টাকশাল, মধ্যযুগীয়
টাকশাল টাকা উৎকীর্ন ও প্রবর্তন কেন্দ্র। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই শাসকগণ শুধু রাজধানী হতেই নয়, অপরাপর প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি হতেও মুদ্রা তৈরি করতে শুরু করেন। মুদ্রাগুলি শুধু সরকারের প্রধান কেন্দ্রগুলির বিভাজনই দেখায় না, বরং শহুরে কেন্দ্রগুলির উত্থান পতনও নির্দেশ করে। সামাজ্যের বিস্তৃতির সাথে সাথে টাকশাল শহরের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। আবির্ভাবের ক্রমানুসারে বাংলার টাকশাল শহরের সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ নিম্নরূপ:
লখনৌতি গঙ্গানদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত বাংলার আদি টাকশাল শহর। সাহিত্যিক উপাদানসমূহ এ ধারণা দেয় যে, ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী কর্তৃক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই লখনৌতি একটি রাজধানী শহর হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং প্রথম টাকশাল শহর হওয়ারও গৌরব অর্জন করে। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে সেখানে মুদ্রিত প্রথম মুদ্রা ছিল ৬৩৪ হি/ ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দীন রাজিয়ার (১২৩৬-১২৪০) রৌপ্য মুদ্রা। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টাকশাল শহর হিসেবে এটি চালু ছিল। লখনৌতি নানাভাবে মুদ্রাসমূহে নির্দেশিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনোরূপ বর্ণনা ছাড়াই শুধু লখনৌতি লেখা হয়েছিল, পরবর্তীকালে খিত্তাহ, হজরত, শাহ, ইকলিম প্রভৃতি শব্দ সংযোজিত হয়েছিল।
সোনারগাঁও ঢাকা শহর হতে ১২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। টাকশাল শহর হিসেবে সোনারগাঁওয়ের যাত্রা শুরু হয় সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ এর (১৩০১-১৩২২) সময় থেকে। ফিরুজ শাহ এখান থেকে ৭০৫ হি/ ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মুদ্রাগুলি জারি করেন। টাকশাল শহর হিসেবে সোনারগাঁওয়ের সমাপ্তি ঘটে সুলতান সিকান্দর শাহের সময়ে (১৩৫৮-১৩৮৯) ৭৮৪ হি/ ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে। এটি সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ এর (১৩৭৯-১৪১০) মুদ্রা হতে বাদ পড়ে যায়, সম্ভবত এ কারণে যে, তখন মুয়াজ্জমাবাদকে (সোনারগাঁও হতে কয়েক মাইল দূরে মুয়াজ্জমপুর রূপে শণাক্তকৃত) প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। ৩৪ বছর পর আবার সোনারগাঁও টাকশাল শহর হিসেবে আবির্ভূত হয় জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহএর আমলে (১৪১৪-১৪৩১)। কিন্তু পরবর্তী শাসকগণ তা অনুসরণ করেন নি। এখান থেকে জারি করা সর্বশেষ মুদ্রার তারিখ হচ্ছে ৮২৪ হি/ ১৪২১ খ্রিস্টাব্দ। সুতরাং এক শতাব্দীর অধিক সময় ধরে টাকশাল শহর হিসেবে সোনারগাঁও চালু ছিল। এটি হজরত এবং হজরত জালাল প্রভৃতি বিশেষণে বিভিন্ন সময়ে উল্লিখিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দনুজমর্দদেব ১৩৩৯ শকাব্দে/ ৮২০ হিজরিতে সুবর্ণগ্রাম টাকশাল হতে মুদ্রা জারি করেছিলেন।
গিয়াসপুর টাকশালটি সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজের (১৩০১-১৩২২) পুত্র গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর (১৩২৩-১৩৩২) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর নামে এর নামকরণ করা হয়। ৭২২ হি/ ১৩২২ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা জারির মাধ্যমে এটির নাম প্রকাশ পায়। মুদ্রায় স্থানের নামের পূর্বে আরসাহ বা শহর শব্দটি সংযোজিত হয়। বর্তমান ময়মনসিংহ শহর হতে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইনায়েতপুরের কাছে একই নামের একটি মৌজার সাথে একে শনাক্ত করা হয়। তবে, শহরটির শনাক্তীকরণ এখনও চূড়ান্ত নয়।
