দেবপর্বত

দেবপর্বত  সমতটের একটি প্রাচীন নগরীর নাম। কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতী শৈলশিরায় এটি অবস্থিত। ময়নামতী এলাকায় সাম্প্রতিক খননের ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ঘাটিত হয়েছে। এসব নির্দশনের মধ্যে রয়েছে বহু ধরনের শিলালিপি, চার শতেরও বেশি পুরানো স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, অসংখ্য সিলমোহর ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, পাথর, ব্রোঞ্জ ও পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী সমৃদ্ধ ভাস্কর্য, অসাধারণ বৈচিত্র্যের স্থাপত্য সম্পদ এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পসামগ্রী ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এগুলি এ অঞ্চলের ইতিহাস ও সভ্যতার পুনর্গঠনে সহায়ক মৌলিক, নির্ভরযোগ্য ও সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস। প্রকৃতপক্ষে দেবপর্বত নিছক একটি নগরীর চেয়ে অনেক বেশি কিছু; এটি এ অঞ্চলের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট মাইলফলক।

সমতটের পরম্পরাগত পাঁচটি পরিচিত রাজধানীর মধ্যে দেবপর্বত ছিল তৃতীয় ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার বহু পূর্বেই এটি ছিল একটি তীর্থস্থান এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কখন কিভাবে এর উৎপত্তি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে এ ধরনের উন্নয়নের জন্য এর ছিল প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য, উপযোগিতা ও সম্পদ। পার্বত্য বন পরিবেষ্টিত এবং পরিখার ন্যায় বেষ্টনকারী একটি প্রবহমান নদীর তীরে অবস্থিত সুউচ্চ ও অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত চিত্রবৎ এ স্থান ছিল রাজকীয় নগরীতে পরিণত হওয়ার এক আদর্শ পরিবেশ। অধিকতর আকর্ষণীয় হচ্ছে এর নিরাপদ আশ্রয়ে গড়ে ওঠা বিখ্যাত সন্ন্যাসী আশ্রম ও বিহার। নগরীর এ উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য শিল্প, স্থাপত্য ও অন্যান্য বিষয়ে মানুষের জীবন ও কর্মকান্ডে প্রভাব বিস্তার করেছে যা খননকৃত ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্ননিদর্শন থেকে বোঝা যায়।

দেবপর্বতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এর প্রান্তর ও বনরাজি, নদী ও হ্রদসমূহ, জলের প্রাচুর্য, উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল ছাড়াও প্রবাদতুল্য কৃষি উন্নতির ফল হিসেবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিকাশের অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। নগরীর পূর্বদিকে দূরবর্তী ত্রিপুরা ও আরাকানের ধূসর পর্বতমালার আকর্ষণীয় দৃশ্য এবং পশ্চিমদিকে মেঘনার নীলাভ কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্টতা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। এ নগরীর দুপাশে এ দুটি সুস্পষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বর্তমানের মতো অতীতেও এর অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তি ছিল।

দেবপর্বত নগরী যে ময়নামতী এলাকায় অবস্থিত ছিল তা নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। উক্ত এলাকায় অর্ধশতক কাল ধরে তথ্যানুসন্ধান, আবিষ্কার ও গবেষণা এ সত্য পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কাজটি এখনও সম্পূর্ণ না হলেও এতে নগরীর চরিত্র, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং এর পরিবেশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রাণকেন্দ্র রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে বির্তক রয়েছে।

নলিনীকান্ত ভট্টশালী কর্তৃক ধারণাকৃত শৈলশিরার দক্ষিণ প্রান্তে চন্ডীমুড়ার সঙ্গে এ কেন্দ্রের অভিন্নতা বর্তমানে স্বীকার করা হয় না। প্রশ্নটির সন্তোষজনক সমাধান এখনও হয় নি। এ নগরকেন্দ্রের সঠিক অবস্থান নির্ণয় ও শনাক্তকরণ নির্ভর করবে ঐ এলাকায় বিশেষ করে উত্তর প্রান্তের দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিশাল ও সুউচ্চ ঢিবি ময়নামতী প্রাসাদ টিলায় ব্যাপক ও গভীর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের উপর, অবশ্য যদি এটা ততদিনে টিকে থেকে থাকে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষিরোদ নদীর স্রোতে তলিয়ে গিয়ে না থাকে।

এ কাজে কিছু সময় লাগতে পারে। ইতোমধ্যে পন্ডিতগণ কিছু অকাট্য কারণে ময়নামতী প্রাসাদটিলার সঙ্গে এ কেন্দ্রের শনাক্তীকরণের কথা বলেছেন। ১৯৬৭ সালে অত্যন্ত সীমিত খননকার্যের ফলে সমগ্র এলাকার চারদিকের রক্ষাপ্রাচীর অংশত উন্মোচিত হয়েছে যা সম্ভবত দুর্গপ্রাচীর। সমকালীন শিলালিপির বর্ণনার অনুরূপ একসময় এ স্থানকে তিন দিকে পরিখার ন্যায় বেষ্টনকারী একটি নদীর সুস্পষ্ট নিদর্শনও শনাক্ত করা হয়েছে।

সমতটের রাজধানী  বলভট্টের ময়নামতী তাম্রশাসন হতে প্রমাণিত হয় যে, খড়গ নরপতি বলভট্ট সাত শতকের শেষার্ধে কোনো এক সময় প্রথম দেবপর্বতে সমতটের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। দেবপর্বত ও এর বিখ্যাত নদী ক্ষিরোদের উল্লেখ নিয়ে এটাই প্রথম দলিল। পরবর্তী সময়ে রাত বংশ সহ বাংলার প্রাথমিক দেব ও চন্দ্র শাসকদের দলিলপত্রে এর আরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

সংগত কারণেই মনে করা যেতে পারে যে, একটি পার্বত্য দুর্গ হিসেবেই দেবপর্বতের নগরকেন্দ্রের উৎপত্তি হয়েছিল। প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার ও আকর্ষণীয় অবস্থানের কারণে এর সামরিক গুরুত্বের ফলেই এ স্থানকে রাজধানীর জন্য প্রাথমিকভাবে পছন্দ করা হয় এবং এর পরবর্তী উন্নয়ন সাধিত হয়। এটি দু’শ বছরেরও অধিক সময় ধরে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কেন্দ্ররূপে অপ্রতিদ্বন্দ্বী থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত এস্থান তার ধর্মীয় ও শিক্ষাগত প্রাধান্য বজায় রাখে। ময়নামতী খননকার্যের ফলাফল এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখে না। এমনকি এর অবনতির যুগেও এটি ঐতিহ্যগতভাবে বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধভিক্ষু, নাথ যোগী ও সিদ্ধদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

রাজধানী শহর দেবপর্বতের অন্তর্বর্তী কটকশিলায় অবস্থিত তার রাজলক্ষ্মী স্পৃহনিয়া প্রাসাদ হতে বলভট্টের ময়নামতী তাম্রশাসন জারি করা হয়েছিল। এতে দেবপর্বত ও এর নদী ক্ষিরোদ সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। অপরাপর নির্মাণকর্মের সঙ্গে রাজধানীটি একটি রাজ-মার্গ (রাজপথ) নির্মাণ করে সুশোভিত করা হয় এবং শৈলশিরার দক্ষিণাংশে বনাঞ্চলে লালাম্বি বনে স্বামী দেবখড়গ কর্তৃক নির্মিত একটি মার্গ-পদস্তম্ভ খুবই চিত্তাকর্ষক।

বলভট্টের পরে শাসনক্ষমতা রাত রাজবংশের হাতে চলে যায় বলে অনুমতি হয়। শ্রীধারণ রাতের কৈলান তাম্রশাসনে দেবপর্বতের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাণবন্ত বর্ণনা রয়েছে। তখন সর্বতোভদ্রক (বর্গাকার বা আয়তাকার) নামে পরিচিত দেবপর্বত ক্ষিরোদ নদী দ্বারা পরিখার ন্যায় বেষ্টিত ছিল। এর জলে ‘হাতিরা খেলা করত’ এবং এর ‘তীরগুলি নৌকার বহর দ্বারা শোভিত ছিল’।

প্রাথমিক দেববংশীয় রাজগণ রাজধানী দেবপর্বত হতে আট শতক এবং সম্ভবত নয় শতকেও সমতট শাসন করেছেন। এ সময় ছিল অতুলনীয় শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কাল যা ময়নামতীতে প্রাপ্ত নিদর্শনে প্রতিফলিত। এ যাবৎ তাদের পাঁচটি শিলালিপির মধ্যে দুটির পাঠোদ্ধার করা গেছে। ভবদেবের কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল তাম্রশাসনে (মূলত আনন্দবিহারে আবিস্কৃত) দেবপর্বত ও এর বিখ্যাত নদী ক্ষিরোদ সম্পর্কে বিস্তারিত ও প্রাণবন্ত বর্ণনা রয়েছে। শহরটি সে সময় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে এবং এর নদীটি বিবেচিত হয় সবচেয়ে পবিত্র নদী হিসেবে। বিখ্যাত রত্নত্রয় তীর্থমন্দিরসহ বহুসংখ্যক সন্ন্যাসী আশ্রম ও মন্দির দেব-রাজাদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠতে থাকে এবং এ স্থানটি শুধু রাজাদের নয়, দেবতাদের বসবাসেরও উপযোগী হয়ে ওঠে।

খ্রিস্টীয় দশ শতকে  চন্দ্র বংশের অধীনে দেবপর্বত পুনরায় খ্যাতির শীর্ষে উন্নীত হয়। রাজধানী বিক্রমপুরে স্থানান্তরিত হলেও দেবপর্বত এর গুরুত্ব বা গৌরব হারায় নি। সমকালীন দলিলপত্র, ধ্বংসাবশেষ ও স্মৃতিচিহ্ন চন্দ্রযুগের শেষ পর্যন্ত (এগারো শতক) এর অক্ষুণ্ণ সুনাম ও গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে। দেবপর্বত ছিল তাদের ক্ষমতায় আরোহণের ভিত্তিভূমি এবং শ্রীহট্টমন্ডল ও কামরূপের বিরুদ্ধে তাদের অভিযানের ঘাঁটি। চন্দ্রযুগের পর দেবপর্বত বা এর অবিচ্ছিন্ন ক্ষিরোদ নদী সম্পর্কে আর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। নতুন রাজধানী পট্টিকের এর স্থান দখল করে নেয়। চন্দ্রযুগে এ নতুন রাজধানীর অভ্যুদয় ঘটে এবং তখন থেকে ‘পট্টিকেরক’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে এটি গড়ে উঠতে থাকে।  [এম. হারুনুর রশিদ]