ব্যবসা-বাণিজ্য

ব্যবসা-বাণিজ্য একটি শব্দ যা দ্বারা পণ্যদ্রব্য ক্রয় ও বিক্রয়ের কাজকে নির্দেশ করে। স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলার অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধি হয়ে আসছে। বাংলায় অসংখ্য নদী-নালা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য উপযোগী সুবিধাজনক যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ তৈরী করে দিয়েছিল। আর বঙ্গোপসাগরের সান্নিধ্য বাংলাকে দিয়েছিল সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুযোগ। এই বাণিজ্যিক ঐতিহ্য সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ব্যবসা বাণিজ্যের ধরণ নিম্নরূপ:

প্রাচীন যুগ আধুনিক ভারতবর্ষের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার কিছু কিছু এলাকা এবং বর্তমান বাংলাদেশের সম্মিলিত ভূখন্ড নিয়ে প্রাচীন বাংলা গঠিত ছিল। এই অঞ্চল সুদূর অতীতে চারটি প্রধান ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। সেগুলি হলো পুন্ড্রবর্ধন, রাঢ়, বঙ্গ এবং সমতট, হরিকেল। ভৌগোলিক বিচারে বাংলার অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায়। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তর ভূখন্ড নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন বাংলা। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপাঞ্চল হিসেবে এ বাংলার ভূগোল, পরিবেশ ও মানুষের ক্রিয়াকলাপ অতি প্রাচীন আমল থেকেই নদীব্যবস্থা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাই একমাত্র প্রকৃত আসমুদ্রহিমাচল অঞ্চল। একদিকে মধ্য গঙ্গা উপত্যকা এবং অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত হওয়ার সুবাদে বাংলা পশ্চিমে গাঙ্গেয় উপত্যকার সঙ্গে এবং পূর্বে তথা উত্তরপূর্বে অসম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারত। দক্ষিণ দিকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা যুক্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। স্থলবন্দি গাঙ্গেয় উপত্যকার ক্ষেত্রে গাঙ্গেয় বদ্বীপই সমুদ্রে পৌঁছবার পক্ষে একমাত্র পথ। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ ও পণ্যের যে গতিবিধি বাংলায় দেখা যায় তা বহুলাংশে এই ভৌগোলিক ও পরিবেশগত উপাদানগুলি দ্বারা প্রভাবিত।

পুন্ড্রবর্ধন, রাঢ়, বঙ্গ এবং সমতট অঞ্চল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে কখনো কোন একটি রাজশক্তির অধীনে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। তার ফলে চারটি অঞ্চলে রাজনৈতিক জীবনের গতিপ্রকৃতি এক রকম ছকে বাঁধা ছিল না। সে কারণে এই চারটি প্রধান অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কোনও একমাত্রিক ও একরৈখিক রূপ নেই।

প্রাচীন বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি সমগ্র উপমহাদেশের প্রাচীন বাণিজ্যের সামগ্রিক পটভূমিতে বুঝতে হবে। সমগ্র উপমহাদেশের মতো প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক জীবন কৃষি অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রে, বিশেষত অর্থশাস্ত্রে, বার্ত্তা (অর্থাৎ বিবিধ বৃত্তি বিষয়ক যে বিদ্যা)-র তিনটি প্রধান দিক কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য উল্লিখিত হয়েছে। কৃষির তুলনায় ব্যবসা থেকে যে অধিকতর অর্থাগম ঘটে, এর স্বীকৃতি দেখা যায় পালি বৌদ্ধ গ্রন্থে (মজ্ঝিম নিকায়)। অঙ্গুত্তর নিকায়েও বলা হয়েছে, বাণিজ্য থেকে প্রভূত ধনলাভ করা সম্ভব। বিখ্যাত বৈয়াকরণিক পাণিনি (আনুমানিক খ্রি.পূ পাঁচ শতক) অবগত ছিলেন যে, বাণিজ্যের দুই প্রধান দিক ‘ক্রয়-বিক্রয়’। প্রাচীন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে চর্চা করার জন্য প্রধান সহায় দেশজ সাহিত্যগত তথ্যসূত্র (উপদেশাত্মক ও সৃজনশীল সাহিত্য), বিদেশী লেখকদের (গ্রিক-রোমান, চীনা, আরবি, ফারসি ও ইউরোপীয়) বিবরণ, লেখমালা, মুদ্রা এবং উৎখনিত ও অনুসন্ধিত প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া বিবিধ পুরাসম্পদ। এই বিচিত্র তথ্যসূত্র অবশ্য খ্রি.পূ ছয় শতকের আগে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে বিশেষ কোনও আলোকপাত করে না। লক্ষনীয় যে, নানা প্রকার আকর তথ্যসূত্র থাকলেও সেগুলি পরিমাণে পর্যাপ্ত নয়, বরং তা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ। তদুপরি ওই তথ্যসূত্রগুলিতে পরিসংখ্যান প্রায় নেই বললেই চলে। প্রাচীন বাংলার বাণিজ্যিক ইতিহাস এই সীমাবদ্ধ তথ্যসূত্রকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে।

প্রাচীন বাংলার আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রবাহ কিন্তু সর্বদা উপমহাদেশীয়, এমনকি উত্তর ভারতীয় ছকের সঙ্গে সমান তালে চলে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, খ্রি.পূ ২৫০০ থেকে ১৭৫০ সময়সীমায় যখন উপমহাদেশের উত্তর ও উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে পরিণত ও সুবিন্যস্ত নগরায়ণ দেখা গিয়েছিল, তখন প্রাচীন বাংলাসহ উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে অনুরূপ কোনও নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির চিহ্ন নেই। আবার খ্রি.পূ ছয় ও পাঁচ শতকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় যখন নগরায়ণ ও মহাজনপদগুলির উত্থান ঘটে, তার অনুরূপ নজির সমকালীন বাংলার অন্য কোথাও নেই।

প্রাচীন বাংলায় জটিল অর্থনৈতিক জীবনের লক্ষণগুলি (স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ, বহুবিধ কারিগরি শিল্পোৎপাদন এবং বাণিজ্য) প্রথম পরিস্ফুট হয় সম্ভবত খ্রি.পূ চার শতকে অর্থাৎ মৌর্য আমলে। লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকর্ম, যা উদ্বৃত্ত ফলনের এক অপরিহার্য উপাদান, কারিগরি শিল্পে অগ্রগতি, সুপ্রতিষ্ঠিত বিনিময় ব্যবস্থা এবং নগরাশ্রয়ী অর্থনীতি এগুলি গাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রি.পূ ছয় শতক থেকে লক্ষ্য করা যায়। অনুমান করা যায়, মগধকেন্দ্রিক মৌর্যশক্তি প্রাচীন বাংলার একাংশে ক্ষমতা বিস্তার করার ফলে উত্তর ভারতীয় জটিলতর অর্থনৈতিক জীবনের লক্ষণগুলি ক্রমে বাংলাতেও মূর্ত হয়ে ওঠে।

বিনিময়যোগ্য পণ্য  মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া বাংলার প্রাচীনতম লিপি থেকে (আনু. খ্রি.পূ তিন শতক) প্রাচীন বাংলার বিনিময়যোগ্য পণ্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। লিপির সূত্রে জানা যায় যে, পুন্ড্র বা প্রাচীন বাংলার উত্তরাংশ ধান ও তিল উৎপাদনের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছিল। লিপিটি সাক্ষ্য দেয়, পুন্ড্রনগরের (বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত প্রত্নস্থল মহাস্থান) কোষাগারে ওই দুই শস্য সংরক্ষিত থাকত। সংরক্ষিত শস্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে উপদ্রুত স্থানীয় অধিবাসীদের একাংশের মধ্যে বিতরণের নির্দেশও ঐ লেখটিতে উপস্থিত। অর্থাৎ পুন্ড্রনগরের কোষাগারে সংরক্ষিত ধান ও তিল কোনও জরুরি পরিস্থিতিতে ত্রাণের জন্য বন্টিত হয়েছিল। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে পণ্যাধ্যক্ষের (বাণিজ্য বিষয়ক উচ্চপদস্থ আধিকারিক) উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন শস্যসহ একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুত ভান্ডার গড়ে তোলার জন্য, যেখান থেকে আপৎকালে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হবে। এদিক দিয়ে বিচার করলে মনে হয়, খ্রি.পূ তিন শতকে উত্তরবঙ্গে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ঘটত এবং উদ্বৃত্তের একাংশ সরকারি খাদ্যভান্ডারে সংরক্ষিত থাকত। অর্থাৎ, খ্রি.পূ তৃতীয় শতকে উত্তরবঙ্গে শস্যের লেনদেন অজানা ছিল না। এই লেনদেনে স্থানীয় প্রশাসনেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা যায়। তবে রাষ্ট্র পরবর্তীকালে সে শস্য ক্রয় ও বণ্টনে অনুরূপ উদ্যোগ নিত কিনা তার কোনও প্রমাণ নেই।

শস্যের বাণিজ্যিক লেনদেন বিষয়ে বিগত এক দশকে চমকপ্রদ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য মিলেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষত উত্তর চবিবশ পরগনা, দক্ষিণ চবিবশ পরগনা এবং মেদিনীপুর জেলা থেকে, আবিষ্কৃত হয়েছে অনেকগুলি পোড়ামাটির নামমুদ্রা এবং নামমুদ্রার ছাপ। নামমুদ্রাগুলি প্রধানত পাওয়া গেছে দুই প্রধান প্রত্নক্ষেত্র চন্দ্রকেতুগড় (উত্তর চবিবশ পরগণা জেলা) এবং তমলুক (মেদিনীপুর জেলা) ও সন্নিহিত এলাকা থেকে। এই নামমুদ্রাগুলির অধিকাংশই ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী মিশ্রিত লিপিতে উৎকীর্ণ লেখ দেখা যায়। ক্ষুদ্র লিপিগুলি পুরালেখবিদ্যার বিচারে আনুমানিক খ্রি.পূ প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় চার শতক পর্যন্ত ব্যবহূত হয়েছিল। লেখসম্বলিত নামমুদ্রার অনেকগুলিতে দেখা যায় জলযানের প্রতিকৃতি; জলযানের পাটাতনে রাখা পেটিকাও প্রদর্শিত; পেটিকার ভেতরে রয়েছে সশীষ ধানের গুচ্ছ। একটি নামমুদ্রায় উল্লিখিত হয়েছে একজন বণিকের নাম যিনি খাদ্য (সম্ভবত ধান) বিক্রয় করে প্রভূত ধনের অধিকারী হয়েছিলেন। অনুমান করা সঙ্গত যে, খ্রিস্টীয় প্রথম চার শতকে বাংলা তার প্রভূত কৃষিসম্পদের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে; উৎপন্ন ফসলের, বিশেষত ধানের একাংশ সম্ভবত সমুদ্রপথে রফতানিও হতো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, চৌদ্দ শতকে ইবনে বতুতা ও পনেরো শতকে মা-হুয়ান এর দেয়া তথ্যানুযায়ী বাংলা থেকে যে সুদূর মালদ্বীপে সমুদ্রপথে চাল রফতানি হতো তা জানা যায়। তাই খাদ্যশস্য, বিশেষ করে ধান যে প্রাচীন বাংলার বিনিময়যোগ্য পণ্যের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিল, সে বিষয়ে খুব আর সন্দেহ থাকে না। ধান ছাড়া পুন্ড্রবর্ধনের আখচাষ প্রাচীনকালে এতটাই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে যে পৌন্ড্রক বলতে পুন্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গে উৎপন্ন আখকে বোঝাত। সমগ্র উত্তরভারতে সেরা আখের তালিকায় পৌন্ড্রক বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। পৌন্ড্রক জাতীয় আখ শর্করা উৎপাদনে বিশেষ সহায়ক ছিল বলে তার ব্যাপক চাহিদা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।