সাতগাঁও মুসলিম পূর্বযুগে কলকাতার প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে গঙ্গা-সরস্বতী এবং যমুনার সংগমস্থলের নিকটে অবস্থিত। সপ্তগ্রাম নামে পরিচিত এটি মুহম্মদ বিন তুগলক এর সময়ে (১৩২৫-১৩৫১) একটি টাকশাল শহর হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর প্রথম প্রাপ্ত মুদ্রার তারিখ ৭২৯ হি/ ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ। ৮২৮ হি/ ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় একশত বছর ধরে এর মুদ্রা তৈরি করার অব্যাহত কৃতিত্ব রয়েছে। টাকশাল শহর হিসেবে এটি পুনরায় ৯৪৬ হি/ ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের সময়ে (১৫৩৮-১৫৪৫) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং এখান থেকে জারিকৃত শেষ মুদ্রাটির তারিখ ইসলাম শাহের (১৫৪৫-১৫৫৪) সময়ে ৯৫৭ হি/ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ। মুদ্রাগুলিতে সাতগাঁওকে বলা হয়েছে আরসাহ। এতে মনে হয় যে, সাতগাঁও একটি প্রশাসনিক ইউনিট ছিল।
ফিরুজাবাদ লখনৌতি (গৌড়) হতে প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার এবং আধুনিক মালদহ শহর হতে মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি আলাউদ্দীন আলী শাহ এর (১৩৪১-৪২) সময়ে টাকশাল শহর হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৭৫৪ হি/ ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের একটি মুদ্রা টাকশাল শহর হিসেবে ফিরুজাবাদের নাম প্রথম বহন করে। এ নামটি শামসুদ্দীন ফিরুজ এর নামানুসারে ইতিপূর্বে পান্ডুয়াকে দেওয়া হয়েছিল। পর পর পাঁচ বার রাজত্বকালে এটি সরকারের কেন্দ্র ছিল এবং জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে গৌড় পুনরায় রাজধানীতে পরিণত হয়। কিন্তু রুকনুদ্দীন বারবক শাহের সময় (১৪৪৯-১৪৭৪) পর্যন্ত ফিরুজাবাদ একটি টাকশাল শহর হিসেবে চালু ছিল। এরপর টাকশাল হিসেবে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শেরশাহ একে পুনরায় গুরুত্ব প্রদান করেন এবং এখান থেকে তাঁর রৌপ্য মুদ্রাগুলি জারি করেন। এ মুদ্রাগুলির ৯৪৭ হি/ ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ এবং ৯৪৮ হি/ ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। মুদ্রাগুলিতে ফিরুজাবাদের পূর্বে বিভিন্ন শব্দ-যেমন, আল-বালাদাত আল-মুয়াজ্জম, হজরত এবং আল-বালাদাত আল-মাহরুসাহ ব্যবহূত হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, দনুজমর্দন দেব এবং মহেন্দ্র দেব পান্ডুনগর হতে যথাক্রমে ১৩৩৯ ও ১৩৪০ শকাব্দ/ ৮২০ ও ৮৪১ হিজরিতে মুদ্রা জারি করেছিলেন।
শহর-ই-নও শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) এবং সিকান্দর শাহের সময়ের একটি টাকশাল শহর। সিকান্দর শাহের শাসন কালের পরে এ নামটি বাংলার মুদ্রা হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ টাকশাল হতে জারিকৃত সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ মুদ্রার তারিখ যথাক্রমে ৭৪৬ হি/ ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দ এবং ৭৮৬ হি/ ১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দ। মুদ্রায় এর নামের আগে আলবালাদ এবং আরসাহ সংযুক্ত করা হয়েছে। এর সঠিক শনাক্তীকরণ এখনও একটি বিতর্কিত বিষয়। ধারনা করা হয় যে, গৌড় এবং পান্ডুয়ার নিকটে অবস্থিত হওয়ায় শহর-ই-নও শুধু উপনগরের মর্যাদা বহন করত এবং যদি এ কথা আমরা বিবেচনায় আনি যে, এটি টাকশাল শহর হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার মাত্র ছয় বছর পূর্বে হজরত পান্ডুয়া রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি যে, রাজধানী হিসেবে পান্ডুয়ার নতুনত্ব তখনও বজায় ছিল। ফলে শহর-ই-নও যা শব্দগতভাবে নতুন নগর বুঝায় তা পান্ডুয়াকেই নির্দেশ করে।
