প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর  ১৯৪৭ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পর দেশের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার এবং সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার করাচিতে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ’-এর পরিবর্তে, ‘প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠা করে। নব্য প্রতিষ্ঠিত এই অধিদপ্তরের পূর্ব পাকিস্তানের সার্কেল অফিস ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে রাজশাহী থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। অপর্যাপ্ত জনশক্তি ও অপ্রতুল অর্থের কারণে অধিদপ্তরের কর্মকান্ড প্রধানত নির্ধারিত অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন এবং ধ্বংসাবশেষসমূহের সংরক্ষণ এবং উৎখননে কেন্দ্রীভূত থাকে।

কিউ এম মনির ছিলেন নব্য প্রতিষ্ঠিত অধিদপ্তরের প্রথম পরিচালক। পরবর্তীতে মৌলভী সামসুদ্দীন আহম্মদ পরিচালক পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের প্রাক্তন মহাপরিচালক স্যার মর্টিমার হুইলার ১৯৪৯ সালে অধিদপ্তরের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫০ সালে করাচিতে পাকিস্তানের জাতীয় জাদুঘর স্থাপন করেন। একই বছরে তিনি মহেঞ্জোদারোতে প্রশিক্ষণ এবং উৎখনন পরিচালনা ও অনুসন্ধান ও উৎখননের একটি প্রণালীবদ্ধ কর্মসূচি সম্পন্ন করেন।

১৯৫১ সালে অধিদপ্তর একটি অনুসন্ধান শাখা সৃষ্টি করে। এই শাখা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করে। ১৯৫৪ সালে রাউল কিউরিয়েল ৪ বছরের জন্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি ১ বছরের জন্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা হন। এ সময়ে প্রত্নতত্ত্বের সকল ক্ষেত্রে প্রভূত কাজ সম্পাদিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকগুলো স্থানে এবং পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলায় অনুসন্ধানের কাজ সম্পন্ন করা হয়। একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রত্নস্থলে এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ময়নামতিস্থ শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া এবং চারপত্র মুড়ায় খনন কাজ করা হয়। পরবর্তীতে উৎকীর্ণলিপি সংক্রান্ত নির্দেশনাবলীর জরিপ, তা সংগ্রহ ও সমীক্ষা এবং অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রকাশনার উদ্দেশ্যে উৎকীর্ণলিপি শাখা এবং প্রকাশনা শাখা সৃষ্টি করা হয়।

১৯৫৮ সালে এফ.এ খান পরিচালক হিসেবে দুয়িত্ব গ্রহনের পর প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় একাধিক কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রত্নস্থলে জাদুঘর (site museum) নির্মিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পাহাড়পুরে ১৯৫৬-৬৭ সালে সর্বপ্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। তার এক দশক পর ময়নামতি জাদুঘর (১৯৬৬) এবং মহাস্থান জাদুঘর স্থাপিত হয়।

অধিদপ্তর ১৯৪৮ সাল থেকে ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান এবং ইটালির অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক মিশনকে সহযোগিতা করে। কিন্তু এসব মিশনের কাজ পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়া অধিদপ্তরের ১৯৬১ এবং ১৯৬৩-এর মধ্যে স্বাধীনভাবেও পশ্চিম অংশের বিভিন্ন জায়গায় এবং পূর্বাংশের ঢাকা, খুলনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর জেলাসমূহে অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করে।

অধিদপ্তর ১৯৬০ এর দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু প্রত্নস্থলে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে। তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গোবিন্দ ভিটা, বৈরাগির ভিটা, মানকালীর কুন্ড, গোকুল মেধ (১৯৬১), পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (১৯৬৭-৬৮), সত্যপীর ভিটা (১৯৬৪-৬৮), শালবন বিহার, কুটিলা মূড়া, বিবি বেগনী মসজিদ (১৯৬৫), রণবিজয়পুর মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ, খেরুয়া মসজিদ, শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর মাযার ও মসজিদ, তাহখানা, ইদ্রাকপুর দুর্গ, লালবাগ দুর্গ, সোনাকান্দা দুর্গ, হাজীগঞ্জ দুর্গ (১৯৬৮-৬৯), কুঠিবাড়ী, সাত মসজিদ এবং নয়গম্বুজ মসজিদ (১৯৬৭-৬৮) প্রভৃতির সংস্কার করে। তাছাড়াও ১৯৬৪ সালে এফ.এ. খান কর্তৃক ‘পাকিস্তান আর্কিওলজি’ শীর্ষক জার্নাল প্রবর্তনের ফলে অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ড যেমন অনুসন্ধান, উৎখনন, সংস্কার, উৎকীর্ণলিপির পাঠোদ্ধার ইত্যাদির তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে।

