সঙ্গীত

সঙ্গীত  প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতে দুটি ধারা বহমান– মার্গসঙ্গীত ও দেশিসঙ্গীত। বর্তমানে প্রচলিত রাগসঙ্গীত বা  উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মার্গসঙ্গীতের অনুসারী। মার্গসঙ্গীতে রাগরূপায়ণ ও সুরের ভূমিকাই মুখ্য, কথার আবেদন সেখানে গৌণ। আর দেশিসঙ্গীত কথা ও সুর উভয়কেই প্রাধান্য দিয়েছে এবং তা একরৈখিক (melody) পথে বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে। বাংলা সঙ্গীত প্রধানত দেশিসঙ্গীতের আদর্শেই রচিত ও বিকশিত।

বাংলা ভাষা ও সঙ্গীতের প্রাচীন নিদর্শন  চর্যাপদ। ১৯০৭ সালে  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থাগার থেকে এর  পুথি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কৃত পুথিটির নাম চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়। এটি মূলত প্রাপ্ত ৪৭টি গানের সংকলন। খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে গানগুলি রচিত।

বর্তমান কালের বাংলা গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলির পরিবর্তে সেকালে ছিল উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ। এগুলিকে বলা হতো ধাতু। এই চারটি ধাতুর মধ্যে উদ্গ্রাহ ও ধ্রুব সব গানেই থাকত, অন্য দুটি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই একটি ধাতু বর্জিত হলে সেই গানকে বলা হতো ত্রিধাতুক, আর দুটি বর্জিত হলে দ্বিধাতুক। সাধারণভাবে সঙ্গীতকে তখন প্রবন্ধগীত বলা হতো। মেলাপকবর্জিত বলে চর্যাগুলি ত্রিধাতুক প্রবন্ধগীত।

চর্যাগীতিগুলি যেসব রাগ-রাগিণীতে গাওয়া হতো সেগুলি হলো পটমঞ্জরী, মল্লারী, গুর্জরী, কামোদ, বরাড়ী, ভৈরবী, গবড়া, দেশাখ, রামক্রী, শবরী, অরু, ইন্দ্রতাল, দেবক্রী, ধানশ্রী, মালসী, মালসী-গবড়া ও বঙ্গাল রাগ। এর সঙ্গে পটহ বা ঢোল এবং  একতারা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হতো।

চর্যাগীতিগুলি মুখ্যত বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনপদ্ধতিমূলক গান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পালরাজাদের সময় চর্যাগীতি বাংলায় বিস্তার লাভ করে। চর্যাপদ ও দোহাকোষে বহু বাঙালি আচার্যের নাম পাওয়া যায়। ছন্দোবদ্ধ ও রূপকাশ্রয়ী চর্যাগুলি সান্ধ্যভাষায় রচিত। এর উদ্দেশ্য সহজিয়া বৌদ্ধসাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা।

চর্যার পরে বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নাথগীতি। নাথ গুরুদের মাহাত্ম্যবর্ণনায় রচিত এই গীতিসাহিত্য চর্যাপদের সমসাময়িক। নাথ সম্প্রদায়ের ধর্মমত এবং তাদের গুরুশিষ্যদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষায় অনেক আখ্যান রচিত হয়েছে। নাথধর্মের উৎপত্তি দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মমতের সংমিশ্রণে। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গোরক্ষনাথ।

নাথগীতি প্রধানত দুটি ধারায় বিকশিত হয়েছে। একটি ধারায় গোরক্ষনাথ ও তাঁর গুরু মীননাথের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ভবানীর অভিশাপে মীননাথের স্খলন ঘটলে গোরক্ষনাথ আপন বিদ্যাবলে গুরুকে সেই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনা মীনচেতন, গোরক্ষবিজয় প্রভৃতি নামেও খ্যাত।

অপর ধারাটি বিকশিত হয়েছে রাজা মানিকচন্দ্র, রাণী ময়নামতী এবং পুত্র গোপীচন্দ্রকে নিয়ে। গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণ এই ধারার মুখ্য কাহিনী, যা মানিকচন্দ্র রাজার গান, ময়নামতীর গান,  গোপীচন্দ্রের গান প্রভৃতি নামে পরিচিত।

চর্যার পদ রচনায় তুক বা স্তবকগত যে শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়, নাথগীতিতে তার অভাব রয়েছে। নাথগীতির গায়নপদ্ধতি চর্যাগীতির চেয়ে ভিন্ন প্রকারের ছিল বলে অনুমান করা হয়। এতে রাগের ব্যবহার থাকলেও গাওয়া হতো সম্ভবত ছড়ার আকারে। ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের কাহিনী গোপীচন্দ্রের পাঁচালি নামেও পরিচিত। এ থেকে অনুমিত হয় যে, এ কাহিনী পাঁচালির সুরেও পড়া হতো।

চর্যাগীতির পর সঙ্গীতশৈলীর অন্যতম নিদর্শন জয়দেবের  গীতগোবিন্দম দ্বাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গীতগোবিন্দম্ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে যেমন আদৃত, তেমনি সঙ্গীতশৈলীর একটি নিদর্শন হিসিবেও সমাদৃত।  জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাকবি। তাঁর রচিত পদগুলিতে কাব্য ও সঙ্গীতের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে, যা বাংলা সঙ্গীতের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই পদগুলি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত। গীতগোবিন্দম্ বিভিন্ন চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তি সমন্বিত নাট্য লক্ষণাশ্রয়ী কাব্যগ্রন্থ। এর প্রধান চরিত্র তিনটি রাধা, কৃষ্ণ ও সখী। গীতগোবিন্দম্ প্রবন্ধশ্রেণীর সঙ্গীত, অর্থাৎ এর গানগুলি কলিদ্বারা নিবদ্ধ।

গীতগোবিন্দম্-এ ১২টি সর্গ, ২৬৬টি শে­াক এবং ২৪টি গান আছে। এই ২৪টি গানই এর প্রাণ। মাত্রাবৃত্ত অপভ্রংশ ছন্দে রচিত গানগুলি মালবগৌড়, বসন্ত, রামকিরি, কর্ণাট, দেশাখ, দেশবরাড়ী, গোন্ডকিরী (গুণকরী), মালব, ভৈরবী ও বিভাস রাগে গাওয়া হতো। এর সঙ্গে ব্যবহূত তালগুলি হলো রূপক, নিঃসার, যতি, একতাল এবং অষ্টতাল।

চর্যাগীতিতে ব্যবহূত রাগসমূহের কয়েকটি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ এবং বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও লক্ষ করা যায়। চর্যার রামক্রী গীতগোবিন্দম্ল-এ হয়েছে রামকিরি এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে দেশাখ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধানুষী (ধানশ্রী) মূলত চর্যাগীতির ধনাসী রাগের পরিবর্তিত রূপ। মল­ারী রাগ মল­ার নামে আজও সুপরিচিত। বর্তমানকালের রাগসঙ্গীতে এখনও প্রচলিত আছে গীতগোবিন্দম্-এ ব্যবহূত কয়েকটি রাগ, যেমন ভৈরবী, বিভাস, বসন্ত, দেশ প্রভৃতি। তবে সে সময়ের রাগরূপায়ণ ও বর্তমানে প্রচলিত রাগলক্ষণ একই রকম কিনা তা জানা যায় না। বিভাস রাগ এখন রাগসঙ্গীতে ভৈরব ঠাটের অন্তর্গত। আবার বাংলাদেশে শুদ্ধস্বরের বিভাস রাগ আছে, যা লোকসুরে বিশেষভাবে প্রচলিত। গীতগোবিন্দম্-এ যেসব তালের উলে­খ আছে, বাংলা কীর্তনে এখনও তার পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যে কর্ণাট রাগের ব্যবহার আছে, রাগতরঙ্গিণী গ্রন্থে তার উলে­খ আছে। বাংলা  কীর্তন গানে কর্ণাট রাগের বহুল প্রয়োগ হয়।

গীতগোবিন্দম্-এর দুটি প্রধান গায়নরূপ প্রচলিত ছিল একটি ধ্রুপদাঙ্গ, অন্যটি কীর্তনাঙ্গ। তবে গীতগোবিন্দম্ প্রধানত ধ্রুপদাঙ্গেই গীত হতো। বঙ্গদেশে গীতগোবিন্দম্ল-এর প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার পর শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কীর্তনান্দোলন শুরু হয় এবং তাঁর অনুসারীরা কীর্তনাঙ্গে জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ গাইতে থাকে। ফলে গীতগোবিন্দম্-এর পদগুলি কীর্তনে পরিণত হয়। এভাবে বাংলা কীর্তন গানে গীতগোবিন্দম্-এর গভীর প্রভাব পড়ে।

বাংলা সঙ্গীতকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বড়ু চন্ডীদাসের  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। গ্রন্থটি কাব্যসঙ্গীত এবং গীতিনাট্য উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে নৃত্যেরও পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মোট পদের সংখ্যা ৪১৮। প্রতিটি পদে সুর, তাল ও গায়নরীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল যেমন চর্যাগীতি ও লোচনদাসের ধামালি রচনার মধ্যবর্তী, তেমনি এর ছন্দরীতিও  প্রাকৃত ও বাংলা-প্রাকৃত রীতির মধ্যবর্তী। সাঙ্গীতিক পরিভাষায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিপ্রকীর্ণ জাতীয় গীতরূপ। দুটি গ্রাম্য গোপ বালক-বালিকার প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে এটি রচিত। এতে গ্রামের পথঘাট, বনাঞ্চল এবং গ্রাম্যজীবনের এক স্বাভাবিক চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনটি চরিত্র রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াইর ছন্দোবদ্ধ উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে। অনেকের ধারণা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে বাংলার ঝুমুর গান ও লোকযাত্রার বীজ নিহিত।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মোট ৩২টি রাগ-রাগিণীর উলে­খ আছে। সেগুলি হলো আহের, ককু, কহু, কহু গুর্জরী, কেদার, কোড়া, কোড়া দেশাগ, গুর্জরী, দেশ বরাড়ী, দেশাগ, ধানুষী, পটমঞ্জরী, পাহাড়ী, বঙ্গাল, বঙ্গাল বরাড়ী, বরাড়ী, বসন্ত, বিভাস, বিভাস কহু, বেলাবলী, ভাটিয়ালী, ভৈরবী, মল­ার, মালব, মালবশ্রী, মাহারঠা, রামগিরি, ললিত, শৌরী, শ্রী, শ্রীরামগিরি ও সিন্ধোড়া। যেসব তালের পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলি হলো যতি, ক্রীড়া, একতালী, লঘুশেখর, রূপক, কুড়ুক্ক ও আঠতালা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহূত ‘শৌরী’ রাগ সম্ভবত চর্যায় ব্যবহূত ‘শবরী’ রাগের  অপভ্রংশ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহূত কয়েকটি রাগ-রাগিণীর পরিচয় প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রে পাওয়া যায়, যেমন আহের (আভীর), কহু (ককুভ), রামগিরি (রামক্রি), ধানুষী (ধানশ্রী), দেশাগ প্রভৃতি।

গীতগোবিন্দম্-এ যেসব রাগ-রাগিণীর উলে­খ আছে তার পরিচয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও পাওয়া যায়। তবে গীতগোবিন্দম্-এ পটমঞ্জরী রাগে রচিত পদের সংখ্যা অধিক, আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাহাড়ী রাগে রচিত পদের সংখ্যা অধিক, যা গীতগোবিন্দম্ল -এ নেই। গীতগোবিন্দম্ল -এ যেসব তালের উলে­খ আছে তার পরিচয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও পাওয়া যায়, যেমন যতি, রূপক ও একতালি। শুধু সাঙ্গীতিক দিক দিয়ে নয়, রচনাশৈলী এবং আঙ্গিকের দিক দিয়েও উভয় কাব্যের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এক কথায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে জয়দেবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে।

বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে  বিদ্যাপতি র দান অপরিসীম। তাঁর পদাবলি মৈথিলী ভাষায় রচিত হলেও একসময় তা বাংলায় খুব জনপ্রিয় ছিল। বৈষ্ণবপদাবলি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর পদাবলিতে যেমন আছে ভক্তিরস, তেমনি আছে মানবিক প্রেম। পরবর্তীকালের গীতিকবিরা তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির ভক্ত ছিলেন। তিনি বিদ্যাপতির অনেক পদ সুরসংযোগে গাইতেন। বিদ্যাপতি রচিত ‘ভরা বাদর মাহ বাদর’ পদটিতে রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করেছেন।

বৈষ্ণবপদাবলি রচনার ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি জয়দেবের অনুসারী ছিলেন। সেজন্য বিদ্যাপতিকে ‘অভিনব জয়দেব’ বলা হতো। আবার বিদ্যাপতির এক শতাব্দী পরে বাংলার বৈষ্ণবকবি গোবিন্দ দাস বিদ্যাপতির পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন বলে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে খ্যাত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ গোবিন্দ দাসেরও ভক্ত ছিলেন। গোবিন্দ দাস রচিত ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’ পদটিতে রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিদ্যাপতির পদগুলি শব্দমাধুর্য ও সুরলালিত্যে অপূর্ব। বাংলার কীর্তনীয়ারা তাঁর পদসমূহ রসকীর্তন ও পালাকীর্তনের অন্তর্ভুক্ত করে তাঁকে অমর করে রেখেছেন।

সামগ্রিকভাবে বাংলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কার ও মননে বৈষ্ণবপদাবলির প্রভাব অপরিসীম। এর প্রভাবে বাঙালির মানবতাবোধ উজ্জীবিত হয়। বৈষ্ণব মতবাদের প্রভাবে  সহজিয়া ও  বাউল মতবাদ পরিপুষ্ট হয়; শাক্ত সম্প্রদায়ে ভক্তিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে এবং বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্তপদাবলি রচিত হয়। বৈষ্ণবরাই বাংলা গীতিকবিতা রচনা এবং অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার সূত্রপাত করেন। প্রেমানুভূতি এবং ভাবের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অভিব্যক্তির কারণে বৈষ্ণবপদাবলি বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে।

রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে অবলম্বন করেই বৈষ্ণবপদাবলির উদ্ভব। এর শুরু প্রাকচৈতন্য যুগে। চৈতন্যদেবের অনুপ্রেরণায় অসংখ্য বৈষ্ণবকবি রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়ভিত্তিক পদ রচনা করেন এবং তা সারা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ পদগুলি কীর্তন নামেও খ্যাত। বাংলা সঙ্গীতজগতের এক অমূল্য সম্পদ এই কীর্তন গান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘কীর্তনে আমরা যে আনন্দ পাই সেতো অবিমিশ্র সঙ্গীতের আনন্দ নয়, তার সঙ্গে কাব্যরসের আনন্দ একাত্ম হয়ে মিলিত।’ চৈতন্যোত্তর যুগে বাংলা ও ব্রজবুলিতে প্রায় দশ হাজারের মতো পদ রচিত হয়েছে। বৈষ্ণবপদাবলির শ্রেষ্ঠ পদকার হলেন  বিদ্যাপতিচন্ডীদাসগোবিন্দদাসজ্ঞানদাসমালাধর বসু, শেখ ফয়জুল্লাহসৈয়দ সুলতান, বলরাম দাস, লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ,  মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস, নরোত্তম দাস প্রমুখ।

বঙ্গদেশে প্রাচীনকাল থেকেই কীর্তন বা ঈশ্বরের নামগান করার প্রচলন ছিল। বৌদ্ধরাও চর্যাগান করত, যা কীর্তন গানেরই অনুরূপ। ঈশ্বরের নাম, লীলা ও গুণের উচ্চভাষণই কীর্তন। এই কীর্তনের বিশিষ্ট রূপ দেন চৈতন্যদেব। তিনি কীর্তনকে দুটি পদ্ধতিতে ভাগ করেন নাম-সংকীর্তন ও রসকীর্তন বা লীলাকীর্তন। কীর্তনের পাঁচটি অঙ্গ কথা, দোঁহা, আখর, তুক্ ও ছুট্। কীর্তনের অপর একটি অঙ্গ হলো ঝুমুর। বাংলা লোকসঙ্গীত এবং আধুনিক গানে ঝুমুরের প্রভাব লক্ষ করা যায়।          কাজী নজরুল ইসলাম ঝুমুর সুর ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন গানে, যেমন ‘চুড়ির তালে নুরির মালা’, ‘তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে’, ‘রাঙামাটির পথেলো’  প্রভৃতি।

কীর্তন উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ অনুসারে রচিত, অর্থাৎ আধুনিক কালের সাঙ্গীতিক পরিভাষায় স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলিতে নিবদ্ধ। কীর্তনে যেসব তালের পরিচয় পাওয়া যায়, প্রাচীন সঙ্গীতগ্রন্থে তার উলে­খ আছে। তালগুলি দক্ষিণী সঙ্গীত এবং বাংলা কীর্তনে এখনও প্রচলিত। তালগুলি হচ্ছে ধ্রুবতাল, শ্রুতিতাল, রুদ্রতাল, বৃক্ষতাল, জপতাল প্রভৃতি। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ল -এর তাল এবং পরবর্তী কীর্তনের তাল প্রায় একই।

ষোলো শতকের শেষদিকে কীর্তন গান সারা বাংলায় বিস্তার লাভ করে। এ সময় কীর্তনের চারটি শাখা গড়ে ওঠে গরাণহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটী ও মন্দারিণী। এগুলির মধ্যে মনোহরশাহী কীর্তনের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। আঠারো-ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র বাংলায় প্রধানত এই কীর্তনই প্রচলিত ছিল।  কবিগান ও আধুনিক পাঁচালিতেও মনোহরশাহী কীর্তনের প্রভাব পড়েছে।

কীর্তন ভেঙে বাংলায় ঢপকীর্তনের সৃষ্টি হয়। মুর্শিদাবাদের রূপচাঁদ অধিকারী (১৭২২-১৭৯২) ও বনগ্রামের (যশোর)  মধুসূদন কিন্নর (মধুকান) রচিত ঢপকীর্তন এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আখরবিহীন এই ঢপে পাঁচালি ও যাত্রাগানের প্রভাব সুস্পষ্ট। ঢপকীর্তনে সাধারণত তিন, চার, পাঁচ ও সাত মাত্রার তাল ব্যবহূত হয়। শাস্ত্রীয় উচ্চাঙ্গ কীর্তনের মতো দশকোষী, আড়, লোফা প্রভৃতি জটিল তালের ব্যবহার এতে নেই। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কীর্তন-অঙ্গের গানে ঢপকীর্তনের ভাব ও রীতির অনুসরণ দেখা যায়। ‘ওকে বলো সখী বলো, কেন মিছে করে ছলো’ মায়ার খেলার এই গানে মধুকানের স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। মধুকান রাধা-কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে বহু পদ রচনা করেন এবং সেগুলি রাগ-রাগিণী সহযোগে গীত হতো।

পনেরো থেকে আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত  মঙ্গলকাব্য বা মঙ্গলগানের যুগ। মঙ্গলসূচক পদসমষ্টিই মঙ্গলকাব্য। এর পদগুলি বসন্ত, মল­ার, শ্রী, কৌশিকী (বোট্টা) প্রভৃতি রাগে রচিত এবং এক বিশেষ সুরে গাওয়া হতো। এই সুর মঙ্গলসুর নামে পরিচিত। সাধারণভাবে দেববিষয়ক সঙ্গীতমাত্রই মঙ্গলসুরে গাওয়া হতো। মঙ্গলকাব্যগুলিতে তৎকালে ব্যবহূত কতগুলি বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়, যেমন  সানাইবাঁশিমৃদঙ্গ, শঙ্খ, করতাল,  মন্দিরা, রবাব,  দোতারাসেতার, ডম্ফ,  খমক প্রভৃতি।

মঙ্গলকাব্যের মতো পাঁচালিও পৌরাণিক ও লৌকিক বা দেশজ কাহিনী অবলম্বনে রচিত। আঠারো শতকে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল থেকে আধুনিক পাঁচালির সূত্রপাত। ঊনবিংশ শতকে  দাশরথি রায় ছিলেন পাঁচালি রচয়িতাদের মধ্যে সর্বপেক্ষা শক্তিমান ও প্রভাবশালী। তাঁর পাঁচালিতে অনুপ্রাসের ঝংকার ও সুরমাধুর্য সকলকে মুগ্ধ করত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে দাশরথি রায়ের পাঁচালির উলে­খ করেছেন: ‘ওরে রে লক্ষ্মণ একী কুলক্ষণ/ জানকীরে দিয়ে এসো বন।’ বর্তমানেও বিশেষ করে মহিলারা লক্ষ্মীর পাঁচালি, শনির পাঁচালি, মঙ্গলচন্ডীর পাঁচালি ও  সত্যনারায়ণের পাঁচালি সুর করে পাঠ করেন।

