ফরাসি, জাতি

ফরাসি, জাতি ফরাসিরা সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে সুরক্ষিত বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। ১৬৭৪ সালে মাদ্রাজের ৮৫ মাইল দক্ষিণে দেশীয় এক শাসক কর্তৃক প্রদত্ত ভূমিখন্ডের ওপর ফ্রাঁসোয়ঁ মার্টিন ফরাসি অধিকৃত ভারতের ভবিষ্যত রাজধানী পন্ডিচেরি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরেই বাংলার সাথে ফরাসিদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়, দিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় আরও অনেক পরে। ১৬৯০ সালে হুগলি নদীর তীরে চন্দননগরে একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত হয়। ১৬৭৪ সালে কলকাতার উত্তরে নওয়াব কর্তৃক প্রদত্ত জমির উপর এ কুঠি নির্মিত হয়েছিল। কিস্তিতে চল্লিশ হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে ফরাসিরা ১৬৯৩ সালে একটি ফরমান লাভ করে। চন্দননগর ছাড়াও কাসিমবাজার এবং বালেশ্বরে তাদের কুঠি নির্মিত হয়েছিল।

ইউরোপীয় যুদ্ধে ১৬৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ওলন্দাজদের হাতে পন্ডিচেরির পতন ঘটে। সুরাটে তাদের কুঠি ঋণভারে জর্জরিত হওয়ায় ফরাসিরা বাংলায় তাদের ব্যবসা কেন্দ্রীভূত করে। দেলান্দ আর্মেনীয়দের কাছ থেকে সোরা ও রেশম সংগ্রহ করলেও ওলন্দাজরা গঙ্গার মোহনা অবরোধ করে রাখায় তিনি জাহাজগুলি পাঠাতে পারেন নি। শোভা সিংরহিম খান এর বিদ্রোহের সুযোগে ফরাসিরা চন্দননগরে তাদের কুঠিতে একটি পরিখা ও দুটি বুরুজ সংযোজন করে। বিদ্রোহীরা কাসিমবাজারে অবস্থিত ফরাসিদের কুঠি লুণ্ঠন করেছিল। ১৬৯৫ সাল নাগাদ ফরাসিরা দেওয়ান কেফায়েত খানের কাছ থেকে ওলন্দাজদের ন্যায় ৪% আমদানি রপ্তানি শুল্ক প্রদানের অনুমতি সম্বলিত অপর একটি পরওয়ানা লাভ করে। ইউরোপে শান্তি ফিরে এলে ফরাসিদের পণ্য বোঝাই দুটি জাহাজ ১৬৯৭ সালে ইউরোপ ছেড়ে আসতে পেরেছিল। তাঁতিদের অগ্রিম প্রদান করার মতো নগদ অর্থ না থাকায় তখনও পর্যন্ত ফরাসিরা সমস্যায় ছিল।

১৭০০ সালে থেকে প্রধানত আর্থিক সমস্যার কারণে বাংলায় ব্যবসা ও বাণিজ্য অব্যাহত রাখা ফরাসিদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। উচ্চ মূল্যের বস্ত্র ছাড়া অন্যান্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নগদ অর্থের অভাবের কারণে নদীপথে কর আদায়কারী চৌকিগুলি আরও সমস্যা সৃষ্টি করে। দেশে অর্থাভাবে বিপর্যস্ত ফরাসি কোম্পানি সোনারূপার বাটের পরিবর্তে অধিক পরিমাণে ইউরোপীয় পণ্যসামগ্রী সহ জাহাজ পাঠাতে শুরু করে; কিন্তু সেসব পণ্য সহজে ভারতে বিক্রি করা যেত না। অপর একটি ইউরোপীয় যুদ্ধের শুরু এবং বাংলায় ফরাসি জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে ওলন্দাজদের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে। দেলান্দের (Deslandes) উত্তরসূরি ডু লিভা (Du Livier) এ অবস্থার কোন উন্নতি করতে পারেন নি।