উপমহাদেশের প্রাচীন বাণিজ্য বোঝার জন্য এক অমূল্য উপাদান অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিকের রচনা পেরিপ্লাস টেস ইরিথ্রাস থালাস্সেস (The Periplus of the Erythraen Sea, আনুমানিক খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শেষ ভাগে রচিত)। এই গ্রন্থে গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিম্নভাগ গ্যাঙ্গে বা গঙ্গা দেশ নামে অভিহিত। গ্যাঙ্গে অঞ্চলের প্রসিদ্ধ পণ্যের মধ্যে ছিল তেজপাতা এবং সুগন্ধী তেল, যাকে পেরিপ্লাসের লেখক বলেছেন নার্ড। এই দুই কৃষিজাত পণ্য যে রোমের সম্ভ্রান্ত ও বিত্তবান গোষ্ঠীর কাছে বিশেষ সমাদৃত ছিল, সে প্রসঙ্গও গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। আনুমানিক খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে লিখিত সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি ঋণসংক্রান্ত চুক্তিপত্রে পেরিপ্লাসের বক্তব্যের চমকপ্রদ সমর্থন মিলবে। প্যাপিরাসের উপর লিখিত এই চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে যে, মালাবার উপকূলের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে (বর্তমান ক্র্যাঙ্গানোর, কেরালা) অপেক্ষমান বিদেশী জাহাজ হার্মোপোলন-এ প্রচুর পরিমাণে গ্যাঞ্জেটিক নার্ড বা গঙ্গাদেশের সুগন্ধীতেল তোলা হয়। ওই সুগন্ধী তেল যে সমুদ্রপথে ও স্থলপথে মিশরের প্রসিদ্ধ বন্দর আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে এই তথ্যটিও ঋণপত্রে উল্লিখিত আছে। পেরিপ্লাসের লেখক তেজপাতা ও নার্ডকে যদিও গঙ্গাদেশের পণ্য বলে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু এগুলি আসলে নিম্ন গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের উৎপন্ন দ্রব্য নয়। তেজপাতা ও নার্ড যে উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত হতো, তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। অতএব উত্তর-পূর্ব ভারতের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী প্রথমে আসত গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায়; সেখান থেকে উপকূলের বাণিজ্য মারফৎ তা পৌঁছত তামিলনাড়ুর উপকূলে; তামিলনাড়ু থেকে স্থলপথে মালাবারের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে তা আনা হতো এবং শেষ পর্যন্ত মুজিরিস থেকে তা পৌঁছাতো পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়।

পেরিপ্লাসের বর্ণনায় অবশ্য গ্যাঙ্গের সর্বাধিক প্রশংসা করা হয়েছে তার অসামান্য সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র (মসলিন)-এর জন্য। বাংলার অন্যতম প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য ছিল এই মসলিন। প্রাচীন বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎকর্ষ অবশ্য খ্রি.পূ তিন শতকে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে স্বীকৃতি পেয়েছিল। পেরিপ্লাসের বর্ণনা অনুযায়ী চীনের রেশমও উত্তরপূর্ব সীমান্ত হয়ে উপমহাদেশে আসত। তারপর তা গঙ্গাবিধৌত বদ্বীপ এলাকার মধ্য দিয়ে সমুদ্রপথে পৌঁছত সুদূর দক্ষিণভারতের ড্যামিরিকা/লিমুরিকে অঞ্চলে, অর্থাৎ দ্রাবিড় দেশে। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত তা রোমের বাজারে সমুদ্রপথে পাঠানো হতো। পরবর্তী আমলেও বাংলার বস্ত্রশিল্পের উচ্চমান যে অব্যাহত ছিল, তার অবিসংবাদিত প্রমাণ রয়েছে আরবি ও ফারসি বিবরণীতে (নয় থেকে চৌদ্দ শতক), মার্কোপোলোর ভ্রমণবৃত্তান্তে (খ্রিস্টীয় তেরো শতকের শেষাংশ) এবং সমকালীন চৈনিক রচনায়। এই বিদেশি লেখকদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে প্রাচীন বাংলায় আসেন নি। এতদ্সত্ত্বেও বাংলার বস্ত্রশিল্প সম্বন্ধে তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা যে দেখা যায়, তার কারণ নিঃসন্দেহে বাংলার বস্ত্রের গুণগত মান এবং বহুল উৎপাদন। বিশেষ লক্ষণীয় চীনের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী চৌ-জু-কুয়া (১২২৫ খ্রি.) জানতেন পোং-কি-লো বা বঙ্গালে উৎকৃষ্ট তুলা উৎপন্ন হয়।

খ্রিস্টীয় আট শতক থেকে লেখমালায় নিয়মিতভাবে স্থান পেয়েছে গুবাক (সুপারি) ও পান চাষের কথা (‘বারজিক’ কথাটি সম্ভবত বরজ থেকেই নিষ্পন্ন)। এই দুই কৃষিপণ্যই ব্যবসার জগতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন বাংলার উপকূলীয় এলাকায় যে নারিকেল ফলানো হতো, তার স্পষ্ট সাক্ষ্য আট শতকের পরবর্তী লেখগুলিতে পাওয়া যায়। উপকূলবর্তী এলাকা লবণ উৎপাদনের কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল; এর প্রমাণ পাওয়া যায় নয় থেকে তেরো শতক পর্যন্ত লেখমালায়। দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য ও বিলাসের সামগ্রীর পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার বাণিজ্যের পান, সুপারি, নুন, নারকেল ও ধানের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনের পণ্যগুলিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

উপরোল্লিখিত প্রায় সব পণ্যই কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুটি বনজ সম্পদও বাংলাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। নয় থেকে চৌদ্দ শতকের আরবি রচনায় বারবার কামারুনী অগুরু কাঠের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কামারুনী অগুরু বৃক্ষ কামরুন বা কামরূপ (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা)-এ বহুল পরিমাণে পাওয়া যেত এবং একমাত্র মুলতানের অগুরু কাঠই কামরূপের অগুরুর তুলনায় উচ্চতর ছিল। আরব লেখকদের লেখায় আসামের এই বহুমূল্য বনজ সম্পদ নদীপথে আদি মধ্যযুগীয় বন্দর সমন্দর-এ আনা (বর্তমান চট্টগ্রাম-এর নিকটে অবস্থিত) এবং সেখান থেকে তা পশ্চিম এশিয়ায় রফতানির বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁদের বিবরণী থেকে আরও জানা যায় যে, সমন্দর থেকে গন্ডারের খড়গ পাঠানো হতো। পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলিতে যার বিশেষ কদর ছিল। অগুরুকাঠের মতোই গন্ডারের খড়গ খুব সম্ভবত কামরূপেই প্রাথমিকভাবে পাওয়া যেত এবং সেখান থেকে তা বাংলার একটি প্রধান বন্দরে আনা হতো।

সাম্প্রতিক গবেষণায় আরও একটি পশুর বাণিজ্যিক গুরুত্ব প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে স্বীকৃত হয়েছে। সেটি হলো অশ্ব (ঘোড়া), বিশেষ করে যুদ্ধাশ্ব। সেরা যুদ্ধাশ্ব অবশ্য কখনই ভারতে সুলভ ছিল না; তা প্রধানত আমদানি করা হতো মধ্য এশিয়া থেকে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে বিদেশী উৎকৃষ্ট ঘোড়া ভারতীয় এলাকায় আনা হতো। কাং-তাই (আনু. খ্রিস্টীয় তিন শতক) জানিয়েছেন যে, ইউয়েচ্চি অর্থাৎ কুষাণ বণিকরা সমুদ্রপথে নিয়মিত কো-ইং দেশে (মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত) ঘোড়া চালান দিতেন। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাঙ্গিয়ান দ্বীপে ঘোড়ার প্রতিকৃতি উৎকীণ তাম্র নির্মিত একটি পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ঘোড়ার পাশে যে দুই ব্যক্তি দন্ডায়মান তাদের পরণে ছিল খাঁটি কুষাণ পোশাক। উত্তর ভারত থেকে কুষাণ যুগের ব্যবসায়ীরা যদি সমুদ্রপথে মালয় উপদ্বীপ অঞ্চলে ঘোড়া চালান দিয়ে থাকে, তাহলে এই সমুদ্রযাত্রা শুরু করার অনুকূল এলাকা গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিম্নভাগ। এরই সঙ্গে যোগ করতে হবে সম্প্রতি আবিষ্কৃত চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া এবং ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী মিশ্রিত লিপিতে উৎকীর্ণ একটি নামমুদ্রার সাক্ষ্য। আনুমানিক খ্রিস্টীয় তিন শতকের এই লেখসম্বলিত নামমুদ্রায় রয়েছে একটি জলযানের প্রতিকৃতি। এক মাস্ত্তল বিশিষ্ট জলযানটির উপরে দন্ডায়মান একটি অশ্বও দেখানো হয়েছে। লেখটিতে বলা হয়েছে যে, জলযানটি ত্রপ্যক। পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী-তে অভিহিত ত্রপ্লগ এবং জৈন গ্রন্থ অঙ্গবিজ্জাতে উল্লিখিত ত্রপ্যগ বলে জলযানের সঙ্গে সহজেই ত্রপ্যক-কে অভিন্ন বলে শনাক্ত করা সম্ভব। বাংলার উপকূলবর্তী এলাকা থেকে জলযানের সাহায্যে ঘোড়া চালান দেওয়ার এটিই সম্ভবত প্রাচীনতম প্রমাণ। প্রায় সমকালীন তামিল সঙ্গম সাহিত্যে দেখা যায় যে, তামিলনাড়ুর বন্দরে ঘোড়া আনা হতো উত্তর থেকে। তামিলনাড়ুর উত্তরে অবস্থিত এই দেশটি বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চল হতে পারে। যখন পাল ও সেন রাজাদের রাজনৈতিক-সামরিক প্রতাপ বাংলাকে উত্তরভারতের অন্যতম আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করে, তখন যুদ্ধের অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বাংলায় ৭৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দে ঘোড়ার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই বহুপরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। পালরাজদের লিপিগুলিতে কিভাবে উত্তরাপথ থেকে তাঁরা বহু যুদ্ধাশ্ব উপঢৌকন রূপে পেত তাই বারবার বর্ণিত হয়েছে (উদীচীনাননেক-নরপতি-প্রাভৃতীকৃতাপ্রমেয়হয়বাহিনী)। এই বর্ণনার মধ্যে প্রথাগত আড়ম্বরপূর্ণ অত্যুক্তি থাকতেই পারে; কিন্তু তাঁদের অশ্ববাহিনীর পক্ষে উপযুক্ত যুদ্ধাশ্ব পাওয়ার প্রধান এলাকা যে সুদূর উত্তরাপথ, এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। ৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের একটি লিপিতে বর্ণিত আছে যে, প্রাচীন পৃথূদক (বর্তমান হরিয়ানার অন্তর্গত পেহোয়া) ছিল ‘ঘোটকযাত্রা’ বা অশ্ব বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র। তেরো শতকে মিনহাজউদ্দীন তাঁর তবকাত-ই-নাসিরীতে উল্লেখ করেছেন যে, নুদীয়া শহরে (আধুনিক নবদ্বীপের নিকটে অবস্থিত নদীয়া জেলার অন্তর্গত নদীয়া) প্রচুর সংখ্যায় সেরা আরবি ঘোড়া আসত। সেন আমলে নুদীয়াতে আরব অশ্ববণিকদের যাতায়াত এতই পরিচিত দৃশ্য ছিল যে, অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে বখতিয়ার খলজীর সেনাবাহিনীর একাংশ যখন নুদীয়া শহরে প্রবেশ করে, লক্ষ্মণসেন এর প্রশাসন সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনই বোধ করে নি। মিনহাজ আরও জানিয়েছেন যে, নুদীয়া ছাড়াও অশ্ব আমদানির অপর বিখ্যাত কেন্দ্র ছিল লক্ষ্মণসেনের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি (যা উত্তরবঙ্গে অবস্থিত ছিল)। মিনহাজের বিবরণ অনুযায়ী লখনৌতিতে দৈনিক ১৫০০ ঘোড়া আসত করমবাত্তান বা করমপত্তন থেকে (করমপত্তনের অবস্থিতি ছিল দক্ষিণপশ্চিম ভূটানের কেরাগোম্পাতে, অথবা তিববতের উত্তরাংশে)। আদিমধ্য যুগে বাংলায় তাহলে ঘোড়া আমদানি হতো উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তরপূর্ব উভয় সীমান্ত অঞ্চল থেকে। পনেরো শতকের চীনা বিবরণের ভিত্তিতে সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে যে, চীনের মিঙ্গ রাজারা সমুদ্রপথে বাংলার বন্দর থেকে ঘোড়া চীনদেশে নিয়ে যেতেন। বাংলায় যেসব যুদ্ধাশ্ব আমদানি করা হতো, তার একাংশ সম্ভবত সমুদ্রবাণিজ্য মারফৎ আবার অন্যত্র রফতানি হয়ে যেত।

