ওলন্দাজ

ওলন্দাজ  উত্তমাশা অন্তরীপের পথ আবিষ্কার এবং ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করে ষোল শতকে পর্তুগিজরা এশিয়া থেকে ইউরোপে ব্যাপকহারে ও সরাসরি মশলা-বাণিজ্যের নতুন ধারার সূচনা করে। ইউরোপের বিশাল বাজার প্রতিষ্ঠা এবং মশলার বাণিজ্যে প্রভূত মুনাফায় আকৃষ্ট হয়ে এশিয়ায় বাণিজ্যের মুখ্য উদ্দেশ্যে সতেরো শতকের প্রথম দিকে  ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলি (ইংরেজ কোম্পানি ১৬০০ এবং ওলন্দাজ কোম্পানি ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে) গঠিত হয়। সতেরো শতকের মধ্যভাগ নাগাদ ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের নিষ্প্রভ করে দেয়। হুগলিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের পর মোটামুটি সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাংলায় তাদের বাণিজ্য শুরু করে।

কোম্পানিগুলি ‘নতুন বিশ্ব’ থেকে সংগ্রহ করা রুপার বিনিময়ে মশলা কেনার জন্য পূর্ব দ্বীপপুঞ্জের তথাকথিত মশলা দ্বীপগুলিতে যায়। কিন্তু তারা লক্ষ্য করে যে, এ সব দ্বীপে রুপার চেয়ে মোটা ও সস্তা ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদাই বেশি। ফলে তারা ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে মশলার বিনিময়যোগ্য বস্ত্রের সন্ধানে ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। প্রথমে মশলা দ্বীপপুঞ্জে বহুল চাহিদা রয়েছে এমন বিপুল পরিমাণ সস্তা ও মোটা বস্ত্র উৎপাদনকারী করমন্ডল উপকূলের প্রতি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু অচিরেই যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা করমন্ডলের বাণিজ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত ও ব্যয়বহুল করে তোলে। ফলে কোম্পানিগুলি শেষ পর্যন্ত বাংলার দিকে মনোযোগ দেয়।

বাংলায় কোম্পানিগুলি বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছিলো। বাংলা ছিল সস্তা ও মোটা সুতি বস্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী অঞ্চল। এগুলি ছিল বাজারে লভ্য সুতি বস্ত্রের চেয়ে অনেক সস্তা ও ভাল মানসম্পন্ন। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক কম দাম ও উন্নত মানের জন্য ইতালীয় ও পারস্যদেশীয় রেশমের পরিবর্তে বাংলার রেশমের ছিল ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং এ কারণে বাংলার রেশম ছিল কোম্পানিগুলির জন্য অত্যন্ত লোভনীয় ও লাভজনক পণ্য। তাছাড়া, কোম্পানিগুলির বাণিজ্যের তৃতীয় লাভজনক পণ্য ছিল সোরা। ইউরোপে এর প্রচুর চাহিদা ছিল এবং তা ইউরোপগামী জাহাজগুলির ভারসাম্য রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হতো।

ওলন্দাজরা ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসে এবং পিপলিতে বসতি স্থাপন করে। রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩% হারে বাণিজ্য শুল্ক প্রদানের শর্তে তারা মুগল সরকারের কাছ থেকে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা হুগলি ছেড়ে চলে গেলে ওলন্দাজরা ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার আজম খান এর কাছ থেকে হুগলিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের জন্য একটি নতুন পরওয়ানা লাভ করে। অবশ্য কোম্পানি হুগলিতে বাণিজ্য কুঠিটি স্থাপন করেছিল ১৬৪৫ থেকে ১৬৪৭ এর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। ওয়েস্টজানেন নামের ওলন্দাজ জাহাজটিই প্রথম সেখানে পৌঁছে। পরওয়ানায় শুল্ক হারের যথার্থ উল্লেখ না থাকায় তাদের সঙ্গে প্রায়শ বিবাদের সৃষ্টি হতো। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের একটি ফরমান বাংলার মধ্য দিয়ে পিপলি-আগ্রা পথে চলাচলকারী পণ্যাদির ওপর ট্রানজিট শুল্ক থেকে ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেয়। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে ইংরেজ বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত হয়।

আওরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরগুলিতে সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চলাচলকারী পণ্যাদির ওপর ট্রানজিট শুল্ক থেকে ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেন। হুগলিতে ৪% এবং পিপলি ও বালাসোরে ৩% হারে বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। শুল্ক হারে এ ধরনের পার্থক্য সরকারের সঙ্গে প্রায়ই বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওলন্দাজরা সব সময়ই শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত। এটাও ছিল বিবাদের আরেকটি কারণ। ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে হুগলির কুঠিয়ালরা বাটাভিয়াস্থ (ইন্দোনেশিয়া) ওলন্দাজ কোম্পানির পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরকে জানিয়েছিল, গত ষোল বছরে তারা কমপক্ষে ২৫% শুল্ক প্রদান কৌশলে এড়িয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে যায় এবং ওলন্দাজরা দেড় লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হয়। বাটাভিয়া কর্তৃপক্ষ যখনই সম্ভব এধরনের শুল্ক ফাঁকি দিতে হুগলির কুঠিয়ালদের উৎসাহিত করেছিল। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা হুগলিতে ৪% হারে বাণিজ্য শুল্ক প্রদানের জন্য শাহজাদা মুহম্মদ আজম-এর কাছ থেকে একটি নিশান সংগ্রহ করে। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ হার ৩.৫%-এ হ্রাস করা হয় এবং ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলমের ফরমানের মাধ্যমে এটাকে আরও কমিয়ে ২.৫% করা হয়। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহান্দর শাহের ফরমান দ্বারা এটি অনুমোদন করা হয়। তিনি সমগ্র মুগল সাম্রাজ্যে চলাচলকারী পণ্যের উপর ট্রানজিট শুল্ক থেকেও ওলন্দাজদের অব্যাহতি দেন।

১৬৩৩ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ওলন্দাজরা উড়িষ্যা ও পাটনায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। কিন্তু অচিরেই সেগুলি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার প্রথম ওলন্দাজ ডিরেক্টর ছিলেন পিটার স্টারথেমিন্স। তিনি হুগলি কুঠি চুঁচুড়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানি চুঁচুড়া, বরানগর ও বাজার মির্জাপুর গ্রামগুলি বার্ষিক ১৫৭৪ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে ইজারা নেয়। এর মধ্যে বরানগরের রাজস্বই ছিল সবচেয়ে বেশি (৭৯৩ টাকা)। শীঘ্রই চুঁচুড়ার বাণিজ্যকুঠির প্রাধান্য দেখা যায় এবং বালাসোর তাদের বড় জাহাজগুলির নঙ্গর বাঁধার স্থান হিসেবে থাকলেও ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে পিপলি বাণিজ্যকুঠি পরিত্যক্ত হয়। সতেরো শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ওলন্দাজরা ঢাকায় একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। বর্তমান মিটফোর্ড হাসপাতাল স্থলে তাদের ঢাকা বাণিজ্যকুঠি অবস্থিত ছিল এবং তেজগাঁয়ে তাদের একটি বাগানবাড়ি ছিল।

বাংলা থেকে কাঁচা রেশম রপ্তানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সতেরো শতকের সত্তরের দশকের দিকে বাংলায় কোম্পানিগুলির বাণিজ্য বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে বাস্তবে আশির দশকের প্রথম দিকে বাংলার বস্ত্র রপ্তানির ব্যাপক বৃদ্ধি কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যের ধরনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। বস্ত্তত, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারকারীদের রুচির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলেই এটা ঘটেছিল। সেখানে ভারতীয় বস্ত্র, বিশেষত বাংলার বস্ত্রের ব্যবহার ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল এবং ফলে বাংলার বস্ত্রের চাহিদা অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যে বাংলা সর্বাধিক প্রভাবশালী অংশীদার হয়ে ওঠে এবং সতেরো শতকের আশির দশক থেকে আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ওলন্দাজ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সামুদ্রিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য ১৭৫৭ সালে পলাশীতে ইংরেজদের জয়লাভের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজ কোম্পানি ও এর কর্মচারীরা বাংলার প্রশাসন ও অর্থনীতির ওপর তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বদৌলতে বাংলার বাণিজ্য থেকে অপরাপর সকল ইউরোপীয় ও এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের উৎখাত করে নিজেদের একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।

আঠারো শতকের প্রথম দিকে ওলন্দাজ কোম্পানি কর্তৃক হল্যান্ডে রপ্তানিকৃত এশীয় পণ্যের গড় বার্ষিক মূল্যের প্রায় ৪০% মূল্য ছিল বাংলার পণ্যের। এর থেকে কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যে বাংলার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। আবার এশিয়া থেকে ওলন্দাজদের রপ্তানিকৃত বস্ত্রের মোট মূল্যের ৫০%-এরও বেশি মূল্য ছিল বাংলার বস্ত্রের। এরূপে বাংলা শুধু ভারতেই নয়, সমগ্র এশিয়াতেই ওলন্দাজ কোম্পানির কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও তেমন ব্যতিক্রম ছিল না। ইংরেজ কুঠিয়ালরা বাংলাকে ‘কোম্পানির বাগানের ফুল’ এবং ‘সবচেয়ে পছন্দের রত্ন’ রূপে বিবেচনা করত।

এশিয়ার অন্যান্য অংশ ও ইউরোপের জন্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য সংগ্রহ করা ছিল বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য। এ অঞ্চলে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমদানিকৃত মূল্যবান ধাতু ও পণ্যের প্রধান ভূমিকা ছিল রপ্তানিযোগ্য পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রয়-ক্ষমতা যোগানো। এসব আমদানিকৃত পণ্যের অধিকাংশই ছিল মূল্যবান ধাতু, কারণ তুলনামূলক মূল্য-কাঠামোয় আমদানিকৃত পণ্যের স্থানীয় চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। ওলন্দাজদের বাংলায় আমদানিকৃত পণ্যের বেশিরভাগই ছিল ইউরোপের রুপা, যদিও তাদের আমদানিকৃত মূল্যবান ধাতুর কিছু পরিমাণ এশিয়া থেকেই সংগ্রহ করা হতো। এগুলির মধ্যে ছিল জাপান থেকে রুপা ও সোনা এবং পেগু, আরাকান ও পারস্য থেকে রুপা।

ইউরোপ থেকে সীসা, লোহা ইত্যাদির মতো সামান্য পরিমাণ ধাতু এবং কিছু পশমি কাপড় ছাড়া ওলন্দাজ কোম্পানির বাংলায় আমদানিকৃত প্রায় সব পণ্যেরই উৎস ছিল এশিয়া। এশীয় দেশগুলি থেকে সে সব পণ্য আমদানি করা হতো সেগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী ছিল গোলমরিচ ও অন্যান্য মশলা। প্রধানত সুমাত্রা এবং মালয় উপদ্বীপ থেকে গোলমরিচ সংগ্রহ করা হতো। অন্যান্য মশলা, বিশেষ করে লবঙ্গ, জায়ফল এবং জৈত্রি সংগ্রহ করা হতো ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাঞ্চল থেকে। এ অঞ্চল থেকে কোম্পানির রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল বস্ত্র, কাঁচা রেশম ও শোরা। প্রধানত এশীয় বাজারগুলিতে রপ্তানির জন্য তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মধ্যে ছিল চিনি, চাল, গম, পরিশোধিত মাখন ও সরিষার তেলের মতো খাদ্যসামগ্রী এবং আফিম, মোম, সোহাগা, কড়ি, চটের থলে ইত্যাদি। কাঁচা রেশম প্রথমে কোম্পানির এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ও পরবর্তীসময়ে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সতেরো শতকের শেষ ভাগে এবং আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলা থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে বস্ত্রই সর্বপ্রধান হয়ে ওঠে।

সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ওলন্দাজদের বাণিজ্য ইংরেজদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। আঠারো শতকের প্রথম দুদশকেও অবস্থা ছিল একই রকম যা নিচের সারণিগুলি থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়:

সারণি ১ বাংলা থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য (১৭০১-১৭২০) [ফ্লোরিন]।

বছর ইউরোপে ইংরেজদের বার্ষিক গড় রপ্তানি ইউরোপে ওলন্দাজদের বার্ষিক গড় রপ্তানি ইউরোপ ও এশিয়ায়

ওলন্দাজদের বার্ষিক গড় রপ্তানি

১৭০১-১৭১০ ১,৩৮২,৫৯৫ ২,৩১৫,৩৮৪ ৩,২৭৪,৩৬৯
১৭১০-১৭২০ ২,৬৬৬,৭৬৪ ২,৬৫০,৬০৭ ৩,৬১৬,২৪২

উৎস ও টীকা ইংরেজদের রপ্তানির হিসাব করা হয়েছে কে.এন চৌধুরীর Trading World গ্রন্থ থেকে (পৃ. ৫০৯)। এতে এক বছরের ফাঁক রয়েছে। ওলন্দাজদের রপ্তানির হিসাব করা হয়েছে ওম প্রকাশের, Dutch Company গ্রন্থ থেকে (পৃ. ৭০)। [১ পাউন্ড=১২ ফ্লোরিন, ১ টাকা=১.৫ ফ্লোরিন]।

আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকের দিকে বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য গতি লাভ করে এবং ওলন্দাজদের রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্যের প্রায় কাছে পৌঁছে যায়, যদিও অন্যান্য এশীয় কুঠির বাণিজ্যসহ ওলন্দাজদের বাণিজ্যের পরিমাণ তখনও ইংরেজদের চেয়ে বেশি ছিল। আঠারো শতকের ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে ইউরোপে ইংরেজ কোম্পানির রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এটা চল্লিশের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে শীর্ষে পৌঁছে। অবশ্য পঞ্চাশের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে এর প্রান্তিক হ্রাস ঘটে। তবে ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সাল পর্যন্ত বাংলা থেকে ইংরেজদের রপ্তানিকৃত পণ্যের বার্ষিক গড় মূল্য প্রায় ৪৪০,০০০ পাউন্ড বা ৩৫০০০০০ টাকার সামান্য বেশির তুলনায় এ হ্রাস প্রাপ্তি বস্ত্তত খুব লক্ষণীয় ছিল না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ইংরেজদের রপ্তানি-হ্রাস এবং একই সময়ে ওলন্দাজদের ইউরোপে রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে বাংলার মোট রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য এসেছিল। এর ফলে সামগ্রিকভাবে ইউরোপের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য-ব্যবস্থায় পূর্বতন সময়ের তুলনায় আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশকে তেমন লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।

আঠারো শতকের বিশের দশকে ইউরোপে ওলন্দাজদের রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পেতে শুরু করলেও ত্রিশের দশকের প্রথম থেকে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুরানো সুবিধাদি অনুমোদন করে ১৭৩০ সালে নওয়াব সুজাউদ্দীন ওলন্দাজদের একটি পরওয়ানা দান করেন। ১৭৪৮ সালে আলীবর্দী খান ওলন্দাজ বেসরকারি বণিকদের এতদিন পর্যন্ত আদায়কৃত ৩.৫% শুল্ক-হারের পরিবর্তে কোম্পানি থেকে আদায়কৃত ২.৫% হারে শুল্ক আদায়ের সুবিধা দান করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার পক্ষে যোগদানের জন্য নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা ওলন্দাজ, ফরাসি ও দিনেমারদের কাছে পরওয়ানা পাঠিয়েছিলেন। ওলন্দাজরা নিরপেক্ষ থাকে। নওয়াব তাদের তিরস্কার করে তাদের বাণিজ্যকুঠি অবরোধ করেন এবং ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করেন। খাজা ওয়াজিদ ও রাজা দুর্লভরামের মধ্যস্থতায় এ অঙ্ক চার লক্ষে কমিয়ে আনা হয়। শেষ পর্যন্ত ওলন্দাজরা কোম্পানির জন্য বিনাশুল্কে বাণিজ্যের বিনিময়ে চার লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হয়। ইংরেজদের চন্দননগর অধিকারের পর ক্লাইভ এর প্রতিবাদ সত্ত্বেও ওলন্দাজরা ফরাসি অধিবাসীদের আশ্রয় দান করেছিল।

আঠারো শতকের ত্রিশের দশকের প্রথমভাগ থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ে ওলন্দাজদের ইউরোপে রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ইংরেজদের বাণিজ্যে কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিলে ইউরোপে ওলন্দাজদের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ওলন্দাজদের বাণিজ্য ত্রিশের দশকের প্রথমভাগে ইংরেজদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তা ইংরেজদের বাণিজ্যের প্রায় সমান হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য এর মধ্যে ওলন্দাজদের এশীয় বসতিগুলিতে তাদের রপ্তানির মূল্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ত্রিশের দশক থেকে নিয়মিত হ্রাস পেয়ে আসছিল। ওলন্দাজদের ইউরোপে রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য ছিল প্রায় ২,৮৪,৭৭৫ পাউন্ড বা ২৩ লক্ষ টাকা এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে এশীয় বাজারগুলিসহ রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৩,৭৩,৩৪২ পাউন্ড বা ৩০ লক্ষ টাকায়। ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সাল পর্যন্ত প্রথম পাঁচ বছরে বাংলা থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্যের তুলনামূলক অবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে নিচের সারণি থেকে।

সারণি ২   প্রথম পাঁচ বছরে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের রপ্তানির মোট ও গড় বার্ষিক মূল্য (১৭৩০-১৭৫৫ সাল) [ফ্লোরিনে]।

বছর ইংরেজ ইউরোপে রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য ওলন্দাজ ইউরোপে রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য এশিয়ায়ও ইউরোপে মোট রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য
১৭৩০/৩১-১৭৩৪/৩৫ ৫,০৮২,৪৫৩ ২,০২০,৪৬০ ৩,৪৮৯,৫৬৭
১৭৪০/৪১-১৭৪৪/৪৫ ৪,৭৬৪,২৮৪ ২,৩৯০,৫৫৮ ৩,৪৭৫,৭৭০
১৭৫০/৫১-১৭৫৪/৫৫ ৪,৮৭৯,৭৮৫ ৩,৪১৭,৩০৬ ৪,৪৮০,১০৪

উৎস ও টীকা ওলন্দাজ রপ্তানির তথ্যাদি ও হিসাব সংগ্রহ করা হয়েছে হেগে রক্ষিত Algemeen Rijksarchief-এ বিধৃত ওলন্দাজ কোম্পানির রেকর্ডে রপ্তানির চালান থেকে। এক বছর পিছিয়ে থাকা ইংরেজদের রপ্তানির মূল্য হিসাব করা হয়েছে KM Chaudhuri: Trading World গ্রন্থ থেকে (পৃ. ৫০৯-১০)। [পরিবর্তনের হার: ১পাউন্ড= ১২ ফ্লোরিন]।

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, সতেরো শতকের শেষভাগে ও আঠারো শতকের প্রথম দশকগুলিতে বাংলা থেকে যে রপ্তানি ওলন্দাজদের বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, ১৭৩০-১৭৫৫ সালে তাতে মন্দাভাব দেখা দেয়। পক্ষান্তরে ১৭৩০ থেকে ১৭৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে রপ্তানির মূল্য নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগে এতে লক্ষ্যণীয় প্রবৃদ্ধি ঘটে। অবশ্য ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সালের প্রথম পাঁচ বছরে বাটাভিয়ায় ওলন্দাজদের রপ্তানির মূল্যে নিয়মিত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় যদিও তাদের এশীয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সামগ্রিক অবক্ষয় ঘটে। ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে বাংলা থেকে বাটাভিয়ায় ওলন্দাজদের রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য ছিল ওলন্দাজদের এ প্রদেশ থেকে এশিয়ার বিভিন্ন অংশে রপ্তানির মোট মূল্যের ৬.৮৩% যা চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে ৭৭.০২% এবং পঞ্চাশের দশকে ৮৯.৯২%-এ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু বাংলার পণ্যের অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ ওলন্দাজ বাজার জাপান ও পারস্যে রপ্তানিতে ক্রমান্বয়িক হ্রাস দেখতে পাওয়া যায়। ১৭৩০-১৭৫৫ সালে এশিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রে ওলন্দাজদের রপ্তানি ছিল প্রায় নগণ্য।

উপরিউক্ত বিশ্লেষণ থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজ কোম্পানিগুলির রপ্তানি বাণিজ্যের কয়েকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আঠারো শতকের প্রথম দশকে ইংরেজদের চেয়ে ওলন্দাজরা নিশ্চিতভাবেই এগিয়েছিল, তবে দ্বিতীয় দশকে তারা প্রায় সমপর্যায়ে চলে আসে। আঠারো  শতকের বিশের দশকের প্রথম দিকে ওলন্দাজরা ইংরেজদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল, তবে ত্রিশের দশক থেকে তারা আবার এগিয়ে যায়। চল্লিশের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে ইংরেজদের রপ্তানির গড় বার্ষিক মূল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে, কিন্তু পঞ্চাশের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে এর সামান্য হ্রাস ঘটে। অন্যদিকে, এশিয়ায় রপ্তানিসহ ওলন্দাজদের রপ্তানির মূল্য পঞ্চাশের দশকের প্রথম ভাগে ইংরেজদের রপ্তানির মূল্যের প্রায় সমান হয়েছিল। কোম্পানি দুটির রপ্তানির মোট মূল্য বিবেচনা করলে ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সাল পর্যন্ত তেমন কোনো হ্রাসই ঘটে নি। পঞ্চাশের দশকের প্রথম ভাগে বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজদের রপ্তানির মূল্যে যে ঘাটতি দেখা যায়, ওই বছরগুলিতে ওলন্দাজদের রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে সে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। এ গোটা সময়কালে ওলন্দাজদের এশীয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ক্রম অবক্ষয় ঘটে যদিও মোট রপ্তানি মূল্যের মধ্যে বাটাভিয়ার অংশে নিয়মিত প্রবৃদ্ধি দেখা যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইউরোপীয়রা বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার ছিল বহুদিন ধরে এ মত পোষণ করা হলেও সাম্প্রতিক কালে প্রমাণিত হয়েছে, আঠারো শতকের মধ্যভাগেও বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রপ্তানি ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এশীয় বণিকদের রপ্তানিকৃত বস্ত্রের মূল্য ছিল বার্ষিক প্রায় ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা যেখানে ইউরোপীয়দের মোট রপ্তানিকৃত বস্ত্রের মূল্য খুব বেশি হলেও কখনও ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায় নি। রেশম রপ্তানিতে এশীয়দের অগ্রগামী অবস্থান ছিল আরও বেশি লক্ষ্যণীয়। ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে আনুমানিক হিসাবে এশীয় বণিকদের বার্ষিক রপ্তানিকৃত রেশমের মোট মূল্য ছিল গড়ে প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে ৪১ লক্ষ টাকা। একই সময়ে ইউরোপীয়দের বার্ষিক রপ্তানিকৃত রেশমের মূল্য ছিল মাত্র ৯৮ হাজার টাকার মতো। অন্যভাবে বলা যায়, পলাশীর যুদ্ধ এর পূর্ববর্তী সময়ে বাংলা থেকে এশীয়দের রেশম রপ্তানির পরিমাণ ছিল ইউরোপীয়দের রপ্তানিকৃত রেশমের ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। ইংরেজরা ইউরোপীয় ও এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করার নীতি অনুসরণ করায় পলাশীর পর ইউরোপীয় অন্যান্য কোম্পানিগুলির অধিকাংশেরই বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। তাদের বাণিজ্যের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটাও বেসরকারি ইংরেজ ব্যক্তিদের অর্থে পরিচালিত হতো যার বিনিময়ে তারা ইউরোপে হুন্ডি গ্রহণ করত।

এটা বিষ্ময়কর যে, ইংরেজরা যখন বাংলা জয়ের ষড়যন্ত্র করে তখন ওলন্দাজরা অনেকটা দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। পলাশীর পরে অবশ্য তারা হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে তারা নওয়াব মীরজাফরকে মিত্র হিসেবে পেয়েছিল। ১৭৫৯ সালের ২০ নভেম্বর ইংরেজরা বরানগরের ওলন্দাজ বাণিজ্যকুঠি দখল করে এবং ২২ নভেম্বর ওলন্দাজরা সঙ্করায়েল রীচে সৈন্য পাঠায়। ২৪ তারিখে ইংরেজরা নৌযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং চন্দননগরে ইংরেজদের অবস্থানের ওপর ওলন্দাজদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ২৫ তারিখে ইংরেজরা চন্দননগর ও চুঁচুড়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বদেরাতে ওলন্দাজদের পরাজিত করে। মীরনের মধ্যস্থতায় ১৭৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত এক সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ওলন্দাজদের তাদের সুবিধাদি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বদেরার যুদ্ধ বস্ত্তত ভারতে ওলন্দাজ প্রাধান্যের পরিসমাপ্তি ঘটায়।

দ্বিতীয় শাহ আলম বাংলা আক্রমণ করলে ওলন্দাজরা ইংরেজদের বিতাড়িত করার এক পরিকল্পনা করে। কিন্তু মীরজাফরের উত্তরাধিকারী মীরকাসিম ওলন্দাজদের তাদের চুঁচুড়ায় ‘ফোর্ট গাস্টাভাস’ এর বহিঃপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে এবং ৫০,০০০ ফ্লোরিন প্রদানে বাধ্য করেন। এর পর নওয়াব ক্ষতিপূরণ বাবদ ওলন্দাজদের কাছে ৫০ লক্ষ টাকা দাবি করেন এবং তাদের কাসিমবাজার বাণিজ্যকুঠি দখল করে নেন। ওলন্দাজরা অর্ধেক অর্থ প্রদান করে এবং ইংরেজদের সহায়তায় ১৭৫০ সালের ২৩ আগস্ট একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করতে সমর্থ হয় যার শর্তাবলি ওলন্দাজদের জন্য ছিল অত্যন্ত কঠোর।

ইংরেজরা দুবার ওলন্দাজদের সাহায্য করা সত্ত্বেও লন্ডনস্থ কর্তৃপক্ষ ওলন্দাজদের প্রতি কঠোর ব্যবহার করতে ইংরেজদের নিষেধ করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত ছিল। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভ এবং ১৭৬৫ সালে তাদের  দীউয়ানি লাভ ওলন্দাজদের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে ফেলে।

ওলন্দাজদের বাণিজ্যিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। তাদের সুতি থান বস্ত্রের রপ্তানির পরিমাণ ১৭৫৮ সালের ৭৯,০০০ থান থেকে ১৭৬৪ সালে ৪৭,০০০ থানে হ্রাস পাওয়া থেকেই এ বাণিজ্যিক অবনতি অনুধাবন করা যায়। ১৭৫৭ সালের পরে শোরাআফিম এর বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া অধিকারের ফলে সুতি থান বস্ত্রের ব্যবসার ওপর ওলন্দাজদের নির্ভর করতে হয়েছিল।

ওলন্দাজদের প্রতি ইংরেজদের সহানুভূতিশীল মনোভাবের একটি কারণ ছিল, ইংরেজ কর্মকর্তারা ওলন্দাজদের হুন্ডি কিনে দেশে টাকা পাঠাত। এ ব্যবস্থা বাংলায় কাঁচা রেশম ও সুতি থান বস্ত্রে পুঁজি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ওলন্দাজদের সাহায্য করেছিল। আঠারো শতকের সত্তরের দশকে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা এবং এ অর্থ যোগানের জন্য তাদের হিরণ্য আমদানির প্রয়োজন হতো না। এ থেকে ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের উন্নতি অনুধাবন করা যায়। অবশ্য গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এর দায়িত্ব গ্রহণের পর ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের অবনতি ঘটে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আঠারো শতকের নববইয়ের দশকে বস্ত্তত ওলন্দাজদের বাণিজ্যের সমাপ্তি ঘটে।

একথা সত্য যে, ওলন্দাজরা আমস্টারডামের ‘হীরেন সেভেনটিন’ (পরিচালনা পর্ষদ)-এর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ বা সহায়তা লাভ করে নি। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, বাংলায় কর্মরত ওলন্দাজ কর্মকর্তারা রাজ্যজয়ে তেমন উৎসাহীও ছিলেন না। পলাশীর যুদ্ধের পর নওয়াব মীরজাফর ও খাজা ওয়াজিদ ইংরেজদের উৎখাতের চেষ্টা করেন। তারা ওলন্দাজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদেরকে বাংলা আক্রমণ এবং ইংরেজদের সমান শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু তাদের এ জুয়ার চাল শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং বাংলার বাণিজ্য জগৎ থেকে ওলন্দাজরা ক্রমান্বয়ে বিতাড়িত হয়। [সুশীল চৌধুরী এবং অনিরুদ্ধ রায়]

গ্রন্থপঞ্জি  Om Prakash, European Commercial Enterprise in Pre-Colonial India, Cambridge, 1998; S Chaudhury, The Prelude to Empire –Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000; S Chaudhury, From Prosperity to Decline – Eighteenth Century Bengal, New Delhi, 1995; Om Prakash, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, Princeton, 1985; KN Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company, Cambridge, 1978।