চারু ও কারু লোকশিল্প

চারু ও কারু লোকশিল্প  বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোককলা; ধর্মীয় ও সামাজিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে এর উদ্ভব।  আলপনা, মনসাঘট, লক্ষ্মীর সরা, মঙ্গলঘট ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন লোকশিল্প। পটচিত্রে ধর্মীয় আবেগ যুক্ত থাকলেও তা জীবিকার উপায় হিসেবে গণ্য। নানারকম ডিজাইন ও অলঙ্করণে শোভিত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি গৃহস্থের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটায়। খেলার পুতুল,  সখের হাঁড়ি, সোনা-রূপার অলঙ্কার ইত্যাদি সৌখিন দ্রব্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। তবে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক-সব শিল্পকলায়ই কিছু না কিছু নান্দনিক আবেদন থাকে। তাই হিংস্র পশু বা রাক্ষসের মুখোশচিত্র যতই কদাকার হোক, নির্মাতার হাতের ছোঁয়া এবং ঐতিহ্য-সংস্কার-প্রথাগত আবেগের সংমিশ্রণে তার মধ্যেও এক প্রকার রস সঞ্চারিত হয়, যা বীভৎস রস নামে খ্যাত।

লোকশিল্পের উপকরণ অতি সাধারণ। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত মাটি, কাঠ, কাপড়, সুতা, শোলা, শঙ্খ, নল, বাঁশ, বেত, শিং ইত্যাদি দিয়ে নানা ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়। সোনা, রূপা, পিতল, হাতির দাঁত প্রভৃতি মূল্যবান উপকরণও ব্যবহার করা হয়। লোকশিল্পের যন্ত্রপাতিও অতি সাধারণ। এসব সাধারণ উপাদান ও যন্ত্রপাতি দ্বারা বাংলার লোকশিল্পীরা যুগযুগ ধরে অসামান্য শিল্প তৈরি করে আসছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাদার-অপেশাদার শিল্পীদের বেশির ভাগই গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করে।  কামারকুমার, ছুতার,  পটুয়া, সোনারু,  কাঁসারুশাঁখারিতাঁতি প্রভৃতি চারু ও কারু শিল্পী জাতপেশা হিসেবে বিবিধ শিল্পকর্মে পুরুষানুক্রমে নিয়োজিত আছে। হস্তনির্মিত এসব শিল্প তাদের জীবিকারও উপায় বটে। আলপনা ও নকশি কাঁথার শিল্পীরা হচ্ছে গৃহস্থ ঘরের সাধারণ নারী; শিল্পী হিসেবে তাদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই। পল্লী অঞ্চলে এরূপ আরও কিছু সৌখিন শিল্পী আছে যারা নান্দনিক চেতনা থেকে নানা ধরনের খেলনা, আসবাবপত্র ও সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করে থাকে।

লোকশিল্পে মোটিফের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোটিফ হচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্যাশ্রিত কতগুলি স্থায়ী ফর্ম বা ডিজাইন, যেগুলি নানা আঙ্গিকে ব্যবহূত হয়। যেমন  পদ্মকল্কা, সূর্য, সজীব গাছ, পুষ্পিত লতা ইত্যাদি মোটিফরূপে চিত্রে, নকশায়, সূচিকর্মে, বুননে ও খোদাই কাজে পরিলক্ষিত হয়। এগুলির সঙ্গে জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কার, বিশ্বাস, প্রতীক ও সৌন্দর্যের চেতনা জড়িয়ে আছে। মাছ, হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, মকর, স্বস্তিকা, বৃত্ত, বর্ফি, তরঙ্গ, মন্দির-মসজিদ ইত্যাদি মোটিফরূপে অঙ্কিত হয় বিভিন্ন চারু ও কারু শিল্পে। এগুলির মধ্যে মাছ প্রজননের, ধানছড়া সমৃদ্ধির, পদ্ম পবিত্রতার ও স্বস্তিকা সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে গণ্য হয়ে থাকে।

উন্নত শিল্পের মতো লোকশিল্প নির্মাণেরও নানা পদ্ধতি আছে। উপকরণ ও ক্যানভ্যাসভেদে লোকশিল্পের বিভাজনগুলি হচ্ছে এরূপ: ১. অঙ্কন ও নকশা (painting and sketch): আলপনা, পটচিত্র, ঘটচিত্র, মুখোশ, দেয়ালচিত্র,  উল্কি ও অন্যান্য অঙ্গচিত্র,  চালচিত্র, করন্ডিচিত্র, সখের হাঁড়ি, নকশি পুতুল ইত্যাদি; ২. সূচিকর্ম (embroidery): বিবিধ  নকশি কাঁথা, রুমাল, শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক; ৩. বয়নশিল্প (weaving):  নকশি পাটিনকশি শিকানকশি পাখা, ঝুড়ি, ফুলচাঙ্গা; ৪. মডেলিং বা প্রতিরূপ দেওয়া (modelling):  পুতুল ও খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল, মুখোশ, ছাঁচ,  নকশি পিঠানকশি দরমা, মিষ্টিদ্রব্য,  অলঙ্কারনৌকা, রথ,  তাজিয়া, খাট, পালঙ্ক, বাক্স, সিন্দুক, পাল্কি ইত্যাদি; ৫.  খোদাই কাজ (engraving): খোদাইকৃত কাঠের দ্রব্য, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, নানা ধাতুশিল্প; ৬. খচিত করা (inlaying): মণি, মুক্তা, হীরা ও পান্নাখচিত বিবিধ অলঙ্কার, রঙিন কাঁচ-পাথর দ্বারা দালান-কোঠা অলঙ্কৃতকরণ ইত্যাদি।

চারু ও কারু দুটি ভিন্ন প্রকৃতির শিল্প। রঙতুলির সাহায্যে নির্মিত চিত্রকলা ও সুই সুতার সাহায্যে নির্মিত  সূচিশিল্প চারুশিল্পের অন্তর্গত; আর মৃৎশিল্প,  দারুশিল্প, বস্ত্রশিল্প, বাঁশ-বেত-শোলা-শঙ্খ-দন্ত নির্মিত বিবিধ হস্তশিল্প এবং সোনা-রূপা-পিতল নির্মিত ধাতবশিল্প কারুশিল্পের অন্তর্গত। তবে কতক লোকশিল্প আছে যেগুলিকে এভাবে বিভাজন করা যায় না, যেমন: সখের হাঁড়ি, মনসাঘট, লক্ষ্মীর সরা এগুলি একাধারে চারু ও কারুশিল্পের নিদর্শন বহন করে। মাটির তৈরী সাধারণ হাঁড়ির গায়ে রঙতুলি দিয়ে মাছ, পাতা কিংবা রেখাদির চিত্র অঙ্কিত হলে তখন তাকে সখের হাঁড়ি বলে। নকশি পাটি বুননশিল্প; এতে রঙ-বেরঙের বেত দিয়ে বুনন কৌশলে গাছ, পাখি, মসজিদ ইত্যাদির ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। এ কারণে নকশি পাটিও চারু ও কারুশিল্পের সমন্বিত নিদর্শনরূপে গণ্য হয়।

চারুশিল্প অঙ্গচিত্র  কোনো কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের নরনারী ধর্মীয় চেতনা থেকে অঙ্গে  উল্কি ধারণ করে। সাধারণত এসব উল্কির নকশা হয় সূর্য, পাখি, সাপ ও বৃত্ত। বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি অঙ্কন করে। বাহুতে সুচ দিয়ে ছিদ্র করে এসব চিত্র অাঁকা হয়। তারপর কেশুর্তিয়া পাতার রস লাগালে নীলাভ উল্কি প্রকাশ পায়। উল্কি একটি বিশ্বজনীন আর্ট। পাশ্চাত্য দেশগুলির শিক্ষিত নারী-পুরুষরাও দেহের বিভিন্ন অঙ্গে উল্কি ধারণ করে। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও সংস্কার দুই-ই কাজ করে। সমুদ্রের নাবিকরা বাহুতে নোঙরের উল্কি অাঁকে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে কনের মুখ হলুদ ও চন্দনগুঁড়া দিয়ে চিত্রিত করা হয়। একে ‘কনে-চন্দন’ বলে। কপালে  তিলক ফোঁটা ও মুখমন্ডলে কনে-চন্দন সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশে দেওয়া হয়। মুসলিম মেয়েরা সারা বছর হাতের করতল মেহেদি দ্বারা রঞ্জিত ও চিত্রিত করে। এক্ষেত্রে কল্কা, গাছপাতা ও রেখার ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়। বিবাহ উপলক্ষে এর ব্যবহার হয় ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য।

আলপনা

আলপনা  এ শ্রেণীর একটি জনপ্রিয় লোকচিত্র। হিন্দু রমণীদের ব্রত এর আদি উৎস। লক্ষ্মীব্রত, সেঁজুতিব্রত, মাঘমন্ডল ব্রত, হরিচরণ ব্রত, বসুধারা ব্রত ইত্যাদি উপলক্ষে ছড়া ও কথা বলা এবং আলপনা দেওয়ার রীতি আছে। সাধারণত ঐহিক সুখ-সম্পদ ও আত্মীয়-স্বজনের মঙ্গল কামনা করে ছড়া বলে ও কাম্যবস্ত্তর আলপনা এঁকে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়। হিন্দু সমাজে  অন্নপ্রাশন ও  বিবাহ উপলক্ষেও আলপনা অাঁকা হয়। আলপনার অন্তর্নিহিত মাঙ্গলিকতা ও সৌন্দর্যচেতনার সূত্র ধরে মুসলমানদের বিবাহ-অনুষ্ঠানেও এক সময় তা প্রচলিত হয়। ক্রমে হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও আলপনা দেওয়ার রীতি চালু হয়। অবশ্য এসব অনুষ্ঠানের চিত্রবস্ত্ত ব্রতের চিত্রবস্ত্ত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্রতের ধর্মীয় চেতনার স্থলে এসব ক্ষেত্রে নান্দনিক চেতনারই প্রতিফলন ঘটে। লতাপাতা, ফুলফল ও জ্যামিতিক নকশা এসবের প্রধান চিত্রবস্ত্ত।

ব্রত উপলক্ষে ব্রতের স্থান উঠান ছাড়াও ঘরের মেঝে, খুঁটি, দেওয়াল, দরজার পাল্লা, কুলা ইত্যাদিতেও আলপনা দেওয়া হয়। বিবাহে ছাতনাতলায়, উঠানে, বাসরঘরে এবং কুলা, ডালা, মঙ্গলঘট, আসনপিঁড়ি ইত্যাদি পাত্রে আলপনা অাঁকা হয়। ব্রতের আসনপিঁড়িতে পদ্মশঙ্খ, অন্নপ্রাশনের আসনপিঁড়িতে ব্যঞ্জনের বাটি আর বিবাহের আসনপিঁড়িতে জোড় ফুল, ভ্রমর, পদ্ম ইত্যাদি অাঁকা হয়। বর্তমানে  একুশে ফেব্রুয়ারি  শহীদ মিনার চত্বরে, রাস্তায় ও প্রাচীরে আধুনিক শিল্পীদের দিয়ে ব্যাপক আকারে আলপনা দেওয়া হয়। এতে পদ্ম, চক্র এবং নানা প্রকার জ্যামিতিক ডিজাইন প্রাধান্য পায়। উপলক্ষভেদে এভাবেই আলপনার পার্থক্য সূচিত হয়।

চালের গুঁড়ির সাদা পিটালি আলপনার প্রধান উপকরণ; এ ছাড়া অনুষ্ঠানভেদে ইটের গুঁড়ি, কালো ছাই, গোবর-গোলা জল, সিন্দুর, হলুদ-বাটা ইত্যাদিও ব্যবহূত হয়। ব্রতের আলপনা আঙুল বা কাঠি দিয়ে অাঁকা হয়। বর্তমানে শহরে কোনো বরেণ্য ব্যক্তির জন্ম-জয়ন্তী বা জাতীয় উৎসবে যে আলপনা দেওয়া হয়, তাতে আধুনিক চিত্রকলার মতো রঙতুলি ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলকভাবে এরূপ আলপনা দীর্ঘস্থায়ী হয়। রঙ, ক্যানভাস ইত্যাদি কারণে ব্রতের আলপনায় বস্ত্তর ডিটেলস দেওয়া সম্ভব হয় না, আভাস বা রূপক-প্রতীক দিয়ে বিষয়বস্ত্তকে বোঝাতে হয়। সেঁজুতি ব্রতের ‘হাতে-পো কাঁখে-পো’ আলপনাটি একটি বিমূর্ত নকশা; বহু সন্তানবতী নারীর প্রতিকৃতি কেবল রেখা দ্বারাই বোঝানো হয়। লক্ষ্মীব্রতে লক্ষ্মীদেবীর পা অনুরূপভাবে রেখাঙ্কিত মানবীয় পদচিহ্ন মাত্র, অন্যকিছু নয়।

করন্ডিচিত্র  শোলা নির্মিত ক্যানভাসে কয়েকটি প্যানেলে অঙ্কিত মনসার কাহিনীভিত্তিক ছবি। এটি করন্ডি, মেড় বা মুন্ডুস নামে হিন্দু সমাজে পূজিত হয়। মনসাপূজা উপলক্ষে মালাকাররা করন্ডিচিত্র অঙ্কন করে। প্রথমে শোলা ও কাগজ দিয়ে বর্গাকৃতির মন্দির সদৃশ ফ্রেম তৈরি করা হয়। তারপর ওপরে-নিচে কয়েকটি খোপে বিভক্ত করে  মনসাবেহুলা, লক্ষীন্দর, চাঁদ সদাগর, বেহুলার সাত ভাই ও তাদের স্ত্রী, মুনি,  জেলেসাপুড়েধোপা, ঢুলি, কুন্ডলিকৃত সর্প ইত্যাদির ছবি রঙতুলি দিয়ে অাঁকা হয়। রীতি ও আঙ্গিকের দিক থেকে পটচিত্রের সঙ্গে এর মিল আছে। পূজাশেষে এ করন্ডি কলার ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

মনসা নাগঘট

ঘটচিত্র  মাটির তৈরী কলস জাতীয় পাত্র ঘট নামে পরিচিত। মঙ্গলঘট, মনসাঘট, নাগঘট, লক্ষ্মীর ঘট, কার্তিকের ভাঁড়, দক্ষিণরায়ের বারা ইত্যাদি বিচিত্র ধরনের ঘট রয়েছে। এ ঘটগুলি হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা উপলক্ষে নির্মিত হয়। মঙ্গলঘটে পিটালি ও তেল-সিন্দুর দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। প্রতিমারূপী মনসার মূর্তিযুক্ত ঘট ও সর্পরূপী মনসার ঘট আছে। দ্বিতীয়টিকে নাগঘটও বলে। ঘটটিকে প্রথমে প্রতিমা অথবা ফণা অঙ্কনের উপযোগী করে রূপ দেওয়া হয়; এজন্য গলাটা উঁচু করা হয়। এরপর ঘটের গায়ে রঙ দিয়ে দেবীমূর্তি অথবা তাঁর প্রতীক সর্পফণা অঙ্কন করা হয়। বাংলা একাডেমীর লোকশিল্প সংগ্রহে সর্পের ফণাযুক্ত একটি মনসাঘট আছে। আটটি নাগের ফণাযুক্ত ঘটকে ‘অষ্টনাগ ঘট’ বলে। সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা ও ধানছড়া অঙ্কিত ঘট ‘লক্ষ্মীর ঘট’ নামে অভিহিত। ঘটলক্ষ্মী হিসেবে এটি পূজা পেয়ে থাকে। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের মুন্ডমূর্তির ঘট ‘দক্ষিণরায়ের বারা’ নামে পরিচিত। নানা রঙ দিয়ে মাথা ও মুকুট পরিস্ফুট করা হয়। এগুলির মধ্যে মনসাঘটই অধিক অলঙ্কৃত ও বহুল ব্যবহূত।

কাঠের তৈরি পুতুল

দারুচিত্র  হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে কাঠ খোদাই করে ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়; আবার কাঠের সমতল জমিনে রঙতুলি দিয়ে চিত্রও অঙ্কিত হয়। দরজার চৌকাঠ, ঘরের কাঠের খুঁটি, জানালার পাল্লা, পাল্কি, রথ, নৌকার গলুই, খেলনা পুতুল ইত্যাদি এভাবে চিত্রশোভিত করা হয়। চৌকাঠে ও খুঁটিতে পুষ্পিত লতাপাতা, পাল্কিতে ফুল, লতা, জ্যামিতিক ছক, নৌকায় স্বস্তিকা, চাঁদতারা, পাখি ও মাছ অাঁকা হয়। মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশেই এসব করা হয়। মানুষ, পাখি, হাতি ও ঘোড়ার  আকৃতিবিশিষ্ট কাঠের পুতুলে ওইসব প্রাণীর এনাটমির দৃষ্টিগ্রাহ্যতা আনার জন্য রং ব্যবহার করা হয়। দু চাকার ঘোড়ার পুতুলে মুখ, চোখ, কান ও দেহ চিত্রণে হলুদ ও লাল রঙ এবং হাতির দেহ ও হাওদা চিত্রণে কাল ও সাদা রঙ ব্যবহূত হয়।

দেওয়ালচিত্র

দেওয়ালচিত্র  মাটির দেওয়ালে আলপনা ছাড়াও মঙ্গলের প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন, পদ্মোপবিষ্টা লক্ষ্মীমূর্তি, পৌরাণিক বীরপুরুষ, ধানশিষ, লতাপাতা, ময়ূর, হাতি ইত্যাদি অাঁকা হয়। কৃষ্ণলীলা, রামলীলা ইত্যাদি অঙ্কিত হয় ম্যুরাল পদ্ধতিতে। দেবমূর্তি অাঁকা হয় আপদবালাই থেকে গৃহকে রক্ষা করার জন্য, আর ফুলফল, লতাপাতা ইত্যাদি অাঁকা হয় সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য। উত্তরবঙ্গে মাটির ঘরের ব্যবহার বেশি। সেখানকার দেওয়ালে বন্দুকধারী মুক্তিযোদ্ধার ছবিও দেখা যায়। দেওয়ালচিত্রের অনুরূপ শহরে প্রাচীরচিত্র দেখা যায়। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে প্রাচীরগাত্রে ম্যুরাল পদ্ধতিতে মনসাকাহিনী ও অন্যান্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এতে রং-রেখার ব্যবহারে পটের চিত্ররীতি অনুসৃত হয়েছে।

পটচিত্র  পট বা কাপড়ের ওপর রংতুলির সাহায্যে অঙ্কিত হয়। বৌদ্ধ আমলে এদেশে পটচিত্রের প্রচলন ছিল বলে পন্ডিতদের ধারণা। ‘মস্করি’ উপাধিধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পটচিত্র এঁকে ও পটগীতি গেয়ে  বৌদ্ধধর্ম প্রচার করত। এদের বংশধরেরা হিন্দু আমলে পৌরাণিক দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে পটচিত্র অাঁকা শুরু করে। মুসলিম আমলে ধর্মান্তর গ্রহণ করলেও তারা পূর্বের সংস্কার ত্যাগ না করে তার সঙ্গে মুসলিম কাহিনী যুক্ত করে নেয়। দেখা যায়, পটুয়ারা যেমন কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, গৌরলীলা, মনসালীলা নিয়ে পট এঁকেছে, তেমনি গাজীর গানের পালা অবলম্বনে  গাজীর পট, বিবি সোনাভানের কাহিনী অবলম্বনে সোনাভানের পট, কারবালার ঘটনা অবলম্বনে মুহরমের পট চিত্রিত করেছে। পনেরো-ষোলো শতকের  মঙ্গলকাব্য এবং চৈতন্যদেবের জীবনীগ্রন্থসমূহ থেকে সে সময়ের পটচিত্র সম্পর্কে জানা যায়।

পটচিত্র

বাংলাদেশে দু রকমের পটচিত্র প্রচলিত আছে: এককচিত্র বা চৌকাপট এবং বহুচিত্র বা দীর্ঘপট। কালিঘাটের পট প্রথম শ্রেণীভুক্ত। এতে সমসাময়িক কালের নরনারীর চিত্র কোনোটি ব্যঙ্গাত্মক, কোনোটি ভাবাত্মক, আবার কোনোটি বা অশ্লীল ভঙ্গিমায় অাঁকা হয়েছে।  কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠার পর আঠারো-উনিশ শতকে শহরকেন্দ্রিক এ চিত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে। পাশ্চাত্যের আদর্শে আধুনিক চিত্ররীতি প্রবর্তিত হলে কালিঘাটের পট লোপ পায়।

কাহিনীর ধারাবাহিক ঘটনা অবলম্বনে চিত্রিত পটই বাঙালির আবহমান কালের খাঁটি চিত্ররীতির নিদর্শন। এগুলি আট-দশ থেকে বিশ-পঁচিশ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। লাঠিতে জড়ানো থাকে বলে এগুলিকে ‘জড়ানো পট’ও বলে। বাংলাদেশে ‘পঞ্চকল্যাণী পট’ নামে মিশ্র বিষয়ক এক প্রকার পটের প্রচলন আছে। বিভিন্ন দেবদেবীর একেকটি লীলা নিয়ে এ ধরনের পট অঙ্কিত হয়েছে। কুমার সম্প্রদায় মাটির পাত্রে এগুলি এঁকে মেলায় বিক্রি করে।

ইসলামি ভাবধারায় অঙ্কিত গাজীর পট বাংলাদেশে আজও প্রচলিত আছে। বাঘের অধিপতি গাজীপীরের প্রচলিত কাহিনী অবলম্বনে এ পট প্যানেল আকারে অঙ্কিত হয়। এরূপ একটি পটে গাজীকে শ্মশ্রুধারী ও পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় বাঘের উপর আসীন দেখা যায়। মূল পটের সঙ্গে ক্ষুদ্রাকার অনেক চিত্র থাকে, যেমন: মকরবাহিনী গঙ্গাদেবী, বাঘের কবলে গরু, মুগুরধারী দক্ষিণরায় ইত্যাদি। চিত্রগুলি স্পষ্ট রেখায় জীবন্তভাবে অাঁকা হয়। ঢাকার মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদিতে এখনও দু-একজন পটুয়া চিত্রকর আছে যারা গাজীর পট এঁকে থাকে। কালের প্রেক্ষাপটে পটচিত্রে ধর্মীয় আবেগ কমে এসেছে; সে স্থান দখল করেছে নান্দনিক মনোভাব। বর্তমানে শহরের সৌখিন ব্যক্তিদের ড্রয়িং রুমে কোনো কোনো পটচিত্র শোভা পায়।

মুখোশ চিত্র

মুখোশ চিত্র  বাঙালির বিভিন্ন লোকোৎসবে মুখোশ পরে বা সঙ সেজে নৃত্য ও অভিনয় করার রীতি আছে। মুখোশ ও সঙের সাজ লোকচিত্রের আদর্শে রূপায়িত হয়। ধর্মীয় মুখোশ নৃত্যে বিভিন্ন দেবদেবীর মুখাকৃতির মুখোশ পরে নৃত্য করা হয়। যেমন শিবনৃত্যে শিবের এবং কালীনৃত্যে কালীর মুখাবয়ব পরা হয়। কাঠের ফ্রেমে কাপড় জড়িয়ে মাটি দিয়ে লেপে তার ওপর রঙের ছোপ দিয়ে শিবের মুখাবয়ব তৈরি করা হয়। কালীর মুখোশে কাঠের খোলে রঙ দিয়ে মুখচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। কালীর মুখমন্ডল নীল রঙ, চোখ ও মণি সাদা ও কালো রঙ এবং জিহবাকৃতির কাঠটি লাল রঙে রঞ্জিত করা হয়। অনুরূপভাবে ‘বুড়াবুড়ি’ নাচের মুখোশ গঠনে ও চিত্রণে বুড়া-বুড়ির স্বতন্ত্র ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। এসব নৃত্যানুষ্ঠানে গ্রামের মালি, ছুতার ও কৈবর্তরা অংশগ্রহণ করে থাকে। লৌকিক আমোদ-প্রমোদের অনুষ্ঠানে সঙ সাজার রীতি অছে। বহুরূপীরা জীবজন্তুর সঙ সেজে রঙ্গকৌতুক করে। বানর, বিড়াল, বাঘ ইত্যাদি জন্তুর বর্ণে চিত্রিত পোষাক পরে ও দেহ চিত্রিত করে সঙ সাজা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘোড়ার সঙ সেজে ‘ঘোড়ানাচ’ হয়। এককালে বহুরূপীরা পেশাদার শিল্পীরূপে পরিগণিত ছিল। তারা সং সেজে রঙ্গকৌতুক দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত।

সখের হাঁড়ি  চিত্রিত মৃণ্ময় পাত্র। কলস বা ঘটসদৃশ মাটির পাত্রের গায়ে সাগু ও আঠার সঙ্গে রং মিশিয়ে তুলির মোটা টানে মাছ, পাখি, পদ্ম, পাতা ও জ্যামিতিক রেখা অাঁকা হয়। এগুলিতে বস্ত্ত অনুযায়ী লাল, হলুদ ও সবুজ রং ব্যবহূত হয়। ছবি ও রং সৌন্দর্য ও প্রজননের সঙ্গে জড়িত; এজন্য বিবাহের ফলমূল, মিষ্টদ্রব্য ইত্যাদি আদান-প্রদানে সখের হাঁড়ি ব্যবহূত হয়। এ ধরনের সৌখিন কাজে এ হাঁড়ি ব্যবহূত হয় বলেই এর নাম হয়েছে সখের হাঁড়ি। রাজশাহীর একটি অঞ্চলের কতিপয় কুমার পরিবার সখের হাঁড়ি তৈরি করে। এখন শহরে ঘর সাজাবার উপকরণ হিসেবেও এর কদর বাড়ছে।

সরাচিত্র

সরাচিত্র  সরা হচ্ছে চালুনের মতো বড় আকারের ঢাকনা। মাটির তৈরী এরূপ সরার সামনের অবতলভাগে রংতুলি দিয়ে লক্ষ্মীমূর্তি অাঁকা হয়। এটি ‘লক্ষ্মীর সরা’ নামে পরিচিত। নিম্নবিত্তের হিন্দুরা এতেই লক্ষ্মীদেবীর পূজা দেয়। সরার অবতলে সাদা রঙের প্রলেপ লাগিয়ে হলুদ, লাল ও কালো রং-রেখা দ্বারা বাহন পেঁচাসহ দেবীমূর্তি অাঁকা হয়। কোনো কোনো সরায় দুর্গা ও সরস্বতীর সঙ্গে, আবার কোনো কোনো সরায় প্যানেল আকারে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সঙ্গে লক্ষ্মীদেবী অঙ্কিত হন। সরা তৈরি ও মূর্তি অঙ্কনের কাজ পেশাদার কুমারেরাই করে থাকে। সরার দ্বিমাত্রিক এ ছবি অাঁকায় আয়তন, রঙ ও রেখার ব্যবহার অন্য চিত্রের তুলনায় অধিক স্পষ্ট ও প্রকাশধর্মী। টাঙ্গাইলে অঙ্কিত ‘গাজীর সরা’ এবং মুহরমের ছবি অঙ্কিত ‘মহরমের সরা’র প্রচলন আছে। মুসলমানরা তা সযত্নে রক্ষা করে। লক্ষ্মীসরার অনুকরণে মুসলমানি সংস্করণরূপে এগুলি পরিকল্পিত হয়েছে। অধুনা শহরবাসীরা আলপনা ও ছবি অঙ্কিত সরা দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে। এভাবে প্রাচীন সরাচিত্র ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পে রূপান্তর লাভ করেছে।

কারুকাজখচিত কাঠের দরজা ও জানালা

কারুশিল্প দারুশিল্প  কাঠের নির্মিত ঘরের দরজা, জানালা, খুঁটি, কড়ি, বরগা, বাক্স, খাট, পালঙ্ক, আসনপিঁড়ি, পিঠার ছাঁচ, বাদ্যযন্ত্রের খোল, পাল্কি, রথ, নৌকা, পুতুল ইত্যাদি খোদাই করে নানারকম চিত্রদ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়। পদ্ম, পাখি, পুষ্পিত লতা, চক্র ও জ্যামিতিক নকশা দারুশিল্পের সাধারণ মোটিফ। দরজা, পাল্লা, পালঙ্ক, বাক্স ও আসনপিঁড়িতে পদ্ম; চৌকাঠ, খুঁটি, খাটের পায়া ও পাল্কির বর্ডারে পুষ্পিত লতা ও জ্যামিতিক ছক; বাদ্যযন্ত্রের খোলে ময়ূর ও টিয়া এবং নৌকায় পদ্ম ও ময়ূর মোটিফ হিসেবে ব্যবহূত হয়। মন্দিরের আকারবিশিষ্ট রথের পুরো কাঠামোটি একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম; উপরন্তু এর সমগ্র শরীর নানা কারুকার্য দ্বারা ভরাট করা হয়। গ্রামের ছুতার মিস্ত্রি এসব চিত্রকর্মের রূপকার। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ‘সুরসু্ন্দরী’ নামে নারীর একটি পূর্ণাঙ্গ দারুমূর্তি সংরক্ষিত আছে। এতে গাত্রবস্ত্র ও অলঙ্কার পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হাতে আছে পাখির মোটিফ। হাতুড়ি, বাটালি, নরুন, হাতকরাত, র্যঁদা, কুরনি, স্কেল, কাঠ পেন্সিল ইত্যাদি অতি সামান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে এসব শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়। শিল্পীরা পুরুষানুক্রমে এ পেশায় নিযুক্ত রয়েছে।

কাঁসার তৈজসপত্র

ধাতবশিল্প  ধাতবশিল্প হিসেবে সোনা-রূপার বিবিধ অলঙ্কার এবং রূপা-কাঁসার থালা, গ্লাস, কলস, মগ ইত্যাদির ব্যবহার দীর্ঘকালের প্রাচীন। অধুনা ফুলদানি, ছাইদানি, টেবিল ল্যাম্প, প্রসাধনীর কৌটা, ঘর সাজানোর নানা সৌখিন দ্রব্যও তৈরি হচ্ছে। কলস, গ্লাস ও মগের গায়ে ফুল, লতাপাতা, পাখি ও জ্যামিতিক ডিজাইন প্রধানত রেখার টানে খোদাই করা হয়। নিছক সৌন্দর্যচেতনা থেকে নিত্য ব্যবহার্য এসব দ্রব্য অলঙ্কৃত করা হয়। এ ধারার শিল্পীদের কাংস্যকার বা কাঁসারু বলা হয়। সোনা-রূপার অলঙ্কার নারীর জনপ্রিয় ভূষণ। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের আঙুল পর্যন্ত দেহের নানা অঙ্গের বহু প্রকার অলঙ্কার আছে। সোনার মতো মূল্যবান ধাতু নির্মিত অলঙ্কারের গায়ে খুব সূক্ষ্ম ও মনোরম শিল্পকর্ম থাকে। মাথার ঝাঁপ, কপালের টিকলি, গলার মালার লকেট, হাতের বাজু, পায়ের মল ইত্যাদি নানা ডিজাইনের হয়ে থাকে।

মকরমুখী মল নামেই প্রমাণ করে যে, এতে মকরের ডিজাইন করা হয়। টিকলির আকার হয় চাঁদতারার মতো। মালার সঙ্গে ফুল, প্রজাপতি ও জ্যামিতিক ছকের আকারবিশিষ্ট লকেট ঝুলানো থাকে। মূল্যবান পাথর, মণি ও মুক্তা খচিত বিভিন্ন অলঙ্কার। এতে অলঙ্কারের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়। এ শিল্পের কাজে স্বর্ণকার বা সোনারু নামে পেশাজীবী এক শ্রেণীর অতি দক্ষ কারিগর আছে। পটুয়া, কুমার, শাঁখারীর মতো সোনারু, কাঁসারুও বংশগত শিল্পিশ্রেণীভুক্ত।

পাট ও মুরতার তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প

পাটশিল্প  সোনালি অাঁশ বলে পরিচিত বাংলার  পাট দ্বারা চট, ম্যাট, ব্যাগ, থলি, ঝুড়ি, বস্তা, কার্পেট প্রভৃতি পণ্যদ্রব্য ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তৈরি হয়। এগুলি হস্তশিল্পের নমুনা। পল্লিরমণীর তৈরি নকশি শিকায় আছে শিল্পিমনের ছাপ। পাট, সুতা, কড়ি ও কাঁচ শিকার উপকরণ। চুলের বিনুনির মতো পাটের লরির ফাঁস তুলে শিকা তৈরি করা হয়। শিকার সাধারণ মোটিফ ফুল। এ ক্ষেত্রে তারাফুল, পুঁতিফুল ও টাকাফুলের নাম পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমীর সংগ্রহে একটি শিকায় পদ্মফুলের নকশা আছে। আকৃতি ও প্রকৃতির দিক দিয়ে মুঠাশিকা, চাকশিকা, কড়িশিকা, নেংটাশিকা প্রভৃতি নামভেদ আছে। কড়িশিকার গায়ে কড়ি গাঁথা হয়। অনুরূপভাবে কাঁচের টুকরা গেঁথেও শিকা বানানো হয়। ঘরের চালের বাতা অথবা বাঁশের সঙ্গে শিকা ঝুলিয়ে খাদ্যদ্রব্যাদি রাখা হয়।

বাঁশশিল্প

বাঁশশিল্প  কুটির নির্মাণ থেকে শুরু করে গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে নিত্য ব্যবহার্য নানা দ্রব্য বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। মাছ ধরার বেশির ভাগ যন্ত্রই বাঁশ ও সুতা দিয়ে তৈরি। পেশাজীবী ঘরামিরা ঘরবাড়ি; ছুতাররা গরুর গাড়ি, লাঙল, মই; ডোমরা ধামা, চ্যাঙারি, কুলা, ডালা, পাখা, চালুন, চাটাই ইত্যাদি জিনিস তৈরি করে। কৃষকরা নিজেরাও এ জাতীয় অনেক জিনিস তৈরি করে। একতারার ফ্রেম নির্মাণে বাঁশের বাতা এবং বাঁশি নির্মাণে সরু বাঁশের টুকরা ব্যবহূত হয়। এর অনেক কিছুর নির্মাণে মুন্সিয়ানা থাকলেও তা শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। ঘরের বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহূত দরমা বা পার্টিশনেও শিল্পের নমুনা আছে। ঢাকার জনৈক আবদুল হামিদের তৈরী একটি দরমায় উড়ন্ত হাঁস ও পুষ্পিত লতার মোটিফ সন্নিবেশিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ থেকে সংগৃহীত একটি দরমার বর্ডারে লতা ও জাফরি এবং মাঝখানে উড়ন্ত উড়োজাহাজের কারুকাজ আছে।  ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত একটি বাওঝাঁপে পানপাতা, ফুল ও জ্যামিতিক নকশা আছে। অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমদের সংগ্রহে বাঁশের তৈরি গৃহসজ্জার একটি সৌখিন দ্রব্য আছে। বৃত্তাকার এ অলঙ্করণের মাথায় একটি পদ্ম, চারদিকের বেষ্টনীতে পুষ্পিত লতা এবং মধ্যস্থলে দুটি ময়ূর মোটিফরূপে ব্যবহূত হয়েছে।  রংপুর থেকে সংগৃহীত বাঁশ-মালীদের একটি বিয়ের ডালির কাজও সুদৃশ্য। বাঁশের তৈরি নকশি পাখাতেও বুটি, সজীব গাছ, গাছে বসা পাখি, হাতি, ফুল, শঙ্খলতা ইত্যাদি মোটিফ আছে। এগুলিতে হাতের বুনন কৌশলে ফুটিয়ে তোলা হয়।

বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র

বেতশিল্প  বাঁশের মতো বেতের তৈরি নানা প্রকার আসবাবপত্র ও সৌখিন দ্রব্য। এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চেয়ার, মোড়া, সোফা সেট, বুক শেলফ, ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, পার্টিশন, হুঁকা প্রভৃতি নির্মিত হচ্ছে। এগুলি হস্তশিল্প হিসেবে উত্তম নিঃসন্দেহে, তবে কারুশিল্প হিসেবে ঐতিহ্যবাহী নকশি পাটি বা শীতলপাটির খ্যাতি ব্যাপক। মুর্তা নামক গুল্ম জাতীয় নল চিরে বাতা তৈরি করা হয়। সেগুলি যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি টেকসই। কোনোকুনিভাবে পাটি বোনা হয়। বুটি বুনন শিল্পকর্মের একটি সাধারণ মোটিফ। শীতলপাটিতে গাছ, পাখি, মন্দির, মসজিদ, হাতি, ঘোড়া, লতাপাতা মোটিফও দেখা যায়। বুননের সময় প্রয়োজনমতো রঙিন বাতা ব্যবহার করে উদ্দিষ্ট ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। সিলেটের শীতলপাটির সুনাম সর্বাধিক; ফরিদপুরেও নকশি পাটি তৈরি হয়। বেতের তৈরি নকশি হাত-পাখাও কারুশিল্পের নিদর্শন বহন করে। সিলেট থেকে সংগৃহীত একটি পাখায় পাশার ছক এবং অপর একটি পাখায় পালংপোষের ডিজাইন আছে।

মৃৎশিল্প

মৃৎশিল্প লোকশিল্পের একটি ব্যাপক ক্ষেত্র। কুম্ভকার নামে এক শ্রেণীর বৃত্তিজীবী লোকেরা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের উপযোগী মাটির যাবতীয় হাঁড়ি-পাতিল, খেলার পুতুল ও ঘর সাজাবার সৌখিন দ্রব্য তৈরি করে। পাল বা আচার্য নামের কুমারেরা হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করে। বাঁশ, খড়কুটা, মাটি, কাপড় ও রং দ্বারা নির্মিত এ মূর্তিগুলি অসাধারণ শিল্পকর্ম। এক্ষেত্রে বাংলার শিল্পীরা বহু প্রাচীন কাল থেকে বংশানুক্রমে দক্ষতা ও কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছে। কাদামাটি দিয়ে কুমাররা বিভিন্ন আকৃতি ও সাইজের হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে, যার কতকগুলি আবার অলঙ্কৃত করা হয়। কলস ও ঘটের মতো পাত্রের গায়ে কাঁচা থাকতেই কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও রেখাদির ডিজাইন করা হয়। এরপর ভাটিতে পুড়িয়ে সেগুলি স্থায়ী করা হয়। মানুষ ও জীবজন্তুর অবয়ববিশিষ্ট খেলনা পুতুলগুলি খোদাই পদ্ধতিতে রূপ দেওয়া হয়। কতক রূপ হয় স্পষ্ট, কতক প্রতীকধর্মী। মানুষের আকারবিশিষ্ট টেপা পুতুল প্রতীকধর্মী বিমূর্ত শিল্প। পীরের থানে উৎসর্গীকৃত মানতের ঘোড়াও প্রতীকধর্মী। এগুলি সাধারণত গ্রামের মেয়েরা তৈরি করে। এ ছাড়াও গৃহকর্মে রত নারী-পুরুষের নানা ভঙ্গির পুতুল আছে; সৌখিন লোকেরা এগুলি ঘরে সাজিয়ে রাখে। শহরবাসীদের ড্রয়িং রুমের শো-কেসেও এগুলি শোভা পায়।

শোলাশিল্প

শঙ্খশিল্প সমুদ্রজাত শঙ্খ দ্বারা শাঁখা, চুড়ি, বাজুবন্ধ, আংটি, লকেট, বোতাম, চুলের কাঁটা, ক্লিপ ইত্যাদি তৈরি করা হয়।  অধুনা সিন্দুরদানি, আগরদানি, ছাইদানি, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি সৌখিন ও ব্যবহার্য দ্রব্যও তৈরি হচ্ছে। এসব দ্রব্য কারুকার্য খচিত ও সুদৃশ্য। পেশাদার শিল্পী শাঁখারীরা এগুলির নির্মাতা। দ্বিমুখী করাত এর প্রধান হাতিয়ার। শাঁখারী ডিজাইন অনুযায়ী শঙ্খ কেটে নিয়ে ঘষেমেজে সেগুলিকে পরিষ্কার করে এবং তারপর তার গায়ে নকশা খোদাই করে বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরি করে। ঢাকার শাঁখারী পট্টির শঙ্খশিল্পের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য রয়েছে। সারা দেশের চাহিদা এখান থেকেই মেটানো হয়।

শোলাশিল্প  শোলা নরম ও হাল্কা জাতীয় এক প্রকার উদ্ভিদ; ধানক্ষেত ও জলাভূমিতে জন্মে। এ শোলা দিয়ে কারুকার্যময় হরেক রকম জিনিস তৈরি করা হয়। শোলানির্মিত প্রতিমার চালচিত্র ও বিয়ের বর-কনের টোপরের ব্যবহার হিন্দুসমাজে অতীতকাল থেকেই চলে আসছে। টোপরে কদম ফুলের ঝালর থাকে। শিশুতোষ খেলনা ও ঘরের সৌখিন সাজ শোলাশিল্পে বৈচিত্র্য এনেছে। বৃত্তিজীবী মালাকাররা এ শিল্পের রূপকার। তারা শোলা, সুতা, কাগজ, আঠা ও রঙের সাহায্যে পাখি, হাতি, ফুল, পুতুল, নৌকা, চাঁদমালা, ঝালর ইত্যাদি তৈরি করে মেলা ও হাটবাজারে বিক্রি করে। বৈষ্ণবগণ শোলানির্মিত রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রাসমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করে। তিন সারির কদম ফুল ও পাতার ‘মাঙ্গলিক’ নামের শোলার শিল্পকর্মটি একটি সৌখিন দ্রব্য; ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ব্রিটিশ আমলে শোলার হ্যাট জনপ্রিয় ছিল। ধারালো ছুরি ও কাঁচি এ শিল্পের প্রধান যন্ত্র। শুকনো শোলার ছাল খুলে এর সাদা অংশ ব্যবহার করা হয়। ছুরি দিয়ে প্রয়োজনমতো শোলা কেটে মালাকার হাতের কৌশলে এসব শিল্পকর্ম তৈরি করে। বাংলাদেশ,  পশ্চিমবঙ্গআসাম ও উড়িষ্যায় শোলাশিল্পের প্রচলন রয়েছে।

নকশি কাঁথা

বিবিধ  নকশি কাঁথা  বয়নশিল্প এবং পল্লিবাংলার নিজস্ব শিল্প। গ্রামের অতি সাধারণ মেয়েরা এ শিল্পের রূপকার। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে নকশি কাঁথার ব্যবহার আছে। তবে সূক্ষ্ম ও নয়নাভিরাম নকশার জন্য  রাজশাহীফরিদপুর ও  সিলেট জেলার খ্যাতি বেশি। পুরাতন পরিধেয় বস্ত্র কয়েক স্তরে সাজিয়ে কাঁথার জমিন তৈরি করে সুইসুতার সাহায্যে নকশা তোলা হয়। কেবল বিছানার কাঁথা ও লেপকাঁথা নয়, ব্যবহারভেদে আরও কয়েক প্রকার কাঁথা আছে যেগুলি নকশা দ্বারা দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়, যেমন: বালিশের ছাপা ও খোল, জায়নামায, পূজার আসন, আয়না-চিরুনি ও পান-সুপারি রাখার বটুয়া ও আরশিলতা, বই বাঁধার বস্তানি, তৈজসপত্র রাখার গাঁটরি, খাওয়ার আবরণী দস্তরখানা ইত্যাদি। কাঁথাগুলির ব্যবহারভেদে যেমন প্রকারভেদ আছে, তেমনি নকশা ও চিত্রভেদও আছে। কোনো প্রকার কাঁথায় কি অাঁকা হবে তা পূর্বনির্ধারিত থাকে না।

কল্কা

শিল্পী সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজস্ব ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে চিত্র নির্বাচন ও বুনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। তবে কাঁথার সাইজ অনুযায়ী চিত্রের ধরণ ও বৈচিত্র্য নির্ধারণ করতে হয়। কতক মোটিফ বিভিন্ন কাঁথার সাধারণ চিত্ররূপে স্থান পায়, যেমন: পদ্ম, সূর্য, চাঁদ-তারা, কল্কা, সজীব গাছ, তরঙ্গিত পুষ্পিত লতা, মানুষ, রাজা, দেবদেবী, ঘোড়া, হাতি, মাছ, পাখি, বর্ফি, তাজিয়া, মন্দির প্রভৃতি। যেহেতু কাঁথার কোনো অংশ খালি রাখা যায় না, সেহেতু পারিপার্শ্বিকতা থেকে টুকিটাকি জিনিস নির্বাচন করে ফাঁকা স্থান ভরাট করতে হয়। সাধারণত শাড়ির পাড়ের রঙিন সুতা দিয়ে এসব কাঁথা সেলাই করা হয়। কতক মোটিফের স্থান নির্ধারিত আছে, যেমন: পদ্ম ও সূর্য থাকে সাধারণত কাঁথার মধ্যস্থলে, কল্কা ও সজীব গাছ চার কোণায়, আর তরঙ্গিত পুষ্পিত লতা থাকে বর্ডারে; অন্যগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। চিত্রের বিন্যাস যেমনই হোক, সেলাই শেষে সম্পূর্ণ কাঁথাখানি একটি অভিন্ন শিল্পকর্মের রূপ ধারণ করে। প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আবেগ ও ভালবাসার সঙ্গে অসীম ধৈর্য, শ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে শিল্পী কাজ করে, আর এখানেই নিহিত নকশি কাঁথার সৌন্দর্য সৃষ্টির সাফল্য ও সার্থকতার চাবিকাঠি।

পিঠার ছাঁচ

নকশি ছাঁচ  লোকশিল্পকলার একটি স্থায়ী ফর্ম। মাটি, পাথর অথবা কাঠ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের ছাঁচ তৈরি করা হয়। এ ছাঁচে ফেলে বস্ত্তকে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপদান করা হয়। কাঠের নকশা করা ছাঁচে রং লাগিয়ে কাপড় ও কাঁথা ছাপানো হয়। কাঠ, মাটি ও পাথরের ছাঁচে মিঠাই, ক্ষীর, আমসত্ত্ব, গুড়ের পাটালি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। হিন্দুসমাজে ছাঁচ দিয়ে ক্ষীরের স্বস্তি ও পুতুল বানানো হয়। পাথরের টুকরার উপর মনোহর লতাপাতা ও ফুলফল খোদিত করে ক্ষীরের স্বস্তির ছাঁচ তৈরি হয়। আমসত্ত্বের ছাঁচের নকশায় আছে পদ্ম, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী। ছাঁচে তৈরী মিছরির মঠে ময়ূর ও পরীর ছবি আছে। খাদ্যবস্ত্তকে সুদৃশ্য করার উদ্দেশ্যে এরূপ ছাঁচের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কাঠের ছাঁচ তৈরীতে ছুতার মিস্ত্রির দরকার হয়, কিন্তু মাটির ছাঁচ তৈরি করে পল্লীর ললনারাই।

নকশি পিঠা

নকশি পিঠা  চালের আটা রুটির মতো পুরু করে বেলে নিয়ে খেজুর কাঁটা অথবা বাঁশের ছিলকা দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইনের নকশি পিঠা তৈরি করা হয়। তারপর তেলে ভেজে চিনি অথবা গুড়ের সিরায় ভিজিয়ে পরিবেশন করা হয়। ‘পাকুয়ান পিঠা’ এর অপর নাম। চাকা, পানপাতা, ফোটাফুল, মাছ, পাখি প্রভৃতি নকশি পিঠার সাধারণ মোটিফ। এ ছাড়াও কিছু বিমূর্ত ডিজাইনও আছে। কন্যামুখ, জামাইমুখ, সতীন মুচড়া, চম্পাবরণ ইত্যাদি এ জাতীয় নকশি পিঠা। প্রকৃতপক্ষে এগুলি হলো নানা ধরনের জ্যামিতিক ছক।  ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায় নকশি পিঠার কদর বেশি। বিয়ের অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন আপ্যায়নের এটি একটি আবশ্যক উপকরণ। স্বল্পস্থায়ী খাদ্যবস্ত্তকে এরূপ নকশাদার করে প্রস্ত্তত করার মধ্যে বাঙালি নারীদের সুরুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

ওপরের আলোচনা থেকে লক্ষ করা যায় যে, বাংলার লোকশিল্পের বিস্তৃত ভুবনে পেশাজীবী কতগুলি পরিবার আছে, যেখান থেকে বংশপরম্পরায় এরূপ শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। তারা কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হাতে-কলমে কাজ করতে করতে দক্ষ কারিগরে পরিণত হয়। তারা শিল্পের মোটিফ সংগ্রহ করে সমাজ ও প্রকৃতি থেকে। লোকশিল্পীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের অতি সাধারণ ও সুলভ উপকরণ দিয়ে কারুকার্যখচিত নয়নাভিরাম শিল্পদ্রব্য তৈরি করে। বাংলাদেশে ধর্ম, জীবিকা ও আনন্দবিধান এ ত্রিবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত বর্ণিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকশিল্পের এক বিশাল ভান্ডার গড়ে উঠেছে। [ওয়াকিল আহমদ]

গ্রন্থপঞ্জি দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ (১ম খণ্ড), কলকাতা, ১৯৩৪; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার ব্রত, কলকাতা, ১৯৪৭; তোফায়েল আহমদ, লোক-ঐতিহ্যের দশ দিগন্ত, ঢাকা, ১৯৯৯; Ajit Mookherjee, Folk Toys of India, Calcutta, ১৯৫৬।