বাংলায় আমদানি করা পণ্যের মধ্যে ছিল প্রধানত কড়ি, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যার গুরুত্ব আদিমধ্যযুগীয় বাংলায় (৭৫০-১২০০) বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। যদিও সেরা জাতের কড়ি বাংলার নিজস্ব সামগ্রী ছিল। ইবন বতুতা এবং মা হুয়ানএর বিবরণ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, বাংলায় প্রচুর পরিমাণে কড়ি আসত সমুদ্রপথে মালদ্বীপ থেকে। কড়ি ছিল ভারতমহাসাগরে দূরপাল্লার বাণিজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত। ধাতবমুদ্রা প্রস্ত্তত করার জন্য প্রয়োজনীয় সোনা এবং রূপাও বাংলার স্থানীয় সামগ্রী না। এই দুর্মূল্য ধাতু বাংলায় আসত নিঃসন্দেহে আমদানিকৃত দ্রব্য হিসেবে। রূপা বাংলায় আরাকান এবং পেগু অঞ্চল থেকে আনা হতো। তার সমর্থনে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে।

প্রাচীন বাংলায় যে পণ্যসামগ্রীর লেনদেন চলত, তার বৈচিত্র্য আমাদের নজর এড়ায় না। খাদ্যশস্য, পণ্যশস্যসহ আটপৌরে দ্রব্যের চাহিদা যেমন ছিল, তেমনই বিত্তবান গোষ্ঠীর শৌখিনতা মেটাতে দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য বস্ত্তর ব্যবসাও চলত।

বাণিজ্যকেন্দ্র ও বণিক সম্প্রদায়  বিনিময়যোগ্য পণ্যগুলির লেনদেন চলত বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে, যেখানে সক্রিয় ছিল বণিকরা। বাণিজ্যকেন্দ্র ও বণিকদের মধ্যে বৈচিত্র্য কিছু কম ছিল না। বাণিজ্যকেন্দ্র ও বণিকদের প্রকারভেদ তথ্যসূত্রে স্পষ্টতই উপস্থিত।

প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত নগরগুলি প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্র ছিল, যেমন, পুন্ড্রনগর (মহাস্থান, বাংলাদেশ), কোটিবর্ষ (বাণগড়, পশ্চিমবঙ্গ), মঙ্গলকোট (বধর্মান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), রামাবতী (পালরাজ রামপালের রাজধানী) এবং  বিক্রমপুর (বাংলাদেশ)। বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে বৃহৎ নগর ছিল শীর্ষস্থানে। প্রধান প্রধান নগরের বিপণনকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রাচীন বন্দরগুলি, সংস্কৃতে যা পট্টন ও বেলাকুল বলে পরিচিত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শেষ থেকে খ্রিস্টীয় আট শতক পর্যন্ত বাংলা তথা সমগ্র মধ্যগঙ্গা উপত্যকার পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি। রূপনারায়ণ নদের তীরে অবস্থিত ও বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকের সঙ্গে অভিন্ন প্রাচীন তাম্রলিপ্তি তথ্যসূত্রে ‘বেলাকুল’ অভিধায় চিহ্নিত। তমলুকে প্রাপ্ত পুরাবস্ত্ত হয়তো সাহিত্যগত সাক্ষ্যপ্রমাণের মতো সুপ্রচুর নয়, তবুও প্রত্নবস্ত্ত এই অগ্রগণ্য বন্দর-নগরের সমৃদ্ধির পরিচয়ই বহন করে। টলেমীর ভূগোলে এই বন্দরের নাম তামালিটেস এবং প্লিনি তাঁর ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে একে উল্লেখ করেছিলেন তালুক্টে নামে। দুই চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন (ভারতে পরিভ্রমণ ৩৯৯-৪১৪ খ্রি.) এবং হিউয়েন-সাং (ভারতে ভ্রমণ ৬২৯-৪৫ খ্রি.) আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হিসেবে, বিশেষকরে বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যে তাম্রলিপ্তি বন্দরের উজ্জ্বল ভূমিকা বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন।

পেরিপ্লাস গ্রন্থে এবং টলেমীর ভূগোলে (আনু. ১৫০ খ্রি.) গ্যাঙ্গে নামক অপর একটি বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। গঙ্গা নদীর তীরে এবং সমুদ্র থেকে অনতিদূরে অবস্থিত ছিল এই গ্যাঙ্গে বন্দর। অধিকাংশ পন্ডিত গ্যাঙ্গে বন্দরকে শনাক্ত করেছেন উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার বিখ্যাত প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড়ের সঙ্গে (এ বিষয়ে অবশ্য ঐতিহাসিক মহলে পূর্ণ মতৈক্য নেই)। বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত চন্দ্রকেতুগড় যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল, তার সমর্থনে সংশয়াতীত প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। চন্দ্রকেতুগড় থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে জলযানের প্রতিকৃতি সম্বলিত পোড়ামাটির অনেকগুলি নামমুদ্রা, যেগুলিতে ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী মিশ্রিত হরফে লেখ ও উৎকীর্ণ হয়েছিল। পুরালেখবিদ্যার বিচারে এই নামমুদ্রাগুলি খ্রিস্টীয় প্রথম তিন বা চার শতক ধরে প্রচলিত ছিল। সমগ্র উপমহাদেশের অন্যত্র কোথাও জলযানের প্রতিকৃতি সমেত নামমুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়নি। নামমুদ্রায় দেখা যায় সাধারণ ডিঙ্গি জাতীয় জলযানের চিত্র, আবার ত্রপ্যগ জাতীয় উপকূলীয় বাণিজ্যের উপযুক্ত জলযানও অজানা ছিল না। দুই প্রকারের জলযান (প্রতিকৃতি সমেত) নামমুদ্রায় ‘জলধিশক্র’ (সমুদ্রে ইন্দ্রের তুল্য) এবং ‘ত্রিদেশযাত্রা’ (বহুদূর দেশে পাড়ি দিতে সক্ষম) বলে চিহ্নিত। গ্যাঙ্গে তথা চন্দ্রকেতুগড়ের বন্দরে যে বহু প্রকারের জলযান নিত্য যাতায়াত করত, সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। তাম্রলিপ্তি যদি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মুখ্য বন্দর হয়, তাহলে গ্যাঙ্গেয় বন্দর ছিল তার যোগ্য সহায়ক বন্দর।

খ্রিস্টীয় আট শতকের পরবর্তী কোনও তথ্যসূত্রে তাম্রলিপ্তের আর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাম্রলিপ্তের পূর্বগৌরব সম্ভবত অস্তমিত হয়ে যায়। তার অধোগতির প্রধান কারণ বোধহয় নদীতে অত্যধিক পলিমাটি জমা হওয়া এবং নদীর গতিপথে পরিবর্তন। প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ সমুদ্র বাণিজ্যের ফলে প্রতিকূল অভিঘাত দেখা দিতে পারে। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের ধারণা সমুদ্রবাণিজ্য ও সামগ্রিক বাণিজ্যের অবনতির ফলে আদি মধ্যকালীন বাংলায় আবদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামমুখী আর্থ-সামাজিক অবস্থার উদ্ভব ঘটে, যা আট শতকের পূর্বে প্রাণবন্ত বাণিজ্য-নির্ভর নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির তুলনায় চরিত্রে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু সাত শতকেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগের জন্যে সমতট-হরিকেল অঞ্চল (বাংলাদেশের নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এলাকা) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং সমতটের এই গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করে দেন। এই অঞ্চলেই, সম্ভবত বর্তমান চট্টগ্রামের সন্নিকটে গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আরও একটি বিখ্যাত বন্দর, আরবি ও ফারসি বিবরণীতে যার পরিচয় সমন্দর এবং সুদকাওয়ান হিসেবে। সোলায়মান, ইবন খুর্দাদবে, আল মাসুদী, আল ইদ্রিসি, আল মারদাজি, ইবন বতুতা প্রমুখ আরব লেখক, অজ্ঞাতনামা লেখকের ফারসি গ্রন্থ হুদুদ আল আলম, চীনা বিবরণে (চৌ-জু-কুয়া এবং চেং হোর সমুদ্র অভিযানের ইতিবৃত্তকারগণ) এই বন্দরের প্রশংসা করেছেন। তাম্রলিপ্তি বন্দরের সম্ভাব্য পতন বোধহয় সমন্দরের উত্থানের দরুন অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিল। পনেরো শতক পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যাহত গুরুত্বের কারণে ষোল শতকে পর্তুগিজরা এই বন্দরটিকে শ্রেষ্ঠ বন্দর হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল।