১৯৬৮ সালে পুরাকীর্তির সংরক্ষণ ও সংস্কার সংক্রান্ত প্রাচীন স্মৃতিচিহ্নের সংস্কার আইন-১৯০৪ (The Ancient Monuments Preservation Act, 1904) এবং পুরাকীর্তির (রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৪৭ [The Antiquities (Export Conrol) Act-1947)] বাতিল করা হয় এবং ‘পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮’ (Antiquities Act-1968) নামে নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়। নাজিমুদ্দীন আহম্মদ ১৯৬৯ সালে এফ.এ. খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৯৭৩ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ সরকার দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ‘প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ভূতপূর্ব পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগের পূর্ব কেন্দ্রের (ইস্টার্ন সার্কেল) অপর্যাপ্ত সম্প্রসারণ। একজন পরিচালক, দু’জন তত্ত্বাবধায়ক, একজন প্রত্নতাত্ত্বিক রসায়নবিদ ও একটি ক্ষুদ্র প্রকৌশল শাখা নিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু হয়েছিল।

১৯৭৩ সালে করাচি থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সকল বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। এর পর থেকে অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিতভাবে প্রত্নস্থলসমূহের সংরক্ষণ, সংস্কার ও পুনরুদ্ধার, অনুসন্ধান ও উৎখনন, প্রত্নবস্ত্ত সংগ্রহ, জাদুঘরসমূহের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রভৃতি কাজ হতে থাকে। স্বাধীনতার সময় দেশে ১৫২টি সংরক্ষিত প্রত্নস্থল, ৪টি প্রত্নস্থল জাদুঘর এবং ৩টি গ্রন্থাগার তথা জাদুঘর (Library/Museum) ছিল। ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৯৭টি সংরক্ষিত প্রত্নস্থল, ১৪টি প্রত্নস্থল জাদুঘর এবং ৪টি গ্রন্থাগার তথা জাদুঘর সৃষ্টি হয়েছে। তন্মধ্যে কেবল পানাম শহরেই ৪৯টি স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ভবন (heritage building) আছে।

ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে জানুয়ারি ১৯৭৩ পর্যন্ত সময়ে মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন, লালবাগ দুর্গ থেকে পুলিশের সদর দফতর স্থানান্তর করা এবং অধিদপ্তর কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে দুর্গটি দখল করার কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে অধিদপ্তর প্রায় এক দশক এ প্রত্নস্থলে সংস্কার কাজ পরিচালনা করে।

নাজিমুদ্দীন আহম্মদ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ এ দেশে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরে যোগদান করেন এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ তে অবসর গ্রহণ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে বহু প্রত্নস্থল অনুসন্ধান, সংরক্ষণ, উৎখনন এবং একইসঙ্গে অনেক স্মৃতিচিহ্নের সংস্কার করা হয়।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ভাসুবিহারে, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ (১৯৮১-৮২ এবং ১৯৮২-৮৪ ব্যতীত) পর্যন্ত বিহারধাপে, ১৯৮১ এবং ১৯৮৩ সালে মঙ্গলকোটে এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আনন্দবিহার উৎখনন করা হয়। দীর্ঘ সময় পর ১৯৮২ সালে পাহাড়পুরে পুনরায় খনন কাজ শুরু করা হয় এবং ১৯৯০ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। দুই পর্যায়ে এই খনন কাজ সম্পন্ন হয়। একই সময়ে দেশের অন্যান্য অংশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা হয়। ফলে নওগাঁ জেলার হলুদ বিহার, বগুড়া জেলার পাথরঘাটা এবং বগুড়ার মহাস্থানগড়ের আশপাশে অবস্থিত মঙ্গলকোট, গোদাইবাড়ীধাপ, কানাইধাপ, শালীবাহন রাজার বাড়ি, শালীবাহন রাজার কাচারি, যোগীর ভবন, দোলমঞ্চ, ধানিকের ধাপ, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার কাঞ্জিরধাপ ও অরুণধাপ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুরের ধাপসমূহ আবিষ্কার এবং সংরক্ষণ করা হয়।

