ব্রহ্মসঙ্গীত

ব্রহ্মসঙ্গীত ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সঙ্গীত। ব্রাহ্মধর্মের প্রবতর্ক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) এর রূপকার। সঙ্গীতপ্রিয় রামমোহন বুঝতে পেরেছিলেন যে,  সঙ্গীত মানবমনের সাধারণ স্তর পার হয়ে গভীর অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম। তাই ধর্মের কঠিন তত্ত্বালোচনায় সঙ্গীতের নান্দনিকতা ব্যবহার করে তিনি ব্রাহ্মধর্মের বিকাশ সাধনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। উনিশ শতকের প্রথমভাগে হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধন করে একেশ্বরবাদিতার যে আদর্শ প্রচারে তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের সহায়ক শক্তি ছিল এই ব্রহ্মসঙ্গীত। তৎকালীন কলকাতার নগরসভ্যতায় ব্রহ্মসঙ্গীতের উদ্ভাবন ছিল রামমোহনের একটি সঙ্গীতসংস্কারমূলক পদক্ষেপ। আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত আদর্শে পরিপুষ্ট এই ব্রহ্মসঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

রামমোহন কর্তৃক ১৮১৫ সালে  আত্মীয় সভা গঠন এবং ১৮২৮ সালে নিজগৃহে  ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত চর্চার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উপাসনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মসমাজের প্রারম্ভিক ও সমাপ্তি অনুষ্ঠানে এই ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশিত হতো। ব্রাহ্মসমাজের দুই প্রধান গায়ক  কালী মির্জা (১৭৫০-১৮২০) ও বিষ্ণু চক্রবর্তী ছিলেন যথাক্রমে টপ্পাবিশারদ ও ধ্রুপদশিল্পী। তাই ব্রহ্মসঙ্গীতের সুরে টপ্পার অলঙ্কার ও ধ্রুপদের প্রাধান্য দেখা যায়।

রামমোহন নিজে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করে সুর দিয়ে গাইতেন। ব্রহ্মসঙ্গীত নামক গ্রন্থে তাঁর রচিত ৪৪টি গান সঙ্কলিত হয়েছে। তিনি তাঁর গানে ধ্রুপদ বন্দিশের বিন্যাস-কাঠামোয় স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগের আদল ব্যবহার করেছেন, যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সঙ্গীত রচয়িতাদের রচনায় সঞ্চারিত হয়েছে। ইমনকল্যাণ রাগে রচিত রামমোহনের একটি বিখ্যাত গান হলো: ভাব সে ঐ একে/ জলে স্থলে শূন্যে যে সমানভাবে থাকে। যে রচিল এ সংসার আদি অন্ত নাহি যার/ সে জানে সকল, কেহ নাহি জানে তাকে\

ব্রাহ্মধর্মে উপাসনার সময় সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্রহ্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়। প্রথমে সমবেত কণ্ঠে আরাধনাসঙ্গীত, পরে ব্রহ্মস্বরূপ আবৃত্তি, ধ্যান ও শেষে প্রার্থনাসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। অতএব ব্রহ্মসঙ্গীত ব্রাহ্মধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

রাগাশ্রয়ী কাব্যসঙ্গীতের অনুসরণে ব্রহ্মসঙ্গীত চর্চার যে ধারা রামমোহন শুরু করেছিলেন,  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) সেই ধারাকে তৎকালীন সঙ্গীতাচার্য বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদু ভট্টাচার্য, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মিত্র, রামগতি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সহায়তায় পরিমার্জিত ও পরিশীলিত সঙ্গীতধারায় রূপান্তরিত করেন। দেবেন্দ্রনাথ রচিত একটি ব্রহ্মসঙ্গীত হলো: ভাব তাঁরে অন্তরে যে বিরাজে/ অন্য কথা ছাড় না। সংসার সঙ্কটে, ত্রাণ নাহি কোন মতে/ বিনা তাঁর সাধনা\