তাম্রলিপ্তির মতোই সমন্দরও কোনও একক বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল না। অনেকগুলি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সমন্দরের সহায়ক বন্দরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনই দুই সহায়ক বন্দরের নাম প্রাচীন লিপিতে দেবপর্বত এবং বঙ্গসাগর সম্ভান্ডারিয়ক নামে উল্লেখ রয়েছে। দেবপর্বত এর অবস্থান বাংলাদেশের ময়নামতী অঞ্চলে। সাত থেকে দশ শতকের কয়েকটি লিপিতে এ অঞ্চলের নামের উল্লেখ রয়েছে। লিপিতে বলা হয়েছে, দেবপর্বত ক্ষীরোদা নদীর দ্বারা বেষ্টিত; ক্ষীরোদা নদীতে বহুজলযান সদাপ্রবহমান এবং দেবপর্বত নগরটি সর্বতোভদ্র (অর্থাৎ চারদিকে খোলা অথবা যে-কোনও দিক থেকে বন্দরটিতে পৌঁছা যায়)। বোঝাই যায় দেবপর্বত ছিল অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর। নদীবন্দর ছাড়াও দেবপর্বত খড়গ ও দেববংশীয় শাসকদের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও সুপরিচিত। এজন্য দেবপর্বত ’জয়স্কন্ধাবার’ (সামরিক ছাউনি তথা প্রশাসনিক কেন্দ্র) বলেও লেখমালায় স্থান পেয়েছিল। ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ চন্দ্ররাজা  শ্রীচন্দ্রএর একটি লিপিতে বঙ্গসাগর সম্ভান্ডারিয়ক নামক এক নদীবন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বিচিত্র স্থাননামটিতে একাধারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, এটি ছিল পণ্য সম্যকভাবে ভান্ডার বা গুদামজাত করার পক্ষে প্রশস্ত (সেইজন্য সম্ভান্ডারিয়ক), অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে (অবশ্যই নদীপথে) এটি যুক্ত ছিল। বঙ্গসাগর সম্ভান্ডারিয়ক বোধহয় ঢাকা শহরের অনতিদূরে অবস্থিত সাভার-এর সঙ্গে অভিন্ন। সাভার নামটি সম্ভবত ‘সম্ভার’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ পণ্যসামগ্রী। ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ শ্রীমদ্ডোম্মনপালের রাক্ষসখাড়ি তাম্রশাসন অনুসারে সুন্দরবন এলাকায় ও গঙ্গাসাগরের নিকটে বিরাজ করত আরও একটি অনুরূপ নদীবন্দর; তার নাম ‘দ্বারহাটক’। হাটক এবং হট্টক সম্ভবত সমার্থক, অর্থাৎ বাণিজ্যকেন্দ্র, যেটির অবস্থান ছিল দ্বার দেশে। দ্বার বলতে এখানে নদীর মোহনা (অর্থাৎ সমুদ্রে পৌঁছবার দ্বার) বোঝানো হয়েছে। বঙ্গ সমতট এবং রাঢ় অঞ্চলের এই নদীবন্দরগুলি আয়তনে ও গুরুত্বে নিঃসন্দেহে তাম্রলিপ্তি এবং সমন্দরের তুলনায় গৌণ। কিন্তু বাংলার মতো নদীমাতৃক এলাকায় সমুদ্র, উপকূল ও অভ্যন্তরের ভূভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য এই ক্ষুদ্রতর বন্দরগুলির তাৎপর্য তর্কাতীত। গঙ্গাসহ বহু নাব্যনদীপথে যে নিয়মিত জলযান চলত (বাণিজ্যিক ও সামরিক কারণে) তার বিশ্বস্ত বর্ণনা পাওয়া যায় বহু লেখনিতে। এই সব আদি মধ্যকালীন লেখনি থেকে জানা যায় ভাগীরথীতে চলাচল করত নৌবিতান (‘স খলু ভাগীরথীপথ-প্রবর্তমান-নৌবাট’)। বঙ্গের বিক্রমপুর অঞ্চল যে নাব্য এলাকা তা-ও লেখনিতে বর্ণিত (‘বঙ্গে বিক্রমপুরভাগে নাব্যে’)।

উপকূল থেকে অভ্যন্তরে মূল ভূখন্ডে যে বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি ছিল, সেগুলিকে সাধারণত হট্ট বা হট্টিকা বলা হয়েছে। হট্ট বা হট্টিকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় পাঁচ শতকের লেখতে, যদিও আট শতক ও তার পরবর্তী আমলের লেখমালায় হট্ট বা হট্টিকার উল্লেখ অনেক বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন হট্ট বলতে বিপণন কেন্দ্র বোঝায়; গ্রামীণ হাট শব্দটি হট্ট-এর সমার্থক। অনুমান করা অসঙ্গত নয়, এখনকার হাটের মতো প্রাচীন হট্ট/হট্টিকাতেও বাজার বসত সপ্তাহে এক বা দুদিন। বিপণন কেন্দ্রের উচ্চাবচক্রম যদি নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে গ্রাম পর্যায়ের বিক্রয় কেন্দ্র হিসেবে হট্ট সম্ভবত ক্ষুদ্র ও প্রাথমিক পর্যায়ের বাণিজ্যকেন্দ্র। হট্ট কথাটি অবশ্য সংস্কৃতে যে-কোনও বাজার/বিক্রয়কেন্দ্র অর্থেও ব্যবহূত। নালন্দার নিকটে অবস্থিত দেবপালদেবহট্ট বোধহয় সাধারণ হাটের তুলনায় আয়তনে ও গুরুত্বে বড় ছিল; কারণ পাল সম্রাটের নামানুসারে নামাঙ্কিত বাজার এলাকা বোধহয় অন্যান্য সাধারণ বিপণন কেন্দ্রের চেয়ে আলাদা ছিল। এই জাতীয় বাজারই বোধহয় ‘হট্টবর’, অর্থাৎ হট্টদের মধ্যে সেরা, বলে অভিহিত হয়েছে লেখমালায়। ধর্মপালের খালিমপুর পট্টোলীতে ‘আপণ’ বা দোকানের উল্লেখ দেখা যায়। সেন আমলের শেষ পর্যায়ে লেখমালায় উল্লিখিত হতে থাকে ‘চতুরক’, যার সন্ধান বারো শতকের আগে পাওয়া যায় না। চারটি রাস্তার সংযোগ স্থলে অবস্থিত এলাকাকে বোঝাতে বোধহয় ‘চতুরক’ কথাটি ব্যবহূত হতো। এদিক দিয়ে দেখলে স্থানীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ‘চতুরক’কে চিহ্নিত করা চলে। এমনই একটি চতুরক ‘বেতড্ডচতুরক’ নামে পরিচিত ছিল, তার পূর্বে ‘জাহ্নবীসীমা’। গঙ্গাতীরস্থ এই অঞ্চল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার অন্তর্গত বেতোড়-এর সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। চতুরকগুলি বোধহয় গ্রামীণ হাটের চেয়ে বড় ছিল। অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, ‘হট্টবর’ ও ‘চতুরক’ জাতীয় বৃহত্তর বিপণন কেন্দ্র একাধারে বড় বন্দর ও নগর এবং অন্যদিকে ক্ষুদ্রতর গ্রামীণ হাটগুলির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। প্রায় একই সময়ে উত্তর ভারতে, দাক্ষিণাত্যে এবং সুদূর দক্ষিণভারতে গ্রাম ও বড় নগরের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ রক্ষার কাজে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে মাঝারি পর্যায়ের বাণিজ্য কেন্দ্র, যা মন্ডপিক (আধুনিক মন্ডি), পেণ্ঠ (আধুনিক পেঠ) ও নগরম্ বলে পরিচিত ছিল।

এই সব ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে বিশেষ সক্রিয় ছিল বণিক সম্প্রদায়। বাণিজ্যকেন্দ্রের মতোই বণিকদের মধ্যেও প্রকারভেদ ও তারতম্য ছিল। সাধারণ ছোট-খাটো ব্যবসায়ী ‘বণিক’ বা ‘বৈদেহক’ বলে অভিহিত। চন্দ্রকেতুগড়সহ গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা থেকে লেখসম্বলিত পোড়ামাটির যে নামমুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে, তাতে প্রায়ই শস্যের বাণিজ্যে যুক্ত বিশেষ বণিককে দেখা যায়। জাতক কাহিনীতে নিয়মিতভাবে উপস্থিত ‘সার্থবাহ’, যিনি কাফেলা নিয়ে তাম্রলিপ্তি থেকে পুষ্কলবতী পর্যন্ত (‘পুববন্ত’ থেকে ‘অপরান্ত’) স্থলপথে পাড়ি দিতেন। ৪৪৪ থেকে ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর বাংলার দামোদরপুর অঞ্চলে যে পাঁচটি তাম্রশাসন উৎকীর্ণ হয়েছিল, তাতে সার্থবাহ ছাড়াও শ্রেষ্ঠী বা অত্যন্ত বিত্তবান বণিকের অস্তিত্ব জানা যায়। এই সার্থবাহ ও শ্রেষ্ঠীরা কোটিবর্ষ নগরে (বর্তমান বাণগড়, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। বিপুল ঐশ্বর্যের কারণে প্রাচীন সাহিত্যে শ্রেষ্ঠীরা যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। এই বিত্তের একাংশ তাঁরা সম্ভবত অন্যান্য ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতেন, অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী ছাড়াও শ্রেষ্ঠীকে অর্থ লগ্নী করার ভূমিকাতেও দেখা যায়। দামোদরপুরের পাঁচটি তাম্রশাসন থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায়, গুপ্তযুগে উত্তরবঙ্গে জেলা পর্যায়ের প্রশাসনে (‘বিষয়াধিষ্ঠানাধিকরণ’) নগরশ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহ দুজনেই সক্রিয় সদস্য ছিলেন, যদিও তাঁরা কোনও মতেই বেতনভুক প্রশাসক নন। নিজ নিজ পেশাদারী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা সম্ভবত জেলা-বোর্ডের সদস্য হতেন। গুপ্তকালীন উত্তরবঙ্গের আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যবসায়ীদের উচ্চমর্যাদা ও সম্ভ্রম সম্বন্ধে দ্বিমত নেই। পরবর্তী আমলের লেখমালায় বণিকদের ব্যক্তিগত উল্লেখ ক্রমেই বিরল হয়ে আসে। সমতট এলাকায় দশম শতকের শেষ পাদে মহীপালএর রাজত্বকালে একটি গণেশ মূর্তি নির্মাণ করিয়েছিলেন ‘বৃদ্ধসার্থ’ জম্ভলমিত্র। বৃদ্ধসার্থ বলতে বয়স্ক বা প্রবীণ সার্থবাহকে বোঝাতে পারে; আবার সমকালীন দক্ষিণভারতে ’বড্ডুব্যবহারী‘-র কথা খেয়াল রাখলে ‘বৃদ্ধসার্থ’কে সার্থবাহদের নেতা/প্রধান হিসেবেও বিবেচনা করা চলে। লেখমালা ও সাহিত্যগত উপাদানে বণিক, শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহ সম্বন্ধে নিয়মিত উল্লেখ খ্রি. ৬০০ থেকে ১৩০০ পর্যন্ত কালসীমায় অপেক্ষাকৃত কম নজরে আসে। কিছু কিছু পন্ডিত এর থেকে অনুমান করেন যে, আদি মধ্যকালীন বাংলায় বাণিজ্য ও বণিকদের অবক্ষয় ঘটছিল, যার দরুন গ্রামকেন্দ্রিক, কৃষিপ্রধান, আবদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আদি মধ্যকালীন বাংলায় বিরাজ করতে থাকে। এই মত অবশ্য বিতর্কিত এবং বাণিজ্যের অধোগতির তত্ত্বে বহু ঐতিহাসিকই সন্দিহান।

যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা  বণিক যখন পণ্যসম্ভার নিয়ে ব্যবসা করতে যান, তখন তিনি নির্দিষ্ট পথ ধরেই যে যাতায়াত করবেন এটাই স্বাভাবিক। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা স্থলপথ, নদীপথ ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের পক্ষে অঞ্চলটিকে অনুকূল করে তুলেছিল। মধ্যগঙ্গা উপত্যকার সঙ্গে রাজমহলের অলিন্দপ্রতিম এলাকার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ বা পুন্ড্রবর্ধনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় অর্থনৈতিক জীবনের দুই বিশিষ্ট লক্ষণ নগরায়ণ ও উত্তরভারতের কৃষ্ণ চিক্কন মৃৎপাত্র; যা বাংলার ভূখন্ডে সর্বপ্রথম দেখা যায় খ্রি.পূ চতুর্থ-তৃতীয় শতকে পুন্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গে।

সম্প্রতি আবিষ্কৃত খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী লেখগুলি বাংলার সঙ্গে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম সীমান্ত এলাকার যোগাযোগের স্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করে। খরোষ্ঠীর ব্যবহার যেহেতু প্রাথমিকভাবে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে, সেহেতু বাংলায় এই লিপির আবির্ভাব নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে যে, উত্তর-পশ্চিমের খরোষ্ঠী ব্যবহারকারীরা গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় এসেছিলেন খ্রিস্টীয় প্রথম তিন বা চার শতক ধরে। এই দুই প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার বিশেষত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে। এর প্রমাণ রয়েছে বারাণসীর নিকটে চুনারে এবং পাটনার নিকটস্থ কুমরাহারের উৎখননে খরোষ্ঠী লেখ আবিষ্কারের মধ্যে। সদ্য আবিষ্কৃত রবাতক লেখ থেকে জানা যায় যে, কণিষ্কের সাম্রাজ্য পূর্ব দিকে শ্রীচম্পা (বর্তমান ভাগলপুর, পূর্ব বিহার) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর ফলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার সঙ্গে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও বদ্বীপ এলাকার ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাংলায় খরোষ্ঠীর আবির্ভাবের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। উত্তরপশ্চিম সীমান্ত এলাকার সঙ্গে প্রাচীন বাংলার নিয়মিত যোগাযোগের অপর নজির হলো উত্তর-পশ্চিম থেকে বাংলায় ঘোড়ার আমদানি, যা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।

গাঙ্গেয় উপত্যকার সঙ্গে গাঙ্গেয় বদ্বীপের সংযোগ পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল। পঞ্চম শতকে এই যোগাযোগের সূত্র ধরেই ফা-হিয়েন মগধ থেকে তাম্রলিপ্তি এসেছিলেন। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত এই ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী। নালন্দা থেকে যাত্রা শুরু করে হিউয়েন-সাং প্রথমে আসেন রাজমহলের নিকটস্থ কজঙ্গলে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে প্রথমে তিনি পুন্ড্রবর্ধন এবং তারপর আরও পূর্বে কামরূপে যান। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাস্থিত কামরূপ থেকে তাঁর পরবর্তী গন্তব্য ছিল দক্ষিণপূর্ব দিকে সমতটে। সমতট থেকে বেরিয়ে তিনি পশ্চিমদিকে আসেন তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত। তাম্রলিপ্তি থেকে উত্তরদিকে যাত্রা করে তিনি পৌঁছেন শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ও সন্নিহিত এলাকায়। মুর্শিদাবাদে অবস্থিত কর্ণসুবর্ণ থেকে বেরিয়ে তিনি ওড্র বা উড়িষ্যায় যান। এই ভ্রমণ তিনি করেছিলেন নিঃসন্দেহে প্রাচীন দন্ডভুক্তি (আধুনিক দাঁতন, মেদিনীপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) হয়ে। অতএব বাংলার চারটি প্রধান এলাকা (পুন্ড্রবর্ধন, রাঢ়, বঙ্গ ও সমতট) যেমন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তেমনি প্রাচীন বাংলার প্রতিবেশী এলাকা মগধ, কামরূপ ও উড়িষ্যার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা যেত। আট শতকে উৎকীর্ণ দুধপানি লেখ অনুসারে তিন বণিক ভ্রাতা উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্তে ব্যবসা করতে এসেছিলেন। দেবপালএর রাজত্বকালে (৮১০-৪৫ খ্রি.) বীরধরদেব যে সুদূর নগরহার (জালালাবাদ) থেকে বোধগয়া পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ঘোষরাওয়া লেখতে। দক্ষিণভারতের করমন্ডল উপকূল থেকে যে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় পৌঁছান যেত, তার পরিচয় রয়েছে চোলসম্রাট রাজেন্দ্রচোলের গাঙ্গেয় এলাকায় অভিযানের বিবরণে। ১০২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে চোলবাহিনী করমন্ডল থেকে বেরিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে প্রবেশ করে এবং তন্ডবৃত্তি (দন্ডভুক্তি), তক্কণলাঢ়ম (দক্ষিণ রাঢ়), উত্তীরলাঢ়ম্ (রাঢ়ের উত্তরাংশ) হয়ে বঙ্গালদেশ পর্যন্ত যায়। বাংলার উপকূলবর্তী এলাকা যে স্থলপথে উড়িষ্যা, অন্ধ্র ও তামিল এলাকার সঙ্গে যুক্ত ছিল, এটি তার পরোক্ষ প্রমাণ। পাল-সেন আমলের তাম্রশাসনে নিয়মিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে ‘গমাগমিক’ (গমনাগমনের উপর তত্ত্বাবধান যে আধিকারিক করেন) এবং ‘শৌল্কিক‘ (শুল্ক আদায়কারী রাজপুরুষ)। এঁদের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা বাংলার বাণিজ্যের পটভূমিকাতেই বিচার্য।

স্থলবন্দি গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে সমুদ্রযাত্রা করতে গেলে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা ও বাংলার তটীয় অঞ্চলই ছিল গমনাগমনের প্রধান সূত্র। বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চল যে বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল, তাতেও সন্দেহ নেই। ছয় থেকে তেরো শতকের লেখমালায় বারবার বলা হয়েছে নৌখাত, নৌযোগ, নৌযোগখাত, নৌ-দন্ডক, নৌবন্ধক, নৌস্থিরবেগ, নৌপৃথ্বীর কথা। গঙ্গাসহ অন্যান্য নদী যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের এক প্রধান উপায়, তার পরিচয় এই বর্ণনায় বিধৃত। বাংলার উপকূলের সঙ্গে সমগ্র পূর্ব উপকূলের ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত যোগাযোগের সংশয়াতীত প্রমাণ দেয় অাঁজিকাটা ‘রুলেটেড’ মৃৎপাত্র (সম্ভাব্য কাল খ্রি.পূ ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় তিন শতক)। এই বিশেষ ধরনের পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে নিম্নলিখিত প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে: অলগনকুলম্, কাবেরীপট্টিনম্, আরিকামেডু, বাসবসমুদ্রম্, কাঞ্জীপুরম্ (তামিলনাড়ু), অমরাবতী, শালিহুন্ডম, কলিঙ্গপটনম (অন্ধ্রপ্রদেশ), শিশুপালগড় ও মাণিকপটনম্ (উড়িষ্যা), তাম্রলিপ্তি ও চন্দ্রকেতুগড় (পশ্চিমবঙ্গ) এবং মহাস্থান ও উয়ারী-বটেশ্বর (বাংলাদেশ)।

৪১৪ খ্রিস্টাব্দে ফা-হিয়েন চীনে প্রত্যাবর্তনের জন্য তাম্রলিপ্তি বন্দর থেকে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন। একটি বাণিজ্যতরীতে চড়ে তিনি তাম্রলিপ্তি থেকে প্রথমে যান শ্রীলঙ্কায়, সেখান থেকে অপর একটি জলযানে পাড়ি দিয়ে পৌঁছান যবদ্বীপে, শেষপর্যন্ত যবদ্বীপ থেকে তৃতীয় দফায় সমুদ্রযাত্রা সমাপ্ত করেন চীনের পূর্ব উপকূলে পৌঁছে। বাংলার উপকূল থেকে সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে যে চীনে যাতায়াত করা যেত, ফা-হিয়েনের বিবরণ তার স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়। সাত শতকে হিউয়েন-সাং উল্লেখ করেন যে, সমতট থেকে সমুদ্রপথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পেগু, শ্রীক্ষেত্র, দ্বারাবতী ও যমনদ্বীপে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা যেত। এই যোগাযোগের সূত্র ধরেই চীনা পরিব্রাজক -ৎসিঙ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে সমুদ্রপথে হরিকেলে পৌঁছেছিলেন। এই রকম জলপথেই নিঃসন্দেহে সক্রিয় ছিলেন রক্তমৃত্তিকার (মুর্শিদাবাদ জেলায়) বাসিন্দা মহানাবিক বুদ্ধ গুপ্ত। এই মহানাবিকের মালয় উপদ্বীপে উপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ছয় শতকের একটি লেখতে। পালরাজা দেবপালের কাছে যবদ্বীপের শাসক বালপুত্রদেব নালন্দা মহাবিহারে ভূমিদানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন নয় শতকে। এই জাতীয় সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের সঙ্গে বিজড়িত থাকে  দুই এলাকার বাণিজ্যিক সর্ম্পকও। নয় থেকে তেরো শতকের মধ্যে আরব বিবরণীতে বলা হয়েছে কিভাবে সমন্দর বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যুক্ত ছিল সিলানদিব (শ্রীলঙ্কা), কান্জা (কাঞ্জীপুরম্) এবং উরানশিন-এর (উড়িষ্যা) সাথে। বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলার সঙ্গে সমুদ্রপথে মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। ইবন বতুতা এই পথেই বাংলায় এসেছিলেন চৌদ্দ শতকে। ফেরার পথে তিনি সোনারগাঁও (ঢাকার নিকটস্থ) থেকে একটি চীনা জাঙ্ক (জলযান)-এ ওঠেন এবং যবদ্বীপ হয়ে শেষপর্যন্ত চীনে পৌঁছেন। মা হুয়ানের বিখ্যাত বিবরণ থেকে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, চীনা মহানাবিক চেং-হোর জাহাজ ১৪০৪ থেকে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত চারবার সাত্তিগাঁও বা চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। চীন থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হয়ে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে বাংলার বন্দরে পৌঁছবার জন্য জলপথে মালাক্কা প্রণালীর বাণিজ্যিক গুরুত্ব চৌদ্দ শতক থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকে। আদি মধ্যকালে বাংলার বাণিজ্য তথা দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যে ভাটা পড়ছিল, সাম্প্রতিক তথ্যের আলোকে এমন অভিমত মেনে নেওয়া কষ্টকর। বরং ভারত মহাসাগরীয় তথা বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে বাংলার গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল এবং এই সম্পর্কজালে প্রাচীন ও আদি মধ্যকালীন বাংলা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে যায়।

