নজরুল সঙ্গীত
নজরুলসঙ্গীত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরারোপিত গান। আধুনিক বাংলা গানের পঞ্চ প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ (১৮৭১-১৯৩৪) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যে এ পঞ্চরত্ন আধুনিক বাংলা গানকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ; তাঁরা ছিলেন একাধারে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। গানের ক্ষেত্রে তাঁরা আবার একই সঙ্গে গীতিকার ও সুরকার।
বাংলা গানের আদি ও মৌলিক সুর হচ্ছে লোকসুর। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা গান লোকসুরভিত্তিক। কীর্তন, বাউল, শ্যামাসঙ্গীত, ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া বাংলার প্রধান প্রধান লোকসুরের নিদর্শন। বাংলা গানে রাগের ব্যবহার স্বতঃস্ফূর্ত নয়, আরোপিত; বাংলার বাইরে থেকে আগত এবং নগরকেন্দ্রিক। আধুনিক বাংলা গানের বিকাশ যেহেতু কলকাতা নগরভিত্তিক, সে কারণেই এ গানে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন রাগাশ্রয়ী সুরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে লোকসুর কোনো সময় উপেক্ষিত হয়নি। শুধু উত্তর বা পশ্চিম ভারতের নয়, উপমহাদেশের বাইরের সুরও আধুনিক বাংলা গানে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য গৃহীত হয়েছে। আধুনিক বাংলা গানের বিষয়, সুর ও আঙ্গিকের যে বৈচিত্র্য, তা বাংলার ভেতর ও বাইরের উপাদানের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। নজরুলসঙ্গীত হচ্ছে বাংলা গানের অণুবিশ্ব; এতে বাংলা সঙ্গীতের সমস্ত ধারার মিলন ঘটেছে।
নজরুলের কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও শিল্পিজীবনের সূত্রপাত লেটোদল থেকে; এখানেই তাঁর কবিতা, গান ও নাটক রচনার শুরু; হিন্দুপুরাণ ও রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ঘটে এ লেটো দলেই। ত্রিশাল-দরিরামপুর স্কুলজীবনে নজরুল ময়মনসিংহ অঞ্চলের তথা পূর্ববাংলার লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হন। সৈনিকজীবনে সামরিক ব্যান্ডের দৌলতে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও ফারসি কবিতার সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে গজলের রসবোদ্ধা হন। নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে প্রবেশ করেন কলকাতায় বিশের দশকের শুরুতে এবং নিয়মিত গান রচনা শুরু করেন ১৯২৪ সাল থেকে অসহযোগ, খিলাফত, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব প্রভৃতি ইংরেজ সরকারবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়।
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে নজরুল বেশ কিছু উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেন, কালানুক্রমিকভাবে যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘ঘোররে ঘোর আমার সাধের চরকা ঘোর’, ‘শিকল পরা ছল মোদের ঐ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, ‘ওঠরে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’, ‘ধ্বংস পথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, ‘আমরা শক্তি আমরা বল’, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’ প্রভৃতি। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নজরুলের সঙ্গীত-প্রতিভার প্রথম স্ফূরণ ঘটে উদ্দীপনামূলক গানে। গানগুলিতে তিনি মূলত স্বদেশী সুর ও ঢং ব্যবহার করলেও তাতে দৃঢ বলিষ্ঠতা সংযোজন করেন।
১৯২৬ সালের শেষ দিকে তিনি গজল রচনা শুরু করেন এবং ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় একটানা বহু উৎকৃষ্ট গজল গান রচনা করেন। নজরুলের গজলের বিষয়বস্ত্ত প্রেম, তবে প্রকৃতি মিশ্রিত। সেগুলির বাণী প্রায়শ উৎকৃষ্ট কবিতা, সুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাগাশ্রিত এবং আঙ্গিকের দিক থেকে প্রায় উর্দু গজলের মতোই। তাতে আগাগোড়া তালের প্রয়োগ নেই, কিছু অংশ তাল ছাড়া মুক্ত ছন্দ ও আলাপের রীতিতে রচিত এবং বাকি অংশ তালের কাঠামোতে গ্রথিত।
নজরুল গজল গানের সুরেই প্রথম রাগের ব্যবহার করেন, যা ক্রমশ বিচিত্র ও ব্যাপক হয়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গজল হলো: ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’ (ভীমপলশ্রী), ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ (ভৈরবী), ‘দুরন্ত বায়ু পুরবইয়া’ (কাফি-সিন্ধু), ‘এত জল ও কাজল চোখে’ (মান্দ), ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’ (পিলু), ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে’ (গারা-ভৈরবী), ‘কেন কাঁদে এ পরাণ’ (মিশ্র বেহাগ-খাম্বাজ), ‘চেয়ো না সুনয়না’ (বাগেশ্রী পিলু), ‘বসিয়া নদীকূলে’ (কালাংড়া) ইত্যাদি। নজরুলের প্রথম দিককার গজলগুলির অধিকাংশই কৃষ্ণনগরে রচিত। সে সময় নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। নজরুলের গজলগুলি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে দিলীপকুমারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
দিলীপকুমার রায় ছিলেন রাগসঙ্গীতে পারদর্শী, তাই তাঁর কণ্ঠে রাগাশ্রিত সুরে নজরুলের গজলগুলি রচয়িতার কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করে। শুধু গজল নয়, নজরুলের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী স্বদেশী গান ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ বা ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ দিলীপ রায় তাঁর সহশিল্পীদের নিয়ে প্রথম পরিবেশন করেন ১৯২২ সালের ২২ মে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতরূপে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম নজরুলের গান রেকর্ড হলেও (শিল্পী: হরেন্দ্রনাথ দত্ত, গীত: ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’) এবং ১৯২৬ সাল থেকে নজরুল গজল রচনা করলেও ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের আগে তিনি প্রত্যক্ষ বা নিয়মিতভাবে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। নজরুলের ১৯২৬-২৭ সালে রচিত গজলগুলি পরবর্তীকালে কে মল্লিক, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতি, রাধারাণী প্রমুখ শিল্পীর কণ্ঠে রেকর্ড হয়।
নজরুল ওস্তাদদের সংস্পর্শে এসেছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এবং কলকাতা বেতারে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পরে, কিন্তু তার আগেই যে তিনি রাগসঙ্গীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন, সে পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৬-২৮ সালের মধ্যে রচিত তাঁর গজল ও গান থেকে। তাঁর বুলবুল (১৯২৮), চোখের চাতক (১৯২৯) এবং চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) গীতি-সংকলনের অধিকাংশ গানের সুরই রাগনির্ভর। বুলবুল-এর গানগুলি গজল আঙ্গিকে হলেও চোখের চাতক এবং চন্দ্রবিন্দু-র গানগুলি গজল ছাড়াও অন্যান্য আঙ্গিকের। বোঝা যায় যে ১৯৩০ সালের মধ্যেই নজরুল তাঁর বিভিন্ন আঙ্গিকের গানের সুরে রাগ-রাগিণী ও তালের ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
নজরুলের বিচিত্র আঙ্গিকের গানের সুরকে রাগভিত্তিক করার পরিচয় তাঁর নজরুল-গীতিকা (১৯৩০) গ্রন্থে সংকলিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে। এর গানগুলির যে শ্রেণিবিন্যাস নজরুল নিজেই করেছেন, তা হলো: ওমর খৈয়াম গীতি, দীওয়ান-ই-হাফিজ গীতি, দেশাত্মবোধক ও উদ্দীপনামূলক স্বদেশী গান, ঠুম্রি, গজল, টপ্পা, কীর্তন, বাউল-ভাটিয়ালি, ধ্রুপদ, হাসির গান ও খেয়াল। এসব আঙ্গিকের গানে তিনি কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি আর হাসির গান ছাড়া অন্য সকল শ্রেণির গানের সুরকে একক, মিশ্র, কখনোবা অপ্রচলিত রাগাশ্রয়ী করেছেন। কতিপয় উদাহরণ: ওমর খৈয়ামগীতি– ‘কাননগিরি সিন্ধুপার’ (ভীমপলশ্রী-দাদরা), ‘তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন’ (ভৈরবী-কাওয়ালি); দীওয়ান-ই-হাফিজ গীতি– ‘আসল যখন ফুলের ফাগুন’ (দুর্গা-মান্দ-কাওয়ালি); দেশাত্মবোধক গান– ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ (বৃহন্নট কেদারা-একতালা), ‘বাজল কিরে ভোরের সানাই’ (মান্দ-কাওয়ালি); ঠুম্রি– ‘ভোরের হাওয়া এলে ঘুম ভাঙাতে’ (রামকেলী), ‘আমার কোনো কূলে আজ ভিড়লো তরী’ (খাম্বাজ-দাদরা); গজল– ‘রেশমী চূড়ীর শিঞ্জিনীতে’ (কালাংড়া-কাশ্মীরী খেমটা), ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর’ (ভৈরবী, দাদরা); টপ্পা– ‘আজি এ কুসুমহার’ (সিন্ধু-কাফি-খাম্বাজ-যৎ), ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ (শাওন-কাওয়ালি); ধ্রুপদ– ‘গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু’ (মালকোষ-গীতাঙ্গী), ‘সাজিয়াছ যোগী’ (যোগিয়া-ঝাঁপতাল); খেয়াল– ‘নাইয়া কর পার’ (ধবলশ্রী-মধ্যমান্দ), ‘ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান’ (বেহাগ ও বসন্ত-একতালা), ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তার’ (বাগেশ্রী-কাওয়ালি) ইত্যাদি।
আবদুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত অপ্রকাশিত নজরুল (প্রথম খন্ড) গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, নজরুল মার্গসঙ্গীত নিয়েও গভীর অধ্যয়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ১৯৩২-৩৪ সালে নজরুলের ছয়টি গীতি-সংকলন প্রকাশিত হয়: সুরসাকী, জুলফিকার, বনগীতি, গুলবাগিচা, গীতিশতদল ও গানের মালা। এ সংকলনগুলিরও অধিকাংশ গানের সুর রাগাশ্রিত। অন্যগুলি হচ্ছে বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, কাজরী, স্বদেশী ইত্যাদি। নজরুলের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে বুলবুল (১৯২৮) ইত্যাদি যে দশটি গীতি-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সংকলিত মোট ৭৬৫টি গানের সুর বিভিন্ন রাগ অবলম্বনে রচিত; অর্থাৎ নজরুলসঙ্গীতের ভিত্তিমূল হচ্ছে রাগসঙ্গীত। তাতে বৈচিত্র্য এনেছে লোকসুর, বিশেষত স্বদেশী, বাউল-ভাটিয়ালি, কীর্তন, ঝুমুর, কাজরী এবং কখনও কখনও বিদেশি সুর।
১৯৩০-৩১ সাল থেকে নজরুল নতুন এক ধারার সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময়ে তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক এবং ইসলামি গান রচনা শুরু করেন। হিন্দু ভক্তিগীতির মধ্যে তিনি প্রথম রচনা করেন ‘জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী’, ‘তিমির বিদারী অলখ বিহারী’, ‘জাগো হে রুদ্র জাগো রুদ্রাণী’ ইত্যাদি। ইসলামি গানের মধ্যে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ’, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি। নজরুল প্রায় এক হাজার ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেন, যার মধ্যে হিন্দু ঐতিহ্যের শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এবং ইসলামি ঐতিহ্যের হামদ্, নাত, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, মর্সিয়া প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের গান রয়েছে। এসব গানের রচনা ত্রিশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল।
নজরুলের সঙ্গীত রচনার চতুর্থ ধারাকে আধুনিক ও লোক-ঐতিহ্যভিত্তিক সঙ্গীত সৃষ্টির পর্বরূপে চিহ্নিত করা যায়। ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ত্রিশের দশকের শেষ অবধি তিনি যেসব আধুনিক গান রচনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘মোর আহত পাখীর সম’, ‘বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ-পথে’, ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’, ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’, ‘শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘ধীরে যায় ফিরে ফিরে চায়’, ‘আধো আধো বোল’, ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী’, ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’, ‘যবে সন্ধ্যা বেলায় প্রিয় তুলসী তলায়’ ইত্যাদি। এসব গানের মাধ্যমে নজরুল আধুনিক বাংলা গানের ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
একই সময়ে রচিত লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যভিত্তিক গানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল’, ‘আমার গহীন জলের নদী’, ‘ও কূল ভাঙা নদীরে’, ‘কুচ বরণ কন্যারে’, ‘পদ্মদীঘির ধারে ঐ’, ‘পদ্মার ঢেউরে’ প্রভৃতি। লোক-ঐতিহ্যভিত্তিক গানের মধ্যে নজরুলের ঝুমুর গানগুলি এক অপূর্ব সৃষ্টি। এ সময়ে তিনি বেশ কিছু হাসির গানও রচনা করেন।
নজরুলের সঙ্গীত-জীবনের পঞ্চম ও শেষ পর্যায় হচ্ছে রাগভিত্তিক গান সৃষ্টির পর্ব; এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এ ক্ষেত্রে তিনি রাগভিত্তিক গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নব নব সৃষ্টিতে মৌলিক সঙ্গীত-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। নজরুল বিশুদ্ধ রাগ অবলম্বনে কিছু হিন্দুস্থানি বন্দিশের ওপর বাংলা কথা বসিয়ে বাংলা খেয়াল রচনার সূত্রপাত করেন, যেমন জয়জয়ন্তীতে ‘দূর বেণু কুঞ্জে’, মেঘ-এ ‘গগনে সঘনে চমকিছে দামিনী’, বাহারে ‘পিউ পিউ বোলে’ প্রভৃতি। এ গানগুলি কলকাতা বেতারের হারামণি, নবরাগ মালিকা, মেল-মিলন, যাম যোজনার কড়ি মাধ্যম, প্রহর পরিচায়িকা নামক অনুষ্ঠানসমূহে পরিবেশিত হতো।
বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে নতুন রাগ-রাগিণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে সঙ্গীতশাস্ত্র সম্পর্কে নজরুলের ছিল সূক্ষ্ম জ্ঞান ও রসবোধ। তাই সমকালীন অধিকাংশ গানের সুরে এ বিষয়টির অভাব লক্ষ করে তিনি ‘বেণুকা’ ও ‘দোলনচাঁপা’ নামে দুটি রাগিণী সৃষ্টি করেন। তাঁর মতে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে যে অভিনব রসের সৃষ্টি হতে পারে তা আধুনিক সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। হিন্দি ভাষা ছাড়া খেয়াল, ধ্রুপদ ইত্যাদি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত রচিত হতে পারে না এ ধারণা নজরুল মিথ্যা প্রমাণিত করেন বাংলায় বিভিন্ন রাগ-রাগিণীভিত্তিক গান রচনা করে।
বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ও সুর-তালের ব্যবহারে নজরুল আধুনিক বাংলা গানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন, তাই হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর গান একদিকে যেমন মধ্যযুগীয় বাংলার কীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত বা ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতকে বিষয় ও সুরের দিক থেকে অবলম্বন করেছে, অপরদিকে তেমনি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীত ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুম্রি, টপ্পা ও গজলকে আঙ্গিক ও সুরের ভিত্তি করেছে। সর্বোপরি প্রেম ও প্রকৃতিকে অবলম্বন করে নজরুলসঙ্গীত হয়ে উঠেছে আধুনিক বাংলা গানের এক অমূল্য সম্পদ। [রফিকুল ইসলাম]