মুর্শিদাবাদ
মুর্শিদাবাদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলা। এর সদর দফতরের নামও মুর্শিদাবাদ। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ নগর একদা পূর্বাঞ্চলীয় মুগল প্রদেশ সুবাহ বাঙ্গালার প্রধান নগররূপে বিখ্যাত ছিল এবং আঠারো শতকে বাংলার নওয়াবদের আবাসস্থল ছিল। আঠারো শতকের শেষ দিকে প্রথমে রাজকোষ এবং পরে প্রশাসনিক সদর দফতর কলকাতায় স্থানান্তরিত হলে নগরটির বর্তমান আকার হ্রাস পায়।
আধুনিক পূর্ব বাংলার নগরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর অস্থিতিশীলতা। শহরগুলি গড়ে উঠেছিল নদীসমূহের তীরে। তাই নদীর গতি পরিবর্তন এবং এ অঞ্চলে চুন ও পাথরের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ইট ও পাথরের স্থায়ী বাড়িঘর ছিল বিরল। বাড়িঘর বানানো হতো সাধারণত বাঁশ, পাতা এবং কাদা দিয়ে। উপমহাদেশের বড় নগরগুলির প্রায় সবগুলির মতোই মুর্শিদাবাদের সাধারণ বাড়িঘরগুলি কাদা ও পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছিল এবং রাস্তাগুলি ছিল সংকীর্ণ। অভিজাতবর্গ এবং ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘরগুলি অবশ্য ইটের তৈরী ছিল। সাধারণ বাড়িঘরগুলির মধ্যে মসজিদ ও বুদ্ধ-মন্দিরগুলি ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এগুলিও সুন্দর নকশা অনুযায়ী ছিল না। এমন কি, নওয়াবের প্রাসাদও জাঁকালো ছিল না।
১৮১৪ সালে নগর জজ এবং মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট জানান যে, ভাগীরথীর তীরে দশ মাইল বিস্তৃত লোকে লোকারণ্য অসংখ্য গ্রাম নিয়ে এটি গঠিত ছিল এবং এর এক বৃহৎ অংশই ছিল ইতস্তত ছড়ানো ঘন জঙ্গলে আবৃত। ক্যাপ্টেন জে.ই গ্যাসট্রেল ১৮৬০ সালে নগরটির ক্রমাবনতির বিষয় লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর মতে, নগর হিসেবে এর কোন সুনির্দিষ্ট সীমা ছিলনা বা এর কোন অংশ বিশেষভাবে ঐ নামে পরিচিত ছিল না। এ নাম দেওয়া হয়েছিল এলোমেলো বিক্ষিপ্ত কয়েকটি মন্দির, মসজিদ, সুন্দর পাকা বাড়ি, উদ্যান, বেষ্টনী প্রাচীর, কুঁড়েঘর, ক্ষুদ্র ঘরবাড়ি এবং মুর্শিদাবাদের নওয়াবদের বাসভবনগুলি ঘিরে গড়ে ওঠা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বহু অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষের চিহ্নিত গুল্মাবৃত জঙ্গলকে।
বাংলার দীউয়ান মুর্শিদকুলী খান ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দীউয়ানি প্রশাসনের কেন্দ্র ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নওয়াব হলে নিজামতের কেন্দ্রও এ নগরে স্থানান্তরিত হয় এবং এভাবে এটি সুবাহ বাঙ্গালার রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এটি প্রায় সত্তর বছর ধরে এ প্রদেশের রাজধানী ছিল। যদিও এ বছরগুলি সবসময়ই নিরবচ্ছিন্নভাবে শান্তিপূর্ণ ছিলনা যা নগর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়। মুর্শিদকুলী খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ চলে গেলে আঠারো শতকের প্রথম দিক থেকে মুর্শিদাবাদ নগরীর ইতিহাস শুরু হয়। কিন্তু এর উৎপত্তি ছিল অনিশ্চিত। রিয়াজ-উস সালাতীন গ্রন্থের প্রণেতা গোলাম হোসেনের মতে মখসুস খান নামক একজন ব্যবসায়ী সর্বপ্রথম মুর্শিদাবাদের বর্তমান স্থানের উন্নতি সাধন করেন। আইন-ই আকবরী গ্রন্থে ষোলো শতকের শেষ দশকসমূহে বাংলা এবং বিহারে দায়িত্ব পালনকারী মখসুস খান নামক একজন অভিজাত ব্যক্তির উল্লেখ আছে। সম্ভবত তিনি ছিলেন আকবরের রাজত্বকালে বাংলার গভর্নর সাঈদ খানের (১৫৮৭-৯৫) ভ্রাতা। তিনি একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করেন এবং দোকান দ্বারা একে ঘিরে রাখেন। স্থানটি তার নামানুসারে মখসুসাদাবাদ বা মখুসুদাবাদ নামে পরিচিত হয়। সম্ভবত ষোল শতকের শেষদিকে রচিত ভবিষ্যপুরাণের ব্রহ্মান্ড খন্ডে জনৈক যবন (মুসলমান) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মোরসুদাবাদ নামেও এ স্থানের উল্লেখ আছে। ভ্যালেন্টাইনের মানচিত্রে (১৬৫৮-৬৪) গঙ্গার দুটি শাখা দ্বারা গঠিত একটি দ্বীপ ‘মক্সুদাবাথ’ দেখানো হয়েছে।
সতেরো শতকে এ স্থান রেশম এবং রেশম বয়নের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৬২১ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইংরেজ প্রতিনিধিরা জানান যে, সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রেশম পাওয়া যেতে পারে। শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অবশেষে এটি একটি মুগল প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৬৬০-এর দিকে মুর্শিদাবাদ পরগনা সদর দফতরে পরিণত হয় এবং কাসিমবাজারের ইউরোপীয় কুঠিগুলির উপরও এর কর্মকর্তাদের এক্তিয়ার ছিল। ইংরেজ ব্যবসা-প্রতিনিধি স্ট্রিনশাম মাস্টার এবং উইলিয়ম হেজেস এটিকে এলাকার শাসনকারী স্থানীয় কর্মকর্তাদের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলার গভর্নর শাহজাদা আজিমুদ্দীন (আজিম-উস-শান) তাকে হত্যা করার এক অসফল প্রচেষ্টার পর মুর্শিদকুলী খানের ঢাকা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ব্যক্তিগত কারণ ছাড়াও এর মূলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক বিবেচনাও ছিল। মগ ও পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে ঢাকা তার কৌশলগত গুরুত্ব হারায় এবং ইউরোপীয় বণিকদের সামরিক কর্মকান্ডও মুর্শিদকুলী খানের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। সুতরাং তিনি তাঁর সকল রাজস্ব কর্মকর্তা, কতিপয় বিত্তবান বণিক এবং ব্যাংকারদের নিয়ে ঢাকা থেকে সরে পড়েন। তাঁর মখসুদাবাদে পৌঁছার পর তিনি শহরটির উন্নয়ন সাধন করেন, সরকারি দফতর ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলেন এবং এর নাম মুর্শিদাবাদ করেন। তাঁর সময়ে নগরটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং অর্ধ শতকের বেশি সময়ের জন্য বাংলার নওয়াবদের অধীনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
দরবার, সেনাবাহিনী, কারিগর এবং ইউরোপীয় ও এশীয় উভয় শ্রেণির ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বিপুলভাবে মুর্শিদাবাদের সম্পদকে বৃদ্ধি করে এবং এর প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপের ফলে অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সেখানে তাদের প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। শীঘ্রই মুর্শিদাবাদ টাকশাল বাংলায় বৃহত্তম টাকশালে পরিণত হয় এবং মুদ্রিত অর্থের মূল্যের উপর শতকরা দুভাগ হারে আদায়কৃত শুল্কের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লক্ষ রুপী। প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তা এবং সরকারি কার্যক্রম ও বাণিজ্যের বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবেই নগরটির সম্প্রসারণ ঘটে।
মুর্শিদকুলী খান শুধু শান্তিই নিশ্চিত করেননি, তিনি তাঁর উত্তরাধীকারীর জন্য একটি দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং একটি প্রতিষ্ঠিত রাজধানীও রেখে যান। তিনি চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদ (চিহিল সুতুন), একটি মসজিদ এবং একটি কাটরা (ভ্রাম্যমাণ বণিকদের জন্য বাসস্থান) নির্মাণ করেন। মসজিদটিতে বিপুল সংখ্যক কুরআন পাঠকারী নিয়োজিত থাকতেন। স্যার উইলিয়াম হেজেস কাটরাকে মুসলিম শিক্ষার শিক্ষালয় বলে বর্ণনা করেন। এর নিকটেই ছিল নওয়াবের অস্ত্রাগার তোপখানা। এটি নগরের পূর্বদিকের প্রবেশপথ ছিল। তাঁর উত্তরাধিকারী সুজাউদ্দীন একজন বড় নির্মাতা ছিলেন। তিনি তার পূর্বসূরি কর্তৃক নির্মিত ইমারতগুলিকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অপ্রতুল বলে বিবেচনা করেন এবং তিনি নগরে একটি প্রাসাদ, একটি অস্ত্রাগার, একটি সুউচ্চ প্রবেশদ্বার, একটি দীউয়ান খানা (রাজস্ব আদালত), সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য একটি বৃহৎ কক্ষ, একটি খাস কামরা, একটি রাষ্ট্রীয় অর্থভান্ডার (খালসা) প্রভৃতি জাঁকালো ইমারতসমূহ নির্মাণ করেন। একটি বিশাল জল সংরক্ষণাগার, প্রবহমান খাল, কৃত্রিম ঝর্ণা, বাগিচা, ফলজ বৃক্ষ প্রভৃতি সহ এক বিস্তৃত অঙ্গনে তিনি সুন্দরভাবে অলংকৃত একটি মসজিদও সম্পূর্ণ করেন। তিনি এ অঙ্গনের নাম দেন ফারাহবাগ (আনন্দ উদ্যান)।
নগরের কেন্দ্রে এবং নদীর তীরে অবস্থিত নওয়াব নাজিমের রাজপ্রাসাদসহ মুর্শিদাবাদ নগরে বেশ কিছু সংখ্যক জাঁকালো ইমারত ছিল। নওয়াবের প্রাসাদটি একটি বিশাল ও মনোরম অট্টালিকা ছিল। একই চত্বরে এটিসহ আরও কয়েকটি ইমারত আছে যা নিজামত কিল্লাহ (দুর্গ) নামে পরিচিত। রাজপ্রাদাসটি বড় কুঠি অথবা হাজার দুয়ারী নামে পরিচিত। এর অর্থ প্রাসাদে এক হাজার দরজা আছে। একই বেষ্টনীর মধ্যে ছিল ইমামবারা। মুহররম মাসে রাজপ্রাসাদটি রুচিসম্মতভাবে আলোকসজ্জিত করা হতো। এখানে দিবা-রাতে এবং বছরের অন্যান্য মাসে কুরআন তেলাওয়াত করা হতো। নিজামত কিল্লাহর প্রধান প্রবেশদ্বারসমূহের উপরে নওবতখানা (বাদকদলের আচ্ছাদিত স্থান) ছিল। এগুলি খুবই মনোরম এবং এত উঁচু ছিল যে এর নিচ দিয়ে আরোহিসহ একটি হাতি হেটে যেতে পারত।
মতিঝিল (মুক্তার হ্রদ) মুর্শিদাবাদ থেকে দুমাইল দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনীত সামগ্রী দিয়ে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা সেখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় রাজকোষ স্থানান্তরিত হওয়া পর্যন্ত সময়ে কোন কোন ইংরেজ রেসিডেন্ট ও গভর্নর এ প্রাসাদে বসবাস করতেন। মতিঝিলের বিপরীতদিকে ভাগীরথী নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত খোশবাগ (শান্তির উদ্যান) ছিল নওয়াবদের কবরস্থান। নগরের কেন্দ্রে মুন্নী বেগম কর্তৃক নির্মিত মোবারক মঞ্জিল নামে পরিচিত মসজিদটি উদার প্রকৃতির প্রার্থনার জন্য বিখ্যাত ছিল, কারণ এখানে শিয়া এবং সুন্নী মুসলিমগণ পাশাপাশি নামায পড়তেন। আঠারো শতকে নগর পরিদর্শনকারী ভ্রমণকারীদের বিবরণ হতে নগরের বিস্তৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। অধিকাংশ সমকালীন বিবরণ ধারণা প্রদান করে যে, নগরটি নদীর উভয় তীরে লম্বায় পাঁচ মাইল এবং পাশে আড়াই মাইল বিস্তৃত ছিল।
নগরটির ব্যাপ্তি সম্পর্কে নগরের ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ১৭৮০-এর দিকে প্রস্ত্ততকৃত প্রতিবেদন বিদেশী বসতিসমূহসহ মাহীনগর হতে বেরহামপুর পর্যন্ত এলাকা অন্তর্ভুক্ত করেছে। একে নগরীর দৈর্ঘ্য বলে ধরে নিলে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এর সর্বোচ্চ সমৃদ্ধির কালে নগরটি লম্বায় দশ মাইল এবং পাশে তিন মাইল বিস্তৃত একটি এলাকা অধিকার করেছিল এবং শহরতলী আরও বড় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। নিঃসন্দেহে শহর এবং শহরতলীর একটি বড় এলাকা জুড়ে ছিল বিপুল সংখ্যক উদ্যান, পুকুর এবং হ্রদ, কিন্তু কেন্দ্রীয় অংশ এবং কাসিমবাজার ও কালকাপুরসহ বাণিজ্যিক এলাকা ছিল অত্যন্ত জনসমাকীর্ণ। সম্ভবত নগরটির বিশাল আয়তন এবং সংকীর্ণ সড়ক ও গলিপথে বিপুল সংখ্যক জনসমাবেশের কারণে সৃষ্ট মানুষের ভিড়ের জন্য বিদেশী ভ্রমণকারি এর বিশালতাকে লন্ডনের সাথে তুলনা করেন। ‘মুর্শিদাবাদ নগর লন্ডন নগরের ন্যায় একটি ব্যাপক, জনাকীর্ণ ও সমৃদ্ধ নগর ছিল। শুধু পার্থক্য ছিল যে, প্রথমটিতে শেষটির চেয়ে সীমাহীন বিশাল সম্পদের অধিকারী কিছু ব্যক্তি আছেন।
আঠারো শতকের জনসংখ্যার কোন বিস্তারিত সংখ্যা নেই। এ শতকের মধ্যভাগে মুর্শিদাবাদ পরিদর্শনকারী ভ্রমণকারি অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে জনসংখ্যা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। জনসংখ্যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, স্থানীয় অধিবাসিগণ, চাকরিজীবীগণ এবং মুর্শিদাবাদের সর্বাপেক্ষা গৌরবজনক যুগ হিসেবে বিবেচিত আঠারো শতকের মধ্যভাগে নগরটিতে ভিড় জমানো ব্যবসায়ী এবং চাকরিপ্রার্থী বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদের বিবেচনা করে ১৭৫০-এর দিকে নগরের জনসংখ্যা ছয় থেকে সাত লাখ বলে প্রাক্কলন করা যেতে পারে। ১৭৬৯-৭০-এর দুর্ভিক্ষ জনসংখ্যাকে প্রায় অর্ধেক করে ফেলে। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর আরেকটি আঘাত হানে। যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোন প্রমাণ নেই, সেহেতু ধরে নেয়া যেতে পারে যে, শতকের শেষ দিকে নগরটির অবনতি প্রক্রিয়ার সমাপ্তি পর্বে, সংখ্যাটি নিশ্চিতভাবে দুলাখে নেমে এসেছিল। ১৮২৯-এর পূর্বে জনসংখ্যা বিষয়ক কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এ সময়ে নগরের ম্যাজিস্ট্রেট উল্লেখ করেন যে, নগরটির জনসংখ্যা হচ্ছে ১,৪৬,১৭৬। এ্যাডাম স্মিথ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮৩৭ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১,২৪,৮০৪। এতে আট বছরে প্রায় শতকরা পনেরোভাগ অবনতি দেখা যায়। ১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নগরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬,১৭২।
সরকারি বিভাগসমূহ ছাড়াও ভূমিজ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থও নগরের বৃদ্ধিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। জমিদারগণ রাজধানীতে নায়েব, উকিল, সংবাদ-বাহক, পিয়ন এবং অন্যান্য চাকরবাকরদের একটি স্থাপনা সংরক্ষণ করত; বড় ব্যবসায়িগণ এবং বণিকরাও তাই করত। সকল বিদেশী কোম্পানির আলাদা কারখানা ছিল এবং তাদের নিজেদের কর্মকর্তা এবং ভৃত্যবর্গ ছাড়াও প্রতিনিধি, দালাল এবং শ্রমিক হিসেবে শত শত লোক নিয়োজিত ছিল।
নগরটি একটি উৎপাদনকেন্দ্র, বিপনন স্থান এবং প্রবেশকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হতো। এটি অভ্যন্তর হতে মালামাল গ্রহণ করত এবং বাংলার ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন স্থানে সেগুলি প্রেরণ করত। ১৭৪৯ হতে ১৭৬৯ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদে কাঁচা রেশম ও বস্ত্র হতে আদায়কৃত বার্ষিক গড় আমদানি-রপ্তানি করের পরিমাণ ছিল আড়াই লক্ষের উপর। শুধু কর প্রদানকারী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যতদিন এটি রাজধানী ছিল, এক বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার তাদের অসংখ্য কর্মচারীসহ নগরে বসতি স্থাপন করেছিল।
যেহেতু নগরটিতে প্রশাসন, শিল্পোৎপাদন এবং বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল, সেহেতু নগরের জনসংখ্যার এক বিপুল অংশ বিভিন্ন কারুশিল্প ও সেবামূলক শিল্পসমূহে নিয়োজিত ছিল এবং তাদের প্রায় সকলেই আলাদা আবাসস্থলে বাস করত। এরূপ কিছু আবাসস্থল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, জহুরতলী (জহুরী এলাকা), কাঠগোলা (কাঠের বাজার), চিনিটোলা (চিনির এলাকা), লাকড়িগঞ্জ (জ্বালানী কাঠের বাজার), গাড়োয়ানটোলা (গরুর গাড়ি এবং ঠেলাগাড়ির এলাকা) এবং বকরিগলি। ব্যবসার পণ্যসামগ্রীর নামানুসারে এ এলাকাগুলির নামকরণ করা হয়েছিল। চক নামে পরিচিত প্রধান বাজারটি নগরের একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। নিত্যবাজারস্থলগুলি ছাড়াও নগরের মধ্যে ও আশে-পাশে কয়েকটি গঞ্জ ছিল।
একটি ছোট বাজার শহর থেকে মুর্শিদাবাদ একটি প্রদেশের সদর দফতরের অবস্থানে উন্নীত হয় এবং আঠারো শতকের মধ্যভাগে এটি বাংলার সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী ও জনবহুল নগরে পরিণত হয়। কিন্তু এ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এটি এর গৌরব এবং গুরুত্ব যত দ্রুত অর্জন করেছিল তার চেয়ে দ্রুত গতিতে তা হারিয়ে ফেলে। এ পতনের পেছনে কতগুলি কারণ ছিল।
