নালন্দা মহাবিহার
নালন্দা মহাবিহার সাত শতকে প্রসিদ্ধি অর্জনকারী বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। বিহারের পাটনা থেকে ৮৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে এবং আধুনিক রাজগিরের ১১ কিমি উত্তরে অবস্থিত বড়গাঁও গ্রামের কাছে নালন্দার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বাংলার ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অবস্থিত হলেও নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে এতদঞ্চলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
সাধারণভাবে প্রচলিত ইতিহাস নালন্দার প্রাচীনত্বকে বুদ্ধের সময় পর্যন্ত নিয়ে যায়। অবশ্য এখানে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে গুপ্ত যুগের আগেকার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। পাল রাজাদের (আট থেকে বারো শতক) সময়েই এটি বিভিন্ন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ধারণা করা হয় যে, গুপ্ত সম্রাটগণই নালন্দা মহাবিহারের নির্মাতা এবং সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তই সম্ভবত এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফা-হিয়েন এর ভ্রমণ বিবরণীতে নালন্দায় বৌদ্ধ স্থাপনার কোন উল্লেখ না থাকায় এ বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সাত শতকের দিকে নালন্দা একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং পড়াশোনার জন্য এখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। তাঁর সময় থেকেই নালন্দা বিশিষ্ট পুরোহিতগণের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণের ৩০ বছরের মধ্যে ই-ৎসিঙ (৬৭৫ থেকে ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেন) সহ কমপক্ষে ১১ জন কোরীয় ও চৈনিক তীর্থযাত্রীসহ বিশিষ্টজনেরা নালন্দা ভ্রমণ করেন বলে জানা যায়। কনৌজের হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) নালন্দা বিহারের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
বাংলার পাল রাজগণ নালন্দার প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মপাল বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। লামা তারনাথ উল্লেখ করেন যে, ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা মহাবিহার তত্ত্বাবধানকারী প্রধান ব্যক্তি নালন্দা দেখাশোনা করার জন্যও রাজা কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হন। সুবর্ণদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব জাভার ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য দেবপালএর অনুমতি নিয়ে নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। এদের প্রতিপালনের জন্য দেবপাল ৫টি গ্রামও দান করেন। সে সময় নালন্দা বিহার ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতি জগতের বিশেষ কেন্দ্র এবং এর অভিভাবক হিসেবে পাল রাজগণ সমগ্র বৌদ্ধ জগতে উচ্চস্থান লাভ করেন। ঘোসরাওয়া শিলালিপি থেকে নালন্দা বিহারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি দেবপালের গভীর অনুরাগের কথা জানা যায়।
দ্বিতীয় গোপাল, প্রথম মহীপাল এবং রামপাল নালন্দার বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে, পাল রাজগণ শুধু নালন্দাতেই তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা সীমাবদ্ধ রাখেন নি; তাঁরা আরও বেশ কয়েকটি নতুন বৌদ্ধ স্থাপনা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে বা সম্প্রসারণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