তত্ত্বগত মতবিরোধের কারণে ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্মসমাজ আদি ও নববিধান নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেও ব্রহ্মসঙ্গীতের চর্চা দুই শাখায়ই সমানভাবে চলতে থাকে। তবে উভয়ের সাঙ্গীতিক ঢঙে পার্থক্য সূচিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ পরিচালিত আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীত ছিল ধ্রুপদাশ্রয়ী। ব্রাহ্মমন্দিরের গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদু ভট্টাচার্য, রাধিকাপ্রসাদ প্রমুখের প্রতিভাগুণে ব্রহ্মসঙ্গীত এক অভিজাত সাঙ্গীতিক রূপ লাভ করে। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে  কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-১৮৯৬),  দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬),  সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩),  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫),  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল, অন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হরলাল রায়,  দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), সুন্দরীমোহন দাস, কিশোরীলাল রায়, প্রসন্ন মজুমদার,  রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০),  অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) প্রমুখ কবি ও সঙ্গীতকার ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় ব্রতী হন। আদি ব্রাহ্মসমাজের ধর্মীয় প্রভাব কলকাতার একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত থাকলেও তার সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা ছিল সমগ্র সুধীসমাজে বিস্তৃত। এর কারণ এই সঙ্গীতের বাণীতে ছিল আধ্যাত্মিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও দেশাত্মবোধক ব্যঞ্জনা এবং এর সুরে ছিল রাগাশ্রয়ী নির্মল সাঙ্গীতিক আবেদন। নববিধান ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বে ছিলেন  কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪)। তাঁর পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজের সাঙ্গীতিক আদর্শ ধ্রুপদ ঢঙের পাশাপাশি মূলত কীর্তন ঢঙে গড়ে ওঠে।

ব্রহ্মসঙ্গীতের সুরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ-রাগিণীর প্রয়োগরীতি অনুসৃত হলেও দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং সত্যেন্দ্রনাথ এতে নতুনত্ব আনয়নের জন্য নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। সত্যেন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীতে হিন্দি ভাঙ্গাগানের রীতি প্রবর্তন করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই ধারাকে বহুমুখী করে তোলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীতের জন্য প্রথম  স্বরলিপি উদ্ভাবন করেন, যা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কর্তৃক পরিমার্জিত হয়ে বাংলা গানের একমাত্র আকারমাত্রিক স্বরলিপি হিসেবে আজও প্রচলিত।

ব্রহ্মসঙ্গীত চর্চায় অগ্রজদের সকল প্রকার প্রয়াসের সার্থক পরিণতি ঘটে রবীন্দ্রনাথের হাতে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সঙ্গীতরচনার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্রহ্মসঙ্গীত। তাঁর রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের বিষয়বস্ত্ত আধ্যাত্মিকতার গন্ডি অতিক্রম করে মঙ্গলবোধ, সৌন্দর্যচেতনা এবং দেশাত্মবোধক আবেদনের মহিমায় উজ্জ্বল। কালের প্রবাহে সমাজে ব্রাহ্মধর্মের আবেদন ক্ষীয়মাণ হলেও ব্রহ্মসঙ্গীত রবীন্দ্রপ্রতিভার দ্বারা বিকশিত হয়ে আজও সজীব। রামমোহন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ এবং রজনীকান্ত রচিত কিছু কিছু ব্রহ্মসঙ্গীত বর্তমানে ভারতের কোনো কোনো মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্রহ্মসঙ্গীতের অস্তিত্ব মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ রচিত একটি ব্রহ্মসঙ্গীতের কয়েকটি পংক্তি এরূপ: আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম/ আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি\ রবি যায় অস্তাচলে অাঁধারে ঢাকে ধরণী/ করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী\

ব্রহ্মসঙ্গীতে  বেদান্ত বা উপনিষদের অদ্বৈতবাদ এবং খ্রিস্ট ও  ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের সুসমন্বয় ঘটেছে। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক কাঠামোয় বিন্যস্ত ব্রাহ্মধর্ম ছিল সেকালে অত্যন্ত প্রগতিমুখী একটি ধর্মদর্শন। ধর্মীয় ও সাঙ্গীতিক সংস্কারমূলক অভিপ্রায় থেকে উদ্ভাবিত ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রহ্মসঙ্গীত পরবর্তীকালে মানবিক চেতনা ও জাতীয় চেতনার লালন ও পরিশীলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রহ্মসঙ্গীতের এই উদার আদর্শের কারণে তখন হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি সব ধর্মের লোকই উপাসনায় অংশ নিতেন এবং ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন। বাংলা গানের বিবর্তনের ধারায় ব্রহ্মসঙ্গীতের উদ্ভব ও বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ফলে বাংলা সঙ্গীতজগতে গড়ে উঠেছে এক রুচিশীল সঙ্গীতসমাজ। [খান মোঃ সাঈদ]

গ্রন্থপঞ্জি  অরুণ কুমার বসু, বাংলা কাব্যসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৯৭৮; অধীর বাক্চী, বাংলাগান: এগারোশো বারোশো শতক, আনন্দ পাবলিশার্স লি:, কলকাতা, ১৯৮৮; সুধীর চক্রবর্তী, বাংলাগানের সন্ধানে, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯০; করুণাময় গোস্বামী, বাংলাগানের বিবর্তন, প্রথম খন্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩।