লোকসম্প্রদায়

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৯, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

লোকসম্প্রদায়  বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী এবং পৃথক পৃথক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠাণে অভ্যস্ত একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এ চারটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এরাও বহুকাল যাবৎ বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। হিন্দুরা পৌত্তলিকতার মাধ্যমে ব্রহ্মতত্ত্বে, বৌদ্ধরা নির্বাণতত্ত্বে, মুসলমানরা তৌহিদবাদে এবং খ্রিস্টানরা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে। কিন্তু বিভিন্ন লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতামত, জীবনাচরণ ও সংস্কার-সংস্কৃতি তাদের থেকে অনেকটাই ভিন্নধর্মী। মূল ধর্ম থেকেই এদের উদ্ভব, কিন্তু এরা শাস্ত্রের প্রতি অনুগত না থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ধ্যান-ধারণা পোষণ করে এবং সেভাবেই এদের জীবনধারা গড়ে ওঠে।

লোকসম্প্রদায়গুলি একই সময়ে একই স্থানে জন্মলাভ করেনি, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে উদ্ভূত হয়েছে। সম্প্রদায়গুলি প্রধানত উৎসভূমির মধ্যেই সীমিত থেকেছে এবং কোনো কোনো সম্প্রদায় কালের সীমা অতিক্রম করে আজও টিকে আছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে  কর্তাভজা, কিশোরীভজন,  জগোমোহিনী, ন্যাড়া, বলাহাড়ি,  বাউলমতুয়া, সাহেবধনী প্রভৃতি ধর্মীয় লোকসম্প্রদায় রয়েছে। এদের ধর্মমতে সাধন-ভজন, প্রেম-ভক্তি ও গুরুবাদের স্থান থাকায়  অক্ষয়কুমার দত্ত এদের উপাসক সম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার শাস্ত্রবর্জিত লোকায়ত ধ্যান-ধারণা, দর্শন ও আচরণবিধির প্রাধান্য থাকায় এদের লোকসম্প্রদায় বলেও অভিহিত করা হয়।

কর্তাভজা  সম্প্রদায়ের আদিগুরু  আউলচাঁদ। তাঁর শিষ্য রামশরণ পাল (মৃত্যু ১৭৮৩) গুরুর আদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। এজন্য তাঁকেই এর প্রবর্তক বলা হয়। ভক্তের নিকট তিনি ‘কর্তা’ ও তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী ‘কর্তামা’ নামে অভিহিত হন। রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবীই এ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীর নিকটবর্তী ঘোষপাড়ায় কর্তামায়ের সমাধি ও মন্দির আছে; এটি কর্তাভজাদের তীর্থক্ষেত্ররূপে পরিগণিত। রামশরণের পুত্র দুলালচাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) এ সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক শক্তি দান করেন। তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। পদগুলি ভাবগীতরূপে ভক্তের নিকট সমাদৃত। কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানে না; তারা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করে। সৎপথে থেকে ও মিথ্যাকথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাদের প্রধান লক্ষ্য।

আউলচাঁদ প্রথমে বাইশজন ভক্ত নিয়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের গোড়াপত্তন করেন। এতে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের স্রোত এসে মিশেছে; তবে হিন্দু সদ্গোপ, কলু, মুচি ও বৈষ্ণব শ্রেণির সংখ্যাই ছিল বেশি। ঘোষপাড়ার দোলখেলা ও ডালিমতলায় দোল পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ইত্যাদি উপলক্ষে কর্তাভজারা উৎসব পালন করে। এর নিকটবর্তী হিমসাগর নামক পুকুরে স্নান করে তারা গঙ্গাস্নানের মতোই পুণ্য অর্জন করে।

কিশোরীভজন  সিলেট জেলার একটি বৈষ্ণব লোকসম্প্রদায়। তারা শুদ্ধ বৈষ্ণবমতের বিরোধী এবং সহজিয়ামতের অনুসারী। তারা আখড়ায় অল্প বয়সের কিশোরীদের সান্নিধ্যে রাধাকৃষ্ণ জ্ঞানে গান-নাচ করে। তাদের গানগুলি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাত্মক। প্রত্যেকেরই সাধনসঙ্গিনী থাকে এবং সে-ই প্রেমশিক্ষার গুরু। এ ছাড়া দীক্ষাগুরু থাকেন এবং তিনি শিষ্যকে দীক্ষা দেন। তারা পঞ্চরসিকের মতে চলে; নাম, মন্ত্র, ভাব, প্রেম ও রস এই পঞ্চরসের মধ্যে প্রেম ও রসই তাদের প্রধান আশ্রয়।