১৭০৮ সালের শেষের দিকে যখন ফ্লাকোর্ট বাংলায় কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ফরাসিরা তিন লক্ষ লিভারেরও অধিক ঋণের দায়ে আবদ্ধ ছিল। গুদাম থেকে সোরা বিক্রি করে এবং চন্দননগরের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছিল। বাংলায় সেন্ট মেলোর বণিকদের জাহাজগুলির আগমনে এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এরা ১০% লভ্যাংশের বিনিময়ে ইন্দো-চীন ব্যবসার অধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু তারা ঋণের অর্থ পরিশোধ করে নি এবং কর্মচারীদের বেতনও প্রদান করে নি। পাওনাদারগণ দেওয়ানের কাছে অভিযোগ পেশ করলে ঋণ পরিশোধের জন্য তিনি ফরাসিদের এক বছর সময় দেন। ১৭১৫ সাল থেকে সেন্ট মেলোর কোম্পানি ফ্রান্সে ঋণ পরিশোধ করা শুরু করে, অথচ বাংলায় পাঁচ লক্ষসহ ভারতে তাদের দায় দেনার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০ লক্ষ লিভারে, যদিও সেন্ট মেলো কোম্পানি নিয়মিতভাবে ভারতে জাহাজ প্রেরণ করছিল।

১৭১৯ সালে জাঁ ল প্যারিসে মোটা অংকের তহবিলসহ একটি নতুন কোম্পানি গঠন করেন। বাংলায় কোম্পানির নতুন পরিচালক হার্ডনকোর্ট কয়েকটি গ্রাম বন্দোবস্ত নেন এবং সেগুলির উপরই চন্দননগর গড়ে ওঠে। ১৭১৯ সালে তিনি সম্রাট ফররুখ সিয়ারএর কাছ থেকে একটি ফরমান লাভ করেন যার দ্বারা আমদানি রপ্তানি শুল্ক আড়াই শতাংশে হ্রাস করা হয়। ১৭২১ সালে নবাব জাফর খান কর্তৃক জারিকৃত একটি পরওয়ানা দ্বারা এটি অনুমোদন করা হয়েছিল। নতুন কোম্পানি তাদের ঋণ পরিশোধ এবং সোরা ও দামী বস্ত্র ক্রয়ের জন্য ৪০ লক্ষ লিভারেরও বেশি মূলধন পাঠায়। ১৭২১ সাল নাগাদ পারস্যে চাল, চিনি ও বস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে ফরাসিদের আন্ত-এশীয় বাণিজ্য সংগঠিত করা হয়েছিল। দাসী ক্রয়বিক্রয়সহ ব্যক্তি খাতের বাণিজ্য তখনও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বুরবোঁ দ্বীপে চাষাবাদের কাজ শুরু হলে প্যারিস কর্তৃপক্ষ দাস-বালকদের সেখানে পাঠাতে আপত্তি করে নি।

অধিক কর প্রদানের চাপ এবং প্রায়শই এ নিয়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের সাথে সহিংস দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে নতুন সম্রাট মাহমুদ শাহের কাছ থেকে ফরাসিদের আরও একটি ফরমান লাভের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ইতোমধ্যে ফ্রান্সে কোম্পানির কাঠামো পুনর্গঠন করা হয়েছিল। ১৭২৬ সালের ২৭ জানুয়ারির একটি প্রশাসনিক আদেশ বলে আন্ত-এশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়। কোম্পানির অর্থব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের জন্য ডুমাসকে পন্ডিচেরিতে এবং ডাইরয়েসকে বাংলায় পাঠানো হয়। পারস্য, লোহিত সাগর ও আফ্রিকার উপকূলসমূহ থেকে বাণিজ্য জাহাজ আসতে শুরু করায় ফরাসিদের কায়কারবারে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এসব দেশে ফরাসিরা পণ্য রপ্তানি করছিল।

নতুনভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়ায় চন্দননগরে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের সমাগম ঘটে। দিরো (Dirois) বদ্ধ পানিতে পরিপূর্ণ চক নাসিরাবাদ নামে পরিচিত জলাভূমি ক্রয় করে তা পরিষ্কার করান। ফরাসি বসতি সম্প্রসারণ করে বোরোগুইচেমপুর পর্যন্ত এর একদিকের প্রান্তসীমা বিস্তৃত করা হয়। দিরো (Dirois) কাসিমবাজার কুঠিকেও পুনরায় কর্মচঞ্চল করে তোলেন এবং ১৭২৬ সালে ঢাকায় একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি লাভ করেন।

এফ. মার্টিনের (মৃত্যু ১৭০৫) স্মৃতিকথা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দেলান্দ (Deslandes) ১৬৮৯ সালে ঢাকা থেকে পণ্য ক্রয় করতেন এবং সেখানে তিনি একটি কুঠি স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে তা তিনি করতে পারেন নি। তিনি গ্রেগোয়ের বুতেতকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে কোন জমি আয়ত্ত করা হয় নি। অবশ্য বুতেত পরে চাকরি ছেড়ে দেন। হুগলি এলাকায় জমি ক্রয়ের বিশদ বর্ণনা প্রদান করলেও মার্টিন কিন্তু ঢাকা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেন নি। ঢাকায় ফরাসি ভবন ক্রয় করা হয়েছিল ১৭৫২ সালে এবং তা অবস্থিত ছিল ঐ স্থানটিতে যেখানে পরবর্তী সময়ে আহসান মঞ্জিল স্থাপিত হয়। তেজগাঁয়ে ফরাসিদের একটি বাগানও ছিল।

আন্ত-এশীয় ব্যবসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি খাতের ব্যবসা শুরু হওয়ার সাথে সাথে ১৭২৩ সাল থেকে চন্দননগরের সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭২৬ সাল নাগাদ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে লেনদেনের গড় পরিমাণ ছিল বার্ষিক পনেরো লক্ষ লিভার যা ১৭৩০ সাল নাগাদ বেড়ে পঁচিশ লক্ষ লিভারে দাঁড়িয়েছিল। কোন কোন বছরে সোনা রূপার বাটের আমদানি ছিল বার্ষিক প্রায় বিশ লক্ষ লিভার মূল্যের। ফ্রান্সে বিক্রয়োত্তর মুনাফা গড়ে প্রায় ২০০%-এ এসে দাঁড়িয়েছিল, যদিও চাল ও সোরা বা যবক্ষার খাত থেকে মুনাফা আসছিল ৩০০%-এরও অধিক। ফ্রান্স ও ভারতে সকল খরচ বাদ দেওয়ার পর এ মুনাফা দাঁড়িয়েছিল ১০ শতাংশে।

১৭৩৭ সালে চন্দননগর পরিদর্শনকারী শেভেলিয়ার ডি অ্যালবার্টের বর্ণনায় দেখা যায় যে, ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত তিনটি ইউরোপীয় বসতির মধ্যে ফরাসিদের বসতিটি ছিল খুবই কম সুরক্ষিত। সেখানে চারটি বুরুজ ছিল, কিন্তু প্রবেশদ্বারগুলি ছিল দুর্বল। পরিচালক, বণিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের আবাসভবন এবং গুদাম, গৃহসংলগ্ন প্রার্থনাকক্ষ ও সেনাছাউনিগুলি ছিল প্রশস্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যকর। নদী তীরবর্তী শ্রেণিবদ্ধ গৃহগুলি ছিল একতলা। জেসুইট ও ক্যাপুচিন এ উভয় সম্প্রদায়েরই নিজস্ব গির্জা ছিল, হিন্দুদের জন্য ছিল কয়েকটি মন্দির। আর্মেনীয়, হিন্দু, মুসলমান ছাড়াও ঐ সময়ে সেখানে পর্তুগিজ সহ প্রায় পাঁচশ ইউরোপীয় ছিল। সেখানে সম্ভবত ভারতীয় বংশোদ্ভূত দেড় হাজারের মতো খ্রিস্টান এবং ক্রীতদাসরা ছিল। বার্ষিক দুহাজার টাকা রাজস্ব প্রদান করে ফরাসিরা চার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিল। ফরাসিরা তাদের নিজেদের আইন অনুযায়ী শহরের বিচারকার্য সম্পাদন করত এবং চূড়ান্ত আপিলের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল পন্ডিচেরি কাউন্সিলের উপর। ফরাসিরা অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর সাথে সোনারগাঁও-এর নানা ধরনের মসলিন ক্রয় অব্যাহত রেখেছিল।

কোন ফরমান না থাকায় ফরাসি ও নওয়াবের কর্মচারীদের মধ্যে প্রায়শই সম্পর্কের অবনতি ঘটত যেমনটি হয়েছিল ১৭২৮ সালে। কাসিমবাজারে একজন ফরাসি কর্মকর্তা নাজেহাল হন এবং ফরাসিরা নওয়াবের কাছ থেকে এর সন্তোষজনক প্রতিবিধান দাবি করে। কিন্তু কোন ফরমান না থাকায় নওয়াব তাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ফরাসি নৌযানগুলি আটক করে দুজন ফরাসিকে হত্যা করা হয়। ফরাসিরা গঙ্গায় একটি যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক এসময় ডুপ্লে পরিচালক হিসেবে চন্দননগর আসেন এবং বিষয়টির আপসমীমাংসা করেন। ফরাসিরা আড়াই শতাংশ হারে আমদানি রপ্তানি শুল্ক প্রদান অব্যাহত রাখে। পুনরায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে ১৭৩২ সালে এবং ডুপ্লে এবারও নগদ অর্থ ও উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে নওয়াবকে শান্ত করেন।