মুয়াজ্জমাবাদ ব্রহ্মপুত্র নদের বিপরীত তীরে সোনারগাঁও হতে বিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি পুরাতন গ্রাম মোয়াজ্জমপুরের সাথে শনাক্তকৃত। সিকান্দর শাহ নগরটি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং সম্ভবত তাঁর নিজের আল-মুয়াজ্জম উপাধি অনুসারে এটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। তাঁর ৭৬০ হি/ ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রাগুলি সর্বপ্রথম এ টাকশালের উল্লেখ করে। এক শতকের অধিককাল অতিবাহিত হওয়ার পর সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৪ -১৫১৯) একটি টাকশাল শহর হিসেবে এর গুরুত্ব পুনরুজ্জীবিত করেন। এ টাকশাল হতে মুদ্রিত প্রাপ্ত সর্বশেষ মুদ্রাগুলির তারিখ হচ্ছে ৯০৭ হি/ ১৫০১ খ্রিস্টাব্দ। লখনৌতিতে রাজধানী স্থানান্তরিতকরণ এবং সোনারগাঁও হতে নতুন নগরে মানুষের ক্রম অভিবাসনের ফলে এর জনসংখ্যা এবং সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ইকলিম-ই-মুয়াজ্জমাবাদ এর সাথে গৌরবজনক উপাধি হজরত জালাল (অর্থাৎ সুলতানের উপস্থিতি বা আসন) সংযুক্ত করা হয় যা সোনারগাঁওয়ের পূর্বেকার পার্থক্যসূচক নাম ছিল।
জান্নাতাবাদ লখনৌতির সাথে অভিন্ন বলে বিবেচিত। শুধু সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মুদ্রায়, বিশেষ করে ৭৯০ হি/ ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ এবং ৭৯৮ হি/ ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রাগুলিতে এটিকে একটি টাকশাল শহর হিসেবে দেখা যায়। এ মুদ্রা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, মুগল সম্রাট হুমায়ুন (১৫৩০-১৫৪০ এবং ১৫৫৫-১৫৫৬) কর্তৃক লখনৌতির নামকরণ জান্নাতাবাদ করার বিষয়ে আবুল ফজলের বক্তব্য সঠিক ছিল না।
ফতেহাবাদ ফারসি উৎসমূহে মহল ফতেহাবাদ অথবা সরকার ফতেহাবাদ হিসেবে উল্লিখিত। এটি যথার্থভাবে আধুনিক ফরিদপুর শহরের সাথে শনাক্ত করা হয়েছে। জালালুদ্দীন মহম্মদ শাহ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ টাকশাল শহর হতে জারিকৃত সর্বপ্রথম মুদ্রাগুলির তারিখ ৮৪০ হি/ ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দ। রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এবং তাঁর পুত্র শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ এর (১৪৭৬-১৪৮০) রাজত্বকালে স্বল্পকালীন বিরতিসহ বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সারা সময়ে এটি একটি টাকশাল শহরের মর্যাদা নিয়ে টিকে ছিল।
চাটগাঁও হচ্ছে আধুনিক চট্টগ্রাম এবং শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৮৮) কর্তৃক এর নাম দেওয়া হয়েছিল ইসলামাবাদ। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ চাটগাঁওকে টাকশাল শহরের মর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর উত্তরাধিকারিগণ টাকশালটি বন্ধ করে দেন। কিন্তু এটি সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল যিনি এখান থেকে ৮১৮ হি/ ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ৮৩৫ হি/ ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুদ্রাজারি করেছিলেন। মুদ্রায় একে আরসাহ বলা হয়েছে যা ইঙ্গিত করে যে, এটি একটি প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে কাজ করছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দনুজমর্দন দেব চাটিগ্রাম, নিশ্চিতভাবে একই স্থান, হতে ১৩৩৯ শকাব্দ/ ৮২০ হিজরিতে মুদ্রা জারি করেন। তাঁর পুত্র মহেন্দ্র দেব একই টাকশাল হতে ১৩৪০ শকাব্দ/ ৮২১ হিজরিতে মুদ্রা জারি করেন।
রোটাসপুর এর নাম টাকশাল হিসেবে ৮২৭ হি/ ১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালালুদ্দীন কর্তৃক জারিকৃত একটি মাত্র মুদ্রায় দেখা যায়। তথ্যাদির স্বল্পতার কারণে এর শনাক্তীকরণ দুরূহ। বিহারের রোটাসগড়ের সাথে এর শনাক্তীকরণও অনিশ্চিত।
মাহমুদাবাদ আপাততভাবে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৬-১৪৫৯)-এর নাম অনুযায়ী নাম ধারন করেছে। এ সুলতান প্রথম এখানে ৮৫৮ হি/ ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রা জারি করেন। পরবর্তী সুলতানদের মুদ্রায় টাকশালটির নাম বাদ পড়ে যায়। সাইফুদ্দীন ফিরুজশাহ (১৪৮২-১৪৯০) এবং নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২)-এর মুদ্রায় এর নাম পুনরায় দেখা যায়। শহরটির শনাক্তীকরণ এখনও সন্দেহজনক। এটিকে আইন-ই-আকবরী এর সরকার মাহমুদাবাদের অন্তর্গত মহল মাহমুদাবাদের সাথে শনাক্ত করা যেতে পারে। সরকার মাহমুদাবাদ উত্তর-পূর্ব নদীয়া, উত্তর-পূর্ব যশোর এবং ফরিদপুরের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল।
বারবকাবাদ টাকশাল সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের অন্তর্গত পশ্চিম দিনাজপুর জেলার মাহীসন্তোষ এর সাথে একে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ টাকশালের প্রাপ্ত আদি মুদ্রার তারিখ হচ্ছে ৮৬৪ হি/ ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ। অপর দুজন সুলতান কর্তৃকও এ টাকশাল হতে মুদ্রা জারি করা হয়েছিল। এরা হলেন শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৪) এবং নাসিরুদ্দীন নুসরাত শাহ। সর্বশেষ মুদ্রার তারিখ ৯২৮ হি/ ১৫২১ খ্রিস্টাব্দ।
মুজাফফরাবাদ শুধু সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহের আমলেই টাকশাল শহর হিসেবে দেখা যায় এবং ওই টাকশালের প্রাপ্ত মুদ্রায় একমাত্র তারিখ হচ্ছে ৮৬৭ হি/ ১৪৬২ খিস্টাব্দ। শহরটিকে পান্ডুয়ার নিকটবর্তী একটি এলাকার সাথে এবং আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখিত সরকার ঘোড়াঘাটের বাজু জাফর শাহীর সাথেও শনাক্ত করা হয়েছে।
মুহম্মদাবাদ নামের টাকশাল শহরটি এখনও শনাক্তীকরণের অপেক্ষায় আছে। এটি ৮৮৭ হিজরি তারিখের একটি মুদ্রায় প্রকাশ পায় যা সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ এর (১৪৮১-১৪৮৭) রাজত্বকালের অন্তর্ভুক্ত। হোসেন শাহী বংশের সকল সুলতানের আমলেই টাকশাল শহর হিসেবে এটি চালু ছিল। এ টাকশাল হতে প্রাপ্ত সর্বশেষ মুদ্রার তারিখ হচ্ছে ৯৩৪ হি/ ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ।
হুসাইনাবাদ সম্পর্কে শিলালিপি হতে জানা যায়। শিলালিপিতে তিনটি হুসাইনাবাদের উল্লেখ আছে। এর একটি ২৪ পরগনা জেলায়, দ্বিতীয়টি মুর্শিদাবাদে এবং তৃতীয়টি লখনৌতির নিকটে মালদাহ জেলায়। যুক্তিসঙ্গত কারণে হুসাইনাবাদ টাকশালটিকে লখনৌতির নিকটবর্তীটির সাথে শনাক্ত করা যেতে পারে। এটি সুলতান হোসেন শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। ৮৯৯ হি/ ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ হতে ৯৫২ হি/ ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শহরটি একটি টাকশাল শহর হিসেবে মর্যাদা ভোগ করেছে।
চন্দ্রাবাদ টাকশাল শহরের নাম সুলতান হোসেন শাহের একটি তারিখবিহীন মুদ্রার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মুর্শিদাবাদ জেলার চাঁদপুরের সাথে একে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ স্থানের সাথে প্রথম জীবনে হোসেন শাহের সম্পর্ক ছিল।
নুসরতাবাদ টাকশালটি সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের ৮৬১ হি/ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের একটি মুদ্রায় এটি প্রথম আবির্ভূত হয় এবং শেষ দু’জন হোসেন শাহী শাসক, নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ এবং গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ এ শহরকে তাঁদের টাকশাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এ টাকশালের শেষ মুদ্রাটির তারিখ ৯৩৩ হি/ ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ। দিনাজপুর, রংপুর এবং বগুড়া জেলা সমূহের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত সরকার ঘোড়াঘাটের অন্তর্গত মহল নুসরতাবাদের সাথে একে শনাক্ত করা হয়েছে।
খালিফতাবাদ আধুনিক বাগেরহাটের সাথে শনাক্তীকৃত। নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ এখান থেকে ৯২২ হি/ ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রাজারি করলে এটি একটি টাকশাল শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটি এখানে উল্লেখের দাবি রাখে যে, তাঁর পিতার জীবদ্দশায়ই নুসরত শাহ নিজ নামে মুদ্রা জারি করার বিশেষ অধিকার ভোগ করেছিলেন। গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালেও এটি টাকশাল শহরের মর্যাদা পায়। এ টাকশাল থেকে তাঁর জারিকৃত শেষ মুদ্রার তারিখ ৯৪২ হি/ ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ।
খলিফাতাবাদ-বদরপুর বাগেরহাটের নিকটে একটি উপশহর। বর্তমানে এটি বিলীন হয়ে গেছে। সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের ৯৪১ হি/ ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা হতে খলিফাতাবাদ-বদরপুরের নাম পাওয়া যায়। বস্ত্তত, সুলতান তাঁর নিজের নাম আবদ-আল-বদর অনুযায়ী বিদ্যমান খলিফাতাবাদের নামের সাথে শুধু বদর শব্দটি যোগ করেন।
শরীফাবাদ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের প্রত্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমে সমুদ্র হতে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শেরশাহ এবং ইসলাম শাহ (১৫৪৫-১৫৫৪) এটিকে একটি টাকশাল শহর হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের সর্বপ্রথম মুদ্রার তারিখ হচ্ছে ৯৮৬ হি/ ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ এবং সর্বশেষ মুদ্রার ৯৫৩ হি/ ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
তান্ডা মালদহের পনেরো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ঠিক যেখানে গঙ্গা নদী ষোল শতকের দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল, সেখানেই অবস্থিত। সুলায়মান কররানী (১৫৬৫-১৫৭২) ৯৭২ হি/ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে এটিকে তাঁর রাজধানী করেছিলেন। তান্ডার এ মর্যাদা মানসিংহের সময় (১৫৯৪) পর্যন্ত ছিল। টাকশাল শহর হিসেবে এটি দাউদ খান কররানী এর সময়ে (১৫৭৩-১৫৭৬) ৯৮০ হি/ ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং ৯৮৪ হি/ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই অবস্থানে ছিল।
চাউলিস্তান/আওয়ালিস্তান ওরফে কামরু, বং, আরাকান প্রভৃতি আরও কতিপয় টাকশালের নামও মুদ্রায় পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি টাকশাল শহর ছিল না, বরং এগুলি ছিল বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের দ্বারা বিজিত ভূ-রাজনৈতিক ইউনিট। তদুপরি, কেউ যেন দেখতে ভুল না করেন যে, সুলতানগণ প্রায়ই তাঁদের রাজধানীর নাম পরিবর্তন করতেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, হুসাইনাবাদ এবং নুসরতাবাদ হচ্ছে লখনৌতির পরিবর্তিত নাম এবং জান্নাতাবাদ ছিল স্পষ্টভাবেই একই নগরের বিশেষ নাম। অনুরূপভাবে শহর-ই-নও ছিল খুব সম্ভবত লখনৌতি অথবা পান্ডুয়ার একটি উপশহর। [মোঃ আখতারুজ্জামান]
গ্রন্থপঞ্জি Abdul Karim, Corpus of the Muslim Coins of Bengal (Down to A.D, 1538), Dhaka , 1960.