জগোমোহিনী  সিলেট জেলার বাঘাসুরা গ্রামের জগন্মোহন গোঁসাই এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামেই সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে। রামকৃষ্ণ নামে একজন শিষ্য এ সম্প্রদায়ের সাংগঠনিক ভিত্তি দেন। জগন্মোহন সতেরো শতকে আবির্ভূত হন।

জগোমোহিনীরা ব্রহ্মবাদী এবং তারা নারীসংসর্গ ত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য পালন করে। তারা বিগ্রহ মানে না; বৈষ্ণবের মতো তুলসী ও গোময়কে পবিত্র মনে করে না। তারা যে গান গেয়ে উপাসনা করে তাকে নির্বাণ সঙ্গীত বলে। এরূপ সঙ্গীতচর্চা ধর্মসাধনারই অঙ্গ। তাদের নিকট গুরুই সত্য; তারা গুরুকে প্রত্যক্ষ দেবতা জ্ঞান করে তাঁর ভজনা ও সেবা করে। বিশাল নামক নদীর তীরে অবস্থিত বিথঙ্গলের আখড়া তাদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। সিলেটের মাছুলিয়া ও জলসুখা এবং ঢাকা ও ফরিদপুরের আখড়াসহ তাদের মোট বারোটি  আখড়া আছে।

ন্যাড়া  নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্র কর্তৃক প্রবর্তিত। ভেকে (সাজ) ও ভাবে বৈষ্ণব ও বাউলদের সঙ্গে ন্যাড়াদের কিছু মিল আছে। তারা হরিবোল ও বীর অবধূত ঘোষণা দেয়, আবার বাউলদের মতো প্রকৃতিসাধনা এবং কায়াসাধনাও করে। তাদের আলখাল­া নানা বর্ণের বস্ত্রখন্ড দ্বারা তৈরি। তারা মাথায় টুপি পরে এবং কাঁধে ঝুলি ও হাতে লাঠি ও কিশতি (নারকেলের মালা) নিয়ে ভিক্ষা করে। ঢাকা ও বীরভূম জেলায় ন্যাড়া সম্প্রদায়ের বংশধররা আজও বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে।

বলাহাড়ি  সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি (১৭৮০-১৮৪৫)। তিনি স্থানীয় মলি­ক পরিবারে দারোয়ানের চাকরি করতেন। গৃহদেবতার স্বর্ণালঙ্কার চুরি গেলে তাঁকে সন্দেহবশে অপরাধী ভেবে প্রহার করা হয়। এই ক্ষোভে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং দীর্ঘকাল সন্ন্যাস পালনের পর দেশে ফিরে দেব ও মূর্তিপূজাবিরোধী লৌকিক ধারার এই ধর্মমত প্রচার করেন। ঈশ্বরোপাসনাকে সার জ্ঞান করে ইন্দ্রিয় দমন ও শুদ্ধ জীবনযাপন তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের মতে বিশ্বব্রহ্মান্ড হলো ঈশ্বরের শরীর। এরূপ উপাস্যকে হিন্দু শিষ্য বলে হাড়িরাম এবং মুসলমান শিষ্য বলে হাড়িআল্লা

বলরামের জীবিতকালে বলাহাড়িদের সংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। তারা ছিল হাড়ি,  ডোমবাগদীবেদে, যোগী, মাহিষ্য,  নমঃশূদ্র প্রভৃতি অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। বলরাম ছিলেন মেধাবী ও বাক্পটু। তাঁর অনেক উক্তি, গান ও বচন-প্রবচনে বলাহাড়িদের ধর্মতত্ত্ব ও প্রতিবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। বর্তমানে বলাহাড়ির ক্ষীয়মাণ ধারাটি মেহেরপুর, নদীয়ার নিশ্চিন্তপুর, পুরুলিয়ার দৈকিয়ারি, বাঁকুড়ার শালুনিগ্রাম প্রভৃতি স্থানে টিকে আছে।

বাউল  বাংলার লোকসম্প্রদায়গুলির মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও বহুল আলোচিত একটি সম্প্রদায়। প্রাচীনকাল থেকেই বাউল শব্দের প্রচলন থাকলেও সম্প্রদায় হিসেবে বাউলরা কখন থেকে স্বীকৃত হয় তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। চৈতন্যদেবের পার্ষদ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র  সহজিয়া মতের যে নেড়ানেড়ি দল গঠন করেন, তার রূপান্তরিত ধারার সঙ্গে মুসলমান ফকির শ্রেণির মিলনে বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব বলে সাধারণ মত প্রচলিত আছে। বাউলশ্রেষ্ঠ লালনের পূর্বে বাউলদের অস্তিত্ব থাকলেও সম্প্রদায় হিসেবে তারা তখন আত্মপ্রকাশ করেনি। লালন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় আস্তানা স্থাপন ও সাধন-ভজন করে, গান রচনা করে ও গেয়ে এবং শিষ্যদের দীক্ষা দিয়ে বাউলদের প্রথম সংগঠিত করে তোলেন। তাঁর সময়ে শিষ্য ও ভক্ত মিলে প্রায় দুই লক্ষ বাউল ছিল বলে জানা যায়। সাধারণত কৃষক, তাঁতি ও যুগী শ্রেণির দরিদ্র, বঞ্চিত ও নিগৃহীত মানুষেরাই বাউল সম্প্রদায়ের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জমিদারের বিরোধিতা করেন এবং নিরাপত্তার কারণে লাঠিয়াল দল গঠন করেন। তিনি ধর্মীয় মতামত নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে একাধিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই শরিয়তপন্থী মুসলমানরা ফতোয়া দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করে।

বাউলদের প্রধানত দুটি ভাগ গৃহী ও গৃহত্যাগী। গৃহত্যাগী বাউলরা ভিক্ষান্ন খেয়ে  একতারা বাজিয়ে গান গায় আর মনের মানুষের সন্ধানে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। অজানা অচেনা অধরা পরমাত্মা হলো তাদের সেই মনের মানুষ। তাঁকে ‘অচিন পাখি’, ‘সোনার মানুষ’, ‘মনুরায়’ ইত্যাদি নামেও তারা অভিহিত করে।

বাউল ধর্মমতে গুরুবাদ ও দেহতত্ত্বের কথা আছে। গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়ে দেহবাদী আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মাকে পাওয়া যায় বলে বাউলরা বিশ্বাস করে। তারা গেরুয়া বসন পরে, চুল-দাড়ি কাটে না এবং ভিক্ষান্নে জীবিকা নির্বাহ করে। গান রচনা করা ও গান গাওয়া ধর্মসাধনার অঙ্গ বলেই তারা মনে করে। তারা জাত-পাতের বিচার করে না; গান গেয়ে মিলনের আহবান ও মানবপ্রেমের বাণী প্রচার করে। মানবদেহে ঈশ্বর বাস করেন, অতএব দেহকে জানলে ঈশ্বরকে জানা যায় এরূপ বিশ্বাস নিয়েই বাউলরা মানবদেহ ও মানবজীবনের মূল্যায়ন করে থাকে। গুরুকে সারবস্ত্ত জেনে প্রেমসাধনা ও যোগসাধনা উভয় পথেই তারা সত্য ও মুক্তির সন্ধান করে।

প্রধানত কুষ্টিয়া ও নদীয়া জেলা বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভবস্থল হলেও পার্শ্ববর্তী জেলা এবং অন্যান্য স্থানেও তা বিস্তার লাভ করে। পূর্বদিকে সিলেট-ত্রিপুরা থেকে পশ্চিমে বীরভূম-মানভূম পর্যন্ত বাউলরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে এবং এসব জায়গায় তাদের সাধনকেন্দ্র আখড়া আছে। আখড়াগুলি তাদের মিলন ও ধর্মীয় মতবিনিময়ের কেন্দ্র। রাজশাহীর প্রেমতলীর নিকট খেতুর নামক স্থানে এক সময় একটি বড় আখড়া ছিল। এখনও সেখানে বার্ষিক বাউল সমাবেশ ও উৎসব হয়। তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বাউল গান। লালন ফকির প্রায় দুহাজার গান রচনা করেন। ভাব, ভাষা ও সুরের দিক দিয়ে উচ্চ মানের এ গানগুলি বর্তমানে শিক্ষিত শিল্পীদের কণ্ঠেও গীত হচ্ছে এবং সেগুলি রেডিও-টেলিভিশন প্রচার করছে। লালন ছাড়াও গগন,  পাগলা কানাইপাঞ্জু শাহ, পাঁচু শাহ ও যাদুবিন্দুসহ শতাধিক বাউল কবির সহস্রাধিক বাউল গান আছে। ব্যতিক্রমধর্মী এ বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না।

মতুয়া  সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দির  হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ প্রচারের মাধ্যমে একে সাংগঠনিক রূপ দেন। এজন্য ভক্তদের নিকট তাঁরা উভয়ই যুগাবতার জ্ঞানে ভক্তিশ্রদ্ধা পেয়ে থাকেন। মত্ত বা মাতোয়ারা থেকে মতুয়া শব্দের উৎপত্তি। উচ্চকণ্ঠে হরিবোল ধ্বনি, ডঙ্কা ও ঝান্ডা সহযোগে উন্মত্ত নৃত্য, প্রেমাপ­ুত আবেগে ক্রন্দন করা, ঘর্মাক্ত কলেবরে ধূলিস্নান প্রভৃতি এ ধর্মের বৈশিষ্ট্য। ধর্মসাধনার এরূপ মত্ত অবস্থা থেকেই এ সম্প্রদায়ের নাম হয়েছে মতুয়া।

