কৃষক আন্দোলন
কৃষক আন্দোলন ‘কৃষক’ শব্দটির সংজ্ঞা নানাবিধ। এরিক উলফ-এর ব্যাখ্যায়, কৃষক হল চাষী বা আবাদকারী, যাদের অস্তিত্ব চাষাবাদের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে কৃষি কাজের সঙ্গে সংম্পৃক্ত। এ সংজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে অসম্পূর্ণ, কেননা এতে ভূমিহীন শ্রমিকদের বাদ দেয়া হয়। বাংলার ভূমিহীন শ্রমিকরা সবসময়ই ভূস্বামী এবং শোষণের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে কৃষক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো এক বা একাধিক শ্রেণি যখন নিজেদেরকে ‘কৃষক’ বলে পরিগণিত করে, এবং রাজনৈতিক কারণে এ কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিজেকে এক করে চিহ্নিত করে, তখন তাদেরকে ‘কৃষক’ হিসেবেই পরিগণিত করা উচিত। তাদেরকে ‘ধনী’ ‘মধ্যবিত্ত’ এবং ‘দরিদ্র’ এ তিন শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। সাধারণভাবে, জোতদার বা তালুকদার, রায়ত এবং নিম্ন-রায়ত যথাক্রমে উপরোক্ত তিন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।
জমিদার ছাড়া পূর্ব বাংলার কৃষকদের ওপর শোষণকারী মহাজন (অর্থ ঋণপ্রদানকারী) এবং ভদ্রলোক (মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবীরা যাতে আইনজীবী ও ডাক্তাররাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) শ্রেণি ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে, কৃষকদের একটি বিরাট অংশ ছিল মুসলমান। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের পরোক্ষ শাসনকার্য ও সাধারণ জনগণ থেকে তাদের দূরত্বের কারণে কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে শোষণকারী হিসেবে পরিগণিত হয় নি। ফলে উনিশ শতকের শেষ অংশে ও বিশ শতকের প্রথমাংশে কৃষক রাজনীতির মূল লক্ষ্যই ছিল জমিদার-মহাজন-ভদ্রলোক-এ ত্রিমুখী ক্ষমতা ও আধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্ত করা। তবে, ব্রিটিশ রাজের প্রথম প্রায় একশত বছর, ১৮৭০ সাল পর্যন্ত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরাই অধিকাংশ কৃষকের দৃষ্টিতে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এর কারণ ছিল সরকারের জমিদারি ব্যবস্থার প্রসার ও নীল চাষের স্বার্থরক্ষাকারী কার্যকলাপ যা কিনা প্রত্যক্ষভাবে কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থি ছিল।
এ সমস্যাটিকে অনুধাবন করার জন্য জানতে হবে যে, এসব কৃষক কি রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, অসচেতন বা উদাসীন ছিল কীনা। অথবা, কৃষক রাজনীতির গূঢ়ার্থ সাময়িকভাবে যে সমস্ত কৃষক সম্প্রদায়ের স্ফূরণ ঘটতো তার বাইরেও বিস্তৃত ছিল কীনা। কৃষকরা সাধারণভাবে অদৃষ্টবাদী এবং নেহায়েত প্রাণধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাতেই তাদের জীবনযাত্রা কেন্দ্রীভূত থাকে। এদের চাহিদা যেমন সীমিত, সমাজ থেকে এদের প্রত্যাশাও তেমনি নিতান্তই সামান্য।
অ-কৃষক বহিরাগতদের’কে এরা সবসময়ই শোষণকারী হিসেবে ঘৃণা করে এবং সন্দেহের চোখে দেখে, অথচ সাহায্য এবং নেতৃত্বের জন্য আবার এসব বহিরাগতদেরই দারস্থ হয়। এদের ধার্মিকতা, নিয়তির ওপর নির্ভরশীলতা এবং কুসংস্কারাচ্ছান্ন বিশ্বাস ও যাদুবিদ্যা ক্ষমতাহীন ও নির্ভরশীল সম্প্রদায়ের রাজনীতির ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এর পরিণতিতে ধর্মীয় নেতারা ধর্মের নামে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৃষকদের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়। যদিও কৃষকরা সাধারণভাবে অদৃষ্টবাদী এবং রাজনৈতিকভাবে নিশ্চেষ্ট, তথাপি তারা ‘গ্রাম্য নির্বোধ’ নয়। তাদের ব্যবহার প্রায়শই যুক্তিপূর্ণ, এবং যেহেতু তারা সবসময় নিছক বেঁচে থাকাতে সন্তুষ্ট থাকেনা তাই উন্নততর ভবিষ্যতের জন্য যে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে বা বাজি ধরতে তারা প্রস্ত্তত থাকে। ধনি এবং মধ্যবিত্ত কৃষকশ্রেণীর ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব আরও বেশি প্রযোজ্য।
আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে বিশেষত মধ্যবিত্ত ও অভিজাত উভয়শ্রেণীর মুসলমান জনগণের জন্য দুর্দশা নেমে আসে। পলাশীর যুদ্ধ এবং ঠিক তার পরপরই দ্রুত কতকগুলি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি নতুন ভূ-সম্পত্তির মালিক শ্রেণি এবং পেশাজীবী অভিজাত শ্রেণির (অধিকাংশই হিন্দু) জন্ম দেয়। অন্যদিকে, সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠী ও অভিজাত শ্রেণি উভয়ই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে ক্রমশ নিঃস্ব ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তএর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ভূমি ব্যবস্থা ভূসম্পত্তির অধিকারী মুসলমান শ্রেণির ওপর বিশেষ বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। সামগ্রিকভাবে বাংলার মুসলমানরা এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং হিন্দু পেশাজীবী (বাবু ও ভদ্রলোক) ও জমিদার-মহাজন শ্রেণির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। বানিয়া ও মুৎসুদ্দি শ্রেণির মধ্যে, যার অধিকাংশই ছিল হিন্দু, অঢেল ধনসম্পদ গড়ে তোলার জন্য লাগামহীন প্রতিযোগিতা ও দুর্নীতি, কোম্পানি রাজের সূত্রপাতের অল্পদিনের মধ্যেই বাঙালি মুসলমান এবং কৃষক-তাঁতি শ্রেণিকে আরও হতদরিদ্র ও নিঃস্ব করে দেয়। এ সমস্ত পরিবর্তনের পরিণতিতে এক বিশাল পদদলিত এবং হতাশাগ্রস্ত জনসমষ্টির সৃষ্টি হয়। এতদিন পর্যন্ত যে শ্রেণিগুলি প্রধান ছিল যেমন কৃষক, দক্ষকারিগর ও তাঁতি শ্রেণি, তাদের ভাগ্যে যে আকস্মিক ও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে তার ফলে পলাশীর যুদ্ধের অল্পকাল পরেই বেশ কতকগুলি কৃষক ও গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। তবে এসব বিদ্রোহের অধিকাংশই ছিল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ও বিক্ষিপ্ত এগুলির মূল লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহকারীদের তাৎক্ষণিক দুর্দশা ও অভিযোগের প্রতিকার করা এবং এসব বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল প্রত্যক্ষ শোষকদের বিরুদ্ধে।
১৭৭০ এর দশকে ফকির ও সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে পরিচালিত ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনএর সঙ্গে দৈব যোগসূত্র ঘটে ১৭৬৯-৭০ এর মহাদুর্ভিক্ষের, যার উৎপত্তির প্রকৃত কারণ ছিল অর্থলোভ, লোভী ভূস্বামী এবং তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা গ্রামাঞ্চলে সংঘটিত নিয়মিত লুটতরাজ। ফকির মজনু শাহ ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা। হিন্দু-মুসলমান সাধারণ জনগণ, কৃষক, এমনকি অ-কৃষক জনগোষ্ঠী এ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না।
