চর্যাপদ

চর্যাপদ   বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায়  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এর  পুথি আবিষ্কার করেন। তাঁরই সম্পাদনায় ৪৭টি পদবিশিষ্ট পুথিখানি হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা (১৯১৬) নামে  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তিনি পুথির সূচনায় একটি  সংস্কৃত শ্লোক থেকে নামের যে ইঙ্গিত পান তাতে এটি চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় নামেও পরিচিত হয়। তবে সংক্ষেপে এটি ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ বা ‘চর্যাপদ’ নামেই অভিহিত হয়ে থাকে।

চর্যাপদ

চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর বিষয়, ভাষা ও কাল সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা হয়। এতে তেইশজন পদকর্তার ৪৭টি পদ আছে। চর্যার কবিদের কাল খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে ধরা হয়। অবশ্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে চর্যার কোনো কোনো পদকর্তার আবির্ভাবকাল সপ্তম অথবা অষ্টম শতক। চর্যাকাররা  সহজযান ধর্মমতে দীক্ষিত ও সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন। তান্ত্রিক যোগসাধনা তাঁদের ধর্মমতের বৈশিষ্ট্য। চর্যাপদে এ সাধনার কথা হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। ফলে দেশজ ভাষায় রচিত হলেও চর্যাপদের মূল ভাবের মর্মোদ্ঘাটন দুরূহ ব্যাপার। এ কারণে পন্ডিতগণ এ ভাষাকে ‘আলো-অাঁধারি’ বা  সন্ধ্যা ভাষা নামে অভিহিত করেন।

চর্যাপদের  ভাষা অবিমিশ্র বাংলা নয়, কারণ চর্যার কবিগণ ছিলেন বিভিন্ন অঞ্চলের (যথা বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম, বিহার)। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা তখন নানাদিকে প্রসারিত ছিল। সেজন্য উড়িষ্যা, আসাম এমনকি বিহারের ভাষাদর্শও চর্যাপদে  লক্ষ্য করা যায়। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলা, অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষা পূর্ব ভারতের একই মূল কথ্য ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই বাঙালি, অসমিয়া ও উড়িষ্যাবাসী প্রত্যেকেই চর্যাপদের দাবিদার। তবে ‘বঙ্গাল দেশ’, ‘পঁউয়া খাল’ (পদ্মানদী), ‘বঙ্গালী ভইলি’ ইত্যাদির উল্লেখ থাকায় বাঙালির দাবি অগ্রগণ্যরূপে বিবেচিত হয়।

চর্যাপদের কবিরা হলেন সরহপা, শবরপা, লুইপা, ডোম্বীপা, ভুসুকুপা,  কাহ্নপা, কুক্কুরীপা, মীনপা, আর্যদেব, ঢেণ্ঢনপা প্রমুখ। চর্যাপদে  তত্ত্বের কথা থাকলেও এর সাহিত্যমূল্যও স্বীকৃত। কবিরা যুক্তিবাদী ও মননধর্মী হয়েও উপমা-রূপকের ব্যবহারে দক্ষ ছিলেন। তাঁদের রচনাশৈলী শিল্পসৌকর্যের অভিমুখী। তাঁদের বাকরীতি সংক্ষিপ্ত, অথচ নিগূঢ় অর্থবাহী। কোনো কোনো পদের এ অর্থগূঢ় বাক্যে সাধনমার্গে পৌঁছাবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যেমন ডোম্বীপার ১৪নং পদ: ‘বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা। সদ্গুরু পাঅ পসাএ জাইব পুণু জিনউরা\’ অর্থাৎ, ডোমনি নদী পারাপার করছে, আর তারই মাধ্যমে সহজ সাধনার তীর্থধামে পৌঁছানোর আভাস সূচিত হচ্ছে।

চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গাওয়া হতো। এ ছাড়া পদগুলি থেকে তৎকালীন বাঙালি জীবনের আচার-আচরণ ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন তখনকার মানুষ হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চেঙারি তৈরি, শুঁড়ির কাজ ইত্যাদি করত। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু ছিল গৃহপালিত পশু; হাতিরও উল্লেখ আছে। মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কর্ণে কুন্ডল পরত। টাঙ্গি, কুঠার, নখলি বা খন্তা ছিল উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। তবে সমকালীন সমাজের এসব চিত্র অঙ্কন করলেও চর্যাকারেরা প্রধানত ছিলেন বৈরাগ্যপন্থি, জগৎমুখী নন।  [আজহার ইসলাম]