আদান-প্রদানের মাধ্যম  খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে ধাতব মুদ্রা প্রচলনের আগে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্ভবত পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। খ্রি.পূ ছয় শতকে উত্তর ভারতে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলিত হয়। প্রাচীন বাংলার মহাস্থান, বাণগড়, চন্দ্রকেতুগড়, মঙ্গলকোট, তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি নগরকেন্দ্র উৎখননের ফলে খ্রি.পূ তিন শতক পর্যায় থেকে এই ছাপাঙ্কিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উয়ারী-বটেশ্বর-এ উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত ছাপাঙ্কিত মুদ্রা প্রমাণ দেয় যে, গাঙ্গেয় অববাহিকার পূর্বাঞ্চলেও বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল এবং ছাপাঙ্কিত মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল। কর্ষপণ মানের এই সকল রৌপ্যমুদ্রার ওজন হতো ৩২ রতি বা ৫৭.৬ গ্রেন। বাংলায় খ্রি.পূ তিন শতকে মুদ্রার প্রচলন এই সম্ভাবনাকেই উজ্বলতর করে তোলে যে, এতদঞ্চলে বাণিজ্য দ্রুত প্রসার লাভ করছিল। পুন্ড্রনগর রাজকোষ গন্ড্য ও কাকিনিতে পূর্ণ- তাম্রশাসনের এরকম সাক্ষ্য থেকে কোন কোন পন্ডিত মনে করেন যে, এতদ্ঞ্চলে গন্ডক ও কাকিনি জাতীয় মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এই একই তথ্যের ভিন্নরূপ ব্যাখা গন্ডা (চার) হিসেবে গণনাকৃত কড়ির প্রচলনও ইঙ্গিত করে। পরবর্তী ব্যাখ্যায় প্রতীয়মান হয় যে, খ্রি.পূ তিন শতক থেকেই ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার সাথে সাথে তাম্র ও স্বর্ণের ছাপাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন বাংলায় আনুমানিক খ্রি.পূ দুই শতক থেকে হয়েছিল। শুধু পূর্ণমানের মুদ্রাই নয়, অর্ধেক ও সিকি মানের মুদ্রাও ছিল। অখোদাইকৃত এই সকল ছাপাঙ্কিত মুদ্রা রূপার কর্ষপণ মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রচলিত ছিল। ছাঁচে ঢালা মুদ্রা বাংলায় প্রচলিত হয় কুষাণ যুগে। রাঢ় ও বঙ্গের নিম্নাঞ্চলে একটি নতুন সিরিজের তাম্র মুদ্রা খ্রিস্টীয় দুই শতকে আত্মপ্রকাশ করে। এগুলি কুষাণ রীতি ও কর্ষপণ মান অনুসরণ করে অঙ্কিত ছিল। কুষাণ-রাঢ় এবং কুষাণ-বঙ্গ মুদ্রা হিসেবে আখ্যায়িত এই তামার মুদ্রাগুলি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কলিঙ্গের তথাকথিত পুরী-কুষাণ মুদ্রার সাথে কিঞ্চিৎ সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। অতএব অনুমিত হয় বঙ্গ-কলিঙ্গের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল।

খ্রিস্টীয় পাঁচ শতক এবং ছয় শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল গুপ্ত শাসনাধীনে আসার ফলে এ সকল অঞ্চলে উন্নত মানের গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের পথ পরিষ্কার হয়েছিল। উত্তর বঙ্গে প্রাপ্ত প্রচুর গুপ্ত তাম্রশাসনে ‘দিনার’ ও ‘রূপক’ নামক গুপ্ত মুদ্রার অস্তিত্বের ইঙ্গিত রয়েছে। দিনার ও রূপক থেকে জানা যায় যে, ১টি দিনারের সাথে ১৫/১৬টি রূপক বিনিময় করা যেত। গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ওজন ছিল ১২৪ গ্রেন, স্কন্ধগুপ্ত ‘সুবর্ণ’ নামক ১৪৪ গ্রেনের অপেক্ষাকৃত ভারী স্বর্ণমুদ্রা জারি করেছিলেন, কিন্তু নরসিংহ গুপ্ত বলাদিত্যের শাসনের পরে এই ভারী মুদ্রা ক্রমশ খাঁটিত্ব হারায়। এই সুবর্ণ মানের স্বর্ণমুদ্রা ৬০০ খ্রিস্টাব্দে শশাংকের আবির্ভাবের আগে বঙ্গের রাজাগণ এবং শশাংক (৬০০-৬৩৭ খ্রি?) নিজেও জারি করেছিলেন। সাত ও আট শতকে সমতটের রাজাদের দ্বারা সুবর্ণ মানের স্বর্ণমুদ্রা জারি অব্যাহত থাকে। তবে এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি নিম্নমানের অর্থাৎ খাদযুক্ত ছিল। এরপর কমপক্ষে চার-পাঁচ শতকের জন্য বাংলার অর্থজগৎ থেকে এ সকল মুদ্রা অন্তর্হিত হয়ে পড়ে।

আনুমানিক ৭৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় সম্ভবত একটা মিশ্র অর্থনীতি চালু ছিল। লক্ষণীয় যে, যেখানে পাল ও সেন রাজারা কোন মুদ্রার প্রচলন করেন নি, সেখানে সমতট হরিকেল অঞ্চলে সাত থেকে তেরো পর্যন্ত ছয় শতক ধরে অব্যাহতভাবে উঁচুমানের রৌপ্যমুদ্রা প্রচলিত ছিল (অবশ্য এই সকল মুদ্রা জারির রাজশক্তি অজ্ঞাত)। এই সকল রৌপ্যমুদ্রার ওজন ও ধাতুর নিরবচ্ছিন্ন বিশুদ্ধতা ইঙ্গিত দেয় যে, এর পেছনে একটা সক্রিয় রাজশক্তি কার্যকর ছিল। ৫৭.৬ গ্রেন ওজনের সুপরিচিত ‘পুরাণ’ বা ‘দ্রম্ম’ মানের সাথে এ সকল রৌপ্যমুদ্রা সামঞ্জস্য বজায় রেখেছিল। পাল ও সেন তাম্রশাসনে মুদ্রা সম্পর্কিত পুরাণ ও দ্রম্ম-এর উল্লেখ দেখা যায়।

আরও লক্ষ্য করা গেছে যে, দশ শতকের পর হরিকেল রৌপ্যমুদ্রা হাল্কা ও পাতলা এবং এর শুধু এক পাশে ছাপাঙ্কিত থাকত। হরিকেল মুদ্রার এই পরিবর্তনকে নতুন আরবি মুদ্রার আংশিক অনুকরণ মনে করা হয়। এ থেকে বাংলার উপকূল এবং আরবের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগেরই ইঙ্গিত মেলে। পাহাড়পুর ও ময়নামতী প্রত্নস্থলে যথাক্রমে হারুন-অর-রশীদ (৮ম শতক) ও মুসতাসিম বিল্লাহর (১২শ শতক) সময়কার মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় আরব বিশ্বের সাথে বাংলার উপকূলের যোগাযোগ সম্পর্কে ধারণা আরও স্পষ্ট হয়।

আদিযুগের বাংলায় ব্যবসার এ সমৃদ্ধি এবং বাংলার সাথে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রমাণ করে যে, বাংলার বাণিজ্য কখনই স্থিমিত হয়ে পড়ে নি, কিংবা এখানে আর্থিক অনটন দেখা দেয় নি। উপমহাদেশের সামন্তবাদী সমাজে কিন্তু চিত্রটাকে এভাবেই প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। এই আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ভূমিদান এবং মুদ্রাঙ্কন ব্যবস্থার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং নির্দিষ্ট যে-কোন অঞ্চলে এই দুই ব্যবস্থারই সহাবস্থান ছিল। পুরাণ বা দ্রম্ম জাতীয় একটি রৌপ্য মুদ্রার সাথে ১২৮০টি কড়ির বিনিময় ছিল একেবারেই ঝঞ্জাটবিহীন। এই বিনিময় করা যেত মধ্যযুগীয় গাণিতিক পাতন অনুসারে।

সেন আমল থেকে চূর্ণী শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। চূর্ণী শব্দটির ব্যবহার হতো ‘কপর্দক’ বা ‘কড়ি’ শব্দের সাথে যুক্ত করে। অর্থাৎ চূর্ণী বা কপর্দক-চূর্ণীর প্রয়োগ ছিল আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে। চূর্ণী খাঁটি স্বর্ণ বা রৌপ্যের চূর্ণ (dust) হিসেবে সঠিকভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। অন্য কথায় চূর্ণ মুদ্রার প্রচলন ছিল।  চূর্ণ মুদ্রাকে পুরাণ (রৌপ্য) এবং সুবর্ণ (স্বর্ণ) মুদ্রার সম ওজনের হতে হতো। রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রা যখন অপেক্ষাকৃত দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ত অথবা ওজন কিংবা ধাতুর খাঁটিত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিত, তখন ব্যবসায়ীরা চূর্ণ মুদ্রা গ্রহণে অধিকতর আগ্রহী হতো। দিনার/সুবর্ণ কিংবা দ্রম্ম/কর্ষপণ মানের স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রার সাথে স্বর্ণ বা রৌপ্যের চূর্ণ যৌক্তিকভাবে বিনিময় করা যেত। পুরাণ বা সুবর্ণ মুদ্রার সমান ওজনের চূর্ণ মুদ্রাও কপর্দক বা কড়ির সাথে বিনিময় করা যেত। আদি মধ্যযুগে ক্রমশই এক জটিল মুদ্রাব্যবস্থা বিকাশলাভ করছিল। এ সময়ে তিনস্তর বিশিষ্ট একটা মুদ্রাব্যবস্থা লক্ষ্য করা গেছে একেবারে নিম্নে ছিল কড়ি বা কপর্দক, সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল সাধারণত মূল্যবান ধাতুতে তৈরি অঙ্কিত মুদ্রা এবং এদের উভয়ের মাঝে স্থান করে নিয়েছিল নতুন ধরনের চূর্ণ মুদ্রা।  [রণবীর চক্রবর্তী]

মধ্যযুগ মধ্যযুগের বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে (পণ্য রপ্তানি করে) প্রচুর অর্থ উপার্জিত হতো। প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনদেশের বণিকেরা এই অঞ্চলে মসৃণ কাপড়, সিল্ক, চীনামাটির বাসন ইত্যাদির সাথে সোনা, রূপা আমদানি করত। এক দশক পরে অন্য একজন চীনা পর্যটক লক্ষ্য করেছেন যে, বহু দূর দেশের বণিকেরা বাংলায় রূপার টাকায় তাদের বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধ করত।

বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের এই ধারা পরবর্তী শতকেও অব্যাহত ছিল। ভেনিসীয় পর্যটক ফ্রেডারিখ সিজার ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন যে, বণিকেরা পেগু (বার্মা) থেকে বাংলায় অন্য কোন পণ্য নয়, শুধু সোনা ও রূপা নিয়ে আসত। বস্ত্তত, বাংলায় মুদ্রা অর্থনীতির উন্মেষ এবং সমগ্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্যের (বাজারের) সাথে সম্পৃক্ততা এই বদ্বীপের রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের খাতকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে। দশ শতকে মুসলিম বণিকদের এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সূচনাপর্বে স্থানীয় পণ্যের মধ্যে বস্ত্রশিল্প ছিল প্রধান। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পর বস্ত্র উৎপাদনের পরিমাণ, ধরন এবং একই সঙ্গে রপ্তানি বহুলভাবে বৃদ্ধি পায়। তেরো শতকের শেষদিকে মার্কোপোলো বাংলার বস্ত্রের (সুতার) বাণিজ্যিক গুরুত্বের কথা বলেছেন এবং ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইবন বতুতা বাংলার উন্নতমানের মসলিনের প্রশংসা করেছেন।

