পালি
পালি প্রাচীন ভারতের একটি অন্যতম বড় ভাষা। ‘পালি’ শব্দটি ‘পাঠ’ (Sacred Text) অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ এ ভাষায় শিষ্যদের পাঠ বা উপদেশ দিতেন; তাই বুদ্ধবচনই হচ্ছে পালি (ইতি পি পালি)। ‘পালন করা’ অর্থ থেকেও ‘পালি’ শব্দটির উদ্ভব হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন; সে অনুযায়ী বুদ্ধদেবের বাণী যে ভাষায় পালন অর্থাৎ সংরক্ষণ করা হয়েছে তাই পালি।
পালির অপর নাম ‘তন্তি’ (সংস্কৃত তন্ত্রী, তন্ত্রি তন্তি), অর্থ রজ্জু বা সূত্র। মূল বৌদ্ধশাস্ত্রের ভাষা হিসেবে ‘তন্ত্রী’র ব্যবহার ছিল; সংস্কৃত পন্ডিতরা ‘পালি’ শব্দটিকে তন্ত্রী বা সূত্র নামে অভিহিত করেছেন। অনেকে ‘পাটলী’ শব্দের অপভ্রংশ থেকেও ‘পালি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন। প্রাচীন মগধের রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র। বুদ্ধের সময়ে পাটলীপুত্র ছিল একটি সমৃদ্ধ নগরী। বুদ্ধদেব পাটলীপুত্রের ভাষায় কথা বলতেন এবং ধর্মোপদেশ দিতেন বলে কালক্রমে তার নাম হয় পালি।
বৌদ্ধ পন্ডিতরা মনে করেন, জগতের সকল ভাষারই পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু পালি ভাষার কোনো পরিবর্তন নেই। এটা সহজাত ভাষা এবং মানুষের মূল ভাষা। ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং এ ভাষায় কথা বলতেন, আলাপ করতেন এবং উপদেশ দিতেন। পালি ভাষা বৈদিক ভাষার ন্যায় ‘দেবভাষা’ হিসেবেও অভিহিত হয়।
কেউ কেউ পালি ভাষাকে বিভিন্ন অঞ্চল বা জনপদের বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট একটি মিশ্রভাষা বা সঙ্কর ভাষা (hybrid language) বলেছেন। গাইজার (Gieger), চাইল্ডার (Childer), উইন্টারনিজ (Winternitze), রীজ ডেভিডস (Rhys Davids), বেণীমাধব বড়ুয়া প্রমুখ পন্ডিত পালিকে সর্বজনবোধ্য ভাষা (Lingua Franca) বা রাষ্ট্রীয় ভাষা (State language) বলে অভিহিত করেছেন। এই পালি বা বুদ্ধবচনই স্থবিরবাদ, অগ্রবাদ, বিভাজ্যবাদ, তন্ত্রী, পর্যাপ্তি এবং বৌদ্ধ অনুশাসন (Buddhist canon) নামে প্রসিদ্ধ।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত পালি ভাষা ও সাহিত্য ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের ব্যবহূত ভাষা ছিল বলে তাঁর অনুসারীদের নিকট পালি অধিক গুরুত্ব লাভ করে। গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধর্মাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে শ্রাবস্তী, জেতবন, বেণুবন, পূর্বারাম, নালন্দা, চাপাল চৈত্য প্রভৃতি বিহার ও সঙ্ঘারাম গড়ে ওঠে। এগুলি কেবল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল ছিল না, ছিল বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চা ও সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্রও। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্ত ও পন্ডিতরা এসব কেন্দ্রে সমবেত হয়ে শাস্ত্রচর্চা করতেন। এগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে সর্বজনবোধ্য পালি ভাষার প্রচলন ঘটে। ক্রমে বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীমন্ডলী ধর্মালোচনার মাধ্যম হিসেবে এ ভাষাকেই আশ্রয় করেন এবং পরবর্তীকালে এ ভাষাতেই মূল ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক সঙ্কলিত হয়।
‘পিটক’ শব্দটি পালি, যার অর্থ ঝুড়ি, পেটিকা, পাত্র ইত্যাদি। যাতে কোনো কিছু সংরক্ষণ করা যায়, তাই পিটক। এ অর্থে বুদ্ধের বাণীসমূহ যাতে সংরক্ষিত হয়েছে তাও পিটক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিনয়ের সংরক্ষণ আধারকে বিনয়পিটক, সূত্রের সংরক্ষণ-আধারকে সূত্রপিটক (সুত্তপিটক) এবং অভিধর্মের সংরক্ষণ-আধারকে অভিধর্মপিটক (অভিধম্মপিটক) বলা হয়। এ তিন পিটকের সমাহারই ত্রিপিটক (পালিতে তিপিটক)।
