বৈষ্ণব আন্দোলন

বৈষ্ণব আন্দোলন চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রবর্তিত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদীয়ায় এ আন্দোলন গড়ে ওঠে।

বৈষ্ণব আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মূলত চৈতন্যদেবের পূর্বে  চন্ডীদাস (১৪শ শতক) ও বিদ্যাপতির (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে;  চৈতন্যদেব এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তখন এর নতুন নাম হয় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম, যা সাধারণভাবে বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। হিন্দু সমাজে ভগবৎপ্রেম ও ভক্তিবাদ আশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন। তিনি রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্বকে গ্রহণ করে  অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদের কথা বলেন। কৃষ্ণের হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী শক্তির মানবীরূপ হচ্ছে  রাধা। সুতরাং মূলে উভয়ে অদ্বৈত, কিন্তু দেহরূপে দ্বৈত; পুনরায় অদ্বৈত বা একাত্ম হওয়ার জন্যই তাঁরা মর্ত্যলীলা করেন। প্রেম ও ভক্তি দিয়ে পরমাত্মাকে পাওয়া যায়; তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমসাধনা একাত্ম হওয়ার সাধনা। এজন্য তা ‘দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এ তত্ত্বের উপলব্ধি ও সাধনা সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য নয় বলে একে ‘অচিন্ত্য’ বলা হয়েছে।

বৈষ্ণবধর্মে  কীর্তন প্রচলিত ছিল। চৈতন্যদেব পদযাত্রাসহ নামসঙ্কীর্তন ও নগরকীর্তন প্রবর্তন করে এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। নব্য বৈষ্ণবধর্মে সুফি ধর্মমতের আশেক-মাশুক তত্ত্ব, নাম-মাহাত্ম্য, জিকির বা ভক্তিবাদ এবং সামা নাচ-গানের প্রভাব পড়েছিল বলে পন্ডিতগণ অভিমত পোষণ করেন। ভক্তিভাবাশ্রিত নামসঙ্কীর্তনে বৈষ্ণব আন্দোলন প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়। এ কারণে বৈষ্ণব আন্দোলন ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও অভিহিত হয়। আবার সার্বিকভাবে চৈতন্যদেবের অবদানের কথা স্মরণ করে একে ‘চৈতন্য আন্দোলন’ও বলা হয়।

চৈতন্যদেবের এই আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল দুটি: এক. স্বধর্ম ও স্বসমাজের সংস্কার সাধন এবং দুই. শাসক শ্রেণির ছত্রচ্ছায়ায় ইসলাম ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করা। তিনি একদিকে মধ্যে বিরাজমান হিন্দু অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপরদিকে নামসঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নব্য প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এভাবে তিনি উচ্চ ও নিম্ন বর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের সন্নিকটে এনে এক আত্মীয়ভাবাপন্ন হিন্দু সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

চৈতন্যদেবের সময়ে হিন্দু সমাজের অবস্থা ছিল খুবই সঙ্কটজনক। সমাজে তখন বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কারণে অস্পৃশ্যতা, অস্পৃশ্যতার কারণে বৈষম্য এবং বৈষম্যের কারণে সামাজিক অনৈক্য বিরাজ করছিল। উপরন্তু  সতী প্রথাকৌলীন্য প্রথা, গৌরীদান বা বাল্যবিবাহ, জাতিচ্যুতি, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি সংস্কার হিন্দু সমাজকে নানা দিক থেকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। স্মার্ত পন্ডিত  রঘুনন্দন নব্যন্যায় ও  স্মৃতিশাস্ত্র প্রবর্তন করে সমাজকে বজ্রবন্ধনে আবদ্ধ করেন। তিনি পুণ্যফল, পরকাল ও ঈশ্বর সামীপ্যের লোভ দেখিয়ে এবং অজস্র বিধিনিষেধ আরোপ করে মানুষকে অনুষ্ঠানক্লিষ্ট করে তোলেন। চৈতন্যদেব হিন্দু সমাজের এই অচলায়তন ভেঙ্গে তাতে মানবতার নবপ্রাণ সঞ্চার করেন। তাঁর কাছে কোনো জাতিভেদ, ধর্মভেদ বা বর্ণভেদ ছিল না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রচার করেন যে, কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে কোনো জাতিকুল বিচার নেই, সবাই সমান। বৈষ্ণব আন্দোলনের মূল শক্তি এখানেই নিহিত।

মধ্যযুগে বিভিন্ন বর্ণশ্রেণীতে বিভক্ত হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের উপর্যুক্ত মতবাদ ছিল কল্পনাতীত। তখন সমাজের উচ্চ কোটিতে ছিল  ব্রাহ্মণ, আর নিম্ন কোটিতে  শূদ্র।  চন্ডাল শূদ্র শ্রেণিভুক্ত। ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তুর্কি বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়। এরূপ অবস্থায় ব্রাহ্মণ সন্তান চৈতন্যদেব চন্ডাল,  মুচি, ম্লেচ্ছ,  বৈশ্যকায়স্থ, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের মানুষকে কৃষ্ণের প্রেমমন্ত্রে ডাক দিয়ে ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রবর্তিত নামসঙ্কীর্তনে যেকোনো ব্যক্তি যোগ দিতে পারত। তিনি বলতেন ভক্তিযোগের মাধ্যমে তিনি সকলকে উদ্ধার করবেন। বৈষ্ণব আন্দোলন যে ভক্তি আন্দোলন ছিল, এতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। নামসঙ্কীর্তন বৈষ্ণব আন্দোলনের একটি শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম ছিল, আর নগর-সঙ্কীর্তনে ছিল সংঘশক্তির পরিচয়। এর সঙ্গে পদযাত্রা (কীর্তনদলের মিছিল) যুক্ত করে তিনি আন্দোলনকে বেগবান করেন।  চৈতন্যদেব দেবতা, ভক্তি, ভজনপূজন এবং ঐশী মহিমার গুরুত্ব স্বীকার করেও মানবমহিমা ও ইহজাগতিকার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এতে তাঁর ব্যক্তিমানুষ ও সমকালচেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে।

চৈতন্যদেব নিজে কোনো কিছুর চর্চা করে অন্যকে তা শিক্ষা দিতেন। চৈতন্যভাগবতে আছে: নবদ্বীপে নগরভ্রমণ উপলক্ষে তিনি প্রথমে তন্তুবায়ের গৃহে যান এবং তার দান হিসেবে নববস্ত্র গ্রহণ করেন। পরে গোয়ালার ঘরে দধিদুগ্ধের মহাদান গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, মালাকার, তাম্বলী সকলের ঘরে গিয়ে তাদের আন্দোলনের শরিক করেন। তিনি যে জাতিভেদ মানতেন না এবং জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়ও করতেন না, এসব দৃষ্টান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য জাতিভেদের কঠোরতা শিথিল করেন। তাঁর কাছে শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল অধিক। তাঁর পরিকর-পার্ষদবর্গের মধ্যে ব্রাহ্মণ ( রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী,  জীব গোস্বামী),  বৈদ্য ( মুরারি গুপ্ত, অদ্বৈত আচার্য), কায়স্থ (রঘুনাথ দাস, নরোত্তম দাস), যবন (হরিদাস), সুবর্ণ বণিক (উদ্ধারণ দত্ত), সদ্গোপ (শ্যামানন্দ দাস) প্রভৃতি বর্ণ বা গোত্রের ব্যক্তিরা ছিলেন। তাঁর প্রেমভক্তিবাদে সমাজের সব স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। এতে সামাজিক সচলতার (social mobility) লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেকালের বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবরা এক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় দেন।

ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দন, দেবীবর ঘটক, ধ্রুবানন্দ মিশ্র প্রমুখের মতো শাস্ত্রবেত্তা সমাজের বিধিবিধানকে কঠোর থেকে কঠোরতর করার নীতি গ্রহণ করেন। চৈতন্যদেব সে পথে না গিয়ে ইসলামের উদারনৈতিক শক্তিগুলি আত্তীকরণ করেন। পৌত্তলিক বিশ্বে আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা দেবগুণ অর্জন করার কথা থাকলেও বৈষ্ণবরা প্রেমভক্তি সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ধারণা একেশ্বরবাদী ও মরমিয়াপন্থী সুফিগণের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছিলেন।

