দেশাত্মবোধক গান
দেশাত্মবোধক গান দেশ ও জনগণের প্রতি নিবেদিত গান, যা স্বদেশী সঙ্গীত নামেও পরিচিত। জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ গান রচিত হয়। গানের বিষয় যখন হয় দেশ তখন তাকে বলা হয় দেশাত্মবোধক গান, আর জনগণ হলে তাকে বলা হয় গণসঙ্গীত। দেশাত্মবোধক গানের এ দুটি ধারা।
বাংলা দেশাত্মবোধক গানের সূচনা হয় উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গীতের মাধ্যমে। পরে উনিশ শতকের মধ্যভাগে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এর পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটে। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির ‘জাতীয় মেলা’ এবং ‘সঞ্জীবনী সভা’ ছিল এর লালন ক্ষেত্র। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সঙ্গীতের এ নতুন ধারা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এ সময় থেকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা সৃষ্টি এবং স্বাজাত্যবোধ জাগরিত করার জন্য একের পর এক দেশাত্মবোধক গান রচিত হতে থাকে। দেশের ঐশ্বর্য বর্ণনা এবং দেশের বীর নায়কদের বীরত্বগাথা এসব গানের বিষয়বস্ত্ত। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল, মুকুন্দদাস, ইকবাল, তালিম হোসেন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবি ও গীতিকার প্রচুর দেশপ্রেমমূলক গান রচনা করেন। দেশের কোনো সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশাত্মবোধক গান জনগণের মনে আশা ও শক্তি সঞ্চার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশাত্মবোধক গান দেশের সাধারণ জনগণ গেরিলা যোদ্ধা এবং রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে প্রবল শক্তি, সাহস ও আশার সঞ্চার করেছিল। এখনও এ শ্রেণির গান নতুন প্রজন্মকে দেশের অতীত ইতিহাস জানতে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে সহায়তা করছে।
বাংলা গণসঙ্গীতের সূচনা হয় ১৯৪৩ সালে গণনাট্যসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ সঙ্ঘের সাঙ্গীতিক কার্যক্রমের একটি বিশেষ ধারাই ছিল গণসঙ্গীত। বিনয়কৃষ্ণ রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখ তাঁদের অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে গণসঙ্গীতের এ নতুন ধারার যথার্থ ভিত্তিস্থাপন করেন এবং এ ধারাকে সম্প্রসারিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীত এবং রাবীন্দ্রিক ও পাশ্চাত্য সুরধারাকে গণসঙ্গীতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
গণসঙ্গীতের মুখ্য উদ্দেশ্য শ্রমজীবী মানুষকে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত ও সংগ্রামশীল হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার আদায়ের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জোগানো। বিশ শতকের মধ্যভাগে গণসঙ্গীতের দুটি বিশেষ চরিত্র লক্ষ করা যায়। এ সময় জাতীয় মুক্তি অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে এমন কিছু গান রচিত হয় যা ইংরেজ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির আন্দোলনে প্রচন্ড শক্তি জোগায়। সেসব গান শুনে দেশের মুক্তিকামী যোদ্ধারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হন। এর পাশাপাশি কিছুটা ভিন্ন ধরনের অনেক গান রচিত হয় যার বক্তব্য ছিল একটি শোষণহীন সমানাধিকারসম্পন্ন সমাজ গঠন করা। এ প্রসঙ্গে চারণ কবি মুকুন্দদাস এবং নজরুলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের দুজনের গানেই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার ধারণা প্রকাশ পায়। নজরুল যখন সৈনিক হিসেবে করাচি ব্যারাকে ছিলেন তখন তিনি রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা জেনেছিলেন। তাই তাঁর গানে বিশেষভাবে দেশের স্বাধীনতা এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে গণসঙ্গীতে আন্তর্জাতিক ধ্যান-ধারণা যুক্ত হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শোষিত মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি অকল্যাণকর প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করা এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে গণসঙ্গীত চর্চার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন এবং আছেন তাঁরা হলেন শেখ লুৎফর রহমান, আবদুল লতিফ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, রমেশ শীল, জাহেদুর রহিম প্রমুখ। [মোবারক হোসেন খান]