সৈয়দ সুলতান
সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০-১৬৪৮) মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবি। তাঁর বাসস্থান ছিল চট্টগ্রামের চক্রশালা চাকলার অধীন পটিয়া গ্রাম। চট্টগ্রামের লস্করপুর তথা পরাগলপুরে কবি সাময়িকভাবে বসবাস করেন। তাঁর পীরের নাম সৈয়দ হাসান; পরে তিনি নিজেও পীরের মর্যাদা লাভ করেন। মক্তুল হুসেন কাব্যের রচয়িতা মুহম্মদ খান ছিলেন তাঁর শিষ্য।
কাহিনীকাব্য ও শাস্ত্রকাব্য রচয়িতা হিসেবে সৈয়দ সুলতানের খ্যাতি ছিল। তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর নবীবংশ, জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা ও জয়কুম রাজার লড়াই উল্লেখযোগ্য। তিনি কিছু পদও রচনা করেন। জ্ঞানচৌতিশা মূলত জ্ঞানপ্রদীপেরই সংক্ষিপ্ত রূপ। উভয়ই যোগ ও সুফিতত্ত্বের কাব্য। জয়কুম রাজার লড়াই যুদ্ধবিষয়ক কাহিনীকাব্য।
কবির সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ রচনা নবীবংশ কাব্য। ফারসি কাসাসুল আম্বিয়া অনুসরণে এটি রচিত। এতে সৃষ্টির সূচনা থেকে হযরত মুহাম্মাদ (স.) পর্যন্ত সকল নবী-রসুলের কর্ম ও ধর্মজীবনের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। এছাড়া বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবীকেও নবীদের ধারাভুক্ত করা হয়েছে। তবে ইসলামের গৌরব ও মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা ও প্রচারই এতে প্রাধান্য পেয়েছে। বিষয়-বৈচিত্র্য ও বিশালতার বিচারে নবীবংশ মহাকাব্যের সমতুল্য।
নবীবংশের দ্বিতীয় খন্ড রসুলচরিত একখানা পৃথক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। কাব্যের শুরুতে আছে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা। পরে আবদুলাহর জন্ম, পরিণয়, আমিনার গর্ভধারণ, আবু জেহেল কর্তৃক তাঁর গর্ভপাতের চেষ্টা, হযরত মুহাম্মদের (স.) জন্ম এবং পরের জীবনের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। কাব্যটিতে ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ আছে; বিশেষত, বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে। জৈনুদ্দীনের রসুলবিজয় (১৫শ শতক) এ ধারার প্রথম কাব্য; পরেই রসুলচরিতের স্থান। মধ্যযুগে রচিত হযরত মুহাম্মদের (স.) পূর্ণাঙ্গ জীবনী হিসেবে রসুলচরিতই শ্রেষ্ঠ কাব্য। শব-ই মেরাজ ও ওফাত-ই রসুল স্বতন্ত্র কাব্য হিসেবে প্রচারিত হলেও তা রসুলচরিতেরই অংশ।
বাংলা ভাষার ওপর সৈয়দ সুলতানের বিশেষ দখল ছিল। তিনি সুফিতত্ত্ব ও ইসলামি ঐতিহ্যের অনেক দুরূহ বিষয় সহজবোধ্যভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। রসুলচরিতসহ (১৯৭৮) তাঁর রচনাবলি আহমদ শরীফ কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বাংলা একাডেমী থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। [খন্দকার মুজাম্মিল হক]