পাঁচালি গান সাধারণত পঞ্চপদে সীমাবদ্ধ। মধ্যযুগে পাঁচালি ছিল ক্ষুদ্র গীতের অন্তর্ভুক্ত। ঊনবিংশ শতকে এর আঙ্গিকগত পরিবর্তন ঘটলেও বিষয়বস্ত্ত একই রয়েছে, তবে পরিবেশনরীতিতে নতুনত্ব ঘটেছে। এ সময় দাশরথি রায় পাঁচালি গানে রাগসঙ্গীতের মাধুর্য আনেন। তিনি ললিত, বিভাস, সিন্ধু-ভৈরবী প্রভৃতি রাগ-রাগিণীতে এবং যৎ ও ঝাঁপতালে বহু পাঁচালি গান রচনা করেছেন। অন্যান্য পাঁচালিকাররা হলেন ঠাকুরদাস, দ্বারকানাথ, রসিকচন্দ্র রায়, ব্রজমোহন রায়, ইশ্বর গুপ্ত, সন্ন্যাসী চক্রবর্তী প্রমুখ।

কীর্তনের সমসাময়িক কালেই শাক্তগীতির উদ্ভব ঘটে। বৈষ্ণবসাধনার শ্রেষ্ঠ সাঙ্গীতিক রূপ যেমন কীর্তন, তেমনি শক্তিসাধনার শ্রেষ্ঠ অবদান শাক্তগীতি। বৈষ্ণবপদাবলি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত, আর শাক্তপদাবলি রচিত হয়েছে শ্যামা বা কালীকে কেন্দ্র করে। এছাড়া রয়েছে উমা সম্বন্ধে  আগমনী-বিজয়া গান। তাই শাক্তসঙ্গীতের দুটি ধারা শাক্তসঙ্গীত ও উমাসঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়া।

সতেরো শতকে বাঙালি মানসচেতনায় বৈষ্ণবভাব মন্দীভূত হয়ে এলে মাতৃশক্তি অর্থাৎ শ্যামার উপাসনা প্রাধান্য পায়। রাষ্ট্রবিপ­বের ফলে দেশে যখন দুর্দিন ঘনিয়ে আসে, তখন প্রেমসাধনার আদর্শ ছেড়ে জনচিত্ত উৎসাহী হয় মাতৃশক্তির আরাধনায়। বৈষ্ণব সাধকসম্প্রদায় ছিলেন সংসারবিমুখ, কিন্তু শক্তিসাধকরা ছিলেন বৈষয়িক জীবনের সঙ্গে জড়িত। তারা সংসারে থেকেই শক্তির সাধনা করেছেন এবং শক্তিকে কেন্দ্র করে যে সঙ্গীত রচনা করেছেন সেগুলিই শাক্তগীতি নামে পরিচিত। মাতৃসঙ্গীত, কালীসঙ্গীত, চন্ডীগীতি, মালসী গান, আগমনী-বিজয়া এই সঙ্গীতের কয়েকটি রূপ। শাক্তগীতিকাব্যের রস হলো বাৎসল্য, বীর, অদ্ভুত, দিব্য ও শান্ত।

শাক্তপদাবলির প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা  রামপ্রসাদ সেন ছিলেন একাধারে ভক্ত, সাধক ও কবি। জগন্মাতার ধ্যানে নিবিষ্ট থেকেও রামপ্রসাদ সংসারকে ভুলে যাননি। তাই সংসারের সুখ-দুঃখের অনুভূতি তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনায় বৈচিত্র্য এনেছে। শ্যামাভক্ত রামপ্রসাদ যে গানগুলি রচনা করেছেন সেগুলি  রামপ্রসাদী গান নামে পরিচিত। রামপ্রসাদের গান রাগসঙ্গীতের ধারাতেও গাওয়া হয়, আবার সহজ-সরল রামপ্রসাদী সুরেও গাওয়া হয়। তাঁর সহজ-সরল কথা এবং দেশী সুরে রচিত গানে চমৎকারভাবে মানবজীবন মূল্যায়িত হয়েছে, যেমন: ‘মনরে, কৃষি কাজ জান না/ এমন মানব জমি রইলো পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা’ ইত্যাদি। রামপ্রসাদ  শ্যামাসঙ্গীত, আগমনী-বিজয়ার গান ব্যতীত কতকগুলি পালাগানও রচনা করেছিলেন, সেগুলি হলো বিদ্যাসুন্দর, কালিকামঙ্গল ও কালীকীর্তন।

রামপ্রসাদের পরই শাক্তপদাবলি রচয়িতা হিসেবে যাঁর নাম উলে­খযোগ্য তিনি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১)। কমলাকান্ত ছিলেন বর্ধমানের মহারাজা তেজসচন্দ্রের সভাকবি। তিনি বহুসংখ্যক আগমনী ও বিজয়াবিষয়ক গান এবং ভক্তিমূলক শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন। শ্যামাসঙ্গীত বা শাক্তপদাবলির এই ধারা রামপ্রসাদ, তেজসচন্দ্র প্রমুখের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, ক্ষীরদাপ্রসাদ প্রমুখ আধুনিক কবি ও নাট্যকারের কল্পনাকে প্রভাবিত করে শেষপর্যন্ত নজরুল ইসলামে এসে সার্থক পরিণতি লাভ করেছে।

বাংলা গানের আরেকটি বিশেষ ধারা কবিগান। এর উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ ছিল। আঠারো-উনিশ শতকের দিকে কবিগানের উদ্ভব হয়। এই গীতরূপে পদাবলির অধঃপতিত ঐতিহ্য সখী-সংবাদ নামে, শ্যামাসঙ্গীতের ঐতিহ্য মালসী নামে এবং লোকঐতিহ্য ‘খেউড়’ নামে সম্মিলিত হয়েছে। এক কথায় বলা যায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রবন্ধগীতিই যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে একালের কবিগান-পাঁচালি-তরজা ও বয়াতির গানে পরিণত হয়েছে।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কবিয়ালদের প্রতিষ্ঠা চরমে উঠেছিল, যদিও তার আগে এবং পরে একাধিক শতাব্দী জুড়ে এর বিস্তার ঘটে। তখন যারা কবিগানের চর্চা করতেন তাঁরা ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও বেদ-পুরাণ-কুরআন এবং রাজনীতি-ইতিহাস সচেতন স্বভাবকবি। কবিগানের উদ্ভব ও ইতিহাস সম্বন্ধে ররীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘ইংরেজের নতুন সৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না। তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি এবং সেই হঠাৎ রাজার সভার উপযুক্ত গান হইল কবিদলের গান।’ জনসাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট কবিগান সে যুগের হঠাৎ কবিদের সাময়িক কীর্তন। এতে আসরে বসেই কবিদেরকে প্রশ্নোত্তর (চাপান ও উত্তর) রচনা করতে হতো। আসরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কবি সুর ও তাল সহযোগে তৎক্ষণাৎ পদ রচনা করতেন। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, অনুপ্রাসের ব্যবহার, সরস রাগবিস্তার, যুক্তিমালা, অপর পক্ষকে আক্রমণ এবং আপন বক্তব্য প্রতিষ্ঠার ওপর কবিয়ালদের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা হারজিৎ নির্ভর করত। এতে বিতর্কের মাত্রা অনুসারে ঢোল, কাঁসি, ঘণ্টা বা মন্দিরার আওয়াজ ও লয়ের তারতম্য ঘটত।

আঠারো শতকের প্রারম্ভে গোঁজলা গুঁই নামক এক কবিয়াল প্রথম পেশাদার দল গঠন করে কবিগান গাইতেন। তাঁর শিষ্যপরম্পরা হলো রঘুনাথ, লালু, নন্দলাল, নিতাই বৈরাগী, নৃসিংহ,  হরু ঠাকুরভোলা ময়রা, রামবসু প্রমুখ। এছাড়া কেষ্টা মুচি,  এন্টনি ফিরিঙ্গি (পর্তুগিজ) ও  রমেশ শীল কবিগানে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এন্টনি ফিরিঙ্গি বিদেশী ও বিভাষী হওয়া সত্ত্বেও কবিগানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং এ নিয়ে পর্যাপ্ত চর্চা করেছিলেন।

কবিয়ালদের মধ্যে রামবসু ছিলেন যথার্থ রসিক প্রকৃতির কবি। ঈশ্বরগুপ্ত তাঁকে বলেছেন ‘কবিয়ালদের কালিদাস’। রামবসুর গান শিক্ষিতসমাজেও সমাদৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রামবসুর গান গাইতেন। রামবসু রচিত ‘মনে রইল সই মনের কথা’ গানটি ভেঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘মনে রয়ে গেল মনের কথা।’

বর্তমানে বাংলার একান্ত নিজস্ব সম্পদ এই কবিগানের ভিন্ন একটি রূপ লক্ষ্য করা যায় বয়াতিদের গানে। যারা গানের ভেতর দিয়ে বয়ান করেন এবং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ভাববিনিময় করেন তাঁদের বলা হয় বয়াতি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বয়াতি হলেন আবদুর রহমান, কুদ্দুস বয়াতি, ইদ্রিস বয়াতি প্রমুখ।  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার এই কবিগানকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁর কবি উপন্যাসে।

বাংলাদেশে যাত্রাগানের উদ্ভব হয় ষোড়শ শতকে। ‘যাত্রা‘ শব্দটির প্রকৃত অর্থ পূজা-পার্বণ ও বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে শোভাযাত্রা এবং বিশেষ এক ধরনের মন্ডপে সমবেত হয়ে দেবমাহাত্ম্যমূলক সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্য প্রদর্শন করা। প্রাচীনকালে যাত্রায় কথোপকথন থাকলেও গানের অংশ বেশি থাকতো বলে একে ‘যাত্রাগান’ বলা হতো। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ল  অনেকটা যাত্রাগানের আকারেই রচিত, কেননা এর পদগুলি এমনভাবে সাজানো যে, সেগুলি অভিনয়ের মাধ্যমে গীত হলে যাত্রাগানেরই রূপ নেয়। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সে যুগের কৃষ্ণযাত্রা পালার একটি প্রামাণ্য নিদর্শন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন জন্মখন্ড থেকে রাধাবিরহ পর্যন্ত ১৩টি খন্ডে অভিনীত হতো। যাত্রাগানের ক্রমবিবর্তনের ধারায় আরও পাওয়া যায় কৃষ্ণনগর রাজসভার পন্ডিত  ভারতচন্দ্র রচিত চন্ডী নাটক বা চন্ডীযাত্রা।

ইংরেজ রাজত্বের সময় থেকেই দেবমাহাত্ম্যের পরিবর্তে সামাজিক কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালা রচিত ও অভিনীত হতে শুরু করে। ভারতচন্দ্রের চন্ডীযাত্রা ও বিদ্যাসুন্দর, মনসার ভাসান ইত্যাদি এই শ্রেণীর উলে­খযোগ্য যাত্রাপালা। মনসার ভাসান  মনসামঙ্গল ভেঙ্গে রচিত। সর্পভয় নিবারণার্থে এই যাত্রাপালা অভিনীত হতো। গত শতাব্দীর  যাত্রা রচয়িতাদের মধ্যে গোবিন্দ অধিকারী, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, পরমানন্দ অধিকারী, মধুসূদন কিন্নর, ব্রজমোহন রায় প্রমুখের নাম উলে­খযোগ্য।

গোবিন্দ অধিকারীর নৌকাবিলাস এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাঁর শিষ্য ছিলেন নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়। তাঁর রচিত কংসবধ, যযাতিযজ্ঞ, চন্ডালিনী উদ্ধার প্রভৃতি যাত্রাগান মঞ্চস্থ হয়। কৃষ্ণকমল গোস্বামীর স্বপ্নবিলাস পালার একটি জনপ্রিয় গান এখনও লোকমুখে শোনা যায়। গানটি হলো: ‘শোন ব্রজরাজ স্বপনেতে আজ/ দেখা দিয়ে গোপাল কোথা লুকালে।’ গানটি খাম্বাজ রাগে ও একতালে নিবদ্ধ। নীলকণ্ঠের বহু গান এখনও গীত হয়ে থাকে।

যাত্রাগুলিতে নানারকম গানের সঙ্গে আড়খেমটা নামক একটি রীতি প্রচলিত ছিল। গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দর পালায় এই রীতির প্রাধান্য দেখা যায়। গোপাল উড়ে, মধুসূদন কিন্নর প্রভৃতির নাম যাত্রাগানের জগতে এখনও প্রসিদ্ধ। উড়িষ্যার যাজপুর নিবাসী গোপাল উড়ে তাঁর সুমধুর কণ্ঠ দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন সেই আমলের কলকাতাকে। বিদ্যাসুন্দর পালায় তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত গান: ‘ঐ দেখা যায় বাড়ী আমার/ চৌদিকে মালঞ্চ বেড়া। ভ্রমরেরা গুন গুন করে/ কোকিলে দিচ্ছে সাড়া।’ ত্রিমাত্রিক ছন্দে রচিত এই গানে এমন এক মাধুর্য পাওয়া যেতো যাতে প্রণয়সঙ্গীতগুলি অত্যন্ত মনোগ্রাহী হয়ে উঠতো। রবীন্দ্রনাথের গানেও যাত্রাগানের এই রীতির অনুবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যাসুন্দর পালার ‘ঐ দেখা যায় বাড়ী আমার’ গানটি ভেঙেই রবীন্দ্রনাথ তাসের দেশের ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’ গানটিতে সুরসংযোজনা করেন। বর্তমানকালে আর যাত্রাগান নেই, এখন সবই গদ্যসংলাপময় যাত্রায় রূপান্তরিত হয়েছে। অবশ্য শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য মাঝে মাঝে এতে নৃত্য-গীত পরিবেশিত হয়।

বাংলা লোকসাহিত্যে পালারীতির প্রচলন সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে  মৈমনসিংহ-গীতিকা ও  পূর্ববঙ্গ-গীতিকা য়। এগুলি বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাস্তবতায়, মানসিকতায় ও জীবনচেতনায় এগুলি অসাধারণ। এতে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি বিধৃত আছে। বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ মেলে এই গাঁথাগুলিতে। বাংলাদেশে এই গাঁথাগুলির মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি পালা হলো মহুয়া, মলুয়া, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, দেওয়ানা মদিনা বা আলাল-দুলালের পালা। এই পালা বা গাঁথাগুলি যেমন গীত হয় তেমনি চলচ্চিত্র এবং নাটকেও রূপায়িত হয়। মাধবী মালঞ্চ কন্যা নামে দেওয়ান ভাবনা পালার নাট্যরূপ মঞ্চায়িত হয়েছে। এই পালাগুলির রচনাকাল ষোলো থেকে আঠারো শতকের মধ্যে।