কর্তাভজারা যেমন ‘দশ নিয়ম’ পালন করে, মতুয়ারা তেমনি ‘দ্বাদশ আজ্ঞা’ পালন করে। সেগুলির মধ্যে সত্যবাদিতা, সাধুসঙ্গ, ত্যাগধর্ম, জীবে দয়া, হাতে কাজ, মুখে নাম ইত্যাদি প্রধান। এসব রীতিনীতির সঙ্গে মানবিকতা ও সমাজকল্যাণের আদর্শ যুক্ত হয়ে মতুয়াবাদ গড়ে উঠেছে। বাউল সম্প্রদায়ের মতো গান এদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের প্রশস্তি, ধর্মতত্ত্ব, মানবকল্যাণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতুয়া সঙ্গীত রচিত হয়। এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী উচ্চারণ আছে। ফরিদপুর ও খুলনা জেলার নমঃশূদ্ররাই মূলত এ মতবাদের অনুসারী।

মতুয়া সঙ্গীত ছাড়াও তারা জীবনী, ধর্মতত্ত্ব, উপদেশাবলি, নাটক প্রভৃতি গ্রন্থ এবং পত্রিকা প্রকাশ করেছে। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের একাধিক জীবনী রচিত হয়েছে, যেমন  তারকচন্দ্র সরকার রচিত শ্রীহরিলীলামৃত, মহানন্দ হালদার রচিত শ্রীশ্রীগুরুচাঁদচরিত, নিতাইচাঁদ মন্ডল রচিত গুরুচাঁদচরিতামৃত প্রভৃতি। মতুয়াদের তত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ হচ্ছে তারকচন্দ্র সরকারের শ্রীশ্রীমহাসংকীর্তন, পতিচাঁদের ষটচক্র ও সাধনতত্ত্ব এবং উপদেশমূলক গ্রন্থ হচ্ছে সুধন্য ঠাকুর সংগৃহীত সদ্বাক্যসংগ্রহ, হরিবর সংগৃহীত দ্বাদশ আজ্ঞা  প্রভৃতি।

সাহেবধনী  সম্প্রদায়ের উদ্ভব নদীয়া জেলার দোগাছিয়া-শালিগ্রামে। এর প্রকৃত প্রবর্তক কে তা জানা যায় না।  অক্ষয়কুমার দত্ত বলেন, উক্ত গ্রামের একজন উদাসীন সাধক এ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাঁর সান্নিধ্যে ও উপদেশে দোগাছিয়ার দুঃখীরাম, বাগাড়ের রঘুনাথ দাস এবং কতিপয় হিন্দু-মুসলমান মিলে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের গোড়াপত্তন করে।  দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, এ সম্প্রদায়ের উৎসমূলে আছেন একজন মুসলমান ফকির। এদের মধ্যে মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য এবং হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য উভয়ই আছে।

সাহেবধনীরা জাতিভেদ ও বর্ণভেদ মানে না এবং মূর্তিপূজাও করে না। গুরুর আসনকে সামনে রেখে প্রতি বৃহস্পতিবার তারা একত্রে বসে উপাসনা করে। তারা তাদের উপাস্যকে ‘দীনদয়াল’, ‘দীনবন্ধু’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। তাদের কামবীজ, কামগায়ত্রী জাতীয় কিছু গুহ্য মন্ত্র আছে। বর্তমানে জলঙ্গী নদীর পারে বৃত্তিহুদা গ্রামে বৈশাখী পূর্ণিমায় সাহেবধনীদের বার্ষিক মহোৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দুঃখীরামের পুত্র চরণপাল (১৭৪০-?) এখানে বাস্ত্তগ্রাম ও গুরুপট গড়ে তুলে তাঁর অনুসারীদের সংগঠিত করেন। ক্রমে এটিই তাদের প্রধান ধর্মকেন্দ্রে পরিণত হয়। কুবীর গোঁসাই সাহেবধনী ধর্মমত অবলম্বন করে অনেক গান রচনা করেন। বর্তমানে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় সাহেবধনীদের সংখ্যা  হ্রাস পেলেও একেবারে বিলু্প্ত হয়ে যায়নি।  [ওয়াকিল আহমদ]

গ্রন্থপঞ্জি  অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, কলকাতা, ১৮৭০; ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী, বাংলার বাউল, কলকাতা, ১৯৫৪; শেখ গাউস, খুলনার লোকসাহিত্যে ইতিহাসের উপাদান, খুলনা, ১৯৮১; সুধীর চক্রবর্তী, সাহেবধনী ও তাদের গান, কলকাতা।