আরবি

আরবি  আরব দেশের ভাষা এবং সেমিটিক বা সামি ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মূল সামি ভাষা এখন আর নেই, তবে ভাষাবিদদের মতে, আরবি মূল সামি ভাষার নিকটতম। অন্যান্য সামি ভাষার ন্যায় আরবি ভাষায়ও কোনো স্বরবর্ণ নেই, কেবল ব্যঞ্জনবর্ণের সাহায্যেই সব রকম ভাব ব্যক্ত করা হয়।

আরবি ভাষায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনটি বর্ণের দ্বারা ধাতু গঠিত হয়। ক্রিয়াপদের কাল দুটি-অতীত (মাযি) ও বর্তমান (মুযারি)। ভবিষ্যৎ বোঝাতে ক্রিয়াপদের বর্তমান রূপই ব্যবহূত হয়। আরবি ক্রিয়াপদ একই সঙ্গে কাল, পুরুষ, লিঙ্গ ও বচন বোঝায়, যথা: কাতাবা ক্রিয়াপদ অতীত কাল, প্রথম পুরুষ, পুংলিঙ্গ ও একবচন নির্দেশ করে। এ ভাষায় ক্লিবলিঙ্গ নেই; শব্দ হয় পুংলিঙ্গ না হয় স্ত্রীলিঙ্গ, যেমন: শাম্স (সূর্য) স্ত্রীলিঙ্গ, কমর (চন্দ্র) পুংলিঙ্গ ইত্যাদি। বাক্যবিন্যাসে না-সূচক অব্যয় ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। স্বরবর্ণের অভাবে স্বরচিহ্ন ব্যবহূত হলেও তা সাধারণত লিখিত হয় না। ফলে ভাষাটির পঠন কিছুটা জটিল।

আরবি ভাষার সঙ্গে এদেশের পরিচয় ঘটেছে সুদূর অতীতে বাণিজ্যসূত্রে। আরব বণিকরা বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন্দর  চট্টগ্রাম বা সন্দ্বীপে পৌঁছাত এবং সেখান থেকে মায়ানমার (বার্মা), মালয় উপদ্বীপ ইত্যাদি অতিক্রম করে চীনের ক্যানটন পর্যন্ত যেত। আরবে  ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরও বাণিজ্যসূত্রে তারা এ দেশে আসত এবং তাদের সঙ্গে আসত সুফি সাধকরা। এভাবে প্রাচীনকালে আরবদের এবং পরবর্তীকালে আরব মুসলিমদের বাংলায় যাতায়াতের ফলে বাংলার অধিবাসীরা আরবি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়। কালক্রমে এ দেশিয় কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে আরবি ভাষা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইসলাম প্রচারকগণ  নামায আদায়ের জন্য যেসব মসজিদ ও  খানকাহ নির্মাণ করেন, সেখানে আরবি  কুরআন পাঠ ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই এ দেশে আরবি চর্চার সূত্রপাত হয়।

ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক এবং ধর্ম প্রচারে মুসলিম সাধকদের মাধ্যমে খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতক কিংবা তারও পূর্বে বাংলা ভাষায় আরবি ভাষার মিশ্রণ শুরু হয়। ফলে বহু আরবি শব্দ, যেমন ইসলাম, ঈমান, যাকাত, হজ্জ, ইমাম, মুরতাদ, উযু, গুসল (গোসল), ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, হালাল, হারাম ইত্যাদি বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত এমন অনেক আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, যেগুলির উচ্চারণ ও বানানে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে; ফলে সেগুলির মূল আরবি রূপ এখন শনাক্ত করা শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এমন কতগুলি শব্দ হচ্ছে অকুফ (ওয়াকুফ = জানা), অজুরা (অজ্র = পারিশ্রমিক), জেরা (জরহ = বাদানুবাদ), বদা (বয়দা = ডিম), মানে (মা‘না = অর্থ, তাৎপর্য) ইত্যাদি।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার গ্রামসমূহে যে আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত তাতে প্রচুর আরবি শব্দ বিদ্যমান। চট্টগ্রামের উপভাষার মোট শব্দের প্রায় অর্ধেক আরবি বা আরবি শব্দলজাত। এ ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না-সূচক শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষার প্রভাবের ফল।

বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে মুসলিম শাসনামলে। তখন  ফারসি রাষ্ট্রভাষা থাকায় তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। ফলে ফারসির মাধ্যমেও বহু আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে। যেমন আরবি দিয়াফত (আপ্যায়ন) ও গুরাবা (অতিথি) শব্দের ফারসি উচ্চারণ যথাক্রমে যিয়াফত ও গরবা বাংলায় ব্যবহূত হয়। আরবি ও বাংলা ভাষার মধ্যে এ যে সংযোগ, তা আর কখনওই বিচ্ছিন্ন হয়নি। এ দেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার এ সংযোগকে আরও ব্যাপক ও নিবিড় করেছে।

তেরো শতকে বাংলায় মুসলিম বিজয় সূচিত হওয়ার পরে এ দেশে আগত সুফিদের কয়েকজন হলেন: শায়খ আহমদ (ভিন্ন মতে আববাস) ইব্ন হামযা নিশাপুরী (মৃত্যু ৯০০, ঢাকা),  বাবা আদম শহীদ (মৃত্যু ১১১৯, ঢাকা জেলার রামপালে),  শাহ সুলতান রুমী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মদনপুরের অধিবাসী ছিলেন এবং ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন), শাহ সুলতান মাহিসওয়ার (বগুড়ার  মহাস্থান) এবং  মখদুম শাহ দৌলা শহীদ (পাবনার শাহবাজপুর)। এঁরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, খানকাহ ও  মকতব প্রতিষ্ঠা করেন, কারণ ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপালনের শিক্ষাদানও ছিল অপরিহার্য। এ ছাড়া বাংলায় মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর ধর্মপ্রচারে আত্মনিবেদিত সুফি সাধকগণ কর্তৃক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার প্রমাণও পাওয়া যায়। যেমন মওলানা তকীউদ্দীন আল-আরবি (মৃত্যু ১২৯১) রাজশাহীর মাহীসুনের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এটিকে এদেশের প্রথম মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করা হয়। এ মাদ্রাসায় আরবি ও ইসলামী বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়া হতো।

শায়খ শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা ঢাকার  সোনারগাঁও-এ একটি  মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন সম্ভবত ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে। এটি অতি উন্নত মানের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বিখ্যাত সুফি সাধক  শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরী এ প্রতিষ্ঠানে বাইশ বছর অধ্যাপনা করেন। এখানে ইসলামী বিষয়াদি ব্যতীত বিজ্ঞানের নানা বিষয়েও পাঠদান করা হতো।

বর্ধমান জেলার বুহার গ্রামের বিদ্যোৎসাহী জমিদার মুনশী সদ্রুদ্দীনের অনুরোধে লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত আলিম ও শিক্ষাবিদ মওলানা আবদুল বারী বুহারে আগমন করেন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্য বুহারে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সব ব্যয়ভার বহন করতেন উক্ত জমিদার। কালক্রমে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে গেলে তার বিরাট ও মূল্যবান গ্রন্থাগারটি ইংরেজ সরকারের নির্দেশে কলকাতা ইম্পেরিয়াল (বর্তমানে ভারতের জাতীয়) গ্রন্থাগারে ‘বুহার শাখা’ নামে সংযুক্ত হয়।

মুসলিম শাসনের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বহু এলাকায় আরও অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে প্রতি চারশ অধিবাসীর জন্য একটি করে মকতব বা মাদ্রাসা তৎকালে চালু ছিল। ম্যাক্সমুলারের এক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ইংরেজ শাসনের পূর্বে বাংলায় ৮০ হাজার মাদ্রাসা চালু ছিল।

এসব মাদ্রাসা-মকতবে বিশেষ যত্নের সঙ্গে আরবি ভাষা শেখানো হতো, যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা নামায আদায় এবং কুরআন ও ওযিফা (দৈনিক প্রার্থনার বই) পাঠে অভ্যস্ত হয় এবং সঠিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে। তখন অবশ্য প্রাথমিক শ্রেণিতে আরবি লিখনপদ্ধতি শেখানো হতো না, তা শেখানো হতো উচ্চ শ্রেণিতে।

তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্য বিষয়গুলি বাংলাদেশের মাদ্রাসায়ও অনুসৃত হতো। পাঠ্য বিষয়গুলি প্রধানত দুভাগে বিভক্ত ছিল- ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক। প্রথমটির অধীন ছিল ইলমুল কিরাআঃ (শুদ্ধ উচ্চারণে আরবি পঠন), ধ্বনিবিজ্ঞান, কুরআনের তাফসির (ভাষ্য), হাদীস শাস্ত্র, আল-ফিক্হ (আইন শাস্ত্র), আল-কালাম (বিশ্বাস সংক্রান্ত বিজ্ঞান), আরবি ভাষা ও সাহিত্য, আরবি ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্র এবং মিরাছ (দায়ভাগ বিজ্ঞান)। আর দ্বিতীয়টির অন্তর্ভুক্ত ছিল মন্তিক (যুক্তিবিদ্যা), হিক্মত ও ফল্সফা (দর্শন ও নীতিবিদ্যা), জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষতত্ত্ব, অংকশাস্ত্র, বীজগণিত, জ্যামিতি, পৌরবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সঙ্গীতবিদ্যা (হাম্দ, না‘ত, গজল ইত্যাদি)।

মকতব ও মাদ্রাসা শিক্ষা সাত থেকে দশ বছরে সমাপ্ত হতো। উচ্চশিক্ষার জন্য কিছু মাদ্রাসা নির্দিষ্ট ছিল এবং বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য দীর্ঘকাল ওস্তাদের সাহচর্যে থাকতে হতো। কুরআন-হাদীসে পারদর্শিতা ও ফিক্হশাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন শিক্ষিত ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য ছিল। কুরআন-হাদীসের ভাষা আরবি এবং ফিক্হশাস্ত্রের মূল গ্রন্থগুলিও আরবিতে রচিত, তাই আরবি ভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন তখন অতি জরুরি বলে বিবেচিত হতো।

তখন শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবাসিক। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করত মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। ফলে শিক্ষা ছিল সহজলভ্য এবং সরকারি ও বেসরকারি সাহায্যকারীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। শিক্ষকমন্ডলী পরামর্শক্রমে নিজেরাই শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং ছাত্রদের সনদপত্র প্রদান করতেন।

বাংলায় সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনে উচ্চমানের আরবি গ্রন্থ তেমন রচিত হয়নি, হলেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে যেগুলি পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: কাজী রুকনউদ্দীন সামারকান্দীর (মৃত্যু ১২১৮/১৯) হাওদুল হয়াত। এটি যোগশাস্ত্রের অমৃতকুন্ড নামক একটি  সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ। আল্লামা আবুতাওয়ামা সুফিতত্ত্ব সম্বদ্ধে মকামাত নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা এখন দুষ্প্রাপ্য। বাংলার গভর্নর নাসিরুদ্দীন বুঘরা খানের আমলে (১২৮৩-১২৯০) কামিল কারীম নামক এক আলেম ফিক্হশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার শিরোনাম মাজমু‘ই-খানী ফী ‘আয়নি’ল- মা‘আলী। শায়খ কুতব-উল আলমের হাদীস সংকলন অনীস-উল-গুরাবা একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। আলাউদ্দীন হুসেন শাহের আমলে (১৪৯৪-১৫২০) মুহাদ্দিছ মুহাম্মদ ইব্ন য়াযদান স্বহস্তে ৩ খন্ডে সহীহ বুখারীর অনুলিপি তৈরি করেন, যা বাকিপুর লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া কয়েকজন কবির নাম পাওয়া যায় যাঁরা সুলতানদের দরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তবে তাঁদের উচ্চমানের কোনো আরবি কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাটের নিকট থেকে বাংলার দীউয়ানি ক্ষমতা লাভ করলে তখন থেকেই মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের মতো আরবি শিক্ষাও সংকুচিত হয়ে আসে। কারণ, মসজিদ কেন্দ্রিক কিছু মকতব ছাড়া অন্য সকল ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অল্পদিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে অবশ্য ইংরেজদের পক্ষেও দেশের শাসন পরিচালনা করা, বিশেষত বিচার বিভাগের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল, কারণ তখনও মুসলিম আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হতো। তাই ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কতিপয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের আবেদনে বাংলার তৎকালীন শাসনকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায়  আলীয়া মাদ্রাসা নামে একটি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এর ফলে বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরায় চালু হয় এবং মোল্লা নিযামউদ্দীন সিহালভী (মৃত্যু ১৭৪৮) প্রণীত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী এ শিক্ষাক্রম পরিচালিত হতো। হাদীস, তাফসির, ফিক্হশাস্ত্র, আরবি ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গ্রিক দর্শন (হিক্মত) ও কালাম (আকিদাহ) পাঠ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারিত হয়। আরবি সাহিত্য তখন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে কুরআন ও হাদীসই সাহিত্য হিসেবে পঠিত হতো। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে  তাফসির ও হাদীসের অধ্যয়ন বর্জন করা হয়।

প্রথম দিকে আরবি শিক্ষা শুধু ব্যাকরণের মধ্যেই সীমিত ছিল। পরে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে হাদীস-তাফসির পুনরায় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরবি আদব বা সাহিত্যও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। ওপরের শ্রেণিসমূহে (সুওয়াম, দুওয়াম, উলা) গদ্যে মকামাতে হারিরি এবং পদ্যে দিওয়ান মুতানাবিব ও আস-সাব‘উ’ল-মু‘আল্লাকাত পঠিত হতো।

আরবি শিক্ষার বিস্তারের উদ্দেশ্যে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে হুগলি মাদ্রাসা এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরও তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদ্রাসা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হতো এবং এগুলিতে কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি অনুসৃত হতো।

এ সময় থেকে সাধারণ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্য এবং ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে মুসলিম ছাত্ররা সে শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। সাধারণ শিক্ষায় স্কুল ও কলেজে আরবি ভাষা ও সাহিত্য ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ১৮৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে।

ইসলামি শিক্ষার ক্ষতি সাধন না করে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্যে ‘নিউ স্কিম মাদ্রাসা’ নামে মাদ্রাসা শিক্ষার আর একটি ধারা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত হয়। এ ধারার পাঠ্যসূচিতে আরবির সঙ্গে ইংরেজিকেও বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে এ ধারায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিও যুক্ত হয়, যাতে ছাত্ররা এখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারে। এ স্কিমটি প্রবর্তনে শামসুল উলামা আবু নস্র ওহীদের (১৮৭২-১৯৫৩) যথেষ্ট অবদান ছিল। হুগলি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ স্কিমের অধীনে সরকারি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারিভাবেও কিছু কলেজ স্থাপিত হয়। এ স্কিমের প্রতি মুসলিম জনসাধারণ বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় এবং এর আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে যেসব মেধাবী ছাত্রের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁরা এ ধারায় শিক্ষা লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে সক্ষম হন।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর কলকাতা মাদ্রাসা ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি তেমন উৎসাহ দেখায়নি। তাদের আমলে ১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠার মাত্র পঞ্চাশ বছর পর এ স্কিমটি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আরবি বিভাগ যথারীতি চালু থাকলেও অনেক কলেজেই আরবির পঠন-পাঠন বন্ধ হয়ে যায়।

কওমী মাদ্রাসা নামে মাদ্রাসা শিক্ষার আরও একটি ধারা বহুকাল পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। চট্টগ্রাম জেলার  হাটহাজারী ও পটিয়ার মাদ্রাসাদ্বয়, ঢাকার লালবাগ ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসাদ্বয়, ময়মনসিংহের বালিয়া মাদ্রাসা ও কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসা উক্ত প্রকারের কয়েকটি বিখ্যাত মাদ্রাসা। এ ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এগুলিতে আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং আরবি ব্যাকরণ শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, শ্রেণির নামকরণও করা হয় আরবি ব্যাকরণ গ্রন্থের নামানুসারে, যেমন মীযান শ্রেণি, নাহ্ওমীর শ্রেণি, হিদায়তুন নাহ্ও শ্রেণি ইত্যাদি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্কুল-কলেজে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা চালু হলেও মুসলিম ছাত্র সংখ্যা কম থাকায় আরবি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল কম, যদিও ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এক সময় মুসলিম ছাত্রদের প্রায় সকলেই আরবি ঐচ্ছিক বিষয়রূপে গ্রহণ করতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে আরবিতে অনার্স ও এমএ ডিগ্রি প্রবর্তিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯২১) থেকেই আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ কলা অনুষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে গণ্য হয়। ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ (সি-গ্রুপ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্ররা তখন এ বিভাগে ভর্তি হতো, কিন্তু আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা এ সুযোগ পেত না। এ বিভাগ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্ররা পরবর্তীকালে আরবি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখেন।

