পর্যটন
পর্যটন চিত্তবিনোদন বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ। বর্তমানে পর্যটন একটি উল্লেখযোগ্য সেবাখাত এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করা বা তাদের আহার ও বাসস্থান সংস্থান, চিত্তবিনোদন ইত্যাদির একটি ভাল ব্যবসায়। অনেক দেশে পর্যটন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় ও বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের একটি কার্যকর শিল্পখাত। পর্যটনের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অন্য যেসব ব্যবসায় বিকাশ লাভ করে সেগুলি হচ্ছে স্থল, বিমান ও সমুদ্রপথে যাত্রী পরিবহণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, ব্যাংকিং, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর কোম্পানি, গাড়ি ভাড়া প্রতিষ্ঠান ও নানারকম খুচরা পণ্যের দোকান। ফলে পর্যটনের উন্নয়ন সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে এবং এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলা সুদূর অতীত থেকেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এসেছে। বিশ্বের নানা অংশ থেকে পর্যটকরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বাংলা ভ্রমণ করেছে। কেউ এসেছে ধর্ম প্রচারে, কেউ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, কেউ প্রাচীন বাংলার নানা জ্ঞানপীঠ থেকে বিদ্যার সন্ধানে আবার কেউ বা শুধুই কৌতূহল মেটাতে। অতীতে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় আসা কয়েকজন পর্যটক হচ্ছেন গ্রিসের প্লিনি দ্য এল্ডার (এসেছিলেন তাম্রলিপ্তিতে, ১ম শতকে) মিসরের ক্লডিয়াস টলেমায়েস টলেমি (গঙ্গারিডাই বা গৌড়, ২য় শতক), চীনের ফা-হিয়েন (তাম্রলিপ্তি, ৫ম শতক) ও হিউয়েন-সাং (মহাস্থান, সমতট, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্তি, ৭ম শতক), মরক্কোর ইবনে বতুতা (চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁও, ১৪শ শতক), চীনের মা হুয়ান (গৌড়, ১৫শ শতক)) ও ফেই সিন (চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁও, ১৫শ শতক), পর্তুগালের দুয়ার্তে বারবোসা (গঙ্গা অববাহিকা, ১৬শ শতক), ইতালির সিজার ফ্রেডেরিক (&চট্টগ্রাম, ১৭শ শতক), ইংল্যান্ডের র্যল্ফ ফিচ (চট্টগ্রাম, ১৬শ শতক), ইতালির নিকোলা মানুচি (ঢাকা, ১৭শ শতক) এবং ফ্রান্সের জে.বি টেভার্নিয়ার (ঢাকা, ১৭শ শতক)।
পর্যটন বর্তমানে যে অর্থে অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত সেটি তুলনামূলকভাবে খুবই সাম্প্রতিক ধারণা। বাংলাদেশ এলাকায় এর সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে আসতেন সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণে, এদেশের শ্যামলসবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। পূর্ববাংলার নদ-নদী, বনভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক জীবন সবই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় গড়ে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল রয়েছে। এখানে খোলা বনভূমিতে বিচরণ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বেশ সুবিধাজনক। বাংলাদেশের অবস্থান ম্যাক্রো-এশিয়াটিক এয়ার ট্রাফিক করিডোরে থাকায় বিশ্বের নানা অংশ থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আগত পর্যটকদের উল্লেখযোগ্য অংশকে বাংলাদেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সরকার দেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পর্যটন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৩ সালে এটিকে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে রূপান্তর করা হয়। কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৭৩-৭৮) আওতায় পর্যটন খাত বিকাশের একটি পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
