সমতট
সমতট দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার একটি প্রাচীন ভৌগোলিক ইউনিট। নামটি বর্ণনামূলক, জাতিবাচক নয়। সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকে (চার শতক) এর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে ডবাক, কামরূপ, নেপাল ও কর্তৃপুর-এর সঙ্গে সমতট পূর্ব সীমান্তে প্রত্যন্ত রাষ্ট্র বলে উল্লিখিত হয়েছে। বৃহৎসংহিতা-য় (ছয় শতক) বঙ্গ থেকে পৃথক একটি জনপদ হিসেবে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সাত শতকে বাংলা ভ্রমণকালে হিউয়েন সাং তাঁর বর্ণনায় বলেন, কামরূপ (পূর্ব আসাম) থেকে দক্ষিণ দিকে ১২০০-১৩০০ লি (প্রায় ৩৫০ কিমি) অতিক্রম করে তিনি সমতট (সান-মো-তট-অ) পৌঁছেন, যার প্রদক্ষিণ পথ ছিল প্রায় ৩০০০ লি (প্রায় ৮০০ কিমি)। জনপদটি ছিল সমুদ্রের পাশে অবস্থিত, নিচু এবং আর্দ্র। তিনি বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র ২০ লি (প্রায় ৫.৫ কিমি) আয়তনবিশিষ্ট সমতটের রাজধানীর চিত্র তুলে ধরেন।
পরবর্তী সময়ে ই-ৎসিঙ্ সমতটের অবস্থান সম্পর্কে অধিকতর তথ্য প্রদান করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, চৈনিক শ্রমণ শেং চি সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ অঞ্চল পরিভ্রমণ করার সময় রাজভট্ট ছিলেন সমতটের শাসক। এই রাজভট্টই খড়গ বংশের রাজারাজভট্ট নামে পরিচিত। রাজা রাজভট্টের রাজধানী (জয়স্কন্ধবার) ছিল কর্মান্তবাসক, কুমিল্লার সন্নিকটে বড়কান্তার সঙ্গে যাকে অভিন্ন বলে শনাক্ত করা হয়েছে। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে কৈলাণ থেকে উদ্ধারকৃত শ্রীধারণ রাত-এর তাম্রশাসনে রাজাকে ‘সমতটেশ্বর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার রাজধানী ছিল দেবপর্বত। এটি আট শতকে উক্ত অঞ্চলের শাসক দেব রাজবংশেরও রাজধানী ছিল। দশ শতকে চন্দ্ররাজাদের তাম্রশাসনেও সমতট ও দেবপর্বতের উল্লেখ আছে। এটা এখন সন্দেহাতীত যে, লালমাই পাহাড় ও ময়নামতীতে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে দেবপর্বতের সম্পৃক্ততা ছিল। তেরো শতকের দামোদরদেব-এর মেহার তাম্রশাসনের মাধ্যমে, মেহার (কুমিল্লার ১৪.৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে)-এর সন্নিকটে যে ভূমি দান করা হয়, তা ছিল সমতট মন্ডলের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, বেশ কিছু লিপি প্রমাণ, চৈনিক বিবরণ এবং লালমাই-ময়নামতীতে খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মেঘনা পূর্ববর্তী এলাকায় কুমিল্লা-নোয়াখালীর সমতল অঞ্চলে ছিল সমতটের অবস্থান। পূর্বদিকে সংলগ্ন ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চল (সমতটের অটবি-খন্ড বিভাগ)এবং দক্ষিণে মেঘনার মোহনায় দ্বীপাঞ্চলও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোটামুটিভাবে উত্তরে সিলেট সীমান্তের পর্বত ও হাওর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে ত্রিপুরা ও আরাকানের পাহাড়ি উঁচুভূমি থেকে পশ্চিমে মেঘনা (পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত স্রোতধারা) পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।
চার থেকে তেরো শতক পর্যন্ত সমতট এ অঞ্চলের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিনহাজ সম্ভবত তাঁর ‘সকনত/সনকত/সনকানাত’ বলতে সমতটকেই বুঝিয়েছেন। মিনহাজের বর্ণনানুসারে লক্ষণসেন-এর সহযোগীরা নদীয়া থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর পালিয়ে ‘বঙ্গ’ ও সমতটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। [আবদুল মমিন চৌধুরী]
মানচিত্রের জন্য দেখুন ইতিহাস (প্রাচীনযুগ)।