প্রচলিত অনুসন্ধান কার্যক্রম ছাড়াও প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতায় ১৯৭৫ সালে বগুড়া জেলায় একটি সারথী জরিপ প্রকল্প শুরু করা হয়। ১৯৮১ সালে এটি সমাপ্ত হয়। ফলে ১৯০টি স্মৃতিচিহ্ন এবং ১১৫টি প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঢিবি জরিপ, দালিলিকরণ এবং ১৯৭৫ এবং ১৯৭৭ এর মধ্যে ২৮টি প্রত্নস্থল (ঢিবি ও স্মৃতিচিহ্ন) সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৮৬ সালে এ প্রকল্পের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংস্কার কাজ করা হয় বিভিন্ন খননকৃত প্রত্নস্থল যেমন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, সত্যপীর ভিটা, সীতাকোট বিহার, শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া এবং বহু মুসলিম এবং হিন্দু স্মৃতিচিহ্নে। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলগুলো হল বাবা আদম মসজিদ, হাজীগঞ্জ দুর্গ, সোনাকান্দা দুর্গ, খান মুহম্মদ মৃধা মসজিদ, রেজাখোদা মসজিদ, সিঙ্গাইর মসজিদ, শাহ আলী কুলী বেগ সৌধ, নয়াবাদ মসজিদ, ফররুখ শিয়ার মসজিদ, রোহনপুর সমাধিসৌধ, খানিয়া দীঘি মসজিদ এবং পুটিয়া শিব মন্দির।

১৯৭৬ সালের ‘পুরাকীর্তি অধ্যাদেশ’ দ্বারা ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইন সংশোধন করা হয়। ১৯৮০ সালে ‘Bangladesh Archaeology, Vol-1’ শীর্ষক বিভাগীয় জার্নাল (ইংরেজি) প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত অধিদপ্তরের কার্যাবলী এই জার্নালে অন্তর্ভুক্ত হয়। অধিদপ্তর মহাস্থানগড় খনন পুস্তিকা এবং ‘মহাস্থান, ময়নামতি, পাহাড়পুর’ পুস্তিকাটির সংশোধিত রূপে পুন:মুদ্রণ করে।

তদানীন্তন পাকিস্তানের লাহোরে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক রসায়নাগার ছিল। এই রসায়নাগারে দেশের অস্থাবর প্রত্নবস্ত্তসমূহের রাসায়নিক পরীক্ষা ও পরিচর্যা করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এরূপ কোন রসায়নাগার ছিল না। ১৯৭৪ সালে লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরে প্রথম একটি রসায়নাগার স্থাপন করা হয়। এই শাখা সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন জাদুঘরসমূহের এবং খনন বা সংগৃহীত প্রত্নবস্ত্ত এবং দন্ডায়মান স্মৃতিচিহ্ন ও খননে উন্মোচিত স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ-এর পরিচর্যা করার ফলে এসব পুরাকীর্তির একেবারে বিলীন হওয়া রোধ করা সম্ভব হয়েছে।

