মুর্শিদি গান
মুর্শিদি গান এক প্রকার আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত। সুফিদের দ্বারা এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ‘মুর্শিদ’ শব্দটি আরবি; এর শব্দমূল ‘এরশাদ’, অর্থ আদেশ-উপদেশ দেওয়া। যিনি মুরিদ বা ভক্তকে আদেশ-উপদেশ দেন এবং জিকিরাদি দ্বারা অধ্যাত্মপথে পরিচালিত করেন, তিনিই মুর্শিদ। এক কথায়, মুর্শিদ হচ্ছেন আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক। হিন্দুর আধ্যাত্মিক যোগসাধনায় গুরুর এবং মারফতি ভাবসাধনায় মুর্শিদের স্থান একই।
বঙ্গদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধতন্ত্রে এবং নাথধর্মে গুরুবাদের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য আছে। মুসলিম বিজয়ের পর সুফি মরমিয়া সাধনার মুর্শিদতত্ত্বের সঙ্গে এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে; ইরানের সুফিতত্ত্বে মুর্শিদের স্থান আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। গুরু বা মুর্শিদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং তাঁর চরণাশ্রয় কামনা গুরুবাদ বা মুর্শিদতত্ত্বের মূল কথা। মুর্শিদ বা পীরকে মনে করা হয় কামেল পুরুষ; তাঁর মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়া যায়। মুর্শিদ ইহকাল-পরকালের মুক্তিদাতা, মানবজীবন-তরীর কান্ডারী। মাঝি ছাড়া যেমন নদী পার হওয়া যায় না, তেমনি গুরু ছাড়া আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করা যায় না। তিনি জগৎ ও জীবনের মোহ-বন্ধনে আবদ্ধ ভক্তকে মুক্তির পথ দেখান। এরূপ গুরু বা মুর্শিদের স্ত্ততি আছে যে গানে, তাই মুর্শিদি গান; এ গানে ভক্ত-হূদয়ের আকুতির কথা ভক্তিভরে প্রকাশ পায়।
মুর্শিদকে সরাসরি সম্বোধন করে ভক্ত আত্মনিবেদন করে। ‘ও তুমি আইসরে দয়াল আমার মুর্শিদ রে’, ‘দয়াল আমার কান্ডারী হইও রে’, ‘তুমি দাও দেখা দরদী রে আমায়’ ইত্যাদি গানে আত্মনিবেদনের এই রীতি লক্ষ করা যায়। ভক্ত আপনভাবে বিভোর হয়ে যে গান গায়, তার ভাষায় প্রকাশিত হয় তার দুঃখ-বেদনার কথা, হূদয়ার্তি ও প্রার্থনার আকুলতা। বাউল গানে নানা গোপনতত্ত্ব, যুক্তিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা থাকে, কিন্তু মুর্শিদি গানে মুর্শিদ ছাড়া অন্য কোনো জটিল তত্ত্ব নেই।
মুর্শিদের গুণগান ছাড়া ঐশীপ্রেমের কথাও মুর্শিদি গানের অন্যতম ভাববস্ত্ত। নদী, নৌকা, পাখি, রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি এ গানে রূপক অর্থে ব্যবহূত হয়। এতে অন্য কোনো পরিভাষা নেই। প্রেম ও ভক্তিভাব ব্যতীত এতে স্থূল লৌকিকতার কোনো স্থান নেই। এদিক থেকে মুর্শিদি গানের বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র।
মুর্শিদি গানের সুর মূলত করুণ ও কান্নাভরা। ভক্ত-হূদয়ের অক্ষমতা, অজ্ঞানতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা থেকে এই কান্না উত্থিত হয়। বিচ্ছেদ, মারফতি, ধুয়া, এমনকি বাউল গানেও মুর্শিদের প্রশংসা এবং আশ্রয় ও করুণা প্রার্থনার কথা আছে। বাণী, সুর ও গায়নরীতির তুলনামূলক বিচার দ্বারা মুর্শিদি গানকে আলাদাভাবে চেনা যায়। মুর্শিদি গান সাধারণত বিলম্বিত লয়ে গাওয়া হয়, কিন্তু তার সঙ্গে দ্রুতলয়ের সুর মিশ্রিত হলে এক মনোরম সুর তৈরি হয়। [ওয়াকিল আহমদ]