সাংবিধানিক ক্রমবিকাশ
সাংবিধানিক ক্রমবিকাশ ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলায় সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত শাসনপদ্ধতির ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। কোম্পানির স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে সূত্রপাত ঘটে ঔপনিবেশিক শাসনের এবং ক্রমশ তা পশ্চিমা শাসনতান্ত্রিক আদলে রূপান্তরিত হয়। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাসের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ার সূচনা হয় এবং চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত মডেল অনুসারে ১৯৪৭ সাল থেকে সাংবিধানিক ধারার বিকাশ ঘটতে থাকে।
রেগুলেটিং অ্যাক্ট ১৭৭৩ উপমহাদেশের সাংবিধানিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এ অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলা এবং অন্যান্য প্রেসিডেন্সি শাসনভার ও নিয়ন্ত্রণ একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত হয়, যা ‘বাংলার গভর্নর জেনারেল ও ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল’ নামে পরিচিত ছিল। চার সদস্য বিশিষ্ট এ কাউন্সিল পার্লামেন্ট কর্তৃক পাঁচ বছরের জন্য মনোনীত হতো। গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে আরও কয়েকটি চার্টার অ্যাক্ট এবং বেশ কিছু পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট পাস করা হয়। চার্টার অ্যাক্টসমূহের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ভূখন্ডে ব্রিটিশ-রাজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা (১৮১৩), ভারতে প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো তৈরি (১৮৩৩), আইন প্রণয়নের সুবিধার্থে নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি (১৮৫৩) প্রভৃতি।
ভারত শাসন আইন, ১৮৫৮ এই আইন ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটায় এবং মহারানীর শাসনের সূচনা করে। এ সময় থেকে ভারতীয় উপনিবেশের প্রধান শাসক হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ-রাজের প্রতিনিধি এবং সে সূত্রে তার পদবি ছিল গভর্নর জেনারেল বা ভাইসরয়। এ অ্যাক্টের মাধ্যমে কোর্ট অব ডিরেক্টর্স এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল- এর যাবতীয় ক্ষমতা ও কার্যাবলি ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটকে প্রদান করা হয়। তাকে সকল প্রকার সহায়তা দানের জন্য ১৫ সদস্যের একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটকে ব্রিটিশ কেবিনেটের সদস্য হতে হতো এবং তিনি পার্লামেন্টের নিকট দায়বদ্ধ ছিলেন। এ অ্যাক্টের আওতায় ভারতের ভাইসরয় এবং প্রাদেশিক গভর্নরদের নিয়োগের ক্ষমতা রানীর ওপর অর্পিত হয়। এ অ্যাক্টে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটের অধীনে একটি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়।
ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১ এ অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত হয়। ১৮৫৮ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে একটি ঘোষণা জারি করেন। এ ঘোষণার ফলে ভারতের শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের সম্পৃক্তকরণ এবং স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করার জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। রানীর ঘোষণার অব্যবহিত পরেই জারি হয় ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১। এ অ্যাক্টের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। উক্ত কাউন্সিলে ন্যূনতম ছয়জন কিংবা অনধিক বারোজন অতিরিক্ত সদস্য নিয়োগের বিধান করা হয়। এ অতিরিক্ত সদস্যগণ দু’বছর মেয়াদের জন্য মনোনীত হতেন এবং তাদের অন্যূন অর্ধেক থাকতেন বেসরকারি সদস্য। বেসরকারি সদস্যের কিছুসংখ্যক ভারতীয়দের মধ্য থেকে মনোনীত হতেন। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল ব্রিটিশ ভারতে বসবাসরত সকল ব্রিটিশ ও ভারতীয়ের জন্য আইন প্রণয়নের অধিকারী ছিল। অনুরূপভাবে গভর্নরদের কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্ট প্রদেশের জন্য আইন পরিষদ গঠনের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় গভর্নর জেনারেলের ওপর। বারোজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় বঙ্গীয় আইন পরিষদ। এ সদস্যদের মধ্যে চারজন ছিলেন ভারতীয়। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলকে সমগ্র ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা হয় এবং প্রাদেশিক পরিষদগুলোর ওপর সংশ্লিষ্ট প্রদেশের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারপদ্ধতির রূপরেখা তৈরি হতে থাকে।
ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৯২ ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে ভারতের জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষ ঘটে। পশ্চিমী শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান, সংবাদপত্র, সাময়িকী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি, মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার সূচনা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য পদ্ধতির শাসনব্যবস্থার অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় স্বায়ত্তশাসনের ইতিবাচক লক্ষ্য নিয়ে। ইংল্যান্ডের উদারপন্থী সরকারের মতানুসারে এবং ব্রিটিশ-ভারতের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লর্ড রিপন (১৮৮০-১৮৮৪) ১৮৮২ সালে ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসও বিরাজমান সরকার পদ্ধতির প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং আইন পরিষদগুলোর সংস্কার সাধনের দাবি জানায়। জনগণের দাবি পূরণের লক্ষ্যে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিন বিতর্কিত বিষয় ও রিপোর্টসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট প্রণীত হয়। এ অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী গভর্নর জেনারেলের আইন পরিষদের অতিরিক্ত সদস্য সংখ্যা ন্যূনতম দশজন এবং ঊর্ধ্বে ষোলজন নির্ধারিত হয়। সদস্যগণ সেক্রেটারি অব স্টেটের অনুমোদনক্রমে মনোনীত হতে পারতেন। আরও বিধান রাখা হয় যে, অতিরিক্ত সদস্যগণের মধ্যে দুই-পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন বেসরকারি এবং তারা সীমিত নির্বাচনের ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। আইন পরিষদের ১৬ জন অতিরিক্ত সদস্যের মধ্যে ৬ জন সরকারি সদস্য, ৫ জন মনোনীত বেসরকারি সদস্য এবং ৫ জন নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। এদের মধ্যে একজন কলকাতা চেম্বার অব কমার্স এবং ৪ জন চারটি প্রাদেশিক আইন পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন। এভাবেই ভারতের ইতিহাসে আইন পরিষদের সদস্য নিয়োগে নির্বাচনের রীতি প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত হয়, যদিও তা ছিল সীমিত এবং সদস্যরা কোন রাজ্যের নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি ছিলেন না। বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বের প্রাদেশিক আইন পরিষদসমূহের অতিরিক্ত সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন ৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ জনে উন্নীত করা হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে অতিরিক্ত সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ জন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও অযোধ্যায় এ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ জন নির্ধারিত হয়। এ অ্যাক্টের আওতায় সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন ও বাজেটের ওপর আলোচনার অধিকার দেয়া হয়, তবে এ ক্ষেত্রে তাদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয় নি।
ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্টের (১৮৯২) গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এ আইনবলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সীমিত পর্যায়ে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়। এ নির্বাচন পৌরসভা, জেলা বোর্ড, চেম্বার অব কমার্স, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ও জমিদারদের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। এ ছাড়া আইন পরিষদের সদস্যগণ বাজেটের ওপর আলোচনার সুযোগ লাভ করেন। সর্বোপরি এ অ্যাক্টের মাধ্যমেই নির্বাচনের ধারা চালু হয়।
ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯০৯ ভারতের নবনিযুক্ত সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড মর্লি ১৯০৬ সালের ৬ জুন লিখিত এক পত্রে ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টোকে তাঁর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে জানান যে, ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লর্ড মিন্টো সাংবিধানিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করার জন্য স্যার এরুন্ডেলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এভাবেই শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের মতামত বিবেচনার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। এ অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে একটি বিলের খসড়া তৈরি করা হয়। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা বিলটি অনুমোদন করে এবং পার্লামেন্ট ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিলটিকে অ্যাক্টে পরিণত করে। এ অ্যাক্টের আওতায় কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৬০ জন করা হয়। বোম্বে, মাদ্রাজ, পূর্ববঙ্গ, আসাম, আগ্রা ও অযোধ্যা যুক্তপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবে এ সংখ্যা ৫০ জনে উন্নীত করা হয়। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে সরকারি সদস্যদের সংখ্যাধিক্য আগের মতোই বহাল ছিল। তবে প্রাদেশিক আইন পরিষদসমূহে বেসরকারি সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্টের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই যে, এ আইনের মাধ্যমে ভারতের সাংবিধানিক বিকাশে নতুন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। মর্লি-মিন্টো সংস্কার যখন বিবেচনাধীন, সে সময় মুসলমানরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা শাসন ব্যবস্থায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করেন। তাদের যুক্তি ছিল, ভারতে তারা কেবল সংখ্যার দিক থেকেই শক্তিশালী নন, রাজনৈতিক দিক থেকেও ভারতে তাদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় তাদের অবদানও কম নয়। তাদের এ দাবি মেনে নিয়ে প্রথমবারের মতো মুসলমানদের পৃথকভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেয়া হয়।
১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট আইন পরিষদে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধনের জন্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে সরকারি সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবসান ঘটানো হয়। দ্বিতীয়ত, এ অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন হয়; তবে ভোটাধিকার অত্যন্ত সীমিত ছিল এবং এলাকাভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয় নি। পক্ষান্তরে স্থানীয় পরিষদ বা পৌরসভা, জেলা বোর্ড, বণিক সমিতি, বড় বড় ভূস্বামী এবং বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীকে নিয়েই নির্বাচকমন্ডলী গঠিত হতো। তৃতীয়ত, এ অগ্রগতির ফলস্বরূপ সার্বিক নির্বাচনের নীতি প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়। চতুর্থত, মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পঞ্চমত, গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। ষষ্ঠত, কাউন্সিলের অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোচনার সুযোগ সম্প্রসারিত হয়। কাউন্সিলে বাজেটের খসড়া উত্থাপন করতে হতো। এ ছাড়া সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন ও তা ভোটের মাধ্যমে অনুমোদন এবং সম্পূরক প্রশ্ন করার অধিকারও প্রদান করা হয়।
সাংবিধানিকতাবাদ (১৯১৯-১৯৪৭) ১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্টের আওতায় সম্পাদিত সংস্কারগুলির মাধ্যমে সাংবিধানিক ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও এসব সংস্কার জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়। সাধারণভাবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি সাধিত হয় নি। প্রাদেশিক অর্থনীতিতেও প্রকৃতপক্ষে কোনও উন্নয়ন ঘটে নি এবং সরকারি পদে ব্যাপকভাবে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তির সুযোগও সৃষ্টি হয় নি। নতুন প্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিকভাবে চালু হলেও তা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সফল হতে পারে নি। কারণ সাফল্য লাভের মৌলিক শর্তের অনেকগুলোই এতে অনুপস্থিত ছিল। ভারতের নেতৃবৃন্দ দেশের জন্য পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু উপরিউক্ত সংস্কারসমূহ তাদের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হয় নি। তথাপি মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস ছিল যে, নবগঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে বেসরকারি বিষয়ে সরকারের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। ভারতের তৎকালীন বিরাজমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের সহযোগিতায় মন্টেগু ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে ভারতের সাংবিধানিক সমস্যা সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এ রিপোর্ট মন্ট-ফোর্ড রিপোর্ট (মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট) নামে পরিচিত। উক্ত রিপোর্টে ভারতের পরবর্তী সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কিত চারটি মূলনীতি নির্দেশ করা হয়: ক. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর ওপর জনগণের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ থাকবে; খ. প্রদেশসমূহে দায়িত্বশীল সরকার পদ্ধতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; গ. ভারত সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে; ঘ. পরিবর্তন কার্যকর করার জন্য ভারত-সরকার ও প্রাদেশিক সরকারসমূহের ওপর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারত সচিবের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে হবে।
এ রিপোর্টের সুপারিশমালা বিল আকারে উত্থাপিত হয় এবং ১৯১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ কমন্স সভায় তা ভারত শাসন আইন নামে পাস হয়। ১৯২১ সাল থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রদেশসমূহে দ্বৈত-শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন। এ ব্যবস্থা অনুসারে প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়সমূহকে ‘সংরক্ষিত’ ও ‘হস্তান্তরিত’ এ দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। সংরক্ষিত বিষয়াদি, যেমন আইন-শৃঙ্খলা, অর্থ ইত্যাদি সরাসরি গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং তিনি তার শাসন পরিষদের সাহায্যে এগুলি পরিচালনা করতেন। অন্যদিকে, হস্তান্তরিত বিষয়াদি, যেমন জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় শাসন প্রভৃতি মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে গভর্নরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। প্রাদেশিক সরকারের শাসনব্যবস্থাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয় বলে এই পদ্ধতি দ্বৈত-শাসন হিসেবে গণ্য হয়। নির্বাহী পরিষদের সদস্যগণ ব্রিটিশ-রাজ কর্তৃক পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। গভর্নর আইনসভার সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রীদের নিয়োগ করতেন এবং প্রত্যেক মন্ত্রীর ওপর এক বা একাধিক হস্তান্তরিত বিষয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হতো। মন্ত্রিগণ আইনসভার নিকট দায়ী ছিলেন। আইনসভার আস্থা হারালে তাদের পদত্যাগ করতে হতো। সাধারণভাবে গভর্নর তার কার্য পরিচালনায় মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতেন। এভাবেই ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে সংসদীয় এবং দায়িত্বশীল সরকার কাঠামো প্রথমবারের মতো চালু হয়।
লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নামে পরিচিত নয়টি প্রাদেশিক আইনসভার পরিধি সম্প্রসারণ করা হয়। এ আইনের বিধান অনুযায়ী কোনও প্রাদেশিক আইনসভার অন্তত ৭০ শতাংশ সদস্য নির্বাচিত হতেন এবং সরকারি সদস্য ২০ শতাংশের বেশি হতে পারতেন না। প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়। আইনসভার মেয়াদকাল তিন বছর নির্ধারিত হয়; তবে এ মেয়াদের আগেই সরকারের আইনসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। ভোটাধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত, জনসংখ্যার মাত্র ২.৮ শতাংশের ভোটদানের অধিকার ছিল।
১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্র ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় প্রবর্তিত দ্বৈত-শাসন ব্যবস্থা ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্রমবর্ধমান দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়। এ আইনের ত্রুটিগুলোও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। মন্ত্রীদের স্ব স্ব বিভাগের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। ফলে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণের অনুকূল বাস্তবসম্মত পরিবেশ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এ আইনের মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি চালু হলেও একটি দায়িত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর অর্পিত ক্ষমতা ছিল নামে মাত্র। প্রকৃত ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের হাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। ভারত শাসন আইনের একমাত্র ইতিবাচক দিক ছিল আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের সরকারের সমালোচনা করার অধিকার। তারা ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনকে ‘দায়িত্বশীল একনায়কতন্ত্র’ বলে সমালোচনা করেন। এভাবে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের অঙ্গীকার প্রহসন হিসেবেই থেকে যায়, এবং রাজনৈতিক নেতাগণ ব্রিটিশ সরকারের সংস্কারগুলির সমালোচনা করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯১৯ সালের বার্ষিক অধিবেশনে এ সংস্কারগুলিকে হতাশাব্যঞ্জক ও অপর্যাপ্ত বলে নিন্দা করে এবং এ শাসনতন্ত্রকে বাতিল বলে গণ্য করে। পরবর্তী পর্যায়ে এ শাসনতন্ত্রের অধীনে নির্বাচনও তারা প্রত্যাখ্যান করে।
সায়মন কমিশন ও নেহেরু রিপোর্ট ১৯২৭ সালের শেষদিকে ব্রিটিশ সরকার স্যার জন সায়মনকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশনের দায়িত্ব ছিল ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা এবং ভারতের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের নীতিমালা সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করা। সাইমন কমিশন কেবল ব্রিটিশ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় কংগ্রেস এ কমিশন বয়কট করে এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি সর্বদলীয় সম্মেলনের আয়োজন করে। ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের মূলনীতি বিবেচনা ও নির্ধারণের লক্ষ্যে পন্ডিত মতিলাল নেহেরুকে চেয়ারম্যান করে ১৯২৮ সালে কংগ্রেস একটি কমিটি গঠন করে। মুসলিম লীগও সায়মন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে। তবে স্যার মোহাম্মদ শফির নেতৃত্বে মুসলিম লীগের একটি অংশ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে।
১৯২৯ সালে প্রকাশিত মতিলাল নেহেরু কমিটির রিপোর্টে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসেবে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা প্রদানের বিষয়কে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে নেহেরু রিপোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এ রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, মুক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধান হবে। রিপোর্টের সুপারিশমালায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামোর আওতায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব্ আরোপ করা হয়। এ ছাড়া ভারতের জন্য দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সুপারিশ করা হয়, যার একটি হবে সিনেট এবং অন্যটি হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস। উভয় কক্ষই রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে। তবে এ রিপোর্ট সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলী ও গুরুত্বদানের ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করে এবং সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের ভিত্তিতে সমন্বিত নির্বাচনের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করে।
জিন্নাহর চৌদ্দ দফা নেহেরু রিপোর্ট অধিকাংশ মুসলিম নেতাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। এসকল মুসলিম নেতা ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির ভিত্তিতে নির্বাচনে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং পৃথক নির্বাচকমন্ডলী ব্যবস্থার জন্য ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু নেহেরু রিপোর্ট উক্ত দাবিসমূহ প্রত্যাখ্যান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার ১৪ দফা সংবলিত দাবি পেশ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতির অধীনে প্রদেশসমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবি অক্ষুণ্ণ রাখার প্রস্তাব দেন এবং পাঞ্জাব ও বাংলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশসমূহের আইনসভায় সংখ্যানুপাতে তাদের অধিক প্রতিনিধিত্ব প্রদানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। জিন্নাহ আরও দাবি জানান যে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় আইনসম্মতভাবে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
গোলটেবিল বৈঠক সায়মন কমিশনের সুপারিশমালা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোনও দলেরই মনঃপুত হয় নি। অধিকন্তু শাসনতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। এ অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইন ঘোষণা করেন যে, শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির স্বার্থে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে। তবে এ ঘোষণা ফলপ্রসূ হয় নি। কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যোগ দেয় নি। তবে অন্যান্য দল এবং ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিরা এ বৈঠকে যোগ দেন। অবশ্য এই সম্মেলনে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছিল। বৈঠকে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে একটি সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত চারটি বিষয়ে ভারতীয় প্রতিনিধিগণ একমত হন। প্রথমত, ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির; দ্বিতীয়ত, ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা প্রদান করা হবে; তৃতীয়ত, ভারতের সরকার ব্যবস্থা হবে সংসদীয় রীতির এবং চতুর্থত, কেন্দ্রে স্বল্পকালের জন্য দ্বৈত-শাসনব্যবস্থা বহাল থাকবে।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩১ সালে এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এতে যোগদান করেন। সম্মেলন শেষে ১৯৩২ সালে সরকার ভারতীয়দের জন্য একটি রোয়েদাদ প্রদান করে। এ রোয়েদাদ অনুসারে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর ব্যবস্থা চালু হয় এবং একই সঙ্গে ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক ও সুযোগবঞ্চিত বা অনুন্নত শ্রেণীর জনগণের জন্যও পৃথক নির্বাচকমন্ডলী অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুন্নত জনগণের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর বিধান চালু করার প্রতিবাদে গান্ধী আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনুন্নত শ্রেণীর সদস্যদের জন্য আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত সংবলিত পুনা চুক্তিকে তিনি উক্ত সমস্যার সমাধানরূপে বিবেচনা করেন। ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক।
ভারতশাসন আইন ১৯৩৫ উপরিউক্ত বৈঠকসমূহ ভারতের শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ভারতের সংবিধান সম্পর্কে বৈঠকের আলোচনা ও সুপারিশসমূহ যৌথ নির্বাচন কমিটিকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের পরিকল্পনা সংবলিত একটি খসড়া প্রস্তাব শ্বেতপত্রের আকারে প্রকাশ করে। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে যৌথ নির্বাচন কমিটি এ শ্বেতপত্রের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে এবং এটিকে চূড়ান্ত রূপদান করে। ১৯৩৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হাউস অব কমন্সে একটি বিল উত্থাপিত হয়। বিলটি আইনে পরিণত হয় ১৯৩৫ সালের ৪ জুন, এবং ২ আগস্ট তা রানীর সম্মতি লাভ করে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ৩২১টি ধারা ও ১০টি তফসিল সংবলিত একটি অতি দীর্ঘায়িত ও জটিল সংবিধি। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল: ক. সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র, খ. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, গ. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, ঘ. রক্ষাকবচ। তদুপরি পূর্বে প্রবর্তিত পৃথক নির্বাচকমন্ডলী ব্যবস্থা বজায় থাকে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কারও নিকটই গ্রহণযোগ্য হয় নি। তথাপি উভয় দলই এ সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। হিন্দুপ্রধান প্রদেশ মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যায় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং বোম্বে ও আসামে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাদেশিক আইনসভার ১৫৮৫টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭১১টি আসন লাভ করে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগের একটি অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।
পাকিস্তান আন্দোলন ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ধারণা করা হয়েছিল যে, প্রাদেশিক সরকারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রাদেশিক গভর্নরদের বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। মুসলিম প্রধান প্রদেশ, যেমন বাংলা, আসাম, সিন্ধু ও পাঞ্জাবে এ ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব বজায় রেখে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তবে হিন্দু প্রধান প্রদেশসমূহে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন গঠনের প্রস্তাব কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন। যে দু’একজন মুসলমান মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, তারা কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব প্রদানে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার অস্বীকৃতি এবং হিন্দু প্রধান প্রদেশসমূহে কংগ্রেসের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসন সাম্প্রদায়িক সমস্যার ভিত তৈরি করে। এ পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আবির্ভাব ঘটে প্রথমে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। পরবর্তী পর্যায়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রচারক হিসেবে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি বারংবার কংগ্রেস নেতাদের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেন নি। এর ফলে জিন্নাহর মধ্যে এ রাজনৈতিক প্রত্যয় জন্মলাভ করে যে, এক জাতি ও একই ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার অধীনে শাসিত যুক্ত ভারতে স্থায়ী সংখ্যালঘু দল হিসেবে মুসলমানদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে জিন্নাহ তাঁর দ্বি-জাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে ভারতের হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতি, এবং জন্মভূমির শাসনব্যবস্থায় উভয় জাতিরই অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। এ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব পাস করা হয়।
মুসলিম লীগের পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি ভারতের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে। ইতোমধ্যে মিত্রশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৪০ সালের ৮ আগস্ট একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যা আগস্ট প্রস্তাব হিসেবে অভিহিত। এ প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারতের সাংবিধানিক জটিলতা নিরসন এবং যুদ্ধশেষে ভবিষ্যৎ সংবিধান তৈরির লক্ষ্যে ভারতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করা হবে। তবে তার আগে সকল দল ও সম্প্রদায়ের উচিত যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথে ভারতের অবাধ ও সমমর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা। অবশ্য কংগ্রেস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের এই আন্দোলনের নিন্দা করে এবং ঘোষণা করে যে, ভারতীয় মুসলমানদের সত্যিকার প্রতিনিধি মুসলিম লীগের অনুমোদন ব্যতীত কোন ধরনের সাংবিধানিক পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য হবে না।
ক্রীপস মিশন, ১৯৪২ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের জড়িয়ে পড়া এবং বিশেষভাবে রেঙ্গুনের পতনের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় ব্রিটিশের নিকট ভারতের সকল দল ও সম্প্রদায়ের সমর্থনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এ সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস ভারতীয় নেতাদের কিছু দাবি পূরণের আশ্বাস সংবলিত নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এ প্রস্তাবের মধ্যে ছিল দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন ভারতীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। এ ইউনিয়নকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়, যা ভারতীয়দের ইচ্ছানুযায়ী ব্রিটিশ কমনওয়েলথ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, সফলভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতের প্রধান দলসমূহের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিষয়ে ভারতের ওপর ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। এ সকল প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোন দলের নিকটই গ্রহণযোগ্য হয় নি। ফলে ক্রীপস মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সিমলা কনফারেন্স ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৫ সালের জুন মাসে সিমলায় ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে তিনি যেসব পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন, তার মধ্যে ছিল: ক. ভাইসরয়ের শাসন পরিষদ এমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে, যাতে গভর্নর জেনারেল ও কমান্ডার-ইন-চীফ ব্যতীত পরিষদের সকল সদস্যই হবেন ভারতীয়। এ ছাড়া বর্ণহিন্দু ও মুসলমানগণ সমান প্রতিনিধিত্ব লাভ করবেন; খ. বৈদেশিক বিষয়ক দফতরের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে একজন ভারতীয় প্রতিনিধির ওপর; গ. যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং ভারতের চূড়ান্ত সংবিধানের ব্যাপারে একটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভাইসরয়ের শাসন পরিষদই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু সিমলা সম্মেলনও ব্যর্থ হয়, কারণ শাসন পরিষদে মুসলিম সদস্যদের মনোনয়ন দানের ব্যাপারে মুসলিম লীগের অধিকার সম্পর্কিত দাবি কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে। আবার এ বিষয়ে কংগ্রেসের অধিকারের দাবিও মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার তিনজন ক্যাবিনেট সদস্য লর্ড পেথিক লরেন্স, এ.ভি আলেকজান্ডার এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস সমন্বয়ে ভারতে একটি মিশন প্রেরণ করেন। এ মিশনের লক্ষ্য ছিল ভারতের হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার মতবিরোধের অবসান ঘটানো এবং স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে তাদের সহায়তা করা। তাঁরা ভাইসরয়ের পরামর্শক্রমে ভারতের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে সাহায্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় তারা ব্যর্থ হন এবং অবশেষে ভারতের সাংবিধানিক অচলাবস্থা নিরসনে নিজস্ব পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। এ পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা হয় যে, ক. ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলির সমন্বয়ে ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে; খ. ইউনিয়ন সরকারের এখতিয়ারে থাকবে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ। ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে এ ইউনিয়নের নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা; গ. ইউনিয়নের আওতাভুক্ত বিষয়াদি ব্যতীত অন্য সকল বিষয় ও অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে; ঘ. ভারতীয় প্রদেশগুলি তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হবে, যেমন প্রথম গ্রুপে থাকবে হিন্দুপ্রধান প্রদেশ মাদ্রাজ, বোম্বে, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যা; দ্বিতীয় গ্রুপে থাকবে মুসলিমপ্রধান প্রদেশ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু; তৃতীয় গ্রুপ গঠিত হবে মুসলিমপ্রধান বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে। প্রদেশগুলোর নির্বাহী পরিষদ ও আইনসভার সদস্যদের নিয়ে গ্রুপ গঠনের অধিকার প্রদেশগুলির থাকবে। প্রত্যেক গ্রুপই প্রাদেশিক বিষয়সমূহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করবে; ভারতীয় ইউনিয়ন এবং গ্রুপ ও প্রদেশসমূহের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করবেন। এ গণপরিষদে প্রত্যেক প্রদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে আসন নির্ধারণ করা হবে। আবার বিভিন্ন সম্প্রদায়ও তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে গণপরিষদে আসন লাভ করবে। কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে।
১৯৪৬ সালের ৬ জুন মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। দীর্ঘ আলোচনার পর কংগ্রেস এর দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব গ্রহণ করে, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, যদি কোন একটি বৃহৎ দল পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে, তবে সে দলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য আহবান জানানো হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গভর্নর জেনারেল ওয়াভেল তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নি। মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। মুসলিম লীগ এটিকে গভর্নর জেনারেলের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ বলে গণ্য করে। তদুপরি ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই নেহেরু বোম্বেতে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে গ্রুপ পদ্ধতির বিরোধিতা এবং প্রস্তাবিত গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব দাবি করেন। ফলে মুসলিম লীগ নেতাদের মনে চরম অবিশ্বাস জন্মে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাগের অনিবার্যতা স্বীকার করে নেয়। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত বিভাগের দাবি উত্থাপন করে। অন্যদিকে কংগ্রেসের দুজন প্রভাবশালী নেতা নেহেরু এবং প্যাটেলও ভারত বিভাগের পক্ষে ছিলেন। তবে গান্ধী প্রথমদিকে এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আগমন করেন। ইতোমধ্যে ভারত বিভাগের সামগ্রিক পটভূমি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বাস্তবতার নিরিখে সমগ্র বিষয় পর্যালোচনা ও অনুধাবন করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভাগ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা পেশ করেন। এভাবেই ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অধীনে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে।
পরীক্ষামূলক সাংবিধানিক প্রক্রিয়া (১৯৪৭-১৯৭০) ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ৮ ধারায় বিধান রাখা হয় যে, কতিপয় সংশোধনী সাপেক্ষে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনই পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসেবে বলবৎ থাকবে। প্রকৃতপক্ষে এ শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়া পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
প্রথম গণপরিষদ ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলি থেকে নির্বাচিত সদস্য নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ। প্রাথমিক অবস্থায় এই গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৯ জন, পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭৯ জন হয়। এই ৭৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪৪ জন ছিলেন পূর্ববাংলার, ২২ জন পশ্চিম পাঞ্জাবের, ৫ জন সিন্ধুর, ৩ জন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের, ১ জন বেলুচিস্তানের এবং ৪ জন পাকিস্তানের এলাকাভুক্ত রাজ্যের প্রতিনিধি। পাকিস্তান গণপরিষদের ওপর দুটি কাজের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করা এবং দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু এই গণপরিষদের কর্মকান্ড এমন ধীরগতিতে চলে যে সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতেই ১৯ মাস সময় অতিবাহিত হয়। এ প্রস্তাব ‘লক্ষ্য প্রস্তাব’ বা ‘আদর্শ প্রস্তাব’ নামে অভিহিত। এর বৈশিষ্ট্য ছিল: ক. জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করবে; খ. ইসলাম-নির্দেশিত গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, সহিষ্ণুতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিসমূহ প্রতিষ্ঠিত হবে; গ. সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করবে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উন্নয়নের অধিকার থাকবে; ঘ. পাকিস্তানের সরকার পদ্ধতি হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর, তবে অঙ্গরাজ্যসমূহ থাকবে স্বায়ত্তশাসিত।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মূলনীতি কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। এ রিপোর্ট পূর্ব বাংলায় প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ, রিপোর্টে বর্ণিত প্রস্তাব থেকে পূর্ববাংলার মানুষের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধে। মূলনীতি কমিটির সুপারিশসমূহ প্রস্তাব আকারে প্রকাশিত হলে পূর্ববাংলার জনগণ এর বিরুদ্ধে যুগপৎ সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষকসহ দলমত নির্বিশেষে সকলের সমন্বয়ে ঢাকায় গঠিত হয় ‘কমিটি অব অ্যাকশন ফর ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন’। এ কমিটির উদ্যোগে ১৯৫০ সালের ১৪ নভেম্বর এক জাতীয় কনভেনশন আহবান করা হয়। এ কনভেনশনে মূলনীতি কমিটির প্রস্তাবিত সংবিধানের বিপরীতে পাকিস্তানের জন্য একটি বিকল্প সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালের ২১ নভেম্বর মূলনীতি কমিটির সুপারিশসমূহের ওপর আলোচনা স্থগিত রাখে। ফলে সংবিধান প্রণয়নের কাজ বিলম্বিত হয় এবং সংবিধানের দ্বিতীয় খসড়া প্রস্ত্তত করতে সংবিধান সভা ১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও দুবছর সময় অতিবাহিত করে। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত সংকট নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামো তৈরি এবং আইন ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে সমতা বিধানের প্রস্তাব পেশ করেন।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচনের পর সমগ্র রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়। এ নির্বাচনে তিনজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা এ.কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে চরমভাবে পরাজিত করে ২২৩টি আসন লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ.কে ফজলুল হক পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু দু’মাস অতিবাহিত হওয়ার আগেই গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করেন। পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যগণ আইনসভার সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর প্রথম গণপরিষদ বাতিল ঘোষিত হয়।
প্রথম গণপরিষদ যেসব জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তার মধ্যে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তি নির্ধারণ, প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা নিরূপণ, পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলির মর্যাদা, ভাষাগত দ্বন্দ্ব প্রভৃতি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় নি। প্রায় সাত বছরের মধ্যে গণপরিষদ মাত্র ১১৬ দিন মিলিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় গণপরিষদ ১৯৫৫ সালের মে মাসে গভর্নর জেনারেল দ্বিতীয় গণপরিষদ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেন। এ গণপরিষদ গঠিত হয় ৮০ জন সদস্য সমন্বয়ে, যাদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন পূর্ববাংলার এবং বাকি ৪০ জন পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে গণপরিষদের সদস্যগণ নির্বাচিত হন এবং জুলাই মাসে পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় গণপরিষদ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলোপ করে সকল প্রদেশের সমন্বয়ে এক ইউনিট বা একটি প্রদেশ গঠন করে। পরবর্তী পর্যায়ে সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান কার্যকর হয়।
পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৫৬ পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ২৩৪টি অনুচ্ছেদ, ১৩টি ভাগ এবং ৬টি তফসিল অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তানের সংবিধানে ছিল একটি দীর্ঘ প্রস্তাবনা, যাতে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকান্ড সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কতিপয় মূলনীতি গ্রহণ করা হয়। তবে এ মূলনীতিসমূহ আইনের বিধানে ছিল না। পশ্চিমা গণতন্ত্রের সংবিধানের ন্যায় অধিকার বিল পাসের মাধ্যমে এ নীতিসমূহ গৃহীত হতো। এ সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
বিচার বিভাগের প্রাধান্য ও স্বাধীনতা ছিল এ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করে। এ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ‘প্রেসিডেন্ট’, যাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হতো এবং চল্লিশ বছরের কম বয়সী কোন ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিধান ছিল না। জাতীয় পরিষদ ছিল পাকিস্তানের আইনসভা। এ পরিষদ ৩০০ সদস্য নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং ১৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য ১০ বছর মেয়াদের ১০টি অতিরিক্ত আসন সংরক্ষিত ছিল। এই ১০ জন সদস্যের ৫ জন পূর্ব পাকিস্তান ও ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হতেন। সংবিধানে সমগ্র পাকিস্তানে একটি সুপ্রিম কোর্ট এবং দুই প্রদেশে দুটি হাইকোর্টের বিধান থাকে। কোর্টগুলির ওপর নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ছিল সংবিধানের রক্ষাকবচ। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের পরিপন্থী কোন আইনকে সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারত। প্রাদেশিক সরকারের প্রকৃতিও কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরূপ ছিল এবং একজন গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ একটি মন্ত্রিসভা দ্বারা সরকার পরিচালিত হতো। প্রাদেশিক আইন পরিষদের ৩০০ জন সদস্যও ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য ১০ বছর মেয়াদের অতিরিক্ত ১০টি আসন সংরক্ষিত ছিল।
সামরিক শাসন জারি পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের প্রয়োগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি করে সংবিধান বাতিল করেন এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাসহ মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির তিন সপ্তাহের মধ্যে ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারণ করে আইয়ুব খান নিজেই প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও বহাল থাকেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উপায় হিসেবে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এ পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আস্থা ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলিক গণতন্ত্রীদের সমর্থন আদায় করেন এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের পথ সুগম করেন। ১৯৬০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে সুপারিশ প্রদানের জন্য পাকিস্তানের প্রাক্তন বিচারপতি মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৬১ সালের ৬ মে প্রেসিডেন্টের নিকট রিপোর্ট পেশ করে। প্রেসিডেন্ট রিপোর্টটি মন্ত্রিসভার বিভিন্ন কমিটিতে আলোচনা এবং গভর্নরের একটি সম্মেলনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খসড়া কমিটিতে প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৯৬২ সালের ১ মার্চ একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়।
পাকিস্তানের সংবিধান ১৯৬২ ১৯৬২ সালের সংবিধান ছিল একটি দীর্ঘ ও বিস্তারিত দলিল। এতে ১২টি অংশে বিভক্ত ২৫০টি অনুচ্ছেদ ও ৩টি তফসিল সন্নিবেশিত ছিল। এ সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের সরকার পদ্ধতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয়, প্রজাতান্ত্রিক ও প্রেসিডেন্ট শাসিত। মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমন্ডলী কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগকৃত একটি মন্ত্রিসভা ছিল। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ছিলেন প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ এবং তার প্রতি দায়বদ্ধ। প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন না এবং তাঁর কার্যকালের মেয়াদ জাতীয় পরিষদের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। কেবল অভিশংসনের মাধ্যমেই তাকে অপসারণ করা যেত। বস্ত্তত এই সংবিধান ছিল ১৯৫৬ সালের সংবিধান থেকে সরে আসার সূচনা।
১৯৬২ সালের সংবিধানে ২১টি মৌলিক নীতি প্রবর্তন করা হয়। সেগুলির মধ্যে ছিল ইসলামী জীবনব্যবস্থা, জাতীয় ঐক্য, সংখ্যালঘুদের প্রতি সদ্ব্যবহার, অনুন্নত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ, কর্মস্থলে মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক নিরাপত্তা, জনগণের মৌলিক চাহিদার ওপর গুরুত্ব আরোপ প্রভৃতি। এগুলি ছিল ১৯৫৬ সালের সংবিধানে নির্দেশিত রাষ্ট্রীয় নীতির অনুরূপ। এই নীতিসমূহ ছিল কতিপয় আদর্শ, তবে আইন নয়। এদের মধ্যে কিছু আদর্শ নির্ধারিত ছিল, যা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো হতো। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ন্যায় নতুন সংবিধানেও পাকিস্তানের জন্য দুটি রাষ্ট্রভাষার বিধান রাখা হয়, উর্দু ও বাংলা। সরকারি এবং অন্যান্য কাজে ইংরেজি ভাষাও ব্যবহূত হতো।
১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির। পাকিস্তান দুই প্রদেশে বিভক্ত একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন ছিল। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত ছিল এবং অবশিষ্ট সব বিষয়ের ক্ষমতা প্রদেশসমূহের ওপর ন্যস্ত ছিল। সরকারের দুটি কাঠামো ছিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক। উভয় সরকারের পালনীয় বিষয় ও ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
১৯৬২ সালের সংবিধান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নামে একটি এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিধান রাখে। এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫৬, যার অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বাকি অর্ধেক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত। প্রত্যেক প্রদেশ থেকে মহিলাদের জন্য তিনটি করে অতিরিক্ত আসন সংরক্ষিত ছিল। জাতীয় পরিষদের মেয়াদ ৫ বছর নির্দিষ্ট ছিল, তবে তার আগেও তা ভেঙে দেওয়া যেত। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ আহবান ও স্থগিত করা হতো। তবে মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশের অনুরোধক্রমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা যেত।
এই সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে একটি সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়। একজন প্রধান বিচারপতি এবং আইনবলে নির্ধারিত সংখ্যক বিচারক সমন্বয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হতো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগ প্রদান করতেন। সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী অধিবেশন স্থল ছিল ইসলামাবাদে, তবে প্রতি বছর অন্তত দু’বার ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বসত।
প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ছিলেন একজন গভর্নর। তিনি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং তার সমুদয় কর্মকান্ড প্রেসিডেন্টের নির্দেশেই সম্পন্ন হতো। প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত ছিল। গভর্নর কর্তৃক নিযুক্ত একটি মন্ত্রিসভা ছিল। গভর্নরকে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও অ্যাডভোকেট জেনারেল নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
প্রত্যেক প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদ নামে একটি করে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ছিল। প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদই ১৫৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতো। প্রতি প্রদেশেই মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত ৫টি আসন সংরক্ষিত ছিল। তবে মহিলাগণ অন্যান্য সাধারণ আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। প্রাদেশিক পরিষদের মেয়াদকাল ছিল ৫ বছর, তবে তার আগেও এই পরিষদ বিলুপ্ত হতে পারত। প্রাদেশিক গভর্নর বিভিন্ন সময়ে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহবান ও স্থগিত করতেন। মোট সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের অনুরোধক্রমে স্পীকারও পরিষদের অধিবেশন আহবান ও স্থগিত করতে পারতেন।
আইয়ুব খান প্রদত্ত ১৯৬২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত হয়। ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল এবং জাতীয় পরিষদ, দুই প্রাদেশিক পরিষদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। তিনি দু’জন সামরিক আইন প্রশাসকের ওপর দুই প্রদেশের শাসনভার ন্যস্ত করেন এবং ১৯৬৯ সালের ৩১ মার্চ নিজেই প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। একই বছর ২৮ নভেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, ১৯৭০ সালে গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে তিনি ৩০ মার্চ একটি আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন।
আইন কাঠামো আদেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল: (১) সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; (২) ৩১৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে, যাদের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৬৯ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৪৪ জন সদস্য থাকবেন। প্রত্যেক প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০টি আসন থাকবে; (৩) গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের সময় থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে; (৪) সংবিধানের ইসলামী আদর্শ অবশ্যই সংরক্ষণ করা হবে।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে কয়েকটি এলাকায় ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে এবং পরিণামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে
১৯৭২ পরবর্তী সাংবিধানিক বিকাশ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পর গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ মুজিবনগরে মিলিত হন এবং একটি গণপরিষদ গঠন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে আইনগত বৈধতা দান এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে গণপরিষদের সদস্য সমন্বয়ে একটি বিপবী সরকার গঠন করা হয়। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়, তবে তা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হয়। এই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ঘোষণাপত্র বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে। রাষ্ট্রপতিকে প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়কের মর্যাদা প্রদান করা হয়। প্রজাতন্ত্রের সর্বপ্রকার প্রশাসনিক, আইনগত ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হয়। গণপরিষদের অধিবেশন আহবান ও তা মুলতবি করার ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতাও তাঁকে প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁর এখতিয়ারভুক্ত হয়। এ আইনগত দলিলই প্রজাতন্ত্রের আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে। ঘোষণাপত্রে আরও বর্ণিত হয় যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের ওপর অর্পিত সকল প্রকার দায়িত্ব পালন করবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা লাভ করার পর এ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক উভয় দিক থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলরূপে গণ্য হয় এবং পরবর্তী সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত এ দলিলই দেশের প্রধান বিধানতন্ত্ররূপে কার্যকর ছিল।
আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তাঁর ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ জারি করেন। প্রশাসনের সর্বত্র ধারাবাহিকতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এ আদেশবলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো থেকে প্রাপ্ত সকল আইনকে স্বাধীনতা ঘোষণার অধীনে বৈধতা দান করা হয়। এতে বলা হয় যে, সরকারের সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগ এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন, তারা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং পূর্বের শর্তানুযায়ী সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। এ ধরনের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ জেলা জজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণের দ্বারা তাদের নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একটি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এ আদেশবলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে মন্ত্রীপরিষদশাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিল: (ক) জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র থাকবে; (খ) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে; (গ) প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর কার্য সম্পাদন করবেন; (ঘ) রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপ্রাপ্ত আস্থাভাজন একজন সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করবেন; মন্ত্রিগণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন; (ঙ) ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। তবে অন্য কোনভাবে বা কোনও আইনে অযোগ্য ঘোষিত সদস্যগণ এর অন্তর্ভুক্ত হবেন না; (চ) গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে রাষ্ট্রপতির পদ শূণ্য হলে মন্ত্রিপরিষদ নাগরিকদের মধ্য থেকে একজনকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করবেন।
একজন প্রধান বিচারপতি এবং সময়ে সময়ে নিযুক্ত অন্যান্য বিচারপতিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে একটি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হবে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান গণপরিষদের ন্যায় বাংলাদেশ গণপরিষদকে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কোনও ক্ষমতা প্রদান করা হয় নি। এ গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণাই দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বলবৎ ছিল। নির্বাহী বিভাগ তখন পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট দায়বদ্ধ ছিল না।
বাংলাদেশ সংবিধান, ১৯৭২ ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি হওয়ার প্রেক্ষিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ আদেশে গণপরিষদের গঠন এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়।
জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত মোট সদস্য ছিলেন ৪৬৯ জন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন এবং কয়েকজন অযোগ্য ঘোষিত হন। ফলে ৪০৪ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। পরদিন ৩৪ জন সদস্য সমন্বয়ে ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। গণপরিষদে বিবেচনার জন্য ১২ অক্টোবর সংবিধান বিল উত্থাপন করা হয়। খসড়া সংবিধানের প্রথম পাঠ শুরু হয় ১৯ অক্টোবর এবং ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় পাঠ চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় পাঠ শুরু হয় ৪ নভেম্বর এবং ৬৫টি সংশোধনীসহ তা অনুমোদন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর করা হয়।
১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে ১টি প্রস্তাবনা, ১১টি বিভাগে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিল সন্নিবেশিত ছিল। এই সংবিধানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল:
প্রস্তাবনা জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি ও রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শস্বরূপ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ও ধর্মনিরপেক্ষতার সর্বোচ্চ আদর্শকে সুনিশ্চিত করে, যা আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এসব আদর্শই সংবিধানের মূলনীতি বলে উল্লেখ করা হয়।
নতুন জাতিসত্তা সংবিধানের প্রথম ভাগ ছিল নতুন জাতীয়তাবাদের সুনির্দিষ্ট এবং আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ। এটি বাংলাদেশকে একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। এতে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক, জাতীয় ফুল এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আকারে রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যসমূহের ঘোষণা সন্নিবেশিত আছে। এতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত চারটি মূলনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটি সুনিশ্চিত করে যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐক্য ও সংহতির মূলে রয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির অভিন্নতা এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন (অনুচ্ছেদ ৯)। মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান ঘটিয়ে ন্যায়ানুগ সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে সমাজতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয় (অনুচ্ছেদ ১০)। গণতন্ত্রকে এমন এক পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যেখানে মৌলিক মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে (অনুচ্ছেদ ১১)। যে কোনও প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার এবং সব ধরনের ধর্মীয় বৈষম্য পরিহার করাকেই ধর্মনিরপেক্ষতারূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১২)। তদুপরি কৃষক-শ্রমিকদের সকল প্রকার শোষণের কবল থেকে মুক্তি দান এবং সকল নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা এবং যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের সুবিধাসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ আইনগত বাধ্যবাধকতা ব্যতীত শুধুমাত্র রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে উল্লিখিত হয়। আরও উল্লেখ থাকে যে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিসমূহ আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রয়োগকৃত হবে এবং সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে প্রযোজ্য হবে। তবে এ নীতিসমূহ আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হবে না।
জনগণের মৌলিক অধিকার সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনও আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করবে না এবং মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ যে কোনও আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। এ অধিকারসমূহ হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ লাভের সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, গ্রেফতার ও আটক সংক্রান্ত রক্ষাকবচ, চলাচলের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা অর্থাৎ সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্পদের অধিকার প্রভৃতি। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার নিমিত্তে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কিংবা নৈতিকতার স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত কারণে মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর রাষ্ট্র আইনগত বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে।
সরকার পদ্ধতি চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ভাগে প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের গঠনপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। সংবিধানে ব্রিটিশ পদ্ধতির অনুসরণে সংসদীয় রীতির গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে ৫ বছর মেয়াদে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হবেন এবং কেবলমাত্র জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য কর্তৃক অভিশংসনের মাধ্যমে তাঁকে অপসারণ করা যাবে। ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীর ন্যায় তিনি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন একজন সংসদ সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিপরিষদের প্রধান। মন্ত্রিপরিষদ গঠনে, প্রাণপ্রবাহে এবং অবলুপ্তিতেও তার ভূমিকাই মুখ্য। মন্ত্রিসভা সরকারের নির্বাহী বিভাগ।
বাংলাদেশের সংবিধানের মূল বিষয় হচ্ছে, এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বা জাতীয় সংসদের প্রাধান্য। একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভোটে ১০ বছর মেয়াদে মহিলাদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। জাতীয় সংসদ দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। সংসদ কর্তৃক পাসকৃত কোনও বিল আইনে পরিণত হতে হলে তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয়, যদিও রাষ্ট্রপতির ভেটো প্রদানের ক্ষমতা নেই। জাতীয় সংসদ জাতীয় তহবিলের অভিভাবক বা রক্ষক এবং এর অনুমোদন ব্যতীত কোনপ্রকার কর আরোপ করা যাবে না। রাষ্ট্রের বিচার সংক্রান্ত দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত এবং সুপ্রিম কোর্ট এর শীর্ষে অবস্থিত। এটি আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত। রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রদান করবেন, যিনি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগ দান করবেন। বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের কর্মের শর্তাবলি ও অন্যান্য বিষয়াদি নির্ধারণের জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাও সংবিধানের আওতাভুক্ত।
নির্বাচন, কর্মবিভাগ এবং হিসাব-নিরীক্ষা সংবিধানের ৭ম, ৮ম ও ৯ম ভাগে নির্বাচন, হিসাব-নিরীক্ষা এবং বেসামরিক কর্মবিভাগ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ তাদের দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবেন এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যে পদ্ধতিতে ও যে কারণে অপসারিত হন একই পদ্ধতিতে ওই ব্যক্তিদের অপসারণ করা যাবে (অনুচ্ছেদ ১১৮, ১২৯ ও ১৩০)।
সংবিধান সংশোধন সংবিধানের দশম ভাগে সংশোধন পদ্ধতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার ন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিক্রমে পাসকৃত বিলের মাধ্যমে সংবিধানের যে কোনও বিধান পরিবর্তন বা রহিত করা যাবে।
বিবিধ বিধি সংবিধানের একাদশ ভাগে বিবিধ বিধিসমূহ বর্ণিত হয়েছে। প্রথম তফসিলে বিচারকি পুনর্বিবেচনা-বহির্ভূত কিছু আইনের বিবরণ রয়েছে। দ্বিতীয় তফসিলে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সম্পর্কিত বিধিমালা আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় তফসিলে সাংবিধানিক পদসমূহের শপথ ও ঘোষণার নমুনা রয়েছে। চতুর্থ তফসিলে সাংবিধানিক সরকারের ক্রান্তিকালীন বিধানাবলি আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীসমূহ বাংলাদেশের সংবিধানে অদ্যাবধি পনেরোটি সংশোধনী আনা হয়েছে। সংবিধানের পনেরোটি সংশোধনী আদেশ এবং অসংখ্য ফরমান সংবিধানের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ সংবিধানের বর্তমান রূপ মূল ভাষ্য থেকে অনেকটা পৃথক। [এমাজউদ্দীন আহমদ]