ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ (১৮৪৯-১৯২৫)  নাট্যকার, গীতিকার, সংগীতজ্ঞ, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী ও সংগঠক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১৮৪৯ সালের ৪ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চমপুত্র এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে এফএ শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু ডিগ্রি নেওয়া হয়নি তাঁর।

১৯৬৮ সালে কলকাতার শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় মেয়ে কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশেষ স্নেহসান্নিধ্য লাভ করেন। ‘নষ্টনীড়’ গল্পের চারুলতা-অমল চরিত্রে এ সম্পর্কের ছাপ আছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। ১৯৬৭ সালে কলকাতায়  প্রথম ‘হিন্দুমেলা’র আয়োজন করা হলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ উপলক্ষে ‘উদ্বোধন’ নামে একটি জাতীয়তামূলক কবিতা রচনা করেন। তিনি হিন্দুমেলার ‘সংশ্লিষ্ট সম্পাদকে’র দায়িত্বও পালন করেন। তিনি স্বদেশপ্রেমে ও জাতীয়তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একে একে ‘ব্রাহ্মধর্মবোধিনী সভা’ (১৮৭২), ‘সারস্বত সমাজ’ (ওই), ‘আদি ব্রাহ্মণসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়’ (১৮৭৫), ‘সঞ্জীবনী সভা’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য তিনি পিতার উৎসাহে পাট, নীল ও স্টিমারের ব্যবসায় পরিচালনা করেন, তবে কোনোটিতেই প্রত্যাশিত সফলতা আসেনি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয় নাটক-প্রহসন রচনার মাধ্যমে। কিঞ্চিৎ জলযোগ (প্রহসন, ১৮৭২), পুরুবিক্রম নাটক (১৮৭৪), সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক (১৮৭৫), অশ্রুমতি নাটক (১৮৭৯), স্বপ্নময়ী নাটক (১৮৮২), হঠাৎ নবাব (প্রহসন, ১৮৮৪), অলীক বাবু (প্রহসন, ১৯০০) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। স্বপ্নময়ী (১৮৮০), বসন্তলীলা (১৯০০), ধ্যানভঙ্গ (ওই) নামে গীতিনাট্য রচনা করেন। তাঁর অধিকাংশ নাটক জোড়াসাঁকো ও কলকাতার নাট্যশালায় একাধিকবার অভিনীত হয়।

ভারত-ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত নাটকগুলির প্রধান উপজীব্য ছিল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। প্রহসনে সমাজের নানা সমস্যার প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল। তিনি মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি সংস্কৃত, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার বহু সংখ্যক নাটক বাংলা অনুবাদ করেন।

নাটকের অনুরূপ সংগীতেও তাঁর সমান কৃতিত্ব ছিল। তিনি সংগীত রচনা, সুরারোপ ও স্বরলিপি প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত শিল্পী হিসেবেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তাঁর স্বরলিপি গীতিমালা (১৮৯৭) একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তরুণ বয়সে সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রবীণ বয়সে বীণাবাদিনী (১৮৯৭) এবং সঙ্গীত প্রকাশিকা (১৯০১) নামে সংগীতবিষয়ক দুখানি পত্রিকা প্রকাশ করে তিনি শুধু সংগীতানুরাগের পরিচয় দেননি, একজন সফল সংগীত-সংগঠকের ভূমিকাও পালন করেছেন। তিনি ‘ভারত সংগীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে সংগীতচর্চাকে উৎসাহিত করেন। তিনি সেতার, পিয়ানো ও বেহালা বাদনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি পিয়ানো ও বেহালায় নতুন নতুন সুর তুলতেন, আর রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী, স্বর্ণকুমারী প্রমুখ তাতে বাণী বসিয়ে গান রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গীতবিষয়ক অবদানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন।

সঙ্গীত রচনায় এবং কবিতার ছন্দ ও গানের সুর সম্পর্কে বালক রবীন্দ্রনাথকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথই সচেতন করে তোলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিচারণ করেন। ভারতীয় রাগসংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতরীতি প্রয়োগের মিলন-প্রয়াসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অগ্রদূত ছিলেন। তিনি ব্রহ্মসংগীত, স্বদেশসংগীত, প্রণয়গীতি প্রভৃতি শ্রেণীর গান রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঠাকুর-পরিবারে ব্রহ্মধর্মের প্রভাব ছিল; দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মোপসনা করতেন। ব্রহ্মসংগীত ব্রহ্মোপসনার অঙ্গ ছিল। পারিবারিক ধর্মানুভূতি থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্রহ্মসংগীত রচনার প্রেরণা লাভ করেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক প্রকাশিত ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি গ্রন্থমালায় (১-৬ খন্ড) তাঁর রচিত ৬১টি সংগীত সংকলিত হয়েছে। তিনি ১৮৭৬ সালে জাতীয় সংগীত নামে দেশাত্মবোধক একটি গীতসঙ্কলন প্রকাশ করেন; এতে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথসহ তাঁর নিজের রচিত গান স্থান পায়। এর পরবর্তী সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি আকারমাত্রিক বাংলা স্বরলিপির প্রচলন করে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন। স্বরলিপিগীতিমালা গ্রন্থে ১৬৮টি গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে; এগুলির মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ছিল ৬৮টি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার একটি অন্যতম দিক হলো চিত্রশিল্প। মানুষের প্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি পারদর্শী ছিলেন। ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ রাঁচিতে তাঁর মৃত্যু হয়। [ওয়াকিল আহমদ]