কলকাতা
কলকাতা ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। পরবর্তী সময়ে এটি অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল। এর অভিজাত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের জন্য কলকাতাকে ‘প্রাসাদ নগরী’ও বলা হতো। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার উত্তর দিকে হুগলি (ভাগীরথী) নদীর বাম (পূর্ব) তীরে অবস্থিত এটি অন্য তিন দিকে অখন্ড চবিবশ পরগণা জেলা দ্বারা বেষ্টিত।
প্রত্নতত্ত্ব দৈবক্রমে যে আবিষ্কারসমূহ সংঘটিত হয়েছে তার কয়েকটি লিপিবদ্ধকৃত উদাহরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো: গুপ্ত যুগের স্বর্ণ মুদ্রার ভান্ডার (কালীঘাট: ১৭৮৩); ভাঙ্গা মৃন্ময় পাত্রসমূহের টুকরা ও বরাহ-দন্ত (ফোর্ট উইলিয়ম: ১৮৮০); আনুমানিক চৌদ্দ থেকে ষোল শতকের কচ্ছপের আকৃতি বিশিষ্ট কালো পাথরের ফলক (ধাপ: ১৮২২); জীবাশ্ম ও ভাস্কর্যসমূহ (হাওড়া ব্রিজ নির্মাণ: ঊনিশ শত চল্লিশের দশক); বিষ্ণু প্রতিমার অংশবিশেষ (বেহালা: ১৯৭৫) বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর- এ (রাজশাহীর বিহারাইল থেকে) রক্ষিত বুদ্ধ মূর্তির অবিকল একটি লাল বেলেপাথরের বুদ্ধ মূর্তি এবং ঘোরবর্ণের আগ্নেয় শিলায় নির্মিত বিষ্ণু মূর্তি যেটা চেতলায় অবস্থিত ছিল বলে নির্দেশিত করা যায়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে লুপ্ত হস্তী প্রজাতির একটি জন্তু এলিফ্যাস নোয়াডিকাস-এর দন্ত বরিশা থেকে মাটি খনন করে তোলা হয়েছে। ঋজু গাছের গুঁড়ি ও কতিপয় অঙ্গারীভূত উদ্ভিজ্জ পদার্থের স্তর, যা বিভিন্ন খননকার্য চালানোর সময় প্রায়শ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা এ ব-দ্বীপ অঞ্চলে বহুবিধ ভূতাত্ত্বিক অবনমনের পক্ষে প্রমাণিক সাক্ষ্য দেয়। এলগিন রোডে (চৌরঙ্গী রোডের সংযোগস্থলে) ভূ-পৃষ্ঠের ১১.১ থেকে ১২.৬ মিটার নিচে অবস্থিত অঙ্গারীভূত উদ্ভিজ্জের স্তর বিশ্লেষণ করে প্রত্ন-উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ চাষযোগ্য ঘাসের (সম্ভবত ধান গাছ) জীবাশ্ম পরাগ আবিষ্কার করেছেন যাকে আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে মনে করা হয়। এগুলির তেজস্ক্রিয়-অঙ্গার অনুসন্ধানে উদ্ঘাটিত হয় যে, মানুষের উদ্ভব-সম্বন্ধীয় বিদ্যায় নবপ্রস্তরযুগীয় উপাদান প্রায় ২.৫ হাজার বছরের পুরানো। এ আবিষ্কারসমূহ জনসাধারণ্যে প্রচলিত বিশ্বাসকে সন্দেহাতীতভাবে খন্ডন করে যে, যেখানে কলকাতা অবস্থিত, অর্থাৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের উপকূলীয় অংশ সাম্প্রতিককালে (আনুমানিক সাত শতক) গঠিত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠা এবং প্রাথমিক বিকাশ কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক বসতি স্থাপন করার অধিকার লাভ করা থেকে। জব চার্নক ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির জন্য কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম মুগল সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সুতানটি ছিল তৎকালে ওই অঞ্চলে সুতা ও বোনা কাপড়ের একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৬৯৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চার্ণক তাঁর সময়ে খড় তালপাতার অল্প কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ ছাড়া আর কিছু করে যেতে পারেন নি। গভর্নর হিসেবে ফ্রান্সিস এলিস তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এলিসের পরে আসেন চার্লস আইয়ার। শোভা সিংহ এর বিদ্রোহ শুরু হলে ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় সুবাহদার ইবরাহিম খান এর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সুবাদার তাদেরকে ‘নিজেদের রক্ষা করা’র অনুমতি দান করেন। যুবরাজ ফররুখ সিয়ারকে ১৬,০০০ টাকা প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানি তাঁর পিতা গভর্নর আজিম-উস-শান এর নিকট থেকে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা এ গ্রাম তিনটিকে খাজনার বিনিময়ে বিলিবন্টন করার অধিকার ক্রয় সংক্রান্ত অনুমতি সংগ্রহ করে। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ববর্তী জমিদার স্বর্ণ চৌধুরী পরিবারকে মাত্র ১,৩০০ টাকা প্রদান করে ব্রিটিশ কোম্পানি এ ক্ষুদ্র গ্রাম তিনটির নতুন জমিদারে পরিণত হয়।
ফোর্ট উইলিয়ম ও নগরায়নের প্রাথমিক পর্যায় দুর্গ নির্মাণের কাজ পূর্বে শুরু হলেও ১৭০৭ সালের আগে শেষ হয়নি। ১৭১০ সালে দুর্গের সাথে জাহাজ ও নৌকা ভিড়িয়ে মাল বোঝাই ও খালাসের জন্য কাঠের নির্মিত একটি ঘাট যুক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে, ১৭০০ সালের ২০ আগস্ট তারিখে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা ৩য় উইলিয়মের নামানুসারে দুর্গের নামকরণ করা হয়ফোর্ট উইলিয়ম। অবিবাহিত কেরানিবৃন্দ দুর্গের অভ্যন্তরে কোয়াটারে অবস্থান করলেও বিবাহিত অফিসারগণ তাদের পরিবার-পরিজনসহ নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করতে পছন্দ করতেন।
এর ফলে দুর্গের চারদিকে ইউরোপীয়ানদের ব্যক্তিগত বসতবাড়ি গড়ে ওঠা শুরু হয়। কোম্পানি কর্তৃক জমিদারি অর্জিত হলে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্যও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। তারা সদ্য গড়ে ওঠা এ নগর তিনটিতে ভিড় জমালে স্বল্পবসতিপূর্ণ স্থানটি ঘন বসতিতে পরিণত হয়। এভাবে এ তিনটি গ্রামে নগরায়নের প্রক্রিয়া বিকাশ লাভ করতে থাকে। কোম্পানি ও তার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জমির উপর দখল প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা মিটাতে ইংরেজরা ১৭১৭ সালে ওই সময়কার জমিদারদের নিকট থেকে আরও ৩৮ টি গ্রাম ক্রয় করার ব্যাপারে সম্রাটের অনুমতি লাভ করে। এগুলির মধ্যে পাঁচটি ছিল নদীর অন্য তীরে (হাওড়ায়), এবং অন্য সবগুলি ছিল মূল গ্রাম তিনটি সংলগ্ন।
মারাঠা হামলা (বর্গি) চলাকালে হুগলি নদীর পশ্চিম তীর থেকে বহু লোক একযোগে গ্রাম ছাড়লে পলাতক গ্রামবাসীদের এ নতুন ব্রিটিশ ভূখন্ডে বসতি স্থাপনে প্রণোদিত করে। নব প্রতিষ্ঠিত দুর্গের উপস্থিতি তাদের মাঝে নিরাপত্তা বোধের সৃষ্টি করে যা এরূপ বসতি স্থাপনকারীদের আকৃষ্ট করে ও দ্রুত নগরায়নের প্রক্রিয়াকে তরান্বীত করে। কিন্তু এ আস্থা ও আগ্রহ ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকর্তৃক ইংরেজদের কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে তাঁর মাতামহ আলীবর্দী খান এর নামানুসারে নগরীটির পুনঃনামকরণ ‘আলীনগর’ করলে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৫৮ সালের জানুয়ারি মাসের পূর্ব পর্যন্ত এর আদি নাম পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়নি। পলাশীতে ব্রিটিশদের বিজয় কলকাতাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেবল বাণিজ্যিক সদর দফতরে রূপান্তরিত করতে প্ররোচিত করে। তখন থেকে স্থানীয় অধিবাসী, আর্মেনিয়ান এবং ভারত ও এর বাইরে থেকে আগত অন্যান্য জনগণ হয় কর্মসংস্থান ও চাকুরি অথবা ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য এ নগরীতে বসতিস্থাপন শুরু করে। এ ক্রমবর্ধমান জনগণের জন্য বাসস্থানের জন্য নতুন নতুন বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়। জন সাধারণের বসতিস্থাপন ধর্ম, জাত, জাতিতত্ত্বমূলক ও জাতীয়তার ধারা