আন্দোলনকারীদের দুঃখ দুর্দশার পেছনের কারণ, অথবা রাজনীতির ক্ষেত্রে যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই রাজনৈতিক রূপান্তর ক্রমশ কিভাবে ইংরেজদেরকে তাদের শাসকে পরিণত করছিল তা’ বুঝবার মতো ক্ষমতাও তাদের ছিল না। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে আঠারো শতকে সংঘটিত অন্যতম প্রধান, বিক্ষিপ্ত, প্রাক-রাজনৈতিক গণ-আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলনসমূহের নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রধানত স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যাদের স্থানীয় মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলার বাইরে থেকে আগত (আরবীয় ওহাবী ও উত্তর ভারতীয় সৈয়দ আহমেদ ব্রেল্ভী এবং অন্যান্যদের) ইসলামি শুদ্ধিবাদ ও সংস্কারের ভাবাদর্শ। ওহাবী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ চবিবশ পরগনার একজন স্থানীয় কৃষক, তিতুমীর, মুসলমান কৃষকদের ওপর আরোপিত আবওয়াব এবং অবমাননাকর শ্মশ্রু কর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর এ আন্দোলন ছিল ক্ষণস্থায়ী ও বিচ্ছিন্ন, এবং এর উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যক্ষ শোষককর্তৃক শোষণের তাৎক্ষণিক প্রতিকার।
অন্যদিকে, ফরায়েজীরা চেয়েছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়াকে, যাকে তারা দার-উল-হারব (বিদ্রোহীদের আবাস) হিসেবে মনে করত, জিহাদের মাধ্যমে দার-উল-ইসলাম (ইসলামের আবাস) এ পরিণত করতে। এরা অমুসলিম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার (প্রধানত ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা এবং পাবনা জিলায়) অঞ্চলসমূহে ‘জুম্মা’ এবং ঈদের নামায পড়তে হবে না এমন কথা প্রচার করছিলেন যাতে করে শেষপর্যন্ত তারা দেশকে দার-উল-ইসলাম বা একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেন। তারা শোষণকারী জমিদার (হিন্দু) এবং ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। ফরায়েজীরা আরও চেয়েছিলেন যে তাঁদের ‘নৈতিক অর্থনীতি’ (moral economy), অথবা যা তাঁরা ওহাবী, ফকির-সন্ন্যাসী এবং অন্যান্য কৃষক নেতৃবৃন্দের মতো নৈতিকভাবে সঠিক বিবেচনা করেছিলেন, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে।
১৮৭২-৭৩ এর সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিদ্রোহ ছিল স্থানীয় জমিদার কর্তৃক স্বেচ্ছাক্রমে খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। এতে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকরাও অংশ গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে পরিচালিত এ বিদ্রোহ ছিল সীমিত সহিংস, বিক্ষিপ্ত এবং প্রাক-রাজনৈতিক চরিত্রের, কেননা জমিদারি প্রথা বিলোপ করা এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। তারা এসব জমিদারের কাছে অন্যায্য খাজনা থেকে রেহাই চেয়েছিল। ‘নৈতিক অর্থনীতি’র দৃষ্টিকোণ থেকে এদের অস্তিত্ব তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল না, যেহেতু সরকার সহিংস আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে ছিল এবং কৃষকদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য অধিকতর অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল এ বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে ১৮৮৫-র বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (Bengal Tenancy Act, 1885) কার্যকর করতে এবং শেষপর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রাখে।
স্বদেশী আন্দোলন এর (১৯০৫-১৯১১) ক্ষেত্রে মুসলমান কৃষকদের সম্পৃক্ততা ছিল নেতিবাচক, কেননা তাঁদের নেতৃবৃন্দ (শহুরে ‘আশরাফ’ এবং গ্রামীণ ‘জোতদার’ উভয়েই) নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বঙ্গভঙ্গের সুফল সম্বন্ধে তাদেরকে সচেতন করে তুলেছিল। ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এবং অন্যান্য মুসলমান অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ (যাঁরা ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করেন), মুসলমান কৃষকদের সবচাইতে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা স্বদেশী ও সন্ত্রাসী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দেরকে প্রচন্ডভাবে অপছন্দ করতেন। হিন্দু ‘স্বদেশী’ (যারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ছিলেন) দ্বারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ এবং তথাকথিত মা-কালীর বোমা হামলার পরিণতিতে ১৯০৭ সালে জামালপুর, কুমিল্লা এবং অন্যান্য জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার উদ্ভব হয়। ১৯১৪ সালের মধ্যেই মুসলিম ‘আশরাফ’ ও জোতদার নেতৃবৃন্দের অধীনে একত্রিত হয়ে মুসলমান কৃষকরা প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করতে এবং তাতে যোগ দিতে শুরু করেছিল। সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সম্মেলনটি হয়েছিল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের কামারের চর অঞ্চলে। এ সম্মেলনগুলি ক্রমান্বয়ে কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার জন্ম দেয়। তারা তাদের শোষণকারীদের বিরুদ্ধে জমির ওপর নিজেদের অধিকতর দাবি, আরও কম খাজনা এবং ঋণের ওপর আরও কম হারে সুদ আদায়ের জন্য সংগ্রামের ক্ষেত্রে অহিংস ও দীর্ঘসূত্রী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলপ্রসূতা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন ও নিশ্চিত হয়।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আস্থাতে প্রচন্ডভাবে আঘাত করলেও, তা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে তাদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী করার চেয়ে বরং তাদেরকে আরও বেশি হিন্দু বিরোধী করে তোলে। ইতোমধ্যে তারা ১৯০৬ সালে একটি জাতীয় মুসলিম সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও ১৯০৯ সালে পৃথক ভোটব্যবস্থা (Separate Electorates) লাভ করে এবং লেজিসলেটিভ ও এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে (Lesislative & Executive Councial) বেশ কয়েকজন সোচ্চার মুসলমান প্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠাতে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সৈয়দ শামসুল হুদা, এ.কে ফজলুল হক এবং ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