এদেশে আরবি চর্চার ক্ষেত্রে যাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে মওলানা  কেরামত আলী জৌনপুরী অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর চারটি গ্রন্থের মধ্যে দাওয়াত মাস্নূনা দোয়া-কালাম সম্পর্কীয় রচনা। আরবি ও উর্দু ভাষায় এটি রচিত। মুলাখ্খাস ও বরাহীন কাত‘ইয়্যা ফী মওলূদি খায়রিল-বরিয়্যা গ্রন্থদ্বয় মওলূদ সম্পর্কে লিখিত এবং নসীমুল-হরমায়ন গ্রন্থে ইসলামী চিন্তাধারা ও তৎসম্পর্কিত মতবিরোধ আলোচিত হয়েছে।

মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা মুহ্সিনিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট। তাঁর রচিত গ্রন্থ পাঁচটি, তিনটি পাঠ্যপুস্ত্তক ও দুটি দর্শন বিষয়ক। ওবায়দী আরবিতে কবিতাও রচনা করেছেন। খান বাহাদুর আবদুল করীম খাকী (মৃত্যু ১৮৯১-৯৯-এর মধ্যে) একটি ফিক্হ গ্রন্থের ভাষ্য আরবিতে রচনা করেন যার নাম জামিউ‘র রুমুয। তাফসীরুফত্হিল-কালাম নামে আরবিতে তাঁর একটি তাফসিরও রয়েছে।

মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে কিছু পরিবর্তন হলে এবং ১৮৭২ সালে স্কুল-কলেজে আরবি শিক্ষা প্রবর্তিত হলে আরবি শিক্ষকগণ আরবি পাঠ্যপুস্তক রচনায় আগ্রহী হন। তাঁদের মধ্যে মওলানা মুহাম্মদ মুসা (মৃত্যু ১৯৬৪), মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ আমীমুল ইহ্সান (মৃত্যু ১৯৭৪), মওলানা আলাউদ্দীন আল-আযহারী ও  শামসুল উলামা আবু নসর ওহীদ এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁরা মূলত আরবি গ্রন্থের সংকলন করেন, যদিও তাঁদের কিছু কিছু মৌলিক রচনাও রয়েছে। যেমন মওলানা মুসার সুব্হাতুল আদব ও কিতাবুল আমালীহ। মুফতী আমীমুল ইহ্সান তাফসির,  হাদীস ও ফিক্হশাস্ত্রের কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণির দীনী বিষয়ের জন্য সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করে। তাঁর ফিকহুসু-সুনন ওয়াল আছার হাদীস ও ফিক্হি মসাইলের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এতে হানাফী মাযহাবের মতামতসমূহ আলোচিত হয়েছে। কাওয়াইদুল্ ফিক্হ তাঁর তদ্রূপ আর একটি বিশদ গ্রন্থ। মওলানা আল-আযহারীর আল-আদা-আল-আসরী স্কুলের পাঠ্যপুস্তক। শামসুল উলামা ওহীদ পাঁচটি আরবি গ্রন্থের রচয়িতা। এগুলি নিউ স্কিম মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি অনুযায়ী রচিত।

