছ, রাবে ও খামেছ এ ৫টি শ্রেণি রয়েছে। আল-মারহালাতুল মুতাওয়াস্সিতা বা দ্বিতীয় স্তরে আওয়াল, ছানী ও ছালেছ এ ৩টি শ্রেণি রয়েছে। আল-মারহালাতুছ ছানুবিয়্যাহ্ আল-আ’ম্মাহ্ বা তৃতীয় স্তরে আস সানাতুল উলা ও আস সানাতুছ-ছানীয়া এ দুটি শ্রেণি রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ৩টি স্তর এবং ৬টি শ্রেণি। আল-মারহালা সানুবিয়্যাহ্ উ’ল্ইয়া বা প্রথম স্তরে রয়েছে আসসানাতুল-উলা ও আস সানাতুছ-ছানীয়া এ দুটি শ্রেণি। মারহালাতুল-ফযীলত (স্নাতক) বা দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে আসসানাতুল-উলা ও আসসানাতুছ-ছানীয়া এ দুটি শ্রেণি। মারহালাতুত-তাক্মীল (স্নাতকোত্তর) বা তৃতীয় স্তরে আসসানাতুল-উলা বা দাওরায়ে-হাদিস, আসসানাতুছ-ছানীয়া বা তাক্মীল ফিত্-তাখাস্ছুছ এ দুটি শ্রেণি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ কওমী মাদ্রাসাতে এ স্তরের কোর্স ১ বছরে দাওরায়ে হাদিস পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়। দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক।
১৯৭৮ সালে দরসে নিযামি মাদ্রাসাগুলি পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম বিফাকুল মাদারিস নামে বেসরকারি কওমী মাদ্রাসা বোর্ড গঠিত হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইত্তেহাদুল মাদারিস, সিলেটের আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ, বগুড়ার জামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রিক তানযীমুল মাদারিস নামে এবং ফরিদপুরের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা কেন্দ্রিক বিফাকুল মাদারিসসহ আঞ্চলিক ভিত্তিতে আরও ১১ টি পৃথক কওমী মাদ্রাসা বোর্ড গড়ে উঠেছে।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সারাদেশে বিফাকুল মাদারিস-এর অধীনে ২,০৪৩টি মাদ্রাসা কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে নিবন্ধিত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১০ হাজারের অধিক কওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। তাক্মিল বা দাওরায়ে-হাদিস (স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের প্রায় আড়াই শত এবং মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে অর্ধশত।
মক্তব ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে শিশুকিশোরদের প্রাথমিক পর্যায়ের কুরআন শরীফ, দীনিয়াত ও আরবি শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের প্রতিষ্ঠানকে মক্তব, নুরানী বা ফুরকানিয়া মাদ্রাসা নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত স্থানীয় কোনো মসজিদে প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই সাধারণত এর শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭০ হাজার ফুরকানিয়া ও মসজিদ ভিত্তিক মক্তব রয়েছে।
সহীহভাবে কুরআন ও কিরাত শিক্ষার জন্যও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া আল্-কুর্আন মুখস্ত করার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক হাফেজিয়া মাদ্রাসা। ২০০৮ সালে এ মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ৪ হাজারের অধিক।
স্বতন্ত্র মাদ্রাসা বাংলাদেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত এবং স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম ও সিলেবাসে পরিচালিত মাদ্রাসাসমূহের মধ্যে মৌলিকভাবে পাঁচটি শিক্ষা ধারা লক্ষ করা যায়। সেগুলি হচ্ছে: (১) কিন্ডার গার্টেন মাদ্রাসা ও ক্যাডেট মাদ্রাসা, (২) শর্ট কোর্স মাদ্রাসা, (৩) স্বতন্ত্র ও বিশেষ নেসাবের মাদ্রাসা, (৪) উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা, গবেষণা ও বিশেষ কোর্সের (তাখাচ্ছুস) মাদ্রাসা, এবং (৫) আহলে হাদিস মাদ্রাসা। এ পাঁচ শ্রেণির মাদ্রাসার মধ্যে প্রথম চার শ্রেণির মাদ্রাসার নির্ধারিত কোনো সিলেবাস নেই। ‘আহলে হাদিস’ কর্তৃক পরিচালিত নিজস্ব সিলেবাস অনুসরণকারী চল্লিশটির মতো মাদ্রাসা রয়েছে। এর অধিকাংশ বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশে এ জাতীয় সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা হলো ঢাকার উত্তর যাত্রাবাড়ীতে জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া এবং রাজশাহীর নওদাপাড়ার আল মারকাযুল ইসলামী আস সালাফী। কওমী মাদ্রাসার আদলে গড়া এ সকল মাদ্রাসা সম্পূর্ণ আহলে হাদিস কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এগুলি জনগণের আর্থিক সহায়তা এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহায্য সংস্থার অনুদানে পরিচালিত হয়ে থাকে। [আ.ব.ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী]