রিয়াজ-উস-সালাতীন

রিয়াজ-উস-সালাতীন  ফারসি ভাষায় লিখিত বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ। গোলাম হোসেন সলিম জায়েদপুরী কর্তৃক রচিত এ গ্রন্থে ১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজীর নদীয়া বিজয় থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাবলির বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। গ্রন্থের বর্ণনার কোন কোন অংশে বেশ ফাঁক পরিলক্ষিত হলেও এ গ্রন্থটি মুসলিম বাংলার পরিপূর্ণ ইতিহাস বলে বিবেচিত।

‘সলিম’ গ্রন্থকারের ছদ্মনাম। তিনি উত্তর প্রদেশের জায়েদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বড় হয়ে তিনি বাংলার মালদহ জেলায় চলে আসেন। এখানে মুনশি (লেখক) হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি মালদহের ইংরেজ ‘কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট’ জর্জ উড্নীর অধীনে ডাক-মুনশি বা পোস্ট মাস্টারের চাকরি নেন। উড্নীর অনুরোধেই ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সলিম এই গ্রন্থ রচনায় হাত দেন। তাঁর ইতিহাসের শিরোনাম দেওয়া হয় রিয়াজ-উস-সালাতীন। রিয়াজ-উস-সালাতীন শব্দটি সংখ্যাসূচক। নামটি দ্বারা ১৭৮৮ সনকে নির্দেশ করে। অথাৎর্ ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির লেখার কাজ শেষ হয়।

গোলাম হোসেন সলিম ইতিহাসের এক নিবেদিত প্রাণ ছাত্র ছিলেন। তাঁর সময়ে প্রচলিত ইতিহাস গবেষণা পদ্ধতির সাথে তিনি ছিলেন পরিচিত। তিনি তাঁর গ্রন্থের মুখবন্ধটি চার শাখায় ভাগ করে প্রতি শাখায় নিম্নবর্ণিত বিষয়াবলি তুলে ধরেন: (১) সীমানা, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং জনসংখ্যা; (২) দেশের বৈশিষ্ট্য, বাংলার জনগণের উদ্ভব এবং জীবন-যাত্রার কিছু নমুনা; (৩) কিছু শহরের বিবরণ; (৪) বাংলায় হিন্দু শাসনের সংক্ষিপ্ত লেখচিত্র। গ্রন্থের বাকি অংশ তিনি চার অধ্যায়ে ভাগ করেন। তন্মধ্যে প্রথম তিন অধ্যায়ে পাওয়া যায়: (১) দিল্লির সুলতান ও তাঁদের নিয়োজিত গভর্নরগণ, (২) বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ এবং (৩) বাংলায় মুগল শাসন। তিনি চতুর্থ অধ্যায়কে দুই অংশে ভাগ করেন প্রথম অংশে খ্রিস্টান ও ইংরেজদের ছাড়া,  পর্তুগিজওলন্দাজফরাসি প্রভৃতি জাতি সম্বন্ধে বলা হয় এবং দ্বিতীয় অংশে দেয়া হয়েছে ইংরেজদের আগমন এবং বাংলায়  ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার বিবরণ।

গোলাম হোসেন সলিম তাঁর গ্রন্থে ব্যবহূত সকল উৎসের সঠিক নির্দেশনা দেন নি। তাঁর গ্রন্থের অভ্যন্তরীণ প্রমাণাদির নিরিখে বোঝা যায় যে, তিনি ফারসি ভাষায় লিখিত সমসাময়িক অনেক মানসম্মত ইতিহাস গ্রন্থ ব্যবহার করতে সক্ষম হন। সেগুলির মধ্যে মিনহাজ-ই-সিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী, জিয়াউদ্দীন বরনী ও শামস-ই-সিরাজ আফীফের তারিখ-ই-ফিরুজশাহী এবং ইয়াহিয়া বিন আহমদের তারিখ-ই-মুবারকশাহী ছিল প্রধান। এ সকল উৎসের ওপর ভিত্তি করে তিনি সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের কাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হন। তিনি সম্ভবত তাঁর লেখায় আফগান ও মুগল আমলে প্রণীত ইতিহাস গ্রন্থও ব্যবহার করেন। সেগুলি হলো আববাস শেরওয়ানির তারিখ-ই-শাহী, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী এবং আকবরনামা, মুগলদের দুটি সাধারণ ইতিহাস বদাউনীর মুন্তখব-উত-তওয়ারিখ ও নিজামউদ্দীন বখশীর তবকাত-ই-আকবরী এবং দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর রাজসভায় লিখিত তারিখ-ই-ফিরিশতা। তিনি আরও ব্যবহার করেন তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, পাদশাহনামা এবং আলমগীরনামা। নওয়াবী আমলের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য তিনি সলিমুল্লার তারিখ-ই-বাঙ্গালা ব্যবহার করেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ের ইতিহাস বর্ণনার জন্য সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবাইর সিয়ার-উল-মুতাখ্খেরীন এবং সমসাময়িক কালে লেখা আরও অনেক গ্রন্থ তাঁর আওতার মধ্যে ছিল। তিনি আরও স্বীকার করেন যে, একটি ‘ছোট বই’ এবং হাজী মুহম্মদ আরিফ কান্দাহারির লেখা আর একটি গ্রন্থ তাঁর কাজে লাগে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ দুটি গ্রন্থের একটিও এখন পাওয়া যায় না। গোলাম হোসেন সলিম তাঁর নাগালের মধ্যে মসজিদ ও অন্যান্য স্থাপত্যে প্রাপ্ত শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। তিনি সুলতানি আমলে বাংলার দুই রাজধানী গৌড় ও পান্ডুয়া পরিদর্শনে যান। বেশির ভাগ স্থাপত্য নিদর্শন এই দুই নগরীতে সীমিত ছিল। শিলালিপি ভিত্তিক উপাত্তের ব্যবহার তাঁর ইতিহাসের গুরুত্ব ও মান বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এভাবে দেখা যায় যে, তিনি শুধু একজন ঐতিহাসিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন পুরাতত্ত্ববিদ এবং প্রত্নতাত্ত্বিকও।

গোলাম হোসেন সলিম মুখ্যত মুসলিম বাংলার ঐতিহাসিক। তাঁর পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকগণ সীমিত সময়ের বা বিশেষ বিশেষ দিকের ইতিহাস বর্ণনা করেন। কিন্তু গোলাম হোসেন তাঁর ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে বাংলায় প্রথম মুসলিম অভিযান থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত, এমন কি তার পরেরও কয়েক বছরের ঘটনাবলি বর্ণনা করেন (১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি লেখা শেষ করা পর্যন্ত)। এই গ্রন্থ না থাকলে বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস পুনর্গঠনে আধুনিক ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট বেগ পেতে হতো।

উৎস সংগ্রহে গোলাম হোসেনের নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ভ্রম-প্রমাদ থেকে অব্যাহতি পান নি, বিশেষ করে কালক্রম নির্দেশনায় তিনি বেশ ভুল করেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে কোন কোন মুগল সুবাহদারের ইতিহাসও বাদ পড়ে, বিশেষ করে মুগল বাংলার গৌরবময় অধ্যায় আমীর-উল-উমারাহ শায়েস্তা খানের শাসনকাল সম্পর্কে তিনি তেমন কিছু উল্লেখ করেন নি। আধুনিক ঐতিহাসিকদের এটা ভাবতে অবাক লাগে যে, শায়েস্তা খানের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী গোলাম হোসেনের দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। এ সকল চ্যুতি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও রিয়াজ-উস-সালাতীনের মাহাত্ম্য এই যে, বাংলায় মুসলিম শাসনের সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখার এটিই সর্বপ্রথম স্থানীয় প্রচেষ্টা। বাংলার প্রথম আধুনিক ঐতিহাসিক ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্ট তাঁর History of Bengal (১৮১৩) লেখার সময় রিয়াজকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এর ওপর ভিত্তি করেই তিনি ঘটনার ধারাবাহিকতা সাজান।

ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিমের ১৮১৭ সালে মৃত্যু হয়। মালদহ শহরে চক কোরবান আলী নামক এলাকায় তিনি সমাহিত আছেন।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  Riyaz-us-Salatin, Persian text, Calcutta , 1893; Abdus Salam (tr.), Riyaz-us-Salatin, Calcutta , 1903; আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস, সুলতানি আমল, ৫ম সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯৯।