বিবাহ

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে।

নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই বিয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হলেও শাস্ত্রীয় বিধানে বৈদিক যুগ থেকেই বিবাহ নারী-জীবনের প্রধান প্রাপ্তি ও পরম সার্থকতা বলে বিবেচিত, নারীর জন্য বিবাহ অপরিহার্য, পুরুষের জন্য নয়। ঋগ্বেদে বিয়ের সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ আছে।

মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্মবিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন।

হিন্দু শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং কৌটিল্যের মতে পুত্রপ্রজননই নারীর প্রধান কাজ। শাস্ত্রীয় বিধানমতে আট বছরের মধ্যে কোনো সন্তান প্রসব না করলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে। আর দশ বছরের মধ্যে স্ত্রী শুধু কন্যাসন্তান প্রসব করলে অথবা বারো বছর পর্যন্ত শুধু মৃত পুত্র প্রসব করলে, স্বামী পুত্রলাভার্থে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে। মনুর মতও তাই: ‘প্রজনার্থং স্ত্রিয় সৃষ্টা’- প্রজননের জন্যই স্ত্রীলোকের সৃষ্টি।

প্রকৃতভাবে সব সংস্কৃতিতেই বিয়ের উদ্ভব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজস্ব তত্ত্ব আছে। তবে বিবাহ ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা প্রশ্নে তাত্ত্বিকগণ মনে করেন বিবাহ নারীকে মাতা করে আর সন্তানের প্রতি মাতার যত দায়িত্ব পিতার ততটা কখনো মনে করা হয় নয়।

প্রাচীন বাংলায় একজন স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের সাধারণ প্রত্যাশা, তবে এর ব্যতিক্রমও ছিল। ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি আইনগত, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধান। ইসলামে বিবাহ বলতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও ধর্মীয়ভাবে নির্ধারিত একটি চুক্তি বোঝায়। এই চুক্তির মাধ্যমেই একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়।

মুসলিম বিবাহের চুক্তিপত্রে (যা কাবিননামা নামে পরিচিত) উল্লেখ করতে হয় বরের পক্ষ থেকে স্ত্রীকে প্রদেয় মোহরানার পরিমাণ। স্ত্রীকে দেয়া স্বামীকর্তৃক প্রদত্ত অর্থকে বলা হয় দেনমোহর। তাৎক্ষণিকভাবে দেনমোহর পরিশোধ স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক যদিও স্ত্রী এ দায়িত্ব থেকে স্বামীকে স্বেচ্ছায় মওকুফ করে দিতে পারেন বা পরে গ্রহণ করার অনুমতি দিতে পারেন। মুসলিম আইন অনুসারে দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর একটি বিশেষ অধিকার। দেনমোহর নির্ধারণ পাত্র-পাত্রীর আর্থসামাজিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। দেনমোহরের অর্থ স্ত্রী যে কোনো সময়ে দাবি করতে পারে এবং স্বামী তা পরিশোধ করতে বাধ্য। কিন্তু এ বিধান কেবলই একটি আনুষ্ঠানিকতা; স্ত্রী কদাচিৎ দেনমোহর দাবি করে এবং প্রকৃতপক্ষে দেনমোহর এখন বিরল পরিশোধ করা হয়। এটি সামাজিক বিত্তের একটি নিদর্শনে পরিগণিত। মোহরের অংক সাধারণত দুটি ভাগ করা হয়: নগদ ও বাকি। নগদ হিসেবে ঘোষিত অংক সাধারণত বরপক্ষ কর্তৃক উপহার হিসেবে প্রদত্ত স্বর্ণালঙ্কারের মূল্যবাবদ পরিশোধকৃত বলে ধরা হয়। বাকি অংশ পরবর্তীকালে অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে স্বামীর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পরিশোধ করতে হয়। এটা সামাজিক প্রথা।

যৌতুকপ্রথা বিয়ে সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিয়েতে পণপ্রথা হিন্দু ধর্মে একটি স্বীকৃত রীতি। চর্যাপদে বিবাহের সময়ে বরপক্ষকে যৌতুক গ্রহণ করতে দেখা যায়। তাতে মনে হয় পণ প্রথা অনেক প্রাচীন। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের বিবাহব্যবস্থায় পণ ও যৌতুক প্রথা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিবর্তিত হয়ে বাস্তবে একই রূপ পরিগ্রহ করেছে। বর্তমানে যৌতুক একটি বড় সামাজিক ব্যাধি।

বাংলার হিন্দু পরিবারগুলির মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। হিন্দু সমাজে ছেলেমেয়েদের বিশেষ করে মেয়েদের, বাল্যকালে বয়ঃসন্ধির পূর্বেই বিবাহ দেওয়াকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। প্রাচীন হিন্দু আইনপ্রণেতা মনু নারীর বিয়ের বয়সের যে বিধান দিয়েছেন, তা হলো তিরিশ বছরের পুরুষ বারো বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে। চবিবশ বছরের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম লঙ্ঘিত হয়। মনু আবার বিধান দিয়েছেন, ‘কন্যা ঋতুমতী হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে আত্মীয়স্বজন তার বিয়ে না দিলে, কন্যা নিজের মনমতো পাত্র নির্ধারণ করলে কোনো বাঁধা নেই।’

উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ভারতে যে সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার উল্লেখযোগ্য একটি দিক ছিল বাল্যবিবাহের বিরোধিতা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। ১৮৭২ সালে হিন্দু বিবাহ আইন পাশ হলে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স মেয়েদের ১৪ এবং ছেলেদের ১৮ ধার্য করা হয়।

১৯২১ সালের আদমশুমারিতে বিয়ের গড় বয়স মেয়েদের ১২ এবং ছেলেদের ১৩ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন (Child Marriage Restraint Act) পাশ হয়। এ আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচের পাত্রী এবং ১৮ বছরের নিচের পাত্রের বিবাহ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বহুবিবাহ প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে প্রচলিত ছিল। জীমূতবাহনের ব্যাখ্যায় এবং প্রাচীন শিলালিপিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ চার পত্নী, ক্ষত্রিয় তিন পত্নী আর বৈশ্য দুই পত্নী গ্রহণ করতে পারেন। পুরুষের বহুবিবাহ শুধু শাস্ত্রীয় অনুমোদনই লাভ করে নি কার্যক্ষেত্রেও বহু প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। আর দাম্পত্য জীবনে প্রাচীনকাল থেকেই নারীর প্রধান অশান্তির কারণ ছিল গৃহে সপত্নীর অবস্থান। ধর্মের বিধানে রাজারা যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারতো। শাস্ত্র পুরুষের শত শত বিবাহ সমর্থন করেছে। সেই শাস্ত্রের বিধানেই আবার নারীর একাধিক পতিত্ব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনু নারীর একপতিত্বের বিধান দিয়েছেন এবং স্বামী দুশ্চরিত্র হলেও স্ত্রীকে সারাজীবন পাতিব্রত্য পালন করতে বলেছেন। পতিপরায়ণতা সাধ্বী স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম।

দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেন প্রবর্তিত কৌলীন্যপ্রথা ধীরে ধীরে তার ধর্মীয় লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে এক ধরনের বিবাহ-ব্যবসায়ে পরিণত হয়। হিন্দুধর্মীয় কুলীন পুরুষের বহু স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই প্রথা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করে। উনিশ শতকে কুলীন ব্যবসায়ীরা বিবাহের জন্য এককালীন পণ এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন উপলক্ষে অর্থলাভের আশা করতেন। ‘কুলমর্যাদা’ অর্থাৎ কিঞ্চিৎ অর্থগ্রহণ না করে এঁরা শ্বশুরবাড়িতে গমন করে উপবেশন, স্নান ও আহার কিছুই করতেন না, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে আলাপও করতেন না। দীর্ঘদিন পরে কুলীন জামাতা বেড়াতে এলে শ্বশুরশাশুড়ি এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন তাই তাকে খুশী করার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। এমনকি অনেকে রাতে শোবার আগে শুভ সাক্ষাত উপলক্ষে জামাতা স্ত্রীর নিকট অর্থ দাবী করতেন।

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না।

ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান ভদ্রশ্রেণি পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে বহুবিবাহের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। কালক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বহুবিবাহ বিরল হয়ে পড়ে এবং শিক্ষিত শ্রেণিতে এক বিবাহ দাম্পত্য আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, ধনী মুসলমান পরিবার ছাড়া সকল পরিবারে দ্বিতীয় স্ত্রী বিরল। ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ একটি মাইলফলক। এতে পুরুষের বহুবিবাহের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা প্রয়াস ছিল। পারিবারিক আইনে যখন দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন হয় তখন থেকে দ্বিতীয় বিয়ের হার আরও কমতে থাকে। বর্তমানে বহুবিবাহ নিম্নশ্রেণী ছাড়া উচ্চ শ্রেণিতে খুবই বিরল দেখা যায়।

