দর্শন
দর্শন বাঙালির দর্শনচর্চার ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। প্রথম বাঙালি দার্শনিক হিসেবে যিনি সুপ্রসিদ্ধ, তিনি হলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্য শান্তদেব। তাঁর তিনটি উল্লেখযোগ্য দার্শনিক গ্রন্থ হলো শ্রীগুহ্যসমাজ-মহাযোগ-তন্ত্রবলিবিধি, সহজগীতি ও চিত্তচৈতন্য-শমনোপায়। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ বিহারগুলি ছিল দার্শনিক তত্ত্বালোচনা তথা সর্ব প্রকার বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রস্থল। সেসময় বৌদ্ধ আচার্যগণ যেসব তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলির অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত বা দুষ্প্রাপ্য। তবে তিববত, চীন ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সেসব গ্রন্থের কিছু কিছু অনুবাদ সংরক্ষিত আছে। বজ্রযানী বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে নৈয়ায়িক শান্তরক্ষিত অন্যতম। তিনি তিনটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। নালন্দার বিশিষ্ট পন্ডিত শীলভদ্র ও মহাচার্য অতীশ দীপঙ্কর (দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, ৯৮০-১০৫৩) ছিলেন সে যুগেরই বাঙালি মনীষী। তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় যেসব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি এখন দুষ্প্রাপ্য। বর্তমানে প্রাপ্য দশম শতকের চর্যাপদেও দর্শনচর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়।
গৌড়পাদের অধ্যাত্মচিন্তা ও দার্শনিক মতবাদ নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেন দশম শতকের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শ্রীধর ভট্ট। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ন্যায়কন্দলী, অদ্বয়সিদ্ধি, তত্ত্বপ্রবোধ ও তত্ত্বসংবাদিনী বিখ্যাত। চৌদ্দ শতকে শঙ্করের মায়াবাদ খন্ডনের চেষ্টা করেন গৌড় পূর্ণানন্দ। সেই প্রাচীন যুগে এ দেশে স্মৃতি-মীমাংসা, এমনকি ষড়দর্শনের চর্চাও প্রচলিত ছিল। ন্যায়শাস্ত্রে বিচক্ষণতার জন্য গৌড়ীয় নৈয়ায়িকেরা সমগ্র ভারতবর্ষে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পনেরো শতকে নবদ্বীপে ব্যাপকভাবে ন্যায়চর্চা শুরু হয় এবং সে ধারা অব্যাহত থাকে আঠারো শতক পর্যন্ত। পনেরো শতকের হরিদাস ন্যায়ালঙ্কার, ষোলো শতকের রঘুনাথ শিরোমণি, কণাদ তর্কবাগীশ এবং সতেরো শতকের জগদীশ তর্কালঙ্কার, জয়রাম পঞ্চানন, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখ ছিলেন নব্যন্যায়ের বিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত।
বাঙালির দর্শনচিন্তা প্রধানত দুটি ধারায় বিকশিত হয়েছে: ধর্মীয় ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারা। প্রথম ধারার মূল ভিত্তি ধর্ম। এখানে আবার দুটি উপধারা দেখা যায়: একটি কেবলই পরলোকমুখী ও অধ্যাত্মবাদী এবং অন্যটি একই সঙ্গে ঐহিক ও পারলৌকিক তত্ত্বে বিশ্বাসী। দ্বিতীয় উপধারার অনুসারীরা পরলোক-পরমেশ্বরে বিশ্বাস করেও ইহজগৎ ও ইহজীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আকাঙ্ক্ষী, অর্থাৎ দর্শনকে তাঁরা জাগতিক কল্যাণে প্রয়োগেও আগ্রহী। আর দ্বিতীয় ধারা ধর্ম কিংবা পরলোকতত্ত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবল মানুষের জাগতিক সুখের কথাই বলেছে।
ধর্মনিরপেক্ষ ধারার প্রচলন ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। এ ধারার প্রবক্তারা ছিলেন মূলত জীবনবাদী। তাঁরা জীবনকাঠি বলতে বুঝতেন দেহমনে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠাকে, দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব আশা করতেন যোগতান্ত্রিক কায়াসাধনার মাধ্যমে এবং অনুশীলন করতেন সাংখ্য, যোগ, তন্ত্র প্রভৃতি নিরীশ্বরবাদী দর্শনের। বাঙালির দর্শনচিন্তায় ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ করা যায় মধ্যযুগ থেকে। এ সময়ের চিন্তায় ও সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব ছিল অসামান্য এবং জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানের প্রত্যাশায় তারা দেবদেবী ও পীর-দরবেশের শরণাপন্ন হতো। তবে তাদের এ প্রবণতা একান্তই পরলোকমুখী ছিল না। বাঙালিরা যে চন্ডী, মনসা, শীতলা, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবতার পূজা করত তা কেবল পারলৌকিক প্রাপ্তির আশায় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পার্থিব সমৃদ্ধি ও সুখশান্তি কামনায়। তাই অন্নদামঙ্গল কাব্যে নৌকার মাঝি ঈশ্বর পাটনি দেবীর নিকট আশীর্বাদ চেয়েছে: ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। অধ্যাত্মবাদের পাশাপাশি বস্ত্তবাদী ও ভোগবাদী চিন্তাও যে বাঙালির ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত চৌদ্দ শতকের গৌড় পূর্ণানন্দ। তত্ত্বমুক্তাবলী-মায়াবাদ-শতদূষণী নামক গ্রন্থে তিনি যে দক্ষতার সঙ্গে শঙ্করের মায়াবাদ খন্ডণ করেছেন, তাতে আধুনিক বস্ত্তবাদী মনোবৃত্তির পূর্বাভাস বিদ্যমান।
বাঙালির দর্শনচর্চার প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। চর্যাপদের পদগুলি বৌদ্ধ ধর্মমত ও দার্শনিক জিজ্ঞাসার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং গীতিধর্মী। এগুলিতে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এমন কিছু দুর্জ্ঞেয় তত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শনেরও উপজীব্য। সহজ সাধনার এসব গীতি থেকেই কালক্রমে বয়ে চলেছে বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলি, আউল-বাউল-মারফতি-মুর্শিদি গানের প্রবাহ। এগুলির অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ বাহ্য স্থূলার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রচলিত স্থূলার্থের আবরণে ধর্মসাধনার এবং জগৎ-জীবনভাবনার নিগূঢ় সংকেত নির্দেশ করাই ছিল এ গানগুলির উদ্দেশ্য।
চর্চাপদগুলির অধিকাংশই বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন প্রক্রিয়ার গূঢ়তত্ত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। উল্লেখ্য যে, সহজিয়ারা বজ্রযানে বিধৃত তন্ত্রমন্ত্র, পূজা-পার্বণ ও আচার-অনুষ্ঠানে তেমন আস্থাশীল ছিলেন না। সম্প্রদায়গত নিষ্ঠার চেয়ে তাঁরা ব্যক্তিগত বোধ ও উপলব্ধির ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। দেহসাধনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধিলাভের আকাঙ্ক্ষাই ছিল তাঁদের মধ্যে প্রবল। চর্যাপদে যে গূঢ় সাধনপদ্ধতির উল্লেখ দেখা যায়, তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যক ব্যঞ্জনা পাশ্চাত্য দর্শনের কিছু কিছু প্রাচীন মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দর্শন কেবলই অধ্যাত্মমুখী।
বৈষ্ণবদর্শন ঐহিক ও পারলৌকিক তত্ত্বে বিশ্বাসী দর্শনগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বৈষ্ণবদর্শন। এর প্রথম প্রকাশ দেখা যায় দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কাব্যে। তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল নানা বর্ণে ও সম্প্রদায়ে। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের কঠোরতা ও সংকীর্ণতা দূরে ঠেলে দিয়েছিল লোকধর্ম ও জনজীবনকে। সেই প্রেক্ষাপটে জয়দেব রাধাকৃষ্ণের রূপকে মানবপ্রেমকে তুলে ধরেন। শাস্ত্রের বাঁধন অতিক্রম করে রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা জনপ্রিয় হয়ে ক্রমে সকল স্তরে বিস্তার লাভ করে। এ উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই মধ্যযুগের সাহিত্যে এবং বৈষ্ণবদর্শনে লাভ করে এক নব রূপায়ণ। একে অবলম্বন করেই প্রাচীন বাংলা সাহিত্য অগ্রসর হয়েছিল এক সম্ভাবনাময় নবযুগের দিকে। এ কারণেই চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) জয়দেবকে দিয়েছিলেন পূর্বাচার্যের মর্যাদা।
জয়দেবের পরে বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদাবলিতে অভিব্যক্ত হয়েছিল জগৎ ও জীবনের অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব, সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল বাঙালির জাতীয় ঐক্য ও মিলনের আকাঙ্ক্ষা। তাঁদের সময়টা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃসময়। তখন অর্থ ছিল, শিক্ষা ছিল, কিন্তু ছিল না নৈতিকতা। তাই সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছিল অসহায়ত্ব। এমনি এক অবস্থায় বিদ্যাপতির পদাবলি বাঙালিকে করেছিল আশ্বস্ত ও মুগ্ধ, আর চন্ডীদাসের পদাবলি এনেছিল মানসিক প্রশান্তি ও আনন্দময় শিল্পরসের ধারা। চন্ডীদাসের কাব্যে প্রেম ও ঐক্যের যে আহবান দেখা যায়, কারও কারও মতে তা ধর্মপুস্তকেও বিরল। আর এজন্যই তাঁকে নিছক কবি না বলে অভিহিত করা হয় কবিতাপস বলে। মূলত চন্ডীদাসের পদাবলি থেকেই আধুনিক বাঙালি সন্ধান পেয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্যের রস ও আনন্দের।
চৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর প্রেমভক্তিবাদ নিয়ে। তাঁর জ্ঞান, ভক্তি ও মানবতার বাণী অবলম্বনেই ভক্তরা রচনা করেন চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ এবং শত-সহস্র পদাবলি। পরবর্তী দুশ বছর প্রবাহিত হয় এ ভাবপ্লাবন; বাঙালি তখন গভীরভাবে নিয়োজিত থাকে দার্শনিক তত্ত্ববিচার, তর্কবিচার ও রসতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। চৈতন্যদেব মাত্র আটটি সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে তাঁর প্রেমদর্শনের জয়গান করেছেন। এ দর্শনেরই বিস্তৃত টীকাভাষ্য রচনা করেন বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী।
বৈষ্ণবমতে জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম–এ তিনটি বৃত্তি নিয়ে মানবসত্তা গঠিত। অভাব থেকে কর্মের সূত্রপাত। পরমসত্তা পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুতরাং তাঁর অভাব বা দুঃখ বলতে কিছু নেই। তাই কর্মমার্গে ভগবৎ সাধনা বৃথা। জ্ঞানের পথেও সব মানুষের পক্ষে পারমার্থিক সত্তার সন্ধান লাভ করা সম্ভব নয়, কারণ পারমার্থিক জ্ঞান সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত। এ ক্ষেত্রে প্রেমভক্তির কার্যকারিতাই বেশি। প্রেম সব দেশের সব যুগের মানুষের অভিন্ন সম্পদ, আর তাই প্রেমের ওপর গুরুত্ব দেয় বৈষ্ণবরা। বৈষ্ণবমতে জ্ঞানে নয়, কর্মেও নয়, কেবল প্রেমভক্তির মাধ্যমেই সসীম মানুষের পক্ষে সম্ভব অসীম ভগবানের মাধুর্যরূপ প্রত্যক্ষ করা, পরম ঐশীপ্রেম ও উপলব্ধি অর্জন করা। ভগবানের রূপ সকল বস্ত্ততে উপস্থিত, আর তাই সকলকে ভালোবাসা এবং বিশ্বজনীন প্রেমচর্চা সব মানুষেরই কর্তব্য। অতীতের জ্ঞানমূলক দর্শনে সসীম ও অসীমের, মানুষ ও দেবতার মধ্যে ছিল দুস্তর ব্যবধান। বৈষ্ণবীয় প্রেমদর্শনের ফলে স্বর্গ ও দেবতার সঙ্গে মানুষের সেই ব্যবধান হ্রাস পায়।
পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ নির্গুণ ব্রহ্ম নন, বরং ভক্তের ভগবান। তিনি প্রেমময় এবং সবার প্রিয় বন্ধুস্বরূপ। তিনি আদিতে এক ছিলেন, কিন্তু জীবনলীলা সম্ভোগের জন্য তিনি সৃষ্টিকে নিজের থেকে পৃথক করে পরিণত হন বন্ধুতে। তাঁর এ লীলা মাতৃলীলাস্বরূপ। গর্ভস্থ সন্তানকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মা যেমন বাৎসল্য সুখ অনুভব করেন, তেমনি রসস্বরূপ পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণও নিজের দেহ থেকে রাধাকে বিচ্ছিন্ন করে ভোগ করেন আপন লীলারূপ। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এ যে সম্বন্ধ তা নিছক ভেদের সম্বন্ধ নয়, আবার একেবারে অভেদের সম্বন্ধও নয়। কারণ তাতে ভেদ ও অভেদ যুগপৎ বিদ্যমান। বৈষ্ণবদর্শনের এ বিষয়টিই ‘অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ’ নামে পরিচিত। এর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় শ্রীজীব গোস্বামীর ষট্সন্দর্ভ নামক গ্রন্থে।
বৈষ্ণবমতে শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর– এ পাঁচটি অতি উৎকৃষ্ট আনন্দদায়ক ভাব স্বীকৃত। নিষ্ঠাবান ভক্তগণ প্রথম চারটি উত্তীর্ণ হয়ে ক্রমশ বিভোর হন মধুর মহাভাবে। মহাভাব হচ্ছে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম প্রেমসম্বন্ধ, যার সঙ্গে যুক্ত থাকে নির্মল আনন্দ। বৈষ্ণবমতে ভক্ত যখন এ বিশুদ্ধ আনন্দ অনুভব করে তখনই সে পায় যথার্থ মুক্তির স্বাদ। এরূপ মুক্ত অবস্থায়ই ভক্ত আস্বাদন করে ভগবানের সঙ্গে মিলনের পরমানন্দ।
বৈষ্ণবদর্শনে বিধৃত এ মহাপ্রেম দেহনিরপেক্ষ নয়। এর সূত্রপাত ঘটে দেহকে কেন্দ্র করে, কিন্তু বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে তা ক্রমশ দেহের বন্ধন অতিক্রম করে পরিণত হয় দেহোত্তীর্ণ অতীন্দ্রিয় প্রেমে। এ প্রেমের মাধ্যম শুধু দেহ নয়, মন বা আত্মাও। এখানে দেহ ও আত্মা যুগপৎ ক্রিয়াশীল। এ মহাপ্রেম গূঢ়ধর্মী দিব্যপ্রেম। এ পর্যায়ে ভক্ত ও ভগবানের ব্যবধান সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়। বৈষ্ণবদের ভাষায় একেই বলে শ্রীরাধার আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণ। বাউল সাধকরা এ অবস্থারই নাম দিয়েছেন ‘জ্যান্তে মরা’।
বৈষ্ণবদের এ প্রেমদর্শন কেবল অতীন্দ্রিয় পর্যায়েই সীমিত ছিল না, একই সঙ্গে তা মানব সম্পর্কের ব্যাপক পরিমন্ডলেও বিস্তৃত ছিল এবং পরিণতি লাভ করেছিল সার্বিক মানবপ্রীতিবাদে। সেদিনের ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণবিভেদের পরিবেশে মানুষে মানুষে যখন রচিত হয়েছিল এক বিরাট বৈষম্য, ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারও যখন সমাজের সর্বত্র প্রবেশাধিকার ছিল না, ঠিক তখনই শ্রীচৈতন্য এগিয়ে আসেন সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার বাণী নিয়ে। তিনি মানবিক মূল্যবোধের যে বাণী ঘোষণা করেন তা বিশেষ কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য। বৈষ্ণবদের এ ঐক্য-সম্প্রীতি রচনার প্রয়াসে যোগ দিয়েছিলেন সেদিনের মুসলমান সুফি-কবিরাও। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে কোনোরকম প্রশ্রয় না দিয়ে সুফি-কবি ও বৈষ্ণবরা সমবেত কণ্ঠে জয়গান করেছিলেন বিশ্বমানবপ্রেমের এবং মানুষের মন থেকে ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশ-কাল-পাত্রের সর্বপ্রকার ভেদাভেদ।
মধ্যযুগের মুসলিম দর্শন মানুষে মানুষে ভেদাভেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থায় ইসলামের সাম্যের বাণী এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার (১৩শ শতকের প্রারম্ভ) পর মুসলমান পন্ডিতরা বাংলা সাহিত্য ও সুফি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সন্ধান করেন জীবনের শ্রেয় ও জগতের পরমসত্তার। এ অনুসন্ধান পরিচালিত হয় জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি ও প্রেমমার্গে। আধিবিদ্যক বিষয়ের পাশাপাশি এসব আলোচনায় স্থান পায় সামাজিক, নৈতিক ও দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা। ষোলো শতকের শেখ ফয়জুল্লাহ, হাজী মুহম্মদ, সৈয়দ সুলতান, সতেরো শতকের শেখ চান্দ এবং আঠারো শতকের আলী রজা ছিলেন অধ্যাত্মদর্শনে সুপন্ডিত। ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা, হাজী মুহম্মদের সুরতনামা, শেখ চান্দের হরগৌরীসম্বাদ ও তালিবনামা এবং আলী রজার আগম ও জ্ঞানসাগর ছিল মধ্যযুগের সুফিসাহিত্যের মূল্যবান গ্রন্থ। এসব গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে যোগচর্চানির্ভর অধ্যাত্মসাধনার কথা। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেহতত্ত্ব, সুফির ফানা, বৌদ্ধ নির্বাণ, বেদান্তের অদ্বৈততত্ত্ব প্রভৃতি গভীর দার্শনিক বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এসব গ্রন্থে। প্রশ্নোত্তর আকারে রচিত সওয়াল-সাহিত্যে অনুসন্ধান করা হয়েছে সৃষ্টি-স্রষ্টা, ইহকাল-পরকাল, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, জীবন, সমাজ, শাস্ত্র, নীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতি পরাতাত্ত্বিক, নৈতিক ও দার্শনিক বিষয়। হেঁয়ালি ও ধাঁধার আকারে উত্থাপিত ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশ্নাবলির উত্তর অনুসন্ধান করা হতো যুক্তিতর্কের মাধ্যমে।
বৈষ্ণব প্রেমভক্তিবাদীরা যেমন, মুসলিম কবি-সুফিরাও তেমনি ছিলেন যথার্থই মানবতাবাদী। তাঁরা মানুষে মানুষে বিভেদ মানতেন না, তাঁদের চিন্তায় সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা স্থান পায়নি। সব মানুষ একই স্রষ্টার সৃষ্টি, অর্থাৎ মূল উৎস এক; সুতরাং বিভেদ নয় ঐক্য, সংঘাত নয় সম্প্রীতি এ উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই সেদিন প্রচার করেছিলেন মুসলিম চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকরা। তাঁদের এ শুভ প্রেরণা নবপ্রাণের সঞ্চার করেছিল বাঙালির চিন্তা-চেতনা, সাহিত্য ও সমাজে।
বাউল মতবাদ বাউল মতবাদ বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট মরমি চিন্তাধারা। বাউলরা জগৎ-সংসারকে উপেক্ষা করে আধ্যাত্মিক ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন এবং সামাজিক আচার-আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে চলেন। বাউল মতবাদের সূত্রপাত হয় পনেরো শতকের শেষার্ধে, কিন্তু এর যথার্থ বিকাশ ঘটে সতেরো শতকের দ্বিতীয় পাদে। এ মতবাদের ব্যাপক পরিচিতির মূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০)। বাউল মতবাদের সঙ্গে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বৈষ্ণব ও সুফিদের ন্যায় বাউলদের জীবন এক ধরনের ভাবোচ্ছ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাউলরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি অনুগত নয়। কারণ, তাঁদের মতে ধর্মের বাহ্য আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে প্রকৃত ধর্মকর্ম সাধিত হয় না। ধর্মের জন্য চাই অকৃত্রিম হূদয়ানুভূতি, চাই অপরোক্ষ স্বাজ্ঞিক প্রতীতি। বাউলমতে মানবদেহই সব তত্ত্ব ও সত্যের ভিত্তি। দেহই সকল জ্ঞান ও কর্মের উৎস, দেহেই কৈলাস-বৃন্দাবন, দেহেই মক্কা-মদিনা। মানবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মা, অলখ সাঁই বা মনের মানুষের অধিষ্ঠান। এ থেকেই বাউলরা বলেন: ‘আপন ভান্ড খুঁজলে পরে সকল জানা যায়’ কিংবা ‘যা নাই ভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে’। বাউলদের যুক্তি নিজের মধ্যেই যেহেতু পরমসত্তার ঠাঁই, সুতরাং পরমসত্তাকে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে নিজেকে, সসীম আমির মধ্যেই খুঁজতে হবে অসীম সাঁইকে।
সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের মতো বাউলবাদও একটি প্রেমাত্মক দর্শন। বাউলমতে প্রেমানুভূতির মাধ্যমেই মানুষের পক্ষে সম্ভব আল্লাহর সন্ধান লাভ করা। এ প্রেম দুরকম– ভাবপ্রেম ও খোদাপ্রেম। ভাবপ্রেম হলো দেহকেন্দ্রিক ক্ষণিকের প্রেম, তা মানুষকে জাগতিক বস্ত্তসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট করে; আর বিকাশের ক্রমিক প্রক্রিয়ায় এ প্রেমই পরিণত হয় লোকোত্তীর্ণ খোদাপ্রেমে। বাউলমতে চলমান ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা কিংবা খন্ডবুদ্ধি নয়, প্রেমতন্ময়তা মিশ্রিত অপরোক্ষ অনুভূতি বা স্বজ্ঞার মাধ্যমেই ঐশীজ্ঞান অর্জন সম্ভব। ঐকান্তিক সাধনাবলে বাউল বস্ত্তজগৎ অতিক্রম করে এমন এক তন্ময়াবস্থায় উপনীত হন যেখানে তিনি কার্যত হয়ে পড়েন জীবন্মৃত এবং প্রত্যক্ষ করেন পরমসত্তার স্বরূপ। রূপ থেকে স্বরূপে উত্তরণের জন্য বাউলরা করেন ‘আরোপ’ সাধনা, সক্ষম হন প্রচলিত ধর্মের স্থলে একটি স্বভাব-ঊর্ধ্ব ধর্ম আরোপ করতে। এভাবেই জাগতিক স্থুল সুখের স্থলে তাঁরা অর্জন করেন লোকোত্তীর্ণ স্থায়ী আনন্দ। বাউলরা এ অবস্থারই নাম দিয়েছেন ‘জ্যান্তে মরা’। সসীম ও অসীমের মিলনের এ চূড়ান্ত অবস্থাকেই বৈষ্ণবরা বলেন শ্রীরাধার আত্মনিবেদন বা আত্মসমর্পণ এবং সুফিরা বলেন ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ।
বাউলমতে কোনো জাতিভেদ নেই। এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য এবং মুসলমান গুরুর হিন্দু সাগরেদ কিংবা হিন্দু বাউল রচিত গানে মক্কা-মদিনা ও রসুলের কথা এবং মুসলমান বাউল রচিত গানে হিন্দু দেবদেবী ও রাধাকৃষ্ণের উপমা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। মুসলমান ফকির, রসিক বৈষ্ণব ও হিন্দু বাউল একই তত্ত্বের, একই সাধন পদ্ধতির অনুসারী। বস্ত্তত, বাউলরা সর্বজনীন ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী।
ফরায়েজী মতবাদ আঠারো-উনিশ শতকে বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে এমন কিছু আচার ও প্রথা প্রচলিত ছিল যেগুলির অনুকূলে ইসলামি আইনের অনুমোদন ছিল না। হিন্দু সমাজের মতো মুসলিম সমাজেও বর্ণভেদ প্রথার প্রচলন, মুসলমান কবিদের হিন্দুগীতির প্রতি আকর্ষণ প্রভৃতি আরও অনেক বিরাজমান প্রথাকে ওলামা সমাজ অনৈসলামিক বলে ঘোষণা করেন এবং এগুলি পরিবর্জনের জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। এ ধরনের অনৈসলামিক রীতিনীতি ও প্রথা সংস্কারের কর্মসূচি নিয়েই উনিশ শতকে আবির্ভূত হন মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ও হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৭৯-১৮৪০) এবং রচনা করেন যথাক্রমে তাইওনিয়া আন্দোলন ও ফরায়েজী আন্দোলন। গান-বাজনা-নাচ, পীর-দরবেশের মৃত্যুদিবস উপলক্ষে ওরশ অনুষ্ঠান, মাযারে ফুলফল প্রদান, প্রয়াত ব্যক্তির আত্মার মাগফেরাতের জন্য ফাতেহা অনুষ্ঠান প্রভৃতি আচার-অনুশীলনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে রচিত হয় তাইওনিয়া আন্দোলন। অন্যদিকে বিয়ে-শাদি ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে ব্যয়বহুল জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজনের বিরোধিতা করা হয় ফরায়েজী আন্দোলনে।
ফরায়েজী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। তিনি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। এর একটি শিক্ষা ছিল এ যে, ভারতবর্ষ যতদিন বিজাতীয় ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের (ব্রিটিশ) শাসনাধীন থাকবে, ততদিন এ দেশ ইসলামি দেশ নয়, বেদ্বীনের দেশ (দারুল হার্ব); এ অবস্থায় এখানে সাপ্তাহিক জুম্মার নামায ও ঈদের নামায আদায় করা বাঞ্ছনীয় নয়। পীর-দরবেশে অতিমানবীয় শক্তি আরোপ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা ও রথযাত্রার অনুকরণে হৈচৈ করে মুহররম পালন প্রভৃতির বিরোধিতা করা হয় ফরায়েজী আন্দোলনে। এছাড়া অতীত পাপের জন্য অনুতাপ এবং ভবিষ্যতে সৎ ও পুণ্য জীবনযাপনের সংকল্প গ্রহণও ছিল এ মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলার নবজাগরণ পনেরো শতকে শ্রীচৈতন্য ও তাঁর পার্ষদদের প্রয়াসে বাঙালি প্রতিভার যে উন্মেষ ঘটে, তাতে বাঙালি জীবনে সংঘটিত হয় এক মহাভাবপ্লাবন। বাঙালি মনীষা বৌদ্ধসংস্কার, বৈষ্ণব প্রেমবাদ ও ইসলামি সাম্যবাদ থেকে লাভ করে অসামান্য অনুপ্রেরণা। ইসলামি সাম্য, হিন্দু ভাবুকতা আর তান্ত্রিক সহজিয়া তত্ত্বের সমন্বয়ে বিকশিত হয় এক নতুন ভাবধারা, যাকে বলা হয় মানবতাবাদী ভাববিপ্লব। কিন্তু এ ধারা ব্রাহ্মণ্য আদর্শের শাসন ও অন্য অনেক প্রতিকূল শক্তির চাপে স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে। যেমন, বৈষ্ণবের মানবপ্রীতি রূপান্তরিত হয় ব্রাহ্মণপূজায়, প্রেমধর্মের স্থলে সূচিত হয় দাসসুলভ মনোভাব, স্বাধীন যুক্তিবাদ পরিণত হয় অসার তত্ত্বচর্চা ও রহস্যবাদে। অবশেষে উনিশ শতকে তার মধ্যে ফিরে আসে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য। সমাজ, ধম,র্ দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সূচিত হয় এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ; সংঘটিত হয় এক বিরাট আলোড়ন যা পরিচিত হয় বাংলার নবজাগরণ নামে। এর সঙ্গে যুক্ত চিন্তাবিদ ও লেখকগণ প্রাচ্যজ্ঞান ছাড়াও সুপরিচিত ছিলেন ইউরোপীয় চিন্তা, ধ্যানধারণা ও ইতিহাসের সঙ্গে। স্বভাবতই তাঁরা প্রভাবিত হয়েছিলেন ইউরোপীয় ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্য দ্বারা এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতেই তাঁরা সংস্কার করার চেষ্টা করেন নিজেদের ধর্ম, দর্শন তথা সংস্কৃতিকে।
বাংলার নবজাগরণের যুগের প্রথম বাঙালি মনীষী ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। স্বাধীন বিচার-বুদ্ধি ও মনকে সংস্কারমুক্ত রাখার অপরিমেয় শক্তি ছিল তাঁর মধ্যে। ধর্মের প্রতি আস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেই তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন সুদক্ষ তর্কবাগীশ হিসেবে। বেদ-বেদান্ত, কুরআন-বাইবেল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ মন্থন করে তিনি যে ধর্মদর্শন প্রচার করেন, তা কোনো মন্ত্রতন্ত্রের সাধনা কিংবা নিছক পরলোকচর্চা নয়, এর ভিত্তি রচিত যুক্তিবুদ্ধি ও দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের ওপর। এর মূল লক্ষ্য পরলোকে পরম সুখের জীবন নয়, ইহলোকে ব্যাপক মানবকল্যাণ। ধর্মকে আচারের বন্ধন থেকে মুক্ত করে বিশ্বমানবতার কল্যাণের বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল রামমোহনের সাধনা, তাঁর জীবনদর্শনের মূল লক্ষ্য ও উপজীব্য।
ধর্মের প্রধান লক্ষ্য যে মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, একথা অবশ্য অস্বীকার করেননি রামমোহন। তবে তিনি ধর্মের অজুহাতে জীবনের ব্যবহারিক দিক ও বস্ত্তগত প্রয়োজনকেও অস্বীকার করেননি। প্রকৃত ধর্ম যে জীবনের আধ্যাত্মিক ও বস্ত্তগত, পারলৌকিক ও পার্থিব উভয় দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, একথা বোঝানোর জন্যই তিনি দৃষ্টিপাত করেন ভারতবর্ষের আদিজ্ঞানের উৎস বেদ-বেদান্তের প্রতি এবং তার জ্ঞান ও শিক্ষা অবলম্বনে তিনি বাঙালিদের এক নতুন দর্শন দান করেন। বেদান্তকে তিনি সমর্থন করেন বটে, কিন্তু শঙ্করের দেওয়া বেদান্তভাষ্যে যে জীবন-বিরাগের সঙ্কেত আছে তাকে তিনি সমর্থন করেননি। তাই শঙ্করের ভক্ত হয়েও তিনি জীবনবিমুখ হননি, তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন একজন কর্মযোগী হিসেবে। তাঁর মতে অবিদ্যা ও মায়াপ্রসূত প্রতিভাসের পর্যায় অতিক্রম এবং যথার্থ জ্ঞান ও সত্য অর্জনের জন্য নিছক উপাসনাই যথেষ্ট নয়; এজন্য প্রয়োজন অক্লান্ত কর্মানুষ্ঠান ও সঠিক পদ্ধতির অনুশীলন। আপন কৃতকর্ম কেবল ব্রহ্মে সমর্পণ করলেই চলবে না, ব্রহ্মার্পিত চিত্তে বহাল রাখতে হবে কর্মানুশীলন প্রক্রিয়াকেও। তাঁর ধ্যান-ধারণার মূল লক্ষ্যই ছিল ধর্মকে অনাচারের বন্ধন থেকে মুক্ত করে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, এভাবেই মানবমুক্তির পথ সুগম করা সম্ভব। ধর্মের মধ্যে মানবিক বোধের যে সঙ্কেত আছে তাকেই তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন যুক্তি দিয়ে। ধর্মনিঃসৃত ও যুক্তিপ্রসূত এ মানবিক বোধই পরে আরও স্পষ্ট ও ব্যাপক রূপ লাভ করে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬২-১৯০২), রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বাঙালি মনীষীর চিন্তা ও সাধনায়।
ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল রামমোহন রায়ের প্রগতিশীল ভাবধারাকে আরও বিকশিত করে তোলেন কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) এবং তাঁর শিষ্যরা, যাঁরা সাধারণত ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। তাঁরা রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মত ও পথকে অস্বীকার করেন এবং আধ্যাত্মিকতা ও মরমিবাদের পরিবর্তে তাঁরা সমর্থন করেন বস্ত্তবাদী ভাবধারা ও প্রগতিশীল জীবনদর্শনকে। দেশপ্রেম ছিল তাঁদের প্রেরণার প্রধান উৎস। তাই বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী দর্শনের চেয়ে তাঁরা বেশি নিবেদিত ছিলেন সামাজিক বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রতি। বস্ত্তবাদী দর্শন ও নাস্তিকতা প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁদের; ডিরোজিওকে বিতাড়িত করা হয়েছিল হিন্দু কলেজ থেকে। তাঁর শিষ্য এবং পরবর্তীকালে হেয়ার স্কুলের শিক্ষক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচার করেন: পরকাল নেই এবং মনুষ্য ঘটিকাযন্ত্রের ন্যায়।
এই মতের অপর প্রবক্তা ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। প্রাচীন ও মধ্যযুগে, বিশেষত উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকে অধ্যাত্মবাদী ও ধর্মাশ্রয়ী মতের পাশাপাশি এ দেশে চলতে থাকে এক বস্ত্তবাদী, সংশয়বাদী ও নিরীশ্বরবাদী ধারা। ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৮৯০) যখন উপনিষদের তত্ত্বের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা করছিলেন, তখন তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহচর অক্ষয়কুমার দত্ত অবলম্বন করেন এক প্রগতিশীল বস্ত্তবাদী ধারা। অক্ষয়কুমার প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু ক্রমশ তিনি অজ্ঞেয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাহ্যবস্ত্তর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১৮৫২) নামক গ্রন্থে তিনি গতানুগতিক ধর্মীয় আচারের সমালোচনা এবং বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদের সমর্থন করেন। তাঁর মতে প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী কাজ করাই ধর্ম, আর তা না করাই অধর্ম। জীবনে প্রার্থনা করার কোনো গুরুত্ব আছে বলে তিনি মনে করতেন না। চমৎকার এক গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা তিনি প্রমাণের চেষ্টা করেন যে প্রার্থনার কোনো মূল্য নেই। সমীকরণটি এরকম: পরিশ্রম = শস্য, প্রার্থনা+পরিশ্রম = শস্য, অতএব প্রার্থনা = শূন্য।
অক্ষয়কুমারের এ ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা তখন সময়ের তুলনায় যথেষ্ট অগ্রসর এবং দুঃসাহসিক ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এমিল ডুরখেইম ও অন্যান্য কয়েকজন ফরাসি চিন্তাবিদ যে সমাজতাত্ত্বিক মত প্রচার করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন, অক্ষয়কুমারের উপর্যুক্ত মতে তার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ডুরখেইমদের মতে মানুষ যেসব দেবতার উপাসনা করে তাঁরা সমাজ কর্তৃক অচেতনভাবে নির্মিত কাল্পনিক সত্তা। ঈশ্বর বলতে কেউ নেই। মানুষের আনুগত্যের দাবিদার যে ঈশ্বর, তিনি আসলে সমাজেরই প্রতিফলন। ব্যক্তির চারদিকে যে সামাজিক সত্তা পরিব্যাপ্ত, তা-ই প্রতীকায়িত হয়েছে ঈশ্বরের ধারণায়। বাঙালির দর্শনচিন্তা যে কেবল পরলোকচর্চা কিংবা ভক্তিমুক্তির সাধনা নয়, প্রগতিশীল জীবনবাদী ও প্রকৃতিবাদী মনোবৃত্তিও যে বাঙালির ধ্যান-ধারণার অন্তর্গত অক্ষয়কুমারের জীবনদর্শন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অক্ষয়কুমারের মতো আরও একজন ইহজাগতিক ও বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। স্মৃতি, বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্র এবং হিন্দুদর্শনে সুপন্ডিত হয়েও তত্ত্বঘেঁষা ষড়দর্শনকে তিনি গ্রহণ করেননি; তাঁর আদর্শ ছিল মানবসেবার, মানুষের ঐহিক কল্যাণসাধন। তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় একজন বাস্তববাদী ও মানবপ্রেমিক হিসেবে। বিমূর্ত তত্ত্বচিন্তা নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কাছে জগৎ ও জীবনের যে বাস্তব রূপটি ধরা পড়ে, তিনি তাকেই বিশ্বাস করতেন। দার্শনিক তত্ত্বজ্ঞানকে তিনি আজীবন ব্যবহার করেছেন মানবকল্যাণে। সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ এবং মানবকল্যাণ সাধন ছিল তাঁর প্রধান ব্রত। এজন্য তিনি হিন্দু সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ করার আন্দোলন করেন এবং তাতে সফল হন। স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান ব্রত।
নীতিবোধ ও মূল্যবোধপুষ্ট জীবনাচরণ প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা দর্শনচর্চার প্রয়াসী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) তাঁদের অন্যতম। অন্যদের মতো তিনিও ধর্মবিশ্বাসের আওতায় থেকেই যুগোচিত ধারণা এবং যুক্তির মাধ্যমে শাস্ত্র ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হন। দার্শনিক যুক্তির সাহায্যে তিনি প্রকৃত শাস্ত্র যাচাই করতে চান। তিনি বলেন: ‘বহুদেবতাবাদ, দেশাচার ও লোকাচার যথার্থ ধর্ম নয়; আবার নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মোপাসনাও হিন্দুধর্মের শেষ কথা নয়। ব্যক্তির সর্বাত্মক বিকাশ এবং পূর্ণবিকশিত ব্যক্তিত্বকে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করাই যথার্থ ধর্মের লক্ষ্য।’ বঙ্কিমচন্দ্র এ ধর্মের নাম দেন ‘অনুশীলন ধর্ম’ এবং একেই তিনি শনাক্ত করেন হিন্দুধর্মের সারাৎসার বলে। বঙ্কিম প্রকল্পিত এ অনুশীলন ধর্মের প্রধান উপকরণ ভক্তি। কিন্তু এ ভক্তি গতানুগতিক ধর্মের ভক্তি কিংবা মোক্ষসাধনার নামান্তর নয়। স্বদেশীয় ভক্তিকে তিনি সময়োপযোগী দৃষ্টি দিয়ে সমন্বিত করেন আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন ও নীতিবিদ্যার সেই কর্মনীতির সঙ্গে, যা ‘পূর্ণতাবাদ’ নামে পরিচিত। এরূপ তত্ত্বই ইউরোপে প্রথম প্রচার করেন স্পিনোজা।
বঙ্কিমচন্দ্র অবতারবাদের এক নতুন ব্যাখ্যা দেন। মানবদেহে ঈশ্বররূপে অবতীর্ণ কোনো অবতারে তিনি বিশ্বাসী নন। অবতার বলে তিনি স্বীকার করেন সেই ব্যক্তিকে যিনি মানুষ হিসেবে পূর্ণতা লাভ করেছেন সম্পূর্ণ নিজের অনুশীলনে, কোনো অলৌকিক অনুগ্রহে নয় এবং যাঁর জীবন মানবকল্যাণে নিবেদিত। এরূপ কর্মবীর ও পূর্ণ মানুষকেই বঙ্কিমচন্দ্র আবিষ্কার করেন মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণে। শ্রীকৃষ্ণ গৌতম বুদ্ধ কিংবা যিশুখ্রিস্টের মতো সংসার ত্যাগ করেননি, বরং সর্ব প্রকার দুঃখ-বঞ্চনার মধ্যেও বহন করেছেন জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব। শ্রীকৃষ্ণের এ কর্মাদর্শের আলোকেই তিনি সকলকে আহবান জানান কর্মের মাধ্যমে মুক্তি অর্জনে। বঙ্কিমের মতে ধর্ম কিংবা দর্শনের মূল লক্ষ্য ব্যক্তির সুখসাধন। এ লক্ষ্য অর্জিত হয় কর্ম দিয়ে, ধ্যান-অনুধ্যান দিয়ে নয় এবং সে কর্ম হিতবাদী কর্ম। এটাই তাঁর কর্মবাদী জীবনদর্শন। এতে ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে সমষ্টিগত কল্যাণের প্রতিই সমর্থন বেশি। অবশ্য তিনি ব্যক্তিসুখকে অস্বীকার করেননি। তাঁর মতে ব্যক্তিসুখই মূল লক্ষ্য, কিন্তু তা সমষ্টিকে বাদ দিয়ে অর্জন সম্ভব নয়। বঙ্কিমের মতে, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্যের কথা না ভাবলে ব্যক্তিপূজার নামে অহঙ্কারবাদ প্রশ্রয় পেতে পারে এবং ব্যক্তির সংকীর্ণ গন্ডিতে বন্দী হয়ে যেতে পারে মনুষ্যত্বের গৌরব।
বাংলার নবজাগরণ ও মুসলমান রেনেসাঁ যুগের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন মুসলমান সমাজকেও স্পর্শ করেছিল। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমিক অগ্রগতির সঙ্গে মুসলমানদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং সেই প্রগতিশীল উদারনৈতিক ভাবধারার আলোকে মুসলমানদের শৈক্ষিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ সুগম করার কাজে যে কয়েকজন মুসলমান চিন্তাবিদ ও সংস্কারক নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হুগলির যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ দেলওয়ার হোসেন আহমদ (১৮৪০-১৯১৩) এবং সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) ছিলেন উল্লেখযোগ্য। দেলওয়ারের চিন্তায় মৌলিকতা ও সাহসিকতার পরিচয় সুস্পষ্ট। সমকালীন পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন, বিশেষত জন স্টুয়ার্ট মিল ও হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর দর্শন ছিল: It is the duty of every man of intelligence and knowledge to seek truth and when he finds it, it is his duty to proclaim it. তাঁর মতে স্থিতিশীল ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। ইসলামের যেসব বিধান মৌলিক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয় এবং যেগুলি প্রগতির পরিপন্থী সেগুলিকে তিনি পরিবর্তন, এমনকি বর্জনেরও সুপারিশ করেন। বহুবিবাহ ও পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি, মুসলিম পারিবারিক আইনের সময়োপযোগী সংশোধন প্রভৃতি কার্য ছিল তাঁর উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল চিন্তার নিদর্শন।
যেসব মুসলমান আধুনিকতাবাদী যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণীকে পাশ্চাত্যের নিকট তুলে ধরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আহমদ খান ও সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন অগ্রগণ্য। সৈয়দ আহমদ বলতে চেয়েছিলেন যে, ইসলাম উদারনীতি ও প্রগতির পরিপন্থী নয়। আমীর আলী আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, শুধু তাই নয়, ইসলামেই নিহিত রয়েছে পূর্ণাঙ্গ উদারনৈতিক প্রগতি। তাঁর মতে জ্ঞানালোক অর্জন যেকোনো সংস্কারের পূর্বশর্ত। আর এর মাধ্যমেই মানুষকে মুক্ত করতে হবে সেসব বন্ধন ও কুসংস্কার থেকে, যেগুলি যুগ যুগ ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাদের স্বাধীন চিন্তাকে।
উনিশ শতকে ধর্মের পথে সমাজসংস্কার ও মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে আরও সংহত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)। তিনি তাঁর ধ্যান-ধারণা ও জীবনদর্শনের মূল প্রেরণা লাভ করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬) থেকে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও রামকৃষ্ণ ছিলেন মানবপ্রেম ও মানবতার প্রতীক। তাঁর মতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; জীবমাত্রই ব্রহ্মের অংশ ব্রহ্মের সাকার অভিব্যক্তি। দরিদ্র কাঙ্গালদের নিজ হাতে সেবা করে তিনি দেখিয়েছেন, জীবসেবাই ঈশ্বরসেবা। রামকৃষ্ণের এ আদর্শই বিশ্বময় প্রচার করেন বিবেকানন্দ। এ সেবাধর্মে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র কিংবা হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদ নেই। বিবেকানন্দ এ মানবধর্ম ও মানবতাবাদী দর্শনের মাহাত্ম্য প্রচার করেন নিপীড়িত জনগণের মধ্যে, যা আরও প্রসারিত হয়ে যুগ, জাতি ও দেশকে অতিক্রম করে যায়।
বিবেকানন্দ সমাজ সংস্কারের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন ধর্মসংস্কারের। ধর্মকে তিনি মনে করতেন সমাজদেহের একটি অঙ্গ হিসেবে এবং সমাজ সংস্কারের ভিত্তি হিসেবে তিনি অদ্বৈত অনুভূতিকে গ্রহণ করেন। তাঁর মতে এ দেশের মানুষের জাতীয় জীবন দাঁড়িয়ে আছে ধর্মীয় ভিত্তির ওপর। তাই সামাজিক বা রাজনৈতিক যেকোনো সংস্কারের জন্য অগ্রসর হতে হবে ধর্মের পথেই। তাছাড়া ধর্মের পথে অগ্রসর হওয়া সহজতর, কারণ এ পথে বাধা কম। বিবেকানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, যথার্থ সংস্কারের জন্য জ্ঞান ও প্রেম উভয়েরই প্রয়োজন। শ্রীচৈতন্যও প্রেমের কথা বলেছিলেন এবং প্রেম-প্রীতি সাধনার পরামর্শও দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল মূলত অতীন্দ্রিয় প্রেম। পক্ষান্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে প্রাপ্ত বিবেকানন্দের প্রেম ছিল যথার্থই মানবপ্রেম। এ প্রেমের অর্থ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জীবের মধ্যে শিবের সাক্ষাৎকার। শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন সর্বজীবে দয়ার কথা, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবের সেবার কথা বলেছেন।
বিবেকানন্দ ছিলেন কর্মযোগে বিশ্বাসী একজন মানবদরদী সন্ন্যাসী। সফল কর্মানুষ্ঠান দ্বারা তিনি চেয়েছিলেন যথার্থ মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা জানতে পেরেছিলেন। সমাজের সংখ্যালঘু উচ্চস্তরের লোকেরা যাদের অপবিত্র ও অস্পৃশ্য বলে প্রচার করত তারাই দেশের মেরুদন্ড, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন– এ ছিল বিবেকানন্দের দর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষুধার্তের পক্ষে ধর্মচর্চা সম্ভব নয়। তাই ক্ষুধার্তকে অন্নদান, বস্ত্রহীনে বস্ত্রদান, গৃহহীনে গৃহদান এবং অশিক্ষিতকে শিক্ষাদানই ছিল তাঁর দর্শনের মূল কথা। তিনি যুবকদের উদ্দেশে বলতেন, গীতা পড়ার আগে ফুটবল খেলে শরীর গঠন করা অধিক জরুরি।
মানব ইতিহাস, সমাজবিপ্লব এবং সমাজজীবনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিবেকানন্দের অধ্যয়ন ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল সুগভীর। তাই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজের নিচের তলার মানুষ একদিন ওপরে উঠে আসবেই। তিনি বলেছিলেন, পদদলিত শূদ্ররা একদিন জেগে উঠবে এবং সর্বত্র একাধিপত্য লাভ করবে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এরূপ ধারণা পোষণ করেছিলেন। মানুষে মানুষে বিভেদ অবাঞ্ছিত, এ বিভেদই সামাজিক অবক্ষয় ও জাতীয় অনৈক্যের কারণ। এরূপ বিভেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্ণবৈষম্য ও জাতিভেদ প্রথাই ছিল সেদিনের ভারতবর্ষের অধঃপতন ও অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। তাই জনগণের ব্যাপক কল্যাণের স্বার্থে তিনি এ অব্যবস্থার দ্রুত অবসান চেয়েছিলেন।
ধর্মকে গতানুগতিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে জীবন ও সমাজে, তথা সর্বাত্মক মানবিক বিকাশে প্রয়োগ করার যে ঐকান্তিক প্রয়াস বিবেকানন্দে লক্ষ্য করা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) চিন্তায় তারই পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে। তাঁর চিন্তাও ক্রমবিকশিত হয়েছে ধর্মীয় প্রত্যয় ও অনুভূতিকে আশ্রয় করে। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর কবিহূদয়ে যুক্তির চেয়ে অনুভূতি ছিল প্রবলতর, কিন্তু হূদয়াবেগের চাপে দার্শনিক যুক্তির পথ তিনি পরিহার করেননি। ধর্ম বলতেও তিনি গতানুগতিক আচারকেন্দ্রিক ধর্ম, মোক্ষসাধনা কিংবা পরলোকচর্চাকে বোঝেননি। ধর্মকে তিনি অবলম্বন করেছেন মানবমুক্তির মাধ্যম হিসেবে। তাই তাঁর ধর্ম মানবধর্ম। তিনি বলেছেন: ‘ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব– যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব বা পরিপূর্ণতা।’ এ ধর্মের লক্ষ্যও কোনো অতীন্দ্রিয় ঈশ্বর নয়, বরং তিনিই ঈশ্বর যাঁকে ভক্তি, প্রেম ও কর্ম দিয়ে পাওয়া যায় মানুষের গভীর সত্তায়। ঈশ্বর মানুষেরই সীমাহীন বিস্তৃতি, মানুষের মধ্যে উপস্থিত মহামানব বা জীবনদেবতা।
রবীন্দ্রনাথের মতে অসীম নিরন্তর প্রকাশিত হয়ে চলেছে সীমার মধ্য দিয়ে। অসীমের প্রেরণা অবলম্বনে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া এবং সেই কর্ম দ্বারা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে এবং পরিণামে সমগ্র পৃথিবীকে ন্যায়, সত্য ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। একক মনুষ্যত্বের মধ্যে মুক্তি নেই, মুক্তি নিহিত সমগ্র মানবসংসারের পূর্ণ প্রকাশে–বঙ্কিমচন্দ্রের এ মতকেই রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেন। একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি এক ব্যক্তির চেষ্টায়ও সমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সব মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। এটাই মানুষের পূর্ণতার সাধনা। এ সাধনায় মানুষকে সহায়তা করার জন্যই যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন মহাপুরুষরা।
রবীন্দ্রনাথ জগৎ-সংসারকে দেখেছেন এক নিরবকাশ প্রেমের লীলা হিসেবে। তিনি মানুষকে পরামর্শ দিয়েছেন এ প্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং প্রেমসম্পৃক্ত কর্মে প্রবৃত্ত হতে, কারণ জ্ঞান ও কর্মকে সার্থক করে তুলতে হলে প্রেম অপরিহার্য। জ্ঞানহীন কর্ম মানুষকে অধঃপতিত করে পশুত্বের স্তরে, আর প্রেমহীন কর্ম তাকে চালিত করে হিংস্রতার দিকে। বুদ্ধিবৃত্তি অবলম্বনে জ্ঞানের পথে অগ্রসর হলে মানুষের মনে জাগে বিশ্বের অখন্ডতাবোধ। সেই বোধ থেকে যখন সঞ্চারিত হয় প্রীতি, তখনই মানুষ অনুপ্রাণিত হয় পরহিত সাধনে।
একই ঐহিক ও প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিক ধারার অনুসারী ছিলেন আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)। তাঁর বিশেষত্ব এখানে যে, তিনি দর্শনে এসেছেন বিজ্ঞানের পথে। বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রতিই ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা এবং তিনি ছিলেন এর একজন নিষ্ঠাবান অনুসারী। ডারউইন, স্পেন্সার প্রমুখ পাশ্চাত্য বিবর্তনবাদীদের মতের সঙ্গে তিনি সম্যক পরিচিত এবং তাঁদের মতোই প্রকৃতিবাদের প্রতি অনুগত ছিলেন। নিয়তিকৃত বা নিয়মবহির্ভূত কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তায় তাঁর আস্থা ছিল না, ধর্মের গতানুগতিক ব্যাখ্যাও তিনি মানতেন না। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে অলৌকিক ঘটনায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি অক্ষয়কুমার দত্তের অনুসারী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রকৃতিবাদী মনোবৃত্তিকে নমনীয় করে শাস্ত্র ব্যাখ্যায় ব্রতী হন, ঝুঁকে পড়েন বেদের দিকে এবং বলেন: ‘বিজ্ঞানের যেখানে শেষ দর্শনের সেখানে শুরু।’ তবে বিজ্ঞানের মতো শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তিনি জগতের সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের কথাই বলেছেন। শাস্ত্র ব্যাখ্যায় তিনি বৈরাগ্য কিংবা পারলৌকিকতার প্রশ্রয় দেননি। তিনি পূর্বাপর কর্মবাদে বিশ্বাসী এবং জীবন থেকে বৈরাগ্যকে বহিষ্কারের পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি বলেন: ‘অলৌকিক উপায়ে নয়, কর্মসাধনার মাধ্যমেই ভাগ্যের উন্নতি করতে হবে।’ Legality and Morality এ দ্বিবিধ বিরুদ্ধধর্ম এবং জীবনের বৈচিত্র্য ও বিরোধের মধ্যে ঐক্যসংস্থাপন করে যোগ্যতম হওয়ার যে শিক্ষা তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন থেকে পেয়েছিলেন, তাঁর মতে এ শিক্ষার পূর্বাভাস রয়েছে বেদ ও গীতায়।
কর্ম দ্বারা পূর্ণতার সাধনা এবং সেই সাধনা অবলম্বনে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র মানবতার কল্যাণ সাধনের যে আহবান রবীন্দ্রনাথে পরিস্ফুট, তারই বিস্তৃত দার্শনিক ভাষ্য পাওয়া যায় ঋষি অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) প্রকল্পিত পূর্ণযোগের ধারণায়। পূর্ণযোগ এক ধরনের যুক্তিনির্ভর আধ্যাত্মিক সাধনা। এ মতে জীব পরম ব্রহ্মেরই অভিব্যক্তি, তাঁরই ছদ্মরূপ। তাই ব্রহ্মের অংশ হিসেবে জগতের সবকিছুই বাস্তব। জীবনসাধনার লক্ষ্য ক্রমশ ওপরের দিকে ওঠা, কিন্তু বস্ত্তজগৎকে অস্বীকার করে নয়। সত্যের মর্মবাণীকে কেবল আত্মতত্ত্বে উপলব্ধি করলেই হয় না, প্রত্যক্ষ করতে হয় বস্ত্ততত্ত্বের মধ্যেও। কারণ সত্য কেবল বস্ত্তব্যতিরিক্ত আত্মা নয়, আত্মা ও জড় উভয়ের মধ্যেই তা উপস্থিত।
পাশ্চাত্যের আধুনিক বিবর্তনবাদী দার্শনিকদের ন্যায় অরবিন্দও মনে করেন, ক্রমবিবর্তন জগতের এক স্বাভাবিক ধারা। এ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জড়ের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে প্রাণ এবং প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে চেতনা। পরবর্তী পর্যায়ে এ চেতনাই পরিপক্বতা অর্জন করে আত্মসচেতন মানুষে, আর বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এ মানুষই রূপান্তরিত হয় অতিমানবে। পরমসত্তা স্থান-কালে বিধৃত একটি গতিশীল বিকাশমান সত্তা। এ সত্তা ক্রমশ ওপরের দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছে দিব্যজীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। তবে এ ঊর্ধ্বায়ন প্রক্রিয়া বস্ত্তজগৎকে অস্বীকার করে ব্রহ্মে স্থিত হতে চায় না, দিব্যজ্যোতি ও দিব্য আনন্দকে ঊর্ধ্বভূমি থেকে নামিয়ে আনতে চায় মাটির পৃথিবীতে। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানুষ জ্ঞানশক্তির এমন এক অবস্থায় উন্নীত হয় যেখানে পরমসত্তা নেমে এসে তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এ পর্যায়েই মানুষ অর্জন করে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং এভাবেই মানুষ রূপান্তরিত হয় অতিমানবে। তবে এর জন্য বিশেষ এক প্রকার সাধনপ্রণালীর অনুশীলন প্রয়োজন। মানুষের এ অতিমানবে পরিণত হওয়াই অরবিন্দের পূর্ণযোগের মর্মকথা। এ পূর্ণযোগ কেবল আশ্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা বিস্তার লাভ করে জীবন ও সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে। অরবিন্দ অবশ্য ‘অতিমানব’ কথাটার চেয়ে ‘বিজ্ঞানপুরুষ’ (gnostic being) কথাটাই বেশি ব্যবহার করেছেন। বিজ্ঞানপুরুষ সেই ব্যক্তি যিনি অর্জন করেছেন যথার্থ জ্ঞান, যাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ মানবকল্যাণের প্রতি এবং যিনি মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে পারেন উচ্চতর আদর্শের জন্য।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ধর্মকে দর্শনের আলোকে দেখার এবং সার্থক ও সফল জীবন রচনার লক্ষ্যে প্রয়োগ করার এ যে মনোবৃত্তি, তা কেবল উনিশ শতকের রেনেসাঁ যুগের এবং শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দু মনীষীদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যেও প্রগতিশীল চিন্তার এক বিরাট ঢেউ উঠেছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে। ১৯২৬ সালে আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের উদ্যোগে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে আত্মপ্রকাশ করে এ আন্দোলন। শিখা নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হতো সাহিত্য, সমাজ, ধম,র্ সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের মননশীল প্রবন্ধ। জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে পরম্পরাগত দৃষ্টিতে না দেখে যুক্তিবিচারের দৃষ্টিতে দেখাই ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। বুদ্ধির মুক্তিবাদীদের মতে ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ যে বুদ্ধিবিচারকে তাঁরা জ্ঞান ও সত্যের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তারই নিরিখে তাঁরা মূল্যায়ন করেছেন মুসলমানদের ধর্মচিন্তা ও নৈতিক মূল্যবোধকে।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও ভাবযোগী কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ধর্ম বলতে তিনি আচারসর্বস্ব গতানুগতিক ধর্মকে বোঝেন নি। তাঁর ধর্মের নাম ‘বিকাশধর্ম’। এ ধর্মের প্রেরণাস্থল ইসলাম বটে, কিন্তু এর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে নানক, কবীর ও রামমোহনের উদার ধর্মান্দোলনের। যে ধর্মের পরিবর্তনে অনুমোদন নেই, যা আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর, সে ধর্মকে তিনি সমালোচনা করেছেন আচারপূজা বলে। তাঁর মতে যা জীবন বিকাশের সহায়ক তা-ই ধর্ম, আর যা প্রতিবন্ধক তা-ই অধর্ম। এ ধর্মবোধের উদ্বোধন ঘটে জ্ঞান ও উপলব্ধির মাধ্যমে এবং এর মূল লক্ষ্য মানবকল্যাণ।
সাম্প্রতিক কালের দর্শনচর্চা সাম্প্রতিক কালের এক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫) ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবপ্রেমিক। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা: ‘ধর্ম নিছক উপাসনা, তপজপ কিংবা পরলোকচর্চা নয়; বিশ্বাস, অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধির সমন্বয়ে গঠিত ব্যক্তিসত্তার সামগ্রিক বিকাশই ধর্ম। ধর্মের যে প্রেরণা তা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে রূপান্তরিত ও উন্নত করে। ধর্মের শিক্ষা: সারা ভূমন্ডল একই স্রষ্টার সৃষ্টি। তাই এখানকার যে-কোন জীবের সেবা প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টারই সেবা। ধর্ম কাউকে আঘাত করা সমর্থন করে না, কারণ ধর্মমতে আঘাতকারী ও আহত উভয়ই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। সব ধর্মই শিক্ষা, ঐক্য, সুনীতি, শান্তি ও মৈত্রীর বাণী শিক্ষা দেয়।’ তিনি ধর্মের নামে হানাহানি ও সংঘর্ষ দেখে ধর্মকে এ পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন এবং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ধর্মের উদার মানবিক দিকটির প্রতি। তাঁর মতে ধর্মে বিধৃত প্রেম ও মানবতার বাণীকে কাজে লাগাতে হলে চাই এমন কার্যকর শিক্ষা যা রূপান্তরিত করে ব্যক্তির চরিত্রকে। এজন্য প্রয়োজন প্রেম যা দিয়েই মানুষ জয় করে প্রবৃত্তিকে এবং অগ্রসর হয় বিকাশের উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে। শুরুতে আত্মসুখে মগ্ন মানুষই ধীরে ধীরে প্রবৃত্ত হয় সমাজসেবা, দেশসেবা ও জগৎসেবায়। এভাবে সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষ উপলব্ধি করে প্রেমময় স্রষ্টার একত্ব। যিনি সমগ্র জগতে প্রেমের এ মহাকর্ষ উপলব্ধি করেন, তিনি জীবে জীবে, মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ দেখতে পান না।
সাম্প্রতিক কালের বস্ত্তবাদী ও মানবতাবাদী দর্শনের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪)। এম.এন রায় নামে সুপরিচিত এ মনীষী কৈশোর-যৌবনেই উদ্বুদ্ধ হন মানবমুক্তির প্রেরণায়। আর এ মুক্তির সন্ধানেই তিনি গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেন সমাজবিবর্তনের ইতিহাস, যোগদান করেন গুপ্ত বিপ্লবী (জাতীয়তাবাদী) দলে এবং ভ্রমণ করেন জাভা, চীন, জাপান, আমেরিকা, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশ। মেক্সিকোতেই তিনি দীক্ষিত হন মার্কসবাদে এবং অচিরেই খ্যাতি অর্জন করেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বরেণ্য তাত্ত্বিকরূপে। কিন্তু তাঁর এ অবস্থান ছিল স্বল্পস্থায়ী। অভিজ্ঞতার নিরিখে, বিশেষত রুশ কমিউনিস্টদের মধ্যে ব্যক্তিমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধিকার-স্বাধীনতার প্রতিফলন না দেখে তিনি মার্কসবাদে আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং বিপ্লবী মানবতাবাদ (Radical Humanism) বা নব-মানবতাবাদ (New-humanism) নামে এক নতুন দর্শনের অনুশীলন ও প্রচার শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে রচিত নব্য-মানবতাবাদের ইস্তেহারে তিনি ঘোষণা করেন যে, তাঁর এ মতবাদ কোনো গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর নয়, বরং যুক্তি ও সুনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে সর্বপ্রকার শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্ত করাই তাঁর এ মানবতাবাদের লক্ষ্য। মার্কসবাদে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের ওপর বেশি জোর দেওয়ার প্রবণতাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন এবং বলেন: ব্যক্তিই সমাজের মৌলিক স্তর; সুতরাং ব্যক্তি থেকেই শুরু করতে হবে প্রগতির যাত্রা, ব্যক্তির মানসিক উৎকর্ষের মধ্য দিয়েই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ক্রমিক অগ্রগতির পথে।
মার্কসবাদ অনুসারে মানুষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশমাত্র। মানুষের ইতিহাস সম্পদকেন্দ্রিক শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। সম্পদ বণ্টনের মধ্যে বৈষম্যই মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রথার পরিবর্তন ঘটায়। এক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথের বক্তব্য: ‘মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক কারণের চেয়ে জৈবিক ও নৈতিক শক্তিই বেশি ক্রিয়াশীল।’ এ যুক্তিতেই তিনি ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও সৃজনশীলতার ওপর জোর দেন এবং মার্কসবাদীদের শ্রেণি-নৈতিকতার স্থলে সর্বজনীন নীতিবোধ ও মূল্যবোধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে সমাজনীতি ও রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতাই হবে মানবাচরণ ও গুণাগুণ বিচারের মানদন্ড। মার্কসবাদ অনুসারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সম্ভব নয়; সুতরাং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হলেও বিপ্লব ঘটাতে হবে। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথের মতে বিপ্লবের চূড়ান্ত কথাই হচ্ছে নৈতিকতা, নৈতিকতাবর্জিত কোনো পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখতে হবে, যেকোনো কাজে অনৈতিক পদ্ধতি ব্যবহূত হলে উপলক্ষের কাছে মূল লক্ষ্যই পরাজিত হতে বাধ্য। এটা আর যাই হোক সচেতন বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়। মানবেন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, দেশের মানুষের দুঃখমোচন ও সার্বিক মুক্তি অর্জনের জন্য কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন এক সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক নব-রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের। এ মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্যই তিনি রচনা করেন From Savagery to Civilization, Indian Message, Science and Superstition প্রভৃতি গ্রন্থ এবং সমমনা বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ১৯৪৭ সালে স্থাপন করেন Indian Renaissance Institute। এ সবকিছুরই লক্ষ্য ছিল মানুষ ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, শোষণ-পীড়নে জর্জরিত অসহায় মানুষের মুক্তি ও শান্তির পথনির্দেশনা।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের দর্শনচর্চার ইতিহাসে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। এ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যথার্থ দার্শনিক প্রবন্ধ রচনা করেন। মানুষের ধর্ম (১৯৩৪) তাঁর একটি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। বরকতুল্লাহ জগৎ ও জীবন, জড়প্রকৃতি ও মনোজগৎ, আত্মা ও পরমাত্মা, ইহলোক ও পরলোক প্রভৃতি দার্শনিক প্রশ্ন দ্বারা বিশেষভাবে ভাবিত হয়েছেন। এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে তিনি প্রথমেই এক বিশ্বময় চেতনার বাস্তবতাকে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে এ সর্বময় চেতনা বা প্রাণলীলার প্রভাবেই চুম্বক আকর্ষণ করে লোহাকে এবং গ্রহ ও নক্ষত্রপুঞ্জ অবিরাম আবর্তিত হয়ে চলছে মহাকর্ষ বলে। এ চেতনা ও প্রাণলীলার পাশাপাশি আবার প্রবহমান রয়েছে আরেকটি ধর্ম, যাকে বরকতুল্লাহ অভিহিত করেছেন আত্মপ্রতিষ্ঠার ধর্ম বলে। এর উপস্থিতি অচেতন জড়বস্ত্ত থেকে সচেতন জীব পর্যন্ত সর্বত্র। একটি নিষ্প্রাণ লোষ্ট্রখন্ডও তাকে তার অবস্থান থেকে অপসারণের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করে। তাই কেউ তাকে পদাঘাত করলে সেও তাকে প্রতিঘাত করে বেদনা দেয়। এ আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই অধিকতর সংহত জীবজগতে। জীব শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট হয় না, নিজেকে প্রসারিত করতে চায় কালের প্রবাহে। তার এ প্রয়াসই মূর্ত হয়ে ওঠে সন্তানবাৎসল্য ও বংশবৃদ্ধির বাসনায়। ঠিক একই বাসনা আবার মানুষের পর্যায়ে অভিব্যক্ত হয় আত্মার শক্তিবলে। আত্মা অমরত্বের দাবিদার; মৃত্যুতে দেহবিনাশের পরও সে টিকে থাকতে চায়। অমরত্বের এ আকাঙ্ক্ষার ফলেই হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ স্বর্গ সম্পর্কে রচনা করেছে এক মনোহর চিত্র। এ আকাঙ্ক্ষাই নানাভাবে প্রসারিত হয়ে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন সমাজের কাব্যকলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতে।
স্বর্গের এ কল্পনাকে মানুষের ইচ্ছাপূরণ আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি বলে মনে হলেও আসলে তা মানুষের ইচ্ছাসৃষ্ট নয়। এর মূলে রয়েছে সনাতন সত্যের প্রভাব। সেই সত্যটি হলো জ্ঞানবুদ্ধিতে মানুষ যতই সীমাবদ্ধ হোক না কেন, বাস্তবকে পেরিয়ে সে অগ্রসর হয় আদর্শের সন্ধানে। আদর্শের প্রতি এ যে আকর্ষণ, বর্তমানকে অতিক্রম করে অনাগতের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রসারণের এ যে ব্যাকুলতা, তা সমগ্র মানবজাতির ভেতরে প্রবহমান। বরকতুল্লাহ বলেন: ‘একই বিদ্যুৎপ্রবাহ যেমন লক্ষ প্রদীপের ভিতর দিয়ে নিজেকে ব্যক্ত করছে, তেমনি একই মহাপ্রেরণা সমগ্র মানবগোষ্ঠীর ভিতর দিয়ে কোনো এক দূর লক্ষ্যের পানে ছুটে চলছে। সেই প্রেরণা মানুষের ভিতর দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, তাই মানুষের বাঁচার এত সাধ।’
জ্ঞান প্রসঙ্গে বরকতুল্লাহ বলেন: ‘সহজাত ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি প্রভৃতি মানুষের জ্ঞানের প্রচলিত বাহন, কিন্তু এদের সাহায্যে পরম সত্তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। তাই বলে সেই সত্তা অজ্ঞেয় বা অজ্ঞাত নয়।’ ইন্দ্রিয়াদি ছাড়াও মানুষের অন্য একটি শক্তি আছে, বরকতুল্লাহ যার নাম দিয়েছেন অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি বা স্বজ্ঞা (intuition)। এর সাহায্যেই মানুষ সরাসরি অবহিত হয় তার আপন অস্তিত্ব ও চেতনা সম্পর্কে। এ স্বজ্ঞা যখন পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, তখন এর আলোকে মানুষ দেখতে পায় পরম সত্তাকে এবং উপলব্ধি করতে পারে সেই সত্তার সঙ্গে তার নিজের সম্বন্ধকে। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির ভিত্তি ও উৎপত্তি বুদ্ধির অধিগম্য নয়, এ কথা অন্যান্য মরমিবাদীর ন্যায় বরকতুল্লাহও বলেছেন। তবে জ্ঞানের বাহন হিসেবে বুদ্ধিকে তিনি অকেজো বলে বাতিল করে দেননি, বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা এবং অতীন্দ্রিয় অনুভূতির প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র। বরকতুল্লাহ বলেন: ‘ইন্দ্রিয়-সংগৃহীত জ্ঞানোপকরণকে বুদ্ধি সংবদ্ধ করে তার যোজনাশক্তি দ্বারা; বুদ্ধি সমৃদ্ধ ও সংহত করে মানুষের জ্ঞানকে। কিন্তু জীবন শুধু বুদ্ধি দিয়েই গঠিত নয়; আবেগ, উচ্ছ্বাস, ইচ্ছা প্রভৃতি জীবনের এমন আরও কিছু দিক আছে যেগুলির সন্ধান বুদ্ধি দিতে সক্ষম নয়। আর তা নয় বলেই বুদ্ধির গুরুত্ব স্বীকার করেও আমাদের আশ্রয় নিতে হয় অতীন্দ্রিয় স্বজ্ঞার।’
ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রতি বরকতুল্লাহ আস্থাশীল। কিন্তু এ মানসিকতা তাঁকে বিজ্ঞানবিমুখ করে নি। বরকতুল্লাহ বলেন: ‘বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ আজ প্রকৃতির অনেক রহস্য উন্মোচন করেছে, করায়ত্ত করেছে বিপুল শক্তি। কিন্তু সেই জ্ঞান ও শক্তির প্রয়োগ নিয়ে আজ দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। একদিকে অর্থনৈতিক অন্তর্জ্বালা, অন্যদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রসার– এ দুয়ের প্রভাবে সমকালীন মানুষ ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। ধর্মযাজকদের চোখের সামনে মুষ্টিমেয় মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠা করছে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে। ধর্মের এ ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তাই দিকে দিকে রচিত হচ্ছে তীব্র আন্দোলন।’
বরকতুল্লাহ মার্কসের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অকুণ্ঠ সমর্থন করেননি, আবার নিন্দাও করেননি। তবে মার্কসবাদের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে তাঁর কিছু আশঙ্কা ছিল। সেগুলির একটি হলো: এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাধীন ইচ্ছাও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাঁর প্রশ্ন: ‘যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার দাম নেই, যেখানে মানুষমাত্রই রাষ্ট্রের মজুর সেখানে স্নেহ, মায়া, প্রীতি, মহত্ত্ব প্রভৃতি মানবিক গুণ বিকাশের সুযোগ কোথায়?’ ধর্মবিষয়ে মার্কসবাদীদের অবস্থান সম্পর্কেও বরকতুল্লাহর কতিপয় সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন: ‘ধর্মের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ সোচ্চার বটে, কিন্তু ধর্মীয় বিধান ও ধর্মপতিদের উপস্থিতিতে সমাজে যেসব অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলির জন্য ধর্ম দায়ী নয়, দায়ী সেসব ব্যক্তি যারা ধর্মকে প্রয়োগ করেছে অসাধু উদ্দেশ্যে এবং ধর্মের নামে শোষণ করেছে অসহায় সাধারণ মানুষকে। সুতরাং ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযান নয়, ধর্মের বিধিবিধান যাতে সমাজে যথার্থভাবে প্রযুক্ত হয়, সেটা নিশ্চিত করাই আজ সময়ের এক বড় প্রয়োজন।’
আনুষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষাবিহীন স্বশিক্ষিত একজন মননশীল লেখক ও যুক্তিবাদী দার্শনিক ছিলেন আরজ আলী মাতুববর (১৯০০-১৯৮৫)। তিনি লড়াই করেছেন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিমত। তাঁর মতে বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও নানারকম কুসংস্কার আচ্ছন্ন করে রেখেছে মানুষের জীবনকে, যার ফলে রুদ্ধ হয়েছে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির ধারা। তাই তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিসহ বিভিন্ন কুসংস্কারের মূলে আঘাত হানতে, যথার্থ ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড় করাতে তৎপর হয়েছিলেন। তিনি অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন না। তাই বিজ্ঞানে বিশ্বস্ত আরজ আলী ভাববাদ ও রহস্যবাদেও ছিলেন আস্থাহীন। তাঁর মতে মানব জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই যাতে বিজ্ঞানীদের অবদান নেই। বিজ্ঞানীদের মূল উদ্দেশ্যই সত্যের উদ্ঘাটন তথা মানবকল্যাণ সাধন। তাই বিজ্ঞানীরা ত্যাগী ও মানবপ্রেমিক। বর্তমানে যাকে মানবতাবাদ বলা হয় তার মূলে রয়েছে বস্ত্তবাদের সঙ্গে ত্যাগ ও প্রেমের সংযোগ। মানবতাবাদ আজ বৈজ্ঞানিক সমাজে যেমন, অন্যত্রও তেমনি সমাদৃত। আরজ আলীর মতে একদা মানবতাবাদই হবে মানবজাতির আন্তর্জাতিক ধর্ম। বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলো: ‘মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের দান অনস্বীকার্য। যে ভাববাদীরা ‘বস্ত্তবাদ’ বলে বিজ্ঞানকে এবং ‘বস্ত্তবাদী’ বলে বিজ্ঞানীদের অবজ্ঞা করেন, তাঁরা মূলত বস্ত্তবাদীদেরই পোষ্য। বিজ্ঞান মানুষকে পালন করে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানবিরোধী কোনো শিক্ষাই গ্রহণযোগ্য নয়।’ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সমর্থনে আরজ আলীর এসব বক্তব্যের মূলে রয়েছে সত্য আবিষ্কারের দুর্বার প্রেরণা। ধর্মের সমালোচক হলেও তিনি যথার্থ ধর্মের বিরোধী ছিলেন না। তাঁর লড়াই ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল ধর্মের নামে প্রচলিত ধর্মান্ধতা ও ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি কুসংস্কারকে ত্যাগ করতে বলেছেন, ধর্মকে নয়।
বাংলাদেশের সমকালীন চিন্তাবিদদের অন্যতম আবুল হাশিমের (১৯০৫-১৯৭৪) দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তার মূল উৎস ইসলাম ও মুসলিম দর্শন। The Creed of Islam (১৯৫০) তাঁর একটি মূল্যবান দার্শনিক গ্রন্থ। দর্শনের স্বরূপ ও উপযোগিতা এবং দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আবুল হাশিমের অভিমত: যথার্থ দর্শনমাত্রই জীবনদর্শন, অর্থাৎ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এমন একটি সামগ্রিক পরিশীলিত ধারণা যা সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করে মানুষের চিন্তা ও কর্মকে। বাস্তব জীবনের সঙ্গে যে দর্শনের সম্বন্ধ নেই, তার কোনো মূল্য নেই। দার্শনিক ব্যক্তিমাত্রেরই উচিত চিন্তা ও কর্মের সমন্বয় সাধন এবং মাটির পৃথিবীতে শক্ত পায়ে অবস্থান গ্রহণ করা। জ্ঞান প্রসঙ্গে আবুল হাশিম বলেন: ‘বিজ্ঞান জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতের দিকে অগ্রসর হতে চায় অবরোহণ, আরোহণ ও অনুমানের সাহায্যে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিসর সীমিত থাকে সেসব জড়বস্ত্ত ও ঘটনার মধ্যে যেগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব ইন্দ্রিয় কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু মানুষ তার জ্ঞানানুশীলন প্রক্রিয়াকে শুধু ইন্দ্রিয়ের চার দেয়ালে সীমিত রেখে স্বস্তি পায় না। কারণ সে বিশ্বাস করে যে, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যা কিছু জানা যায় তার বাইরেও সত্য ও বাস্তব বলে কিছু থাকতে পারে। মানুষের কৌতূহলের সঙ্গে এ বিশ্বাস মিশ্রিত আছে বলেই জ্ঞান ও সত্যের অনুশীলনে লক্ষ্য করা যায় গতিশীলতা এবং একই কারণে মানুষ নিয়ত অগ্রসর হয়ে চলছে অদৃষ্টকে দেখার এবং অজানাকে জানার প্রয়াসে।’
মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আবুল হাশিমের ধারণা: প্রকৃত সভ্যতা কোনো বিশেষ আঞ্চলিক ব্যাপার নয়, সভ্যতামাত্রই বিশ্বসভ্যতা। যথার্থ সভ্যতার একটি বিশ্বজনীন আবেদন থাকতেই হবে। সভ্যতার আবির্ভাবকে তুলনা করা যায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আলোকিত হয় সমস্ত দিগন্ত, তেমনি একটি নতুন সভ্যতার আবির্ভাবে প্রভাবিত হয় বিরাজমান সমগ্র সভ্যতা।
অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবের (১৯০৭-১৯৭১) দৃষ্টিতে দার্শনিক মতবাদ মাত্রেরই রয়েছে একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ব্যবহারিক ব্যঞ্জনা। দর্শনের এ ব্যবহারিক দিকটিকে সার্থকভাবে তুলে ধরার কাজে এবং মানবতাবাদী দর্শনের সেবায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন আজীবন। দর্শনকে কল্পলোক থেকে সরিয়ে হাসিকান্নার বাস্তব জগতের সঙ্গে সংযোগের ও সাধারণ গণমানুষের কল্যাণে প্রয়োগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তাঁর মতে যথার্থ দর্শন মানেই জীবনদর্শন; যে দর্শনের সঙ্গে জীবনের কোনো যোগ নেই তা নিছক তত্ত্বকথা। দর্শনকে তিনি সব সময় দেখেছেন অফুরন্ত শুভ প্রেরণার উৎস হিসেবে এবং এর মূল্য যাচাই করতে চেয়েছেন মানুষের বৃহত্তর জীবনের ক্ষেত্রে। তাঁর মতে দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশের মূলে রয়েছে মানুষের জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত এক স্বাভাবিক কৌতূহল, জীবনকে সুন্দর ও মহৎ করার এক আন্তরিক প্রয়াস। সুতরাং জীবনকে বাদ দিয়ে দর্শন হতে পারে না।
গোবিন্দ দেবের দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিমূলে যে তত্ত্বটি কার্যকর তাকে তিনি প্রয়োগ করেছেন বিশ্বমানবতার ঐক্য-সম্প্রীতির যৌক্তিক ভিত্তি হিসেবে। তিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধারক, বাহক ও পরিচালক এক পরমসত্তায় বিশ্বাসী। তাঁর দার্শনিক আদর্শ উপনিষদ-বেদান্তে বিধৃত নিখিল বিশ্ব ও মানবতার একত্বের আদর্শ। এ একত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত স্রষ্টা ও সৃষ্টির, প্রকৃতি ও মানুষের একত্বের ওপর। এ আদর্শ খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব ঐতিহাসিক ধর্ম ও দর্শনে। এ মতে একই পরমসত্তা বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন মাত্রায় অভিব্যক্ত হয়ে চলছে। কোথাও তা জড়বস্ত্ত কোথাও চেতনা, কোথাও এক কোথাও বহু, কোথাও সত্তা কোথাও তার অবভাস। এ একক সত্তাই রূপ নেয় বহুর, আবার বহু তার অস্তিত্ব খুঁজে পায় এ একের মধ্যে। বহুর এ অন্তরতম ঐক্যের ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করতে হবে জগৎ ও জীবনকে এবং এর ভিত্তিতেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং জাতিতে জাতিতে।
গোবিন্দ দেব এক সমন্বয়ী দর্শনের প্রচার করেছিলেন। সমন্বয়ী দর্শন হচ্ছে বস্ত্তবাদ ও অধ্যাত্মবাদের সমন্বয়। তাঁর মতে বস্ত্তবাদ ও অধ্যাত্মবাদ একই পরমসত্তার দুটি দিক। জৈবিক চাহিদা মানুষকে বস্ত্তবাদের দিকে চালিত করে, আর আধ্যাত্মিক চাহিদা চালিত করে অধ্যাত্মবাদের দিকে। সত্তার স্বাভাবিক তাগিদেই মানুষের পদচারণা এ দুই আপাত বিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। এদের একটিকে বাতিল করে অপরটিকে অাঁকড়ে থাকা মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য নয়। মানুষের সার্বিক নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্যই প্রয়োজন এ দুই দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়। বস্ত্তগত ও আধ্যাত্মিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয়, পার্থিব ও পারলৌকিক প্রভৃতি নিয়ে দ্বন্দ্ব অচিরেই লোপ পাবে, মানুষের জীবন বস্ত্তবাদ ও অধ্যাত্মবাদ উভয় মতবাদের সমন্বয় ও সম্মিলনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, ধর্মবেত্তা, এক কথায় সকল শ্রেণির বিবেকবান মানুষ সেই অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাবেন– এ ছিল গোবিন্দ দেবের ঐকান্তিক আশা ও বিশ্বাস। এটাই তাঁর সমন্বয়ী ভাববাদের মূল কথা।
গোবিন্দদেব তাঁর দর্শন রচনা করেছেন ঐতিহাসিক ধর্মানুভূতি ও আধুনিক বিজ্ঞানের সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষ যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসের এবং দর্শনের চেয়ে ধর্মের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। এ কারণেই তিনি চেয়েছিলেন দর্শনের যুক্তির সঙ্গে ধর্মের বিশ্বাস ও অনুভূতিকে সমন্বিত করতে। তিনি যে ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন তা গতানুগতিক বিশেষ ধর্ম নয়, বরং এক সর্বজনীন মানবধর্ম। তাঁর দৃষ্টিতে যথার্থ ধর্মমাত্রই সাধারণ মানুষের বস্ত্তগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের বাহন, তথা মানবমুক্তির উপায়স্বরূপ। সব ধর্মেরই মূলকথা প্রেম। বিশ্বমানবতার কল্যাণ চেয়েছিলেন গোবিন্দদেব। ধর্ম ও দর্শনের দেওয়া সর্বজনীন দৃষ্টি মানুষের মধ্যে জাগাবে প্রেম, আর সেই প্রেমের সঙ্গে বিজ্ঞানের শক্তি যুক্ত হয়ে সুদৃঢ় করবে মানুষের ভবিষৎকে, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নিখিল বিশ্বের মানুষ সুখশান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হবে এ ছিল গোবিন্দদেবের স্বপ্ন, এটাই ছিল তাঁর দর্শনের মূলমন্ত্র।
ইহজাগতিক ও মানবতাবাদী দর্শনের অপর এক প্রবক্তা ছিলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান (১৯০৯-১৯৮৭)। দর্শনের জীবনমুখী ও মানবতাবাদী বাণীকে মুক্তবুদ্ধির আলোকে দেখা এবং নির্ভীক চিত্তে তা প্রকাশ, প্রচার ও মানবকল্যাণে প্রয়োগ করার জন্য তিনি অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল যাবৎ তিনি এ সত্যই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, দর্শন শুধু তত্ত্ব নয়, উন্নত জীবনের দাবি এবং তাকে জীবনে বাস্তবায়ন করাই দার্শনিকের মুখ্য উদ্দেশ্য। জীবন-সংগ্রামের লক্ষ্য মানবকল্যাণকর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার হবে অবসান, বিলুপ্ত হবে অন্ধ কুসংস্কারের অনুশাসন। বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের সাধনা হবে এরূপ একটি পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক, যা থেকে কল্যাণসাধনের মানসিকতা জন্মলাভ করবে। প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করে নতুন মানবকল্যাণকর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে দর্শন। বিশ্বে মানুষ নিষ্ক্রিয় দর্শক নয়, বরং সতত ক্রিয়াশীল। মানুষের চেষ্টায়ই রূপান্তর ঘটেছে জগতের ঘটনা-প্রবাহের। যথার্থ দর্শনের জন্য প্রয়োজন কল্যাণচিন্তা ও বিশ্বমানবতার কল্যাণসাধনের মানসিকতা। বস্ত্তত, দর্শন বলতে সাইদুর রহমান বুঝেছেন এ কল্যাণধর্মকেই এবং এর নাম দিয়েছেন ‘কল্যাণদর্শন’। পারলৌকিক ধর্মসাধনার চেয়ে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন ঐহিক কর্মানুষ্ঠান ও বিজ্ঞানসাধনার প্রতি; ভক্তির চেয়ে তিনি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন যুক্তির প্রতি। তাইতো তাঁর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা: প্রগতির জন্য তপস্যা নয়, চাই কর্ম, চাই স্বাধীন ও সংস্কারমুক্ত মন, চাই ত্যাগ ও মানবকল্যাণের মানসিকতা।
বাঙালির দর্শনের মূল্যায়ন বাঙালির দর্শনচিন্তায় আবেগানুভূতি ও ধর্মপ্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে এ প্রবণতা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে যুক্তিবাদী দর্শনের লীলাভূমি ইউরোপেও দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষে দর্শনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের যোগ ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। যেমন, বেদপন্থী আস্তিক দার্শনিকদের কেউ কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও বৈদিক ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেননি। অন্যদিকে নাস্তিক বলে পরিচিত চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈনদর্শন বেদের বিরোধিতা করলেও বৌদ্ধদর্শন বুদ্ধের ধর্মমত দ্বারা এবং জৈনদর্শন জৈন ধর্মমত দ্বারা প্রভাবিত। এদিক থেকে একমাত্র চার্বাকদর্শনই ছিল গতানুগতিক ধর্মমতের প্রভাবমুক্ত। তবে চার্বাকদর্শন যতই ধর্মনিরপেক্ষ হোক, সে যুগেও সর্বত্র ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাঙালি প্রধানত ধর্মপ্রবণ ও আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন হলেও এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। কারণ, বাঙালির মনে ধর্মীয় ও পারলৌকিক ধারার পাশাপাশি উপস্থিত দেখা যায় অপর একটি ধর্মনিরপেক্ষ বস্ত্তবাদী ঐহিক ধারা। যথার্থ জীবন বলতে বেশির ভাগ বাঙালি পারলৌকিক জীবনকে বুঝলেও অন্য অনেকে বুঝেছেন দেহাধারস্থিত সেই চেতনাকে, আধুনিক বস্ত্তবাদী দর্শনে যাকে অভিহিত করা হয় মস্তিষ্কের ক্রিয়া বলে। যেমন, চার্বাকদর্শনে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মবিশ্বাসের নামগন্ধও নেই; কণাদের বৈশেষিক দর্শনেও ঈশ্বরের ভূমিকার উল্লেখ নেই। ওখানে কণা বা জড়োপকরণকে উপস্থিত করা হয়েছে জগৎ ও জীবনের পরম সত্তা ও আদি উৎস বলে।
বাঙালির দর্শন যে ধর্মকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত, সে ধর্ম পাশ্চাত্যের রিলিজিয়নমাত্র নয়। ধর্ম বলতে বাঙালি কেবল মোক্ষসাধনা কিংবা পরলোকচর্চাকে বোঝে নি, বুঝেছে সমগ্র জীবনচর্চাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাঙালির ধর্ম বলতে সামাজিক কর্তব্যবোধ, রিলিজিয়ন, পলিটিক্স সবকিছুকেই বোঝায়। ঈশ্বর বলতেও আধুনিক বাঙালি জগৎ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কবিবর্জিত কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তাকে বোঝেনি, বুঝেছে সকল মানুষের মধ্যে যিনি স্বয়ং প্রকাশিত তাঁকে। মোট কথা, বাঙালির দার্শনিক চিন্তায় আবেগ ও বিশ্বাসের মাত্রা যাই থাক, সে আবেগ ও বিশ্বাসকে তাঁরা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছেন যুক্তি দিয়ে; ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনাকে তাঁরা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন একটা সুখি-সমৃদ্ধ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। [আমিনুল ইসলাম]
গ্রন্থপঞ্জি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা, মুখবন্ধ, কলকাতা, ১৯১৬; আহমদ শরীফ, ‘বাংলার তত্ত্বসাহিত্য’, দর্শন, ঢাকা, ১৯৬৪; নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস, সংক্ষেপিত সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৬৬; শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, পদাবলীর তত্ত্বসৌন্দর্য ও কবি রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা, ১৯৬৭; রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ), পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৭৩; ভূদেব চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (১ম পর্যায়), ৫ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৭৮।