মুহম্মদ বিন তুগলক

মুহম্মদ বিন তুগলক (১৩২৫-১৩৩৮)  দিল্লির তুগলক বংশের দ্বিতীয় সুলতান। তিনি ১৩২৫ থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে তিনি সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিভ্রান্তিকর সুলতান। অসাধারণ প্রতিভা ও অদম্য কর্মশক্তির অধিকারী মুহম্মদ বিন তুগলক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়- যেমন দর্শন, ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা, হস্তাক্ষর, গণিত, জোতির্বিদ্যা এবং সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। কুরআন ও হাদিসে পারদর্শী মুহম্মদ বিন তুগলক ফার্সি ও আরবি ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। উপমা দেওয়া এবং রূপক-বর্ণনায় তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, কোন শিক্ষিত ও পরিশীলিত ব্যক্তিই তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস করতেন না।

মুহম্মদ বিন তুগলক পিতা গিয়াসউদ্দীন তুগলক এর কাছ থেকে এক বিশাল সালতানাতের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করার পরপরই বাংলার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। কারণ, পূর্বাঞ্চল থেকে তিনি ভীষণ বিপদের আশঙ্কা করছিলেন। এ সময়ে নাসিরুদ্দীন ইবরাহিম লখনৌতির শাসনকর্তা ছিলেন এবং সোনারগাঁও ও  সাতগাঁও এর শাসনভার ন্যস্ত ছিল তাতার খান ওরফে বাহরাম খানের ওপর। নাসিরুদ্দীন ইবরাহিম ও বাহরাম খান উভয়ই ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলকের আশ্রিত। তারা শক্তিশালী ও উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং বিদ্রোহ করার মতো অবস্থা তাঁদের ছিল। তাই তাদের উচ্চাভিলাষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বাংলার রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে মুহম্মদ বিন তুগলক গিয়াসউদ্দীন বাহাদুরকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন; তাঁকে উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেন এবং বাহরাম খানের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য তাঁকে সোনারগাঁয়ে প্রেরণ করেন। যুগ্ম শাসনকর্তা নিয়োগ নীতি অনুসরণ করার লক্ষ্যে মুহম্মদ বিন তুগলক একই সময়ে বাংলায় অন্যান্য নিয়োগও প্রদান করেন। তিনি পিন্দর অথবা বিদর খলজীকে কদর খান উপাধি দিয়ে লখনৌতি এর যুগ্ম শাসক নিযুক্ত করেন। তিনি হুসামউদ্দীন আবু রেজাকে লখনৌতির নিজাম-উল-মুলক এবং উজির হিসেবেও নিয়োগ দেন। অধিকন্তু, মুহম্মদ বিন তুগলক সাতগাঁওকে একটি পৃথক প্রশাসনিক ইউনিটে রূপান্তরিত করেন এবং তার শাসনভার আজম-উল-মুলক ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার ওপর ন্যস্ত করেন।

মুহম্মদ বিন তুগলক লখনৌতির শাসনকর্তা নাসিরুদ্দীন ইবরাহিমকে অবিশ্বাস করেন, কারণ তিনি তাঁর কাছ থেকেই বিপদের আশঙ্কা করছেন। তাই তিনি কৌশলে বাংলা থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সে মতে তিনি তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে দেন এবং মুলতানের কিশলু খানের বিরুদ্ধে রাজকীয় বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে তাঁকে প্রেরণ করেন।  মুদ্রা প্রমাণে দেখা যায় যে, নাসিরুদ্দীন ইবরাহিম সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক ও তাঁর নিজের নামে ৭২৭ হিজরি (১৩২৭ খ্রি) পর্যন্ত মুদ্রা প্রবর্তন করেন। এরপর নাসিরুদ্দীন ইবরাহিমের নামে আর কোন মুদ্রা পাওয়া যায়নি। তাই বলা যায় যে, নাসিরুদ্দীন ইবরাহিমের ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে মৃত্যু হয় অথবা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।

সোনারগাঁয়ের যুগ্ম শাসক গিয়াসউদ্দীন বাহাদুরও যৌথনামে মুহম্মদ বিন তুগলক ও তাঁর নিজের নামে ৭২৮ হিজরি (১৩২৮ খ্রি) পর্যন্ত মুদ্রা প্রবর্তন করেন। যেহেতু সুলতান অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন, সেকারণে বাহাদুর শাহ দিল্লি সালতানাতের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু বাহরাম খান তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন এবং এ যুদ্ধে বাহারাম খান পরাজিত ও নিহত হন। এভাবে পূর্বাঞ্চলে বিপদ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা দূরীভূত হয়ে যায়। অতঃপর কদর খান, মালিক ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়া এবং বাহরাম খান কোন রকম অন্তর্বিরোধ ব্যতিরেকে অথবা সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোন প্রচেষ্টা ছাড়াই আরও প্রায় দশ বছর যথাক্রমে লখনৌতি, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও শাসন করেন।

কিন্তু বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তার বর্ম-রক্ষক ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সাতগাঁওয়ে ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে হাজী ইলিয়াস মুখ্য শাসনকর্তা হন এবং আলী মুবারক ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। এভাবে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের রাজত্বকালে বাংলায় দিল্লি সালতানাতের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]