বৈষ্ণবদের গুরু ও  আখড়া সুফিদের পীর ও খানকাহ্র সমতুল্য। ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে আখড়াগুলি সংগঠনের কাজ করেছে। নদীয়ার শান্তিপুর, রাজশাহীর খেতুরি, বর্ধমানের শ্রীখন্ড, বাঁকুড়ার বনবিষ্ণুপুর, হুগলির খড়দহ প্রভৃতি আখড়া হিসেবে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। এগুলি একেক জন গোস্বামী বা গুরুর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। চৈতন্যদেবের মতানুযায়ী যিনি কৃষ্ণতত্ত্বজ্ঞ তিনিই গুরু হতে পাতেন, তা তিনি যে বর্ণেরই হোন না কেন। গুরুর প্রতি এরূপ সর্বোচ্চ শ্রদ্ধানিবেদন ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বৈষ্ণব আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শীর্ষ স্থানীয় বৈষ্ণব গুরুদের মধ্যে নারীরও স্থান ছিল। নিত্যানন্দের কনিষ্ঠা পত্নী ও বীরভদ্রের বিমাতা জাহ্নবীদেবী খড়দহে বৈষ্ণব কেন্দ্র গড়ে তুলে ধর্মপ্রচার করেন। তিনি ভক্তের চোখে ‘ঈশ্বরী’ রূপে খ্যাত ছিলেন। বিষ্ণুপুরের শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরানীও অনুরূপভাবে আখড়া পরিচালনা, ভক্তদের দীক্ষাদান ও ধর্ম প্রচারের অধিকার লাভ করেন। নাথপন্থায় মহাজ্ঞানের অধিকারিণী ময়নামতীও গুরুর অধিকার ভোগ করেন। সুফিবাদে নারীর এ ধরনের অধিকার ছিল না। ধর্মপ্রচারে নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দিয়ে বৈষ্ণবগণ প্রগতিশীল সাংগঠনিক ও মিশনারি চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করে চৈতন্যদেব বৈষ্ণব আন্দোলনকে আরও বাস্তবমুখী ও বেগবান করে তোলেন। উচ্চ বর্গের হিন্দু সম্প্রদায় সংস্কৃতকে এবং মুসলমান সম্প্রদায় আরবি-ফারসিকে শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যম করায় বাংলা ভাষা প্রায় দু-তিনশ বছর উপেক্ষিত ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষায় কোনো কিছু রচনা বা অনুবাদ করাকে অধর্মের কাজ বলে মনে করা হতো। শ্রীচৈতন্য এবং তাঁর পার্ষদদের অনেকে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন এবং তাঁরা সংস্কৃতে বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা বৈষ্ণব প্রেমভক্তিবাদ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ ও প্রচার করেন। বৈষ্ণব কবিগণ তাঁদের পদগুলিকে অধ্যাত্ম সাধনার অঙ্গরূপেই মনে করতেন। ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত অসংখ্য বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি চৈতন্য ও মোহান্তগণের বিশালাকার চরিতকাব্য, কিছু কড়চা ও শাস্ত্রকাব্যও রচিত হয়েছে। ফলে বৈষ্ণব আন্দোলন শক্তিশালী ভিত্তি ও গতিবেগ লাভ করে।  দীনেশচন্দ্র সেন শ্রীচৈতন্যের সমকাল ও উত্তরকালে ১৬৪ জন বৈষ্ণব পদকর্তার নাম করেছেন, যাঁদের রচিত পদসংখ্যা ৪,৫৪৮টি। এছাড়া শতাধিক বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিও ছিলেন। আঠারো শতকে পদকল্পতরু, পদামৃতসমুদ্র, রসমঞ্জরী, গীতচিন্তামণি, পদকল্পলতিকা ইত্যাদি সংকলন-গ্রন্থে অসংখ্য বৈষ্ণবপদ সংকলিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্য ও মোহান্তদের জীবনীগ্রন্থগুলি ( চৈতন্যভাগবতচৈতন্যমঙ্গলচৈতন্যচরিতামৃত, ভক্তিরত্নাকর ইত্যাদি) একাধারে জীবনী, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন ও সমাজকথার দলিলরূপে বিবেচিত। জীবনচরিত ও তত্ত্বকাব্যে বৈষ্ণবদের বুদ্ধিবৃত্তির সূক্ষ্মতা ও জ্ঞানের গভীরতার ছাপ রয়েছে। এভাবে চৈতন্যদেবের জীবন ও কর্মকে কেন্দ্র করে একটি শিক্ষিত বৌদ্ধিক শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল।  সুশীল কুমার দে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় রচিত বৈষ্ণবদের অসাধারণ সাহিত্যকর্মকে চৈতন্য আন্দোলনের একটি বিশিষ্ট ধারা বলে মন্তব্য করেছেন। চৈতন্যদেব স্থবির হিন্দু সমাজকে কেবল গতিশীলই করেননি, তিনি সে সমাজকে সৃষ্টিশীল করে তুলেছিলেন। বৈষ্ণব আন্দোলনের এরূপ সাংস্কৃতিক সাফল্য সমকালের অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না। সুফিরাও অধ্যাত্মসাধনার কথা প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস বৈষ্ণবদের মতো এত সুসংগঠিত ও সম্প্রসারিত ছিল না।

বৈষ্ণব আন্দোলনে ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও চৈতন্যদেব মানবপ্রেমের ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি কোনো শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর তিরোধানের পর বেনারসের  ষড়গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মনীতি ও আচরণবিধি প্রণয়ন করে একে নানারূপ আনুষ্ঠানিকতা দান করেন। ফলে শাস্ত্রমুখী চিন্তার প্রভাবে চৈতন্যদেবের হূদয়াশ্রিত প্রেমধর্মের গতিপ্রবাহ ক্রমশ রুদ্ধ ও শুষ্ক হয়ে পড়ে। এদিকে উদারপন্থী বৈষ্ণবগণ শাস্ত্রের কঠোরতা অস্বীকার করেন এবং গুরু ও আখড়া অবলম্বন করে  সহজিয়া মতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের অনুসারী নেড়ানেড়ির দল আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে  বাউল সম্প্রদায়ের পত্তন করে এবং গুরু বা মোহান্তগণ মিশনারির আদর্শ থেকে সরে গিয়ে  মোহান্তগিরিকে উপার্জনের পন্থা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা গুরুদর্শন, দীক্ষাদান, মন্ত্রশিক্ষা, সাধনভজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষিণা ও ভেট প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা আরোপ করে একে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করেন।

চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই মানবতাবাদী বৈষ্ণবদের ধর্মচর্চা বর্ণবাদী ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়, কারণ বর্ণপ্রথার পরিপন্থী আচরণমালা তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। কালের প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ্যসংস্কার প্রবল হলে উচ্চবর্ণের লোকেরা সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়ে বৈষ্ণবধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে নতুন মেধার আগমন বন্ধ হয়ে যায়। এসব কারণে শতাব্দীকালের ব্যবধানে বৈষ্ণব আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং সতেরো শতক পর্যন্ত টিকে থাকলেও আঠারো শতকে সামাজিক শক্তি হিসেবে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।  [ওয়াকিল আহমদ]

আরও দেখুন বৈষ্ণববাদ; বৈষ্ণব সাহিত্য

গ্রন্থপঞ্জি  মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৫; গোপাল হালদার, বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা (১ম খন্ড), কলকাতা, ১৯৭০; ক্ষেত্র গুপ্ত (সম্পাদিত), শ্রীচৈতন্য : একালের দৃষ্টিকোণ, কলকাতা, ১৯৮৬; Sushil Kumar De, History of the Vaisnava Faith and Movement in Bengal, Calcutta, 1961।