অনুসরণ করে চলতে থাকে। এভাবে নগরীটির প্রত্যেকটি অংশ এ সব নিদর্শন দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন ব্যবসায়ী ও সমুদ্রগামী নাবিকগণ দলবেঁধে বাংলায় আসতে শুরু করে এবং এজেন্সি হাউসগুলি ‘প্রাচ্যের (ভারতের) সাথে ব্যক্তিগত ব্রিটিশ ব্যবসায়-বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্যসূচক একক’-এ পরিণত হয়। ১৭৯০ সাল নাগাদ পনেরোটি এজেন্সি হাউস গড়ে ওঠে এবং উইলিয়ম ফেয়ারলি, জন ফারগুসন, জন পামার নামগুলি সুপরিচিত হয়ে ওঠে। শুরুতে এ হাউসগুলি কমিশনের ভিত্তিতে অন্যান্যের জন্য পণ্যসমূহের ক্রয়-বিক্রয় পরিচালনা করত। কিন্তু ১৭৯৩ সালের অনুকূল আইন, বিস্তারশীল নীল ব্যবসায় ও ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে তারা ব্যাংকার, বিল-দালাল, বীমার এজেন্ট, আড়তদার, মাল বহনকারী ও জাহাজমালিক হিসেবে স্বাধীনভাবে কর্মতৎপরতায় প্রবৃত্ত হয়। সতেরো শতকের সত্তরের দশকে আলেক্সান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি কর্তৃক সম্ভবত ভারতে ‘ব্যাংক অব হিন্দুস্থান’ নামক প্রথম ইউরোপীয় ব্যাংক চালু করা হয়।
এজেন্সি হাউসগুলি সতেরো শতকের আশির দশকে জাহাজ নির্মাণ কারখানা শুরু করে। কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী কর্ণেল হেনরী ওয়াটসন (১৭৩৭-১৭৮৬) খিদিরপুরে বাংলার প্রথম ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। করমন্ডল উপকূল থেকে লবণ আমদানি এবং চাল, সুতার তৈরি বিভিন্ন বস্ত্রের থানসমূহ ইত্যাদি ইংল্যান্ডে রপ্তানি জাহাজ নির্মাণের ব্যাপারে প্রেরণা যোগায়। যদিও অধিকাংশ জাহাজের মালিক ছিলো ইউরোপীয় এজেন্সি হাউসসমূহ তথাপি ব্যতিক্রম ছিলেন, শেখ গোলাম হোসেন, দোরাবজি বৈরামজি ও রামদুলাল দে প্রমুখ মুষ্টিমেয় ভারতীয় মালিক। জাহাজ চলাচলের সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় বীমার। ১৮০৪ সালের ৬টি বীমা কোম্পানি ১৮৩২ সালে ১৫টিতে দাঁড়ায়, যেগুলি এজেন্সি হাউসসমূহের সাথে একত্রে মিলেমিশে তাদের কার্য পরিচালনা করত।
যদিও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি পূর্ববর্তী মুসলিম অভিজাতদেরকে তাঁদের শাসক মর্যাদা থেকে অপসারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তবুও কলকাতার সমাজের অভ্যন্তরে একটি নতুন উদীয়মান মুসলিম শ্রেণি ক্রমান্বয়ে দানা বাঁধতে ছিলো। ১৮৫৬ সাল নাগাদ কমপক্ষে ২৮টি যাতায়াতের পথ তাঁদের নামানুসারে পরিচিত ছিল। সদরউদ্দীন-দিদার বক্স-আলীমউল্লাহ্ মুনশি, ইমদাদ আলী-গোলাম সোবহান মৌলবী, লাল-বুধু-গুলু-নবাবদি ওস্তাগর, করিম বক্স খানসামা, রফিক সারেং, আনিস পরামানিক, নাজির নজিবউল্লাহ্, শরিফ দফতরি, ইমাম বক্স থানাদার, খায়রু মেথর প্রমুখের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তাদের নামে এ সকল রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য, তাদের আর্থিক সচ্ছলতা সম্পর্কে পরোক্ষ প্রামাণিক তথ্য ছিল।
খায়রু ও গুলু যথাক্রমে ধাঙর ও দরজি হওয়া সত্ত্বেও মনোরম দুটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এটা পরিতাপের বিষয় যে, উক্ত ব্যক্তিবর্গ কোনো ভাষাভাষী তা জানা যায়নি। যে নূর মুহম্মদ সরকার ও শুকুর সরকারের নামে দুটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে তাদের পদবি নির্দেশ করে যে তারা বাঙালি ছিলেন।
উপরের বর্ণনামূলক আখ্যায় যে সকল পেশাজীবীর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তারা ছাড়াও সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন হাকিম ও চিকিৎসক, সদর দীউয়ানি আদালতের উকিল, মোক্তার ও অনুবাদক হিসেবে কর্মরত মৌলবি ও মুনশিগণ, অশ্ব, চামড়া, মহিষের-শিং, ‘মির্যাপুর কার্পেট’, সুতি কাপড় ও সিল্কের তৈরি বস্ত্র, গ্লাস ও মৃন্ময় পাত্র, নির্মাণ সামগ্রী ও আলোক সামগ্রী, আফিম, নীল, মিঠাই ইত্যাদি কারবারের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীগণ। মুসলমান কর্মজীবী শ্রেণির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল হীরক-কাতুরি, ‘স্বর্ণ ও রৌপ্যের লেস’ (জরি) প্রস্ত্ততকারী, আরবি-ফারসি-উর্দু পুস্তক ছাপাকারী, নকশা খোদাইকারী, চুল পরিচর্যাকারী ও পরচুলা তৈরীকারক, চাকাওয়ালা গাড়ি ও পালকি নির্মাতা, মরিচা রোধক ধাতু প্রলেপকারী ও গিলটি প্রস্ত্ততকারী, আস্তাবল-রক্ষক, কসাই, ও অন্যান্যেরা। সুতরাং সিপাহি বিপ্লব এর মাত্র এক বছর পূর্বে ১৮৫৬ সালে, যখন মুসলিম অভিজাতদের পড়ন্ত অবস্থার বিদ্বেষ প্রকাশ হচ্ছিলো, কলকাতায় তখন আরেক শ্রেণির মুসলমানদের উত্থান পরিদৃষ্ট হতে থাকে যাদের অধিকাংশেরই তেমন পারিবারিক পটভূমি ছিলো না। এ অবস্থা কলকাতার সমাজে শীর্ষে উঠে আসতে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সহজাতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। শেষোক্ত ভূঁইফোর সম্প্রদায়টির উন্নাসিক চরিত্রকে কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতুম প্যাঁচার নকশায় (১৮৬১-৬২) কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।
কলকাতার এ দেশিয় ‘রাজোচিত’ সামাজিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন রাজা রাজবল্লভ (বাগবাজার; রাজ দুর্লভের পুত্র), রাজা রামমোচন (পাথুরিয়াঘাটা; বাঁশিত্তর্ত-এর দীউয়ান রামচরণ রায়ের পুত্র), রাজা জয় নারায়ণ (ভূকৈলাস-খিদিরপুর; ভেরেল্স্ট-এর দীউয়ান গোকুল ঘোষালের ভ্রাতুষ্পুত্র), রাজা লোকনাথ (জোড়াসাঁকো; হেস্টিংসের দীউয়ান কৃষ্ণকান্ত নন্দীর পুত্র), এবং জোড়াসাঁকো পাইকপাড়ার রাজ পরিবার (কোম্পনির দীউয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহের বংশধরবৃন্দ)। কিন্তু রাজকীয় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন ক্লাইভের ফারসি লিপিকার শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ যাকে হেস্টিংস ১৭৭৮ সালে সুতানটির চিরস্থায়ী তালুকদারি প্রদান করেন।
এ শ্রেণির মুসলমান সদস্যবৃন্দ ছিলেন চিৎপুরের নবাবগণ (রেজা খানের বংশধরবৃন্দ), টালিগঞ্জের যুবরাজগণ (টিপু সুলতানের বংশধরবৃন্দ) এবং মেটিয়াবুরুজে ওয়াজেদ আলী শাহ্র পরিবার।
এ সকল রাজা ও নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ এবং সে সাথে যারা গভর্নর, শেরিফ, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি, লবণ এজেন্ট, রাজার অমাত্যবর্গ, বেতন প্রদানকারী কর্মচারীবৃন্দ, রাজ কোষাগারে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিবর্গ, কোম্পানির অস্ত্রাগার, শুল্ক বিভাগ, লবণ কমিটি ও অন্যান্য আরও অনেক বিভাগে যারা দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তারা সমৃদ্ধিশালী হন এবং সুযোগ-সুবিধামত কলকাতায় বসিত স্থাপন করেন। নন্দরাম সেন, চূড়ামণি দত্ত ও তুলসীরাম ঘোষের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ঢাকায় বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদের অধীনে চাকুরি করে বিত্তশালী হন কিন্তু স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে কলকাতাকে বেঁছে নেন। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত ব্যক্তি অত্যুচ্চ পীঠস্থান এবং অন্য দু’জন প্রশস্ত বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। এ শ্রেণির ব্যক্তিদের উদ্বৃত্ত সম্পদরাজি সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারি ক্রয় করার কাজে বিনিয়োগ করা হয়। পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর (আদিতে যশোহর থেকে) ঠাকুর পরিবার ছিলেন এরূপ জমির মালিকানার ভিত্তিতে নব উন্নীত অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টান্তস্থাপনকারী সদস্যবৃন্দ।
