মনসা
মনসা বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় সর্পদেবী। মধ্যযুগের লোককাহিনীবিষয়ক মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র। প্রতিটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর গাথা-কাহিনীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে সর্প-সংশ্লেষ। প্রাচীন মেসোপটমিয়া, মিশর, গ্রিস, ক্রিট, ফিনিশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া প্রভৃতি দেশে সর্পপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩০০০ অব্দের সুমেরিয় শিল্পকলার নিদর্শনে দুটি পেচানো সাপের প্রতীকী উপস্থাপনা দেখা যায়। মিশরের ফারাওদের প্রতীক ছিল সাপ এবং ঈগল। এছাড়া তাদের ভূদেবতার মাথা ছিল সর্পাকৃতির এবং তিনি ছিলেন সকল সাপের অধিষ্ঠাতা দেবতা। হরপ্পা সভ্যতার সিলে সর্প-মানবের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে আসা সঙ্গীদের বর্ণনায় ভারতবর্ষে সর্পপূজার জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আলেকজান্ডার যখন ভারতে একের পর এক নগর অধিকার করছিলেন তখন তিনি কোনো এক স্থানে অন্যান্য পশুর সঙ্গে বৃহদাকৃতির সাপকে গুহার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান। অথর্ববেদে প্রথমবারের মতো ঘৃতাচী নামক কিরাত কন্যার সর্পবিশ নাশের ক্ষমতার বর্ণনা পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্রে সর্পদংশন থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সে উপায় বর্ণিত হয়েছে- বর্ষাকালে চার মাস মাটিতে শয্যা নিষিদ্ধ, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা রাতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উঁচু শয্যা এবং কয়েক মাস পরে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় প্রত্যাবোরহন নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় ঘরের মেঝেতে শয্যা যাপন শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে সর্পদংশন থেকে রক্ষা পেতে শ্রাবণ-পূর্ণিমা থেকে অগ্রাহায়ণ-পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রত্যহ সাপের উদ্দেশে বিভিন্ন ভোগ দেওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায় দেবী মনসার পূজা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পালন করে। বর্ষার প্রকোপে এ সময় সাপের বিচরণ বেড়ে যায়, তাই সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভক্তকূল দেবীর আশ্রয় প্রার্থনা করে। এছাড়া ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতির জন্য সর্পদেবীর ভক্ত তার দ্বারস্থ হয়। মনসা একজন লৌকিক দেবী। তবুও তার অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে হিন্দু সমাজের সকল সম্প্রদায় তাকে দেবী হিসেবে মর্যাদা দেয়। আদি পুরাণগুলিতে মনসার কোনো উল্লেখ নেই। অপেক্ষাকৃত নবীন পুরান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান ও দেবীভাগবত পুরাণে মনসার উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গাথা কাহিনী।
মনসার উৎপত্তি বিষয়ে পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যে রয়েছে দু’ধরণের ভাষ্য। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী ব্রহ্মার নির্দেশে কশ্যপ মুনি সর্প বিষনাশক মন্ত্র রচনাকালে ধ্যানমগ্নাবস্থায় মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আবির্ভাব ঘটে এবং তার মন থেকে আবির্ভাব ঘটায় দেবীর নাম হয় মনসা। পরবর্তী সময়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় জরৎকারু মুনির সঙ্গে। মহাভারতে কশ্যপ ও কদ্রুর বিয়ে এবং তাদের ঘরে সহস্র সর্পের জন্ম সে সঙ্গে জরৎকারু ঋষির সঙ্গে সর্পরাজ বাসুকির বোন জরৎকারুর বিয়ে এবং আস্তিক মুনির জন্মলাভের কাহিনী বিবৃত হয়েছে।#
পরবর্তী সময়ে আস্তিক মুনি রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ হতে মাতৃকূলকে রক্ষা করেন অর্থাৎ নাগ বংশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। মহাভারতে মনসা নামক কোনো সর্প দেবীর উল্লেখ নেই। তবে এ কাহিনী ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান ও দেবীভাগবতম পুরাণে জরৎকারু স্ত্রী স্বনাম্নি জরৎকারুর স্থান দখল করেছে মনসা। পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী মনসা কশ্যপ মুনির কন্যা। তিনি জন্মের পর কৈলাসপর্বতে গিয়ে হাজার বছর আরাধনা করে মহাদেবের কাছ থেকে দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে, কশ্যপ মুনি কন্যা মনসাকে জরৎকারু ঋষির নিকট সম্প্রদান করেন। কোনো এক সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় ঘুমন্ত স্বামীকে উপাসনার জন্য জাগালে, জরৎকারু ক্রোধান্বিত হয়ে স্ত্রী পরিত্যাগে উদ্যত হলে মনসার কাতর আহবানে বিষ্ণু, মহাদেব, কশ্যপ মুনির নিকট উপস্থিত হয়ে স্ত্রী পরিত্যাগে জরৎকারুকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়। তবে নিজ ধর্ম রক্ষার্থে মনসার গর্ভে পুত্র উৎপাদনের আদেশ করেন দেবতাগণ। জরৎকারু দেবতাদের অনুরোধ রক্ষা করতে মন্ত্রবলে মনসার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন। সন্তানের নাম রাখা হয় আস্তিক, যিনি রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ থেকে মাতৃকূল রক্ষা করেন। পুরাণে এভাবেই মনসার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। পুরাণে মনসাকে কশ্যপ ও জরৎকারুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ফলে তিনি মর্যাদা লাভ করেন।
অন্য এক কাহিনীতে, মঙ্গলকাব্যের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মনসা ও চাঁদ সওদাগরকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচলনের প্রধান বাধা চাঁদ সওদাগর। চাঁদ শিব উপাসক তাই সে নিম্নবর্গের উপাস্যকে অর্ঘ্যদানে অনাগ্রহী। কিন্তু চাঁদ সওদাগর যতটা অনাগ্রহী মনসা ততটাই আগ্রহী কারণ চাঁদের পূজা না পেলে ধরণীতে তার পূজা প্রতিষ্ঠিত হবে না। চাঁদের স্ত্রী মনসার উপাসক, মনসা চাঁদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একে একে তার ছয় ছেলেকে বাণিজ্য জাহাজসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। সর্বশেষ সন্তান লখিন্দরকে মনসার নির্দেশে বাসরঘরে সর্প দংশন করে। পুত্রবধূ বেহুলা স্বামী লখিন্দরের লাশ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে নদী পথ ধরে দেবপুরের উদ্দেশ্যে গমন করে এবং নানা বিপদ-আপদ পেরিয়ে অবশেষে নৃত্যগীতে দেবতাদের তুষ্ট করে। মহাদেব ও অন্যান্য দেবতাদের নির্দশে মনসা চাঁদ কর্তৃক ধরণীতে পূজার শর্তে লখিন্দরের জীবন সেই সঙ্গে চাঁদের অন্যান্য পুত্রদের সপ্তডিঙ্গাসহ ফিরিয়ে দেয়। বেহুলা ও চাঁদের স্ত্রী শুলকার পুনঃপুনঃ অনুরোধে অবশেষে চাঁদ মনসাকে পূজা দিতে রাজি হয় এবং মর্ত্যলোকে প্রতিষ্ঠিত হয় মনসা পূজা।
মঙ্গলকাব্যে শিবের কন্যা হিসেবেও দেখানো হয়েছে মনসাকে। বাংলায় শিব এক অতিসাধারণ হতদরিদ্র দেবতা যিনি কুঁড়েঘরে বাস করেন, যার সঙ্গে সমুদ্র মন্থনে প্রাপ্ত অনল পানকারী ত্রিশূলধারী পৌরাণিক শিবের অনেক পার্থক্য। বাংলায় শিব সাধারণের আপনজন হিসেবে ‘প্রভু’ ও গোসাই’ হিসেবে পরিচিত- যার প্রতীক লাঙল। মঙ্গলকাব্যের এ কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে সাধারণের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় এক দেবীর অনেক প্রচেষ্টার পর উচ্চবর্গের স্বীকৃতি আদায়ের বিবরণ। কোনো কোনো মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার আরেক নাম সিদ্ধযোগিনী।
মনসা নামটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত- কারো মতে, ভারতের কানাড়া অঞ্চল থেকে ‘মনে-মাঞ্চাম্মা’ নামক দেবীর নাম থেকে মনসা নামটি এসেছে, কারো মতে মহীশূরের ‘মুদামা’ নামক দেবীর নাম থেকে নামটি বাংলায় এসেছে। আবার কারো মতে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরাঞ্চল প্রদেশের ‘মনসা’ দেবী বা মধ্যপ্রদেশের কোল উপজাতীয়দের ‘মনসা দেও’ নামক দেবতার নাম থেকে এসেছে নামটি। মনে-মঞ্চাম্মা’র অস্তিত্ব বাস্তবে নেই, সে এক অদৃশ্য সাপিনীর নাম, এ সাপিনীর উপর দেবীত্ব আরোপ করে বছরে একদিন নাগপঞ্চমীর দিনে পূজা নিবেদন করা হয়, তার কোনো প্রতিমা নির্মিত হয় না। মুদামা অর্ধ-নারী অর্ধ-সর্প আকৃতির প্রতিমা এবং নিম্নবর্গ কর্তৃক পূজিত কিন্তু সমাজের উচ্চকোটিতে পৌরাণিক চরিত্র সর্পরাজ বাসুকি জনপ্রিয়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরাঞ্চল প্রদেশের মনসা কোনো উল্লেখযোগ্য দেবী নয় আর মনসা দেও কোনো দেবী নয় দেবতার নাম। ফলে বাংলার জনপ্রিয় দেবী মনসার নাম এসব অপ্রধান দেবী থেকে আসার সম্ভাবনা কম। মনসা এদেশেরই দেবী।
মনসার নানাপ্রকার প্রস্তর, ব্রোঞ্জ ও পোড়ামাটির প্রতিমা পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। মূর্তিগুলোর অধিকাংশ চার বা দুই হাত বিশিষ্ট। উপবিষ্ট অবস্থায় উপস্থাপিত মনসার একপাশে স্বামী জরৎকারু অন্যপাশে ভাই ও নাগরাজ বাসুকি, কখনো কোলে সন্তান আস্তিক। মাথায় সাত ফনাযুক্ত মুকুট। ডান হাত ফলাঞ্চলিহস্ত, বাম হাতে কোলে আস্তিক কখনো বা সাপ থাকে। চার হাত বিশিষ্ট মনসার ক্ষেত্রে উপরের দুহাতে পানপাতা এবং নিচের ডানহাত ফলাঞ্চলিহস্ত ও বাম হাতে আস্তিক। ব্যতিক্রমও দেখা যায় কোনো প্রতিমায়। রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের চার হাত বিশিষ্ট মনসা প্রতিমাটি যোগাসনে উপবিষ্ট-নিচের ডানহাতে জপমালা, উপরের ডান হাতে সাপ এবং নিচের বা হাতে পান্ডুলিপি ও উপরের বা হাতে ঘট।
বগুড়ার মঙ্গলকোটে পাওয়া গেছে মনসার আদিতম প্রতিমা; দুহাত বিশিষ্ট প্রতিমাগুলির ডান হাত ফলাঞ্জলিহস্ত ও ডান হাতে কোলে আস্তিককে ধরে আছে। কোনটিতে আস্তিকের সঙ্গে ঘটের উপস্থিতি চোখে পড়ে। মাথায় সর্পফণা বিশিষ্ট মুকুট রয়েছে। গুপ্তযুগের এ প্রতিমাগুলির সময় ৫/৬ শতক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে আটচল্লিশটিরও বেশি মনসা প্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়াও মনসামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত মনসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকটি চরিত্রের নামে বগুড়া জেলার প্রত্নক্ষেত্রের নাম পাওয়া যায়। যেমন, বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর, নেতাই ধোপানির পাট, ওঝা ধনন্তরীর ভিটা, চাঁদের বাড়ি, চাঁদের ধাপ, গোদার ধাপ- ফলে ধারণা করা হয় এ অঞ্চলে মনসা কাল্ট অনেক গভীরে প্রোথিত এবং উত্তরবঙ্গ থেকেই মনসা দেবীর উৎপত্তি।
মনসার যেসব প্রস্তর ও ধাতব প্রতিমা পাওয়া যায় সেগুলো প্রায় সবগুলি মুসলমান পূর্বযুগের। মুসলমান আগমনের পর মনসা প্রতিমা নির্মাণ রীতিতে পরিবর্তন আসে। প্রস্তর ও ধাতব প্রতিমার পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে মৃন্ময় প্রতিমার প্রচলন শুরু হয়। প্রতিমালক্ষণেও দেখা দেয় পরিবর্তন। এ সময় পৌরাণিক যুগের অবসান ঘটে মঙ্গলকাব্যের যুগের সূচনা হয়। এ সময় মনসার কাহিনীর সঙ্গে জড়িত হয় জড়ৎকারু, বাসুকি ও আস্তিক মুণির পরিবর্তে চাঁদ সওদাগর, লখিন্দর, বেহুলা, শুলকা। মনসার বাহন হয় ব্রহ্মা ও সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। কোথাও মনসার চার হাতের তিন হাতে সাপ একহাতে বর প্রদান করেন, কোথাও সব হাতেই সাপ, আট সাপের ফণা অষ্টনাগ মনসা হিসেবে, কোথাওবা ঘট আকৃতিতে ইত্যাদি নানা আকারে মনসা প্রতিমা পাওয়া যায়। [মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া]