ঠুম্রি

ঠুম্রি এক প্রকার লঘু রাগসঙ্গীত; খেয়ালের পরেই এর স্থান। এ গানের সুর অতি মিষ্টি, তাই এর নাম হয়েছে ঠুম্রি। ঠুম্রির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭শ শতকে রচিত ফকিরুল্লাহ্র রাগদর্পণ গ্রন্থে। তখন বারোঁয়া রাগে মিষ্টি সুরে এক প্রকার গান গাওয়া হতো, যার নাম ছিল ঠুম্রি। সংস্কারের মাধ্যমে এ গানই এক সময় রাগসঙ্গীতের একটি ধারায় পরিণত হয়।

ঠুম্রি রাগসঙ্গীত হলেও এতে রাগের চেয়ে ভাবের প্রাধান্যই বেশি, তাই এতে বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ ঘটে।  খেয়াল যেমন ধ্রুপদের চেয়ে লঘু, তেমনি ঠুম্রি আবার খেয়ালের চেয়েও লঘু প্রকৃতির। এ গান রাগের দিক থেকে খেয়ালের চেয়েও শিথিল এবং এর সুরও মিষ্টতর। এর বিষয়বস্ত্ত শৃঙ্গাররসাত্মক, তাই শৃঙ্গাররস প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত আলঙ্কারিক প্রক্রিয়া এতে যুক্ত হয়। ঠুম্রি স্থায়ী ও অন্তরা এ দুই তুকে বিভক্ত। এর বাণী অল্প ও গৌণ, ভাবই মুখ্য। ছোট ছোট তান, মুর্কী, খটকা, গিটকিরি ইত্যাদি প্রয়োগে ঠুম্রি গানকে সুন্দর করে তোলা হয়।

বিশেষ কয়েকটি রাগ ও তালে ঠুম্রি বেশি গাওয়া হয়। রাগের মধ্যে কাফি, খাম্বাজ, তিলং, তিলককামোদ, ভৈরবী, পিলু ইত্যাদি এবং তালের মধ্যে যৎ, ত্রিতাল, দাদরা, কাহারবা, পাঞ্জাবি, দীপচন্দী, ধূমালী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রথমে বিলম্বিত লয়ে শুরু করে এর শেষাংশ দ্রুত কাহারবা অথবা ত্রিতালে গাওয়া হয়। একে বলা হয় ‘লগ্গি’।

ঠুম্রি প্রধানত দুটি অঙ্গে গাওয়া হয়: পূর্বী ও পাঞ্জাবি। বেনারস ও লক্ষ্ণৌতে যে ঠুম্রি গাওয়া হয় তা পূর্বী অঙ্গের ঠুম্রি। পাঞ্জাবি ঠুম্রিতে টপ্পার প্রভাব লক্ষণীয়। এতে কথার চেয়ে তানের কাজ বেশি। বর্তমানে পূর্বী অঙ্গের ঠুম্রির মধ্যে পাঞ্জাবি অঙ্গের মিশ্রণ দেখা যায়। পাঞ্জাবি ঠুম্রি ছাড়া পূর্বী ঠুম্রিতে তানের প্রয়োগ হয় না।

বর্তমানে ঠুম্রির যে রূপটি প্রচলিত তার সূচনা হয় উনিশ শতকের প্রথম দিকে। এর উদ্ভাবক হিসেবে ওস্তাদ সাদিক আলী খাঁ এবং ওস্তাদ গোলাম নবীর নাম বলা হয়। আবার কদরপিয়া, ললনপিয়া, অখতরপিয়া প্রভৃতি ছদ্মনামে অনেক সঙ্গীতগুণী ঠুম্রি রচনা করেছেন। তবে অধিকাংশের মত, আধুনিক ঠুম্রির উদ্ভব হয়েছে লক্ষ্ণৌর রাজদরবারে। লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্ স্বয়ং ঠুম্রির একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ‘অখতরপিয়া’ ছদ্মনামে প্রচুর ঠুম্রি রচনা করেন। তাঁর দ্বারাই লক্ষ্ণৌ তবলা ঘরানার মাধ্যমে ঠুম্রি বাংলায় প্রচলিত ও ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়।  [মোবারক হোসেন খান]