ইসলাম

ইসলাম  ‘সিল্ম’ ধাতু হতে উৎপন্ন। এর ধাতুগত অর্থ শান্তি, আপোষ, বিরোধ পরিহার। স্বরচিহ্নের তারতম্যে বিভিন্ন আকারে প্রায় একই অর্থে পবিত্র কুরআনে এ ধাতু হতে নিষ্পন্ন কয়েকটি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, যথা: যুদ্ধবিরতির জন্য শান্তির প্রস্তাব (৮:৬১), ইসলামী বিধান (২:২০৮),  যুদ্ধ পরিহারের প্রস্তাব (৪; ৯০:৯১), শান্তি (১০:২৫) অথবা শান্তি কামনামূলক ইসলামী অভিবাদন (৫১:২৫)।

সিল্ম ধাতু হতে কর্তৃকারকে মুসলিম ইসলাম গ্রহণকারী এবং বহুবচনে মুসলিমূন ও মুসলিমীন ব্যবহূত হয়। ইসলামের পরিভাষাগত অর্থ (১) এক অদ্বিতীয় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা (২:১১২), (২) শান্তিস্থাপন তথা বিরোধ পরিহার করা। ইসলাম একটি ‘দীন’ (৩:১৮), একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

ইসলামের উৎস দুইটি: (১) কুরআন- দীন ইসলামের প্রথম, প্রধান ও মূল উৎস যা হতে ইসলামের মৌলিক বিধানসমূহ গৃহীত হয়েছে এবং (২) হাদীস- ইসলামের দ্বিতীয় ও মাধ্যমিক উৎস যা হতে ইসলামের শিক্ষাসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে।

ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় মূখ্যত আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব জীবন-দর্শন ও কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা, যা জীবনের সকল ক্ষেত্র ও যাবতীয় কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলাম মানুষের চিরন্তন ধর্ম (৩:১৮)। এর মূল কথা হচ্ছে: (ক) আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বে বিশ্বাস, (খ) ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস, (গ) আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস, (ঘ) সকল নবী রাসূলের প্রতি বিশ্বাস, (ঙ) আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস, (চ) আল্লাহর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ (তাকদীর)-এ বিশ্বাস, (ছ) মৃত্যুপর পুনরুত্থান ও বিচারান্তে অনন্ত পরজীবনে বিশ্বাস, (জ) আমাল-ই-সালিহ বা সৎকর্মে আত্মনিয়োগ।

ইসলামের ভিত্তি বা স্তম্ভ পাঁচটি: (১) ঈমান: আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ (উপাস্য) নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া; (২) সালাত (নামায) প্রতিষ্ঠা; (৩) যাকাত প্রদান: ধনীর সম্পদে নির্ধনের অধিকার স্বীকৃতিমূলক অপরিহার্য এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ দান; (৪) হজ্জ পালন করা: মক্কার কা‘বা ও তৎসন্নিহিত স্থানসমূহে নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেক সুস্থ ও সম্পন্ন মুসলিমের পক্ষে জীবনে অন্তত একবার একটি বার্ষিক বিশ্ব মহাসম্মেলনে যোগদান এবং আনুষ্ঠানিক ‘ইবাদাত সমাপন; (৫) রামাদান মাসের সাওম (রোযা) পালন (বুখারী: কিতাবু‘ল ঈমান)।

’আমাল-ই-সালিহ সংক্রান্ত বিধান পদ্ধতির সমষ্টি কুরআনে শির‘আ এবং মিনহাজ নামে (৫:৪৮) বা শারী‘আ (৪৫:১৮) নামে অভিহিত। শির‘আ এবং শারী‘আ একই ধাতু হতে উদ্ভূত ও একার্থবোধক। স্থান-কাল পাত্রভেদে নবীদের প্রাপ্ত ও প্রচারিত শারী‘আ-র মধ্যে কিছুটা তফাৎ ছিল। নবীদের প্রচার ও সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা বর্ণনার ক্ষেত্রে কুরআনে নূহ (আঃ) ও তাঁর কাওমের বিদ্রোহের কথা সর্বাগ্রে বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হয়েছে (৭:৫৯); (১০:৭১)।

শারী‘আ-র বিষয়বস্ত্ত হলো: (ক) মানুষ এবং আল্লাহর মাঝে ‘আবদ-মাবুদ সম্পর্ক নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ; (খ) মানুষের সাথে অপর মানুষ ও জীবের সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এ দুয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, (গ) আল্লাহর সৃষ্ট এবং আল্লাহ কর্তৃক জীবের কল্যাণে নিয়োজিত যাবতীয় সামগ্রীর ব্যবহার ও বণ্টন ইত্যাদির নীতিমালা। নবীগণ যুগোপযোগী শারী‘আ লাভ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নবীদের শারী‘আতে কিছু প্রভেদ ছিল, কিন্তু তাওহীদ, আখিরাত ও আমাল-ই-সালিহ এ তিনটি মৌলিক বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শারী‘আ দীনের অন্তর্ভুক্ত। দীন চিরন্তন কিন্তু শারী‘আ বিবর্তনশীল।

ইসলাম ও মুসলিম পারিভাষিক ব্যবহার  কুরআনে ইসলাম ও মুসলিম শব্দদ্বয়ের পারিভাষিক ব্যবহার প্রবর্তন হয়। নূহ (আঃ)-এর অন্যতম প্রসিদ্ধ বংশধর ইব্রাহীম (আঃ) অপেক্ষাকৃত উন্নত শারী‘আতের প্রাপক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর দু পুত্র ইস্মাঈল এবং ইস্হাক (আঃ) উভয়ই নবী; উভয়ের বংশে আরও নবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইস্মাঈল-এর শাখায় মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্ম, ইস্হাক-এর শাখায় বানী ইস্রাঈল (য়া‘কুবের অপর নাম) বংশীয় নবীদের উদ্ভব হয়। যেমন মূসা ও ঈসা (আঃ)। সুতরাং তাঁদের সকলের ঊর্দ্ধতন পিতৃপুরুষ ছিলেন ইব্রাহীম (আঃ) এবং ইসলাম তাঁদের সকলেরই পবিত্র উত্তরাধিকার। কুরআনে ঘোষণা হয়: তোমাদের পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম-এর দীন বা মিল্লাত। তিনিই তোমাদেরকে ‘মুসলিম’ নামে অভিহিত করেছিলেন (২২:২৮)। পরে তাঁদের অনুসারিগণ নবীর নামে (য়াহুদা হতে য়াহুদি, ক্রাইস্ট হতে খ্রিস্টান ইত্যাদি) নিজেদের নামকরণ করেন এবং উভয় দল ইব্রাহীম (আঃ)-কে তাঁদের স্বধর্মাবলম্বী বলে দাবি করেন। কুরআনের জিজ্ঞাসা, ‘তোমরা কি বলতে চাও ইব্রাহীম, ইস্মাঈল, ইসহাক, য়া’কুব এবং তাঁদের বংশধরগণ য়াহুদি কিংবা নাসারা (খ্রিস্টান) ছিলেন? তোমরা কি আল্লাহ অপেক্ষা অধিকতর জ্ঞানী’ (২:১৪০)? কুরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে, ‘বরং ইব্রাহীম ছিলেন হানীফ (পরম নিষ্ঠবান) মুসলিম, তিনি মুশরিক ছিলেন না’।

শেষ নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর নুবুওয়াতে কুরআনের মাধ্যমে ইসলামী শারী‘আ পূর্ণত্ব লাভ করে (৫:৩)। পূর্ববর্তী নবীদের শারী‘আতের যে বিধানগুলি প্রশংসাবাদের সাথে অথবা বিরুদ্ধ মন্তব্য ছাড়া কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে তা ইসলামী আরী‘আ-এর অঙ্গরূপে গণ্য হয়েছে। যথা: জিহাদ (৩:১৪৫), কিসাস (৫:৪৫); পক্ষান্তরে নিন্দাবাদের সাথে উল্লিখিত পূর্ববর্তী উম্মাহর ক্রিয়াকর্ম ইসলাম বহির্ভূত হয়েছে। যথা: অস্বাভাবিক পন্থায় যৌনকর্ম (৭:৮১) এবং অন্যায়ভাবে অর্জিত অর্থ, সুদ, ঘুষ (৫:৬৩)। সুতরাং ইসলাম সম্পূর্ণ নতুন বা অভিনব দীন নয়, বরং একটি সমন্বিত ক্রমবিবর্তনজাত জীবন ব্যবস্থা যাতে অভিনব যুক্তিনির্ভর অনেক বিধানের সংযোজন হয়েছে।

ইসলামী বিধানের উৎস চারটি:  (১) কুরআন: মহানবী (সঃ)-এর তেইশ বছরের নুবুওয়াতকালে অবতীর্ণ সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ, সার্বজনীন আসমানী ধর্মগ্রন্থ।  (২) হাদীস: নবী কারীম (সঃ), তাঁর সাহাবী ও তাবি‘য়ীগণের কথা, কাজ এবং অনুমোদন সম্পর্কীয় বর্ণনা। (৩) ইজমা’: সঠিক যোগ্যতা সম্পন্ন ও ন্যায়নিষ্ঠ আলেমীদের শারী‘আতের বিধানের কোনো বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঐকমত্য ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। (৪) কিয়াস; যে বিষয় সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে কোনো স্পষ্ট বিধিনিষেধ নেই সেক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে প্রদত্ত অনুরূপ প্রশ্নের মীমাংসাকে ভিত্তি করে যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহণ। ইজমা ও কিয়াস ব্যবস্থাপক প্রক্রিয়ার বিধানসম্মত রূপ পরিগ্রহ করার কারণে ইসলাম গতিশীলতা অর্জন করেছে। ইসলাম যুক্তিবহ জীবন বিধান। এতে অন্ধ বিশ্বাসের স্থান নেই।

ইসলামকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবরূপে অমুসলিমরাও স্বীকার করেছে। Rev. Bosworth Smith-এর ভাষায়, ‘Islam is the most sudden, most complete and the most extra ordinary revolution that has ever come over any nation on earth’.  [ আ.ন.ম আবদুল মান্নান খান]

গ্রন্থপঞ্জি Rev. Bosworth Smith, Mohammed and Mohammedanism, London , 1875, p. 251; আল-কুরআন; সাহীহ আল বুখারী; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