আমীর হামজা
আমীর হামজা মধ্যযুগের দোভাষী পুথিসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাব্য। এতে বীর যোদ্ধা আমীর হামজার যুদ্ধজয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ফারসি দস্তান-ই-আমীর হামজা-র অনুসরণে বাংলা ভাষায় প্রথম (১৬৮৪) আমীর হামজা কাব্য রচনা করেন চট্টগ্রামের কবি আবদুন নবী। এরপর ফকির গরিবুল্লাহ ও সৈয়দ হামজা যৌথভাবে একই বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেন। মোট ৭০টি পর্বে এ বিশাল কাব্য সমাপ্ত হয়। এর প্রথম অংশ গরিবুল্লাহ রচনা করেন আঠারো শতকের মধ্যভাগে, বাকি অংশ তাঁর শিষ্য সৈয়দ হামজা ১৭৯৪ সালে সমাপ্ত করেন। বটতলার ছাপাখানায় এটি মুদ্রিত হয়ে প্রচারের সুযোগ পায় বলে অধিক জনপ্রিয় হয়, কিন্তু আবদুন নবীর কাব্য হস্তলিখিত পান্ডুলিপির আকারে একটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র আমীর হামজা হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর পিতৃব্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ইরানের অধিপতি নওশেরোয়ানের বিরোধ ও যুদ্ধ কাব্যের প্রধান বিষয়বস্ত্ত। তিনি এরূপ অনেক রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তাঁরা সকলে পরাজিত হয়েছেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণ ও রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। কাব্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি প্রেম-সম্ভোগেরও বিস্তর বর্ণনা আছে। তারমধ্যে আমীর হামজা ও মেহেরনিগারের প্রেমোপাখ্যান প্রধান ও চমকপ্রদ। মেহেরনিগারের অসামান্য রূপে মুগ্ধ আমীর হামজা সুড়ঙ্গপথে তার সঙ্গে মিলিত হন, কিন্তু কোতোয়ালের হাতে ধরা পড়ে দুঃখকষ্ট ভোগ করেন। পরিশেষে পরিণয় ও মিলনের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুর্ভোগের অবসান ঘটে। এভাবে লৌকিক, অলৌকিক, ঐতিহাসিক, কাল্পনিক বহু ঘটনা এবং প্রধান-অপ্রধান নানা চরিত্রের সমাবেশে কাহিনী পল্লবিত হয়ে আমীর হামজা মহাকাব্যতুল্য বিশালতা লাভ করেছে।
যুদ্ধের প্রাধান্যের কারণে কাব্যখানি ‘আমীর হামজার জঙ্গনামা’ নামেও পরিচিত। আঠারো ও উনিশ শতকে মিশ্র ভাষায় এ জাতীয় আরও অনেক কাব্য (জৈগুনের পুথি, সোনাভান, হাতেম তাই প্রভৃতি) রচিত হয়েছে। এর কারণ, কোম্পানি আমলে পরাজিত শক্তি হিসেবে মুসলমানগণ বীর পুরুষ, বীর রমণীর যুদ্ধ ও বীরত্বের কাহিনী শুনতে ভালবাসত। তারা এতে এক প্রকার মানসিক সান্ত্বনা ও আত্মপ্রসাদ লাভ করত। ভাষা ও রচনাশৈলীর দিকে না তাকিয়ে কেবল বিষয়গৌরবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলার প্রায় সকল শ্রেণির মুসলমান এক সময় মোহাচ্ছন্নের মতো এসব কাব্য পাঠ করেছে এবং অতীত ঐতিহ্যে অবগাহন করে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। [ওয়াকিল আহমদ]