বাংলার বৌদ্ধরা ধর্মীয় ভাষা হিসেবে পালির চর্চা করেছেন, কিন্তু তাঁরা পালি ভাষায় কোনো গ্রন্থ রচনা করেছেন কিনা তা জানা যায় না। পালি ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পঠন-পাঠন বৌদ্ধসম্প্রদায় ও পন্ডিতমহলে আজও অব্যাহত আছে। কেবল বৌদ্ধ-প্রতিষ্ঠানে নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেও এখন পালি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে।
বাংলাদেশে পালি ভাষা ও সাহিত্যেরচর্চা শুরু হয় মূলত ধর্মীয় প্রয়োজনে অনুবাদের মাধ্যমে। ব্রিটিশ আমলে ত্রিপিটকসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদ করে এই প্রয়োজন মেটানো হয়। বাংলাদেশে ত্রিপিটক চর্চার ইতিহাস বেশিদিন আগের নয়। প্রথম দিকে দেবনাগরী ও রোমান হরফে পালি গ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হতো, পরে বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত হওয়ায় ত্রিপিটকসহ পালিচর্চার পথ সুগম হয় এবং সে ধারা বর্তমানেও অব্যাহত।
বাঙালি বৌদ্ধদের পালি ভাষায় যথার্থরূপে শিক্ষিত করে তোলার পেছনে আচার্য পুন্নাচারের (চন্দ্রমোহন) অবদান সর্বাধিক। তিনিই প্রথম ১৮৮৫ সালে জমিদার হরগোবিন্দ মুৎসুদ্দীর অর্থানুকূল্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মহামুনিতে একটি পালি টোল স্থাপন করেন। সেখানে দ্বিতীয় পালি টোল স্থাপিত হয় ১৯০২ সালে সারানন্দ নামক একজন সিংহলী ভিক্ষুর প্রচেষ্টায়। পরবর্তীকালে রাজানগর, সাতবাড়িয়া, উনাইনপুরা, মির্জাপুর গৌতমাশ্রম প্রভৃতি স্থানে আরও টোল স্থাপিত হয়। এভাবে বিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আরও কিছু পালি টোল প্রতিষ্ঠিত হলে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম তথা পালি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
১৯০৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পালি পড়ার ব্যবস্থা হলে ধর্মবংশ মহাস্থবির সেখানে পালির শিক্ষক নিযুক্ত হন। পরে চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান স্কুলগুলিতে পালির পঠন-পাঠনের সুযোগ হয়। ক্রমে কলেজ পর্যায়েও পালি শিক্ষা প্রবর্তিত হলে উভয় বঙ্গের তিনটি কলেজে পালি পড়ানোর ব্যবস্থা হয়; কলেজগুলি হলো কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিদ্যাসাগর কলেজ এবং চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম কলেজ। মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, অমূল্যচরণ ঘোষ, নীরদরঞ্জন মুৎসুদ্দী, প্রাণকৃষ্ণ ভিক্ষু, ধর্মবংশ মহাস্থবির প্রমুখ পন্ডিত ওইসব কলেজে পালির অধ্যাপক ছিলেন।
১৮৯৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিভাগ খোলা হলে বাংলা ও ভারতের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পালি ভাষার পঠন-পাঠন বিকাশ লাভ করে। এ সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষায় যাঁরা অধ্যাপনা করতেন তাঁরা হলেন বেণীমাধব বড়ুয়া, নলিনাক্ষ দত্ত, শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র, ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির, অনুকূলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাসচন্দ্র মজুমদার, সুকুমার সেনগুপ্ত, কানাইলাল হাজরা, শ্যামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়, ধর্মাধার মহাস্থবির প্রমুখ। তাঁরা অনেকেই পালি গ্রন্থাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। পালি শিক্ষার ধারা ক্রমে বাংলাদেশের ঢাকা (১৯২১), রাজশাহী (১৯৫৫) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৮) সম্প্রসারিত হয়।