১৯১৪ এবং তার পরবর্তী সময় ছিল কেবল উলামাদের দ্বারাই নয়, বরং সে সঙ্গে সে অঞ্চলের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান এবং নমঃশূদ্র নেতৃবৃন্দের দ্বারা সামগ্রিকভাবে কৃষকদের রাজনৈতিকক্ষেত্রে সচেতন করে তোলার কাল। ১৯১৪ সালে কৃষকদের স্বার্থে আনীত প্রজাসত্ত্ব আইন (Tenancy Act) এর প্রস্তাবিত সংশোধন, জোতদার এবং স্বচ্ছল কৃষক যারা তাদের দখলি জমির ওপর আরও সুনিশ্চিত অধিকার আশা করছিলো, তাদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহের সৃষ্টি করে। ১৯১৪ সালে তারা জামালপুরের (ময়মনসিংহ) কামারের চরে প্রথম প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করেন যেখানে, ফজলুল হক, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মৌলভী রাজীবুদ্দীন তরফদার এবং অন্যান্য মুসলমান নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ নেতাগণের একটি উচ্চশ্রেণীর কৃষকপরিচিতি এবং যোগসূত্রতা ছিল। তাঁরা জমিদারি প্রথার সমালোচনা করনে এবং প্রজাদের অধিকতর অধিকার সংরক্ষণের জন্য দাবি জানান। শীঘ্রই গভর্নর রোনাল্ডশে এর পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি কৃষক ও নমঃশূদ্র সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। ১৯১৭ সালের শেষ দিকে ফজলুল হক এবং মুসলমান আইনজীবী ও সাংবাদিকদের একটি দল ‘‘কলকাতা কৃষি অ্যাসোসিয়েশন’’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২০ সালে ‘বেঙ্গল জোতদার এবং রায়ত অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমসাময়িক তথ্যাবলি থেকে স্পষ্ট হয় যে, কৃষকরা ‘সার্ভে ও সেটেলমেন্ট অপারেশন’, সমবায় আন্দোলন, ইউনিয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য সরকারি উদ্যোগ, এমনকি মহাজনদের ক্ষমতা খর্বকারী ‘ঋণ সেটেলমেন্ট বোর্ড’ (Debt Settlement Boards) প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে আশান্বিত ও উৎসাহিত বোধ করে। ‘সেটেলমেন্ট অপারেশন’-এর কার্যক্রমগুলি প্রজাদেরকে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তzুলছিলো। ফলে তারা ভূস্বামীদের খাজনা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়। কোনো কোনো জেলায় এ কার্যক্রমগুলি প্রজাদের কাছ থেকে আবওয়াব আদায়ের প্রথাকে নিরুৎসাহিত করে। ১৯২০ সালের মাঝামাঝিতে প্রজাসত্ত্ব সংশোধনী বিল (Tenancy Amendament Bill) যখন রায়ের মাধ্যমে বাতিল হতে যাচ্ছিল, তখন প্রজারা জমিদার ও জমির ভোগদখলকারীদের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নিজস্ব বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলে। কিছু জেলায় ভোগদখল অধিকারের ভাবনা থেকে বর্গাচাষীরাও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
প্রজাসত্ত্ব আইনের প্রভাবে, এবং ভোটদানের অধিকার স্বচ্ছল কৃষকদের পর্যন্ত পৌঁছানোর ফলে এর পরবর্তীকালে পূর্ব বঙ্গের কৃষকদের আচরণে এক পরিবর্তন আসে। ‘আবওয়াব’ এবং ‘নজর’ (উপহার) থেকে প্রাপ্ত আয় হতে যাতে বঞ্চিত হতে না হয় তার জন্য জমিদার মধ্যবর্তী পক্ষের বিলোপ চান, কেননা জোতদাররা প্রজাদের কাছ থেকে এগুলি সংগ্রহ করত। ১৯৪০ সালে ফ্লাউড কমিশন এর কাছে প্রদত্ত ভূস্বামীদের বিভিন্ন স্মারকে এ রকম মনোভাবই প্রতিফলিত হয়। জোতদাররা স্বত্বাধিকার বা মালিকের পদমর্যাদা দাবি করে এবং সামাজিকভাবে নিজেদের অবস্থান উন্নীত করার জন্য নিজেদেরকে তালুকদার বলে অভিহিত করে। ভোগদখলকারী রায়তরা অপেক্ষাকৃত কম হারে খাজনা এবং তাদের দখলি জমির ওপর অধিকতর নিশ্চিত অধিকার দাবি করে, আর অন্যদিকে অ-ভোগদখলকারী রায়তরা স্থায়ী ভোগদখলের অধিকার চায়, বর্গাচাষীরা দাবী স্থায়ী অধিকার এবং ফসলের দুতৃতীয়াংশ, এবং ভূমিহীন শ্রমিকরা উচ্চতর সামাজিক অবস্থান ও স্থায়ী ভোগদখল কাল উভয়ই নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্য ‘গৃহস্থ’ বা ‘গৃহস্বামী’র মর্যাদা দাবি করে। সমগ্র এলাকা জুড়ে কৃষক রাজনীতির মূল বিষয়টিই ছিল মধ্যবিত্ত এবং ধনী কৃষকদের ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার উচ্চাভিলাষ।
১৯২০-৪৭ সময়ের মধ্যে স্বচ্ছল কৃষকদের মনে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এবং কয়েকটি সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ার কারণে জমিদারদের দখলকারী রায়ত ও জোতদারদের আশা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কৃষক সম্প্রদায়ের গুরুত্ব এবং এর রাজনৈতিক প্রভাবের মূল কারণ ছিল কৃষি নির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী (১৯২১ সালে প্রায় ৮০.৬৬ শতাংশ)। ১৯২১ সালে কৃষক-জমির আনুপাতিক হার ছিল মোটামুটি ভাবে ১:২.৫ একর। সমগ্র জনসংখ্যার জন্য কৃষিকাজই ছিল জীবিকার একমাত্র উপায়। ১৯২১ সালের মধ্যে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৯,৬৮৭,৭০১, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল মুসলমান, আর জনসংখ্যার গড় ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ৬৬০ জন।
ভোটদানের অধিকার পাওয়ার পরপরই স্বচ্ছল কৃষকরা ইউনিয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য স্থানীয় স্ব-শাষিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা নির্বাচিত করতে তাদের ভোটের মূল্য অনুধাবন করলেও, একই সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ফসলের মন্দ ফলন এবং পাটের আকস্মিক মূল্য হ্রাসের কারণে তারা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। অচিরেই সরকারের সঙ্গে গান্ধীর অসহযোগিতার ডাক, যা স্বশাসন এবং নাগরিক অধিকারের বিষয়টিকে সামনে তুলে ধরেছিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যখন ‘স্বরাজ’ বা স্বশাসনের নামে কৃষকদেরকে একত্রিত করছিল তখন পূর্ব বঙ্গের কৃষকশ্রেণী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ সময় এ অঞ্চলের কৃষকেরা স্বরাজ বলতে বুঝেছিল ‘‘এমন একটি স্বর্ণযুগ যখন দ্রব্যমূল্যা হ্রাস পাবে, কর প্রদান স্থগিত হবে, এবং যখন রাষ্ট্র আর ব্যক্তি মানুষের আনন্দের কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করবে না।’’
ইতোমধ্যে গান্ধী এবং কংগ্রেস পার্টির অন্যান্য প্রথম সারির হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দ অসহযোগ আন্দোলনের ইস্যুর সঙ্গে খিলাফত এর ইস্যুটিও যোগ করে দেন। ফলে ভারতীয় মুসলমানরা স্বদেশের ভূমি ছাড়িয়েও বাইরের প্রতি তাদের আনুগত্যে উজ্জীবিত হয়, আর এটা হয় ‘আলেমদের এক অংশের ভাববিলাসী চিন্তাভানা ও উৎসাহের অতিশয্যের কারণে। সমগ্র দেশ জুড়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। গান্ধী এ ইস্যুটিকে ‘মুসলিম কাউ’ (Muslim Cow) হিসেবে তুলে ধরলেন এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করলেন। পূর্ব বঙ্গে, কৃষক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ‘খিলাফত’ প্রকৃতপক্ষে কি সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। কৃষকরা খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল এ ভেবে যে এ আন্দোলন তাদেরকে স্বরাজ বা একটি ‘কৃষক স্বর্গরাজ্য’ এনে দেবে। তাদের এ লক্ষ্য অর্জনের পথে কৃষকেরা তাদের প্রত্যক্ষ শোষণকারী এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের প্রতিপক্ষকে নানাভাবে বয়কট এবং সামাজিকভাবে একঘরে করা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডদ্বারা ভীত করে রাখে। ‘স্বরাজ’ বা ‘খিলাফত’ সাধারণ একজন কৃষকের কাছে প্রাক্-রাজনৈতিক এ লক্ষ্য অর্জনের উপায় ছাড়া আর বেশি কিছুই ছিল না। ‘জাতীয়তাবাদ’ বা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতার ধারণা ১৯২০ সালে তাদের বোধশক্তির বাইরে ছিল।
১৯২২ সালে গান্ধীর খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলে কৃষকরা যেভাবে স্বরাজ বা জাতীয়তাবাদকে বুঝেছিল তাদের নিকট তার গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায়। রাজনৈতিকভাবে স্বরাজের চাইতে প্যান ইসলাম ও মুসলিম সংহতি তাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৮৭০-এর দশকে সংঘটিত ওহাবী আন্দোলনের প্রায় ৫০ বছর পর খিলাফত আন্দোলনের সময় বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে উলামাদের (মোল্লা, মৌলবি, পীর এবং সুফি) পুনরাবির্ভাব বাংলার কৃষকের মনে ইসলামের ভাবাবেগকে পুনর্জাগরিত করে। পরবর্তী সময়ে বাঙালি মুসলমান কৃষকেরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইসলামকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এ আন্দোলন একদিকে যেমন কৃষকদেরকে তাদের প্রভুদের কর্তৃত্ব অমান্য করার লক্ষ্যে কিভাবে বিক্ষোভে ব্যবহার করা যায় তা শিক্ষা দেয়, অন্যদিকে তেমনি এ আন্দোলন উলামাদের আধিপত্য বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জনগণকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে উলামাদের গুরুত্ব ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরও অনেকদিন পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের মূল্যের দ্রুত ওঠা-নামা, এবং ১৯২৯-৩৬ এর মন্দা (Great Depression) ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকের কৃষকদের রাজনৈতিক আচরণে বিশেষ পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে। পাটের মূল্যে আকস্মিক ধ্বস নামার ফলে যখন ১৯২৩ এবং ১৯২৪ পাট উৎপাদনকারীদের জন্য চরম খারাপ বছর ছিল, তখন ১৯২৫ এবং ১৯২৬ সালে হঠাৎ করে পাটের মূল্য বৃদ্ধি তাদের জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনে। অবশ্য এ সমৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯২৯-৩৬ এর মহামন্দা খুব শীঘ্রই কৃষকদের এ সমৃদ্ধিকে গ্রাস করে। কৃষিজাত দ্রব্যের নিম্নমূল্য এবং বেকারত্ব সর্বত্র, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু তৎকালীন ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, পাবনা এবং রাজশাহী জেলার অধিকাংশ জমিদার এবং মহাজনরা ছিলেন হিন্দু, সেহেতু প্রজা-ভূস্বামী এবং ঋণদানকারী-ঋণগ্রহীতার মধ্যকার দ্বন্দ্ব অচিরেই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের রূপ নেয়। আশরাফ-উলামা-জোতদার এ তিন শক্তির যৌথ নেতৃত্বে যে সমস্ত ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধু হয়েছিল, প্রধান হিন্দু শ্রেণিগুলির সঙ্গে যাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল, তারা মুসলমান কৃষক ও তাদের হিন্দু প্রভুদের মধ্যকার শ্রেণিদ্বন্দ্বকে সাম্প্রদায়িকীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এটা উল্লেখযোগ্য যে, যদিও স্বরাজ অথবা একটি স্বর্ণ যুগ অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালি মুসলমান কৃষকদের এক বিরাট অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিল, তথাটি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের অল্প কিছুকালের মধ্যেই কৃষক অভ্যুত্থানের এক নতুন যুগ শুরু হয়। এ যুগে কৃষকেরা বেশ কিছু স্থানে সমাজের প্রতিষ্ঠিত শ্রেণি বিন্যাস ও আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে শুরু করে।
নিম্ন কৃষক পরিবার হতে উদ্ভূত এবং বাজার ও প্রজাস্বত্ত্ব অধিকারের সম্পর্ক অজ্ঞ সকল পল্লী কবি এবং সাহিত্যিক, ১৯২৫-১৯২৬ সালে যখন পাটের বাজার অত্যন্ত ভালো তখনও, পাট চাষ করার জন্য কৃষকদেরকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেছিল। কেউ কেউ হিন্দু এবং মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদেরকে (হিন্দু জমিদার ও মহাজন সহ) পাটের মূল্যের দ্রুত পরিবর্তন এবং তাতে ধ্বংস নামার জন্য দায়ী করে তাদের লেখায় তা উপস্থাপন করে। ময়মনসিংহের এক পল্লী কবি (আব্দুল সামেদ মিঞা, ১৯২১) অ-বাঙালিদের (উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়) দ্বারা কৃষক শোষণ সম্বন্ধে লেখেন, ‘‘যখন এদেশে পাট আসল পশ্চিমারাও (উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়রা) তখন আসল এবং এদেশকে দখল করল... এখন তারাই হলো বিত্তশালী ব্যক্তি। বাঙালিদেরকে তারা এখন অবজ্ঞা করে। এসব বিজাতীয়রা যাদের এক সময় ছাতু মিলতো না, দেখ! আজ তারা বালাম চাল খাচ্ছে। অন্যদিকে বাঙালিরা খাচ্ছে মোটা রেঙ্গুন চাল। বাঙালিরা বোবা হয়ে গেছে। পশ্চিমারা কেবলমাত্র বাংলাতেই আশ্রয় পেয়েছে, অন্য কোনো স্থানে তাদের কোনো জায়গা মিলবে না।’’
পল্লী লেখকদের আরেকজন, (আবেদ আলী মিঞা) লিখলেন, ‘‘মাড়োয়ারি কোটিপতিরা পাটের জন্য একবছর তোমাদেরকে ভাল মূল্য দেয়, পরবর্তী তিন বছর তোমাদেরকে শোষণ করার জন্য।’’ এভাবে পল্লী সাহিত্যে হিন্দু মহাজন, দোকানদার, জমিদারদের কর্মচারী, জমিদার এবং এরূপ অন্যান্যদের প্রতি কৃষকসহ সকল মুসলমানের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
পল্লী সাহিত্য, যা কিনা আগেই হিন্দুদেরকে ‘বিজাতি’ (অন্য ধর্মাবলম্বী) এবং কৃষকদের শোষণের প্রতিশোধ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রমাণ করে যে, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কেবল রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট, উপর থেকে চাপানো কোনো ধারণা ছিল না।
কলকাতা এবং উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গ্রামাঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বাষ্পকে আরও ঘনীভূত করে। মুসলমান পল্লী কবিগণ প্রায়শই কলকাতার দাঙ্গার (১৯২৬) গল্প আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মুসলমান গ্রামবাসীদের কাছে বর্ণনা করে এবং এভাবে গ্রামীণ মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের বিরদ্ধে তীব্র সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয়।
পরস্পরবিরোধী মনে হলেও কৃষকদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’র কালে (১৯২৫-২৬), যখন পাটের মূল্য পূর্ববর্তী যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি ছিল, তখন কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ছিল তীব্রতর। কৃষকদের দ্বারা দখলিজমির ভোগদখল হ্রাস (জনসংখ্যাবৃদ্ধির এবং ভূস্বামীদের দ্বারা ১৯২৩ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করার প্রচেষ্টার কারণে) এবং ১৯২৫-২৬ সালে পাটের তেজী বাজারের সময় ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। ১৯২৫-২৬ সালে, যখন পাটের মূল্য অপ্রত্যাশিতভাবে উচ্চ ছিল (১৯২৩-২৪ সালে প্রতি বেল পাটের মূল্য ২৫.০০ টাকা থেকে ৬০.০০ টাকার পরিবর্তে প্রতি বেল ৯৪.০০ টাকা থেকে ১৪২.০০ টাকা), তখন তৎকালীন ভোগদখলকারী প্রজা, যারা ততদিনে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ‘বর্গাদার’ কিংবা ‘আধিয়া’তে রূপান্তরিত হয়েছিল, তারা জোতদারকে (যারা বহুক্ষেত্রে কৃষকের ঋণ শোধ করতে না পারলে তাদের জমি দখল করে নিচ্ছিল) দেয় ফসলের (পাটের) অর্ধেক কিংবা তারও অধিক অংশ ছেড়ে দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।
ইতোমধ্যে, ঔপনিবেশিক সরকার তাদের সহযোগী বা মিত্র হিসেবে কৃষকদের সম্ভাবনার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারার ফলে কয়েকটি আইন প্রণয়ন সম্বন্ধকীয় এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন আরও বেশি সংখ্যক কৃষককে ভোগদখলের অধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্বে আইন সংশোধনী বিল প্রণয়ন; পার্লামেন্টে আরও অধিক সংখ্যক কৃষক প্রতিনিধি যেন স্থান পায় সেজন্য ভোটাধিকারকে আরও ব্যাপকীকরণ এবং ১৯২৬ সালে Royal Commission on Agriculture-এর প্রতিষ্ঠা। হিন্দু জমিদার-ভদ্রলোক-মহাজন এ তিন যৌথ শক্তি এবং হিন্দু সংবাদ মাধ্যম জাতীয়তাবাদ-বিরোধী অভিহিত করে সরকারের এ সব পদক্ষেপের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে ১৯২৮ সালে প্রজাস্বত্ত্ব সংশোধনী বিল কার্যকর হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সাধারণভাবে বাঙালি হিন্দুরা, যারা জমিদার-ভদ্রলোক-মহাজন এ তিনশক্তির প্রতিনিধিত্ব করছিল, তারা এ বিলের বিরুদ্ধাচারণ করে। অন্যদিকে, আশরাফ-উলামা-জোতদার এ যৌথ শক্তির নেতৃত্বাধীন বাঙালি মুসলমানেরা এর পূর্ণ সমর্থন করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অনেক মুসলমান জমিদারও এ বিলকে সমর্থন করে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার কৃষক আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকীকরণের ক্ষেত্রে অ-কৃষক নেতারা এবং তাদের শ্রেণি শত্রুরাই (জমিদার ও জোতদাররা) প্রধান ভূমিকা রাখে। এর ফলে ‘আশরাফ’ এর সঙ্গে ‘জোতদার’ এবং ‘জোতদারের সঙ্গে নিম্ন কৃষকের, যারা ধর্মে মুসলমান ছিল, তাদের একত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যা টেনে নিয়ে যায় ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের দিকে। একদিকে যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস-এর নেতৃত্বে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির এক অংশ মুসলমান মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রকাশিত করার লক্ষ্যে ১৯২৩ এর আশ্বস্তকারী চুক্তি বেঙ্গল প্যাক্ট (হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট হিসেবেও পরিচিত) স্বাক্ষর করেছিল যেখানে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জিত হলে অন্তত ৫৫% চাকুরি মুসলমানদেরকে দেওয়া হবে এমন অঙ্গীকার ছিল। অন্যদিকে তেমনি হিন্দু অভিজাত শ্রেণির অন্যান্য সদস্যরা মুসলমানদের খুশি করার এ ধরনের যে কোনো প্রয়াসেরই চরম বিরুদ্ধাচারণ করে।
হিন্দুদের দ্বারা এ প্যাক্টের বিরোধিতা মুসলিম গোড়াপন্থিদেরকে দেশ জুড়ে হিন্দু বিরোধী প্রচারণা শুরু করার সুযোগ করে দেয়। যা পরিণতিতে তৃণমূল পর্যায়ের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয়। উচ্চবর্ণ হিন্দু রাজনীতিবিদ ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা, যাদের অনেকেই শুদ্ধি সংগঠন, হিন্দু মহাসভা এবং ল্যান্ডলর্ডস অ্যাসোসিয়েশনের মত হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাদের অসহিষ্ণু মনোভাব সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কৃষকদের একত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করে। মুসলিম প্রজাসম্প্রদায়কে জোতদার, নিম্ন রায়ত/বর্গাদার (রায়ত/বর্গাদারের অধীনে জোতদার) হিসেবে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কারণ প্রথমত, নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের সঙ্গে হিন্দু উচ্চশ্রেণীর প্রায় কোনোরকম যোগাযোগ ছিল না। দ্বিতীয়ত, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহ-ধর্মাবলম্বী হিসেবে জোতদারদের নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের ওপর অধিকতর কর্তৃত্ব ছিল। সর্বশেষে, মুসলমানদের মনে বিরাজমান এ ধারণা যে, তারা হচ্ছে ‘বাঙালি সমাজের কিছু নাই’র দল, যাদের অবস্থান হলো কোনো রকম নির্দিষ্ট আকারবিহীন এক প্রজা সম্প্রদায়ের মধ্যে, এ শ্রেণি চেতনা তাদের সাম্প্রদায়িকতা বোধকে গ্রথিত করতে সাহায্য করেছিল। এ চেতনাই জমিদার-ভদ্রলোক-মহাজন এ তিন শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে আশরাফ-উলামা-জোতদার তিন যৌথ শক্তির নেতৃত্বাধীনে ধনী-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র কৃষকদের একত্রিত করে যুক্তফ্রন্ট (United front) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
