লোকসংস্কৃতি
লোকসংস্কৃতি লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবন-যাপন প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি। এটা সম্পূর্ণই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি তাদের প্রকৃত পরিচয় বহন করে।
কোনো দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা প্রধানত দুটি: নগরসংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি। ভ্যাটিক্যান সিটি একটি নগররাষ্ট্র, তাই ভ্যাটিক্যানবাসীর সংস্কৃতি একটাই নগরসংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা তিনটি: নগরসংস্কৃতি, গ্রামসংস্কৃতি ও উপজাতীয় সংস্কৃতি। বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত।
নগরের স্বল্প পরিসরে ঘন বসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসায়, বৃত্তি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, আনন্দোৎসব, যাতায়াত ও উৎপাদন পদ্ধতির সংমিশ্রণে নগরসংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ সংস্কৃতি সূক্ষ্ম, জটিল, বৈচিত্র্যময়, গতিশীল ও জাঁকজমকপূর্ণ। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে নগরসংস্কৃতি পরিবর্তন ও রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত বিস্তার ও উৎকর্ষ লাভ করে। কিন্তু প্রকৃতিনির্ভর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা প্রধানত ঐতিহ্যমুখী, গতানুগতিক ও মন্থর। গ্রামবাসীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। তারা পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মকর্ম, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাকে অবলম্বন করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। সরলতা, সজীবতা ও অকৃত্রিমতা লোকসংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে ৩২টি উপজাতি রয়েছে। উপজাতীয় সংস্কৃতি এক অর্থে লোকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত, তবে কতক বিষয়ে পার্থক্য থাকায় তা পৃথকভাবে বিবেচিত হয়। উপজাতীয় সংস্কৃতি অধিক মাত্রায় রক্ষণশীল, পরিবর্তনবিমুখ ও ঐতিহ্যপন্থী। বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের অপরিবর্তনীয় অর্থনীতি ও অন্তর্মুখী মনমানসিকতার কারণে যেখান থেকে জীবনযাত্রা শুরু করেছিল, বর্তমানেও প্রায় সেখানেই রয়ে গেছে। একই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাস করেও তারা বৃহত্তর লোকসমাজের সঙ্গে মিলেমিশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে এগিয়ে না এসে বরং নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার নামে প্রাচীন সংস্কার, প্রথা ও ঐতিহ্যকে অাঁকড়ে ধরে আছে। সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা না থাকায় তাদের সংস্কৃতিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তনও লক্ষ করা যায় না।
প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত অক্ষরজ্ঞানহীন ও ঐতিহ্যানুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনসমষ্টিকে ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়। এই অভিধাভুক্ত বিশ্বের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বিকশিত সংস্কৃতিতে বিস্ময়কর মিল আছে। লোককলাবিদ স্টিথ থমসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোককাহিনী ও পুরাণকে অবলম্বন করে ৬ খন্ডে যে মোটিফ ইন্ডেক্স রচনা করেছেন, তা থেকেই বিশ্বের এই লোক-মানসিকতার অভিন্ন গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখে। একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়’। বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে; কোথাও তা ‘শস্যরাণী’, কোথাও ‘শস্যপুতুল’, কোথাও বা ‘শস্যমাতা’ নামে অভিহিত। বিষয়, চিন্তা-ভাবনা ও আবেদনের দিক থেকে লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ আছে।
লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্ত্তগত (material), মানসজাত (formalised), অনুষ্ঠানমূলক (functional) এবং প্রদর্শনমূলক (performing)। লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে সেসব বস্ত্তগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, যেমন: বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটির আবার বহুবিধ প্রকারভেদ আছে। যেমন কৃষক প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে, তাঁতি সব ধরণের বস্ত্র, কুমার সব ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, ছুতার কাঠের যাবতীয় আসবাবপত্র, কামার লোহার বিবিধ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নির্মাণ করে। ধোপা, নাপিত, সোনারু, কাঁসারু, শাঁখারি, ময়রা,চর্মকার, ঘরামি, জেলে, কাহার প্রভৃতি বৃত্তিধারী শ্রমজীবী মানুষ পেশাগত কাজে নানারকম হাতিয়ার ব্যবহার করে। গ্রামের মানুষ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য নিজেরাই উৎপাদন ও বিতরণ করে; এজন্য তাদের অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় না। স্যার মেটকাফ তাই বাংলার স্বল্পতুষ্ট ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিকে ছোট ছোট রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেছেন। পর্ণকুটিরে বসবাস গ্রামের একটি সাধারণ দৃশ্য। পাশাপাশি আবার একচালা থেকে আটচালা ঘরও নির্মিত হয়। সৌখিন ও অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আটচালা গৃহ নির্মাণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে কেবল প্রয়োজনীয়তা নয়, নান্দনিকতারও ব্যাপার আছে। বাংলার লোকসংস্কৃতি এখানে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
বাংলার তাঁতিরা মসলিন তৈরি করে এককালে বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল। জামদানি বস্ত্রের সুনাম এখনও আছে। কুমার নির্মিত মাটির দেবদেবীর মূর্তি এখনও মৃৎশিল্পের অনন্য নিদর্শন। তারা সখের হাঁড়ি, মনসার ঘট, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি তৈরি করে অনন্য শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছে। ছুতার প্রাচীন কাল থেকেই কাঠের খাট-পালঙ্ক, দরজা, চৌকাঠ, নৌকা ইত্যাদি দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ করে আসছে। এক সময় বাংলার ময়ূরপঙ্খি, সপ্তডিঙ্গা, চৌদ্দডিঙ্গা প্রভৃতি সমুদ্রগামী নৌকার সুনাম ছিল। বাঁশ, বেত, কাঠ, পাট ও শোলা দিয়ে নানারকমের নিত্য ব্যবহার্য ও সৌখিন দ্রব্য তৈরি হয়। সিলেটের নকশি পাটির সুনাম দীর্ঘকালের।
পাটের তৈরি নকশি শিকা আন্তর্জাতিক বাজারে সৌখিন পণ্যরূপে সমাদর পাচ্ছে। নকশি পাখা, শিকা ইত্যাদি পল্লীর রমণীরাই তৈরি করে। তারা বিচিত্র ধরণের ও বিচিত্র স্বাদের রন্ধনশিল্পেও পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। বাঙালির রন্ধন-তালিকায় বত্রিশ ব্যঞ্জনের উল্লেখ আছে। রন্ধনকর্মে নারী কীরূপ পারদর্শিনী তা বিচার করে এক সময় বিয়ের পাত্রী নির্বাচন করা হতো। বিচিত্র ও সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরিতে বাঙালি ময়রার দক্ষতা এখনও তুলনাহীন। দুধ, চিনি, আটা ও ময়দা দ্বারা শতাধিক ধরণের মিষ্টান্নের নাম পাওয়া যায়। এতে ভোজনরসিক বাঙালির পরিচয় ফুটে ওঠে। এখানে বস্ত্তগত লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কয়েকটি ধারার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
মৌখিক ধারার লোকসাহিত্যকে মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সঙ্গে কিছু চিত্রকর্মকেও যুক্ত করা যায়। অনুমান হলেও সত্য যে, মানুষ যখন থেকে ভাষা পেয়েছে তখন থেকেই কিছু না কিছু সৃষ্টি করে আসছে। এ অর্থে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের লোকসাহিত্যও বেশ প্রাচীন। বিশ্বের প্রায় সব ধারার লোকসাহিত্যের উপাদানই বাংলা ভাষায় বিদ্যমান। বাংলায় লোককাহিনী, লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যের প্রচলন আছে। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। পলি দ্বারা গঠিত বাংলার নরম মাটি, শ্যামল প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, কৃষি-অর্থনীতি, দীর্ঘস্থায়ী সামন্ত সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে বাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছে। মুখ্যত কৃষকসমাজই লোকসাহিত্যের স্রষ্টা ও ধারক-বাহক। এর সঙ্গে গো-মহিষের রাখাল, নৌকার মাঝি-মাল্লা, গায়ক সম্প্রদায় বাউল, ভিক্ষোপজীবী ফকির-বৈরাগী ও পেশাজীবী বেদে-বেদেনিরা লোকসঙ্গীতের চর্চা করে থাকে। লোকচিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ওঝা ও মন্ত্রগুপ্তিরা মন্ত্রের চর্চা করে। সাপের ওঝা সর্পবিষের ও ভূতের ওঝা তথাকথিত ভূত-প্রেতাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করে। শিরালি মন্ত্রগুণে আকাশের মেঘ-শিলাবৃষ্টি পর্যন্ত বিতাড়িত করতে পারে বলে লোকসমাজ বিশ্বাস করে।
বিগত একশ বছর ধরে লোকসাহিত্য সংগ্রহ, সংকলন, সম্পাদনা ও তা নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। সব ধরনের উপাদান একত্র করলে এ সাহিত্য বিপুল আকার ধারণ করবে। লোককথা, রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি ও লোকপুরাণ মিলে লোককাহিনীর এক বিশাল ভান্ডার গড়ে উঠেছে। স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ ও চিন্তা মিশ্রিত এসব রচনায় জাতির অতীতের অনেক কিছুই নিহিত আছে। বাংলার রূপকথায় ড্রাগন নেই, আছে রাক্ষস-খোক্কস ও ভূত-প্রেত। এসব অলৌকিক জীবের প্রতীকে মূলত অত্যাচারী কোনো প্রবল শক্তিকেই রূপায়িত করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে যুদ্ধে রূপকথার রাজপুত্রকে জয়ী করা হয়েছে। সে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে আগামী দিনগুলিতে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত করবে। কাহিনী-নির্মাতা রাজপুত্রের নিরাপদ ও দ্রুততম বাহন হিসেবে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পরিকল্পনা করেছে; অসহায়ের বন্ধু হিসেবে সাহায্যকারী ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমির চিন্তা করেছে। এগুলি প্রতীক চরিত্র, যা লোকমনের ইচ্ছাপূরণ করে থাকে। ব্রতকথায় হিন্দু রমণীর ধর্মবোধের অন্তরালে বৈষয়িক ও জাগতিক কামনা-বাসনা নিহিত থাকে। কিংবদন্তিতে আছে লুপ্ত ইতিহাসের খন্ড ক্ষুদ্র উপাদান।
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসঙ্গীতের প্রচলন আছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি ধারার শতশত গান আজও প্রচলিত আছে। লৌকিক ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ এসব গানের বাণীতে জাতির অন্তর্জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। কতক গানে ধর্মীয় আবেগ জড়িত আছে; তবে অধিকাংশ গানই চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গীত হয়। খেমটা, পটুয়া ও সাপুড়ে গানগুলি জীবিকার সঙ্গে জড়িত। মেয়েলি গীত, সহেলি গীত, হুদমা গীত ইত্যাদিতে নারীসমাজের কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটেছে।
লোকগাথার মতো দীর্ঘ পালাগানএ সমাজজীবনের বাস্তব চিত্রটি ধরা পড়েছে। প্রেমই গাথাগুলির মুখ্য বিষয়; তবে কিছু বীরত্ব ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্রও আছে। ছড়ায় আছে কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্রণজাত বিচিত্র বিষয়। শিশুতোষ রচনা হিসেবে ছড়া সুদূর অতীত থেকে শিশুর সরস চিত্তকে অভিষিক্ত করে আসছে। মন্ত্র ইচ্ছাপূরণের মাধ্যম, কেননা এতে জাদুশক্তি আছে। বাঙালি তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাসী; তারা বাহুবল অপেক্ষা মন্ত্রবলে বৈরি ও অপশক্তিকে দমন করার বাসনা পোষণ করে। মারণ, উচাটন ও বশীকরণ মন্ত্রও জাদুবিশ্বাসের ফল। বুদ্ধি ও মননপ্রসূত ধাঁধা, প্রবাদ ও প্রবচনগুলি জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। প্রবাদ-প্রবচন সব দেশের ভাষার এক অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত হয়।
চিত্রকলাকে বলা যায় বস্ত্ত-আশ্রিত মানস ফসল। আলপনা, পটচিত্র, ঘটচিত্র, দেওয়ালচিত্র, অঙ্গচিত্র প্রভৃতিতে রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। ঘরের মেঝে, খুঁটি, দেওয়াল, কুলা, ডালা ইত্যাদিতে আলপনা দেওয়া হয়। ব্রতপূজা উপলক্ষে ব্রতের আলপনা দেওয়ার রীতি আছে। বর্তমানে অন্নপ্রাশন, বিবাহ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষেও পথে-প্রাঙ্গণে আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা। পটুয়ার পটচিত্র ও পটগীত বাঙালির ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি থেকে উদ্ভূত। কালীঘাটের পটচিত্র এর রূপান্তরিত ও অবক্ষয়িত রূপ। কালীঘাটের পট লোপ পেয়েছে, কিন্তু পটুয়ার পটচিত্রের প্রচলন আজও আছে।
নকশি কাঁথা সূচিশিল্পের মধ্যে পড়ে। এটি একান্তভাবে পল্লিরমণীর নিজস্ব সম্পদ। বিছানার চাদর এবং লেপ ও বালিশের কভার হিসেবে ব্যবহূত হলেও নানা চিত্রকর্মে শোভিত এসব কাঁথা নান্দনিকতা গুণে দেশ-বিদেশের শিক্ষিত সমাজেও সমাদৃত হয়েছে। শহরে এখন নকশি কাঁথা সৌখিন পণ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হয়।
অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান। অভিনয় ও অঙ্গক্রিয়া দ্বারা এসব রূপায়িত হয়। বাউল, গম্ভীরা প্রভৃতি গান, নাচ ও অভিনয় ত্রি-অঙ্গের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়। জারি গানের সঙ্গে জারি নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলি সকল শ্রেণির মানুষের চিত্তবিনোদনের উৎস। হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে নিজস্ব কিছু আচারসহ পরিবেশিত হয়। কতক গান পেশাজীবী গায়েন, বয়াতি ও গীদালরা পরিবেশন করে; আর বাকিগুলি বাড়ি-ঘরে, মাঠে-ঘাটে ও খেতে-খামারে নানা শ্রেণির মানুষ কাজ করতে করতে বা কাজের অবসরে গেয়ে শ্রান্তি দূর ও আনন্দ উপভোগ করে।
প্রথম জমি চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত নানা ধরনের লোকাচার আছে। এর কতগুলি প্রাকফসল, আর কতকগুলি ফসলোত্তর আচার। বৃষ্টির জন্য মেঘারাণী, হুদমা দেওয়া, বেঙ বিয়া, ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতবন্ধন, কাকতাড়ুয়া, গাস্বি উৎসব প্রভৃতি প্রাকফসল আচার; আর লক্ষ্মীর ছড়, নবান্ন, মাগন প্রভৃতি ফসলোত্তর অনুষ্ঠান। এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই; তবে টুসু, ভাদু, করম, বসুধারা প্রভৃতি ব্রতাচার হিন্দু রমণীরাই পালন করে থাকে।
শরীরচর্চা, আমোদ-প্রমোদ ও অবসরযাপনের জন্য লোকসমাজে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। জল, স্থল ও অন্তরীক্ষভেদে তিন ধরনের লোকক্রীড়া আছে। শ্রমসাপেক্ষ শরীরচর্চার খেলা ও শ্রমহীন আনন্দের খেলা হিসেবে অন্তরঙ্গন ও বহিরঙ্গনের খেলারূপেও এগুলিকে ভাগ করা যায়। হাডুডু একটি জনপ্রিয় খেলা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে হাডুডু স্বীকৃতি লাভ করেছে। বলীখেলা, নৌকা বাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, মোগল-পাঠান, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামছি, ঘুড়ি উড়ানো, কবুতর উড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি খেলায় সকল স্তরের লোকজন অংশগ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তরে কতক অঞ্চলে নৌকা বাইচ, বলীখেলা ও ষাঁড়ের লড়াই বাদ্যযন্ত্রসহ বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় উৎসবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কতক খেলাধুলা শরীরচর্চা ও শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে স্কুলের বালক-বালিকারাও অনুশীলন করে।
‘বার মাসে তের পার্বণ’ প্রবাদ দ্বারা উৎসবমুখর বাঙালি জাতির মৌলিক পরিচয় ফুটে ওঠে। হিন্দুদের ব্রতাদি আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্যের কথা বিবেচনা করেই এরূপ প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। বার, তিথি, মাস ও ঋতুভিত্তিক এসব পার্বণের উদ্ভবের পেছনে প্রাকৃতিক ও দৈব শক্তির কল্পনা আছে। শাস্ত্রীয় ধর্মের পাশাপাশি হিন্দুরা লক্ষ্মী, মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, ওলাদেবী, বনদুর্গা, দক্ষিণরায়, সত্যনারায়ণ, পাঁচু ঠাকুর প্রভৃতি লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর পূজাচার পালন করে থাকে। দীর্ঘকাল একত্র বসবাসের ফলে নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের ওপরেও এসবের প্রভাব পড়েছে। তারা সত্যপীর, গাজীপীর, মানিকপীর, মাদারপীর, খোয়াজ খিজির, ঘোড়াপীর, বনবিবি, ওলাবিবি, হাওয়া বিবি প্রভৃতি কাল্পনিক, লৌকিক ও ঐতিহাসিক পীর-পীরানিকে হিন্দু দেবদেবীর প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে পূজা-মানত করে থাকে। এসবের পেছনে অসহায় মানুষের রোগ-ব্যাধি ও ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার কামনা-বাসনা নিহিত রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কতক পূজা-মানত পৃথকভাবে করে, আবার কতক ক্ষেত্রে উভয়ে পরস্পরের অংশীদার হয়। সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর, বনদুর্গা ও বনবিবি যে একই ভাবনার ভিন্ন রূপ তাতে সন্দেহ নেই। অনুরূপভাবে অসংখ্য মেলা আছে যেখানে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যোগদান ও আনন্দোপভোগ করে। হিন্দুর রথযাত্রার মেলায় মুসলমান এবং মুসলমানের মুহররমএর মেলায় হিন্দুর অংশগ্রহণে কোনো বাধা নেই। বৈশাখী মেলা এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। হিন্দুরা দেওয়ালি উৎসবে প্রদীপ ভাসায়, মুসলমানরা মুহররম অনুষ্ঠানে বেরা ভাসায়। শুভ অনুষ্ঠানে মঙ্গলঘট স্থাপন ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো আগে শুধু হিন্দু সমাজেই প্রচলিত ছিল, এখন মুসলমানের অনুষ্ঠানেও মঙ্গল কামনায় ওইরূপ করা হয়। জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু উপলক্ষে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু আচার-অনুষ্ঠান আছে। গায়ে হলুদ, ডালা, বর-কনে স্নান, মাড়োয়া সাজানো, আয়নামুখ, কড়ি খেলা, বরবধূ বরণ, ফিরানি ইত্যাদি আচার কমবেশি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই পালিত হয়।
নৃতত্ত্বের বিচারে বাঙালির দেহে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো, মোঙ্গলীয় প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রক্তধারা প্রবাহিত; এর সঙ্গে পরবর্তীকালে অ্যালপানীয়, পলিনীয়, সেমিটিক প্রভৃতি জাতির রক্তও মিশেছে। এদিক থেকে বাঙালি একটি সংকর জাতি। বাংলার লোকসংস্কৃতিতেও বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ করে কৃষিকাজ ও কৃষকজীবনের ক্ষেত্রেই মিশ্রণ বেশি হয়েছে। ধর্ম, মত ও পথ নির্বিশেষে যুগযুগ ধরে বিভিন্ন বর্ণ ও পেশার মানুষের একত্র বসবাস ও পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের ফলে গ্রামীণ জীবনে বিরোধ অপেক্ষা ঐক্যের সুরই বেশি ধ্বনিত হয়েছে। এজন্য ভারতীয় সংস্কৃতির মতো বাংলার লোকসংস্কৃতিতেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে এবং এর মধ্যেই বাঙালির জাতিগত পরিচয় নিহিত রয়েছে। [ওয়াকিল আহমদ]