১৯৮৩ সালে অধিদপ্তর পুনর্গঠিত হয়ে এর পরিবর্তিত নাম করা হয় ‘প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর পরিদপ্তর’। এর প্রধান দপ্তর ঢাকায় এবং তৎকালীন ৪টি বিভাগ ৪টি আঞ্চলিক পরিচালক দপ্তর স্থাপিত হয়। প্রধান দপ্তরে প্রশাসন ও হিসাব শাখা ছাড়াও প্রকাশনা, উৎকীর্ণলিপি ও মুদ্রাতত্ত্ব, সংরক্ষণ ও প্রত্নবস্ত্ত, প্রকৌশল এবং রসায়নাগার নামে ৫টি কারিগরী শাখা সৃষ্টি করা হয়। ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক দপ্তর স্থাপিত হয় ঢাকায়। পক্ষান্তরে বিদ্যমান প্রত্নস্থলসমূহের আধিক্যের বিষয়টি বিবেচনা করে চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক অফিসসমূহ যথাক্রমে কুমিল্লা, বাগেরহাট এবং বগুড়ায় স্থাপন করা হয়। ১৯৯২ সালে খুলনা শহরে বিভাগীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সময় খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় বাগেরহাট থেকে খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু পূর্বের অনুসন্ধান ও খনন শাখা, স্মৃতিচিহ্ন, জাদুঘর এবং প্রত্নস্থানসমূহ (শাখা) এবং স্মৃতিচিহ্নের জরিপ প্রকল্প বিলুপ্ত করা হয়। ফলে অনুসন্ধান ও খনন এবং সংরক্ষণ কাজ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর আঞ্চলিক দপ্তরসমূহের উপর ন্যস্ত হয়।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এবং ঐতিহাসিক মসজিদ নগরী বাগেরহাটকে সংরক্ষণের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা ১৯৮৩ সালে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৮৫ সালে উভয় প্রত্নস্থলই বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে প্রত্নস্থল দুটির সংস্কার, উপস্থাপন এবং প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে প্রথম পর্বে ৫ বছরের জন্য ১৯৮৭ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয় যা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে চালু থাকে এবং ২০০২ এ সমাপ্ত হয়। আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় পাহাড়পুর বিহারে খনন কাজ পুনরায় শুরু করা হয় এবং পাহাড়পুর বিহার ও সত্যপীর ভিটা এবং বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, সিঙ্গাইর মসজিদ, বিবিবেগনী মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, জিন্দাপীর মসজিদ এবং সাবেকডাঙ্গা স্মৃতিচিহ্নের সংস্কার করা হয়। পাহাড়পুর বিহারের মন্দিরের দেয়ালে ৮২২টি পোড়ামাটির ফলক অনুকৃতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে পাহাড়পুরে ও ১৯৯৯ সালে বাগেরহাটে ২টি প্রত্নস্থল জাদুঘর এবং উভয় স্থানে অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। পাহাড়পুরের পুরনো এবং ছোট জাদুঘরটি বিশ্রামাগারে রূপান্তর করা হয় এবং প্রদর্শন সামগ্রীসমূহ নতুন জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়। বাগেরহাট জাদুঘরে প্রধানত স্থানীয় জনৈক প্রত্নসামগ্রী সংগ্রাহকের বিভিন্ন সময়ে সংগৃহিত উলুখ খান জাহানের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্নবস্ত্তসমূহ এবং এই এলাকার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে উদ্ধারকৃত মুসলিম যুগের প্রত্নবস্ত্ত প্রদর্শন করা হয়।

সারথী জরিপ প্রকল্প সমাপ্তির পর ঢাকা বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্ট জেলাগুলোর জরিপের উদ্দেশ্যে জরিপ প্রকল্পের প্রথম পর্ব (১৯৮১-৮৫) চালু করা হয়। অবশিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করা এবং খুলনা বিভাগের বৃহত্তর ৪টি জেলার (খুলনা, যশোর, বরিশাল ও কুষ্টিয়া) জরিপের উদ্দেশ্যে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৮৬-৯১) শুরু করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি কেবল দিনাজপুর, ফরিদপুর এবং মুন্সিগঞ্জ  জেলার প্রতিবেদন ইংরেজিতে এবং পাবনা, যশোর ও খুলনা জেলার প্রতিবেদন বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।