পরিকল্পনায় দেশে পর্যটনের প্রাকৃতিক আকর্ষণসমূহের সম্ভাবনা বিকশিত করে তোলা এবং এর মাধ্যমে অধিক পরিমাণে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ ও দেশে তাদের অবস্থান উপভোগ্য করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর থেকে সরকার প্রতি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই পর্যটন খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দের বিধান অনুসরণ করে আসছে এবং বাজেটকৃত অর্থ পর্যটনের উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা কার্যক্রম ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করছে।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কাপ্তাই, সিলেট, রাঙ্গামাটি এবং আরও বেশ কয়েকটি স্থানে যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে সেগুলি দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের ওপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
১৯৯২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় পর্যটন নীতি পর্যটনকে অগ্রাধিকারসম্পন্ন শিল্পখাত হিসেবে বিবেচনা করে পর্যটন উন্নয়ন ও পর্যটনের বিপণন কৌশলের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। ১৯৯৯-এর শিল্পনীতি পর্যটনকে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকার এই খাতে যৌথ উদ্যোগ বা ১০০% বিদেশি মালিকানা উভয় ধরনেরই বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই পর্যটকদের আকর্ষণের বহুবিধ বিষয় ও উপকরণ বিদ্যমান। রাজশাহী শহরের পদ্মা তীরে আছে বড়কুঠি ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। বাংলাদেশ রেশম বোর্ড-এর প্রতিষ্ঠিত সিল্ক ফ্যাক্টরি পর্যটকের জন্য আরেকটি আকর্ষণ। রাজশাহী শহর থেকে ৫৫ মাইল দূরে অবস্থিত বাংলার মধ্যযুগীয় ইসলামিক ঐতিহ্যবাহী গৌড়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। গৌড়-এর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ প্রায় ৬ বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সালতানাত-এর পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে দরসবাড়ি মসজিদ (১৪৭০ খ্রি. তৈরি) ও মাদ্রাসা, ধুনিচক মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ (১৪৭০ খ্রি. তৈরি), খনিয়া দিঘি ও রাজবিবি মসজিদ। কিছু মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দির আছে রাজশাহী শহর থেকে ১৮ মাইল দূরত্বে পুঠিয়া নামক স্থানে। এগুলির মধ্যে গোবিন্দ মন্দির (১৮২৮-৯৫ সালে নির্মিত) এবং শিবমন্দির (১৮২৩) অন্যতম। ১৮৯৫ সালে রানী হেমন্তকুমারী দেবী কর্তৃক নির্মিত পুঠিয়া রাজপ্রাসাদ একটি ঐশ্বর্যমন্ডিত ও দর্শনীয় স্থাপনা।
নাটোর শহরের দুই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ঐতিহাসিক দীঘাপতিয়া রাজবাড়ি সংস্কার করে বর্তমানে উত্তরবঙ্গের রাষ্ট্রপতি ভবন (উত্তরা গণভবন) হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এই ভবনটি প্রায় ৪৩ একর জায়গা জুড়ে মূলত দীঘাপতিয়া মহারাজার প্রাসাদ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন সম্প্রতি ঐ স্থানে ভ্রমণ ও রাত্রিযাপনের নিমিত্তে প্যাকেজ ট্যুর প্রোগ্রাম চালু করেছে। এই এলাকায় অবস্থিত নাটোরের রাজবাড়ী (বড় তরফ এবং ছোট তরফ প্রাসাদ) পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়পুর-এ রয়েছে হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মঠ সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। সপ্তম শতাব্দীর এই ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রায় ২৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। নয়শত ফুট প্রস্থবিশিষ্ট চতুষ্কোণ অঙ্গনটি প্রায় ১২ থেকে ১৫ ফুট উঁচু। উত্তরে বিস্তীর্ণ ও বিশাল ফটক ও ৪৫টি কুঠরি এবং দক্ষিণে ৪৪টি কুঠরিসহ সর্বসাকুল্যে ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে। পিরামিড ও ক্রুশাকৃতির মন্দিরগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, বিশেষ করে মায়ানমার ও জাভার স্থাপত্যশৈলির নমুনা বহন করে।