মধ্যযুগে বাংলার মূল রপ্তানি পণ্য ছিল বস্ত্র ও চাল। ষোল শতকের শেষদিকে এখানকার দুটি প্রধান বন্দর পূর্বদিকে চট্টগ্রাম এবং পশ্চিম দিকে সাতগাঁও থেকে সমগ্র ভারত মহাসাগরের পথে পশ্চিমে গোয়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মালাক্কা অঞ্চল পর্যন্ত চাল রপ্তানি হতো। ষোল শতকের আশির দশকে রালফ ফিচ বাংলাকে বিশাল বস্ত্রভান্ডার বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে কাপড় ও চাল সমগ্র ভারতবর্ষ, শ্রীলঙ্কা, পেগু (বার্মা), মালাক্কা, সুমাত্রা এবং অন্যান্য স্থানে রপ্তানি হতো। এ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন পিরার্ড ডি লাভাল। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রাম সফর করে তিনি লিখেছেন যে, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরও চট্টগ্রামে প্রচুর পরিমাণে চাল গোয়া, মালাবারসহ সমগ্র ভারতবর্ষ, সুমাত্রা, মালাক্কা, সুন্দা দ্বীপসমূহে রপ্তানির অপেক্ষায় জমা (স্তূপীকৃত) আছে। মুগল শাসনামলেও এই উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানি অব্যাহত থাকে এবং রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যানরিক লিখেছেন যে, প্রতিবছর শত শত বড় নৌকাভর্তি চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বাংলার বন্দর থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু সতেরো শতকের সত্তর দশকের দিকে বাংলা থেকে প্রাচ্যে চাল রপ্তানি কমে আসে।

মুগল আমলে এই বদ্বীপে অর্থকরী দ্রব্যাদি, বিশেষত কাপড় ও সিল্ক উৎপাদন বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। কাপড় উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রগুলি হলো ঢাকা ও সন্নিহিত অঞ্চল এবং পশ্চিম বাংলার উত্তরে মালদা থেকে কাসিমবাজার-হুগলি হয়ে দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রালফ ফিচ মন্তব্য করেন যে, সোনারগাঁয়ে তুলা থেকে যে মসৃণ ও উন্নত মানের কাপড় উৎপাদিত হতো, তা ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মুগল শাসনামলে রাজদরবারের বিলাসবহুল দ্রব্য-সামগ্রী সরবরাহের জন্য বাংলা আকর্ষণীয় স্থান ছিল। এই আকর্ষণ ছিল বিশেষত কাঁচা সিল্কের জন্য। সিল্ক উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল কাসিমবাজার ও সন্নিহিত অঞ্চল।

বাংলার কৃষি ও কৃষি উৎপাদনের ব্যাপক সমৃদ্ধি যুগপৎভাবে বাংলার মুগল শাসনকে সুসংহত করে এবং সমুদ্র ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে বাংলার সম্পৃক্তি ঘটায়। সুলতানি যুগের পতনের প্রথম পর্বে পর্তুগিজ বণিকেরা বঙ্গোপসাগরে চলে আসে এবং ষোল শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। ষোল শতকের শেষ দুই দশকে বদ্বীপের গভীর অভ্যন্তরে মুগলদের আগমন অবধি পর্তুগিজরা হুগলিতে বন্দর গড়ে তোলে, চট্টগ্রামে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটায় এবং ঢাকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় বাণিজ্য-বসতি স্থাপন করে। অবশ্য পর্তুগিজরা কখনও বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যে এশীয় বণিকদের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেনি বলে সাধারণত মনে করা হয়। ষোল শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় এবং তা স্থানীয় পণ্যের উৎপাদন ধারার গতিকে বেগবান করে তোলে।

ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাতগাঁও ছিল বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এই সময়ের কবি মুকুন্দরাম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, এই বন্দর বিদেশী বণিকদের এতই আকর্ষণ করত যে, স্থানীয় বণিকেরা বাড়িতে বসেই যথেষ্ট উপার্জন করতে পারতেন। স্থানীয় বণিকদের এই আয় ছিল বিদেশী বণিকদের আয়ের সমান। বাংলার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সাতগাঁও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের এবং বিদেশী বণিক সমাজকে আকর্ষণ করত। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি ছিল পর্তুগিজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এটি পরিচিতি লাভ করেছিল ‘পর্তুপিকোয়েনো’ হিসেবে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিখ সিজার সাতগাঁওকে একটি ব্যস্ততম শহর হিসেবে দেখেছেন। এখান থেকে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫টি ছোট-বড় জাহাজে বিভিন্ন পণ্য বোঝাই করে বিভিন্ন দিকে যাত্রা করত।

কিন্তু ঐতিহাসিক সাতগাঁও বন্দরের পতন হতে শুরু করে সরস্বতী নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে যা এখানে নৌ চলাচলকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। এরপর শুধু পর্তুগিজ বণিকেরাই নয়, স্থানীয় বণিকেরাও সাতগাঁও ছেড়ে হুগলিতে বাণিজ্য বসতি গড়ে তোলে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাতগাঁওয়ের পরিবর্তে হুগলি বাংলার প্রধান বন্দর হিসেবে পরিগণিত ছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য হুগলি বন্দর দিয়ে পরিচালিত হলেও ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাতগাঁও রাজকীয় বন্দরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। এখানে গভর্নরের অফিস ছিল এবং কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত কাস্টমস অফিস ছিল। ঐ বছরই আনুষ্ঠানিকভাবে হুগলি রাজকীয় বন্দর হিসেবে ঘোষিত হয়।

পর্তুগিজদের অধীনে হুগলি বন্দর খুবই দ্রুত বিকাশ লাভ করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি বাংলার সকল বাণিজ্য কেন্দ্র ও বন্দরের মধ্যে সবচেয়ে অর্থশালী, সবচেয়ে বিকাশমান এবং সবচেয়ে জন-অধ্যুষিত হয়ে ওঠে। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন ক্যাবরাল লিখেছেন যে, হুগলি সারা পৃথিবীর সাধারণ বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এখানে ভারত বিশেষত পর্তুগিজ ভারত, চীন, মালাক্কা ও ম্যানিলার অনেক জাহাজ পুনঃমেরামতের জন্য আসত। তিনি আরও লিখেছেন যে, শুধু এদেশের অধিবাসীরাই নয়, হিন্দুস্থানি মুগল, পারসিক, ও আর্মেনীয় বণিকেরাও এখানে দ্রব্য ক্রয় করতে আসত। ভ্যান লিন্সকোটেন এবং রালফ ফিচ লিখেছেন যে, ষোল শতকের আশির দশকেও হুগলি একটি বিশাল বন্দর ছিল। ১৫৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে আইন-ই-আকবরী লেখা শেষ হয়। এতে বর্ণিত হয়েছে যে, সাতগাঁওয়ের চেয়ে হুগলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল।

বাংলায় পর্তুগিজ বাণিজ্যের বিস্তৃত বিবরণ ও নির্দেশনা পাওয়া যায় মানরিকের বিবরণে। তিনি পর্তুগিজদের সবচেয়ে প্রতিপত্তির সময়ে এখানে অবস্থান করছিলেন। পর্তুগিজরা দক্ষিণ ভারত এমনকি সুমাত্রা, বোর্নিও, মালাক্কা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে সিন্ধের কারুকার্য করা বিশেষত বুটিদার জরির কাপড়, মখমল, বিভিন্ন দৃশ্যখচিত বস্ত্র, কাপড়, পাতলা চকচকে রেশমি কাপড়, মসলিন প্রভৃতি আমদানি করত। তারা মালাক্কা ও বান্দা থেকে আমদানি করত লবঙ্গ, জায়ফল, দাঁত বাধানোর ধাতু এবং বোর্নিও দ্বীপ থেকে অত্যন্ত উন্নতমানের কর্পূর। পর্তুগিজরা মালদ্বীপ থেকে বাংলায় নিয়ে আসত কড়ি যা তখন এদেশে ছিল ছোট মানের মুদ্রা; টুটিকরিন এবং তিন্নিভেলী উপকূল থেকে আসত শঙ্খ, মালাবার থেকে মরিচ এবং শ্রীলংকা থেকে আসত দারুচিনি। এই বণিকেরা চীন থেকে নিয়ে আসত প্রচুর পরিমাণে চীনামাটির বাসন, তৈজসপত্র, মূল্যবান মুক্তা, মণি বা জহরত, বিভিন্ন উপলক্ষে বা উৎসবে অন্যকে প্রদান করার জন্য দামি জিনিসপত্র  যেমন খাট, পালঙ্ক, টেবিল, বাক্স, সিন্দুক, লেখার ডেস্ক প্রভৃতি। তারা সালোর ও তিমুর রাজ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে লাল ও সাদা চন্দন আমদানি করত। বাংলায় এই চন্দন ছিল একটি অত্যন্ত মূল্যবান পণ্য।

পর্তুগিজ বণিকেরা বাংলা থেকে বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানি করত। সেগুলির মধ্যে ছিল সুতিবস্ত্র, যেমন ঘাস থেকে উৎপাদিত সুতি কাপড়, বিভিন্ন প্রকার সিল্কের কাপড়, ঘি, চাল, নীল, মরিচ, লবণ, মোম প্রভৃতি। এদেশে এসকল পণ্যের খুব একটা চাহিদা ছিল না। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে পর্তুগিজদের একটি প্রধান পণ্য ছিল চাল। পিরার্ড ডি লাভাল এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, যখন চালভর্তি জাহাজগুলির পথে বিলম্ব হতো কিংবা ডুবে যেতো তখন সুমাত্রা, মালাক্কা প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত কারণ এসব অঞ্চলে চাল ছিল প্রধান খাদ্য।

পর্তুগিজ বণিকেরা বাংলায় কি পরিমাণ বাণিজ্য করত তা তাদের দেয় বাণিজ্য শুল্কের পরিমাণ থেকে আন্দাজ করা যায়। আমদানি ও রপ্তানির উপর ২.৫ শতাংশ হারে পর্তুগিজরা মুগল রাজশক্তিকে বছরে ১,০০,০০০ টাকা শুল্ক প্রদান করত। অন্য কথায় বলা যায়, তারা বছরে বাণিজ্য পরিচালনা করত ৪০ লক্ষ টাকার। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পর্তুগিজরা বাংলায় খুবই লাভজনক বাণিজ্য পরিচালনা করত এবং বাংলার সমুদ্র ও বহির্বাণিজ্যে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। তবে এখানকার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে বিভিন্ন বিদেশী ও দেশী বণিকেরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট শাহজাহান এর সুবাহদার কাসিম খান তাদের পরাজিত করে হুগলি দখল করে নেয়। সেই সাথে বাংলায় পর্তুগিজ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।

সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে হুগলিতে কারখানা স্থাপন করে ইংরেজ ও ওলন্দাজ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে। ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরে গঠিত হয় এবং সতেরো শতকের আশির দশকে তারা এই অঞ্চলে বাণিজ্য শুরু করে। অন্যান্য ইউরোপীয়দের মধ্যে দিনেমার কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে আঠারো শতকের প্রথম দিকে এবং তাদের বাণিজ্যের পরিধি ছিল সীমিত। প্রথমদিকে ইউরোপীয় বণিকদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল মসলা বাণিজ্যের দিকে।  ইংরেজ ও ওলন্দাজরা মসলার দ্বীপ বলে পরিচিত প্রাচ্যের দ্বীপপুঞ্জসমূহ থেকে মসলা সংগ্রহের চেষ্টা করে। এই কোম্পানিগুলি তাদের ভাষায় নতুন বিশ্ব থেকে প্রাপ্ত রূপা দিয়ে মসলা ক্রয়ের প্রয়াস চালায়। কিন্তু তারা খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে, ঐ অঞ্চলে রূপার কোন চাহিদা নেই বরং সেখানে রয়েছে বাংলায় উৎপাদিত সস্তা দামের মোটা সুতিবস্ত্রের চাহিদা। তাই তারা বাংলার সুতিবস্ত্রের দিকে নজর দেয় ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে মসলা আনয়নের জন্য। মসলা দ্বীপপুঞ্জের বিশাল চাহিদা মেটানোর জন্য প্রচুর সস্তা দামের মোটা কাপড় উৎপাদনকল্পে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি করমন্ডল উপকূলকে বেছে নেয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি করমন্ডল অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত ও ব্যয়বহুল করে তোলে। এ অবস্থায় ইউরোপীয় কোম্পানিসমূহ বাংলার দিকে নজর দেয়।