অধিদপ্তর পুনর্বিন্যাসের ফলে আঞ্চলিক দপ্তরগুলো স্ব স্ব বিভাগের খনন এবং সংস্কার কাজ শুরু করে। অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার ময়নামতি-লালমাই অঞ্চলের রূপবান মুড়ার খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। একই বছর নওগাঁ জেলার হলুদ বিহারে সর্বপ্রথম খনন করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে এ স্থল পুনরায় খনন করা হয়। ১৯৮৬ সালে যশোরের কেশবপুরের ভরত ভায়না ঢিবি, ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯-এর মধ্যে সাভারের হরিশচন্দ্র রাজার বাড়ি এবং ১৯৮৬ সালে ইটাখোলা মুড়া খনন করা হয়। ১৯৮৮ সালে মহাস্থানগড়ে পুনঃখনন শুরু হয়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত গড়ের পূর্ব প্রাচীর এবং মাযার এলাকায় খনন সম্পাদিত হয়। ১৯৮৯ সালে সাতগাছিয়া গায়েবানা মসজিদ খনন করা হয়।

খননের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্নস্থলে অনুসন্ধানের কাজ সম্পন্ন করা হয়। চাঁদগাহী ভূঁইয়া মসজিদ, খুরশীদ আলম মসজিদ, খইনা মুড়ী, চীনার মুড়ী, গায়েবী দিঘি মসজিদ, ঘোলদার মসজিদ, সীতানাথ আশ্রম, খেলারাম দাতার বাড়ী, বারুরী ফুলবাড়ী মন্দির, মুড়াপাড়া প্রাসাদ, বালিয়াটি প্রাসাদ, পুটিয়ার একগুচ্ছ মন্দির, দুবলহাটি প্রাসাদ, দিনাজপুর প্রাসাদ এবং বড়কুঠি-এর অন্তর্ভুক্ত।

অনেক প্রত্নস্থলে সংস্কার কাজ করা হয়। এগুলো হল হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির, গোকুল মেধ, কুসুম্বা মসজিদ, সীতাকোট বিহার, বড় গোবিন্দ মন্দির, শাহ নিয়ামত উল্লাহ ওয়ালী মসজিদ, নবরত্ন মন্দির, কিসমত মারিয়া মসজিদ, বাঘা মসজিদ, জোড় বাংলা মন্দির, সুরা মসজিদ, মিঠাপুকুর মসজিদ, দারাসবাড়ী মাদ্রাসা ইত্যাদি। এছাড়া বহু স্মৃতিচিহ্নে ছোট খাট মেরামত কাজ করা হয়।

১৯৯০ সালে অধিদপ্তরের নাম ‘প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর পরিদপ্তর’ থেকে ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর’-এ পরিবর্তন করা হয়। তবে এর প্রধান কার্যনির্বাহীর পদমর্যাদা একই থেকে যায়। এই সময় কিছু পুস্তক প্রকাশিত হয় যেমন, বাংলাদেশের ‘An Album of Archaeological Relics in Bangladesh’ (প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এ্যালবাম) ও ‘Sculptural Arts of Bangladesh’ (বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্প)।

১৯৯২ সালে সময়ে ঝিনাইদহ জেলার শহর মুহাম্মদবাদ (বর্তমানে বারোবাজার নামে পরিচিত) এ খনন করা হয়। প্রথম মৌসুমে জোড় বাংলা ঢিবি, গলাকাটা ঢিবি এবং ঘরের দীঘি বা মাতারানী ঢিবি শীর্ষক এই তিনটি ঢিবিতে খনন করা হয়। শহরের আরো ধ্বংসাবশেষ উন্মোচনের জন্য এখানে এক দশক যাবত খনন অব্যাহত থাকে।

মহাস্থানগড়ে যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকান্ড পরিচালনার উদ্দেশ্য ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তদানুযায়ী পরবর্তী বছর যৌথ উদ্যোগে খনন কাজ শুরু হয় এবং প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত খনন কাজ চলে। খনন কাজে জ্যা ফ্রাঁসোয়া সালে এবং শফিকুল আলম যথাক্রমে ফ্রান্স ও বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। এ দীর্ঘ অভিযানে মহাস্থানগড়ে প্রথমবারের মতো প্রাক-মৌর্য যুগের গুরুত্বপূর্ণ নির্দশনসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে এই প্রথম মহাস্থানগড়ের বেশ কিছু বিভিন্ন বসতি যুগের তারিখ কার্বন-১৪ পরীক্ষায় নির্ণয় করা হয়েছে।

১৯৯৪-১৯৯৫ সালে বারোবাজারের নুনগোলা, মনোহর ঢিবি, শুকুর মল্লিকের ঢিবি, ঘোপের ঢিবি, পাঠাগার ঢিবি এবং পীরপুকুর ঢিবিতে খনন করা হয়। একই মৌসুমে বগুড়ায় গোদাইবাড়ী ধাপে খনন শুরু করা হয় এবং পরবর্তী তিনটি মৌসুমে তা অব্যাহত থাকে। ১৯৯৩-৯৪ এ কুমিল্লার ভোজ বিহারে খনন আরম্ভ করা হয় এবং বৃহৎ এই প্রত্নস্থল উন্মোচনের লক্ষ্যে ২০০৪ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এই সময়ে জাহাজঘাটা হাম্মামখানা, গোড়ার মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ, পীরপুকুর মসজিদ, এম.এম. দত্তের বাড়ি, কান্তনগর মন্দির, রাজা হরিশচন্দ্রের ঢিবি, সাত মসজিদ, লালবাগ দুর্গ এবং সাত গাজী ভূঁইয়া মসজিদ এ সংস্কার করা হয়।

১৯৯৬ সালে লালবাগ দুর্গে খনন শুরু করা হয় এবং তা ২০০০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কয়েক বছর বিরতির পর ২০০৫ সালে খনন পুনরায় শুরু হয়। ভারত ভায়নায় ১৯৯৫-৯৬ সালে পুনরায় খনন করা হয় এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতি শীত মৌসুমে অব্যাহত থাকে। জাহাজঘাটা, দমদম এবং নামাজগাঁও শীর্ষক বারোবাজারের আরও তিনটি প্রত্নস্থল খনন করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ এ কুমিল্লার রানীর বাংলোয় খনন পুনরায় শুরু করা হয়।

আঞ্চলিক পরিচালক অফিসসমূহ কর্তৃক প্রতি বছর বেশ কিছু সংখ্যক প্রত্নস্থলে খনন এবং প্রকল্প সমূহের আওতায় জরিপ কাজ করা হলেও প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংখ্যা খুবই কম। ফলে প্রথম সংখ্যার ন্যায় সকল কার্যাবলী অন্তর্ভুক্ত করে অধিদপ্তর ‘বাংলাদেশ আর্কিওলজি’ শীর্ষক জার্নাল এর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত তথ্যের জন্য জার্নালটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে শুধূমাত্র স্বতন্ত্র প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সময়ের কাজের বিচ্ছিন্ন প্রতিবেদনগুলো প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে বেশ কিছু প্রতিবেদন, গবেষণা কাজ এবং গাইড বই প্রকাশ করা হয়। প্রকাশনাসমূহ হল, আনন্দ বিহার, রূপবান মুড়া, বিহার ধাপ, হলুদ বিহার, রয়ালবাড়ী এবং মহাস্থানগড়ে ফ্রান্স-বাংলাদেশ খনন প্রতিবেদন, ‘History of Dhaka Based on Inscriptions and Architecture: A Portrait of Sultanat Period’ শীর্ষক গবেষণা কর্ম, মহাস্থান প্রদর্শনীর তালিকা, মুন্সীগঞ্জ এবং বৃহত্তর দিনাজপুর, ফরিদপুর, খুলনা জেলার (বাংলা) জরিপ প্রতিবেদন এবং পাহাড়পুর, ময়নামতি-লালমাই, লক্ষণাবতী-গৌড় এবং চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর এর গাইড বই (বাংলায়)। এ প্রক্রিয়ায় পূর্ববর্তী অসম্পূর্ণ কিছু কাজ হালনাগাদ করা হয়।

জগদল বিহারে খনন কাজ প্রথম শুরু করা হয় ১৯৯৬-৯৭ এবং ১৯৯৮-৯৯ সালে। ১৯৯৭-৯৮ সালে এখানে পুনরায় খনন করা হয়। এ সময়ে কুতুব মসজিদ, লালবাগ দুর্গ, পাতরাইল মসজিদ, মীর কাদিম সেতু, মুক্তাগাছা, সাহেব বাড়ী মসজিদ ইত্যাদি বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নের সংস্কার করা হয়।

২০০০-০১ সালে কুমিল্লার আনন্দ বিহার ও ময়নামতি ঢিবি-১, ২০০১ সালে বারোবাজারের বাদেডিহি ২০০২-২০০৪ সালে যশোরের ভাত ভিটা, ২০০৩ সালে বগুড়ার শালীবাহন রাজার বাড়ী এবং ২০০৩-২০০৬ সালে লতিকোট মুড়ায় খনন করা হয়।

২০০৪-২০০৫ সালে উয়ারী বটেশ্বর, নরসিংদী এবং যশোরের দমদম পীরস্থান ঢিবিতে খনন করা হয়। শেষোক্ত স্থানে খনন কাজ ২০০৯-১০ পর্যন্ত চালু থাকে। এ সময়ে হাজী মোহাম্মদ মোহসীনের ইমামবাড়া (যশোর), গালুয়া মসজিদ, শুভড়াঢ়া মসজিদ, সিংদহ মসজিদ, মিঠাপুকুর মসজিদ, তাজহাট প্রাসাদ, উলচাপাড়া মসজিদ, আরিফাইল মসজিদ, বড় শরিফপুর মসজিদ এবং বিথাঙ্গল আখড়ায় সংস্কার করা হয়।

২০০৫ সালে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি কমপ্লেক্স থেকে রংপুর জাদুঘর তাজহাট প্রাসাদে স্থানান্তর করা হয়।

২০০৫-২০০৯ কার্যসময়ে অধিদপ্তরের প্রধান নির্বাহীর পদবীটি মহাপরিচালক এ রূপান্তরিত হয়। অধিদপ্তরের প্রথম মহাপরিচালক হন শফিকুল আলম। শেরেবাংলানগরের আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকায় অধিদপ্তরের নিজস্ব ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং ২০০৬ এ সেখানে প্রধান দপ্তর এবং তার শাখাসমূহ এবং ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক দপ্তর স্থানান্তরিত হয়। অধিদপ্তর ২০০৫ সালে প্রত্নচর্চা নামে একটি নতুন জার্নাল প্রকাশ করে।

২০০৬-০৭ সালে আনন্দ বিহারে পুনঃখনন, ২০০৬-০৭ সালে বিহার ধাপে, ভাসু বিহার ও পাহাড়পুর কেন্দ্রীয় মন্দিরে ২০০৭-০৮ সালে এবং শালবন বিহার ও খান জাহানের বসত বাটিতে ২০০৯-১০ এবং খনন কাজ শুরু হয় এবং পরবর্তী মৌসুমে তা অব্যাহত থাকে।

বিহারধাপ, পাহাড়পুর, ভোজ বিহার, রূপবান মুড়া, লতিকোট মুড়া, পানাম নগর, নূনগোলা মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ,  ইমামবাড়া, মানকালীর কুন্ড, শুভড়াঢ়া মসজিদ, দক্ষিণ ডিহি, মোমিন মসজিদ, বরিশাল পুরানো কালেক্টরেট ভবন, কুটিলামুড়া, বকশী হামিদ মসজিদ এবং আরো অনেক প্রত্নস্থলে সংস্কার কাজ হয়।

২০০৯ সালে শালবন বিহার, খান জাহানের বসতবাটি, লালবাগ দুর্গ এবং মহাস্থানগড়ে খনন কাজ করা হয়। শালবন বিহার, এম.এম. দত্তের বাড়ি, শেখপাড়া মসজিদ, নূনগোলা মসজিদ, শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, দক্ষিণ ডিহি এবং শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি সংস্কার করা হয়।  [শফিকুল আলম]

সূত্র পাকিস্তান আর্কিওলজি নং-১, ১৯৬৪, বাংলাদেশ আর্কিওলজি নং- ১, ১৯৭৯, প্রত্নচর্চা সংখ্যা- ১-৪; ২০০৭-২০০৮।