চৈনিক তীর্থযাত্রী, বিশেষ করে হিউয়েন-সাং-এর বিবরণের ভিত্তিতে কানিংহাম কর্তৃক শনাক্তকৃত নালন্দায় ১৮৭২ সালের দিকে কয়েকটি প্রাথমিক উৎখনন পরিচালিত হয়। পরে ১৯১৫-১৬ থেকে ১৯৩৫-৩৬ সালের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং জে.এ পেইজ (JA Page)-এর নেতৃত্বেআর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া উৎখনন পরিচালনা করে এবং মঠ, মন্দির স্থাপত্যসহ অন্যান্য স্থাপনা উন্মোচিত হয়। নালন্দার বিহারসমূহ সাধারণ ধরনের। এর সাধারণ নক্শা সমকোণী চতুর্ভুজাকৃতির যা উন্মুক্ত বারান্দাসহ বাইরের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ দ্বারা ঘেরা। বিহারটির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল একদিকে পুরোহিতদের সারিবদ্ধ কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মঠ, অপরদিকে মন্দির, সুসজ্জিত ভবন ও কোর্ট। উভয় দিক প্রাচীর বেষ্টিত হয়ে সমগ্র বিহারটি গঠন করেছিল। মন্দির এবং মঠসমূহ ছিল দ’ুটি সমান্তরাল সারিতে, মন্দিরগুলি পূর্বাভিমুখী এবং মঠগুলি ছিল পশ্চিমাভিমুখী। এগুলির মাঝের বিস্তৃত জায়গায় কখনও কখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্দির গড়ে উঠতো।
নালন্দায় নানা ধরনের সীল এবং ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। মঠ বা বিহারে ব্যবহূত আনুষ্ঠানিক বা সরকারি সীলসমূহ যথারীতি চাকা ও হরিণের ছবি এবং শ্রী-নালন্দা-মহা-বিহারীয়ার্য-ভিক্ষু-সংঘস্য ক্ষোদিত লিপি বহন করত। সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার বিভিন্ন শাসক অথবা কর্মকর্তাদের সীলও পাওয়া গেছে। ব্রোঞ্জ নির্মিত সামগ্রীর জন্য নালন্দা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে পাওয়া গেছে তন্ত্রযান-বজ্রযান ধর্মমতের গৌতম বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ দেব-দেবীর ব্রোঞ্জনির্মিত পাঁচ শতাধিক মূর্তি, পালযুগে যেগুলি নালন্দাকে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। বৌদ্ধমতসহ নালন্দার ব্রোঞ্জ নির্মিত শিল্পকর্মের প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
নালন্দার পন্ডিতগণ ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত। হিউয়েন-সাং এবং ই-ৎসিঙ উভয়েই নালন্দার শিক্ষকগণের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। হিউয়েন-সাং যখন নালন্দায় ছিলেন তখন বাঙালি বৌদ্ধ ভিক্ষু শীলভদ্র ছিলেন এর অধ্যক্ষ। শীলভদ্র ছিলেন সর্বপ্রথম বাঙালি বৌদ্ধ শিক্ষক যিনি বাংলার বাইরে এরূপ দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন। হিউয়েন-সাং নিজেও শীলভদ্রের একজন ছাত্র ছিলেন। পরবর্তী পাল রাজাদের দলিলপত্রেও বিভিন্ন প্রসঙ্গে নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়।
চার থেকে নয় শতক পর্যন্ত নালন্দা শিক্ষা-দীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান ছিল। নালন্দায় প্রাপ্ত বৈন্যগুপ্ত, বুধগুপ্ত এবং কুমারগুপ্তের মাটির সীলগুলি চতুর্থ থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এর সমৃদ্ধির বড় সাক্ষ্য। যদিও গুপ্ত সম্রাটগণ এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং হিউয়েন সাং-এর বর্ণনানুযায়ী শকারীদিত্য নামে একজন গুপ্ত সম্রাট ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং যদিও এ তথ্যকে সত্য বলে মনে হয় না, তথাপি বিশাল এ প্রতিষ্ঠানের সবচাইতে সমৃদ্ধিশালী যুগ ছিল ছয় থেকে নয় শতক পর্যন্ত। এর কারণ বাংলার পাল রাজগণের অকুণ্ঠ ও উদার পৃষ্ঠপোষকতা যাঁরা শিক্ষা-দীক্ষার এই মহান প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় বড় দান অনুমোদনের মাধ্যমে গুপ্তদের ঔজ্জ্বল্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
বারো শতকের দিকে নালন্দা তার গুরুত্ব হারায়। তেরো শতকের প্রথমদিকে যখন ধর্মস্বামী নালন্দা পরিদর্শন করেন ততোদিনে এর অতীত গৌরব লুপ্ত এবং এর অনেকগুলি স্থাপনা তুর্কীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কেবল দুটি বিহার ছিল ব্যবহারের উপযোগী এবং সেখানে রাহুলশ্রীভদ্র নামক ৯০ বছর বয়স্ক একজন মহাপন্ডিত-এর সঙ্গে ধর্মস্বামীর দেখা হয়।
পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এলাকায় অবস্থানের কারণে বাংলার সঙ্গে নালন্দার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ। এটি কম গৌরবের বিষয় নয় যে, প্রাচীন যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র নালন্দার উপর বাংলার প্রভাববলয় বিস্তৃত হয়েছিল। একই সঙ্গে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলার সংস্কৃতি ও শিক্ষা এ কেন্দ্র থেকে লাভবান হয়েছে। [আকসাদুল আলম]