কবিগান
কবিগান এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক গান। দুটি দলে এ প্রতিযোগিতা হয়। দলের দলপতিকে বলে কবিয়াল বা সরকার। কবিয়ালের সঙ্গীদের নাম দোহার। যন্ত্রসঙ্গীতকারীদের মধ্যে ঢুলি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দল দুটি পর্যায়ক্রমে আসরে এসে গান পরিবেশন করে। এ গানের বেশ কয়েকটি অঙ্গ আছে, যেগুলি বিশেষ অনুক্রমে বিন্যস্ত, যেমন: ডাক, মালসি, সখীসংবাদ, কবি, কবির টপ্পা, পাঁচালি ও ধুয়া এবং জোটের পাল্লা। এগুলির মধ্যে মালসি, সখীসংবাদ ও কবি নামক গানগুলির গঠনশৈলী অভিন্ন। এসব গানের পদক্রম এরূপ: ধরণ, পাড়ন, ফুকার, মিশ, মুখ, প্যাঁচ, খোচ, অন্তরা, পরচিতান ও ছুট্টি। ডাক গান বন্দনামূলক এবং এগুলি লঘুসঙ্গীতের মতো। বাউল গানের সমতুল্য ধুয়া গানগুলিও প্রায় একই গঠনের, যা পাঁচালির ফাঁকে ফাঁকে পরিবেশিত হয়। পাঁচালি অংশে পয়ার ও ত্রিপদীতে কবিয়ালগণ ছড়া কাটেন। সবশেষে জোটের পাল্লা অংশে দু কবিয়াল কোনো একটা গানের সুরে ছড়া কাটতে কাটতে গান শেষ করেন। আঠারো শতক কবিগানের উদ্ভবকাল। বাংলাদেশের একাধিক লোকসঙ্গীতের সমন্বয়ে এ গানের সৃষ্টি হয়েছে।
কবিগান সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক তাৎপর্য অর্জন করে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায়। নবউত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কবিগান তখন বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সময় ও শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় এ গান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। গোঁজলা গুঁইকে বলা হয় কবিগানের আদি কবিয়াল। তাঁর আবির্ভাবকাল আঠারো শতকের প্রথমার্ধ। উনিশ শতকের কলকাতায় যে কয়জন কবিয়াল বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে হরু ঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪), নিতাই বৈরাগী (১৭৫১-১৮২১), রাম বসু (১৭৮৬-১৮২৮), ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিলগ্নে কলকাতায় কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। তবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এ গানের জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে। এ অঞ্চলে কবিগান নতুন কিছু বৈশিষ্ট্যও অর্জন করে। এ পর্বের কবিগানে বাংলাদেশের লোকসাধারণের কবিপ্রতিভা, সৃজনশীলতা এবং সঙ্গীতসাধনার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রতিভাধর কবিয়াল ছিলেন তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৭-১৯১৪)। বিশ শতকে সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকজন কবিয়াল হরিচরণ আচার্য (১৮৬১-১৯৪১), রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২-১৯৭৪), মানিকগঞ্জের রাধাবল্লভ সরকার, উপেন্দ্র সরকার, ভাসান সরকার, কুমুদ সরকার, অভয়চরণ সরকার, বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩-১৯৮৫), গুমানী দেওয়ান প্রমুখ। [স্বরোচিষ সরকার]