হিন্দুবিবাহ একটি ধর্মীয় আচারিক বা আধ্যাত্মিক বিষয় এবং এ জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক লিখিত দলিলের প্রয়োজন হয় না। হিন্দু পরিবারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কয়েকদিন ধরে চলে। ভবদেবের মতে, বিবাহের আচারাদি শুরু হয় জ্ঞাতি করমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পিতার দিক থেকে কনের রক্তসম্পর্কীয়া আত্মীয়ারা বিবাহের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যাদি সম্পন্ন করে থাকে। আট প্রকার বিবাহ পদ্ধতির মধ্যে ব্রাহ্মবিবাহই হিন্দুদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদে বর্ণিত বিবাহের মাঙ্গলিক আচরণগুলি আজও পালিত হয়। বিবাহকর্ম আরম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠানগুলি ছিল: শুভদৃষ্টি, মাল্যদান, মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞসম্পাদন, কন্যাদান, পাণিগ্রহণ, অগ্নিপ্রদক্ষিণ, সপ্তপদীগমন এবং স্বস্তিবচন।

হিন্দু সমাজে পাত্র-পাত্রীর কোষ্ঠী বিচার করে দেখার রীতি আছে। পাত্রী-পাত্রীর অন্য কোন বিষয়ে আপত্তি না থাকলেও কোষ্ঠী বিচারে যোটক না মিললে বিবাহের আর অগ্রগতি হয় না। পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মুসলিম সমাজেও পূর্বে কোষ্ঠী বিচার করে ছেলেমেয়ের বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। হিন্দু সমাজে বিয়ের আগে কথা পাকাপাকি করার অনুূষ্ঠানকে ‘আশীর্বাদ’ বলে। পাত্র-পাত্রী পছন্দ হলে সোনার আংটি বা টাকা দিয়ে পাকা কথা হয়ে থাকে। নতুন পাটি, নতুন খাতা, কলম দিয়ে পুরোহিতের উপস্থিতিতে উভয়পক্ষের কর্তা ব্যক্তিরা বিয়ের কথা চূড়ান্ত করেন। এটাকে অনেকে ‘পাটিপত্র’ বা ‘মঙ্গলাচরণ’ বলে থাকেন। এতে উল্লেখিত থাকতো বিয়ের দিন-ক্ষণ-লগ্ন এবং দেনা-পাওনার কথাও। বিয়ের আগের দিনকে বলা হয় ‘অধিবাস’ ঐ দিন বর-কনেকে পূজা করতে হয় এবং মধ্যরাতে নতুন কাপড়, গহনা পরে পাঁচ পদ দিয়ে খাবার খেতে হয়। বর-কনে উভয়ের বাড়িতেই অধিবাসের দিন একই আয়োজন হয়ে থাকে। বিয়ের দিন সাধারণত নির্ধারিত হয়ে থাকে পঞ্জিকা-অনুসারে শুভলগ্ন দেখে এবং পাত্র-পাত্রীর জন্মকোষ্ঠী বিচার করে। বিয়ের দিন বর-কনেকে গিলা, চন্দন, কাঁচা হলুদ, কাঁচা দুধ, ঘি, মধু এবং পুকুরের জল দিয়ে স্নান করানো হয়। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বর ও কনে উভয়কেই না খেয়ে থাকতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মধ্যরাতের পর কন্যাদান সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরদিন থাকে বাসিবিবাহ, এইদিন নানা আনুষ্ঠানিকতা চলতে থাকে। বাসিবিবাহের দিন উভয়কে পুরোহিত আবার মন্ত্র পড়ান এবং ঐ দিন প্রথা-অনুযায়ী নানা আনুষ্ঠানিকতা চলতে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছোট পুকুরের মতো কেটে তাতে পানি বা দুধ দিয়ে গোলাপ পাপড়ি ভাসিয়ে আংটি লুকোচুরির খেলা। তার পরের দিনে চলে স্ত্রীর রান্না করা খাবার গ্রহণ, যা সাধারণত বৌভাত বলে পরিচিত। বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকায় হিন্দুসমাজে ‘পুনর্বিবাহ’ বলে আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ যদি বিবাহের পূর্বে কনের ঋতুস্রাব না হয়ে থাকে তাহলে বিবাহোত্তর প্রথম ঋতুস্রাবের পরে পুনর্বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

উনিশ শতকের পরিবারে দাম্পত্যজীবনে পুরুষের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব লক্ষ্য করা যায়। পিতৃতন্ত্র দাম্পত্যজীবনের জন্য কতগুলি বিধিনিষেধ নির্ধারণ করে দেয়- যেমন, স্বামী হচ্ছে ইহজগতের প্রভু ও দেবতা, তাঁর প্রতি স্ত্রীর প্রশ্নাতীত ভক্তি প্রদর্শন করতে হবে ইত্যাদি। সনাতন বিয়ে দুটি ব্যক্তির মধ্যেই নয় শুধু, এর পারিবারিক গুরুত্ব ছিল স্বামী-স্ত্রীর পরিবারের মধ্যে পরিব্যপ্ত। সামাজিকভাবে একটি মেয়ের বিয়ে শুধু একটি ব্যক্তির সঙ্গে হতো না, পরিবারের সঙ্গেও অপরিসীম। একটি মেয়েকে শুধু স্বামীকেই তৃপ্ত করা যথেষ্ট ছিল না, পরিবারের সবাইকেই তুষ্ট করতে হত। নারীর দায়িত্ব ছিল পরিবারের সবাইকে খুশি করা।

বিয়েতে মন্ত্র পড়ে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করা হলেও দাম্পত্যজীবনে স্ত্রী অর্ধাঙ্গিনীর মর্যাদা পাওয়া বিরল ঘটনা। উনিশ শতকের শুরুতে বাঙালি পরিবারে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক কেমন ছিল তার একটি চিত্র পাওয়া যায় রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) প্রকাশিত ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদে’ (১৮১৯)। তিনি লিখেছেন, ‘বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্ধঅঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময় পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহার করেন; যেহেতু স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জ্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জ্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কর্ম করিয়া থাকে; এবং সূপকারের কর্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে, অর্থাৎ স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর ভ্রাতৃবর্গ অমাত্যবর্গ এ সকলের রন্ধন পরিবেষণাদি আপন নিয়মিত কালে করে, ঐ রন্ধনে ও পরিবেষণে যদি কোনো অংশে ক্রটি হয়, তবে তাহারদের স্বামী শাশুড়ি দেবর প্রভৃতি কে তিরস্কার না করেন; এ সকলকেও স্ত্রীলোকেরা ধর্মভয়ে সহিষ্ণুতা করে, আর সকলের ভোজন হইলে ব্যঞ্জনাদি উদর পূরণের যোগ্য অথবা অযোগ্য যৎকিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকে, তাহা সন্তোষপূবর্বক আহার করিয়া কাল যাপন করে; ...বৈকালে পুষ্করিণী অথবা নদী হইতে জলাহরণ করেন, রাত্রিতে শয্যাদি করা যাহা ভৃত্যের কর্ম্ম তাহাও করেন, ...তবে ঐ স্ত্রীর সবর্বপ্রকার জ্ঞাতসারে এবং দৃষ্টিগোচরে প্রায় ব্যভিচার দোষে মগ্ন হয়, এবং মাস মধ্যে এক দিবসও তাহার সহিত আলাপ নাই।’

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও ব্রাহ্মধর্মের বিকাশ সমাজে নারীর স্থান সম্বন্ধে একটি নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি করেছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও ইংরেজি শিক্ষা এবং ব্রাহ্মধর্মের বিকাশের সঙ্গে একটি নতুন নীতি-আদর্শ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নতুন শিক্ষা ও ভাবাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির মানসিক জগতে এক পরিবর্তনও সূচনা হয়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনের ফলে এক নতুন পবিত্রতা ও ঔচিত্যবোধের দ্বারা উদ্বধিত হয়েছিলেন। যার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকাশের সাথে সাথে শুরু হয় পরিবার, বিবাহ ব্যবস্থা এবং নারী পুরুষ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রক্রিয়া। এর সাথে যুক্ত হয় নৈতিকতাবোধ।

তত্ত্বগতভাবে ইসলামি শরিয়ত আইনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে কেউ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত পারস্পরিক দায় অধিকার সংজ্ঞায়িত হয়েছে যার ফলে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে অনেক দায় ও অধিকার আইনী-ভিত্তি লাভ করেছে।  [বিলকিস রহমান]