রাজশাহী জেলা

রাজশাহী জেলা (রাজশাহী বিভাগ)  আয়তন: ২৪২৫.৩৭ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°০৭´ থেকে ২৪°৪৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°১৭´ থেকে ৮৮°৫৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে নওগাঁ জেলা, দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য , কুষ্টিয়া জেলা ও পদ্মা নদী, পূর্বে নাটোর জেলা, পশ্চিমে নবাবগঞ্জ জেলা। এ জেলা বরেন্দ্রভূমি, দিয়ারা ও চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত।

জনসংখ্যা ২৫৯৫১৯৭; পুরুষ ১৩০৯৮৯০, মহিলা ১২৮৫৩০৭। মুসলিম ২৪৩০১৯৪, হিন্দু ১২২৩৯৪, বৌদ্ধ ১৩৪, খ্রিস্টান ২৭৮৩০ এবং অন্যান্য ১৪৬৪৫। এ জেলায় সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।

জলাশয় প্রধান নদী: পদ্মা, মহানন্দা, শিব। গোদাগাড়ীর পালতোলা বিল এবং চলন বিল উল্লেখযোগ্য।

প্রশাসন রাজশাহী জেলা গঠিত হয় ১৭৭২ সালে। এ জেলা ভেঙ্গে পর্যায়ক্রমে গঠিত হয় মালদহ, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ ও নবাবগঞ্জ জেলাসমূহ। ১৮৭৬ সালে রাজশাহী শহরটি পৌরসভায় এবং ১৯৯১ সালে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে রাজশাহী একই সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর ছিল। এ শহর ১৮৭৬ সালের ১ এপ্রিল পৌরসভা, ১৯৮৭ সালের ১৩ আগস্ট পৌর-কর্পোরেশনের অধীন হয়। জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলা সর্ববৃহৎ (৪৭৫.২৬ বর্গ কিমি) এবং সবচেয়ে ছোট উপজেলা মোহনপুর (১৬২.৬৫ বর্গ কিমি)।

জেলা
আয়তন (বর্গ কিমি) উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
শহর গ্রাম
২৪২৫.৩৭ ১৪ ৭১ ১৪৮১ ১৭৩০ ৮৫৪৬১৯ ১৭৪০৫৭৮ ১০৭০ ৫৩.০
সিটি কর্পোরেশন (আদমশুমারি ২০০১)
সিটি কর্পোরেশন মেট্রোপলিটন থানা ওয়ার্ড মহল্লা
৩৫ ১৭০
মেট্রোপলিটন থানা
মেট্রোপলিটন থানার নাম আয়তন (বর্গ কিমি) ওয়ার্ড মহল্লা ও মৌজা জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
বোয়ালিয়া ৩৮.৫৬ ২১ ৮২ ১৯১৭১১ ৪৯৭২ ৭১.২২
মতিহার ২০.৫৬ ২০ ৫১৭২৪ ২৫১৬ ৬৩.৫৫
রাজপাড়া ২৫.১৯ ১০ ৪৬ ১২১০৭৬ ৪৮০৭ ৬৯.৭০
শাহ মখদুম ১২.৮৭ ২২ ২৪৩০০ ১৯৬৪ ৬৩.৮৬
জেলার অন্যান্য তথ্য
উপজেলা নাম আয়তন (বর্গ কিমি) পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
গোদাগাড়ী ৪৭৫.২৬ ৩৫৫ ৩৯৯ ৩৩০৯২৪ ৬৯৬ ৪৬.৩
চারঘাট ১৬৪.৫০ ৮৪ ১১৫ ২০৬৭৮৮ ১২৫৭ ৪৭.৭
তানোর ২৯৫.৪০ ১৭৭ ১৬৯ ১৯১৩৩০ ৬৪৮ ৪৮.৮
দুর্গাপুর ১৯৭.৮৯ ৯৮ ১০৭ ১৮৫৮৪৫ ৯৩৯ ৪৮.২
পবা ৩৪০.০৩ ১৪১ ২০৯ ৩১৪১৯৬ ৯২৪ ৫০.৩
পুঠিয়া ১৯২.৬৩ ১২৩ ১৮৩ ২০৭৪৯০ ১০৭৭ ৪৯.৬
বাগমারা ৩৬৬.২৬ ১৬ ২৭৩ ৩৩২ ৩৫৪৬৬৪ ৯৬৮ ৪৬.৩
বাঘা ১৮৫.১৬ ৮২ ৭৮ ১৮৪১৮৩ ৯৯৫ ৪৯.৬
মোহনপুর ১৬২.৬৫ ১৪৮ ১৩৮ ১৭০০২১ ১০৪৫ ৫১.৩

সূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে ইপিআর সিপাহি আব্দুল মালেক শহীদ হন। ২৬ ও ৩০ মে গোদাগাড়ী উপজেলায় পাকবাহিনী ৩১ জন লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৩ এপ্রিল পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর ব্রিজের কাছে কলেজের অধ্যাপকসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৪ মে পাকসেনারা তাহিরপুর হাটে অতর্কিত আক্রমণ করে ২৫ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে। ৪ আগস্ট হাবিলদার শফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাহিরপুরের নিকট পাকসেনাদের টহলনৌকায় আক্রমণ চালালে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। নগর বাড়ি অতিক্রমরত পাকবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন চারঘাটের আনসার বাহিনীর ১ জন সদস্য। সারদা, বানেশ্বর, আড়ানী ব্রিজ প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর লড়াই সংঘটিত হয়। বানেশ্বর এবং সারদা পতনের পর গ্রামবাসী পদ্মানদীর ধারে আশ্রয় গ্রহণ করলে পাকবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে এবং ৮০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা হলে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শত শত লোককে হত্যা করে নিকটস্থ মাঠে মাটিচাপা দেয়। পাকসেনারা চারঘাটের প্রবেশমুখে বানেশ্বরে নাদের চেয়ারম্যান এবং সারদা বাজারে আনসার বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে। তারা পদ্মার তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান কয়েকশত নিরস্ত্র মানুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে এবং চারঘাট বাজার পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, ক্যাডেট কলেজ, সারদা পাইলট স্কুল, রায় সাহেবের ইটভাটা প্রভৃতি স্থানে অস্থায়ী সেনাছাউনিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং নারীদের নির্যাতন করা হতো। পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের সোনাইকান্দি গ্রামে ২৭ জন যুবককে দিয়ে পাকসেনারা একটি গণকবর খনন করায় এবং পরে তাদের সবাইকে হত্যা করে গণকবরে পুঁতে রাখে। একই ইউনিয়নের বোলনপুর পুলিশ ক্যাম্পে পাকসেনারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ক্যাম্পের পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে একটি ইটের ভাটায় কবর দেয়। কসবা আখ ক্রয়কেন্দ্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রাস্তায় টহলরত পাকবাহিনীর একটি গাড়ি অ্যামবুশ পেতে ধ্বংস করে। এতে ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পবা ও দুর্গাপুর উপজেলা সীমান্তে অবস্থিত কাবাসমূল নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে একজন পাকিস্তানি মেজর নিহত হলে বিক্ষুব্ধ পাকসেনারা গাগনবাড়ীয়া ও পালসা গ্রামের ৪৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। জেলার ৬টি স্থানে গণকবর এবং ২টি স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে; বিভিন্ন স্থানে ৪টি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।

শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৫০.০%; পুরুষ ৫৫.৮%, মহিলা ৫০.১%। বিশ্ববিদ্যালয় ২, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ১, মেডিকেল কলেজ ২, কলেজ ১৪৯, ক্যাডেট কলেজ ১, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ১, শারীরিক শিক্ষা কলেজ ১, প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ১, ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি ১, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ২, সার্ভে ইনস্টিটিউট ১, সেবিকা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ১, আঞ্চলিক লোক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ১, ডিপ্লোমা ইন কমার্স ইনস্টিটিউট ১, ভোকেশনাল স্কুল ২৬, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৬০, প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০২৮, কিন্ডার গার্টেন ও এনজিও স্কুল ৪৭, মাদ্রাসা ২১১। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৩), রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (১৯৬২), রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩), সারদা ক্যাডেট কলেজ (১৯৬৬), রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমি (১৮৯৮), রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল (১৮২৮), লোকনাথ উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৪৭), পুঠিয়া পি এন টেকনিক্যাল হাইস্কুল (১৮৬৫), তালোন্দ আনন্দ মোহন উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৮২), পি এন উচ্চবালিকা বিদ্যালয় (১৮৮৬), ডায়মন্ড জুবিলী ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল (১৮৯৮), সারদা পুলিশ একাডেমি (১৯১২), বীরকুৎসা অবিনাস হাইস্কুল (বাগমারা, ১৯১৭), রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৬), গোদাগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৪৮), মোহনপুর পাইলট হাইস্কুল (১৯৪৮), সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুল (১৯৬৯), শলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (চারঘাট, ১৮৮৫), হলদিগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (চারঘাট, ১৮৯৫), শ্রীধর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (দুর্গাপুর, ১৮৫৭), শীতলাই খরখড়ী ও নওহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় (পবা, ১৮৮৪), রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা (১৮৭৪)।

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান প্রধান উৎস   কৃষি ৫৯.৩৫%, অকৃষি শ্রমিক ৩.৩৬%, শিল্প ০.৯৯%, ব্যবসা ১৪.২৫%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ৪.৩৬%, চাকরি ৮.৯৭%, নির্মাণ ১.৪৫%, ধর্মীয় সেবা ০.১২%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৪১% এবং অন্যান্য ৬.৭৪%।

পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক: বার্তা (১৯৭৬), সোনার দেশ (১৯৮৪), সানসাইন (১৯৮৬), উপাচার (১৯৯৪), লাল গোলাপ (১৯৯৬), আজ (১৯৯৭), প্রথম প্রভাত (২০০০), চেনা জগত (২০০১), নতুন প্রভাত (২০০২), সোনালী সংবাদ (১৯৯৩); সাপ্তাহিক: দুনিয়া (১৯৯৭), রাজশাহী বার্তা (১৯৬১), গণখবর (১৯৯৩), সুবর্ণ সংবাদ (২০০৩), ধরণী (১৯৯৮), উত্তর জনপদ (১৯৯৮); মাসিক:  নব প্রবাহ (১৯৯২),  আত্ তা্হরিক (১৯৯৭), লোকপত্র (২০০১), প্রযুক্তি প্রবাহ (২০০৩), আল মাযহার (২০০৩), নির্ঝর (১৯৯৬); ত্রৈমাসিক: লোক সংস্কৃতি (১৯৯৭), হক কি আওয়াজ (২০০২); অবলুপ্ত পত্র-পত্রিকা: হিন্দু রঞ্জিকা (১৮৬৫), রাজশাহী সংবাদ (১৮৭০), জ্ঞানাঙ্কুর এবং প্রতিবিম্ব (১৮৭২), রাজশাহী সমাচার (১৮৭৫), উদ্বোধন (১৮৮২), চিকিৎসা (১৮৮৯), উৎসাহ (১৮৯৭), ঐতিহাসিক চিত্র (১৮৯৮), নূর আল ইমান (১৯০০), বংগ মহিলা (১৯১৫), পল্লী বাহক (১৯২৫), মারকাব আল ইসলাম (১৯৩৩), পল্লী শক্তি (১৯৩৪), সম্মিলন (১৯৩৪), একতারা (১৯৪৩), নয়া জামানা (১৯৪৬), অভিধারা (১৯৪০), ছাত্রলীগ (১৯৪৭), দীপালি (১৯৪৯), দিশারী (১৯৫০), প্রবাহ (১৯৫৩), যাত্রী (১৯৬০), পূর্বমেঘ (১৯৬২), পাপড়ি (১৯৬২), পরিচয় (১৯৪৩), এন্টিক রিভিউ (১৯৩৩), নতুন বাংলা।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রাজশাহী কলেজের মূলভবন (১৮৮০), সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের পুরাতন ভবনাদি, পানসিপাড়া রাজবাড়ী কুঠি (বর্তমান বোয়ালিয়া ক্লাব), বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ (ভাস্কর্য), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ, ভদ্রায় স্মৃতি অম্লান, কোর্টচত্বর শহীদ মিনার, ভুবন মোহন পার্ক শহীদ মিনার, রাজশাহী কলেজ শহীদ মিনার, তালাইমারী শহীদ মিনার, বিসিএসআইআর (সায়েন্স) ল্যাবরেটরী, সেরিকালচার রিসার্চ ইনন্সিটিউট, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ফল গবেষণা কেন্দ্র।

লোকসংস্কৃতি গম্ভীরা, কবিগান, মেয়েলী গীত, ছড়া, পুতুল নাচ, লোকনাট্য, উপকথা, ধাঁধাঁ উল্লেখযোগ্য। [মো. মাহবুবর রহমান]

আরও দেখুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা।

তথ্যসূত্র   আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ ও ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; রাজশাহী জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭; রাজশাহী জেলার উপজেলাসমূহের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।