যাকাত
যাকাত আরবি শব্দ। অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। বস্ত্তত: যাকাত প্রদান যাকাতদাতার মনকে ধনসম্পদের প্রতি লোভ লিপ্সা এবং কৃপণতা থেকে পবিত্র করে। উপরন্তু ধনীদের ধনসম্পদে গরীব মিসকীনদের অধিকার রয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘আর তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে প্রার্থীগণের (গরীব) ও বঞ্চিতদের অবশ্যই অধিকার রয়েছে’’ (৫১ঃ ১৯)। তাই যাকাত প্রদানে ধনীদের ধনসম্পদের কিছু অংশ ব্যয়ের দ্বারা তাদের অবশিষ্ট ধনসম্পদ পবিত্র হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তাদের ধনসম্পদ থেকে সাদাকা আদায় কর, এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করে দেবে’’ (৯ঃ ১০৩)। যাকাত শব্দের অপর অর্থ বৃদ্ধি। যাকাত প্রদান করলে এর ফলস্বরূপ ধনসম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। পবিত্র কুর’আনে উল্লেখ আছে, ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যাকাত দান করে, তাদেরই ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়’’ (৩০ঃ ৩৯)।
শরী‘আতের পরিভাষায়, কোনো মুসলমানের ধনসম্পদ তার নিজের ও পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর শরী‘আত নির্ধারিত পরিমাণে অবশিষ্ট থাকলে এবং ওই ধনসম্পদ তার মালিকানায় ১ বছর মেয়াদে স্থায়ী থাকলে বছর পূর্ণ হয়ে গেলে সেই সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ শরী‘আত নির্ধারিত খাতসমূহে প্রদান করাকে যাকাত বলা হয়।
সালাতের ন্যায় যাকাতও ফরয ইবাদত। কুর’আন মাজীদের অনেক জায়গায় সালাতের আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই যাকাতের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন- সূরা আল মুয্যামমিলে উল্লেখ আছে, ‘‘আর সালাত কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর, আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর’’ (৭৩ঃ ২০)। উল্লেখ্য, যাকাত সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশাবলী নাযিল হবার পূর্বে সাহাবীগণ (রা.) নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদ প্রায় সবটাই দান করে দিতেন। এ ব্যাপারে কুর’আন মাজীদে উল্লেখ আছে, ‘‘(হে মুহাম্মদ,) লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? তুমি বলে দাও, যা উদ্বৃত্ত থাকে তাই’’ (২ঃ ২১১)। পরে কুর’আন মাজীদের ২ঃ ১০৩ নং আয়াত নাযিল হলে যাকাত নির্দিষ্ট উপায়ে আদায় করা এবং তা নির্দিষ্ট খাতসমূহে ব্যয় করা মুসলিমদের জন্য ফরয বলে নির্ধারিত হয়।
হযরত আবু বকর (রা.) যে দুটি মুসলিম গোত্র যাকাত দান করতে অস্বীকার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহর কসম, যে ব্যক্তি সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব’’ (বুখারী ও মুসলিম, কিতাবুয যাকাত)।
কুর’আন মাজীদের, এবং হাদীস গ্রন্থসমূহের যাকাত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় যাকাত ব্যবস্থা সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক সাম্য অর্জন এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজে ধনসম্পদের আবর্তন, বিস্তার সাধন, বেকার সমস্যার সমাধান ও দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে ধনীদের ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। উল্লেখ্য অন্য কোনো ধর্মে এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নজির নেই। মহানবী (স.) বলেন, ’’নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের (ধনীদের) ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের নিকট থেকে আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হবে’’ (বুখারী ও মুসলিম, কিতাবুয যাকাত)।
গরীব-মিসকীন, ইয়াতীম, বিধবা, বিকলাঙ্গ, উপার্জনে অক্ষম নারীপুরুষ প্রভৃতি যারা জীবনধারণের উপযোগী অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে পারে না এমন নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত মানুষ যাকাত দ্বারা লালিত পালিত হতে পারে।
যে পরিমাণ ধনসম্পদ অবশিষ্ট থাকলে যাকাত ফরয হয়, ইসলামী পরিভাষায় একে ‘নিসাব’ বলে। (ক) রৌপ্যের নিসাব দুইশ দিরহাম, আমাদের দেশে প্রচলিত ওজনে ৫২১/২ তোলা। (খ) স্বর্ণের নিসাব বিশ মিহকাল, প্রচলিত ওজন হিসেবে ৭১/২ তোলা। (গ) পণ্যদ্রব্যের নিসাবও এর মূল্যের ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়েছে: স্বর্ণ, রৌপ্য ও পণ্যদ্রব্যের যাকাত চল্লিশ ভাগের এক ভাগ; নদী, বৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপায়ে সিঞ্চিত জমির শস্যের যাকাত দশ ভাগের এক ভাগ; কৃষক কর্তৃক সেচকার্য দ্বারা যে জমির ফসল উৎপন্ন হয় তার উৎপন্ন শস্যের যাকাত বিশ ভাগের এক ভাগ; অমুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের বিজয় লব্ধ ধনসম্পদ, খনিজ দ্রব্য ও ভূগর্ভে প্রোথিত ও প্রাপ্ত ধনসম্পদের যাকাত পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
পশুর মধ্যে (ক) উট, (খ) গরু, মহিষ, (গ) ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া এবং (হানাফী মতে) (ঘ) অশ্বের যাকাত দিতে হয়। উট পাঁচটি, গরু বা মহিষ বা উভয় মিলে ত্রিশটি, এবং ছাগল, দুম্বা বা ভেড়া বা সব মিলে চল্লিশটি হলে নিসাব পূর্ণ হয়। এই তিন ক্ষেত্রে যথাক্রমে একটি ছাগল, একটি ২য় বর্ষের বাছুর এবং একটি ছাগল যাকাত দিতে হয়।
যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ স্বয়ং আল্লাহ তা’তালা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ জন্যই নির্ধারিত খাত ব্যতীত অন্যত্র যাকাতের মাল ব্যয় করা যায় না। যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ নির্ধারণে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘সাদাকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের বিত্ত আকর্ষণ করা আবশ্যক তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণ-ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী, মুসাফিরদের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’’ (৯ঃ ৬০)। [মুহাম্মাদ মনসুরুর রহমান]