লখনৌতি

লখনৌতি  প্রাচীন নাম লক্ষ্মণাবতী। মুসলিম শাসনামলে লখনৌতি নামে পরিচিতি লাভ করে। লক্ষ্মণসেনের (১১৭৮-১২০৬ খ্রি) নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়। সম্ভবত গৌড় অঞ্চলে রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রি) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রামাবতী (‘আইন’-এর রামুতী)-এর অনুকরণে এরূপ নামকরণ হয়েছে। রাজমহলের প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে গঙ্গার পশ্চিম তীরে গঙ্গা-মহানন্দার মিলনস্থলের নিকটবর্তী স্থানে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের মালদা জেলায় এর অবস্থান। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে (৬০১ হিজরি) বখতিয়ার খলজী (মৃত্যু ১২০৬ খ্রি) নদীয়া জয় করার পর পরই লক্ষ্মণাবতীতে আসেন এবং এখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। ইওজ খলজী (১২১২-১২২৭ খ্রি) পরবর্তীকালে গঙ্গার বন্যার কবল থেকে শহর রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ করেন এবং রাস্তা তৈরি করে দিনাজপুরের দেবকোট ও বীরভূমের লখনৌর-এর সাথে রাজধানী লখনৌতির সংযোগ স্থাপন করেন। তেরো শতকের প্রথম দিকে তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের লেখক মিনহাজ-ই-সিরাজ এসব নির্মাণকাজ প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানা যায়।

১২০৬ থেকে ১২১১ খ্রিস্টাব্দ এই ছয় বছর ব্যতীত ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লখনৌতি মুসলমান শাসকদের রাজধানী ছিল। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রি) পান্ডুয়ায় তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। লখনৌতিতে বাংলার প্রাথমিক সময়ের টাকশালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। লখনৌতির তাৎপর্যপূর্ণ দিক এই যে, মুসলিম শাসনের এই কেন্দ্র থেকে সমগ্র বাংলায় মুসলিম শাসন বিস্তার লাভ করে।

পনেরো শতক থেকে বাংলার ঐতিহাসিক সূত্রসমূহে লখনৌতির নাম বাদ পড়ে। নগরটি প্রাচীন গৌড়ের সাথে একীভূত হয়ে যায়, যার ধ্বংসাবশেষ পশ্চিম বাংলার মালদা এবং বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ জেলায় পরিদৃষ্ট হয়। সুলতানি আমলে গৌড় ৪০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ষোল শতকের শেষ দিকে, আবুল ফজলের সময়ে, লখনৌতি মালদার একটি পরগনা হিসেবে টিকে ছিল। খুব সম্ভবত গঙ্গার গতি পরিবর্তন এই বিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ।

জিয়াউদ্দিন বরনীর (চৌদ্দ শতক) বর্ণনানুসারে লখনৌতিতে ১.২৪ কি.মি দীর্ঘ একটি বাজার ছিল। শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত একটি প্রশস্ত ও সোজা রাস্তা ছিল। বাজারে দোকানগুলি ছিল সারিবদ্ধভাবে সাজানো। মূল শহর থেকে উওর দিকে ফুলওয়ারীদের পুরানো বল্লালবাড়ি প্রাসাদ ছাড়াও শহরের দক্ষিণ দিকে পটলচন্ডিতে নতুন একটি প্রাসাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কানিংহাম লখনৌতির নগর সংলগ্ন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে মত প্রকাশ করেন যে, বর্তমান গৌড়ের উওর অংশেই মধ্যযুগের লখনৌতির অবস্থান, যা ২.৫ কিমি দীর্ঘ ও ১.২৪ কিমি চওড়া ছিল। সে সময়ে লখনৌতি ছিল ফুলওয়ারী, কমলবাড়ি, পটলচন্ডি, বল্লালবাড়ি, সাগরদিঘি, রামকেলী প্রভৃতি এলাকা সম্বলিত। এখনকার লখনৌতি একটি বিস্তৃত গ্রাম, যেখানে ধংসপ্রাপ্ত কতগুলি দুর্গ, প্রবেশদ্বার, জলাশয় ও পরিত্যক্ত নিদর্শনাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।  [মোঃ আখতারুজ্জামান]

গ্রন্থপঞ্জি  JH Ravenshaw, Gaur: Its Ruins and Inscriptions, London, 1878; A Cunningham, The Archaeological Survey of India Report, XV, Calcutta, 1882; Abid Ali Khan & HE Stapleton, Memories of Gaur and Pandua, Calcutta, 1931; ABM Husain et al (ed), Gawr - Lakhnawti, Dhaka, 1997.