খানকাহ
খানকাহ আরবি শব্দ, সুফি দরবেশদের জন্য নির্দিষ্ট গৃহ বা আস্তানা। ধারণা করা হয়, ইবাদত ও ইসলামি শরী‘আতর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শিক্ষাদানের কেন্দ্ররূপে খোরাসান ও ট্র্যান্সঅক্সিয়ানায় দশ শতকে খানকাহর আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই ইরান, ইরাক, সিরিয়া-মিশর, আল-মাগরির (মরক্কো), এশিয়া মাইনর এবং অটোম্যান বা উসমানি সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে-ইসলামি বিশ্বের সর্বত্র শহর ও গ্রামাঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে খানকাহ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
বাংলাদেশে আগমনকারী সুফিরা তেরো শতকে সরাসরি পারস্য থেকে খানকাহর ধারণা নিয়ে আসেন। খানকাহ মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। খানকাহগুলিতে নামায, মহফিল ইত্যাদির মতো ইসলামি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। বহু সংখ্যক সুফিদের আশ্রয়দানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রায় সব খানকাহতেই আবাসিক ভবন, মসজিদ,মাদ্রাসা, মাযার, বিভিন্ন উপগৃহ ও অন্যান্য ভবন থাকে। ফলে খানকাহগুলি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খানকাহগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লাখেরাজ বা নিষ্কর ভূমির উপর।
মধ্যযুগের বাংলায় শেখ ও সুফিদের খানকাহগুলি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিনহাজ-ই-সিরাজ উল্লেখ করেন যে, তৎকালীন লখনৌতিতে বাংলার রাজধানী স্থাপনের পর বখতিয়ার খলজী বহু মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকাহ নির্মাণ করেছিলেন। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাংলায় মুসলমান শাসনের প্রথম একশত বছরের মধ্যে (১২০৪-১৩০৪) তেরোটি শিলালিপির মধ্যে ছয়টিই খানকাহর স্মৃতি বহন করে। এগুলি তৎকালীন বাংলার সমাজে খানকাহ এর গুরুত্ব নির্দেশ করে। দেবকোট, দেওতলা, মহাস্থান, ঢাকা, সোনারগাঁও, চট্টগ্রাম, সিলেট, গৌড়, পান্ডুয়া, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ এবং ত্রিবেণীর (সাতগাঁও) মতো স্থানগুলি ছিল খানকাহর জন্য বিখ্যাত।
‘চিল্লাখানাহ’ বা খানকাহসমূহ প্রতিষ্ঠা করে সুফীরা বাংলার সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই অনেক অনুগামী ছিল। শুধু আধ্যাত্মিক জ্ঞানই নয়, সাধারণ শিক্ষা বিস্তারেও তাঁরা ছিলেন অগ্রণী। বাংলার সুফি-দরবেশদের কোনো কোনো খানকাহ ছিল ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনচর্চার বড় পীঠস্থান। এগুলি শুধু বাংলার জন্যই নয়, সমগ্র ভারতের জন্যই বেশ কিছু সুফি-দরবেশ ও আলেম ব্যক্তিদের সৃষ্টি করেছিল। শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরী, আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি, নাসিরুদ্দীন মানিকপুরি, শেখ হোসেন ঢুক্কারপোস, হাসানউদ্দীন মানিকপুরি, শেখ কাকি এবং উত্তর ভারতের আরও কয়েকজন বাংলায় তাঁদের আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। খানকাহতে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মানসিক শান্তি লাভ এবং আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য তার আগ্রহ পরিতৃপ্ত করতে পারত। এটা হাসপাতাল বা আশ্রয়স্থানরূপেও কাজ করত যেখানে বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা আশ্রয়, উপযুক্ত চিকিৎসা ও ভালো সেবা-শুশ্রূষা এবং যত্ন পেতে পারত।
প্রত্যেকটি খানকাহতে একটি লঙ্গরখানা সংযুক্ত থাকত যেখান থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের খাদ্য সরবরাহ করা হতো। লঙ্গরখানাগুলির ব্যয় নির্বাহ করা হতো দানকৃত অর্থ বা লাখেরাজ সম্পত্তির আয় থেকে। সুতরাং খানকাহ ও লঙ্গরখানাগুলি দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্তদের যথেষ্ট স্বস্তি দান করত। এসব লঙ্গরখানা সুফি-দরবেশদেরকে সাধারণ মানুষের অধিকতর কাছে আসার সুযোগ এবং তাঁদের অনুভূতি ও মনোভাব বুঝতে সাহায্য করেছিল।
খানকাহ ছিল মানবতা ভিত্তিক। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব মতের মানুষ এখানে আসত, অবাধ মেলামেশা এবং খোলাখুলি আলোচনায় প্রবৃত্ত হতো।
আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান ছাড়াও খানকাহগুলি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত। যেসকল সুফি তাঁদের সম্পূর্ণ সময় আল্লাহর ধ্যানে ব্যয় করতেন শুধু তাঁদের জন্য প্রতিষ্ঠিত নির্ধারিত খানকাহ এর প্রথম লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে ১২২১ খ্রিস্টাব্দের উৎকীর্ণ ‘সিয়ান’ শিলালিপিতে। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন যে এটি বাংলার দ্বিতীয় ইসলামি শিলালিপি। লিপিটির অবস্থানও কৌতূহলোদ্দীপক, কারণ এটি মুসলমানদের প্রাথমিক প্রশাসনিক কেন্দ্র লখনৌতি-এর অদূরে অবস্থিত। উপনিবেশিক শাসন আমলে ব্যাপকভাবে লাখেরাজ ভূমি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে বাংলার অনেক খানকাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। [রাশেদা ওয়াইজ]