কোম্পানিসমূহের বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বাংলা ছিল অধিকতর সুবিধাজনক এলাকা। বাংলা ছিল অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত মানের মোটা সুতি কাপড় উৎপাদন কেন্দ্র। দ্বিতীয়ত বাংলার সিল্ক ছিল তাদের কাছে লাভজনক পণ্য। উন্নত মান ও তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ার কারণে এই সময় ইটালীয় ও পারসিক সিল্কের পরিবর্তে ইউরোপে বাংলার সিল্কের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উপরন্তু, তৃতীয় একটি লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্য ছিল সোরা। ইউরোপে ছিল সোরার ভীষণ চাহিদা। আবার ইউরোপগামী জাহাজ সমুদ্রবক্ষে স্থির রাখার জন্য সোরার মতো ভারী জিনিস জাহাজের তলদেশে স্থাপন করা ছিল সুবিধাজনক। সুতরাং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি গভীর আগ্রহের সাথে বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে।

সতেরো শতকের সত্তরের দশকে বাংলা থেকে কাঁচা সিল্ক রপ্তানি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মূলত সতেরো শতকের আশির দশকে বাংলার কাপড় রপ্তানি আকস্মিক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কোম্পানিসমূহের এশীয় বাণিজ্যের ধরনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। বস্ত্তত, এ পরিবর্তন ঘটেছিল ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ক্রেতাদের রুচির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারণে। এই সময় হঠাৎ করেই ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ভারতীয় কাপড় বিশেষত বাংলার কাপড় অদমিত ফ্যাশনে পরিণত হয়। ফলে বাংলার কাপড়ের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলশ্রুতিতে কোম্পানিগুলির এশীয় বাণিজ্যে বাংলা হয়ে দাঁড়ায় প্রধান ক্ষেত্র। সতেরো শতকের আশির দশক থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ডাচ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফরাসি কোম্পানি এরূপ ভূমিকা পালন করে আঠারো শতকের ত্রিশের দশকে, যখন ডুপ্লে বাংলায় ফরাসি কোম্পানির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনায় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানির বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। অবশ্য ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ এর পর বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ইংরেজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ইউরোপীয় ও এদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটিয়ে দেয় এবং বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

এশীয় বাণিজ্যে বাংলার গুরুত্ব কোম্পানিসমূহের আনুপাতিক বাণিজ্যের হার লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। আঠারো শতকের শুরুতে এশিয়া থেকে হল্যান্ডে রপ্তানিকৃত মোট পণ্যসামগ্রীর চল্লিশ শতাংশ ছিল বাংলার। একই সঙ্গে এশিয়া থেকে হল্যান্ডে কাপড় রপ্তানির মোট মূল্যের ৫০ শতাংশ ছিল বাংলা থেকে রপ্তানিকৃত। এভাবে বাংলা কেবল ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র এশিয়াতে ওলন্দাজ কোম্পানির বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইংরেজ কোম্পানির কাছে বাংলা ছিল তাদের বাগানের ফুল এবং পছন্দের মণি।

১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওলন্দাজ কোম্পানি ইংরেজ কোম্পানির তুলনায় বাণিজ্যে অনেক অগ্রসর ছিল। এরপর থেকে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য বাড়তে থাকে এবং তা ওলন্দাজ কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের সমান হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য অন্যান্য এশীয় দেশসমূহে ওলন্দাজ কোম্পানির মোট বাণিজ্য তখনও ইংরেজ কোম্পানির চেয়ে বেশি ছিল। আঠারো শতকের ত্রিশের দশকের শুরুতে ইউরোপে ইংরেজ কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৭৪০-৪৫ সময়ে তা সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছায়। আঠারো শতকের চল্লিশের দশকের শেষ (১৭৪০) এবং পঞ্চাশের দশকে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যে সামান্য ভাটা পড়ে। অবশ্য ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা থেকে ইংরেজ কোম্পানির বার্ষিক গড় হারের দিকে লক্ষ্য করলে এই ভাটা চোখে পড়ার মতো নয়। এই সময়ে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মোটামুটি ৪৪,০০০ স্টার্লিং পাউন্ড অথবা ৩.৫ মিলিয়ন রুপির সামান্য বেশি। এখানে বলা প্রয়োজন যে, আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ইংরেজ কোম্পানির রপ্তানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি একই সময়ে ওলন্দাজ কোম্পানির রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই ১৭৫০-৫৫ সময়ে ইউরোপে বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয় নি।

ওলন্দাজ কোম্পানির বেলায় দেখা যায় যে, তাদের ইউরোপে রপ্তানি বাণিজ্য আঠারো শতকের বিশের দশকে অবনতির দিকে ধাবিত হয় এবং ১৭৩০ এর দিকে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। অবশ্য ওলন্দাজ কোম্পানির রপ্তানির গড় বাৎসরিক মূল্য ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সময়ের মধ্যে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে ওলন্দাজ কোম্পানির রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। সেসময়ে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য সামান্য কমে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ওলন্দাজ কোম্পানির বাণিজ্য ইংরেজ কোম্পানির চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল; পরবর্তীকালে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তা প্রায় সমান হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক না কেন, ওলন্দাজ কোম্পানির রপ্তানি তাদের দখলীকৃত এলাকাসমূহে রপ্তানিসহ ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আস্তে আস্তে পতনের দিকে ধাবিত হয়। ইউরোপে ওলন্দাজ কোম্পানির বার্ষিক রপ্তানির গড় মূল্য ছিল ২.৩ মিলিয়ন রুপি। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এশীয় বাজারে রপ্তানিসহ বার্ষিক গড় মূল্য দাঁড়ায় ৩ মিলিয়ন রুপি।

এখানে উল্লেখ্য যে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা থেকে ইউরোপীয় বণিকদের পণ্য রপ্তানির চেয়ে এশীয় বণিকদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল বেশি। কাপড় রপ্তানির হিসেবের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, যেখানে এশীয় বণিকেরা বছরে ৯-১০ মিলিয়ন রুপির মালামাল বাংলা থেকে রপ্তানি করত, সেখানে ইউরোপীয় বণিকদের বাংলা থেকে কাপড় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫-৬ মিলিয়ন রুপি। অত্যন্ত দূরদর্শীতার সাথে এশীয় বণিকেরা সিল্ক রপ্তানিতে অগ্রসর ছিল। ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশীয় বণিকেরা গড়ে ৫.৫ মিলিয়ন রুপির কাঁচা সিল্ক রপ্তানি করে এবং ১৭৫৪-১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল গড়ে ৪.১ মিলিয়ন রুপি। একই সময়ে ইউরোপীয় বণিকেরা রপ্তানি করে গড়ে প্রতি বছর ০.৯৮ বিলিয়ন রুপির কাঁচা সিল্ক। তাই বলা যায় যে, পলাশী-পূর্ব সময়ে এশীয় বণিকেরা সিল্ক বাণিজ্যে ইউরোপীয় বণিকদের চেয়ে ৪/৫ গুণ বেশি অগ্রসর ছিল।

এই অনুষঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সকল ইউরোপীয় বা এশীয় বণিকেরা পণ্য রপ্তানি করে নগদ অর্থ অথবা রূপা আনয়ন করত। একটি ঐতিহাসিক তথ্যে দেখা যায় যে, ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলার কাপড় বার্মায় রপ্তানি হতো প্রধানত বদ্বীপে রূপা আনার জন্য। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পর্তুগিজ বণিকেরা লক্ষ্য করেছেন জাহাজে করে প্রচুর সম্পদ বাংলায় আনা হতো এবং মালাক্কার বাণিজ্য মৌসুমে গোয়াতে রূপার মুদ্রার দাম ওঠানামা করত ও কোম্পানির আমদানিকৃত পণ্যের তালিকায় ছিল বনাত কাপড়, পশমি কাপড় এবং সীসা, লোহা, টিন প্রভৃতি ধাতু। অবশ্য এগুলির আমদানির পরিমাণ ছিল খুবই সীমিত। কোম্পানিসমূহ দামি ধাতু আমাদনি করে কি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত তা তাদের বাণিজ্যিক পণ্যের আনুপাতিক হার দেখলেই আন্দাজ করা যায়। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওলন্দাজ কোম্পানির আমদানির ৮৭.৫ শতাংশই মূল্যবান ধাতু। আঠারো শতকের প্রথম দুই দশকে ইংরেজ কোম্পানির আমদানির এই হার ছিল ৯০-৯৪ শতাংশ। পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। সর্বোপরি ব্রিটিশদের বাংলা বিজয় পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা বাংলায় রূপা আমদানি অব্যাহত থাকে।

বহির্বিশ্ব থেকে বাংলায় বিপুল পরিমাণ সোনা, রূপা, ধাতব মুদ্রা প্রভৃতির আমদানি পলাশীর যুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ইংরেজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বাংলার সম্পদ, কোম্পানির অর্জিত অর্থ, কোম্পানি কর্মচারীদের উপহার, নিয়ন্ত্রিত আয়ের বাইরে থেকে উপার্জিত টাকা প্রভৃতি বিনিয়োগ হয়। ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃক গৃহীত ইউরোপীয় ও দেশীয় বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটিয়ে দেওয়ার নীতির কারণে বাংলায় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানির বাণিজ্যের পতন ঘটে। ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য বা বিনিয়োগ এই সময়ে বাতিল হয়ে যায়। এখানে প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীতে একটি বিষয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো ইউরোপীয়রা বাংলায় একমাত্র সোনা-রূপার আমদানিকারক (আনয়নকারী) ছিল না এবং একই সঙ্গে তারা বৃহত্তম অংশীদারও ছিল না। এশীয় বণিকেরা ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করত এবং একই সঙ্গে তাদের চেয়ে বেশি রূপা কিংবা নগদ অর্থ তাদের পণ্যের বিনিময়ে নিয়ে আসত। তাই দেখা যায় যে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এশীয় বণিকেরা বাংলায় সোনা-রূপার প্রধান আমদানিকারক (উপার্জনকারী) ছিল, ইউরোপীয়রা নয়। [সুশীল চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  S Chaudhury, Trade and Commercial Organization in Bengal, 1650-1720, Calcutta, 1975; Om Prakash, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, 1620-1750, Princeton, 1985; S Chaudhury, From Prosperity to Decline – Bengal in the mid-Eighteenth Century, New Delhi, 1995; Om Prakash, European Commercial Enterprise in Pre-Colonial India, Cambridge, 1998; S Chaudhury & M Morineau (ed), Merchants, Companies and Trade – Europe and Asia in the Early Modern Era, Cambridge, 1999.