পলাশীর যুদ্ধের পরে এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীউয়ানি লাভের পরে, বাংলার বিষয়ে কোম্পানির নীতি ছাড়াও এবং ১৭৬৯-৭০-এর মহাদুর্ভিক্ষ নগর পতনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর অংশ জুড়ে ধ্বংসাত্মক মহাদুর্যোগ কবলিত দুর্ভিক্ষ মুর্শিদাবাদের অধিবাসী এবং উৎপাদনকারীদের ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। যারা বেঁচে যায় তারাও দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে অক্ষম ছিল। সরকারি তদন্তে দেখা যায় যে, ব্যাপকহারে তাঁতী, শিল্প-কারিগর এবং শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটায় দুর্ভিক্ষের পর মুর্শিদাবাদের রেশম উৎপাদনের অবনতি ঘটে। এমনকি দুর্ভিক্ষের দুবছর পরেও মুর্শিদাবাদের অবস্থা ছিল একটি পরিত্যক্ত নগরের ন্যায় এবং এর পরিণতি মোকাবেলা করারও কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। এ অবস্থা ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি মুর্শিদাবাদে আগত সফরকারি সার্কিট কমিটির সদস্যদের দৃষ্টি এড়ায়নি এবং তাদের মনোভাব খালসাকে (কোষাগার) কলকাতায় সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে দীউয়ানি এবং খালসার কলকাতায় স্থানান্তর ছিল প্রদেশের প্রধান নগর হিসেবে মুর্শিদাবাদের অবস্থানের ওপর একটি প্রচন্ড আঘাত। শুধু খালসাই নয়, অবশেষে দীউয়ানি এবং ফৌজদারি বিচারের সুপ্রিম কোর্ট দুটিও কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে শুধু কাজী, কোতোয়াল, কানুনগো এবং মুহতাসিবদের কার্যালয় কিছুদিনের জন্য থেকে যায়। এ ব্যবস্থাসমূহের দ্বারা সকল ক্ষমতা এবং প্রাদেশিক সরকার কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এটি কার্যত বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়।
নওয়াবের বাসস্থান, কোম্পানির কুঠির কেন্দ্র, শুল্কভবন, একজন ইংরেজ প্রতিনিধি এবং নিজামত ও ফৌজদারি আদালতসমূহ মুর্শিদাবাদেই থেকে যায়। কিন্তু সকল শাখা ও কর্মচারীসহ রাজস্ব বিভাগের স্থানান্তরকরণ শুধু মর্যাদার ক্ষেত্রেই নয়, বরং নগরের অর্থনৈতিক জীবনেও আঘাত হানে।
একটি নতুন প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার উত্থানে মুর্শিদাবাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। নওয়াবের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ হ্রাস পাওয়ায় এবং অভিজাতদের নিঃস্বতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ভোক্তার কেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের অবনতি ঘটে। বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা, কারণিক, ভৃত্য, ব্যাংকার এবং বণিকদের জন্য একটি লাভজনক বাজার হিসেবে এর সমাপ্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে এটি একটি জেলা শহরের রূপ ধারণ করে। [কে.এম মোহসীন]
গ্রন্থপঞ্জি WW Hunter, A Statistical Account of Bengal, IX, London, 1876; Major JHT Walsh, A History of Murshidabad District, London, 1902; LSS O’Malley, Bengal District Gazetteers, (Murshidabad), Calcutta, 1914; KM Mohsin, A Bengal District in Transition: Murshidabad 1765-93, Dhaka, 1973; K Ballhatehet & J Harrison (ed.), The City in South Asia (Pre-Modern and Modern), London, 1980.