ব্রিটিশ আমলে কয়েকজন বাঙালি বৌদ্ধ মনীষী রেঙ্গুনে গিয়ে বুদ্ধিস্ট মিশন প্রেস (১৯৩০) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক চর্চার সূচনা হয় সেখান থেকেই। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (১৮৭৯-১৯৭১), সুধাংশু বিমল বড়ুয়া প্রমুখ। তাঁদের এই উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বেণীমাধব বড়ুয়া ১৯৩৭ সালে ত্রিপিটকের মধ্যম নিকায়ের প্রথম ভাগ অনুবাদ করেন। এটি প্রকাশের জন্য চট্টগ্রামে ত্রিপিটক প্রকাশনা ফান্ড গঠিত হয় এবং ফান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির অনূদিত বিনয়পিটকের ‘মহাবগ্গ’ (১৯৩৭) ও বেণীমাধবের ‘মধ্যম নিকায়’ (১ম খন্ড, ১৯৪০) প্রকাশিত হয়। অবশ্য ঈশানচন্দ্র ঘোষ ত্রিপিটকের জাতকসমূহের বাংলা অনুবাদ এর আগেই সম্পন্ন করেন (১৯২৯)। এর ফলে বাংলাভাষী পাঠকসমাজে ত্রিপিটক পাঠে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে পালিচর্চায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ফুলচন্দ্র বড়ুয়া (১৯ শতকের মধ্যভাগ) পাদিমুখ, বৌদ্ধরঞ্জিকা ও বিসন্দর জাতক এ তিনটি গ্রন্থ লিখে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পাদিমুখ বাংলা ভাষায় রচিত পালিবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন, যদিও মঘা খমুজা-কে কেউ কেউ প্রথম বলেন। বৌদ্ধরঞ্জিকা পদ্যে রচিত; এর বিষয়বস্ত্ত পালি ধাতুবংশ থেকে গৃহীত। রামচন্দ্র বড়ুয়ার (১৮৪৭-১৯২২) উল্লেখযোগ্য চারটি গ্রন্থ হলো শ্রমণকর্তব্য (১৯৩১), অভিধর্মার্থসংগ্রহ (১৯৪১), নির্বাণ দর্শন (১৯৪২) ও মহাসতিপট্ঠান সুত্ত।
পন্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া (১৮৬০-৯৪) পালি সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্মের একজন স্বনামখ্যাত পন্ডিত ছিলেন। তিনি সূত্রপিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ের সূত্রনিপাত গ্রন্থের সূত্রসমূহ সরল বাংলায় পদ্যানুবাদ করে ১৮৮৭ সালে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মপুরাবৃত্ত, সিগালোবাদসূত্র, হস্তসার (১-৩ ভাগ), শ্যামাবতী, জ্ঞানসোপান, সত্যসার, মাতৃদেবী প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর হস্তসার গ্রন্থটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। সাধু নবরাজ বড়ুয়া (১৮৬৬-৯৬) থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রচারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলা ভাষায় একটি পালি ব্যাকরণসহ বৌদ্ধালঙ্কার, নীতিরত্ন, প্রাথমিক বৌদ্ধশিক্ষা, প্রসন্নজিতোপাখ্যান, প্রকৃত সুখী কে, অভিধানপ্পদীপিকা, বুদ্ধপরিচয় প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।
সর্বানন্দ বড়ুয়া (১৮৬৬-১৯০৮) ছিলেন একজন খ্যাতিমান কবি। তাঁর অমর কীর্তি এডুইন আর্নল্ডের The Light of Asia অবলম্বনে রচিত জগজ্জ্যোতি কাব্য। তাঁর অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো: শ্রীশ্রীবুদ্ধচরিতামৃত ও ঋষিসন্দর্শন। তিনি অনেক বৌদ্ধ সংকীর্তন ও গানও রচনা করেন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধ পত্রিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করেন।
অগ্গসার মহাস্থবির (১৮৭১-১৯৪২) একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। লিখনে ও ভাষণে তাঁর যুগপৎ প্রচেষ্টা বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক চর্চার পথকে বহুলাংশে সুগম করে। বাংলা, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপন্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হলো: গাথাসংগ্রহ, বুদ্ধভজনা, পালি-বাংলা অভিধান, পূজাবলীয় (বঙ্গানুবাদ) এবং ধম্মপদট্ঠকথা-র বঙ্গানুবাদ।
প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির পালি ও বৌদ্ধধর্মের একজন সুপন্ডিত, সুলেখক ও সুবক্তা ছিলেন। তাঁর সঙ্কলিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশের অধিক। বংশদীপ মহাস্থবির (১৮৮০-১৯৭১) ত্রিপিটকের বিবিধ বিষয় নিয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণা করেন। তাঁর রচিত ও সঙ্কলিত গ্রন্থের সংখ্যা সাতের অধিক। ভিক্ষু শীলভদ্র (১৮৮৪-১৯৫৫) দীর্ঘ-নিকায় (৩ খন্ড), ধর্মপদ ইত্যাদি পালি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ কাজে খ্যাতি অর্জন করেন। গিরিশচন্দ্র বড়ুয়া (১৮৯১-১৯৬০) ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী। তিনি হিন্দি, উর্দু, পালি, সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষা লিখতে ও বলতে পারতেন। সংস্কৃত ও পালিতে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বঙ্গীয় সারস্বত সমাজ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদ’ অভিধায় ভূষিত করে। ভারতীয় ধর্মদর্শন ও বেদান্তশাস্ত্রে তিনি সুপন্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত, অনূদিত ও সঙ্কলিত গ্রন্থগুলি হলো: প্রতীত্যসমুৎপাদ, আর্যপথ, অন্ধের দৃষ্টি, মদনমোহন, ধর্মপদ, ভুলের বোঝা, জাতকের কথা, বিবিধ বিধি, ভ্রাতৃরক্ত, খোলাকথা প্রভৃতি।
ধর্মাধার মহাস্থবির (১৯০১-?) ত্রিপিটকের অনুবাদ ও গবেষণায় একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে ত্রিপিটক শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ধম্মপদ, মধ্যম নিকায় (২য় খন্ড), শাসনবংস, অধিমাস বিনিশ্চয়, মিলিন্দপ্রশ্ন ও রাহুল সাংকৃত্যায়নকৃত বৌদ্ধদর্শন-এর বঙ্গানুবাদ তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্ম। এছাড়া তিনি সদ্ধর্মের পুনরুত্থান ও বুদ্ধের ধর্মদর্শন নামে দুখানি মৌলিক গ্রন্থ এবং নানা পত্রপত্রিকায় বিবিধ বিষয়ে বহু প্রবন্ধ রচনা করেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) ছিলেন একজন খ্যাতনামা ভাষাবিদ ও গবেষক। সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ও বাংলা ভাষায় তাঁর সুগভীর পান্ডিত্য ছিল। তিনি অনেক পুথি সংগ্রহ করেন যার মধ্যে একটি হলো বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন বৌদ্ধ গান ও দোহা (১৯১৬)। বৌদ্ধধর্ম এবং পালি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গবেষণামূলক পালি গ্রন্থগুলি: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দি ললিতবিস্তর (১৮৭৭), বুদ্ধগয়া দি হারমিটেজ অব শাক্যমুনি (১৮৭৮), দি স্যানস্ক্রিট বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অব নেপাল (১৮৮২) প্রভৃতি।
শান্তপদ মহাথের (১৯১৫-১৯৮৭) ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম সঙ্ঘ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এবং থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি: মিলিন্দপ্রশ্ন, ধাতুকথা, অপদান, চরিয়াপিটক, অঙ্গুত্তরনিকায়, শীলার্থদীপন, অভিধর্মার্থসংগ্রহ প্রভৃতি।
শরচ্চন্দ্র দাস ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। অবিভক্ত বঙ্গের রাজপ্রতিনিধি হয়ে তিনি সিকিম, চীন, নেপাল, জাপান প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। এজন্য তাঁকে ‘শরৎ রাজদূত’ বলা হতো। তিববতি ভাষা ও বৌদ্ধধর্মে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি তিববত থেকে প্রচুর প্রাচীন পুথি এবং ধর্মীয় ও পৌরাণিক তথ্য সংগ্রহ করেন। তিববতীয় লামারা তাঁকে ‘পুন্ডিব-লা’ (অর্থাৎ পন্ডিত মশাই) বলে সম্বোধন করতেন। তিনি ১৮৯২ সালে ‘বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটি’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ: রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি (১৮৯৯), টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারী (১৯০২), ইন্ডিয়ান পন্ডিতস ইন দি ল্যান্ড অব স্নো, বোধিসত্ত্বাবদান, কল্পলতা প্রভৃতি।
অধ্যক্ষ প্রমোদরঞ্জন বড়ুয়া (১৯১৮-?) চট্টগ্রাম কলেজে পালির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও খন্ডকালীন (১৯৬৬-৬৮) শিক্ষক হিসেবে পালি ও প্রাকৃত পড়াতেন। পালি সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্ম-দর্শন বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি: ম্যাট্রিকুলেশন পালি সিলেকশান (১৯৫৩), ইন্টারমিডিয়েট পালি সিলেকশান (১৯৬১), পালি গ্রামার (১৯৬১), আর্লি বুদ্ধিজম অ্যান্ড দি ব্রাহ্মনিক্যাল ডকট্রিনস (১৯৬৭), এ নিউ পালি রীডার (১৯৬৮) ইত্যাদি। তিনি অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধও রচনা করেন।
অধ্যাপক রণধীর বড়ুয়া (১৯১৮-১৯৮৮) চট্টগ্রাম কলেজে পালির শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি পড়াতেন। তিনি পালি সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্ম-দর্শন বিষয়ে গবেষণামূলক অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর ভগবান বুদ্ধ (১৯৫৬) গ্রন্থটি গবেষক ও পাঠকসমাজে খুবই সমাদর লাভ করে।
শীলাচার শাস্ত্রী ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়নশেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালির লেকচারাররূপে যোগদান করেন। তিনি পালি সাহিত্য ও বৌদ্ধধর্ম-দর্শন বিষয়ে অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি: ইসিপতন, বুদ্ধবন্দনা, সারনাথ তীর্থ, চার পুণ্যতীর্থ, মহাযান বৌদ্ধধর্ম-দর্শন, চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম (১৯৮১) প্রভৃতি।
রবীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া (১৯৩৩-১৯৯০) পালি ভাষা ও সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট পন্ডিত ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে সংস্কৃত ও পালি নিয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা হলে তিনি সেই বিভাগে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পালিচর্চার ব্যাপারে তাঁর অবদান স্মরণীয়। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি: মধ্যভারতীয় আর্যভাষা সংকলন (১৯৬৬), কথায় ধম্মপদ (১৯৬৮), মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্য (১৯৭০), পালি সাহিত্যের ইতিহাস (দুই খন্ড, ১৯৮০ ও ১৯৮৮) প্রভৃতি। তাঁর আরও কয়েকটি মূল্যবান পান্ডুলিপি অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি থেরবাদ সংঘ নামে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায় পঞ্চাশটির মতো গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
পশ্চিমবঙ্গে পালিচর্চার ক্ষেত্রে যাঁর প্রথম অবদান তিনি হচ্ছেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রচেষ্টায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষার পঠন-পাঠন শুরু হওয়ার পর কলকাতার বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজে পালি ভাষার পঠন-পাঠন প্রবর্তিত হয়। বিভিন্ন মনীষী, সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনা সংস্থা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে। প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে মহাবোধি সোসাইটি (ইন্ডিয়া), বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার, ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনা সংস্থা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বঙ্গীয় সংস্কৃত পরিষদ এবং নালন্দা বিদ্যাভবন পালি টোলও পালিচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ওই সব সংস্থা থেকে পালিতে আদ্য, মধ্য ও উপাধি পরীক্ষার সনদ দেওয়া হতো। পশ্চিমবঙ্গে পালি ভাষা ও সাহিত্য এবং বৌদ্ধধর্ম-দর্শনচর্চায় আর যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের কয়েকজনের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হলো:
কৃপাশরণ মহাস্থবির ছিলেন কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং বিহার থেকে প্রকাশিত জগজ্জ্যোতি পত্রিকার সম্পাদক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি প্রবর্তনের ব্যাপারে তাঁর বিরাট অবদান ছিল। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁরা উভয়ে অবিভক্ত বঙ্গে পালিচর্চার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করেন। বেণীমাধব বড়ুয়া ধর্মাঙ্কুর বিহারে ‘নালন্দা-বিদ্যাভবন’ নামে পালি টোল খোলার ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংগঠক ছিলেন। নলিনাক্ষ দত্ত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালির অধ্যাপক। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: আসপেক্টস অব মহাযান অ্যান্ড ইটস রিলেশন টু হীনযান (১৯৩০) এবং আর্লি মনাস্টিক বুদ্ধিজম (২ খন্ড, ১৯৪১)।
এঁদের ব্যতীত আরও কয়েকজন হলেন: শরচ্চন্দ্র দেব (শাক্যসিংহ-প্রতিভা বা বুদ্ধদেব চরিত, ১৮৮৮), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত ও সংঘাত, ১৮৯১), রামদাস সেন (ঐতিহাসিক রহস্য, ৩ ভাগ, ১৮৭৬-৭৯, বৌদ্ধধর্ম, শাক্যসিংহের দিগ্বিজয়, পালিভাষা ও তৎসমালোচনা, বৌদ্ধমত ও তৎসমালোচনা, বুদ্ধদেবের দন্ত, বুদ্ধদেব, ১৮৯১), নবীনচন্দ্র সেন (অমিতাভ, ১৮৯৫), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বৌদ্ধধর্ম, ১৯০১), রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বুদ্ধচরিত, ১৯০৬), পি.এন বোস (ইন্ডিয়ান টিচার্স অব বুদ্ধিস্ট ইউনিভার্সিটি, ১৯২৩), সুকুমার দত্ত (আর্লি বুদ্ধিস্ট মনার্কিজম, ১৯২৪, বুদ্ধিস্ট মংকস অ্যান্ড মনাস্টারিজ অব ইন্ডিয়া, ১৯৬২), নীহাররঞ্জন রায় (স্যানস্ক্রিট বুদ্ধিজম ইন বার্মা-১৯৩৬, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব থেরবাদ বুদ্ধিজম ইন বার্মা, ১৯৪৬); শশিভূষণ দাশগুপ্ত (বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি), রাহুল সাংকৃত্যায়ন (একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধ পন্ডিত; তিনি বৌদ্ধধর্ম ও পালি বিষয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন), বিধুশেখর শাস্ত্রী (পালিপ্রকাশ) প্রমুখ।
এ পর্বে অনেক পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও পালিচর্চার প্রসার ঘটে। পত্রিকাগুলির বেশির ভাগ কলকাতা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পত্রিকা: দি মহাবোধি (১৮৯২, কলকাতা), বৌদ্ধ পত্রিকা (১৯০৬, চট্টগ্রাম), জগজ্জ্যোতি (১৯০৮, কলকাতা), বৌদ্ধবন্ধু (১৯১১, চট্টগ্রাম), বুদ্ধিস্ট ইন্ডিয়া (১৯৩৪, কলকাতা), মৈত্রীবাণী (ঢাকা) প্রভৃতি।
সম্প্রতি, বিশেষত ১৯৯০ সালের পর থেকে, বাংলাদেশে পালিচর্চার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়েছে। উনিশ ও বিশ শতকের প্রারম্ভে ত্রিপিটকের যে অনুবাদ গ্রন্থগুলি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল, বাংলাদেশ বৌদ্ধকৃষ্টি প্রচার সংঘ, ন্যাশনাল বুদ্ধিষ্ট ইয়ুথ ফেডারেশন, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি ইত্যাদি সংগঠনের উদ্যোগে সেগুলি তাইওয়ানের The Corporate Body of the Buddha Educational Foundation-এর পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক অনুবাদসহ বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় শান্তরক্ষিত মহাস্থবির প্রণীত পালি-বাংলা অভিধান শীর্ষক একটি অভিধান মুদ্রিত হয়েছে। [সুকোমল বড়ুয়া]