বিদেশি সম্প্রদায় ও স্থানীয় এ দেশিয় ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভারতীয়রাও কলকাতা যে বাণিজ্যিক উৎকর্ষের অনুকূল পূর্বলক্ষণের হাতছানি দিয়ে আহবান জানাত তার আকর্ষণে এখানে চলে আসে। দিল্লি, বারাণসি, এলাহাবাদ, মথুরা, বৃন্দাবন, কনৌজ, হাতরা ও মির্যাপুর থেকে খত্রিগণ উনিশ শতকে এখানে চলে আসে। তারা ব্যাংকিং, দালালি, এজেন্সি ব্যবসায় এবং খাদ্যশস্য, বীজ, তামাক, সুগন্ধি দ্রব্য, ধুপকাটি, বস্ত্র, পাট, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে উন্নতিলাভ করে।
বহিরাগত জাঠগণ প্রধানত জুয়েলারি, পাট ও রেশমের ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সুরাটের অস্তাচলের পর পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত বণিকগণ (হিন্দু: বেনিয়া ও শ্রাবক; মুসলমান: শিয়া ও দাউদী বোহ্রা; পারসিক) কলকাতার উদ্দেশে অভিগমন করে। দিয়াশলাই ব্যবসায়ী মেহেরবানজী নানাভাই মেহতা, বাদাম ও চালের কারবারি আয়ুব ভ্রাতৃগণ, এবং চায়ের বিরাট ব্যবসায়ী এম.এম. ইস্পাহানি যথাক্রমে বরোদা, কাথিওয়াড় ও সুরাট থেকে এখানে আগমন করেন। অনুরূপভাবে, পাঞ্জাব থেকে আগত সাবরওয়ালরা, জিৎমুল ভোজরাজ ও অন্যান্যেরা বিভিন্ন কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করে সাফল্য লাভ করেন। কিন্তু তাদের সকলের সাফল্যকে অতিক্রম করে যায় মাড়োয়ারীদের বিপুল উদ্দীপনা। উনিশ শতকে তাদের প্রভাব বড়বাজারকে ফলত রূপান্তরিত করে ফেলে।
একটি নগরী কারিগর ও শ্রমিকদের জন্যও কর্মসংস্থানের যোগান দেয়। প্রান্তীয় জনগণ যেমন রাস্তার ঝাড়ুদার (হাড়ি ও ধাঙর), বিহারি দুধওয়ালা (আহির), বাঙালি দুধওয়ালা (গোয়ালা), লেপ-তোশক সেলাইকারী (কম্বুলিয়া), কসাই, ভেষজ গুণসম্পন্ন লতাপাতা সংগ্রাহক ও বিক্রেতা (কাওড়া), তাল-মিছরি উৎপাদনকারী (গুড়ি), কাঠমিস্ত্রি (ছুতার), মৎস্যজীবী (জেলে), মুসলিম বয়নকারী (জোলা), কয়লার সূক্ষ্ম চূর্ণ দিয়ে টিকিয়া তৈরীর কাজে লিপ্ত মুসলমান, মৃতদেহ দাহকারী (ডোম), ঢোলবাদক (ঢুলি), পুস্তক বাঁধাইকারী (দপ্তরি), ধোপা, মাছ কাটার সাথে জড়িত মুসলামন (নিকারি), চিত্রকর (পটুয়া), তরি-তরকারি ও শাক-সবজি বিক্রেতা (ফড়িয়া), গরুর গাড়ি চালক (বলদিয়া), যাযাবর (বেদিয়া), ভোজবাজিকর (ভালুকওয়ালা ও ডুগডুগিওয়ালা), নৌকা চালক (মাল্লা), মুচি, শাঁখারি, শিকারি সকলেই কলকাতার বিভিন্ন স্থানের নামকরণে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু আজকাল তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আর কিছু জানা যায় না। বারবনিতারাও স্বতন্ত্র একটি গ্রুপ গঠন করেছিল। ইউরোপীয় ও স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উপপত্নীরা তাদের সঙ্গীদের বন্দোবস্তকৃত বাসস্থানে সমস্ত নগরীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত।
কলকাতার জাতিগত বৈচিত্র্যে সর্বশেষ পরিবর্তনের প্রকাশ ঘটে ইউরোপীয় ধর্ম প্রচারকদের ধর্মান্তরিত করার কাজে আত্মনিয়োগের মধ্য দিয়ে। যিশু খ্রিস্টের বাণী প্রচারের কাজে তাদের প্রচেষ্টা নেয়ার ফলে একটি এদেশীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণ চলতে থাকে। কলকাতায় প্রথম প্রধান ধর্মপ্রচারক জন যাখারিয়া কিয়ারনান্ডার (১৭১১-১৭৯৯) প্রাচীন বা মিশন চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে পরবর্তীকালে (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৩) মাইকেল মধুসুদন দত্ত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন। পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত এরূপ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক হলেন নাথানিয়েল ফরসিথ (লন্ডন মিশনারি সোসাইটি), উইলিয়ম কেরী (ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি; পরবর্তীকালে হুগলির শ্রীরামপুরে স্থানান্তরিত), জেমস লং (চার্চ মিশনারি সোসাইটি), আলেক্সান্ডার ডাফ (চার্চ অব স্কটল্যান্ড) এরা সকলেই প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসকে প্রতিনিধিত্ব করতেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে তাদের সমষ্টিগত অবদান শ্রদ্ধাযোগ্য। বৃহৎ একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় (১৮১৮) ব্যাপ্টিস্টদের প্রচেষ্টা এবং নীল চাষ বিরোধী আন্দোলনে লং-এর সহূদয় অংশগ্রহণ অধিকভাবে স্মরণযোগ্য।
ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্বকারী জেসুইটগণ ১৮৩৪ সালে এদেশে এসে পৌঁছেন এবং ১৮৩৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যাদেরকে ধর্মান্তরিত করা হতো তাদেরকে প্রধানত বাংলার সমাজের সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণিসমূহ থেকে তুলে আনা হতো। কিন্তু ডাফ উচ্চতর শ্রেণি ও বর্ণসমূহের মধ্য থেকে অনেককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। রেভ: কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী, রেভ: কালিচরণ ব্যানার্জী, রেভ: লালবিহারি দে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর (প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার), মনোহর ঘোষ (শ্রীহট্ট প্রকাশ-এর সম্পাদক) প্রমুখের মতো খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হিন্দুগণ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। রামবাগানের দত্ত পরিবারের খ্রিস্টান শাখাটি, যেটির প্রতিনিধিত্ব করতেন মহিলা কবি তরু, কবি হরচন্দ্র, গিরীশ চন্দ্র ও অন্যান্যেরা, সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁদের কীর্তির জন্য উচ্চ প্রশংসিত হয়েছেন। মুসলমানদের মধ্য থেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে যারা অভিনিবেশ সহকারে সাহিত্য পঠন-পাঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে গুলজার শাহ্ একটি শাস্ত্রীয় পাঠ্যপুস্তক অনুবাদ করেছেন এবং স্যামুয়েল পীর বক্স একটি নাটক রচনা করেছেন (বিধবা বিরহ, ১৮৬০)।
কলকাতার পুলিশকে প্রয়োজনীয় জনশক্তির ঘাটতির কারণে সর্বদা দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে, এবং ১৭৭৮ সালে ৭০০ জন পাইক, ৩১ জন থানাদার ও ৩৪ জন নায়েব নিয়োগের মাধ্যমে এর প্রতিকারের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ১৭৮৫ সালের ৯ জুন তারিখে প্রত্যেক থানাদারের অধীনে একটি করে অংশের দায়িত্ব ন্যস্ত করে শহরটিকে ৩১টি অংশে বিভক্ত করা হয়। তবু এ বিভাগ ক্রমাগতভাবে সমালোচিত হতে থাকে, এবং লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৯৩), লর্ড ওয়েলেসলী (১৮০০), লর্ড মিন্টো (১৮০৮), লর্ড বেন্টিঙ্ক (১৮২৯) এ দুর্নাম দূর করতে তদন্ত ও প্রতিকারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু ফিভার হসপিটাল কমিটির সামনে প্রায় সকল আমলা এ পুরো ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। পরিশেষে চীফ ম্যাজিস্ট্রেট জে.এইচ প্যাটন আমূল সংস্কার সাধন করেন। তাঁর প্রচেষ্টা যে চিরস্থায়ী সুবিধা বয়ে আনেনি তা আন্দাজ করা যায় এ ঘটনা থেকে যে লর্ড ক্যানিংকে নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্রতী হতে হয় (১৮৬০-৬২)। ইতোমধ্যে ‘প্রিন্স অব মার্চেন্টস’ নামে খ্যাত জন পামার এর ১৮৩৫ সালে নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যু হয় এবং কলকাতার পুলিশের জন্য একটি স্থায়ী সদর দফতর যোগাতে লালবাজারে অবস্থিত তাঁর প্রাসাদতুল্য দালান-কোঠা ২ লক্ষ সিক্কা টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয়। ১৭৯৩ সালে একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া সকল দারোগা ছিল মুসলমান। ১৮৫০ সালের মে মাসে শেখ মোলায়েমকে কলকাতার প্রথম ভারতীয় পুলিশ ইন্সপেক্টর নিয়োগ করে এ ধারাটি বজায় রাখা হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতকের প্রারম্ভে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পুলিশের নির্মম অত্যাচার পরিলক্ষিত হয়। তাদের স্বদেশ মুক্তির আন্দোলন থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাধান্য রক্ষা করার জন্য চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট, পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী, বসন্তকুমার চ্যাটার্জী প্রমুখ যে ধরনের সহায়তা করে তা’ বিশেষভাবে কুখ্যাত।
দলে দলে ভিড় জমাতে থাকা বিপুল জনসংখ্যার জন্য কলকাতায় পূর্ণাঙ্গ পৌর প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ১৭২৭ সালের রাজকীয় সনদের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একজন মেয়র ও নয়জন বিশেষ সম্মানিত সদস্য সমবায়ে গঠিত মেয়রের আদালত ব্রিটিশবাসীদের জন্য দীউয়ানি, ফৌজদারি ও গির্জা সংক্রান্ত বিচারকার্য পরিচালনা ও কর আরোপ করত। এ বিরাজমান ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ সংশোধিনের জন্য ১৭৯৪ সালে বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হয় যারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত থাকবেন। সম্পদের ঘাটতি তাঁদেরকে অসহায় করে তোলে এবং ১৮০৩ সালে ওয়েলেসলী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ের উন্নতিবিধান ও লটারি কমিটিদ্বয়ের সফল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নগরীটির শোচনীয় স্বাস্থ্যগত অবস্থা লর্ড অকল্যান্ডকে ১৮৩৬ সালে ফিভার হসপিটাল ও পৌর উন্নতিবিধান কমিটিটি নিয়োগে উদ্দীপ্ত করে। অভীষ্ট লাভে বিশাল প্রচেষ্টা চালানোর পর কমিটি আমূল সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। এ পরিবর্তনসমূহকে বাস্তবায়িত করতে নির্বাচিত ও মনোনীতি উভয় পদ্ধতিতে কমিশনারদের নিয়োগ দানের জন্য নতুন আইন প্রণীত হয় এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা, রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৮৭৭ সালে একটি শহর পরিষদ গঠন করা হয়। সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯২৩ সালের আইনের মাধ্যমে পৌর কর্পোরেশনকে চূড়ান্ত আকার দেওয়া হয়।
কলকাতা বৈদ্যুতিক বাতি আইন প্রণয়ন (১৮৯৫) ও কলকাতা বৈদ্যুতিক বাতি লাইসেন্স প্রবর্তনের (১৮৯৬) পরে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোং লি. প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয় (ডিসেম্বর, ১৮৯৬)। কোম্পানিটি শীঘ্রই তার নাম পরিবর্তন করে কলকাতা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্পোরেশন লি. করে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭) এবং ‘ক্রোম্পটন’ ডায়নামো, ‘উইলান্স’ ইঞ্জিন ও ‘বেকক অ্যান্ড উইলকক্স’ বয়লারের সাহায্যে ইমামবাগ লেনে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন নির্মাণ করা হয়। ১৮৯৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা আরম্ভ হয়।
যেকোনো নগরে জনসাধারণের যাতায়াতের পথ ফলত ধমনীসদৃশ যার উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করে। প্রথম যে প্রশস্ত রাজপথটি ইট বিছানো হয় সেটি ছিল সার্কুলার রোড (১৭৯৯; পাথর-চূর্ণ দিয়ে কলকাতার রাস্তাসমূহ পাকা করার কাজ চালু করা হয় ১৯৩৪-৩৫ সালে)। যেহেতু অশ্ব-চালিত যানবাহন চলাচলের জন্য শান-বাঁধান রাস্তার প্রয়োজন হয়, তাই উনিশ শতকের শুরুতে শেষ পর্যন্ত এ ধরণের রাস্তার প্রচলন করা হয়। তখন পর্যন্ত গরুর গাড়ি ও পালকি ছিল স্থানীয় যাতায়াতের একমাত্র পন্থা। শুরুতে বাঙালি ডুলিয়া ও বাগদিগণ এবং পরে হিন্দুস্থানিরা পালকি বহন করত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে উড়িয়া বাহকগণ তাদের সবাইকে হটিয়ে দিয়ে সে স্থান দখল করে।
যদিও অশ্ব-চালিত গাড়িসমূহের সংখ্যা, বৈচিত্র্য ও চমৎকারিত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে, একই সাথে মোটর গাড়ি ও ট্রাম চলাচল প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত পালকির প্রতাপও বিদ্যমান থাকে। শিয়ালদা ও হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে যাতায়াত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক ট্রাম ব্যবস্থা চালু করা হয় (১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি)। প্রথম লাইনটি বউবাজার রাস্তা ও ডালহৌসি স্কয়ারের মধ্য দিয়ে স্ট্র্যান্ড রোডের আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত চলাচল করত যেখানে যাত্রীগণ নদী পার হয়ে হাওড়া পৌঁছার জন্য স্টিমারের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারত। এতে লোকসান হতে থাকায় এ সার্ভিসটি শীঘ্র ভেঙ্গে পড়ে (১৮৭৩ সালের ২০ নভেম্বর) এবং রেলপথ ও শকটাদি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ১৮৭৮ সালে এটি পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং প্রাক্তন ক্রয়কারীগণ কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানি গঠন করে। পৌর কর্পোরেশনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ট্রাম আবার নতুন করে চালু করা হয় (১৮৮০ সালের ১ নভেম্বর)। ট্রাম টেনে নিয়ে যাবার কাজে নিয়োজিত পশ্চিমা ঘোড়াসমূহ ক্রান্তীয় উচ্চ তাপ সহ্য করতে না পেরে প্রায়শ মারা যেত এবং এগুলির ঘন মৃত্যুর হার বাস্পচালিত ইঞ্জিন দিয়ে পরীক্ষা চালানোকে উৎসাহিত করে (১৮৮২-৮৩)। পরবর্তীকালে কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানির নিকট থেকে একটি প্রস্তাব (১৮৯৬), যাতে ট্রামের পন্য বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বাস্তব সমাধান বলে বিবেচনা করা হয়, এবং ১৯০২ সালে অশ্বের স্থান দখল করে নেয় বিদ্যুৎ। ট্রামের মতো, কলকাতা ও ব্যারাকপুরের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বাসগুলি চলাচল করত (১৮৩০) সেগুলিকেও অশ্ব কর্তৃক চালিয়ে নেওয়া হতো। ১৮২২ সালে কলকাতায় মোটর বাস চালু করা হয়। ওয়ালফোর্ড অ্যান্ড কোম্পানি তাদের বৃহদাকার লাল বাস প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্যান্য বিনিয়োগকারীকে ছাড়িয়ে যায়। তারা দ্বি-তল বাসও নিয়ে আসে (১৯২৬)। শহরতলিতে বাস-সার্ভিস প্রবর্তন করেন আবদুস সোবহান। ব্যক্তিগত পর্যায়ের যানবাহনসমূহের মধ্যে কলকাতায় বাইসাইকেল আসে ১৮৯৯ সালে এবং মোটর গাড়ি ১৮৯৬ সালে। ভাড়ায় চলা টেক্সির ব্যবসা শুরু হয় ১৯০৬ সাল থেকে। ১৯০০ সালের দিকে চীনাগণ কর্তৃক রিকসা আমদানি করা হয়, কিন্তু ১৯২০ সাল নাগাদ এ ব্যবসায় পুরোপুরিভাবে ভারতীয়দের হাতে চলে আসে।