পূর্ববঙ্গের ঢাকায় একটি কুঠি স্থাপনের জন্য ১৭২২ সালে ফরাসিদের অনুমতি দেওয়া হলেও তারা সে অনুমতি কাজে লাগায় নি। ১৭৩৫ সালে সন্দ্বীপের নিকটবর্তী জগদিয়ায় (এখন সমুদ্রগর্ভে বিলীন) ফরাসি কুঠির কর্মকান্ড শুরু করা হয়। দুজন এশীয় খ্রিস্টান ইগনেস ও টেচিয়ারকে গর, তাফেতা ও চিরুনি সংগ্রহের জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। এ কুঠির সঠিক অবস্থা নির্ণয় করা খুবই কঠিন, কারণ এর কার্যক্রম ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ১৭৫৭ সালে কুঠিটি নদী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ১৭৩৫ সালে ফরাসিরা চল্লিশ হাজার টাকা মূল্যের কাপড় কিনেছিল।

১৭৩৬ সালে পেগু থেকে ফেরার পথে একটি ফরাসি জাহাজ চট্টগ্রামে নোঙর করে। চট্টগ্রামে জাহাজ ভিড়াবার কোন আইনানুগ অধিকার ফরাসিদের না থাকায় স্থানীয় কর্মকর্তারা জাহাজের বণিক ভিগে ও মালামালের একটি অংশ আটক করে। ১৭৩৬ সালে ইংরেজরা সেখানে শুল্কমুক্ত ব্যবসার যে অধিকার লাভ করেছিল ডুপ্লে তেমন একটি পরওয়ানা লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু হাজী আহমদ এর জন্য এত বেশি অর্থ দাবি করেন যে, শেষ পর্যন্ত ডুপ্লে পরওয়ানা লাভের চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন।

কোন দালাল বা মুদ্রা যাচাইকারীর মধ্যস্থতা ছাড়াই বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনারূপার বার মুগল মুদ্রায় রূপান্তরিত করার জন্য এগুলি বাংলার টাকশালে নিয়ে আসার অনুমতি সম্বলিত পরওয়ানা ইংরেজ ও ওলন্দাজদের ছিল। দেলান্দকে (Deslandes) বহু পূর্বেই এই অনুমতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ফরাসিরা তখন এটি কাজে লাগায় নি। ১৭৩১ সালে থেকেই ডুপ্লে (Dupleix) এ পরওয়ানা লাভের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন; কিন্তু মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী ফতেহ চাঁদ তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। ১৭৩৭ সালে বিষয়টি সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছে এবং ডুপ্লেকে পরওয়ানা লাভের জন্য নওয়াবকে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করতে হয়েছিল। ১৭৩৮ সালের ১০ জানুয়ারি পরওয়ানাটি জারি করা হয়।

ডুপ্লে বাংলায় পৌঁছেই নওয়াবের কাছ থেকে ওলন্দাজদের মতো আড়াই শতাংশ হারে আমদানি রপ্তানি শুল্ক প্রদানের অনুমতি সম্বলিত একটি পরওয়ানা লাভ করেন। এ সময়ের মধ্যে গর, চিরুনি, রুমাল, মলমল, তানি সিল্ক, তানজেব, নয়নসুখ প্রভৃতি বস্ত্র ক্রয়ের জন্য তহবিল দুলক্ষ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৩১ সালের তহবিলের পর্যায়ে পৌঁছে। ডুপ্লে প্রায়শই ঋণ গ্রহণ করতেন এবং কোম্পানি কর্তৃক প্রেরিত বিনিয়োগের চেয়েও বেশি পরিমাণ মূল্যের মালামাল জাহাজে বোঝাই করতেন। ১৭৩৬ সাল নাগাদ বাংলার পণ্যসামগ্রীর জন্য কোম্পানি দু'লক্ষ টাকারও অধিক বিনিয়োগ করতে শুরু করে। ১৭৪০ সালে ডুপ্লে আট লাখেরও বেশি টাকা মূলধন লাভ করেন।

ডুপ্লে ইংরেজ, ফরাসি বা ওলন্দাজ বণিকদের নিয়ে কোম্পানি গঠন করে প্রায়শ আন্ত-এশীয় বাণিজ্যে তার ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ডুপ্লে এসব অংশীদারদের অনেককে তাঁর সাতগাছিয়ার নিবাসে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করতেন। ডুপ্লের ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন। একটি নির্দিষ্ট ব্যবসা খাতেই তার বিনিয়োগ ছিল আশি হাজার টাকার মতো এবং এর থেকে মুনাফা আসছিল ২০% থেকে ৫০% হারে। চন্দননগর থেকে তিনি লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, মালদ্বীপ, এচেন, মালাক্কা ও ম্যানিলার সঙ্গে নৌপথে বাণিজ্য পরিচালনা করতেন।

১৭৪১ সালে ডুপ্লে পন্ডিচেরি ফিরে যাবার পর বাংলার ফরাসি কুঠিয়ালরা ১৭৪৭ সালে চট্টগ্রামে একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি পান। ১৭৫৩ সালে শেভেলিয়ারকে আসামের ব্যবসা সংগঠিত করার জন্য গোয়ালপাড়া থেকে পাঠানো হয়; কিন্তু উদ্যোগটি সফল হয় নি। তার উত্তরসূরি ল্যাভালও ব্যর্থ হন এবং কুঠিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও ঢাকা থেকে ঢাকার দালালদের মাধ্যমে ফরাসিরা ১৭৪৬ থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে ২৮.৫ লক্ষ টাকা মূল্যের (গড়ে বার্ষিক ২ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা) পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করেছিল।

ঢাকা থেকে যখন সৌখিন পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছিল তখন জগদিয়া কুঠি যোগান দিচ্ছিল মোটা বস্ত্রের। জগদিয়া কুঠিকে চন্দননগরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছিল। পলাশী-পূর্ব সময়ে অ্যালবার্ট ছিলেন জগদিয়া কুঠির প্রধান। এমনকি ১৭৫৫ সালে জগদিয়া থেকে ইংরেজ কুঠি লক্ষ্মীপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ফরাসিরা জগদিয়ায় তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৭৮৬ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্তও চন্দননগর কর্তৃপক্ষের নিকট জগদিয়ার গুরুত্ব অব্যাহত ছিল। অ্যালবার্টের প্রস্থানের পর ছয় বছর ধরে কুঠিটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন আমিনাবাদের দালাল জনৈক শোভারাম। এরপর কুঠির দায়িত্বে নিয়োজিত হন ব্রোকলে নামে এক ফরাসি। তিনি শোভারামকে বরখাস্ত করে জনৈক মল্লিককে বানিয়া হিসেবে নিয়োগ করেন। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে বাংলায় ফরাসিদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

১৭৫৭ সালের ২৪ মার্চ ইংরেজরা চন্দননগর দখল করে নেয়। ১৭৬৫ সালের ২৫ জুন ফরাসিরা চন্দননগর পুনরুদ্ধার করে। এ সময়ের মধ্যে পুরাতন দুর্গ ডি’অরলিয়েনস সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল এবং অধিকাংশ ইমারত ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। চন্দননগরের জনসংখ্যা ১৭৫৭ সালে ছিল ষাট হাজার এবং ১৭৬৫ সালে তা নেমে এসেছিল বিশ হাজারে। ১৭৬৩ সালে সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির ফলে ফরাসিরা বাণিজ্যিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ঘন ঘন প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইংরেজদের দ্বারা বরাবরই বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।

১৭৬৯ সালে ফরাসি কোম্পানিটি ভেঙে দেওয়া হয় এবং ব্যক্তিখাতের ব্যবসা সবার জন্য অবারিত করা হয়। ১৭৭৮ সালে চন্দননগর পুনরায় ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৭৮৫ সালের গোড়ার দিকে ইংরেজরা অপর পাঁচটি অধীনস্থ কুঠি সমেত চন্দননগর প্রত্যর্পণ করে। ১৭৮৭ সালে অনুষ্ঠিত পৃথক ইঙ্গ-ফরাসি বাণিজ্যিক সম্মেলন ফরাসিদের সমস্যা কিছুটা সহজতর করেছিল। এ সময়ে কেলোনের একটি নতুন কোম্পানি ফ্রান্সে কাজ শুরু করে। পন্ডিচেরির কমিটির ধরনে চন্দননগরে একটি বৈপ্লবিক কমিটি গঠিত হয়। ১৭৯৩ সালের ১১ জুন ইংরেজদের দ্বারা চন্দননগর অধিকৃত হলে চূড়ান্তভাবে এর কলহের অবসান ঘটে এবং বাংলায় একটি সক্রিয় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ফরাসিদের ভূমিকার অবসান ঘটে। [অনিরুদ্ধ রায়]