এদেশের আরবি ভাষাবিদদের অনেকেই আরবিতে সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন সৈয়দ আবদুর রশীদ শাহজাদপুরী (মৃত্যু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়), মুফতী আযীযুল হক (মৃত্যু ১৯৬০), মওলানা  আবদুর রহমান কাশগড়ী (১৯১২-১৯৭১), হাফেজ মুহাম্মদ কুববাদ (মৃত্যু ১৯৭৫) ও শামসুল উলামা বেলায়াৎ হুসাইন (মৃত্যু ১৯৮৪)। এঁরা প্রায় সকলেই মহানবীর (স.) প্রশংসামূলক কাসিদা (দীর্ঘ কবিতা) রচনা করেছেন। বেলায়াৎ হুসাইনের ‘আল-বিতাকাঃ’ কবিতাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে এমএ প্রথম পর্বে কিছুকাল পাঠ্য ছিল। মওলানা কাশগড়ীর আয-যহারাত গ্রন্থে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে রচিত চমৎকার কিছু কবিতা আছে। মওলানা আবদুল আওয়াল জৌনপুরীর (মৃত্যু ১৯২০) ৪০টি আরবি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির বিষয়বস্ত্ত সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্ম। মওলানা আবদুল্লাহ আল-কাফীর (মৃত্যু ১৯৬০) ইসলামী বিষয়ে মূল্যবান ১২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির বিষয়বস্ত্তর উপস্থাপনা ও ভাষা প্রয়োগ প্রশংসনীয়। বিগত এক শতকে বাংলাদেশে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়েছে।

এদেশে অমুসলিমরাও আরবি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা  রামমোহন রায় তুহফাতুল্ মুওয়াহ্হিদীন (১৮০৩) নামে ফারসিতে তাওহিদ বিষয়ে যে গ্রন্থটি রচনা করেন তার একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন আরবিতে। ভাই  গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) আরবি ভাষা শিখে প্রথম কুরআন শরীফের পূর্ণ বঙ্গানুবাদ করেন এবং মিশকাত শরীফেরও আংশিক অনুবাদ করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভবের পর আরবি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় অভূতপূর্ব গতির সঞ্চার হয়। ১৯৮৫ সালে  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে ইসলামী শিক্ষা অনুষদ প্রবর্তিত হয়। এ অনুষদের অধীনে আরবি বিভাগ ও ইসলামী বিষয়ে স্বতন্ত্র তিনটি বিভাগ খোলা হয়। শেষের তিনটি বিভাগে শিক্ষার মাধ্যম আরবি। এ ছাড়া ইতোপূর্বে ১৯৭৫ সালে  ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম সম্পর্কে আরবিতে কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সে সবের মধ্যে এ কে এম আইয়ূব আলীর আকীদতুল্ ইসলাম ওয়াল্ ইমাম আল্-মাতুরীদী এবং মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানের তাবীলাতু আহ্লিস্ সুন্নাহ গ্রন্থদ্বয় দেশ-বিদেশে বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও আরবি বিভাগ রয়েছে। সেখানে বহু ছাত্র অধ্যয়ন করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতিবছর কিছু ছাত্র এম ফিল ও পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করছে। তাদের রচিত অভিসন্দর্ভসমূহের কোনো কোনোটি আরবিতে লিখিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি ডিগ্রি প্রাপ্ত প্রথম মুসলিম রজব আলী মির্যা আরবি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে আরবিতে ডিগ্রি প্রাপ্ত ছাত্ররা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় নিযুক্ত রয়েছে।

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ থেকে কয়েকটি আরবি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হলো: আলাউদ্দীন আল-আযহারী সম্পাদিত আছ-ছাকাফাঃ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃর্তক প্রকাশিত মাজাল্লাতুল মুওয়াস্ সাতিল ইসলামিয়্যাহ (এদুটি বর্তমানে বিলুপ্ত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগীয় পত্রিকা আল-মাজাল্লাতুল‘আরাবিয়্যাহ (১৯৯৩ থেকে), ইক্রা পত্রিকা (ঢাকা দারুল আরাবিয়্যাহ থেকে প্রকাশিত), হারুন ইসলাম আবাদীর সম্পাদনায় মাসিক আল-কলম, আল-মারকাযুল ইসলামী ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা আল-ইসলাহ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত আল-হুদা নামক মাসিক পত্রিকা।  [আ.ত.ম মুছলেহউদ্দীন]

গ্রন্থপঞ্জি  মওলানা আবদুস সাত্তার, তারীখে মাদরাসায়ে আলীয়াহ, ১৯৫৯; আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭; ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাংলাদেশের খ্যাতনামা আরবীবিদ্, ঢাকা, ১৯৮৩; SGM Hilali, Perso-Arabic Elements in Bengali, Dhaka, 1967; Dr. AKM Ayub Ali, History of Traditional Islamic Education in Bangladesh, Dhaka, 1983; MM Ali, History of the Muslims of Bengal, Vol. 1A and 1B, Riyadh, 1985.