আধুনিক কলকাতা রেল যোগাযোগ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক কলকাতার সূত্রপাত ঘটে। কলকাতা-রাণীগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র রুটের প্রস্তাবের সাথে (১৮৫০) কলকাতাকে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সাথে রেলপথের দ্বারা সংযুক্ত করার ধারণা আরম্ভ হয়। নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় ১৮৫১ সালে এবং হুগলি (সেপ্টেম্বর, ১৮৫৪), বর্ধমান (ডিসেম্বর, ১৮৫৪) এবং রাণীগঞ্জকে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৫) তৎপরতার সাথে সংযুক্ত করে ফেলা হয়। রাণীগঞ্জ-আসানসোল (১৮৬৩) ও ডানকুলি-শিয়ালদা (১৯৩২) লাইন খোলার মধ্যবর্তী সময়ে হাওড়া ও শিয়ালদা স্টেশনের মাধ্যমে আড়াআড়ি ও কোনাকুনিভাবে প্রদক্ষিণ পথের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার ফলে কলকাতার রেল ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়।
১৯২২ সাল থেকে দমদমের তৃণভূমি উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য ব্যবহূত হয়ে আসছিল। বিমান ঘাঁটি ও রানওয়ে তৈরীর কাজ শুরু হয় যথাক্রমে ১৯২৮-২৯ ও ১৯৩০ সালের কাছাকাছি সময়ে। ১৯৩৩ সাল থেকে নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হয়।
দেশের অন্যান্য অংশের সাথে কলকাতার যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যাপারে যে ব্যবস্থাটি অন্যগুলিকে ছাপিয়ে ওঠে তা হলো জলপথে আসা-যাওয়া। মালামাল ও যাত্রী বহন করার জন্য দেশিয় নৌকা এ জলপথগুলি ব্যবহার করত। উত্তর ভারতে চলাচলের জন্য ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোং, রিভারস স্টিম নেভিগেশন কোং ও অন্যান্য স্টিমার সার্ভিস চালু করে। কলকাতা ও হাওড়ার প্রধান ঘাটগুলিকে সংযোগকারী দি পোর্ট কমিশনারস ফেরি সার্ভিস (১৯০৭-১৯২৭) আর্থিক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয় এবং এ কাজটির ভার পরবর্তী সময়ে বহন করে ক্যালকাটা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড।
সুয়েজ খালটিকে জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্তকরণ (১৮৬৯), কলকাতা বন্দরকে তার পশ্চাৎভূমির সাথে সংযুক্তকরণের জন্য রেলপথ নির্মাণের কাজ সম্পাদন (১৮৭০) এবং কৃষিভিত্তিক থেকে শিল্পোন্নত অর্থনীতির প্রতি ক্রমান্বয়ে ঝোঁক এ বন্দরটির গুরুত্ব ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করে। ভবিষ্যৎ উৎকর্ষের অনুকূল পূর্বলক্ষণ সমৃদ্ধ ও বন্দরটির উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে নিরাপদে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে ১৮৬৩ সালে একটি রিভার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার কথা গভীরভাবে চিন্তা করা হয়, ১৮৬৬ সালে এটার উদ্বোধন করা হয়, কিন্তু স্বতন্ত্র তহবিলের অভাব হেতু ষোল মাসের মধ্যে তা ভেঙ্গে পড়ে। এর ধ্বংসাবশেষ থেকে দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর ১৮৭০ সালের অক্টোবর মাসে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট অস্তিত্ব লাভ করে। এর কমিশনারগণের প্রবল কর্মোদ্যমের ফলে পূর্বেকার জেটিগুলিকে সংযুক্ত করে একটি অবিচ্ছিন্ন কাষ্ঠনির্মিত ঘাট গঠন সম্ভব হয় যা মাল বোঝাই বা খালাসের নিমিত্তে জাহাজ বা নৌকা ভিড়ানোর জন্য ব্যবহূত হয়, বাষ্পচালিত ক্রেনগুলিকে হাইড্রোলিক ক্রেন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়, রাতের-শিফটে কাজ শুরু করে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের নিজস্ব রেল লাইন সম্প্রসারিত করে। ১৮৭৪ ও ১৮৮৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মালপত্র উঠা-নামার পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত স্থান সংকুলানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং খিদিরপুর ডক নির্মিত হয় (১৮৮৫-১৮৯২)। ১৯১৩-১৪ সালে কল্পিত ও প্রস্তাবিত গার্ডেন রীচ-এ আরেকটি নতুন ডক-ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিকূল বাণিজ্যিক পরিবেশের দ্বারা ব্যাহত হয়। যা হোক, এটা ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করে এবং এর নাম রাখা হয় কিং জর্জেস ডক। কিন্তু এ বিস্তৃত প্রচেষ্টাসমূহ ঊনিশ শত ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দা, রেলওয়ের সাথে প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক আলোড়ন দ্বারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। কীভাবে ক্রমে ক্রমে এর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপ প্রবল হয়ে ওঠে এবং প্রকৃতপক্ষে খিদিরপুর ডকে বোমাবর্ষণ করা হয়।
সাংস্কৃতিক জীবন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শৈল্পিক কৃতিত্বের বিবেচনায় এক সময় কলকাতা ‘উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলে বিবেচিত হতো। ১৭৮৪ সালে স্যার উইলিয়ম জোনস এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কলকাতা মাদ্রাসা, কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি, কলিকাতা স্কুল সোসাইটি, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, বেশ কিছু সংবাদ ও সাময়িক পত্রের প্রতিষ্ঠা, হিন্দু কলেজ এবং নানা ধরনের শিক্ষাশ্রম, স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, বেশ কিছু পেশাজীবী সমিতি, ছাপাখানার সৃষ্টি এবং পরিশেষে বেশ কিছু অধিভুক্ত কলেজসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠা সাংস্কৃতিকভাবে কলকাতাকে উনিশ শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অনন্য শহরে পরিণত করে।
ছাপাখানা আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করে। কলকাতার প্রথম মুদ্রাকর ছিলেন বেঙ্গল গেজেট অথবা ক্যালকাটা জেনারেল এডভাটাইজার-এর জনক জেমস অগাস্টাস হিকি (১৭৩৯ ?-১৮০২ খ্রি.)। প্রথম ভারতীয় মুদ্রাকর হচ্ছেন উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ বাবুরাম (খিদিরপুর)। Bangal Gejeti-এর জনক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য (মৃত্যু ১৮৩১ খ্রি. ?) হলেন প্রথম বাঙালি মুদ্রাকর। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রকাশক, সাংবাদিক ও পুস্তক বিক্রেতা। বর্তমানের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই এর কাছাকাছি বিশ্বনাথ দেব কর্তৃক বটতলার প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় (১৮১৮ খ্রি.)। ১৮৭০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বটতলা ছিল বাংলা ভাষায় গ্রন্থাদি ছাপা ও প্রকাশের কেন্দ্র। কিন্তু হিন্দু কলেজের স্থানান্তর এবং পটলডাঙ্গায় সংস্কৃত কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, হেয়ার স্কুল এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটলে ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রীট বই-পুস্তক ছাপা ও প্রকাশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে। মোটামুটিভাবে ১৮৭৪ এবং ১৮৮৬ সালে যথাক্রমে ২টি এবং ৭টি এবং ১৮৯৯ সালে এ স্ট্রীটে ৩৬টি বইয়ের দোকান গড়ে ওঠে। বটতলা এবং কলেজ স্ট্রীটে ব্যাপকভাবে ঈশ্বরতত্ত্ব, গল্প, উপন্যাস বা কল্পিত কাহিনী এবং যৌন বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহ দেখা দেয়। রামমোহন রায় এর ফারসি পত্রিকা মিরাত-উল-আখ্বার (১৮২২), এবং হিন্দি পত্রিকা উদন্ত মর্তন্দ (১৮২৬)-এর পাশাপাশি উনিশ শতকে কলকাতা থেকে বাংলায় সমাচার চন্দ্রিকা, সংবাদ কৌমুদী, সংবাদ তিমিরনাশক ইত্যাদি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়।
চারুকলায় কলকাতা অনেক শহরকেই ছাড়িয়ে যায়। ১৮৩১ সালে কলকাতা টাউন হল এ ‘ব্রাহ্ম ক্লাব’-এর আয়োজনে প্রথম শিল্পকলা প্রদর্শনী হয়। কয়েকজন ‘শিক্ষিত ভারতীয়’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সোসাইটি ফর ইমপ্রুভমেন্ট অব ওরিয়েন্টাল পেইনটিং অ্যান্ড স্কাল্পচার’ (১৮৪২)-এর অখ্যাত ও স্বল্প স্থায়িত্বের পর ১৮৫৪ সালে ‘সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’-এর গৌরবময় আবির্ভাব ঘটে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এ সোসাইটি ১৮৫৪ সালের ১৬ আগস্ট ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ এবং পরে এটিই ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট’ (১৮৬৪)-এ রূপান্তরিত হয়। ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা আর্ট সোসাইটি’ (১৮৮৯) এবং বাঙালি চিত্রকরদের প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রমোশন অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড ন্যাশনাল গ্যালারি’ (১৮৯২) বিলুপ্ত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিগণের সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট বঙ্গীয় কলা সংসদ (১৯০৫) ও টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। বিশ শতকের কলকাতার সুবিখ্যাত শিল্পকলা সমিতি হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’ (১৯০৭)। পশ্চিমা রীতির অনুসারীগণ ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অব আর্ট’ (১৯২০) এবং ‘সোসাইটি অব ফাইন আর্টস’ (১৯২১) প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে একটি বিপ্লবী গ্রুপ ‘ইয়াং আর্টস্ট ইউনিয়ন’ (১৯৩১) এবং ‘আর্ট রেবেল সেন্ট্রাল’ (১৯৩৩) গড়ে তোলে। ক্ষণকালীন প্রভাব বিস্তারের পর এসকল অ্যাসোসিয়েশনেরও মৃত্যু ঘটে। ‘একাডেমী অব ফাইন আর্টস’ (১৯৩৩) ব্যতিক্রমভাবে সংগঠনটির সাফল্যময় অস্তিত্ব অব্যাহত রাখে।
দেশিয় এবং ইউরোপীয় থিয়েটার হচ্ছে কলকাতার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতায় চিরায়ত যাত্রা ছিল খুবই জনপ্রিয়। উনিশ শতকে গোবিন্দ অধিকারী (আনু. ১৮০০-১৮৭২) এবং নোকো (লহ্মণ) ধোপা নিজেদের যাত্রা দলে খ্যাতি অর্জন করেন। পশ্চিমা থিয়েটারের অনুপ্রবেশ এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ধীরে ধীরে দেশিয় যাত্রাকে হটিয়ে দিতে থাকে। সিরাজের কলকাতা অবরোধের সময় ইংরেজদের প্রথম নাট্যশালা ‘প্লে হাউস’ (মিশন রো, ১৭৫৫) ধ্বংস করা হয়। পলাশী-উত্তর দুটি প্রয়াস ছিল কলকাতা থিয়েটার (লিয়নস রেঞ্জ, ১৭৭৫-১৮০৮) এবং মিসেস ব্রিস্টৌ থিয়েটার (চৌরঙ্গী, ১৭৮৯)। কলকাতাস্থ ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠার পেছনে কোনো বাঙালি ছিলেন না ছিলেন Gerasim Lebedeff (এজরা স্ট্রিট, ১৭৯৫-৯৬) নামে রাশিয়ার একজন নাগরিক। পরে ইংরেজ উদ্যোক্তাগণ হুইলার প্যালেস (১৭৯৭), এথেনিয়াম (সার্কুলার রোড, ১৮১২), চৌরঙ্গী এবং San Souci (পার্ক স্ট্রীট, ১৮৩৯) থিয়েটার স্থাপন করেন। প্রচলিত ধারায় উৎসাহিত হয়ে প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ১৮৩১ সালে নারকেল ডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিন্দু থিয়েটার’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কলকাতার ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত অনেকগুলি থিয়েটার হাউস উপরিল্লিখিত।
অপেশাদার গ্রুপের উদ্ভব ছিল অত্যন্ত স্বভাবিক এবং বাগবাজারে এ ধরনের দলের উদ্যোগ থেকেই পাবলিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠা তরান্বিত হয় (জাতীয় থিয়েটার, আপার চিতপুর রোড ৭ ডিসেম্বর ১৮৭২- ৮ মার্চ ১৮৭৩)। দ্বিতীয় বারের উদ্যোক্তাদের (ওরিয়েন্টাল থিয়েটার, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, ১৮৭৩) সাদামাটা উদ্যোগের পর শরৎচন্দ্র ঘোষ (বেঙ্গল থিয়েটার, বিডন স্ট্রীট, ১৬ আগস্ট ১৮৭৩ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৮৯০) উচ্চাকাক্ষী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। শরৎচন্দ্র প্রথম মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পতিতাদের নিয়োজিত করেন। এ থিয়েটারের নাম ‘রয়্যাল এপ্রোবেশন’ (১১ জানুয়ারি ১৮৯০ থেকে ২০ এপ্রিল ১৯০১) এর পরিবর্তে ‘রয়্যাল বেঙ্গল থিয়েটার’ রাখা হয়। অসময়ে এটি বন্ধ হয়ে যাবার পর বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে এর অঙ্গন ব্যবহূত হয়। গ্রুপগুলির মধ্যে ছিল অরোরা (১৯০১-২), ইউনিক (১৯০৩-৪), ন্যাশনাল (১৯০৫-১১), গ্রেট ন্যাশনাল (১৯১১), গ্রান্ড ন্যাশনাল থিয়েটার (১৯১১-১৪), থেসপিয়ান টেম্পল (১৯১৫-১৬) এবং প্রেসিডেন্সি থিয়েটার (১৯১৭-১৮)।
ধর্মদাস শূর-এর প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় ভুবন মোহন নিয়োগী প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’ (বিডন স্ট্রীট) তার বৈচিত্রময় অস্তিত্ব বজায় রাখে (৩১ ডিসেম্বর ১৮৭৩- অক্টোবর ১৮৭৭ পর্যন্ত)। নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এটি গিরিশচন্দ্র ঘোষ ভাড়া নেন এবং এর নতুন নামকরণ করেন ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু তিনি এ থিয়েটারের অধ:পতন রোধ করতে ব্যর্থ হন। মিনার্ভা থিয়েটার (১৮৯৩) হিসেবে নতুন নামকরণের পূর্বে ও পরে এটি বার কয়েক মালিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত দুর্ভোগের শিকার হয়। বিনোদিনী দাসীর স্বামী গুরমুখ রায় মুসদ্দি নির্মিত স্টার থিয়েটার (বিডন স্ট্রীট, ১৮৮৩) রসরাজ অমৃতলাল বোস ও অন্যান্যরা ১৮৮৭ সালে কিনে নেন। সুনামের সঙ্গেই পরে তাদের স্থানচ্যুতি ঘটে এবং সেন্ট্রাল এভিনিউ নির্মাণের জন্য ভেঙ্গে ফেলার পূর্বে এগুলি পরিচিত হয় এমারেল্ড (১৮৮৭-৯৬), সিটি (১৮৯৬-৯৬), ক্লাসিক (১৮৯৭-১৯০৭), কোহিনুর (১৯০৭-১২), মনোমোহন থিয়েটার্স (১৯১৫-২৪), শিশির কুমার ভাদুরির নাট্যমন্দির, (১৯২৪-২৫), মিত্র (১৯২৬-২৭), এবং আর্ট থিয়েটার্স (১৯২৮-৩১) হিসেবে। পূর্বের জায়গা থেকে স্থানচ্যুত হবার পর স্টার থিয়েটারের চারজন অংশীদার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে চলে আসেন। ১৯১১ সালে এ ‘স্টার থিয়েটার’ ইজারাবলে অধিকৃত হয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, অপরেশচন্দ্র মুখার্জী এবং শিশিরকুমার ভাদুরী কর্তৃক ব্যবহূত হয়। নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় তাঁর ‘বীণা থিয়েটার’ (মচুয়াবাজার স্ট্রিট, ১৮৮৭-৮৮) ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং জায়গা-জমিসহ ভবনটি পরবর্তীকালে ‘আর্য নাট্যসমাজ’ এবং উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘নিউ ন্যাশনাল থিয়েটার’ দখলে নেয়। এটি পুনঃপ্রচলনের বৃথা প্রচেষ্টায় রাজকৃষ্ণ দেউলিয়া হয়ে যান (১৮৮৯)। পরে ‘ইন্ডিয়ান অ্যান্ড সিটি থিয়েটার’, ‘ভিক্টোরিয়া অপেরা হাউস’ এবং ‘গেইটি থিয়েটার’ এ হল ব্যবহার করে।
সিটি (১৯০০), গ্রান্ড (১৯০৫), এবং নিউ ক্লাসিক (১৯০৬) থিয়েটার কার্জন থিয়েটার হলের (হ্যারিসন রোড) মালিকানা লাভ করে। (পরবর্তীকালে এটি জে.এফ মদনস আলফ্রেড থিয়েটারে রূপান্তরিত হয়)। এমনকি, পরে এটি ব্যবহার করে মদনস বেঙ্গল থিয়েট্টিকাল কোম্পানি (১৯২৩), শিশির কুমার ভাদুরি (১৯২৪), মিনার্ভা (নিজস্ব হলে অগ্নিকান্ড ঘটার কারণে, ১৯২৪), মিত্র থিয়েটার (১৯২৬) এবং নাট্য ভারতী (১৯৩৯-৪২)। প্রবোধচন্দ্র গুহের নাট্যনিকেতন (১৯৩১), যা পরবর্তীকালে শিশিরকুমারের শ্রীররঙ্গমে (১৯২৪-৫৬) পরিণত হয়, এবং অন্যান্য ছোট খাট থিয়েটার যেমন কর্নওয়ালিস থিয়েটার (১৯২১), রংমহল (১৯৩১), চীপ থিয়েটার (১৯৩৩), রঙ্গমহল (১৯৩৩), কালিক থিয়েটার (১৯৪৪০ ইত্যাদিও সুনিশ্চিতভাবেই প্রভাব বিস্তার করে।
বিশ শতকের প্রথম পাদে ‘বায়োস্কোপ’-এর সূচনা কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। জামসেদজি ফ্রামজি মদন (১৮৫৭-১৯২৩) তার এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি এবং নগরে ৫টি সিনেমা হলের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেন। মদনের উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে অনাদী বসু অরোরা সিনেমা কোম্পানি (১৯১১) এবং অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন (১৯২৯) চালু করেন। মদনের টীম থেকে কয়েকজন দলত্যাগীকে সঙ্গে নিয়ে দীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী (সাধারণভাবে ‘ডিজি’ হিসেবে পরিচিত) ‘ইন্দো-ব্রিটশ ফিল্ম কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন যা একটা মিশ্র ফল বয়ে আনে। পরে তিনি প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার সঙ্গে যোগ দিয়ে ‘ব্রিটিশ ডোমিনয়ন ফিল্মস্ লিমিটেড’ গড়ে তোলেন। কিন্তু ‘নিউ থিয়েটার লিমিটেড’-এর মাধ্যমে ধীরেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উপর দীর্ঘদিন (১৯৩১-৫৪) তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। টালীগঞ্জে এ গুচ্ছবদ্ধ স্টুডিও এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা টলিউড হিসেবে পরিচিত।
রামমোহনের ভক্তিমূলক গান তাঁর অনুসারীদের কর্মস্পৃহায় এক ধরনের গতি অর্জন করে। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী রবীন্দ্রনাথ এ ব্রহ্মগীত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল, ক্ষিরোদ প্রসাদ এবং দ্বীজেন্দ্রলালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভকারী মঞ্চ সংগীত রবীন্দ্রনাথ সমন্বিত এবং রূপান্তরিত করেন। কলকাতায় সৃষ্ট স্বদেশী সংগীত তাঁর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়।
নানা ধরনের পশ্চিমা খেলাধুলার মধ্যে আঠারো শতকে ক্রিকেটের প্রচলন এবং কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের প্রথম সুসংগঠিত ক্রিকেট ম্যাচ এ শহরেই অনুষ্ঠিত হয় (১৮-১৯ জানুয়ারি ১৮০৪)। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খেলার মাঠ ইডেন গার্ডেনের গৌরবময় উত্থান, এবং ১৮৬৪ সালে বালিগঞ্জ ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম ইংরেজ দলের সফরের আগেই বাঙালির মধ্যে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়। মাছুয়ার শরদরঞ্জন রায়ের (১৮৫৮-১৯২৫) উৎসাহ উদ্দীপনায় ক্রিকেট জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং স্পোর্টিং ইউনিয়ন, দি এরিয়ানস প্রভৃতি ক্লাব সাফল্য লাভ করে।
হকি খেলার প্রবর্তন (১৮৮৫), প্রথম বিইটন কাপ টুর্নামেন্ট (১৮৯৫), বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা (১৯০৫) এবং হকিতে প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ (১৯২৮) ধরে রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কলকাতার গৌরবময় কৃতিত্ব রয়েছে।
কলকাতাবাসীদের সবসময়ই নানা ধরনের খেলার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল, যেমন, ঘোড় দৌড় (বেঙ্গল জকি ক্লাব, ১৮০৩; ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব, ১৮৪৭, পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব, ১৯১১), গল্ফ (দি রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব, ১৮২৯), রেসলিং (১৮৫৭ সালে অম্বিকচরণ গুহ প্রবর্তন করেন), পোলো (ক্যালকাটা পোলো ক্লাব, ১৮৬৩; ইন্ডিয়ান পোলো অ্যাসোসিয়েশন, ১৮৯২), রাগবি (১৮৭২-৭৬; ১৮৮৪ সালে পুন:প্রবর্তন), বক্সিং (১৮৮৪ সালের দিকে প্রবর্তিত), লন টেনিস (১৮৮৭) সাল থেকে চাম্পিয়নশিপ চালু হয়), বিলিয়ার্ডস (বিলিয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশন, ১৯২৬), বাস্কেটবল (বেঙ্গল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন, ১৯২৭), ভারোত্তলন (বেঙ্গল স্টেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ওয়েটলিফটিং, ১৯৩৩), ব্যাডমিন্টন (অল ইন্ডিয়া ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন, ১৯৩৪), টেবিল টেনিস (বেঙ্গল টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন, ১৯৩৪), সাঁতার (বিভিন্ন পুকুর ও ক্ষুদ্র জলাধার পরিবেষ্টিত নানা ধরনের ক্লাবের অস্তিত্ব ছিল) ইত্যাদি। কিন্তু ফুটবলের প্রতি তাদের অনুরাগ ছিল অতুলনীয়।
ইংরেজগণই কলকাতায় ফুটবল খেলার প্রবর্তন করেন। ১৮৫৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২ সালে। দেশিয়দের মধ্যে ফুটবল জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব ওয়েলিংটন (১৮৮৪), টাউন (১৮৮৫) এবং শোভাবাজার (১৯৮৫) ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর। শোভাবাজার হলো প্রথম ভারতীয় ক্লাব যাদের কাছে ‘ইস্ট সারে রেজিমেন্ট’ নামে একটি ইউরোপীয় টীম ১৮৯২ সালে অনুষ্ঠিত ট্রেডস কাপে পরাজিত হয়। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (১৮৯৩) প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টের প্রবর্তন করে যা পরবর্তীকালে ভারতের সবচাইতে আকর্ষণীয় ট্রফি হিসেবে পরিগণিত হয়। যখন মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব (১৮৮৯) ইস্ট ইয়র্ক শায়ারকে পরাজিত করে (২৯ জুলাই ১৯১১) এ ট্রফি জয় করে তখন এক আবেগময় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৩৯ ব্যতীত ১৯৩৪ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত আই.এফ.এ লীগে মোহামেডান স্পোর্টি ক্লাব (১৮৯১) ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করে তার গৌরবময় অস্তিত্ব বজায় রাখে। মোহনবাগানের ৫০ বছর পূর্তির বছরে অপর ৩টি প্রধান ক্লাব (মোহামেডান, ইস্ট বেঙ্গল এবং কালীঘাট) আপোষে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়ে মোহনবাগানদের বিজয় উদযাপন করার সুযোগ করে দেয়। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব (১৯২১) ১৯৪২ সালে প্রথমবারের মতো লীগ শিরোপা পায় এবং ১৯৪৫ সালে তারা লীগ এবং শিল্ড উভয়ই লাভ করে।
কলকাতার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব কেবল অভিজাত শ্রেণির প্রচেষ্টার কারণেই সৃষ্টি হয় নি। বরং এক্ষেত্রে লোকজ বৈশিষ্ট্যাবলির গুরুত্বও একেবারে কম ছিল না। কুমোরটুলির মৃৎপাত্র, মূর্তি; রামবাগানের বাঁশ ও বেতের সামগ্রী; কালীঘাট মৃৎপাত্র; সিমলার সন্দেশ; উৎসব উদযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্গা পূজা, হালখাতা অথবা বড়দিন ও নববর্ষ; জৈনদের (পার্শ্বনাথ) ও মুসলমানদের (মুহররম) বর্ণাঢ্য র্যালী; এবং সর্বোপরি উত্তপ্ত আড্ডা এ নগরকে অনন্য বৈশিষ্ট্যে প্রাণবন্ত করে তোলে।
স্থাপত্য ‘প্রাসাদ নগর’ কলকাতার স্থাপত্যিক সম্পদ ঘরোয়া এবং পাবলিক উভয় রকমই ছিল। ব্রিটিশ প্রশাসকদের বসত বাড়ি যেমন, হেস্টিংস-এর (বেলভেদের, আলীপুর) বাড়ি পাশ্চাত্য রীতির ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনে উঠতি শ্রেণির মানুষদের বসত বাড়িগুলি ছিল বিশাল পেডিমেন্ট, প্রলম্বিত স্তম্ভ শ্রেণির অলংকৃত ক্যাপিটাল, স্টাকো-টেরাকোটা-ছাঁচে ঢালা লৌহ অলংকরণ, রেলিং এবং ফিগার সমৃদ্ধ। এ ধরনের স্থাপত্যরীতির ভবনের মালিক হলেন রাজা নবকৃষ্ণ (শোভাবাজার), ঠাকুর পরিবার (জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়াঘাট ও এমারেল্ড বাওয়ার: ৫৬, বি.টি. রোড), রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক (মার্বেল প্রাসাদ: চোরবাগান) হেস্টিংস-এর দীউয়ান রামলোচন ঘোষের উত্তরসূরি (পাথুরিয়াঘাট ও জোরবাগান), রাজা দিগম্বর মিত্র (ঝামাপুকুর), বর্ধমান রাজ (বিজয় মঞ্জিল), পোস্তরাজ (বড়বাজার, জোড়াসাঁকো ও চিড়িয়া মোড়), শীল-মল্লিক (পাথুরিয়াঘাট ও শিকদারপাড়া), দে-মল্লিক (বড়বাজার, পাথুরিয়াঘাট ও জোড়াসাঁকো), রানী রাশমণি (জানবাজার), ল’পরিবার (থানথানিয়া), মনমথনাথ মিত্র (শ্যামপুকুর রাজবাড়ী; পূর্বের মালিক ব্যারিস্টার আর. মিত্র), কান্দি/কাঁদি রাজ (পাইকপাড়া ও বেলগাছিয়া ভিলা), মাথুর সেন পরিবার (নিমতলা ও বেলগাছিয়া), নন্দলাল-পশুপতিনাথ বসু (বাগবাজার) এবং বদন রায় (কলুতলা)। অলংকরণ উপাদানের সূক্ষ্ম বিচারে এটি প্রতীয়মান যে, এগুলি ছিল প্রাক ব্রিটিশ উপাদানের মিশেল; এর মধ্যে ভারতীয় ঐতিহ্যিক ও মুগল রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। শেষোক্ত রীতিটি টালীগঞ্জ ও মেটিয়াবুরুজ নবাব এলাকার ভবনগুলিতে পরিলক্ষিত হয়।
সরকারি ভবনগুলির মধ্যে ছিল গভর্নর হাউস, গভর্নর স্টেট, রাইটার্স বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস, কালেক্টরেট, পুরানো টাকশাল, টাউন হল, হাই কোর্ট, বংশাল কোর্ট, মিলিটারি একাউন্টস অফিস।
কলকাতায় বহু বৈচিত্রের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলি হলো সিনাগগ, শিক গুরু দুয়ারা, বৌদ্ধ মন্দির, পার্সিক অগ্নি মন্দির, ব্রাহ্ম প্রার্থনা হল, চীনা মন্দির, গির্জা, জৈন মন্দির, হিন্দু মন্দির এবং মসজিদ (এর মধ্যে অর্ন্তভুক্ত ছিল ইমামবারা, দরগাহ ইত্যাদি)। শেষোক্ত দুটি সমস্ত শহর জুড়ে ছিল। চ্যাপেল ব্যতীত আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, স্কটিশ, ইংরেজ এবং স্থানীয় খ্রিস্টানদের গির্জাগুলি ছিল ব্যাপকভাবে ছড়ানো। প্রার্থনা হলগুলিতে শোভা পায় বহু বৈচিত্রের ভাস্কর্য, চিত্রকলা, দারুশিল্প এবং উৎকীর্ণ লিপি। সেন্ট পল ক্যাথেড্রেল-এর বিশাল অলংকৃত কাঁচের জানালা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সম্পদশালী সম্প্রদায়ের প্রার্থনা কেন্দ্র হওয়ার কারণে সিনাগগগুলিও সমপরিমাণ জমকালো হতো। গৌড়ীবের ও বড়বাজারের জৈন মন্দিরগুলিও ভিন্ন বৈচিত্র্যে বিলাসবহুল ছিল।
অসাধারণ পরিমাপ শৈলীর কারণে নাখোদা মসজিদ (সিন্দুরিয়াপতি) প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কলকাতার মুসলিম সমাধিগুলির মধ্যে বশিরি শাহ দরগাহ (শেঠপুকুর রোড, আনুমানিক ১৮ শতকের প্রথমার্ধে) প্রাচীনতম বৈশিষ্ট্য বহন করছে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট কিতাবউদ্দীন সরকার মসজিদের (উত্তর শিয়ালদা রোড, ১৮৩০) দ্বিতল বিশাল ভবনটি তার প্রশস্ত প্রার্থনা কক্ষের জন্য চিহ্নিত। নয় গম্বুজের বিশাল মুহম্মদ রমজান মসজিদে (নিমতলা, আনুমানিক ১৭৮৪) রয়েছে অষ্টভুজাকার কর্ণার টাওয়ার এবং একটি অলংকার সমৃদ্ধ মিহরাব। অন্যদিকে গুলু ওস্তাগার মসজিদে (দর্জিপাড়া, আনুমানিক ১৯ শতকের প্রথমার্ধে) রয়েছে মধ্যস্থিত চারচালা ভল্টসহ পাঁচটি গম্বুজ। টিপু সুলতানের পুত্র যুবরাজ গোলাম মুহম্মদ ১৮৩৫ সালে টালীগঞ্জ ও ১৮৪২ সালে ধর্মতলায় দুটি অসাধারণ মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে এ পরিবারের সর্বোৎকৃষ্ট অবদান কালীঘাটে তাদের সমাধিস্থলে অবস্থিত। এ মসজিদ দুটি গম্বুজ ও একজোড়া শিরাল মিনারসহ স্থাপত্য রীতিতে সম্পূর্ন আলাদা।
কালীঘাট, চিতেশ্বরী (চিতপুর), থানথানিয়া, ফিরিঙ্গি কালী (বউবাজার) মন্দির ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্থাপত্যিক গুরুত্বের বিচারে বিশেষ অবদান রাখে। ভূকৈলাস (খিদিরপুর), টালীগঞ্জ (বড় ও ছোট রাশবাড়ি), পশ্চিম পুটিয়ারি (করুণাময়ী), বরিষা (সবর্ণ চৌধুরী পরিবার); রামেশ্বর (নন্দরাম সেন স্ট্রীট), দূর্গেশ্বর (মোঃ রমজান লেন), বাণেশ্বর (বনমালি সরকার স্ট্রীট), আটচালা মন্দির; ত্রিলোকরাম পাকরাশির পঞ্চরত্ন মন্দির (বউবাজার), চন্দ্রকুমার রায় (কাশীপুর) ও অঘোরনাথ দত্ত (কালীঘাট); মন্ডল মন্দির লেনের নবরত্ন মন্দির, বলরাম ঘোষ স্ট্রীটের ও বেথুন রায়ের মন্দিরগুলি নন্দনশৈলীতে অসাধারণ।
ঐতিহ্যিক ভবনের মধ্যে স্মৃতিসৌধ অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদগুলি সমাধিসৌধ ও মৃতদাহ স্থল, এ দুভাগে বিভক্ত এবং পাবলিক স্মৃতিস্তম্ভগুলি ছিল বহুধা ছড়ানো। প্রথমোক্ত গ্রুপের মধ্যে মহিশূর সমাধিস্থল (টিপু সুলতানের পরিবার, কালীঘাট), মহারাজা স্যার চমরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারের মহিশূর স্মৃতিসৌধ (কেওরাতলা শ্মশান ঘাট), স্যার উইলিয়ম জোন্স ও মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্টের সাউথ পার্ক স্ট্রীট সমাধির স্মৃতিস্তম্ভ (হিন্দু স্টুয়ার্ট) অন্তর্ভুক্ত। শেষোক্ত শ্রেণির মধ্যে পরে ওক্টারলোনী মনুমেন্ট, প্যানিয়োটি ফাউন্টেন, লস্কর মেমোরিয়াল, সমাধি ফলক ইত্যাদি।
সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্যান্য নগরের মতো কলকাতাবাসীও বিভিন্ন বিষয়, অশান্তি, বিরোধ ও আন্দোলন নিয়ে তাদের মতামত জ্ঞাপণ করেছে। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনের ধর্মযুদ্ধ, বহুবিবাহের সমাপ্তি (রাঢ়ীয় কুলিন ব্রাহ্মণদের মাঝে) ও বিধবা বিবাহের (উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মাঝে) সূত্রপাত করার জন্য বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রম, সামাজিক মূল্যবোধ ও বিভিন্ন ধর্মের মাঝে ঐক্য আনয়নে প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মদের সমাজ সংস্কার এ সব কিছুর ক্ষেত্রেই নগরটি প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। তবে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই ছিল কলকাতার বুকে সবচেয়ে তেজস্বী আন্দোলন। মুরারিপুকুর বোমা হামলা (অরবিন্দ-বারীন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্যরা জড়িত), ডালহৌসী স্কয়ার বোমা হামলা (দীনেশচন্দ্র মজুমদার ও অনুজাচরণ সেন জড়িত), ‘বারান্দা যুদ্ধ’ (বিনয়-বাদল-দীনেশ জড়িত) এরূপ ঘটনা কলকাতার বিদ্রোহী রূপকে পরিচিতি দিয়েছে। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সত্যি, তবে বাংলা হয়েছিল বিভক্ত। এর বৃহত্তর পূর্ব অংশটি (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব অংশ) সৃষ্টি করে পাকিস্তানের পূর্ব ভাগ (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ), আর পশ্চিম অংশ (কলকাতা সহ) নিয়ে গড়ে ওঠে ভারতের পশ্চিম-বাংলা প্রদেশ। [দেবাশীষ বসু]
গ্রন্থপঞ্জি জোগেশচন্দ্র বাগল, কলিকাতার সংস্কৃতি-কেন্দ্র, কলকাতা, ১৯৫৯; pradip sinha, Calcutta in Urban History, Calcutta, 1978; রাধারমণ মিত্র, কলিকাতা-দর্পন, কলকাতা, ১৯৮০; sukanta chaudhuri (ed), Calcutta: the Living City (2 Vols), New Delhi, 1990; দেবাশীষ বসু, কলকাতার পুরাকথা, কলকাতা, ১৯৯০; প্রানকৃষ্ণ দত্ত, কলিকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য রচনা, কলকাতা, ১৯৯১।