ধনুকাকৃতির ক্ষমতা-কাঠামো যার শীর্ষে অবস্থিত ছিল জমিদার তা যখন দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন জোতদাররা, যাদেরকে নিম্ন কৃষকেরা তাদের অধিকতর সৌভাগ্যবান সমগোত্রীয় এবং একই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গণ্য করত, তারা জমিদাররা ক্রমশ ক্ষমতা থেকে সরে যেতে থাকার (retreat) ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থানগুলি দখল করল। এর ফলে জোতদার-প্রজা দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত জমিদার-জোতদার দ্বন্দ্বে রূপ নেয় এবং এটা তখনই সম্ভব হলো যখন শেষোক্তজন ইসলাম বা মুসলিম ধর্মীয় ঐক্যের নামে নিম্ন কৃষক (এবং মুসলমানদের) এবং আশরাফ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হলো। এ ব্যবধান দূর করতে ‘উলামারা’ এক বিশেষ ভূমিকা রাখে। কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধনে বহিরাগত দু’টি উপাদান, ‘আশরাফ’ এবং ‘উলামা’-র নেতৃত্বে একজন কৃষক প্রথমে সাম্প্রদায়িক ও তারপর রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
কৃষক সম্প্রদায়ের যখন এভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটছিল, ১৯২৯-৩৬ এর মহামন্দার (Great Depression) আকস্মিক সর্বগ্রাসী প্রভাব পূর্ব বাংলাতেও এসে লাগে। ফলে, পল্লী ঋণদাতা, ভূ-স্বামী এবং তাদের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কৃষকের যে ক্ষোভ ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছিল তার জোড়ালো বহি: প্রকাশ ঘটে ‘আর খাজনা নয়’ (no-rent) এ দাবির সমর্থনে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত কৃষক আন্দোলনের বুৎপত্তি অর্জনের মাধ্যমে। বহু মুসলমান কৃষকদেরকে তাদের কৃষক এবং অ-কৃষক উভয় নেতারাই বোঝাল যে, হিন্দু জমিদার এবং মহাজনরাই ফসলের নিম্নমূল্য তথা তাদের দুঃখ দুর্দশার জন্য দায়ী।
১৯৩০ সালে সমগ্র বাংলায় এবং অন্যান্য প্রদেশে কংগ্রেস ও গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনের নামে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু পূর্ব বঙ্গের অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি, যাদের সঙ্গে জমিদার ও ঋণদাতাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক, সেহেতু ওই অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর বলতে গেলে তাদের কোনো প্রভাবই ছিল না। ইতোমধ্যে, সরকার জাতীয়তাবাদ, কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদ এবং সন্ত্রাসী প্রচারণার থেকে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বিরত রাখার জন্য বেশ কয়েকটি ‘কৃষকদের পক্ষে’ (pro-peasant) পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলির মধ্যে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯২৮; the Bengal Rural Primary Education Act, 1932; the Bengal Local Self-Government Bill, 1933; এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৩২ সালে সরকার প্রদত্ত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ (Communal Award) এবং ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন যে কেবল ভোটাধিকারকে আরও বিস্তৃত করল তাই নয়, বরং এ উপমহাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে সহায়ক হলো। হিন্দু জমিদার-ভদ্রলোক-মহাজন এ ত্রিশক্তি, কৃষকদের স্বার্থের এবং মুসলমানদের স্বার্থের পক্ষের পদক্ষেপগুলির তীব্র বিরোধিতা করায় এবং কৃষকদের সঙ্গে তাদের শ্রেণি দ্বন্দ্বের ফলে, তারা আর কৃষক জনগোষ্ঠীকে প্রভাবান্বিত করার মতো বা নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অবস্থানে থাকল না।
সরকারের পক্ষের মুসলমান নেতৃবৃন্দ, তাদের অর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে, সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে মুসলমানদেরকে হিন্দু-বিরোধী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করে। কৃষকদের মধ্যে এ হিন্দু-বিদ্বেষী চেতনার অনুকূলে সাড়া জাগাতে মন্বন্তর একটি বিশেষ সহায়ক হয়। এ আন্দোলনের সংগঠকরা সাধারণ কৃষকদের মধ্যে এ বলে ভয়াবহ সব গুজব ছড়ায় যে, একদিকে যেমন হিন্দু জমিদার ব্যবসায়ী এবং ঋণদাতারা কৃষিজাত দ্রব্যের নিম্নমূল্যের জন্য দায়ী, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটিশ সরকার আইন করেছে যে, যে সব মুসলমান তাদের দাঙ্গাবাজ হিন্দু শত্রুপক্ষকে আক্রমণ বা লুট করবে, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করবে তাদেরকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না। ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার কিছু অংশে, কিছু মোল্লাদের প্ররোচনায়, কৃষকরা বিশ্বাস করে যে, সরকার সাত দিনের জন্য ‘স্বরাজ’ অনুমোদন করেছে এবং ঢাকার নওয়াব হিন্দু স্বচ্ছ্বল শ্রেণির উপর আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঘোষণা করেছেন। এর পরিণতিতে ১৯৩০ সালে ঢাকার রুহিতপুর, মাতুয়াইল, আতি, জিঞ্জিরা ও মিরপুরে এবং কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
১৯৩০ সালের কিশোরগঞ্জের দাঙ্গা কৃষক ও তাদের শোষণকারী ঋণদাতাদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে। ক্রব্ধ মুসলমানেরা তাদের শত্রু চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন ছিল। তারা তাদের ক্রোধের আগুন থেকে মুসলমানদেরকে রেহাই দিয়ে শুধু হিন্দু ঋণদাতাদের আক্রমণ ও তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করে। কিশোরগঞ্জ ছাড়াও, মুসলমান কৃষকরা মন্বন্তরের সে দারুণ দুর্দশাপূর্ণ সময়ে তৎকালীন ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা এবং নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানের হিন্দুদেরকে আক্রমণ ও হত্যা করে। এমনকি কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলনও তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের হত্যা করা থেকে মুসলমানদের বিরত করতে ব্যর্থ হয়।
ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানের বিরোধী এবং সরকার সমর্থনকারী মুসলমান অভিজাত শ্রেণিদ্বারা প্রভাবিত এবং স্থানীয় নেতৃত্বাধীন এ সকল স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত সম্প্রদায়িক হাঙ্গামাগুলি কৃষকদের কাছে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি এবং জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি উভয়দলকেই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাতিল করতে ভূমিকা রাখে। ইতোমধ্যে, মুসলিম জোতদার-তালুকদার এবং এমনকি আশরাফ-জমিদার শ্রেণি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার এবং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলি ও সরকার বিরোধী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে কৃষক ও প্রজা সংগঠনগুলিকে সংগঠিত ও প্রস্ত্তত করছিল। উল্লেখযোগ্য যে, মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ মুসলমান জমির মালিকদেরকে কৃষক সম্প্রদায়েরই একটি অংশ হিসেবে গণ্য করলেও, হিন্দু ভূ-স্বামীদের তারা কঠোর খাজনা-আদায়কারী এবং কৃষকদের শোষক ব্যতীত অন্য কিছুই ভাবত না। তখন থেকে মুসলমান আশরাফ-উলামা-জোতদার নেতৃবৃন্দ মুসলমান কৃষকদেরকে মৌলিক কাঠামোগত আমূল ভূমি সংস্কার ও কৃষকদের স্বার্থ রক্ষাকারী অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতির প্রলোভন দেখাতে শুরু করল, এবং একই সঙ্গে হিন্দু জমিদার-ভদ্রলোক-মহাজন এ তিন যৌথ শক্তিকে বাংলার উচ্চ ও নিম্ন উভয় শ্রেণির মুসলমানের একমাত্র শত্রু হিসেবে তুলে ধরে। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমান নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলের মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে এ.কে ফজলুল হকের (১৯৩৭ সালে বাংলার নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী বা Chief Minister) নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফজলুল হক এবং তাঁর সহকর্মী অন্যান্য মুসলমান রাজনীতিবিদরা যাঁরা উচ্চ কৃষকশ্রেণী হতে উদ্ভূত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা প্রধান প্রভাবশালী হিন্দু শ্রেণিকে পাশ কাটিয়ে নিজেদেরকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে উর্দু ভাষী আশরাফ নেতৃবৃন্দের (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমউদ্দীন) সঙ্গে হাত মিলান। এর ফলে, ১৯৩৭ সালের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্ব্লি (খবমরংষধঃরাব অংংবসনষু) নির্বাচনের পর ফজলুল হক এবং কৃষক প্রজা পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বাধ্য হন তাদের ‘প্রজা স্বত্ত্বা’কে বিসর্জন দিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দিতে। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময় পর্যন্ত ঘটনাগুলির মধ্যে যা উল্লেখযোগ্য ছিল, হিন্দু জমিদার-ভদ্রলোক মহাজন এ যৌথ ত্রিশক্তির বিরুদ্ধে প্রজাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ‘আশরাফ’ কর্তৃক সফলভাবে নিম্নরায়ত ও বর্গাদারদেরকে একত্রে সংগঠিত করা। একইভাবে উল্লেখযোগ্য যে কীভাবে জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও কমিউনিস্ট বা সামন্তবাদীরা একই সময়ে কৃষকদেরকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়।
ফজলুল হক এবং তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি (KPP) যাঁরা জমিদার বিরোধী/মহাজন বিরোধী অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন, যা কিনা কচচ এর নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলিত হয়েছিল, তাঁরা ১৯৩৭ সনের এপ্রিল মাসে বাংলায় একটি জোট (coalition) সরকার গঠন করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মিলান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কতিপয় মুসলমান জমিদার, যাদের মধ্যে ধনবাড়ীর (টাঙ্গাইল) নওয়াবজাদা হাসান আলী খান অন্যতম, ১৯৩৭ এর নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে জমিদার বিরোধী এবং কৃষকদের পক্ষের কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
ইতোমধ্যে, সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আন্দোলনের পাশাপাশি বেশ কিছু শ্রেণি ভিত্তিক এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনও সংঘঠিত হয়। মনি সিং এবং আরও কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতার নেতৃত্বাধীন উত্তর ময়মনসিংহের উপজাতীয় (হাজং) কৃষকদের শ্রেণি ভিত্তিক টংক আন্দোলন (Tonk Movement) এ প্রদেশের অন্যকোন স্থানের অ-উপজাতীয় মুসলমান অথবা নমশূদ্র কৃষকদের দলে টানতে ব্যর্থ হয়। ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলিও সীমিত ছিল নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত-কৃষক-প্রধান উপ-অঞ্চলে। উপ-অঞ্চলে প্রধান শোষক হিসেবে হিন্দু জমিদারদের অনুপস্থিতি মুসলমান কৃষকদেরকে একটি অসাম্প্রদায়িক অথবা জাতীয়তাবাদী ধারায় সংগঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, বিশেষত নোয়াখালী এবং কুমিল্লা জেলার কিছু অংশে। উপ-অঞ্চলের কয়েকজন বিশিষ্ট কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট নেতা মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, যেমন কুমিল্লার আশরাফউদ্দীন চৌধুরী এবং অসিমুদ্দীন আহমেদ এবং আব্দুল মালেক, মুখলেসুর রহমান, মকবুল মিঞাসহ নোয়াখালী-কুমিল্লা উপ-অঞ্চলের প্রগতিবাদী কৃষক সমিতির অন্যান্য অনেকে।
১৯৪১ সনের ঢাকার নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাব এর পরিপ্রেক্ষিতে আশরাফ-উলামা-জোতদার যৌথশক্তি কর্তৃক পাকিস্তান গঠনের নামে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সংগঠিতকরণ মুসলিম-জোতদার প্রভাবিত উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও দিনাজপুর জেলার এবং মুসলমান মধ্যবিত্ত কৃষক প্রভাবিত নোয়াখালী এবং কুমিল্লা জেলার জনগোষ্ঠীসহ সমগ্র বাংলা জুড়ে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক করে তোলে।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রজা-আশরাফ জোটবন্ধন ছিল অবশ্যম্ভাবী। আশরাফ ও প্রজাদের (বিশেষকরে জোতদারদের) সৌভাগ্যক্রমে মুসলমান কৃষকদের এক বিরাট অংশের মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রভাবে কংগ্রেস এবং হিন্দু নেতৃত্বাধীন অন্যান্য সংগঠনগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্তি ঘটেছিল। ততদিনে কৃষকদের সামন্ততান্ত্রিক বিরোধী সংগ্রাম বাংলায় একটি ধর্মীয় ধারায় ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় চেতনায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। আশরাফ ও প্রজার মধ্যে পারস্পরিক সুবিধাজনিত জোটবন্ধন, যা কিনা ১৯৩৭ এর নির্বাচনোত্তর কালে বাংলায় হিন্দু প্রাধান্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে একটি ফলপ্রসূ মুসলিম মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য অপরিহার্য ছিল, তা প্রকৃতপক্ষে আশরাফদের নিকট প্রজাদের আত্মসমর্পনের নির্দেশক ছিল।
ফজলুল হক ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে একটি জোট মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে নিজেকে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়সহ কৃষদের থেকে আরও দূরে সরিয়ে ফেলেন। শেষপর্যন্ত খাজা নাজিমউদ্দীন এবং এইচ.এস সোহরাওয়ার্দীর মতো আশরাফ নেতারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার প্রধান মন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হকের স্থানে অধিষ্ঠিত থাকলেন, এবং তখন থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আশরাফ নেতৃবৃন্দ কিছু অনুগত প্রজা নেতা, যেমন নুরুল আমীন, তমিজুদ্দীন খান, ওয়াহিদউজ্জামান (ঠান্ডা মিঞা), ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা), ফজলুল রহমান এবং অন্যান্যের সহযোগিতায় বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে থাকেন।
ইতোমধ্যে, ১৯৪৩ সনের বাংলার দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৬ এর আগস্টের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা পরিবেশকে আরও অবনতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। একজন সাধারণ বাঙালি মুসলমানের কাছে হিন্দু ব্যবসায়ী, মজুতদার এবং কালোবাজারীসহ জমিদার এবং মহাজনেরা ছিলেন দুর্ভিক্ষের জন্য মূলত দায়ী ও অপরাধী। সাধারণভাবে হিন্দু নেতৃবৃন্দ, বিশেষকরে জমিদার এবং ভদ্রলোকেরা মুসলমান জনগণের কাছে তাদের বিশ্বস্ততা হারালেন। কৃষকসহ বাংলার মুসলমান জনগণের কাছে পাকিস্তানের ধারণাটি মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে দেখা দিয়। ১৯৪৬ এর কলকাতার হত্যাযজ্ঞ, যা কিনা মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসএর দ্বারা ত্বরান্বিত হয়েছিল, পাকিস্তানের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।
১৯৪৬ এর প্রারম্ভেই মুসলিম লীগ পূর্ববাংলার প্রায় প্রতিটি জেলাতেই তাদের ঘাঁটি সৃদৃঢ় করে তোলে। এর প্রতিফলন ঘটে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে। মুসলমানরা পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েই মুসলিম লীগকে ভোট প্রদান করে। তবে, ‘পাকিস্তান’ নামক কল্পরাজ্যটি বলতে যারা ভোট দিয়েছিলেন তারা এবং যাদের ভোটাধিকার ছিল না তারা কী বুঝেছিলেন সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন সাম্প্রদায়িকতার চরম দিনগুলিতে (১৯৪৬-৪৭) ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের কৃষক সম্প্রদায়কে বিপ্লবীকরণ করতে গিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে শ্রেণি-ভিত্তিক কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে। অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলন ছিল সেইরূপ একটি আন্দোলন, এবং এটা মুখ্যত সীমাবদ্ধ ছিল উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার উপজাতি, রাজবংশী, সাঁওতাল এবং গারোদের মধ্যে। যখন বর্গাদাররা জোরপূর্বক ক্ষেত থেকে তাদের প্রাপ্য অংশ অর্থাৎ ফসলের দু-তৃতীয়াংশ ছিনিয়ে নিল তখন সি.পি.আই নেতৃবর্গ, প্রধানত উচ্চবর্ণ হিন্দু ভদ্রলোকদের নেতৃত্বাধীন এ আন্দোলন এক সহিংস রূপ গ্রহণ করল। অনেক ভূমিহীন কৃষক এবং অন্যান্যরা, বর্গাদারী ব্যবস্থার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, তারাও এ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে।
এটা উল্লেখযোগ্য যে, হিন্দু মুসলমান ভদ্রলোক উভয়ই এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন, কেননা গ্রাম সম্প্রদায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে একটি শ্রেণি যুদ্ধের আশংকা তারা করেছিলেন। মুসলিম লীগ নেতারা মুসলমান কৃষকদের এ বলে নিরস্ত করেন যে, পাকিস্তান অর্জন হলে সমস্ত জমির মালিক তারাই হবে কেননা তখন হিন্দু ভূ-স্বামীদের পাকিস্তান নামক ‘বিশুদ্ধ (মুসলমান) এর আবাসভূমি’ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করা হবে। কোন কোন মুসলমান নেতা তাদের স্বপ্নের ‘সোনার পাকিস্তানে’ মুসলমান কৃষকদের চৌভাগা অর্থাৎ গোটা ফসলের প্রতিশ্রুতি দিলেন। ফলে, একজন সাধারণ মুসলমান কৃষকের কাছে পাকিস্তানের ‘সাম্প্রদায়িক’ ধারনার আবেদন শ্রেণি সংহতি কিংবা জাতীয়তাবাদের নামে অন্য যেকোনো আবেদনের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। স্বর্গরাজ্য পাকিস্তানের আবেদন কৃষকদের মধ্যে এতটাই প্রবল ছিল যে, তেভাগা আন্দোলনের অনেক হিন্দু কমিউনিস্ট নেতা মুসলমান নাম গ্রহণ করেন (যেমন বারীণ দত্ত হলেন আব্দুস সালাম), ইসলামের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে মুসলমান কৃষকদের সঙ্গে বাস্তবিকই অংশ গ্রহণ করেন, এবং একই স্থানে কমিউনিস্টদের লাল পতাকা ও মুসলিম লীগের সবুজ পতাকা উত্তোলিত হয়। সি.পি.আই নেতা কর্তৃক আয়োজিত সভায় মুসলমান কৃষকেরা একই সঙ্গে পাকিস্তান ও তে-ভাগার পক্ষে স্লোগান দেয়।
ক্রমশ সমগ্র অঞ্চল জুড়ে পাকিস্তানের দাবিই মুসলমান কৃষকদের প্রধান স্লোগানে পরিণত হয়, এবং অন্যদিকে তে-ভাগার দাবি, যা কিনা অনেক ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু সংখ্যক কৃষক, প্রধানত উপজাতীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্বল হয়ে মিইয়ে যায়। অন্যদিকে কৃষকরা ব্যক্তিগত মালিকানায় দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল। এ কারণেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যাপারে তাদের দোটানা মনোভাব ছিল এবং কমিউনিজমের প্রতি তাদের সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল না। প্রথমত কৃষকরাই প্রথম এ দাবি তুলেছিল, সি.পি.আই নয়; এবং দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলন জমির ব্যক্তিমালিকানার ধারণাকে কখনও প্রশ্ন করে নি।
১৯৪৭ সনের মধ্যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সাম্প্রদায়িকতা এবং সর্বোপরি, উচ্চবিত্ত কৃষকদের ওপর সাধারণ দরিদ্র কৃষকের নির্ভরশীলতা পূর্ববাংলার কৃষকদের রাজনৈতিক আচরণের প্রকৃতিতে যে উপ-আঞ্চলিক পার্থক্য ছিল তা মুছে দেয়। ত্রিপুরা নোয়াখালী উপ-অঞ্চলের তুলনামূলকভাবে স্বাধীনচেতা মধ্যবিত্ত কৃষক (১৯৩০ ও ১৯৪০ এর ব্রিটিশ বিরোধী কংগ্রেস আন্দোলনের অগ্রগামী সৈনিক), মুসলিম জোতদার অধ্যুষিত রংপুর, দিনাজপুর এবং যশোর, খুলনা উপ-অঞ্চলের মুসলমান নিম্ন কৃষকসহ মুসলিম লীগের ‘ইসলামি’ এবং ‘সোনার পাকিস্তানের’ অধীনে আমূল অর্থনৈতিক সংস্কার ও ’‘বিপন্ন ইসলামের’ নামে আবেদনের প্রলোভনে বশীভূত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে, উচ্চবর্ণ হিন্দু কংগ্রেস নেতারা অধিকাংশ নমঃশূদ্র কৃষককে নিজেদের দলে টানতে সক্ষম হয়। [তাজুল ইসলাম হাসমী]
গ্রন্থপঞ্জি Ranajit Guha, Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India, Oxford, 1983; Loel S Migdal, Peasants, Politics, and Revolutio Pressures toward Political and Social Change in the Third World, Princeton, 1974; Sumit Sarkar, 'The Condition and Nature of Subaltern Militancy: Bengal from Swadeshi to Non-cooperation, c 1905-22', in R Guha (ed), Subaltern Studies III, Oxford, 1984; Taj I Hashmi, Pakistan as a Peasant Utopia, Boulder, 1992.