সুউচ্চ মাটির ঢিবি বা পাহাড়ের ন্যায় দেখতে বলে ঐ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে পাহাড়পুর। মঠ এলাকার পাশেই সদ্যনির্মিত একটি জাদুঘরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের সমাহার রক্ষিত আছে।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা মহাস্থান বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিমে অবস্থিত। মনোরম ও চিত্তাকর্ষক দৃশ্যাবলিসমৃদ্ধ সমস্ত এলাকাটি একটি সুরক্ষিত প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। প্রাচীরবেষ্টিত এলাকার বাইরে প্রায় ৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মঠ। তার মধ্যে রয়েছে, গোবিন্দভিটা মন্দির, খোদার পাথর ভিটা, মনকালীর কুন্ড, পরশুরামের প্রাসাদ ও জিয়ত কুন্ড।
হিন্দু সম্প্রদায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে নির্মিত মহাস্থানগড়ের মঠকে আজও তাদের অতি পুণ্য তীর্থস্থান হিসেবে গণ্য করে। প্রতিবছর একবার মধ্য এপ্রিলে ও দ্বিতীয়বার ডিসেম্বর মাসে হাজার হাজার হিন্দু তীর্থযাত্রী মহাস্থানের পাদদেশে করতোয়া নদীতে পুণ্যস্নান করে থাকেন। মহাস্থানগড়ের জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীনকালের নিদর্শনাদি বিশেষ করে, পোড়ামাটির দ্রব্যাদি, স্বর্ণের অলঙ্কার ও স্বর্ণমুদ্রা পর্যটকদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। সামান্য দূরেই রয়েছে অশোক কর্তৃক নির্মিত স্তূপ যেখানে বসে বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের নিকট সূত্রসমূহ ব্যাখ্যা করতেন। চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং সপ্তম শতাব্দিতে বসুবিহার দেখতে আসেন। ছোট টিলার উপরে অবস্থিত একজন বিশিষ্ট মুসলিম সাধকের মাযার শরীফের জন্যও মহাস্থানগড় বিখ্যাত।
দিনাজপুর শহরের সন্নিকটে অবস্থিত সৌন্দর্যমন্ডিত কান্তনগর মন্দির ১৭৫২ খ্রি. দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ কর্তৃক নির্মিত হয়। মূলত, মন্দিরটির নবরত্নাকারে (নয়টি চূড়া নিয়ে) নির্মিত হয় যার চার দেওয়াল ছিল সুদৃশ্য ও দামি কারুকার্যখচিত। উনিশ শতকের শেষে এক ভূমিকম্পে চূড়াগুলি ধ্বংস হয়। এটি পোড়ামাটি ও ইটের তৈরি বাঙালি শিল্পকর্মের একটি দর্শনীয় নিদর্শন। প্রতিটি দেওয়ালের ভিতরে ও বাইরে ডিজাইন করে সাজানো আছে গাছপালা, জীবজন্তু, জ্যামিতিক আকার ও মানবমূর্তি সম্বলিত অতি সুন্দর পোড়ামাটির ফলকরাজি।
সাধক উলুঘ খানজাহান পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মসজিদ নগরী বাগেরহাট প্রতিষ্ঠা করেন। খুলনা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের এই নগরীকে তিনি বিভিন্ন মসজিদ, সেতু, রাস্তাঘাট, প্রাসাদ ও মৌসলিয়ামে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলেন। শিল্পকার্যের বিশিষ্ট নিদর্শনস্বরূপ এখনও দাঁড়িয়ে আছে ষাটগম্বুজ মসজিদ যা বাংলাদেশে ইঁট দিয়ে তৈরি বৃহত্তম মসজিদ রূপে গণ্য। গ্রীষ্মমন্ডলের সুন্দরী ও গরান গাছে সমৃদ্ধ পৃথিবীর একটি সর্ববৃহৎ বনভূমি হচ্ছে সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, অনেক জাতের হরিণ, কুমির ও বিভিন্ন বন্য পশুপাখির সমারোহ সুন্দরবনকে বিখ্যাত করে রেখেছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম জুড়ে রয়েছে পাহাড়ি বনাঞ্চল, ছোট ছোট নয়নাভিরাম হ্রদ ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলি। বায়েজীদ বোস্তামী মাযার, ফয়’স লেক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সৈনিকদের সমাধিস্থল, সীতাকুন্ড, পতেঙ্গা সৈকত, জিয়া স্মৃতি জাদুঘর ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান ছড়িয়ে আছে এ শহরে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কক্সবাজার। এখানে আছে বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকা সৈকত (১২০ কিমি)। সৈকতের একদিকে জলরাশি আর অপরদিক জুড়ে আছে সুদৃশ্য পাহাড়শ্রেণী যেখানে আছে রঙবেরঙের প্যাগোডা, বৌদ্ধদের মন্দির, পাহাড়ি বাড়িঘর এবং চিত্তাকর্ষক নানা দৃশ্য। সমুদ্র সৈকতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য আবাস ও রুচিসম্মত দেশি-বিদেশি খাবারের সুব্যবস্থা। হিমছড়ির পিকনিকের স্থান, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের শহর টেকনাফ, রামুর বৌদ্ধ বিহার ও সৈকত সংলগ্ন সোনাদিয়া, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ, মহেশখালী ইত্যাদি দ্বীপসমূহ যেকোন পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।
পাহাড়ের বিস্তার, চিরজীবী বৃক্ষরাজীর সমাহার, ঘন বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু বনপথ এবং একই সাথে কাপ্তাই হ্রদের গাঢ় নীল জলরাশি হচ্ছে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-এর পরিচিত দৃশ্য। পাহাড়ি জেলাসমূহের এলাকা জুড়ে আছে পাহাড়ি অধিবাসীর জীবনধারার চিত্র, পাহাড়ি হস্তশিল্প ও কারিগরি শিল্পনিদর্শন যা সকল পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চট্টগ্রাম থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি পরিবেশে রয়েছে বিখ্যাত কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চিট মোরং বৌদ্ধ মন্দির। এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধের অনেকগুলি সুদৃশ্য মূর্তি।
রাজধানী ঢাকা শহরের ৩৫০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বদিকে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উপজাতীয় সংস্কৃতির ধারক সিলেট শহর। শাহ জালাল (রঃ), শাহ পরান ও অন্যান্য সাধক সন্ন্যাসীদের মাযার-সম্বলিত সিলেট শহরকে পবিত্র নগরী গণ্য করা হয়। বৌদ্ধকৃষ্টির সমারোহ রয়েছে ময়নামতি লালমাইয়ের নিচু পাহাড়ি ভূমিতে। কুমিল্লা শহরের প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, ঢাকার ১১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এ ভূমি অবস্থিত।
দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত শালবন বিহারে খননকার্য পরিচালনায় উন্মোচিত হয়েছে মন্দিরসহ বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহার। ১৮ কিলোমিটার লম্বা এ টিলাভূমিতে আছে পঞ্চাশটি কীর্তি-স্থান। ১৯৫৯ সনে আখতার হামিদ খান কর্তৃক বৌদ্ধ বিহারের সন্নিকটে স্থাপিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) স্থানীয় সমবায় আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক স্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের জন্য ঢাকা সুবিখ্যাত। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বর্তমান অবস্থানে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মুগল সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটি রাজধানী হিসেবে কার্যকর ছিল। মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় সন্তান ও শায়েস্তা খানের উত্তরসূরি বাংলার সুবাহদার শাহজাদা মোহম্মদ আজম ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে লালবাগ দুর্গ বা আওরঙ্গবাদ কেল্লার নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। সুচারু কারুকাজখচিত প্রাচীর ফটক ছাড়াও লালবাগের দুর্গে রয়েছে দরবার হল, মসজিদ, রাজমিস্ত্রির দক্ষ হাতে নির্মিত পুকুর ও পরীবিবির মাযার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পশ্চাদভাগে রয়েছে হুসেনী দালান। এটি একটি বিখ্যাত ইমামবাড়া ও মুসলমান ধর্মের শিয়া সম্প্রদায়ের এক তীর্থস্থান। এটি সম্ভবত ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। মুগল সাম্রাজ্যের আরও এক নিদর্শন বড় কাটরা রয়েছে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী চকবাজারে। শাহ সুজার দীউয়ান আবুল কাসিম ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে অতি সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত এই কাটরা নির্মাণ করেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খা কর্তৃক নির্মিত ছোট কাটরা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বড় কাটরা থেকে মাত্র ২০০ গজ পূর্বে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জে রয়েছে খিজিরপুর দুর্গ। সেখান থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর এক মাইল ভাটিতে রয়েছে সোনাকান্দা দুর্গ। শায়েস্তা খানের উত্তরসূরি নওয়াব ইব্রাহীম খাঁ (দ্বিতীয়) ১৬৮৯-৯৭ খ্রিস্টাব্দে জিনজিরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন।বড় কাটরা বরাবর বুড়িগঙ্গার ঠিক অপর পাড়ে ছিল এর অবস্থান। জানা যায় যে প্রাসাদদুটি একটি কাঠের সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। সুরক্ষার জন্য জিনজিরা প্রাসাদটি ছিল পরিখাবেষ্টিত।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে আরও রয়েছে নবাববাড়ি বলে পরিচিত আহসান মঞ্জিল।১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে নওয়াব আব্দুল গণি প্রথম এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
এটি ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীকালে পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার এটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢাকা থেকে প্রায় ১৬ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সোনারগাঁও। এরই প্রায় এক মাইল দূরত্বে রয়েছে পুরাতন অনেক নিদর্শন ও ধ্বংসস্তূপের সাক্ষী মোগরাপাড়া।
বলধার জমিদার প্রয়াত নরেন্দ্র নারায়ণ রায়-এর এক অনন্য কীর্তি ১৯০৪ সনে স্থাপিত বলধা গার্ডেন। এতে আছে দুর্লভ, বিরল ও আকর্ষণীয় গাছপালার সমারোহ। যেকোন পর্যটক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানীকে এটি আকৃষ্ট করবে। পুরাতন ঢাকার ওয়ারী এলাকার খ্রিস্ট ধর্মীয়দের সমাধিস্থলের বিপরীতে বলধা গার্ডেন-এর অবস্থান। জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানার পার্শ্বে অবস্থিত। সেখানে প্রায় ২০৫ একর জমির উপর বিস্তৃত রয়েছে একশ প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছ-গাছালি। এদের মধ্যে অনন্য হচ্ছে ১০০ প্রজাতির বাঁশ, বিভিন্ন প্রজাতির সুগন্ধিযুক্ত চন্দন কাঠ এবং একটি অতি পুরাতন বটবৃক্ষ। পাশাপাশি অবস্থিত রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা। প্রায় ২৩০ একর জায়গায় বিস্তৃত এই চিড়িয়াখানায় রয়েছে প্রায় ১২৪ প্রজাতির ১,৪০০ ধরনের পশু ও পাখি। ঢাকা শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৬ কিমি পশ্চিমে মিরপুর এলাকায় অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানায় রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতা বাঘ, হরিণ, বানর, শিম্পাঞ্জি, অজগর সাপ ইত্যাদি। এখানে বহু দর্শকের সমাগম হয়। ভাওয়াল গড়ে আছে জাতীয় উদ্যান। ঢাকা থেকে ৪০ কিমি উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে প্রায় ১৬,০০০ একর জায়গা জুড়ে এটি বিস্তৃত। এই উদ্যানে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি এবং গাছপালা। জায়গাটি যেকোন পর্যটক, ফটোগ্রাফার, উদ্ভিদপ্রেমিক এবং দর্শনার্থীর কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
শাহবাগ এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ঢাকায় পর্যটকদের আরেকটি আকর্ষণ। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘরটি শাহবাগ এলাকায় নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। জাদুঘরে স্থান পেয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম শাসনামলের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, মূর্তি ও নিদর্শনসমূহ। এখানে আছে পুরাতন মুদ্রার এক বিপুল সংগ্রহ, লোহার কারুকার্য, শিল্পের ওপর প্রকাশনা, গজদন্ত ও রুপার ঝালর, মসলিন সামগ্রী, নকশি কাঁথা, ঐতিহাসিক যোদ্ধাদের হাতিয়ার ও গোলাবারুদ, নানারকম হস্তশিল্প, গ্রাম্য ও শহুরে ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি ও জীবনধারার নিদর্শন, সমসাময়িক চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য। সর্বোপরি এখানে সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মূল্যবান বস্ত্তসামগ্রী।
সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর ১৯৭৫ সনে শিল্পাচার্য জয়নূল আবেদিন-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়। এই জাদুঘরে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি বিষয়ক দ্রব্যাদির বিপুল সংগ্রহ রয়েছে। দর্শনীয় এই সকল বস্ত্ত কারিগরদের দক্ষতা, সহিষ্ণুতা, মানসিকতা, বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ও ধৈর্যের এক অপূর্ব স্বাক্ষর বহন করে।
চট্টগ্রামে অবস্থিত জাতিবিদ্যা সংক্রান্ত জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে প্রায় বারোটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহার সামগ্রী। এই সঙ্গে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও পাকিস্তানি উপজাতীয়দের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। লালবাগ কেল্লা, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর এবং ময়নামতি প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে স্ব-স্ব এলাকা থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী। রাজশাহীতে অবস্থিত বরেন্দ্র জাদুঘরে রয়েছে মহেঞ্জোদারো এলাকা থেকে প্রাপ্ত দ্রব্যাদিসহ ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রচুর সামগ্রী যা পুরাতন হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান ধর্মের ঐতিহ্যের স্মারকচিহ্ন। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক সংঘ ১৯৭৮ সালে রাঙ্গামাটি শহরে স্থাপন করে পাহাড়ি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক জাদুঘর।
এখানে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভাবধারার চিহ্নসমূহ। এই সকল সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে উপজাতীয়দের পরিধেয় বস্ত্র, অলঙ্কার, মুদ্রা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ, কাঠ, তামা ও নানাবিধ ধাতুর তৈরি মূর্তিসমূহ, বাদ্যযন্ত্র, গজদন্ত সামগ্রী, হস্তশিল্প এবং উপজাতীয় জীবনধারার চিত্রকর্ম।
মহানগরী ঢাকাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি উন্নত ও অভিজাত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল, যেখানে প্রদর্শিত হয় ইংরেজি, মহাদেশীয় ও বাংলাদেশি সিনেমা। প্রতিটি জেলা শহরেই রয়েছে প্রেক্ষাগৃহ। বাংলা ও বাংলায় রূপান্তরিত পাশ্চাত্য নাটক প্রায়শই মঞ্চস্থ হয়।
পর্যটন শিল্পের আরেকটি ধারা হচ্ছে উৎসব-পর্বাদি ও মেলা। বেশিরভাগ অনুষ্ঠান-পর্বাদির উৎপত্তি হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে কিন্তু মেলার উৎপত্তি মানুষের হূদয়ের আবেগ থেকে যেখানে ধর্মের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর এবং এর পরেই রয়েছে ঈদুল আযহা। অন্যান্য মুসলিম অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঈদ-ই-মীলাদুন্নবী, শবে বরাআত এবং আশুরা। হিন্দুদের জন্য দুর্গাপূজা, খ্রিস্টানদের বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। ধর্মীয় পর্বাদি ব্যতিরেকে বাংলা নববর্ষ, বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) এবং স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ) এবং ২১ ফেব্রুয়ারি (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) সারা দেশব্যাপী পালন করা হয়। হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠান লাঙ্গলবন্দের মেলা উদযাপিত হয় প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিনে সোনারগাঁও সংলগ্ন লাঙ্গলবন্দ এলাকায়।
সমগ্র দেশ জুড়ে নামী-দামি হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ঐতিহ্যবাহী হোটেলসমূহে পাওয়া যায় দেশি ও পাশ্চাত্য খাদ্য। দেশীয় খাবার সতাদে-গন্ধে অতুলনীয়। মিষ্টান্ন হিসেবে রয়েছে ডিম, দুধ, সুজি, গাজর, ইত্যাদি সমন্বয়ে তৈরি মুখরোচক সামগ্রী এবং বিভিন্ন ধরনের বাদামের সংমিশ্রণে তৈরি হালুয়া। মিষ্টি দই, সন্দেশ, জর্দা ও ফিরনি অতি সুস্বাদু। রসগোল্লা ও কালোজাম হচ্ছে দুধ, চিনি ও ঘি দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় মিষ্টি। রসমালাই, নানা রকম পিঠা (যেমন চিতই, ধুপি, তক্তি, আন্দোশা, ভাপা ও পোয়া পিঠা) অতীব যত্নসহকারে তৈরি করা হয়ে থাকে। ফলের মধ্যে রয়েছে আম, জাম, লিচু, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, তরমুজ, আনারস, নারিকেল ও কমলা। এসবকিছুই পর্যটন শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার দেশের পর্যটন শিল্পকে বিকাশের জন্য কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করে বাংলাদেশকে ‘রূপময় বাংলাদেশ’ (Beautiful Bangladesh) শ্লোগানে দ্বারা পরিচিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
[সৈয়দ রাশেদুল হাসান]