আধুনিক গান
আধুনিক গান প্রগতিশীল চিন্তাপ্রসূত যুগদাবি অনুযায়ী রচিত গান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সুরুচিসম্মত ভাব, ভাষা ও আধুনিক সুর-তাল সমন্বয়ে এর উৎপত্তি। আঠারো শতকের শেষভাগে নিধু গুপ্তের টপ্পা গানের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা গানের সূচনা হয়। সূচনালগ্নে নরনারীর প্রেমবিরহের কাহিনী ছিল এর মুখ্য বিষয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ‘ভাবগীতি’ ও ‘কাব্যগীতি’ নামে নতুন বাংলা গান প্রচারিত হতো। এ কাব্যগীতিই মূলত আধুনিক গান। আধুনিক গান নামে এ গান প্রথম প্রচারিত হয় বিভাগোত্তর পূর্ববাংলার ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকেও তখন নতুন আঙ্গিকে রচিত ও গীত কিছু গানকে আধুনিক গান হিসেবে বিশেষায়িত করা হতো।
আধুনিক গান কাব্যসঙ্গীত (lyric song) নামেও পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন সাপেক্ষে দিলীপকুমার রায় প্রথম এ অভিধা ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান, অতুলপ্রসাদের গান এবং নজরুলসঙ্গীতসহ আধুনিক কালের বহু গীতিকার ও সুরকারের নিরীক্ষাধর্মী গানগুলি কাব্যসঙ্গীত নামে পরিচিত।
আধুনিক গানে কবিতার পরিসর থাকে সংক্ষিপ্ত বা নির্দিষ্ট। এর সুরে প্রকাশ পায় যুগোপযোগী ছন্দোবদ্ধ ও ভাবপূর্ণ গীতিরূপ। কলার ভাব ও সুরের ভাবের সমন্বয়করণ আধুনিক গানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো কথার ভাবকে পেছনে ফেলে সুরের বিস্তার আধুনিক গানে প্রকাশ পায় না।
আধুনিক গান কথাশিল্প ও সুরশিল্পের সমন্বয়ে এক অপরূপ সৃষ্টি। হিন্দুস্থানি গানের মতো বাংলা গানে সুরের প্রাধান্য থাকে না, থাকে কাব্যের প্রাধান্য; সুর তাকে ব্যঞ্জিত ও রসময় করে তোলে। বাংলার নিজস্ব সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলে এ বৈশিষ্ট্য নিয়ে নতুন ভাব ও ভাবনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আধুনিক গানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাপী যেসব যুদ্ধ ও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার ফলে বৈশ্বিক সমাজে এসেছে নানারকম পরিবর্তন, যার প্রতিফলন ঘটেছে সমকালীন শিল্প-সংস্কৃতিতে। সঙ্গীত যেহেতু শিল্প-সংস্কৃতিরই অঙ্গ, সেহেতু এতে সমাজ ও ব্যক্তি-মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব ছবি প্রতিফলিত হয়। তাই পরিবর্তিত জীবনধারার নব নব অভিজ্ঞতা, আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে নতুন আঙ্গিকে যেসব সঙ্গীত রচিত হতে থাকে তা-ই আধুনিক গান। দেশি, বিদেশি ও আঞ্চলিক সুরের মিশ্রণে নিত্যনতুন সুরসৃষ্টি, পরিমিত বাক্যবিন্যাস দ্বারা বিষয় উপস্থাপন এবং দেশিবিদেশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
একটি সার্থক আধুনিক গানের লক্ষণীয় দিকগুলি হচ্ছে স্বর-গ্রন্থনার উপায় উদ্ভাবন, পরীক্ষণ ও নিরীক্ষণ; বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রীতির সঙ্গীত থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান আত্মস্থকরণ; সুরসংযোজনায় নানা ব্যঞ্জনা, ইঙ্গিত ও বিস্ময় সৃষ্টির কৌশল উদ্ভাবন; একঘেয়েমি দূর করে ভাবানুগ বিভিন্ন সুর সৃজন; ছন্দে বৈচিত্র্য সাধন; গীত অনুযায়ী কণ্ঠ নির্বাচন অথবা কণ্ঠ অনুযায়ী সুর সংযোজন এবং যন্ত্রসঙ্গীত সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা। আধুনিক সঙ্গীতের এসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেই এ যুগের সঙ্গীতকারগণ সঙ্গীত রচনায় প্রয়াসী হন।
বাংলা গানের ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রথম যুগের আধুনিক গানের নির্মাণশিল্পী হিসেবে নিধুবাবু, কালিদাস চট্টোপাধ্যায় বা কালী মীর্জা, রঘুনাথ রায়, শ্রীধর কথক প্রমুখের নাম পাওয়া যায়। হিন্দুস্থানি রাগসঙ্গীত টপ্পার আদলে নিধুবাবু যে বাংলা টপ্পা রচনা করেন তাতে কাব্যগুণ বিচারে, সুরের নব রূপায়ণে এবং সমসাময়িক বাস্তব জগতের রীতিনীতিভিত্তিক বিষয়ের আঙ্গিকে আধুনিক গানের প্রারম্ভিক চিত্রটি পরিলক্ষিত হয়।
নিধুবাবুর বাংলা গান রচনার সময়কাল ছিল ব্রিটিশ কর্তৃক কলকাতা শহর নির্মাণের যুগ। তখন শহরকেন্দ্রিক সঙ্গীতসভার আয়োজনে, সঙ্গীত পরিবেশনে এবং সঙ্গীত রচনায় সংযোজিত হয়েছিল দেশিবিদেশি প্রভাব। সে সময় থেকেই বাংলা সাহিত্য তথা দেশিয় লোকজ শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের মিলনপর্বেরও সূত্রপাত হয়। সে অর্থে আধুনিক গানের গোড়াপত্তন কলকাতা শহরে।
ঔপনিবেশিক শাসনে জীবনধারণের তাগিদে গ্রামের মানুষকে কলকাতামুখী হতে হয়েছিল। সে সঙ্গে গ্রামীণ সংস্কৃতি, বিশেষ করে লোকসঙ্গীত, কীর্তন, কবিগান, যাত্রাগান, রামপ্রসাদী, পাঁচালি, খেউর প্রভৃতি গানের আমদানি হয় কলকাতায়। ইংরেজ শাসকদের ছত্রছায়ায় তৎকালীন সমাজে যে এক নব্য ধনিক শ্রেণির উন্মেষ ঘটে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার সঙ্গীতে গ্রামীণ সুর, ভাব ও ভাষার সঙ্গে উল্লিখিত নব্য ধনিক শ্রেণির শহুরে ভাব-ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের শালীনতাবর্জিত গানের উদ্ভব হয়। তার মধ্যে কবিগান, খেউর, ঢপকীর্তন, ঝুমুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ শিবপ্রসঙ্গে রচিত ভবানীর একটি ঝুমুর গান এখানে উল্লেখ করা যায়: ‘বাপ হয়ে জামাই এনেছে/ দোষ দিব কি পরকে। মোটা-সোটা ঢোলের মত/ যম নারে তার বলকে\ এমন এনেছে জামাই/ ভাঙ্গ ধুতরা নাইকো কামাই। পাকা দাড়ি ত্রিশূলধারী/ তা দেখে মন টলকে\’।
এ ধরনের গান আধুনিক বাংলা গানের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নয়, অর্থাৎ এগুলি বাংলা কাব্যসঙ্গীত নয়। বাংলা গানের এরূপ পরিবেশকে উপেক্ষা ও অতিক্রম করেই নিধুবাবু এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাধর সঙ্গীতকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আধুনিক বাংলা গান ভাব, ভাষা ও সুরে সমৃদ্ধ উচ্চমার্গের সুরুচিসম্পন্ন একটি সাঙ্গীতিক ধারা। এ গান কমলাকান্ত, নিধুবাবু, কালী মীর্জা,দাশরথি রায়, গোপাল উড়ে, শ্রীধর কথক থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুলে এসে পূর্ণতা লাভ করে। এঁদের গানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, যেমন নিধুবাবুর রচনা: ‘আমারি মনের দুঃখ চিরদিন মনে রহিল। ফুকারি কাঁদিতে নারি বিচ্ছেদে প্রাণ দহিল\’। এ ধারাপ্রবাহে রবীন্দ্রনাথের রচনা: ‘ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর/ মরমে লুকানো থাক মরমের ভার’। এ ছাড়া নিধুবাবু রচিত ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা।’। গানটি বাংলা ভাষাভাষীগণের নিজস্ব ভাষাপ্রীতির প্রথম উজ্জ্বল সাঙ্গীতিক স্বাক্ষর। এ সময়ের আধুনিক গানের আরও কিছু উদাহরণ, যেমন শ্রীধর কথকের গান: ‘তারে ভুলিব কেমনে/ আমি প্রাণ সঁপিয়াছি যারে আপন জেনে।’; গোপাল উড়ের গান: ‘ঐ দেখা যায় বাড়ী আমার/ চারদিকে মালঞ্চের বেড়া।’।
পরবর্তী পর্যায়ের কিছু গানের দৃষ্টান্ত, যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান: ‘সে কেন দেখা দিলরে/ না দেখা ছিল রে ভাল।’; রজনীকান্তের গান: ‘মধুর সে মুখখানি/ কখনও কি ভোলা যায়।’; অতুলপ্রসাদের গান: ‘তোমার নয়ন পাতে/ ঘুচিয়া গিয়াছে নিশা।’; নজরুলের গান: ‘এসো প্রিয়া আরো কাছে।’- এ গানগুলিতে নরনারীর প্রণয়ভিত্তিক যে ভাব ব্যক্ত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে আধুনিক গানের মর্ম উপলব্ধি করা যায় এবং সেসঙ্গে বিভিন্ন গীতিকারের রচনাশৈলীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও লক্ষ্য করা যায়।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কলকাতার নগরজীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল। তার ফলে তখনকার কলকাতায় এক নতুন সাঙ্গীতিক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞগণের মিলিত প্রয়াসে বাংলা সঙ্গীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাঁদের মধ্যে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সঙ্গীতের তত্ত্বগত বিষয়ে এঁদের অবদান সুদূরপ্রসারী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত আকারমাত্রিক পদ্ধতি বাংলা গানের জন্য একমাত্র প্রচলিত স্বরলিপি। তিনিই সর্বপ্রথম ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি জোড়াসাঁকো মঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্ন রচিত নব-নাটক-এর অভিনয় উপলক্ষে বাংলা রঙ্গমঞ্চে দেশিবিদেশি সুর সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রা সৃষ্টি করেন। বাংলা গানের আধুনিকীকরণে বিদেশি সুর ও বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজনসম্মত সংযোজন তখন থেকেই শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের গানে এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সার্থক প্রমাণ মেলে।
আধুনিক বাংলা গানের বিবর্তনের ধারায় তৎকালীন বাংলার ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে একটি সাঙ্গীতিক নবজাগরণের পথ প্রসারিত হয়েছিল। সে পথ ধরে রচিত হয়েছিল আধুনিক গীতশৈলীর রূপকার পঞ্চগীতিকবিদের (রবীন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র, রজনী, অতুল, নজরুল) যুগ। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একটি স্তম্ভস্বরূপ। সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার প্রয়োগে এবং নিত্যনতুন সাঙ্গীতিক রূপ উদ্ভাবনে তাঁর প্রজ্ঞা বাংলার সঙ্গীতজগৎকে ভাস্বর করে রেখেছে। তিনি ধ্রুপদের চারটি তুক- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ বেশির ভাগ গানে ব্যবহার করেছেন, যা পরবর্তীকালে আধুনিক গানের গঠনধারায় প্রযুক্ত হয়। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, বাউল, কীর্তন প্রভৃতি ধারা রবীন্দ্ররচনায় নবরূপ লাভ করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত মূলত মার্গসঙ্গীত ও দেশিসঙ্গীতের মিলনে এক অপূর্ব সঙ্গীতশিল্প, যা পরবর্তীকালে আধুনিক গানের পথকে সুদূরপ্রসারী করেছে।
রবীন্দ্রপ্রতিভায় প্রভাবিত হয়েও আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্থান করে নিয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ। পরে গানের কথা ও সুর রচনায় ভিন্ন মেজাজ ও ঢঙ তথা বিচিত্র নান্দনিক রসসম্ভারে আধুনিক বাংলা গানকে ঋদ্ধ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি এবং আকাশবাণী কলকাতার প্রচার মাধ্যমের জন্য যুগের চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর আধুনিক গান রচনা করেন। নজরুলের সমকালে আরো যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁরা হলেন সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখ। ১৯০৭ সালে গ্রামোফোন রেকর্ড, ১৯২৭ সালে আকাশবাণী কেন্দ্র এবং প্রায় একই সময়ে সবাক ছায়াছবির প্রবর্তন হওয়ায় আধুনিক গান জনগণের খুব কাছে পৌঁছে যায়।
নজরুল পরবর্তী আধুনিক বাংলা গানে যে অভিনবত্ব পরিলক্ষিত হয় তা হলো, একই গানের ভিন্ন ভিন্ন গীতিকার ও সুরকার। আগে যিনি গান রচনা করতেন সাধারণত তিনিই সুর দিয়ে তা গেয়ে শোনাতেন, কিংবা শিল্পীকে দিয়ে পরিবেশন করাতেন। কিন্তু নজরুলের পর থেকে এ ধারার পরিবর্তন ঘটে। তখন থেকে একজন গান লেখেন, অন্যজন সে-গানের সুর করেন। এতে সুবিধা হয় এ যে, সুরকার না হয়েও গান রচনা করা যায়, আবার গীতিকার না হয়েও সুর করা যায়। বর্তমানে আধুনিক গানের এটি একটি বিশেষ লক্ষণ।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আধুনিক বাংলা গানের কথা ও সুরের ভুবনে যে ভিন্ন ঢঙের অবতারণা করেন, তারই প্রতিফলন ঘটে পরবর্তীকালের গীতিকার ও সুরকারদের মধ্যে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে গীতিকার হিসেবে যাঁরা খ্যাতি লাভ করেন তাঁরা হলেন অজয় ভট্টাচার্য, হীরেন বসু, শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ, নিশিকান্ত, প্রণব রায় প্রমুখ। সুরকারদের মধ্যে যাঁরা প্রখ্যাত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন হিমাংশুকুমার দত্ত, দিলীপকুমার রায়, রাইচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানা কেষ্ট), সুধীরলাল চক্রবর্তী, অনিল বাগচী, কমল দাশগুপত, অনুপম ঘটক, সুবল দাশগুপ্ত, শচীনদেব বর্মণ প্রমুখ। সেকালের প্রখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে দিলীপকুমার রায়, কানন দেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, আঙ্গুর বালা, কে এল সায়গল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শৈল দেবী, শচীনদেব বর্মণ, হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্র-নজরুল যুগ পর্যন্ত আধুনিক গান রচনায় ঈশ্বরভক্তি, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ভাষা, নরনারীর প্রেম ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালের স্বল্পসংখ্যক গানে দেশাত্মবোধ তথা গণচেতনার প্রতিফলন ঘটলেও অধিকাংশ গানেই প্রেম-বিরহের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে একথা ঠিক যে, তখনকার গানের বাণী, সুর ও পরিবেশনে যে শৈল্পিক মৌলিকত্ব ছিল তা আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের আনন্দ দেয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক বাংলা গানের সুর ও পরিবেশনের অভিনবত্বে যাঁরা সুদূরপ্রসারী অবদান রাখেন তাঁরা হলেন সলিল চৌধুরী, গীতা দত্ত, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, ভূপেন হাজারিকা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কিশোরকুমার প্রমুখ।
১৯৪৭ সালে ভারতবিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন করে সঙ্গীতের চর্চা, প্রচার ও প্রসারের আয়োজন শুরু হয়। এ সময়ের আধুনিক গানের বাণী ও সুর রচনায় যাঁরা মৌলিকত্বের পরিচয় দেন তাঁদের মধ্যে তালিম হোসেন, ফররুখ আহমদ, সায়ীদ সিদ্দিকী, হাবীবুর রহমান, শামসুর রহমান, আজিজুর রহমান, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, খান আতাউর রহমান, সমর দাস, আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল লতিফ, আব্দুল হালিম চৌধুরী, আবুবকর খান, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, খন্দকার নুরুল আলম ও শেখ সাদী খানের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের রচিত বাণী ও সুরে পূর্ববর্তী আধুনিক বাংলা গানের ধারা অনুসৃত হলেও সাঙ্গীতিক চলনে ও গঠনে ভিন্ন স্বাদের অবতারণা সুস্পষ্ট। বিশেষ করে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত গণসংগ্রামের বিভিন্ন পর্বে যে-সব দেশাত্মবোধক গান, যেমন: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/ রক্ত লাল রক্ত লাল’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’ ইত্যাদি প্রজন্মান্তরের জন্য চির দীপ্তিমান হয়ে আছে। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সে সময় যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁরা হলেন মাহবুবা রহমান, আবুবকর খান, আনোয়ারউদ্দিন খান, মোঃ আবদুল জববার, মাহ্মুদুন্নবী, ফেরদৌসী রহমান, ফরিদা ইয়াসমীন, সৈয়দ আবদুল হাদী, আঞ্জুমান আরা বেগম, ফওজিয়া ইয়াসমীন, ইসমত আরা, শাহ্নাজ রহমতউল্লাহ্, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন প্রমুখ।
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক বাংলা গানের বিভিন্নমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের উন্নতি এবং বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এখন আধুনিক গানের সুরে এসেছে বৈচিত্র্য। বাংলা গানের মূল উৎস যে লোকগীতি তার সঙ্গে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরির মিশ্রণে আধুনিক গান নতুন নতুন রূপ লাভ করেছে। সুরকাররাও কখনও কখনও নির্দিষ্ট কোনো একটি রাগে অথবা মিশ্ররাগে গান রচনা করে চমৎকারিত্বের নিদর্শন রাখছেন।
বর্তমানে লোকগীতি, বাউল, কীর্তন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ইত্যাদি ধারার পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গান একটি ক্রমবিবর্তনশীল গীতধারা। এতে কথা, সুর, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এবং পরিবেশনায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অনুকরণ লক্ষ্য করা গেলেও যুগের দাবি অনুযায়ী ক্রমশই এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। [খান মোঃ সাঈদ]
গ্রন্থপঞ্জি দিলীপকুমার রায়, সাঙ্গীতিকী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৮; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্গীতচিন্তা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনা বিভাগ, কলকাতা, ১৯৬৬; সুকুমার রায়, বাংলা সঙ্গীতের রূপ, এ মুখার্জী অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লি:, কলকাতা, ১৯৬৯; সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের সন্ধানে, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯০; রাজেশ্বর মিত্র, সঙ্গীত মূল্যায়ন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসঙ্গীত একাডেমী, কলকাতা, ১৯৯২; মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, বাংলা গানের ধারা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা।