ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি  রানী প্রথম এলিজাবেথ প্রদত্ত সনদের (১৬০০ সাল) মাধ্যমে সৃষ্ট ব্রিটিশ নৌ-সংগঠনটি প্রাচ্যের জলপথে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে এবং পরবর্তীসময়ে ভারতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। পনেরো ও ষোল শতকে আন্তঃমহাসাগরীয় যোগাযোগ উন্মক্ত হওয়ার পর পশ্চিম ইউরোপের নৌ-জাতিসমূহ বহির্দেশে উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ পায়।

প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ  ১৬০০ সালে রানী এলিজাবেথ প্রদত্ত সনদ এর মাধ্যমে সৃষ্ট কোম্পানির প্রাথমিক নাম ছিল ‘The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies ’ . অনেক বছর পর্যন্ত কেবল ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই প্রাচ্যে সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করত। ১৬০৮ সালে কোম্পানির এমনি একটি সমুদ্র যাত্রা সুরাটে পৌঁছালেও কোনো পণ্য আদান-প্রদান হয়নি। ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণকারী পর্তুগিজেরা তাদেরকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৬১২ সালে কোম্পানি মুগল প্রশাসন থেকে সুরাটে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করলে পর্তুগিজদের মোকাবেলা করার জন্য কোম্পানি তাদের সমশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাজা প্রথম জেমস্ ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো’কে সম্রাট জাহাঙ্গীরএর দরবারে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। রো কর্তৃক রাজার পক্ষ থেকে সম্রাটকে উপঢৌকন প্রদান এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহার সম্রাটকে সন্তুষ্ট করে। ফলশ্রুতিতে সম্রাট এর নিকট দূত এর সব প্রার্থনা মঞ্জুর হয় এবং কোম্পানি দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে ‘ফ্যাক্টরি’ বা বাণিজ্যকুঠি নামে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করার সুযোগ লাভ করে। ১৬৩৯ সালে কোম্পানি ওয়ান্ডিওয়াশ এর স্থানীয় প্রশাসকের কাছ থেকে মাদ্রাজে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে কোম্পানি এ স্থান নিজেদের ভূখন্ডের ন্যায় শাসন করার অধিকার পায়। কোম্পানি মাদ্রাজে সেন্ট জর্জ ফোর্ট নির্মাণের পর তা ভারতে কোম্পানি বাণিজ্যের সদর দফতরে পরিণত হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৩৩ সালে মহানন্দা বদ্বীপের হরিহরপুরে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপনের মাধ্যমে বাংলায় ব্যবসা বানিজ্য শুরু করে। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দুই তারিখে ইংরেজগণ সম্রাট শাহ জাহান থেকে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি সম্বলিত একটি ফরমান লাভ করে। কোম্পানি বাংলার সুবাহদার  শাহ শুজা এর কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পায়। তিনি ইংরেজদেরকে বার্ষিক নামমাত্র তিনহজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন। এ সুবিধাটি পরবর্তী সময়ে কোম্পানিকে বাংলার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করে। একই বছরে ইংরেজরা হুগলিতে তাদের ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। ১৬৫৮ সালে তারা কাসিমবাজারে এবং ১৬৬৮ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকায় একটি করে নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন করে। জব চার্নক কর্তৃক ১৬৯০ সালে কলকাতা শহর পত্তনের মাধ্যমে ফ্যাক্টরি স্থাপন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। এর পর থেকেই বাংলায় কোম্পানির কর্তৃক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বাংলা সুবায় কোম্পানি তাদের দাবিসমূহ ও তার অর্জনকে সব সময় আইনগত অধিকার হিসেবে দেখেছে। ১৬৯৬ সালে শৈাভ সিং-এর বিদ্রোহ কোম্পানিকে তার কলকাতা বসতির নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। বালার সুবাহদার এর সামরিক তাৎপর্য অনুধাবন না করেই কোম্পানিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অনুমতি প্রদান করেন। কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুরের জমিদারি ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানির এর প্রভাব বিস্তারের পরবর্তী ধাপের সূচনা করে এবং এর ফলে নীরবে বাংলায় কোম্পানির একটি শক্তির ভিত্তি রচিত হয়। ১৬৯৮ সালে কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি কোম্পানি গঠিত হয়। এটি ‘General Society Trading to the East Indies’ নামে সংসদীয় ভাবে অঙ্গীভূত হয়। এ ঘটনা সমূহের পথ ধরেই কলকাতায়  ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ স্থাপিত হয় এবং ১৭০০ সালে এটি একটি স্বাধীন প্রেসিডেন্সিতে রূপান্তরিত হয়। ১৭০২ সালে দুপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘East India Companies’ একটি নতুন সনদের মাধ্যমে একীভূত হয় এবং নতুন নাম হয় ‘The United Company of Merchants of England Trading to the East Indies’. যদিও শেষ সময় পর্যন্ত এটির প্রচলিত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামই বহাল থাকে।

আঠারো শতকের শুরু থেকেই কোম্পানি বাংলায় তাদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে থাকে। বাংলায় আগমনকারী জাহাজের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তে থাকে। এ সময়টি ছিল বাংলার বিখ্যাত শাসক মুর্শিদকুলী খানের শাসনামল। তাঁর সময়ে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যপক উন্নয়ন ঘটে। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর কোম্পানি কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে। কিন্তু মুর্শিদকুলী খান দৃঢ়ভাবে নতুন সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিরোধিতা করেন এবং পুরনো সুবিধাদি কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।

চৌকি বা কাস্টম হাউস গুলিতে কোম্পানি কর্মকর্তাদের হয়রানির বিষয়টিতে কোম্পানি ক্ষুব্ধ হয়। তাছাড়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানির দস্তক এর ব্যবহার এবং বিনা শুল্কে ব্যবসা করার চেষ্টা প্রায়শ উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে। সঠিকভাবে মালামাল যাচাই করার অজুহাতে প্রায়ই কোম্পানির বানিজ্য নৌকাসমূহ চৌকীতে থামানো হতো। মুর্শিককূলী খান নতুন সুবিধা প্রদানে কোম্পানির দাবির প্রতি কখনও নত হন নি। সুযোগ সুবিধা লাভের লক্ষ্যে কলকাতা কাউন্সিল জন সারম্যান এর নেতৃত্বে প্রচুর উপঢৌকনসহ একটি প্রতিনিধি দল সম্রাট ফররুখ সিয়ার এর নিকট প্রেরণ করে। সারম্যান প্রতিনিধি দলকে সম্রাট উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং হূষ্টচিত্তে একটি ফরমান প্রদান করেন। এটি সাধারণত ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান নামে পরিচিত। (ফরমানে বর্ণিত তারিখটি ছিল- ৩০ ডিসেম্বর, ১৭১৬) বাংলার সুবাহদারকে এ ফরমানের মাধ্যমে কোম্পানিকে নিম্নোক্ত সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়:

১.    কোম্পানির বর্তমান সুবিধাদির অতিরিক্ত হিসেবে কলকাতা বসতির পাশ্ববর্তী ৩৮টি মৌজার জমিদারি দেওয়া হবে।

২.    কোম্পানি এবং অন্যান্য ইংরেজদের কোনো পণ্য চুরি গেলে, চুরি হয়ে যাওয়া পণ্যসমূহ উদ্ধারের ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। পণ্য উদ্ধারে ব্যর্থ হলে ক্ষতিপূরণ অবশ্যই প্রদান করতে হবে।

৩.    সুরাট মানের মাদ্রাজি টাকার অবমূল্যায়ন না করে একই মানে বাংলায় তা চালু করতে হবে।

৪.    মূল সনদ প্রদর্শনের জন্য দাবি করা যাবেনা।

৫.    কোম্পানির কাছে দায়বদ্ধ বা ঋণগ্রস্ত এমন সব ব্যক্তিদেরকে ফ্যাক্টরি প্রধানের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

৬.    ফ্যাক্টরি প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত দস্তকপ্রাপ্ত পণ্য চৌকি দ্বারা থামানো বা পরীক্ষা করা যাবেনা।

৭.    সুবাহদার কোম্পানিকে মুর্শীদাবাদ টাকশাল থেকে মুদ্র জারি করার বিষয়ে অনুমতি দিবে।

কোম্পানি ভাল করেই জানত যে, এ সনদ দ্বারা প্রাপ্ত অধিকারসমূহ সুবাহদার মানতে চাইবেন না। কারণ এ সনদটি সম্রাট এর কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে লাভ করা হয়েছিল যা রাজ্যের সার্বভৌমত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফরমানে দফাসমূহ বিস্তারিত ভাবে বলা হয়নি যা দস্তকের আওতাধীন ছিল। সুতরাং নওয়াবের চৌকিসমূহ এবং কোম্পানির কর্মকর্তাগণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন এবং প্রায়শই বিরোধপূর্ণ পরিবেশ সৃস্টি করে যা কখনো কখনো খন্ড যুদ্ধের রূপ নেয়। যখন কোম্পানির কর্মকর্তাগণ লক্ষ করে যে, নওয়াব নিজেই আইনভঙ্গকারীদের গ্রেফতার ও অন্তরীণ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয়। তবে মুর্শিদকুলী খান সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ পরিহার করার চেষ্টা করেন।

১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন খান ক্ষমতা দখল করলে কোম্পানি তাদের  দাবি সমূহকে পুরোপরি কার্যকরী করার সুযোগ পায়। বিশেষ করে ৩৮টি গ্রামের উপর কোম্পানির জমিদারী কর্তৃত্ব পাওয়ার বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য। সুজাউদ্দীন খান তাঁর পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য বাধাহীন রাখার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি কোম্পানির সঙ্গে যে কোনো ধরনের বিরোধ পরিহার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লবণ বাণিজ্য নিয়ে অবশেষে কোম্পানি ও সুবাহদারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। লবণ ব্যবসাকে কোম্পানি শুল্ক মুক্ত পণ্য হিসেবে দাবী করলেও  নওয়াব একে শুল্ক মুক্ত পণ্য মনে না করায় দুপক্ষের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। জগৎ শেঠ এর মধ্যস্থতায় এই দ্বন্দের অবসান ঘটে। প্রশাসন এবং কোম্পানির বিশ্বাসভঙ্গের প্রধান কারণ ছিল দস্তক এর আবরণে কোম্পানি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা। কোম্পানির কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় ব্যপকভাবে দস্তকের সুবিধা ভোগ করতে থাকে। কোম্পানি তাদের মালবাহী নৌকাসমূহকে পরীক্ষা করার জন্য চৌকি গুলিকে অনুমতি দিত না। কারণ তারা দাবী করত যে, ১৭১৭ সালের রাজকীয় ফরমান তাদেরকে এ পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।

নওয়াবের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঠান্ডা হওয়া সত্ত্বেও সুজাউদ্দীন খানের আমলে (১৭২৭-১৭৩৯) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার প্রতি কোম্পানির আগ্রহও বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন নওয়াব যাতে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতায় আসীনাকেন এমন ধরনের নীতি কোম্পানি গ্রহণ করেছিল। কোম্পানি এমন  একটি সুযোগ আলীবর্দী খানের শাসনামলেই (১৭৪০-১৭৫৬) পেয়ে যায়। মারাঠাদের দ্বারা বার বার আক্রমণে বিপর্যস্ত আলীবর্দী খান অনুধাবন করেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আরও সংকট বড়ানো সমীচিন হবেনা। পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদের মসনদে সিরাজউদ্দৌলা আসীন হওয়ার পর মারাঠাদের আক্রমণও বন্ধ হয়ে যায়। সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানিকে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য তিনটি শর্ত মেনে চলার নির্দেশ দেন। (ক) কলকাতার অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে (খ) ইংরেজগণ অবশ্যই দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং (গ) তাঁদের এদেশের আইন মেনে চলতে হবে। ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল নওয়াবের নির্দেশ অমান্য করায়  নওয়াব কলকাতা অভিযান করেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করেন। বিতাড়িত ইংরেজরা হুগলী নদীর ভাটিতে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। এ বিজয়কে স্মরণীয় করার জন্য সিরাজউদ্দৌলা তাঁর মাতামহের নামানুসারে কলকাতার নাম রাখেন আলীনগর। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার এ অভিযানের প্রতি ফরাসিদের নৈতিক সমর্থন ছিল।

এ সময় ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ চলছিল। ব্রিটিশদের কাছে সিরাজউদ্দৌলার আলীনগর পদক্ষেপটি একাধিক পরাজয়ের সমান বলে গণ্য হয়েছিল। প্রথমত স্থানীয় নওয়াবের কাছে এবং দ্বিতীয়ত ফরাসিদের কাছে যারা নওয়াবকে সমর্থন করেছিল। শীঘ্রই মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে নতুন সৈন্যদল আসে। রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি কলকাতা পুনর্দখল করেন এবং হুগলির মুগল বন্দর ধ্বংস করেন। তরুণ নওয়াবের বিরোধী মুশীর্দাবাদ দরবারের একটি উপদলের সঙ্গে জগত শেঠ এর নেতৃত্বে সংলাপ শুরু হয়। ইংরেজদের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীগণ একটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তিতে সম্প্রতি বরখাস্তকৃত নওয়াবের বখশী মীরজাফরকে বাংলার ভবিষ্যৎ নওয়াব হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীতে একটি পাতানো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নওয়াবের অধিকাংশ সৈন্য মীরজাফর ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং মীরজাফরের পুত্র মীরন কর্তৃক নিহত হন।

কোম্পানির অবলুপ্তির সূচনা পাশ্চাত্যের ইতিহাসে ১৮ শতকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বাধিক বড় দুই শক্তি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যেকার ‘সপ্তবর্ষ ব্যাপী’ যুদ্ধের ফলাফল পলাশীর যুদ্ধের প্রভাবক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। কারণ একই সময়ে সিরাজউদ্দৌলা এবং তার মিত্র শক্তি ফরাসিদের পরাজয় ঘটেছিল। যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয় একাধারে মুর্শিদাবাদের মসনদে একজন পুতুল নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ সহ বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও ইংরেজদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থানের পথ রচিত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পরই ইংরেজ শক্তি পুতুল নবাবের কাছ থেকে ২৪ পরগনাকে উপহার হিসেবে আদায় করে নেয়। ১৭৬০ সালের মধ্যে বাংলার তিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী জেলা (বর্ধমান, মেদেনীপুর এবং চট্টগ্রাম) কোম্পানি অধিগ্রহন করে নেয়। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি ও রাজস্ব ক্ষমতা গ্রহন করে। ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বাংলার প্রশাসনের সঙ্গে রাজস্ব ক্ষমতা ভাগাভগি করলেও তারা প্রশাসনিক কোনো দায়-দায়িত্ব সরাসরি গ্রহন করেনি। কোম্পানির পক্ষে সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান রাজস্ব সংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এ সময়েই কোম্পানী ও তার কর্মচারিদের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে বাংলার সম্পদ নির্বিচারে ধ্বংস হয়েছে। ফলে দেশের শুধু অর্থনীতিতেই না, আইন শৃংখলা পরিস্থিতিরও দ্রুত অবনতি ঘটে। কোম্পানির এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার ফলেই ১৭৬৯-৭০ সালে দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের প্রাণহানী ঘটে। ক্ষমতা দখল করে কোম্পানি কেবল বাংলায় দুর্যোগ ডেকে আনে নি, বরং তা নিজের সর্বনাসের কারন হয়ে দাড়ায়। কোম্পানি ও তার কর্মচারি দুবৃত্তের মত তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নেই ব্যস্ত ছিল। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের পর কোম্পানির আয় ব্যায়ের হিসাবে শুধু লোকশানই হতে থাকে। ক্রমাগত লোকশান কোম্পানিকে শেষপর্যন্ত ১৭৭১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ  থেকে ঋণের আবেদন করতে হয়। সরকার ঋণ প্রদানে সম্মত হয় এবং একই সঙ্গে ১৭৭৩ সালে  রেগুলেটিং অ্যাক্ট অকার্যকর করার মাধ্যমে কোম্পানির কাজে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা লাভ করে।

কোম্পানি আমলের সমাপ্তি সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট দুটি সমান্তরাল বিষয়ের জন্ম দেয়। (১) কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সরকারি (ব্রিটিশ) নিয়ন্ত্রণ প্রবেশ করে এবং (২) ১৮৫৮ সালে কোম্পানির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হওয়া পর্যন্ত সময়ে কোম্পানির ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা কিভাবে চলবে সে বিষয়ে রেগুলেটিং অ্যাক্টে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় সরকার প্রয়োজনবোধে যে কোনো সময় হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। ১৭৮৪ সালে সরকার ভারতে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের একটি বিশদ আইন তৈরি করে। কোম্পানি ব্যবস্থাপনা তদারকি করার জন্য একটি স্থায়ী সংসদীয় কমিটি বোর্ড অব কন্ট্রোল গঠন করা হয়। বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের কোনো সদস্য দ্বারা বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হওয়ার জন্য মনোনীত ক্যাডেটদের কাছ থেকে কোনো উপঢৌকন বা উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কর্নওয়ালিসকে বিশেষ কিছু নির্দেশ বাস্তবায়িত করার জন্য একজন গভর্নর জেনারেল হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। কোম্পানির অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও কর্নওয়ালিস একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো তৈরি করেন। উপঢৌকন গ্রহণ করা এবং ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিষয়ে কর্মকর্তাদের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

বেসরকারি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের চাপে ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার অনেকটা শিথিল করা হয়। কোম্পানির জাহাজসমূহের মধ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহণের সংরক্ষিত জায়গা রাখার ব্যবস্থা হয়। অ্যাক্ট কোম্পানির অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করে এবং ভারতে কোম্পানি পরিচালিত রাষ্ট্রকে ব্রিটিশ রাজা বা রাণীর অধীনস্থ করা হয়। এরপর থেকে রাজা বা রানীর পক্ষে কোম্পানি ভারত শাসন করার এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল গভর্নর জেনারেল নিয়োগের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। লর্ড ওয়েলেসলী, যিনি কোম্পানির বাংলা ভিত্তিক রাষ্ট্রকে ভারতীয় সাম্রাজ্যে রূপ দেন তাকে বোর্ড অব কন্ট্রোল নিয়োগ দিয়েছিল। ভারতে কোম্পানির ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একটি অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এবং মুক্ত বাণিজ্যের ব্যবসায়ীগণের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্লামেন্ট কোম্পানির স্বার্থ হানিকর কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৮১৩ সালের চার্টার আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার রদ করার সিদ্ধান্তটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তখন মুক্ত বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। একটি বাণিজ্যিক সংগঠন হিসেবে কোম্পানিকে এরপর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলির সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে।

ভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত না থাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে একটি দুর্বল সংগঠনে পরিণত হয়। উপরন্তু, কোম্পানির প্রশাসনিক অংশের কারণে বাণিজ্যিক অংশ ম্লান হয়ে যাওয়ায় কোম্পানির বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় যোগ্য ব্রিটেনবাসী আকৃষ্ট হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ১৮৩৩ সালের চার্টার আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বাণিজ্যিক তৎপরতা বিলুপ্ত হয়। তবে চীন দেশে বাণিজ্য করার অনুমাতিটি বহাল রাখা হয়।

এরপর থেকে কোম্পানি রাজার পক্ষে একটি প্রশাসনিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। কোম্পানির কভেনান্টেড সিভিল সার্ভিসে ক্যাডেট মনোনীত করা ছিল কোম্পানির একমাত্র ক্ষমতা। এ সুবিধাটিও ১৮৫৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে সীমিত করা হয়। কোম্পানির সর্বশেষ সম্মান এবং সুবিধাটি ছিল ডাইরেক্টর কর্তৃক সিভিল সার্ভিসে ক্যাডেট মনোনীত করা। ১৮৫৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের অধীনে কোম্পানির এ সুবিধাটিও রদ করা হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে সিভিলিয়ান নিয়োগের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং দুশত বছর ধরে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এরপর একটি খোলসে পরিণত হয় এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব এর পর ১৮৫৮ সালে রানীর ঘোষণার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আনুষ্ঠানিক ভাবে বিলুপ্ত হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]