বাংলা লোকগীতির একটি বিশেষ ধারা বাউল গান। উনিশ শতকের আগে বাউল গানের কোন লেখ্যরূপ পাওয়া যায় না, যদিও এর আগে থেকেই বাউল মতবাদ ও বাউল গানের প্রচলন ছিল। এর কারণ বাউল সাধকদের সাধন প্রণালী গুরু-শিষ্য (মুরশিদ-মুরিদ) পরম্পরায় শ্রুতি-স্মৃতি অবলম্বনেই প্রবহমান ছিল।

সতেরো শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলায় তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখা থেকে সুফিপ্রভাবে বাউলমতের উন্মেষ ঘটে। মাধববিবি এবং  আউলচাঁদ এই মতের প্রবর্তক বলে ধারণা করা হয়। মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র বাউলমত জনপ্রিয় করে তোলেন। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ-সহজিয়া-নাথগীতিকা, সুফিধর্মের প্রভাব, চৈতন্যদেব প্রবর্তিত প্রেমধর্ম এবং লোকসংস্কৃতির সম্মিলনে বাউলধর্ম এক সর্বজনীন দর্শনরূপে বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে ওঠে। আর উনিশ শতকে লালন শাহর সাধনা ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। বাউল ধর্মের মর্মবাণী বিশ্বমানবতা অর্থাৎ মানুষে মানুষে ভেদহীনতা এবং স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদন। এই বাণীর প্রচারে  লালন শাহ যে গানগুলি রচনা করেন তা বিশ্বমানবের অমূল্য সম্পদ। ‘নানান বরন গাভীরে ভাই একই বরন দুধ/ জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত’, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’, ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখানা’ ইত্যাদি গানের মধ্য দিয়ে জাতিভেদের অসারতা এবং বিশ্বমানবতা চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

উনিশ শতকে  কাঙাল হরিনাথ (ফিকির চাঁদ)-এর গান সবিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময়  মনোমোহন দত্ত এর বাউলগানও প্রসিদ্ধি লাভ করে। হরিনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ বাউলগানের প্রতি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরা বাউল গান সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিভিন্ন লেখায় বাউলগানের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করেন। লালনপরবর্তী গগন,  দুদ্দু শাহপাগলা কানাই, ভবা পাগলা, রাধারমণ (১৮৩৩-১৯১৬), মদন, শা-নূর, সাহাবুদ্দীন, হাছন রাজা প্রমুখ বাউল-মরমিয়া সাধকের অবদানে বাউল গানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। বাউল গানের ভাবদর্শন ও বিশেষত্ব পরবর্তী আধুনিক গীতিকবিদেরও প্রভাবিত করে। বাংলা সঙ্গীতের পঞ্চ প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল রায়, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ ও নজরুলের গানে বাউল গানের পরিশীলিত রূপ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সঙ্গীতের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য কথা ও সুরের মিলন বাউল গানে তার সার্থক পরিচয় পাওয়া যায়।

আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাগসঙ্গীত চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ সময় টপ্পাগানেরও প্রচলন হয়। বাংলা টপ্পাগানের প্রবর্তক রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু। তাঁর নামানুসারেই টপ্পাগান ‘নিধুবাবুর টপ্পা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। টপ্পাগান উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয় ছিল। নিধুবাবু শুধু টপ্পারই প্রতিষ্ঠাতা নন, আধুনিক বাংলা কাব্যসঙ্গীতের প্রথম প্রেরণাও তাঁর কাছ থেকেই এসেছে।

টপ্পা ছিল পাঞ্জাবের লোকসঙ্গীত। আঠারো শতকের প্রথমদিকে পাঞ্জাবের ঝাঙ্গ জেলার গায়ক গোলাম নবী (মতান্তরে শোরি মিঞা) সে অঞ্চলের উটচালকদের গানের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে টপ্পাগানের সৃষ্টি করেন। শোরি মিঞার টপ্পার  রাগতাল, ছক বা সাঙ্গীতিক আদর্শ ও আঙ্গিক অনুসরণে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা রচনা করেন। যেমন, শোরির টপ্পা: ‘ও মিঞা বে জানেওয়ালে (তানু)/ আল­া কি কসম্ কিরিয়া নানুওয়ালে।’(সিন্ধু খাম্বাজ)। নিধুবাবুর টপ্পা: ‘কি যাতনা যতনে মনে মনে মনই জানে/ পাছে লোকে হাসে শুনে, লাজে প্রকাশ করিনে।’ (সিন্ধু খাম্বাজ)।

পশ্চিমী টপ্পার মূল আদর্শ দোলায়িত সুরের নকশা অনুসরণ করলেও নিধুবাবু যে বাংলা টপ্পারীতি প্রবর্তন করেন তার মধ্যে দ্রুত তানের আধিক্য নেই। পশ্চিমী টপ্পায় তানের কাজটা খুব দ্রুত, কিন্তু নিধুবাবু এই তানে একেকটি সুরের ওপর একেকটি আন্দোলনের ভাব সংযোজন করেন যাতে টপ্পার করুণ রসটি মূর্ত হয়ে ওঠে। বাংলা টপ্পার এই বৈশিষ্ট্যই পরবর্তীকালের রচয়িতাগণ গ্রহণ করেছেন। নিধুবাবুর পরে  টপ্পা রচনায় যাঁরা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে শ্রীধর কথক, কালীদাস চট্টোপাধ্যায় বা কালী মির্জা, রঘুনাথ রায়, রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, হাবিব মিঞা, হস্নু মিঞা টপ্পাবাজ প্রমুখ উলে­খযোগ্য। বাংলা সঙ্গীতের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য কথা ও সুরের মিলন অর্থাৎ কাব্যধর্মিতা, বাংলা টপ্পায় সে আস্বাদ পাওয়া যায়। বস্ত্তত বাংলা টপ্পা অনেক মার্জিত ও বিশেষত্বসম্পন্ন, যার মধ্যে প্রাচীন ও নবীন রীতির সুসমন্বয় ঘটেছে। বাংলা টপ্পা পরবর্তীকালের গীতিকবিদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল রায়, অতুলপ্রসাদ ও নজরুলের রচনায় টপ্পার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

উনিশ শতকে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রাহ্মধর্মের উপাসনার অঙ্গ হিসেবে ব্রহ্মসঙ্গীতের উদ্ভব ঘটে। এর স্রষ্টা  রামমোহন রায়।  ব্রহ্মসঙ্গীত হচ্ছে পৌত্তলিকতাবিরোধী এবং একেশ্বরবাদী অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উদ্দেশে নিবেদিত ভক্তিমূলক রাগসঙ্গীত। প্রথমদিকে টপ্পা ও  খেয়াল আঙ্গিকে ব্রহ্মসঙ্গীত রচিত হয়েছে। পরে বিষ্ণু চক্রবর্তী ও কৃষ্ণপ্রসাদ চক্রবর্তীর প্রভাবে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় ধ্রুপদ আঙ্গিক ব্যবহূত হতে থাকে। ধ্রুপদের ভাবগাম্ভীর্য এবং শান্তরসের আবেদন উপাসনার উপযোগী। তাই পরবর্তী ব্রহ্মসঙ্গীতগুলি ধ্রুপদ আঙ্গিকেই রচিত হয়েছে। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন। ব্রহ্মসঙ্গীতের এই ধারা আধুনিক গীতিকবিদের রচনাকে প্রভাবিত করেছে এবং বাংলা সঙ্গীতকেও সমৃদ্ধ করেছে।

উনিশ শতকে জাতীয় চেতনার পুনরুন্মেষ তথা স্বাজাত্যপ্রীতির তাগিদে ঐতিহ্যানুশীলনের প্রবণতা দেখা দেয়। লোকসংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় এ কথা তখন উপলব্ধ হয়। তাই ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লুপ্তপ্রায় লোকসঙ্গীতের প্রতি  সংবাদ প্রভাকর এর মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলার প্রাচীন সঙ্গীত সংগ্রহ ও প্রকাশ করে তিনি আলোচনার সূত্রপাত করেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে রবীন্দ্রনাথ,  মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, জসীমউদ্দীন,  ক্ষিতিমোহন সেনদীনেশচন্দ্র সেনচন্দ্রকুমার দে প্রমুখ এ বিষয়ে সচেতন প্রয়াস চালান। তাঁদের প্রচেষ্টার ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয় বাউল,  ভাটিয়ালি, সারি, জারি, মারফতি,  মুর্শিদি প্রভৃতি  লোকসঙ্গীত। ভাবে, ভাষায় ও সুরে বৈচিত্র্যময় এই সঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ। বর্তমানে বাংলা সঙ্গীতে বৈচিত্র্যের যে সমাবেশ ঘটেছে, তাতে রাগসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত ও কাব্যসঙ্গীতের সীমা চিহ্নিত হয় উনিশ শতকের শেষপর্ব পর্যন্ত। পরে নাগরিক সভ্যতায় আধুনিক জীবনধারা-উপযোগী আধুনিক সঙ্গীতের সূত্রপাত হয়।

বাংলা সঙ্গীত জগতে সুর ও বাণীমাধুর্যে এখনও শ্রেষ্ঠ যাঁদের গান তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুল। প্রায় সমকালীন এই পঞ্চ গীতিকবির গান যেমন সমকালে, তেমনি পরবর্তীকালেও বাংলা সঙ্গীতকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করছে।

সুরের আবেদন সর্বজনীন হলেও বাংলা গানের ক্ষেত্রে কথার গুরুত্ব অপরিসীম। পঞ্চকবির গানে সুরের সঙ্গে কথার সার্থক মিলন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে গীতিকার ও সুরকার। তাই তাঁর গানে কথা ও সুর মিলেমিশে এক সুসংহত রূপ নিয়েছে। সমকালীন ও পরবর্তীকালীন গীতিকবিরা এই আদর্শ অনুসরণ করলেও এই পঞ্চ গীতিকারদের গান স্বতন্ত্র মহিমায় প্রোজ্জ্বল। শ্রোতার বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনটি কার গান। এই পঞ্চ গীতিকার বাংলাসঙ্গীতে রাগসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিলন ঘটিয়েছেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের যে গানগুলি সমধিক পরিচিত ও জননন্দিত সেগুলি তিনি রচনা করেছিলেন নাটকের প্রয়োজনে। তিনি বিচিত্রধর্মী গান রচনা করলেও পেশাদারি মঞ্চের প্রয়োজনেই বেশি গান রচনা করেছেন। দেশাত্মবোধক এবং প্রেম-প্রকৃতি ও হাসির গান রচনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মঞ্চনাটকের গানের মতো তাঁর অন্যান্য গানও সমান আবেদনশীল।

অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে মফস্বলে থেকে গান রচনা করেছেন রজনীকান্ত সেন, যা  রজনীকান্তের গান বা কান্তগীতি নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর গানে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের সংকল্প, স্বাজাত্যপ্রীতি, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। কান্তগীতির অপর একটি উলে­খযোগ্য দিক হলো ভক্তিরসের আবেদন এবং স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদন।

অতুলপ্রসাদ সেন প্রধানত প্রবাসে থেকেই গীত রচনা করেছেন। রাগ-রাগিণীর সঙ্গে প্রাচীন সুর তথা বাউল-কীর্তন সুরের সংমিশ্রণে এক গভীর আর্তিময় আবেদন জাগিয়ে তুলেছেন অতুলপ্রসাদ। আধুনিক সঙ্গীতে নজরুলই প্রথম রবীন্দ্রোত্তীর্ণ অনুষঙ্গ নিয়ে আসেন। ভাব ও সুরের দিক থেকে ভিন্ন রকম তাঁর রচনা। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুলের অন্যতম প্রধান অবদান উৎকৃষ্ট মানের  গজল। নর-নারীর প্রণয়ভিত্তিক গজল রচনা করে তিনি আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন। অতুলপ্রসাদও বাংলা গজলের রূপ নির্মাণ করেছেন, কিন্তু তার সার্থক রূপকার নজরুল। বাংলা গানে প্রেম, প্রকৃতি, চাঁদ, ফুল, মালা, সমাধি ইত্যাদির অনুষঙ্গ নজরুলই প্রথম প্রয়োগ করেন, যা পরবর্তী গীতিকারগণ অনুসরণ করেছেন এবং এখনও তারই অনুরণন লক্ষ করা যায় বর্তমান আধুনিক বাংলা গানে। নজরুল কর্তৃক বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর স্বচ্ছন্দ ব্যবহার, লোকসুরের প্রয়োগ এবং আরবি-ফার্সি শব্দের যথার্থ ব্যবহার বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নজরুল প্রধানত গান রচনা করেছেন গ্রামোফোন কোম্পানি এবং চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে।  নজরুলসঙ্গীত এর ভাব-ভাষা-সুরে এমন এক অসাধারণত্ব আছে যার প্রভাবে বিংশ শতাব্দীর তিরিশ-চলি­শ দশকে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। প্রখ্যাত শিল্পীদের কণ্ঠে ধারণকৃত রেকর্ড এবং চলচ্চিত্র এই জনপ্রিয়তা অর্জনে সহায়তা করে। নজরুলসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে উলে­যোগ্য কয়েকজন হলেন  দিলীপকুমার রায়, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী,  শচীন দেববর্মণ, কানন দেবী, আঙুর বালা, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মৈত্র, আবদুল হালিম চৌধুরী, ফিরোজা বেগম, সুধীন দাশ প্রমুখ।

নজরুলের সময় থেকে আধুনিক বাংলা গানে এক মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সময় থেকেই লক্ষ করা যায়, বাংলা আধুনিক গানে গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী ভিন্ন ভিন্ন। এতে বাংলা গানের প্রাণ কথা ও সুরের যে অপূর্ব সমন্বয় তা অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নজরুলের সমসাময়িক বা পরবর্তী গীতিকাররা মূলত এই ধারাকেই অনুসরণ করে গীত রচনা করেন, যা এখনও অনুসৃত হচ্ছে। নজরুলের সমকালীন চারজন বিখ্যাত গীতিকার হলেন সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬), হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩), দিলীপকুমার রায় এবং  তুলসী লাহিড়ী। বাংলা গানের জগতে দিলীপকুমারের আবির্ভাব সম্ভাবনাময় হলেও অচিরেই তিনি এ মার্গ ছেড়ে সাধনমার্গে চলে যান।

তুলসী লাহিড়ীর অনেক গান নজরুলগীতিরূপে প্রচলিত ও প্রচারিত হলেও স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। সৌরিন্দ্রমোহনের গানে রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ করা যায়। হেমেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন নৃত্য-গীত-অভিনয়ে দক্ষ। তাঁর বেশকিছু গান পেশাদারি মঞ্চে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এ সময় নজরুলের গানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন কোম্পানির সৌজন্যে বাংলা গান জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়। তখন রেকর্ডের গান শোনার জন্য এক নতুন শ্রোতৃমন্ডলী গড়ে ওঠে। ফলে আধুনিক বাংলা গানের বিকাশ ও সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শ্রোতৃমন্ডলীর চাহিদা অনুযায়ী রেকর্ড কোম্পানি নতুন নতুন গান প্রকাশ করতে উৎসাহী হয় এবং এজন্য প্রয়োজন দেখা দেয় অনেক গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর। এ সময়কার কয়েকজন উলে­খযোগ্য গীতিকার হলেন সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২), হীরেন বসু, শৈলেন রায় (১৯০৫-১৯৬৩), অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩), বাণীকুমার (১৯০৭-১৯৭৪), সুবোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-১৯৮৪), অনিল ভট্টাচার্য (১৯০৮-১৯৪৪), প্রণব রায় (১৯১১-১৯৭৫), প্রেমেন্দ্র মিত্র, নিশিকান্ত, শ্যামল গুপ্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-১৯৮৬) প্রমুখ। এ সময়কার কয়েকজন সুরকার-গীতিকার তথা সঙ্গীতশিল্পী হলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১-১৯৭৭), হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২- ?); বিনয় রায় (১৯১৮-১৯৭৫), সুকৃতি সেন, সলিল চৌধুরী (১৯২৩-১৯৯৪), অমল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের রচিত গান সমকালে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে এবং সফলতা লাভ করেছে। এই সফলতার কারণ, গীতিকাররা যেমন ছিলেন লিরিকধর্মে (কাব্যধর্মিতায়) আস্থাবান, তেমনি সুরকাররাও ছিলেন প্রতিভাবান। তখনকার সুরকারদের মধ্যে বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য হলেন  হিমাংশুকুমার দত্ত, দিলীপকুমার রায়,  কমল দাশগুপত, অনুপম ঘটক, সুবল দাসগুপ্ত প্রমুখ। সে সময়ে আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয়তা ও সমৃদ্ধি অর্জনে যেসব সঙ্গীতশিল্পীর অবদান বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য দিলীপকুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কানন দেবী, কে মল্লিক, (কাসেম মল্লিক), কে.এ সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, শৈল দেবী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মণ, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, উমা বসু, আববাসউদ্দীন, সন্তোষ সেনগুপ্ত, ফিরোজা বেগম প্রমুখ।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, সে উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বাউলসুরে রচনা করেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, দ্বিজেন্দ্রলাল লেখেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, রজনীকান্ত আহবান জানান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ মাথায় তুলে নিতে, অতুল প্রসাদ লেখেন ‘বলো বলো বলো সবে’, আর ছিল নজরুলের অগ্নিবীণাঝংকৃত কবিতা ও গান। নজরুলের ‘এই শিকল পরা ছল মোদের, এই শিকল পরা ছল’ গানটি এ সময় স্বদেশীদের মধ্যে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। চারণ কবি মুকুন্দ দাসের (১৮৭৮-১৯৩৪) ‘দেশের গান’, ‘মাতৃপূজা’ প্রভৃতি যাত্রাপালা গ্রাম-গ্রামান্তরে স্বদেশমন্ত্রে এবং ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে বাংলার মানুষকে। পরবর্তীকালে ৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই গানগুলি হয়ে ওঠে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। এ সময়  মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত হয় পর্যাপ্ত সংখ্যক উদ্দীপনা ও দেশপ্রেমের গান। বাংলা সঙ্গীতে এই গানগুলি এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে, যা পরে পরিচিতি পায় ‘দেশের গান’ বা ‘দেশাত্মবোধক গান’ হিসেবে।

১৯৪৭-পরবর্তী বাংলাদেশে রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত-চর্চা ক্রমশ ব্যাপকতা লাভ করে এবং চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে শিল্পীরা গ্রামোফোনে  আধুনিক গান রেকর্ড করতে থাকেন। এ সময়কার উলে­খযোগ্য গীতিকার-সুরকাররা হলেন  আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান,  খান আতাউর রহমান, দেবু ভট্টাচার্য,  সমর দাস, আবদুল আহাদ প্রমুখ।

১৯৫২-র  ভাষা আন্দোলন ও  একুশে ফেব্রুয়ারি র ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিগণ রচনা করেন অসংখ্য কবিতা, গান, শোকগাঁথা ও বীরত্বগাঁথা। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে মিশে আছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ও শহীদ  আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত সেই বিখ্যাত গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ লোককবি-পল­ীকবিরা গান বাঁধেন ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি।’ শিল্পী আবদুল লতিফ রচনা করেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি। গণসঙ্গীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান তাঁর ‘মিলিত প্রাণের কলরবে, যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’ গান দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা-শহীদদের স্মরণে রচিত এসব গান পরিচিত হয় ‘দেশ ও ভাষার গান’ নামে। বাঙালিরা এখনও এই দেশের গান ও ভাষার গানের ভেতর দিয়ে দেশমাতৃকা ও ভাষাশহীদদের প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।

দেশিসঙ্গীতের আদর্শে বিকশিত বাংলা সঙ্গীতের সঙ্গে নানা সময়ে রাগসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিলন ঘটলেও বাংলা গান সর্বদা কথা ও সুরের যুগল মিলনের একরৈখিক ধারায় বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে। বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে শিক্ষার প্রচার-প্রসার এবং রাগসঙ্গীত চর্চার বিকাশে বাংলা সঙ্গীত নবনব রূপে, বিষয়বৈচিত্র্যে আর সুরবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সে ধারা এখনও অব্যাহত। বিশ শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে; কিন্তু সঙ্গীতের গুণগত মানে তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।  [মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী]

গ্রন্থপঞ্জি  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৯০৭; আহমদ শরীফ, বিচিত চিন্তা, চৌধুরী পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৭৫; দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, বাঙ্গালীর রাগসঙ্গীত চর্চা, ফার্মা কে.এল.এম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৭৬; রাজ্যেশ্বর মিত্র, বাংলা সঙ্গীত (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৮৪; সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের সন্ধানে, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯০; করুণাময় গোস্বামী, বাংলা গানের বিবর্তন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩; মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, বাংলা গানের ধারা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩।