ই-ৎসিঙ্

ই-ৎসিঙ্ সাত শতকের চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী যিনি তাঁর ভারত ভ্রমণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ সম্ভবত ইজিং। তাঁর নাম ই-চিং হিসেবেও লেখা হয়। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বেইজিং-এর নিকটবর্তী ফান-ইয়াং (আধুনিক চো-চৌ) এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৭ বছর বয়সে তিনি সাধারণ শিক্ষা শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে তাঁর শিক্ষক মারা যান এবং এসময়েই তিনি বৌদ্ধ অনুশাসন অধ্যয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৪ বছর বয়সে (৬৪৮ খ্রি.) তিনি সন্ন্যাস জীবন শুরু করেন।

৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুুক্তির পর ই-ৎসিঙ্ পাঁচ বছর তাঁর মূল আগ্রহের বিষয় বিনয়পিটক পড়াশোনা করেন এবং এটিই তাঁর লেখালেখির মূল বিষয়বস্ত্ত হিসেবে গড়ে ওঠে। ফা-হিয়েন এর ভ্রমণ ও হিউয়েন সাং সম্বদ্ধে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। তাঁর নিজেরও অবশ্য ভারত ভ্রমণের ব্যাপারে অ্রাগ্রহ ছিল। ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে চেংইয়ান-এ যখন হিউয়েন সাঙ-এর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় তখন ই-ৎসিঙ্ সেখানে অবস্থান করছিলেন।

৬৭১ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রপথে ই-ৎসিঙ্ ক্যান্টন থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে পৌঁছেন। মগধ-এর বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থান দশ©র্নর পর তিনি নালন্দায় দশ বছর (৬৭৬-৬৮৫) অতিবাহিত করেন এবং সেখানে তিনি বিনয়পিটক শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রীভোজ (অথবা শ্রীবোজ, শ্রীবিজয় হিসেবে পরিচিত সুমাত্রার পালেমবাং) নগরের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। ওই সময়ে এখানে ভারতীয় সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ছিল। এখানেই তিনি বৌদ্ধ সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদে একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করেন।

৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে ই-ৎসিঙ্ তাঁর অনুবাদে সহায়তা পাওয়ার জন্য চীনে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পুনরায় শ্রীবিজয়ে ফিরে আসেন এবং এখানে আরও পাঁচ বছর অতিবাহিত করেন। ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুপরিচিত সম্রাজ্ঞী ইউ জেতিয়ানের শাসনামলে চীনে প্রত্যাবর্তন করেন। তাহলে, মোটামুটি ভাবে ই-ৎসিঙ্ প্রায় ২৫ বছর (৬৭১-৬৯৫) বিদেশে অতিবাহিত করেন। দেশে ফিরে তিনি বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। তাঁর পূর্বসূরি হিউয়েন সাং-এর মতো ই-ৎসিঙ্ও তাঁর বাকি জীবন বৌদ্ধ গ্রন্থে অনুবাদে অতিবাহিত করেন। ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক সম্রাট ঝোংজং-এর শাসনামলে ৭৯ বছর বয়সে ই-ৎসিঙ এর মৃত্যু হয়।

অনুবাদ ছাড়াও ই-ৎসিঙ্ দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রেখে যান। প্রথমটি কিউফা গাওসেং জুয়ান (চ’ইউ-ফা কাও-সেং চুয়ান)। এটি ভারতে অবস্থানকালে যে সকল বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীর সাথে ই-ৎসিঙ্ পরিচিত হয়েছিলেন অথবা তাঁদের সম্বন্ধে জেনে ছিলেন তাঁদের ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত জীবনীগ্রন্থ। এ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বহু তীর্থযাত্রী ভারতে আসলেও তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কোনো বিবরণ রেখে যান নি। এ কারণে গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রধান গ্রন্থ হলো, নান-হাই যিগুই নেইফা জুয়ান (নান-হাই চি-কুই নেই-ফা চুয়ান)। এর অর্থ ‘দক্ষিণ সাগর থেকে স্বদেশে পাঠানো বৌদ্ধ ধর্মের দলিল’। বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের রেখে যাওয়া দলিলের মধ্যে এটি একটি অনন্য গ্রন্থ। সম্ভবত হিউয়েন সাং-এর অসাধারণ গ্রন্থ জিউ জি (Xiyu Ji) এর অস্তিত্বের কারণে ই-ৎসিঙ্ ভারত ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কোনো ভ্রমনবৃত্তান্ত লিখে যাননি। তিনি অবশ্য বিনয়পিটক-এর ব্যাখ্যা অনুসারে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে বিবরণ দিয়েছেন।  [হরপ্রসাদ রায় এবং সারিতা ক্ষেত্রী]