শাহজাহান

শাহজাহান (১৬২৮-৫৮)  মুগল সম্রাট। তিনি জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় খুররম। মেবার এবং আহমদনগর অভিযানে তাঁর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পিতা জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘শাহজাহান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

সম্রাট শাহজাহান

১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর জীবিত দুই পুত্র শাহজাহান ও শাহরিয়ারের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব সংঘটিত হয়। শ্বশুর আসফ খানের কূটনৈতিক কৌশলের বদৌলতে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আবুল মুজাফ্ফর শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ শাহজাহান’ উপাধি নিয়ে শাহজাহান আগ্রার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি উত্তর পূর্বে আসাম ও আরাকানে রাজ্যবিস্তার নীতি অনুসরণ করেন। তিনি কাসিম খান জুইনি (১৬২৮-১৬৩২), আজম খান (১৬৩২-৩৫),  ইসলাম খান মাশহাদী (১৬৩৫-১৬৩৯) এবং শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০)-কে পর পর বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। পর্তুগিজরা তাঁর সময়  হুগলিতে বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের নামে বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম চালাতে থাকে যা মুগলদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরকে প্রদত্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধার যথেচ্ছ অপব্যবহার করে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। অনেককে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে। এমনকি তাদের ধর্মপ্রচারকগণও স্থানীয় জনগণকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। ফিরিঙ্গিরা (চট্টগ্রামের পর্তুগিজ জলদস্যু) আরাকান রাজার পক্ষে মুগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। হুগলিতে দুর্গ নির্মাণ করে তারা নিজেদের বসতিকে সুরক্ষিত এবং বাংলার নদীগুলিতে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে অবাধে জলদস্যুতা শুরু করে। বিদ্রোহী যুবরাজ হিসেবে বাংলায় অবস্থানকালে এতদঞ্চলের পর্তুগিজ সমস্যা সম্পর্কে শাহজাহান অবগত ছিলেন। সম্রাটের নির্দেশক্রমে কাশিম খান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের হুগলি থেকে বিতাড়িত করেন। এ সময় বহু সংখ্যক পর্তুগিজ প্রাণ হারায় এবং যারা বেঁচে ছিল তারা বন্দি হয়। বছর খানেক পর পর্তুগিজরা ফিরে আসার অনুমতি পেলেও এবারে তাদের শক্তি ছিল সীমিত। গভর্নর ইসলাম খান মাশহাদীর আমলে আসামের রাজা প্রতাপসিংহ মুগলদের কাছ থেকে কামরূপ পুনরুদ্ধারে পরীক্ষিৎ নারায়ণকে সহায়তা করে এক আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষে বেশ কয়েকটি খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং অবশেষে আসামরাজ মুগলদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে বাধ্য হন এবং কামরূপ তাদের হাতে ছেড়ে দেন। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী পর্তুগিজদের সহায়তায় মগ জলদস্যুরা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় লুণ্ঠন চালিয়ে এ অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে। ইসলাম খান মাশহাদী তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে তারা পালিয়ে যায়।

ইসলাম খান মাশহাদী ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং সম্রাটের দ্বিতীয় পুত্র যুবরাজ সুজা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। শাহ সুজার শাসনামলে বাংলার কৃষি ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধি দেখা দেয় এবং দেশে শান্তি বিরাজ করে। উত্তর-পূর্ব সীমান্তের মুগল বিরোধীরা রাজকুমারের বিপক্ষে বিশৃংখলা সৃষ্টির সাহস পায় নি এবং তাঁর সময়ে মারাত্মক ধরনের কোন বিদেশী আক্রমণও সংঘটিত হয় নি। তাঁর আমলে ইংরেজ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় অবাধ বাণিজ্যিক অধিকার লাভ এবং বালাশোর, হুগলি ও পিপলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। শাহ সুজার সময়ে বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর হতে রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়। ১৬৪২ সালে উড়িষ্যাও তাঁর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। তাঁর শাসনকালে পারস্যের ধর্মপ্রাণ শিয়া মতাবলম্বী বহু সম্ভ্রান্ত ও বিদ্বান ব্যক্তি বাংলায় আসেন।

শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর চার পুত্র এক গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এদের মধ্যে সুজাই সর্বপ্রথম নিজেকে রাজমহল থেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। উত্তরাধিকারের এ লড়াইয়ে সুজা দুবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন প্রথমবার দারা এবং দ্বিতীয়বার আওরঙ্গজেব-এর বিরুদ্ধে। বাহাদুরপুরের যুদ্ধে দারার বাহিনী কর্তৃক সুজা পরাজিত হয়ে রাজমহলে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব মুরাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কয়েকটি যুদ্ধে পরপর জয়লাভ করেন। তিনি সম্রাট শাহজাহানকে আগ্রার দুর্গে অন্তরীণ করেন, গোয়ালিয়র দুর্গে মুরাদকে অবরুদ্ধ করে নিজে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের পর সুজা পুনরায় তাঁর ভাগ্য পরীক্ষার চেষ্টা করলেও খাজোয়ার যুদ্ধে তিনি দারুণভাবে পরাজিত হন। রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর ক্রমাগত চাপের মুখে সুজা আরাকানে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার রাজার গোপন চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন।

তাজমহল, বিভিন্ন সৌধ, বাগান প্রভৃতি স্থাপত্যকর্মে শাহজাহানের পরিশীলিত রুচির প্রকাশ ঘটেছে। সুবিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন শাহজাহানের আমলে আড়ম্বর এবং ঐশর্যের চিত্রই তুলে ধরে। আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণের আট বছর পর ১৬৬৬ সালে শাহজাহানের মৃত্যু হয়।  [কে.এম করিম]